হলদে প্রজাপতি পর্ব-৪২+৪৩

0
200

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

বিয়াল্লিশ

ভুল হয়ে গেল একটা । ছোট-বড়-মাঝারি কেমন ভুল তা বলতে পারব না । আসলে সমস্ত কিছুই বিচারের ভার সময়ের ওপর ছেড়ে দিতে হয় । আপেক্ষিকতাবাদের উপর নির্মিত আমাদের জীবনের সবকিছুর শেষ বিচার্য নায়ক হয়ে দাঁড়ায় সময় । তবুও বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এটুকু বলাই যায়, ভুল একটা হয়েছে। ইন্দ্রাশিষ বাবুর কোন বক্তব্যই না শুনে প্রথমেই অতগুলো কথা তাঁকে বলা মোটেও উচিত হয়নি । মানুষের কাল্পনিক চরিত্রের উপর, বা কাল্পনিক ভুলের উপর কিছু কিছু সময় আমরা আক্রমণ করে ফেলি । আমার ভুলটা তেমনই এক কল্পনাপ্রসূত আক্রমণের ভুল । কিন্তু ভুল যা হওয়ার হয়ে গেছে । এখন ভাবতে হবে, এই ভুল শোধরানোর কোন উপায় কি রয়েছে ? অভিমান করার জন্য সম্পর্কের একটা নির্দিষ্ট গভীরতায় যাওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে । সেই গভীরতায় কি আমরা পৌঁছেছিলাম , যে তিনি আমার ওপর অভিমান করেই চলে গেলেন ? নাকি, তিনি মুখের ওপর বলতে পারছিলেন না , কিন্তু এই ভবিষ্যৎ পরিণতি তাঁর ঠিক পছন্দের ছিল না ? তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন , এই সূত্র ধরে প্রত্যাখ্যানের পথ মসৃণ হল বলে ? আমার কি ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া উচিত? ভুল যখন করেছি, তখন উচিত বৈকি। তবে কিনা ক্ষমা চাওয়ার সাথে সাথেই প্রত্যাশার নতুন এক সীমারেখা তৈরি হয়ে যায় । তিনি যদি সত্যিই অসমর্থ হয়ে থাকেন সে প্রত্যাশা পূরণে, তাহলে কি প্রত্যাশার ভার মানুষটার মাথার ওপর চাপিয়ে দিয়ে শুধুমাত্র তাঁকে বিব্রত করা হবে ? আর, আমার ? আমারই বা কি রইল পড়ে ? আমি চেয়েছিলাম , সত্যিই যে চেয়েছিলাম ! আবারো ভিক্ষাভান্ড নিয়ে বেরিয়ে শূন্য হাতে ফেরা বই তো নয় । তাহলে কি করা উচিত ?

সন্ধ্যা হতে গুটি গুটি পায়ে বাবার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলাম । বাবা আর মা এই ঘরেই শোয়। তবে সন্ধ্যাবেলার দিকটা এখন আমরা বাপ-বেটিতে ছাদে বসে গল্প করেই কাটাই । দুটো বেতের চেয়ার থাকে সঙ্গী । আর দূর কোনখান থেকে ভেসে আসা হালকা ছাতিম ফুলের গন্ধ ! এই ছাতিম ফুলের গন্ধে বড় হরিদ্বারের গঙ্গার ঘাটের কথা মনে পড়ে যায় । শরৎকালে পুজোর আগে সময়টায় বছর চারেক আগে গেছিলাম হরিদ্দার । গঙ্গার ঘাট বরাবর থোকা থোকা ছাতিম ফুল ফুটে রয়েছে । সেকি মন মাতানো গন্ধ ! রাতের দিকে যখন পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের ভিড় থিতু হয়ে আসে , তখন এই ছাতিম ফুলের গন্ধ মেখে মাতাল হাওয়ায় গঙ্গার ঘাটে ঘুরে বেড়ানো – সে এক অনন্য অনুভূতি !
তবে আজকে বাবা ছাদে ওঠেনি । আমি একাই ছিলাম । দুটো পাক দিয়েও এলাম । বুঝলাম , বাবা আজকে ছাদে উঠবে না । তারপরে গুটিগুটি পায়ে নেমে এলাম বাবার ঘরে । দেখি ঘরটা অন্ধকার । বাবা চুপচাপ শুয়ে রয়েছে খাটের ওপর । এই সন্ধ্যার সময় ঘরে কোন লাইট জ্বলছে না । একেবারে অন্ধকার ঘরে বসে থাকা ,বা শুয়ে থাকার তো কোনো প্রশ্নই নেই । বাবার মতে ভোরবেলা আর সন্ধ্যাবেলার সময়টা দিনের মধ্যে সবচেয়ে মহার্ঘ । এই দুটোর সময় শুয়ে কাটিয়ে দিলে দিনের বাকি সময়ের সব সক্রিয়তাই মাটি হয়ে যায়। আমি আমার জ্ঞানতঃ, শরীর অসুস্থ ছাড়া বাবাকে কখনো এই দুই সময় শুয়ে থাকতে দেখিওনি ।
আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে সুইচ বোর্ডের কাজ শেষে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম , বাবা ঘর অন্ধকার করে রেখেছো কেন ? লাইট জ্বালাবো?
বাবা কোন উত্তর দিল না । টিউব ছাড়া একটা ছোট লাইট ছিলো ঘরে । সেটা জ্বালালাম । দেখলাম, বাবা বিছানার উপর টানটান হয়ে শুয়ে রয়েছে । চোখের কাছে ভাঁজ করে রাখা বাঁ হাতটা। বাবার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
বললাম, শরীর ঠিক আছে তো বাবা ? শুয়ে রয়েছ যে এখন?
বাবা হাতটা সরালো চোখের ওপর থেকে। বলল, না, ঠিক আছে –
— তাহলে শুয়ে রয়েছ যে ?
— এমনি । বল্ , কিছু বলবি ?
বাবার গলার মধ্যে অদ্ভুত একটা নির্লিপ্ততা। এইটা আমায় ভাবায় সবচেয়ে বেশি। বাবা তবে ক্ষুব্ধ হয়েছে আমার ওপর যথেষ্ট ।
বিছানায় গিয়ে বসলাম । বললাম , ছাদে যাবে না ?
— না । বল্ , কিছু বলবি কি ?
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম । তারপর বললাম , তুমি জানতে চাও বাবা, আমার সঙ্গে ইন্দ্রাশিষ বাবুর ঠিক কি কথাবার্তা হয়েছে?
বাবা চুপ করে রইলো। কিছু বলল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দেখলাম বাবা কোন কথা বলছে না , তখন উসখুস করতে লাগলাম।
উঠে চলে যাব ঘর থেকে ভাবছি, এমন সময় বাবা হঠাৎ করে বলল, অনেকদিন তো আছি এখানে। পুজো আসছে । এবারে তোর মাকে নিয়ে ফিরে যেতে হবে। টিকিট কাটার ব্যবস্থা কর্ । দ্যাখ্ কোন ট্রেনে পাস্। যত তাড়াতাড়ি কাটতে পারিস , ততই ভাল। কাল হলে কালই।
চুপচাপ মাথা নিচু করে শুনলাম । বললাম না কিছু। বুঝলাম এখন এই ব্যাপারে বাবার সঙ্গে কথা বলে লাভ হবেনা। থেকে যেতে বললেও বাবা শুনবে না। ভেবেছিলাম পরে বুঝিয়ে বলব । নিশ্চয়ই বুঝবে । তবে বাবা আমাকে আর সময় দিলোনা বোঝানোর। দুদিন পরেই ফিরে গেল কলকাতা ।

আজকে অক্টোবর মাসের তিন তারিখ । সামনের সপ্তাহেই মহালায়া । পুজোর মুখে মুখে সবমিলিয়েই মনটা ভারি ভারাক্রান্ত। একা একা কাটছে দিন । আবার সেই আগের মত । সঙ্গী শুধু টগর । মাঝে মাঝে ফোনে ইন্দ্রাশিষ বাবুর নামটা বার করে ডায়াল করতে গিয়েও করতে পারিনা । একটা টাচের ব্যাপার। ফোন কল হয়ে যাবে । কিন্তু, সেইটা আর করা হয়ে ওঠে না। পাতাও আসেনি কতদিন । তাও প্রায় সপ্তাহ দুয়েক হয়ে গেল । মেয়েটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছিল। মায়া জড়ানো অভ্যাস । এই অভ্যাস থেকে বেরোতে এখন অনেক বেগ পেতে হবে । বেরোনো কি প্রয়োজন ? সত্যিই প্রয়োজন ? একটা ফোন কল করে ওনাকে ডাকলে, বা যদি আমি একবার গাড়ি ড্রাইভ করে চলেই যাই পাতাদের বাড়ি ? পাতাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে আসি? ওতো আমার কাছেই থাকত দুপুরবেলাটা । পাতার ওপর রাগ হচ্ছে । অভিমান হচ্ছে । ওর সাথে সম্পর্কটা নিশ্চয়ই আমার সেই গভীরতায় পৌঁছেছিল ! ওর ওপর অভিমান আমি অবশ্যই করতে পারি । কিন্তু মানুষ সময়ে সময়ে কি বোকাই না হয়ে যায়। পাতার ওপর রাগ কিসের ? কিসের অভিমান ? ওর কি আর সত্যিই ইচ্ছে করেনি আমার কাছে আসতে ? ওকে আসতে দেওয়া হয়নি তাই আসেনি। সত্যিই তো, বাবা য’বে থেকে প্রপোজালটা এনেছে , তবে থেকেই ইন্দ্রাশিষ বাবু নিজের মেয়েকে আর আমার কাছে পাঠান নি। এর থেকেও তো আমার বোঝা উচিত ছিল । ইস্ , মেয়ে যেন ওঁর সম্পত্তি ! অধিকারবোধ শুধু শাসনের বেলায় ফলালে হয় ? ভালবাসার সময়ও তো ফলাতে হয় । মেয়েটার কি ছিরি করে রেখেছিল । ক্ষেপীর মত ঘুরে বেড়াতো বনেবাদাড়ে । কোথাও কোনো যত্নের ছোঁয়া নেই । যাক গে যাক । লোকের মেয়ে , তারা যা ভালো বোঝো করুক –

অফিসে অলসভাবে বসেছিলাম । যদিও কাজের চাপ যথেষ্ট ছিল । উদাস ভাবে মাঝে মাঝে টেবিলের পাশে জমা ফাইলগুলোর দিকে চোখ বুলোচ্ছিলাম। মনিটরটা অন করাই ছিল । পুজোর আগে একটা প্রেজেন্টেশন আছে । তারই পিপিটি পেজগুলো রেডি করার ছিল । কিছুটা হয়েছে । কিছুটা বাকি। মাঝে মাঝে স্ক্রল ডাউন করছিলাম । তবে করছিলাম না কিছু ।
মৃন্ময় এসে নক করলো আমায় । বলল , ম্যাম, আজকে টি ফ্যাক্টরি থেকে যে প্যাকেজড্ টি-গুলো এসেছে , তার মধ্যে একটু গরমিল দেখতে পাচ্ছি আমি । প্রিমিয়াম সিটিসি-টা চল্লিশ প্যাকেট আসার কথা ছিল , পঁয়ত্রিশটা এসেছে দেখছি । আর লুজ ডাস্টটাও ওজনে কম রয়েছে । আমি তো কালকে মোটামুটি একটা এস্টিমেশন নিয়েই এসেছিলাম ওখান থেকে আসার সময় । কিন্তু আজকে যখন ফাইনালি গুদামে এসে পৌঁছলো, দেখছি কিছু কিছু গন্ডগোল রয়েছে।
বিরক্ত মাখা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম , নিজেই কালকে হিসেব করে এসেছ বলছ । আজকে আবার নিজেই বলছো গন্ডগোল রয়েছে। কোথায় কি গন্ডগোল , নিজেই খুঁজে বার করো । আমাকে কি বলতে এসেছো ? আমার কি করার আছে এখানে ?
— না মানে ম্যাম –
— এখন যাও মৃন্ময়। নিজে দেখে এসো-
ঘন্টাখানেক পরে বেরিয়ে পড়লাম অফিস থেকে । সারাদিনে প্রায় কিছুই কাজ করি নি । এখন সবে তিনটে বাজে । আরো ঘন্টাখানেক থাকতেই পারতাম , কিন্তু থাকলাম না ।
জগন্নাথ দা’কে বললাম, আজকে অফিসের কাজ মোটামুটি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে । চলো একবার নদীর দিকে । কিছুক্ষণ সেখান থেকে ঘুরে আসি ।
জগন্নাথ দা একবার আমার মুখের দিকে তাকালো। কি বুঝলো কে জানে । বললো না কিছু । গাড়ি স্টার্ট করল । ঘন্টাখানেক চুপটি করে বসে রইলাম নদীর ধারে । অলস গতিতে ঝিরিঝিরি ধারায় বয়ে চলেছে । সরু হয়ে এসেছে যাত্রাপথ। বর্ষাকালে বালিভর্তি অঞ্চল সম্পূর্ণটাই নদীর অধিকারে চলে যায়। আবার তা কমতে কমতে তন্বী দেহে বয়ে চলা এক নদী । নদীর ধারে একটা পাথরের উপর বসে বসে ভাবছি । ভাবছি আমি । ফিরে যাওয়ার সময় দুটো রাস্তা ধরে যাওয়া যায় বাড়িতে । একটা রাস্তা একটু শর্টকাটে পাতাদের বাড়ির সামনে দিয়ে আর একটা রাস্তা অপেক্ষাকৃত চওড়া , তবে একটু ঘুর হয় । যাওয়ার সময় অবশ্য জগন্নাথ দা’কে বললাম , চওড়া রাস্তা দিয়ে যেতে। কি দরকার ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার? যদি আবার মেয়েটাকে দেখতে পাই? আমি তখন কি করব ? আর ওই বা কি করবে ? আমি তো জানিই না , আমার কি করা উচিত । মন খুলে আগে সে কথা জেনে নিই। তারপর না হয় দেখা যাবে ।
জগন্নাথ কিছুক্ষণ ধরেই উসখুস করছিল । কিছু একটা প্রশ্ন ঘটছে হয়তো ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।একসময় করেই ফেলল।
বলল , পাতা দিদি আর আসে না আপনার বাড়িতে ? শরীর টরির কি খারাপ হয়েছে ?
বললাম , না । তেমন কিছু নয় –
— তবে?
চট করে মাথায় আধা সত্য, আধা মিথ্যা, বাকি মনগড়া, একটা কথা গজিয়ে উঠলো।
বললাম , ওরা হয়ত এখান থেকে চলে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই বদলি হয়ে । তাই এখন বাড়ি থেকে বের হয় কম ।
— তাই নাকি ? ইস্ , মেয়েটা খুব ভালো থাকতো আপনার কাছে এসে, জানেন তো দিদি ?
জানলা দিয়ে ছুটে আসা হিমেল হাওয়ায় মুখটাকে একটু বাড়িয়ে দিয়ে চাপ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বললাম , হুম !
বাড়ি পৌঁছতে যখন আর মিনিট সাত কি আট বাকি, তখন রাস্তার ধারে একটা শিউলি গাছ পড়ে । গাছটার কাছে এসে পৌঁছতে জগন্নাথ দা’কে বললাম , গাড়িটা একটু দাঁড় করাও তো।
জগন্নাথ দা ব্রেক কষলো । গাড়ি থেকে নেমে গাছটাকে সুন্দরী প্রেমিকার মুগ্ধ প্রেমিকের মতো পর্যবেক্ষণ করলাম । এখনো শিউলি ফুলগুলোর পাপড়ি মেলার সময় হয়নি । রাত যত গভীর হয় , তত বাড়ে ওদের সক্রিয়তা । একেবারে ভোরের মুখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে । পুজোর আগে একদিন পাতার আমাদের ঘরে রাতে থাকার কথা ছিল । আর তারপর, একেবারে ভোরবেলা উঠে আমি, পাতা আর বাবা তিনজনে মিলে এই শিউলী গাছটায় শিউলি ফুল করতে আসতাম– এইরকম একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিল বাবা আর তার নাতনি দুজনে মিলে । ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কেন যে মানুষ করে ? এতটুকু কিছুও ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে, হারিয়ে যায় চোখের সামনে। ফুলগুলো মুখ লুকিয়ে রয়েছে বটে , তবে হালকা একটা গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে । কিছুক্ষণ গাছটার দিকে চেয়ে হেমন্তের শিশির ভেজা ঘাসের মত দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িতে উঠে বসলাম ।

বাড়ি ফেরার পর একসময় টগর জিজ্ঞাসা করল , দিদি রাইতে কি খাবা? মাছ মুরগা দুইই আছে কিনা ফিরিজে ? কোনখান রান্ধি ?
ওর দিকে তাকিয়ে ব্যাজার মুখে বললাম , সব ছোটখাট ব্যাপারে আমাকে এত প্রশ্ন করে জ্বালিয়ো না তো । নিজের যা ইচ্ছা হয় করো গে । এতদিন তো হলো সংসার সামলাচ্ছে । কোনো ডিসিশনই কি নিজে থেকে নিতে পারো না ?
টগর মাংসই রান্না করেছিল , বেশ কষিয়ে , রগরগে করে। খাওয়ার সময় পাতে মাংস দেখে ঠেলে সরিয়ে দিলাম বাটিটা।
বললাম , ইস্, এই রাত্রিবেলা একেবারে রগরগে করে মাংসের ঝোল রেঁধে রেখেছে । আমি খাব না।
টগর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গেল । তারপর আর কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে বাটিটা তুলে রাখলো ।

………………………………………………………………………….

আমি জানলার খোলা পাল্লার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছি উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে। আমার ঘরের জানলার ঠিক তিন হাত দূরে একটা শিউলি গাছ হয়েছে । সারা দিনরাত সাদা কমলায় ঝামড়ে থাকে । আমি উদাস চোখ মেলে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছি। টুপ টাপ করে ঝরে পড়ছে । ঝরে পড়ছে আলতো মন মাতানো গন্ধ । হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এসে নীল ডানায় ভর করে একটা নীলকন্ঠ পাখি বসল সাদা ফুলের নুয়ে পড়া গাছটায়। পিছলে যাচ্ছে ওর আকাশ নীল রংয়ের ডানা , যেন রং পিছলে পিছলে পড়ছে –
আমার দিকে কালো মুক্তোর দানার মত দুটো চোখ মেলে ঠোঁট নামিয়ে বার দুয়েক সে ডাকলো —
কাক্ কাক্ খাক্ খাক্ ..
আবার তাকাচ্ছে আমার দিকে। যেন ডাকছে আমায় । আস্তে আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে আমি গেলাম শিউলি গাছের কাছে । পাখিটা বসে আছে । বসেই আছে। উড়ে চলে যাওয়ার কোনো চেষ্টাই করছে না । নীলকন্ঠ পাখি কোনদিন দেখিনি আমি । কোনদিন না । আজকে হঠাৎ করে জানলার একবারে পাশের শিউলি গাছে এত সুন্দর পাখিটা কোত্থেকে এসে বসল কে জানে ? সামনে পুজো , প্রায় চলেই এসেছে। শুনেছি মর্তে মায়ের বিসর্জন হওয়ার পর নীলকন্ঠ পাখিকে উড়িয়ে দেওয়া হয় । সে নাকি নীলকন্ঠ মহাদেবের কাছে মায়ের আগমন বার্তা নিয়ে যায় কৈলাশে । তবে কি , মা আজকে সাধ করে নিজের মর্তে আগমন বার্তা জানান দিতে আমার একেবারে সামনে দূত পাঠিয়ে দিয়েছেন ? আমি হাত বাড়িয়ে নীল রঙে ভিজে যাওয়া ডানাটা স্পর্শ করলাম । পাখিটা ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছে আমায় । উড়ে যাচ্ছে না । হঠাৎ করে কোথা থেকে একটা হলুদ রঙের প্রজাপতি উড়ে এলো । এইবার উড়ে গেল পাখিটা । না , তবে উড়ে চলে গেল না । কিছুটা নীল রং চারপাশে ছিটকে দিয়ে এক ঝাপটায় ঠোঁটে করে ধরে ফেললো প্রজাপতিটাকে । তবে খেয়ে নিল না । হলুদ নিথর মৃতদেহটাকে ঠোঁট নেড়ে ফেলে দিল মাটির ওপর । আরও একটা প্রজাপতি উড়ে এলো । পাখিটা আবার উড়ে গেল । আবারো একটা হলদেটে মৃতদেহ টুপ করে খসে পড়লো মাটির ওপর ।
আরও একটা..
আরও একটা..
এইবার ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে । পাখিটা প্রত্যেকটাকে নিমেষ ফেলতে না ফেলতেই ঠোঁটের মধ্যে চেপে ধরে ফেলছে । টুপ টুপ করে হলুদ মৃতদেহগুলো খসে পড়ছে মাটির বুকে। তার সাথে একগোছা করে শিউলি ফুল । সাদা, কমলা আর হলুদে ভরে উঠছে আমার শিউলি-গাছতলা । এমন কেন করছে পাখিটা ? আমি হাত বাড়িয়ে ওকে থামাতে গেলাম । হাত পাচ্ছিনা । কিছুতেই পাচ্ছিনা । তখনো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে হলুদ প্রজাপতিগুলো অমোঘ মৃত্যুর টানে। আমার পায়ের পাতা ভরে উঠেছে শিউলি ফুল আর প্রজাপতির মৃতদেহে। কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে দেখি শুধু গাছতলায় নয় , যতদূর আমার চোখ যায় , শুধু সাদা, কমলা আর হলুদে ভরে উঠেছে । যেন একটা বিস্তীর্ণ পথ তৈরি হয়েছে । সেই পথ মিশে গেছে কোন সুদূর দিগন্তে । আর সেই পথ ধরে অনেক দূরে ছায়ার মত একজন হেঁটে চলেছে । রাজ্যের কুয়াশা জমা হয়েছে সেখানে । তবুও বোঝা যায় । এত দূর থেকেও বোঝা যায় — সাদা রঙের পাজামা-পাঞ্জাবী, উন্নত মাথা, ঋজু মেরুদন্ড , নির্মেদ শরীর , অটল পদক্ষেপ .. বাবা !

উঠে বসলাম ঘুম থেকে । হ্যাঁ , একেবারে পূর্ণ চেতনায় উঠে বসে আছি। ফোনটা বাজছে না ? হাতড়ে বালিশের পাশ থেকে টেনে বার করলাম ফোনটাকে । মা ! মায়ের ফোন ! কটা বাজছে এখন ? ভোর ছটা ? এত ভোরে মা ফোন করছে ? কি ব্যাপার? কি হল? বুকের ভেতরটা কেমন যেন অজানা আশঙ্কায় ভরে উঠলো। ঠান্ডা আঙ্গুলের ডগা ঘষে ফোনটা রিসিভ করলাম ।
— হ্যালো ! মা , কি হয়েছে ?
ওপাশ থেকে মায়ের গলাটা বিভ্রান্ত শোনালো ।
— তুই আজকেই একবার আসতে পারবি ?
— কেন মা? হয়েছেটা কি?
— তোর বাবার .. বাবার খুব শরীর খারাপ। রাত্রিবেলাতেই কেমন যেন করছিল । তখন প্রায় রাত তিনটে হবে । ওই পাশের ফ্লাটের প্রশান্ত, শ্যামল, ওদের সব ডাকলাম । খুব ঘামছিল জানিস ? আর হাত পা’গুলোও কেমন যেন ঠান্ডা । ওরা সবাই মিলে এসে তোর বাবাকে নার্সিংহোমে এডমিট করেছে ।
— কি হয়েছে বাবার ?
আমার অলরেডি গলা কাঁপছে । হাত-পায়ে কোন জোর নেই ।
— ডাক্তার তো বলছে হার্ট অ্যাটাক।
আমি তখন আছড়ে পড়া ঢেউয়ে নিমজ্জিত হয়ে আপ্রাণ বালি আঁকড়ে ধরছি ।
প্রশ্ন করলাম , বাবা এখন আছে কেমন আছে?
— আছে । ভর্তি আছে আই সি ইউ তে । তুই আয় ।

আছে !
বাবা আছে !
কাঁপা কাঁপা হাতে মৃন্ময়ের নাম্বারটা ডায়াল করলাম ।
বললাম , এত ভোরে তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম, প্লিজ কিছু মনে করো না। আমাকে এক্ষুনি একটা ফ্লাইট এর টিকিট কেটে দিতে পারবে? বাগডোগরা টু কলকাতা । একচুয়ালি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় দেখো ভাই । আমার কিছু কাজ আছে। তৈরি হয়ে নিতে হবে । তাই তোমায় রিকুয়েস্ট করছি । একটু যদি ফ্লাইট এর টিকিটটা বুক করে দিতে –
— কোন সমস্যা হয়েছে ম্যাম ? মানে এত আর্জেন্ট বেসিসে টিকিট বুক করতে গেলে ফেয়ার কিন্তু অনেকটাই পড়ে যাবে ।
— ফেয়ার যাই পড়ুক । তুমি বুক করো । কুইক ।

মনে মনে বললাম , বাবা আছে । আছে বাবা ।

ক্রমশ..
#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

তেতাল্লিশ

বাবাকে যখন দেখলাম তখন বাবা আচ্ছন্ন । ঘোরের মধ্যে রয়েছে । একেবারে কাছাকাছি নার্সিংহোমে স্টাফরা যেতে দিচ্ছে না পেশেন্টের রিলেটিভদের । আমি একবার করে বাবার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম , একবার করে বেডের পাশে রাখা মনিটরটার দিকে , অবুঝ ভাবে । মনিটরে যে লেখা , সংখ্যা আর গ্রাফগুলো ফুটে উঠছিল , সেগুলো সবই যেন কোন এক অবোধ্য ভাষায় লেখা । দেখেও দেখছিনা , পড়লেও মাথা কিছু নিচ্ছে না। বাবার চোখ কখনো বন্ধ, কখনো আবার একটু খুলছে। মুখ নাক যান্ত্রিক মেঘে অস্পষ্ট। সরু, মোটা , নল এদিক ওদিক করে চলে গেছে । কোন কিছুরই যেন কোন অর্থ বুঝতে পারছিনা আমি । দৃশ্যটা একটা অবোধ্য ছবির মত লাগছে । এমন কেন হচ্ছে ? ঠিক এই রকম অনুভূতি তো জীবনে কখনো হয়নি । বাবারই তো বছর পাঁচেক আগে বাইপাস সার্জারি হয়েছিল । তখনও আইসিইউতে দেখেছি । কই এমন লাগেনি’ । আজ ভেতরটা কোন অজানা ঝড়ের আশঙ্কায় যেন থমকে গেছে । এই আপাত সচল দুনিয়াটার কোন অর্থই আর মাথায় ঢুকছেনা । কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছি ওইভাবে ঠায় চোখ মেলে । পায়ের তলা দিয়ে বয়ে গেছে সময়ের স্রোত । তারপর এক সময় টলটল পা’য় ওয়ার্কিং আর এম ও’র কাছে গিয়ে বাবার কন্ডিশন জানতে চাইলাম ।
ডাক্তার বললেন , স্যার আসবেন রাউন্ডে ঘন্টাখানেক পর। তখন আপনি ডিটেইলস ওনার কাছেই জেনে নেবেন ম্যাডাম । ডাক্তার অজিতেশ মন্ডল ওনাকে মেইনলি অ্যাটেন্ড করছেন ।

ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেল । আমি আর মা বেরিয়ে এলাম । মা আমাকে আসতে দেখে প্রথমেই একবার রেস্টলেস হয়ে উঠেছিল । ভীষণরকম কান্নাকাটি করছিল। এখন স্টেবল হয়েছে। মাকে নিয়ে গিয়ে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসলাম । ঘন্টাখানেক ওয়েট করে ডাক্তার অজিতেশ মন্ডলের সাথে কথা বলে এখান থেকে চলে যেতে হবে । কারণ , এখন আর হসপিটালে থেকে লাভ নেই । বাবার সাথে তো আর দেখা হবে না এখন । আবার বিকেলে ভিজিটিং আওয়ারে আসতে হবে। ছোট মাসি আর মেসোমশাই এসেছে । ওরাই মায়ের সাথে ছিল । মেসোমশাই গিয়ে আমাদের জন্য গরম গরম কফি এনে দিল। আমি আর মা দুজনেই কফির কাপ হাতে নিয়ে বসে বসে ঠান্ডা করছি দেখে ছোট মাসি প্রায় জোর করে আমাদের মুখের সামনে তুলে ধরল। খেলাম । তবে মনে হল যেন চিরতার জল নামছে গলা বেয়ে । এখান দিয়ে এই করিডোর পেরিয়ে বাবাকে য’বে আবার সুস্থ করে নিয়ে যেতে পারবো, তার আগে পর্যন্ত গোটা দুনিয়াটা বিষ লাগছে। লাগবে আমি জানি ।

কিছুক্ষন পর ডক্টর অজিতেশ মন্ডল এলেন । রাউন্ডে গেলেন । সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর, আমি আর মেসোমশাই দুজনে মিলে গেলাম ওনার সাথে কথা বলতে। গুরুগম্ভীর , লম্বা , সাহেবের মত চেহারা । রাউন্ড সেরে ফাস্ট বেরিয়ে যাচ্ছিলেন । বাবার নাম করে কন্ডিশন জানতে চাইতে, হাতের ফাইল ওপেন করে দু তিনটে পেজে ফাস্ট চোখ বুলিয়ে নিলেন। বেশি কথা বললেন না। যেটুকু যা বললেন, বাবার মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন মারাত্মক কিছু সিভিআর নয় । কিছুদিন ইনটেন্স মেডিকেল অবজারভেশনে থেকে সুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা । বাকি ঈশ্বরের ইচ্ছা ।
ঈশ্বরের ইচ্ছা !
ঈশ্বরকে চোখে দেখা যায় না । অনুভব করা যায় না পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে । তাই তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা বোঝার কোন উপায় নেই। তবু মা দিনের অর্ধেক সময় ঠাকুর ঘরে পড়ে রইল। আমি মনে-মনে স্মরণ করতে লাগলাম আমার কেষ্টঠাকুরকে ।
বললাম , ঠাকুর তুমি শুধু বাবাকে সুস্থ করে পাঠিয়ে দাও । যে লাউঞ্জটা দিয়ে বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আই সি ইউ এর উদ্দেশ্যে, সেই লাউঞ্জ আর করিডোর পেরিয়ে বাবাকে যেন সুস্থ করে নিয়ে আসতে পারি।

এই করে কয়েকটা দিন কাটল। দিন-রাত, ঘুম-জাগরন, সব মিলেমিশে একাকার । শুধু ভিজিটিং আওয়ারস এর টাইমটা মাথায় থাকে। পৃথিবীর বাকি সবটা যেন ঝাপসা । এইভাবে কয়েকটা দিন কাটার পর বাবাকে জেনারেল বেডে দিল। বাবা টুকটাক করে কথা বলতে আরম্ভ করল আমাদের সঙ্গে।

পুজো আসছে সামনে । দেবীপক্ষ শুরু হয়েছে। আজ মহালয়া। দেবীপক্ষের সূচনায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় চণ্ডীপাঠ আর আজন্মলালিত এক সমুদ্র আবেগ নিয়ে আকাশবাণীর নিবেদন শুনতে শুনতে চোখের জলে বালিশ ভিজে এল।
মা’কে বারবার বললাম, মা আর কেন ? ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ । আমাদের ঘরেও সেই আলোর বেণু বেজে উঠুক । এবার বাবাকে তুমি সুস্থ করে ঘরে ফিরিয়ে দাও । বাবার গলা জড়িয়ে ধরে পূজোটা কাটাই। মন কষাকষির জন্য কিছুটা রাগ করেই বাবা ওখান থেকে চলে এসেছিল । আমাকে পুজোর পোশাক দেয়নি এখনো । পুজোয় বাবার দেওয়া জামা-শাড়ি, যাইহোক, পরে এক আকাশ প্রাপ্তি নিয়ে তোমার ত্রিনয়নের দিকে চোখ মেলে তাকাবো । মাগো ! বাবাকে তুমি ঘরে ফিরিয়ে দাও –

মা আমার কথা শুনলেন। কখনো কখনো মা’কে রক্তমাংসের মানবী বলে বোধহয়। মনে হয় যেন, হাত বাড়ালেই মায়ের মন ছোঁয়া যায় । এই কেমন নিজের মনের সবটুকু চাওয়া দিয়ে মায়ের মনকে ছুঁয়ে দিলাম ! সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের করিডরটা দিয়ে গর্বিত পদক্ষেপে আমার সুপার হিরো বাবাকে নিয়ে চলে এলাম বাড়ি ।
আজ তৃতীয়া । দুদিন পরেই ষষ্ঠী । মায়ের বোধন । বাবা ঘরে ফিরে এসে একটু ধাতস্থ হয়ে নিয়ে পরের দিন অল্প কাঁপা কাঁপা হাতে আমাকে চারটে হাজার টাকা বার করে দিল ।
বলল, পুজোর আগে তো তোদের উপর দিয়ে বেশ ঝামেলা বয়ে গেল । অনেক দেরি হয়ে গেল মা । তোর আর তোর মায়ের জন্য দুটো শাড়ি কিনে আনিস আজকে ।
দুচোখ ভরে জল এলো । বাবার হাতে করে তুলে দেওয়া পুজোর এই উপহারটুকু না পেলে পুজো কি কাটে ? সে যে থমকে যাবে । টাকাটা দুহাত ভরে নিয়ে চোখের জল হাতের পিঠে মুছে ফেলে প্রায় ছুট্টে বেরিয়ে গেলাম বাজারে। বাবার দেওয়া পুজোর উপহার কিনতে যাওয়ার সময় আমি আজও সেই তেরো চোদ্দো বছরের কিশোরী তরু । এই একটা ক্ষেত্রে বয়স আমার আজও থমকে রয়েছে। মায়ের জন্য একটা হাজার বুটির মেরুন পাড়ের অফ হোয়াইট শাড়ি আর নিজের জন্য কচি কলাপাতা রঙের একটা তাঁতের শাড়ি কিনলাম। এইতো গেল বাবার দেওয়া উপহার। আমি বুঝি বাবা-মাকে দেব না? মায়ের জন্য একটা সফট পিওর সিল্ক আর বাবার জন্য খাদির পাঞ্জাবি কিনলাম । দেশের বাড়ি থেকে আমাদের জন্য পুজোর পোশাক আসে , জ্যাঠাইমা পাঠায় । এবার বাবার অসুস্থতার কারণে ওদেরও পাঠাতে দেরি হলো । ছোট মাসিও প্রতি পুজোতেই পোশাক দিয়ে থাকে । পঞ্চমীর দিন এসে হাজির হলো । আমিও প্রতিবার নিজেকে নিজে কিছু না কিছু উপহার দিই। দামি কিছুই দিই । এবার আর দিইনি যদিও । তবে সবকিছু ছাপিয়ে বাবার হাতে তুলে দেওয়া টাকা কটা দিয়ে কেনা ড্রেসটা যেন অন্যমাত্রার । পোশাকের মূল্য কি প্রিন্টেড প্রাইস এ নির্ধারিত হয়? তার মূল্য নির্ধারক হল মনের আবেগ ।

অষ্টমীর দিন রাত ন’টা নাগাদ পাড়ার প্যান্ডেলে বাবার দেওয়া শাড়িটা পরে বাবার হাত ধরে টুকটুক করে গিয়ে বসলাম । কর্পোরেট পুজোর যুগে পাড়ার ঘরোয়া ব্যান্ডেলে মহাষ্টমীর রাতে এই সময়ে বিশেষ ভিড়ভাট্টা নেই । ঢাকের বাদ্যি এখন বন্ধ । ঢাক বেজে উঠবে আবার সন্ধি পুজোর সময় । বাবা প্যান্ডেলের চেয়ারে বসে তন্ময় হয়ে অনেকক্ষণ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ।
একসময় ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা যেন স্বগতোক্তির মতো বলল , কি জানি ! এই হয়তো শেষ বার ।
বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল । বাবার হাতটা চেপে ধরে বললাম , এসব কি কথা বলছো বাবা ! চুপ করো !
বাবা কেমন যেন স্নেহ মাখানো উদাস ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আমার মাথার ওপর ডান হাতটা রাখল । চোখ বন্ধ করে রইল প্রায় এক মিনিট ।
তারপর চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল , মায়ের কাছে বসে মনের সব কথা খুলে বল্ । কিছুক্ষণ পর সন্ধিপুজো আরম্ভ হবে । এ বড় মহার্ঘ্য সময় । মা’কে মনের সব কথা জানাতে হয় ।
আমি জানালাম । দু’হাত জোড় করে ব্যাকুল হয়ে মায়ের কাছে প্রার্থনা করলাম , মা এই যে বাবাকে পাশে নিয়ে বসে রয়েছি মহাষ্টমীর রাতে এখন , এইসব মুহূর্ত যেন আমার জীবনে বারে বারে ফিরে আসে। এইগুলো যেন অনন্ত হয় । এগুলো তুমি আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না , মা ।
মা অবলীলায় ত্রিশূল হাতে অসুর বধ করছেন । আমার দিকে চেয়ে রইলেন । মুখে স্মিত হাসি ।

পুজো শেষ হয়ে গেল । ঢাকের বাদ্যি শুনতে শুনতে মা ঝুপ করে জলে ডুব দিলেন। উঠবেন সেই কৈলাস পর্বতে গিয়ে। বাবার অসুস্থতাজনিত কারণে পুজোর আগে থেকে বেশ কিছুদিন এমার্জেন্সি ছুটি নিয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম । এবারে ফিরে যেতে হয়। প্রতিবার দেশের বাড়িতে যাই লক্ষী পুজো উপলক্ষে । এবার আর যাওয়া হবে না । বাবার শরীরে অত ধকল নেওয়ার মত জুত নেই , সত্যি কথা বলতে কি। খুবই চিন্তা হচ্ছে বাবা-মাকে এখানে একা ফেলে যেতে। এই হচ্ছে বাড়ি থেকে দূরে চাকরি করার অসুবিধা । বাবার যেকোনো সময় মেডিকেল ইমার্জেন্সি প্রয়োজন হতে পারে। এই অবস্থায় ওখানে আমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখারও কোনো উপায় নেই । এখন মনে হচ্ছে হুট করে অতদূরে চাকরির অফারটা একসেপ্ট না করলেই ভালো হতো । বিশেষ করে বাবা-মাকে দেখার জন্য যখন আর কেউ নেই । আপাতত কয়েক সপ্তাহ ছোট মাসি আর মেসোমশাই এসে থাকবে বলেছে । কিন্তু সেটা তো কখনই কোন পার্মানেন্ট সলিউশন হতে পারে না । আমায় কি তাহলে ওই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে আবার কলকাতার দিকে নতুন কোন চাকরি খুঁজতে হবে? দেখা যাক কি হয় । এই মুহূর্তে তো সেটা সম্ভব নয় । এখন আপাতত আমায় ফিরে যেতেই হবে । টিকিট কাটলাম । লক্ষ্মী পূজার পরের দিনই ফিরে যাব। এই বছর ফ্ল্যাট বাড়িতেই মা ছোট করে লক্ষ্মী পুজোর আয়োজন করে ঠাকুরকে পাঁচালী পড়ে শোনাবে ।

বাবা আমাকে লক্ষ্মী পুজোর আগের দিন সন্ধ্যাবেলায় নিজের ঘরে ডেকে পাঠাল । বাবা এই সন্ধ্যাবেলার সময়টায় নিজের ঘরে রাখা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ , স্বামী বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনখানা ছবির সামনে কাঠের র্্যাকের ওপর তিনটে মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকে । তবে আজকাল বাতি জ্বালালেও বসে থাকতে পারে না । হয়তো মিনিট পাঁচেক বসে রইল । তারপর শুয়ে পড়ে । এই সময়ে এই ঘরটা যেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান বলে মনে হয় আমার। বাঙালির তিন ঠাকুর, সাথে বাবা । চারজনের সান্নিধ্যে মনটা কানায় কানায় ভরে ওঠে ।

আমি গিয়ে বাবার মাথার পাশটাতে বসতে বাবা বলল , এসেছিস ?
— হ্যাঁ বাবা । বলো, কিছু বলবে বলে ডেকেছো ?
— হ্যাঁ ।
বলে বাবা দুটো হাতের আঙ্গুলগুলো পরস্পরের খাঁজে খাঁজে ঢুকিয়ে হাত দুটো বুকের উপর রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইলো ।
তারপর ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সেদিন ইন্দ্রাশিষের সঙ্গে তোর ঠিক কি কি কথা হয়েছিল বলতো মা আমায় ।
সত্যি কথা বলতে কি, বাবাকে নিয়ে এই মানসিক অশান্তি আর টানাপোড়েনের মধ্যে এ কটা দিন যেন সম্পূর্ণ এক অন্য জগতে পৌঁছে গেছিলাম । তবুও মনের মাঝে ইন্দ্রাশিষ বাবু আর পাতার কথাটা যে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পেরেছি যে তা নয় । তারা যে রয়েছে আজও , বেশ জাঁকিয়ে বসে রয়েছে মনের মাঝে, তা জানান দিয়ে যায় । বাবা হঠাৎ করে এই প্রসঙ্গ তুলবে বুঝতে পারিনি। প্রশ্ন শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম ।
তারপরে বললাম , আচ্ছা বেশ । বলছি শোনো –
যা যা কথা হয়েছিল সেদিন তাঁর সঙ্গে আমার, সবটাই বললাম বাবাকে । বাবা চুপচাপ শুনলো। তারপর আস্তে আস্তে উঠে বসলো । ঘরের নরম মোমবাতির আলোয় বাবার মুখটা কেমন যেন অপার্থিব লাগছে । আমার প্রতি স্নেহের ছবিখানা মুখের প্রতিটা খাঁজে যেন প্রকট হয়ে উঠেছে ।
বাবা ধীরে ধীরে বলল , শোন্ মা , ইন্দ্রাশিষ সোনার টুকরো ছেলে , তা আমি বুঝেছি। জীবনে একজন মানুষের সঙ্গে যদি কাটাতে হয় , তাহলে তার সেই গুণটা থাকলেই যথেষ্ট । সেই মানুষটার মনটা যেন খাঁটি হয় । একেবারে সোনার মত । ইন্দ্রাশিষ তাই । আমি বুঝেছিলাম বলেই আজকে তোর বিয়ের জন্য এতোখানি লেট হয়ে যাওয়া সত্বেও আমি ভীষণভাবে চেয়েছিলাম তুই এই বিয়েটা কর । সুখে না থাক, শান্তিতে থাক।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাবা বলল , আমি আর বেশিদিন নেই মা । তোর মা না হয় তোর সঙ্গে কিছুদিন থাকবে । কিন্তু সারাটা জীবন, জীবনের অনেকগুলো বছর সামনে পড়ে থাকবে । একজন মনের মানুষ না থাকলে, একজন বন্ধু না থাকলে, ওভাবে কি জীবন কাটানো যায়? আমার একটা ভুল হয়েছে। মারাত্মক বড় ভুল। হয়তো তোর মতামতের তোয়াক্কা না করেই বিয়েটা আগেই দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি তা পারি নি। সবাই কি সব কিছু পারে ? বাবা হিসেবে আমি সেটা পেরে উঠিনি । তোর অমতে গিয়ে তোর বিয়ে দেওয়া । পারলে এবার ফিরে গিয়ে ইন্দ্রাশিষের সঙ্গে সামনাসামনি বসে কথা বলিস । সেদিন হুট করে কি বলতে কি বলেছিস। ও’ই বা কি বলেছে, কি বুঝেছে ! গন্ডগোল হয়ে গেছে পুরো ব্যাপারটা । ঠান্ডা মাথায় দুজনে মিলে বসলে ঠিক সলিউশন বেরিয়ে আসবে। আমি জানি মা, তুই ইন্দ্রাশিষ আর পাতাকে নিয়ে ভালো থাকবি । আমি সেদিন থাকি আর না থাকি , আমার আশীর্বাদ থাকবে তোদের সঙ্গে । ভালো থাকতে তুই বাধ্য । ঠাকুর এইটুকু কথা আমার ঠিকই শুনবেন ।
আমি চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলাম।
বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার তরু মা লাল বেনারসি পরে, কপালে ছোট ছোট চন্দনের কলকা এঁকে সোনার গয়না গা’য় সেজেগুজে, রজনীগন্ধার বড় একটা মালা গলায় ঝুলিয়ে, সিংহাসনের ওপর রানীর মত বসে রয়েছে । তার রাজপুত্তুর আসছে তাকে নিয়ে যাবে বলে । রাজপুত্তুর রাজকন্যার বিয়ে হয়ে গেল । তারা হাত ধরাধরি করে গালভর্তি হেসে এগিয়ে গেল নতুন জীবনের পথে । আমি দুহাত ভরে অনেক আশীর্বাদ করলাম । এ স্বপ্ন কবে থেকে দেখেছি মা –
বাবার গলাটা কেঁপে গেল। বলল , তুই একটা সুন্দর জীবন সাথী পাবি । রাজপুত্র তো সেই হয় , যার একটা ভালো মন থাকে । অনেক টাকা পয়সা , সোনা দানা , গয়না গাটি , এসব নিয়ে কি হবে? শেষমেষ তো চাই দিনের শেষে একটু হাসি মুখ । একটু ভালোবাসা । তোর জন্য রাজপুত্র সিলেকশনে আমার ভুল হয়নি মা। তুমি নিশ্চিন্ত থাকিস । ফিরে গিয়ে ইন্দ্রাশিষের সঙ্গে কথা বল । তোরা দুজনে ভালো থাকবি। আমি বলছি ।

বাবার কথাগুলো শুনতে শুনতে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছিল । বুঝতে পারছিলাম, বাবা আমার বিয়ে দেওয়া নিয়ে আমার অমতে গিয়ে কখনো নিজের জোর না খাটালেও, কতখানি আবেগ , কতখানি স্বপ্ন, ওই একটা বুকের মধ্যে আজ এত বছর ধরে চেপে রেখেছে ! স্বপ্ন বুনেছে। আজও বুনে চলেছে। হয়তো এইবারে এসে কিছুটা অসহায় পড়েছে।
বললাম , দেখছি বাবা কিরকম কি পরিস্থিতি দাঁড়ায় । আগে ফিরে যাই । তোমাকে আর মাকে এখানে একা রেখে যেতে খুব চিন্তা হচ্ছে।

লক্ষ্মী পুজো হয়ে গেছে কালকে। আজকে আমার ফিরে যাওয়ার কথা । সকালবেলায়, তা বেশ ভোরের দিকেই হবে , মায়ের চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম ।
দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলাম , কি হয়েছে মা?
মা কেমন যেন উদভ্রান্তের মত তাকিয়ে বলল , তোর বাবা চোখ খুলছে না। সাড়া দিচ্ছে না।
— কি বলছ !
হুড়মুড় করে ছুটে গেলাম বাবার ঘরে ।
বাবা ঘুমোচ্ছে।
হ্যাঁ ঘুমাচ্ছে তো –
চোখ দুটো গভীর প্রশান্তিতে বন্ধ । হাত দুটো আঙুলের খাঁজে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ওইভাবেই বুকের ওপর রাখা । কি হয়েছে ? ঘুমোবে না? এত সকালে উঠবে কেন বাবা? শরীরটা খারাপ না?
— বাবা !
বাবার মাথার উপর হাত রেখে ডাকলাম , বাবা !
বাবা সাড়া দিল না। কপালটা ঠান্ডা । মনে হল যেন দেহে কোন উত্তাপ নেই ।
উত্তেজিত হয়ে ডাকলাম, বাবা , ওঠো !
বাবা চোখ মেলে চাইল না । পাগলের মত ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম , বাবা – , বাবা শুনছো ?
বাবা সাড়া দিল না ।
দিল না।
কিছুতেই দিল না।
অনেকক্ষণ পর ছুটোছুটি দৌড়োদৌড়ি করে ডাক্তারের কাছ থেকে যখন ডেথ ডিক্লেয়ার্ড কাগজটা হাতে পেলাম , তখন অবুঝ চোখে নির্মম লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম–
মা শুধু দেবীপক্ষটুকুর জন্যই বাবাকে ঘরে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। দেবীপক্ষ শেষ হল । মা’ আমার বাবা’কে সাথে করে নিয়ে কোথায় গেলেন কে জানে ! ওইখানে ওই কৈলাসের পারে ?

ক্রমশ..