হাতে রেখো হাত পর্ব-৭+৮

0
181

হাতে রেখো হাত (৭)

অনেক কিছু কিনেছে আবরাজ। হাজার হোক চাচার বাড়ি। তবু খালি হাতে যাওয়া যায় নাকি? চাচা চাচির জন্য শাড়ি আর পাঞ্জাবী। রুবির জন্য গলার মালা। আর রুস্মির জন্য বই। বই নেওয়ার কারণ আছে। সেদিন অতোগুলো বই নিয়ে গেল রুস্মি। এক সপ্তাহেই পড়া শেষ! ফেরত দিয়ে গেছে। ঘরে আসে নি। রাস্তা থেকেই ফেরত দিল। তারপর কেটে গেল চারটে দিন। আবরাজ সময় বের করে এতো শপিং করেছে। এ মাসের বেতনের মোটা অংশ ব্যয় করে। আবরাজের হাতে থাকা জিনিস পত্র এগিয়ে নিল দারোয়ান। ভীষণ আনইজি লাগছে। ভেতর থেকে ছুটে এলেন রেবেকা বেগম। ছেলেটার মাথায় হাত বুলালেন। তারপর ঝরঝরে কেঁদে উঠেন। বিস্মিত না হলেও বিব্রত হতে হয় ওকে। চাচিকে নীরবে সান্ত্বনা দেয়। ভদ্রমহিলা চোখের জল মুছেন। “রুবি,রুস্মি কোথায় তোরা? দেখ কে এসেছে।”

বিকেল বেলা বাগান বিলাশ করা রুস্মির স্বভাব। বাড়িটা বিশাল নয় তবে পরিপাটি আর গোছানে। এক পাশে অনেক ধরনের গাছ লাগিয়ে ছোট করে বাগান করা। আর তারপাশেই রাখা দোলনা। রুস্মির কানে হেডফোন। কিছুই শুনতে পেল না মেয়েটা। রুবি এলো। আবরাজের সাথে প্রথম দিনই ওর দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ছেলেটা খুব সহজ ভাষায় অপদস্ত করেছে ওকে। এই নিয়ে চাপা রাগ ছিল। সেটা যেন বেড়ে গেল হু হু করে। তবু সৌজন্যতায় হাসল। “কেমন আছো রুবি?”

“ভালো আছি। তুমি এমন সময় এলে, যখন বাবা বাড়ি নেই।”

“কোথায় গেছেন চাচা?”

” ব্যবসার কাজেই ব্যস্ত। তুই বাবা ভেতরে আয়। আমি ফোন করে দিব কাল ই চলে আসবে।” পাশ থেকে উত্তর করলেন ভদ্র মহিলা। রুস্মিকে না দেখতে পেয়ে বাগানে এলো রুবি। চট করে বসে পরে পাশে। দোলনাটা ইষৎ নড়তেই চোখ খুলে রুস্মি। রুবির শরীরে হাল্কা করে চাপর দিয়ে শুধায় “কি হলো তোর?”

“শ*য়তান ছেলেটা এসে গেছে।”

“কার কথা বলিস?”

“আবার কে, তোমার মা বাবার আদরের ভাতিজা আবরাজ।”

রুস্মি চমকালো। অন্য সময় হলে ধমকে দিত রুবিকে। আজ তেমন কিছুই করল না। চটপট উঠে গেল। রুবি সেদিকে তাকিয়ে কি যেন বিরবির করল।

নাস্তার আয়োজন দেখে চক্ষু বড় বড় হয়ে গেল। আবরাজ প্রায় হাত উচিয়ে বলল
“আমি এত খেতে পারব না।”

“কেন ডায়েট করা হয়?”

মিষ্টি হাসি দিয়ে বসল রুস্মি। পেছন পেছন এলো রুবিও। হাল্কা হেসে বলল
“আমার গানের ক্লাস শুরু হবে। আমি যাচ্ছি।”

রুবি চলে যেতেই আবরাজ বলল “ডায়েট না এটা লিমিটেশন। আমি এমন কোনো খাদক নই যে এতো খাবার খেয়ে ফেলব।”

“এতো খেতে হবে না। একটু একটু টেস্ট করে দেখো।”

আরও কিছু নাস্তা নিয়ে এলেন রেবেকা বেগম। আবরাজ এবার বাঁধা দিল।”চাচি আর কিছু না। আমি এগুলোর এক অংশ ও খেতে পারব না।”

“আর দিচ্ছি না। তুই কিন্তু আজ যেতে পারবি না।”

“আমাকে তো যেতে হবেই চাচি।”

“তোর চাচা রাগ করবেন।”

“চাচাকে আমি বলে দিব। তিনি রাগ করবেন না।”

“আচ্ছা মোবাইল ধর, বোঝা তোর চাচাকে।”

আনিসুল হক বললেন “ভালো আছিস বাবা?”

“জী। আপনি ভালো আছেন?”

“আল্লাহর রহমতে ভালো। তুই এসেছিস আমার যে কি ভালো লাগছে। এবার হয়তো মৃ*ত্যুর পর একটু শান্তি পাব।”

এ বিষয়ে মৌন রইল আবরাজ। ভদ্রলোক আরও কিছু বললেন। আবরাজ বারংবার বলল আজ চলে যাবে। কিন্তু আনিসুল সাহেব নারাজ। তিনি অনুরোধ করলেন আজ থেকে যেতে। কাল বিকেলেই চলে আসবেন। এক মন দ্বিধা নিয়ে সর্বশেষ থাকতে হলো ওকে।

রাতের খাবারের আয়োজন দেখে আবরাজ বিস্মিত না হয়ে পারল না। রুস্মি রান্না করেছে কিছু পদ। আর বাকি সব রেবেকা বেগম। সেসব পরিবেশন করে রুবি। সচরাচর রান্না ঘরে যাওয়া হয় না কারো। বাড়িতে কাজের লোক আছে। এলাহি জীবন না হলেও সুখের অভাব নেই। শখের বসে রান্না শিখেছে রুস্মি। সারাদিন গল্প উপন্যাসে ডুবে থাকা মেয়েটা তেমন চটপটে নয় এমন না। রুস্মি দারুণ স্বভাবের মেয়ে। কম কথা বলে তবে যখন কথা বলে তখন হৃদয়ে গেথে যায়।
আবরাজ খাচ্ছে না দেখে রুস্মি নিজে বেড়ে দিল। রেবেকা বেগম মাথার কাছে দাঁড়িয়ে। “আমার খারাপ লাগছে।”

“রান্না ভালো হয় নি?”

“আপনাদের কষ্ট দিলাম। আমার জন্য শুধু শুধু এতো সব।”

“তোর মা থাকলে আয়োজন করত না? কি করত তো?”
উত্তর দিলো না আবরাজ। রেবেকা বেগমের বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস সবাই শুনতে পায়। আঁচলের কোণে চোখ মুছে তিনি বলেন “তোর মা আমাকে খুব ভালোবাসতো। আমি বড় বউ হলেও তোর মা সংসারে আগে এসেছে। আমি তার কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। সেই ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারব না।”

“ঋণ শোধ করতে চান চাচি?”

“ছি ছি তেমন কিছু না। আমি শুধু তোর চাচার ভুল গুলোর জন্য লজ্জিত। অরি তখন খুব ছোট। আমার হাতে মানুষ হয় নি তবে একটা ভালোবাসা ছিল। যখন শুনতে পেলাম খবরটা বিশ্বাস কর আমার মনে হয়েছে আমি আমার পেটের একটা অংশ হারিয়েছি। আমার পেটের সন্তান না তো কি হয়েছে। আমিও তো তদের আরেক মা।”

ভদ্রমহিলা কথার মাঝে চোখের জলের ফোয়ারা নামিয়েছেন। আবরাজের খারাপই লাগে। রুস্মি রুবিকে বলে মা কে ঘরে নিয়ে যেতে। তারপর আবরাজের পাশে বসে। নিচু কণ্ঠে বলে “তোমার সাথে ছোট সময়ের কিছু স্মৃতি আমার মনে আছে। আমি তোমার কাঁধে উঠার বায়না করতাম। অথচ তুমি আমার থেকে খুব বেশি বড় নও। তিন কি সাড়ে তিন বছরের ফারাক আমাদের। তবু তুমি আমাকে কাঁধে নিতে। এসব আমার খুব মনে পড়ে। বাবার কাজের জন্য সত্যিই আমরা লজ্জিত।”

সীরাতের কলটা এলো পরদিন সকালে। আবরাজ তখন গভীর ঘুমে। রুস্মি চা দিতে এসেছিল। ফোনের স্ক্রিনে নামটা দেখতে পেল। ‘মন ভালো হওয়ার বন্ধু’। নামটা এতো ভালো লাগে রুস্মির। সে চেয়ে থাকে। যখন ধ্যান ভাঙে তখন কল কেটে গেছে। চা রাখতে রাখতে ফের কল আসে। আবরাজ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কাল রাতে অনেক খাওয়া হয়েছে। নিজে থেকে সব পদ টেস্ট করালো রুস্মি। ছেলেটার ঘুমের ভাব থেকে রুস্মির ইচ্ছে হলো না ডেকে দেওয়ার। তবে অন্যের কল ধরার মতো কাজটিও করল না সে। চা রেখে নিচে একটা চিরকুট রাখল। দশটার পর ঘুম ভাঙে আবরাজের। অনেক ঘুম লেগে আছে দু চোখের পাতাতে। ধীরে ধীরে আরমোরা ভাঙে। পাশে থাকা চায়ের কাপ। হাতে নিতেই বুঝতে পারল ঠান্ডা হয়ে গেছে। চা কাপ রাখার সময় চিরকুটটা দেখতে পেল। লেখা ‘সুন্দর সকালের শুভেচ্ছা।’ লেখাটা ভালো লাগে আবরাজের। চট করেই বুঝে যায় রুস্মির কাজ। মেয়েটার মাঝে কেমন একটা শক্তি দেখতে পায়। সর্বদা সব বিষয়ে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে যেন।

এগারোটায় সীরাতের মিস কল দেখতে পায় আবরাজ। চারটে কল এসেছে। এই কদিনে মেয়েটার কথা একদম ই ভুলে বসেছিল। তখনি কল করে। “হ্যাঁ সীরাত কেমন আছো তুমি?”

“ভালো নেই আবরাজ। প্রচন্ড টেনশনে।”

“টেনশন কেন?”

“গত দিন একটা আঘা*ত পেয়েছি পায়ে। ব্যথাটা অনেক বেশি। আমি দৌড়াতে পারছি না আগের মতো।”

মন খারাপ হয়ে গেল আবরাজের। সীরাত জানালো দুদিন পর একটা রেস আছে। সেই রেসে অংশগ্রহণ করবে মেয়েটি। আরও কিছু কথা হলো ওদের। তারপর ই রেখে দিল সীরাত। আবরাজ লক্ষ্য করেছে পুরোটা সময় সীরাতের কণ্ঠ ছিল ভার। কয়েক মাসে এইটুকু জেনেছে সীরাতের বন্ধু নেই। ছোট থেকে ওর সাথে কম মিশতো সবাই। এর কারণ অধিক মেধা। বিষয়টা ব্যথিত করেছিল ওকে। প্রতিটা মানুষ ই কোনো না কোনো ভাবে অবহেলিত। ভীষণভাবে অবহেলিত।

** আমি গ্রামে এসেছি। যেই ফোন নিয়ে এসেছি এটায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। চার্জ হয় না। তিন ঘন্টা চার্জ দিলে দেখা যায় চার্জের পরিমান চার কি পাঁচ। এমন অবস্থায় লিখাই যাচ্ছিল না। তবু এই টুকু লিখেছি। রিচেক করা হয় নি। পাঠকরা একটু ধৈর্য ধরবেন বলে আশা করছা।***

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ

#হাতে_রেখো_হাত (৮)

খুব সাহসী মেয়ে সীরাত। পায়ে এখনো ব্যথা। চোটটা ভালোই পেয়েছে। ডাক্তার বার বার বলেছেন রেস্ট করতে। অথচ সীরাত শুনে নি! এই ব্যথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে এসেছে রেসিং ফিল্ডে। চোট থাকাতে সীরাতকে বাদ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সীরাত জানায় সে পারবে। মেয়েটির জোরের কাছে হেরে যায় অথোরিটি। এর জন্য বন্ডে সাইন করতে হয়েছে। রেসিং এর জন্য কোনো প্রকার ক্ষতি হলে এর দায় নিবে না অথোরিটি। সীরাতের দ্বিমত ছিল না। সে পুরোপুরি প্রস্তুত। পায়ের গোড়ালির উপরটায় হাল্কা করে মালিশ করছিল। ওমন সময় এলো আবরাজ। সীরাতের জার্সি দেওয়া হয়েছে। নাম্বার ২৫১। আবরাজকে দেখে খুশি হলো। উঠে দাঁড়ানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই পাশ থেকে রুস্মি এসে সাহায্য করল। মেয়েটাকে চিনতে পারে নি সীরাত। তাই খানিকটা অবাকের সহিত বলল “ও কে?”

“আমার কাজিন।”

“আচ্ছা। তোমরা আসবে আগে জানালে না যে?”

“আগে জানালাম,অথচ য‍দি না আসতে পারতাম। তুমি এমন ব্যথা নিয়ে, রেসটা স্কিপ করলেও হতো।”

“ভয়কে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়াটা বড় বোকামি। আমি নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই। এই সামান্য ব্যথার সাথে মোকাবেলা না করতে পারলে সামনের আঘা*ত গুলো সহ্য করব কেমন করে?”

মেয়েটার কথায় শীতল হয়ে আসে বুক। আবরাজের চোখ দুটো দেখতে পায় এক সাহসী নারীকে। সীরাতের প্রতিটা পদক্ষেপ যেন এক একটা আগুনের হল্কা হয়ে জ্বলতে শুরু করেছে। রেস শুরু হয়। আবরাজের ঠোঁট দুটো বলে “এভাবেই লড়ে যাও সীরাত।”

সীরাতের পা চলছে তবে চোখ দুটোও ফোয়ারা নামিয়েছে। রুস্মির শরীরে উত্তেজনা। সীরাতকে ভীষণ ভালো লেগেছে ওর। মেয়েটার ব্যপারে আবরাজের থেকে শুনেছিল। তখনি আগ্রহ জাগে। এখানে এসে আরও বেশি আকর্ষণ পায়। সীরাত যেন অদম্য শক্তি নিয়ে জন্মেছে। রুস্মির শরীর কাপছে। বিষয়টা চোখে পরতেই আবরাজ বলে “তুমি কি অসুস্থ বোধ কর রুস্মি?”

“আমার ভয় হচ্ছে। আমি চাই না ও হেরে যাক।”

আবরাজ নিজেও চিন্তিত। সীরাত অনেক চেষ্টা করল। তবে পারল না প্রথম হতে। অবশেষে সেকেন্ড হয়ে ফিরল মেয়েটি। এতে সামান্য মন খারাপ হলেও কোথাও একটা স্বস্তি খুঁজে পেল। ক্লান্ত সীরাত ধপ করে বসে পরল। রুস্মি পানি এগিয়ে দিতেই সীরাত বলল “আরও ইফোর্ট দেওয়া উচিত ছিল আমার। মাত্র ২ সেকেন্ড এর জন্য প্রথম হতে পারলাম না। এটা খুব ই দুঃখের।”

“তুমি খুব ভালো করেছ সীরাত। আমি ভাবি নি সেকেন্ড হতে পারবে। তোমার ব্যথা না থাকলে নিশ্চয়ই প্রথম হতে।”

কথাটা বলতে বলতে সীরাতের চোখের পানি মুছিয়ে দিল রুস্মি। মেয়েটি হাসল। আবরাজ মৌন। সীরাত কে দেখলেই ভেতরটা কেমন যেন করে। মনে হয় মেয়েটা জ্বলন্ত কোনো শক্তি।

ডিনার অফার করেছে সীরাত। আবরাজ প্রথমে না করলেও রুস্মির আগ্রহ ছিল। সীরাতকে ওর ভীষণ পছন্দ। আবরাজ লক্ষ্য করেছে কম কথা বলা রুস্মি সীরাতের সংস্পর্শে এসে পরিবর্তন হয়ে এসেছে। প্রচুর কথা বলছে! অথচ বিগত দুদিনে মেয়েটির মুখ থেকে অপ্রয়োজনীয় কথা শোনা হয় নি। খাবার অর্ডার করা হলো। সীরাতের পাশে বসা রুস্মি। “তুমি খুব দারুণ সীরাত। প্লিজ মাইন্ড করবে না নাম ধরে বললাম বিধায়। আমি খুব বেশি বড় না হলে নাম ধরেই সম্মোধন করি।”

হাসে সীরাত। রুস্মি তখন থেকে বকবক করে যাচ্ছে। অথচ মেয়েটাকে দেখলে মনে হয় খুব ই চুপচাপ। এত সময়ে আবরাজের সাথে কথা হয় নি। ছেলেটা যেন মৌনতার প্রতীক। সীরাত শুধায় “তোমার কি হলো? একদম ই নেতিয়ে পরলে যে।”

“এমনিই ভালো লাগছে। তোমাদের গল্প শুনতে।”

“কিছু বলো তুমিও।”

“তোমরা বলো আমি শুনি।”

“সেকি তুমি কি কথা না বলার প্রতিযোগিতায় নামলে নাকি?” রুস্মির কথায় হেসে ফেলল সীরাত। তবু কথা বলল না আবরাজ। খাবার এসে গেছে। সার্ভ করে দিল। খাবার মুখে দিয়ে বলল সীরাত “গত মাসের নিউজটা আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। দেশের মানুষ যখন দেশের ধ্বংস চায় তখন সত্যিই কিছু করার থাকে না।”

“মনে হচ্ছে ফের যু*দ্ধের আভাস। ১৯৭১ সালের যু*দ্ধ কিংবা ১৭৫৭ সালের যু*দ্ধ।”

“১৭৫৭ সালের যু*দ্ধে হেরেছিল বাংলা। ১৯৭১ সালের যু*দ্ধে জিতেছিল বাংলা। এবার যদি যু*দ্ধ হয় তবে সেটা ফাইনাল ম্যাচের মতো। নেক্সট কোনো অপশন থাকবে না। হেরে গেলে সত্যিই হেরে গেলাম।”

রুস্মি খবর দেখে না। ভালো লাগে না। জানে না দেশের পরিস্থিতি। শুধু শুনেছিল অরিতার মৃ*ত্যু ঘটেছে বোমা আঘা*তে। এসবে ওর ভয়। ভীষণ ভয়। তাই ঘাটায় নি ফের। সে বোঝার চেষ্টা করে ও বুঝতে পারল না। তেমন আগ্রহও দেখাচ্ছে না। সীরাত খুব দ্রুত কথা শেষ করল। তারপর ই রুস্মির সাথে কথা এগোলো। অল্প সময়েই রুস্মির স্বভাব বুঝে ফেলে সীরাত। মেয়েটা সম্পর্কে একটা ধারণা আসে। পোকা ধরা গাছের সব থেকে সুন্দর আর শুদ্ধ ফুল।

.

আবরাজ বাড়ি ফিরতে চাইলেই বাধ সাজলেন আনিসুল সাহেব। ভদ্রলোক চাইলেন আবরাজ তাদের সাথে থাকুক। বাকি সময়টা অন্তত ভালো কাঁটুক। একা থাকলে কষ্ট হবে। বারংবার অরির কথা স্মরণ হবে। দুঃখে যাবে দিন। ছেলেটা প্রথমে চাইছিল না। তবে সকলের কথায় যুক্তি পেল। গত কয়েকদিন সত্যি ভালো গেছে ওর। অরি ওর জীবনের সবথেকে সুন্দর অধ্যায়। যেই মেয়েটা সার্বক্ষণিক স্মরণে থাকবে। তবে এটা সত্য একা থাকলে বুকে ভেতর মোচড় দেয়। কষ্টে চোখে জল আসে। আবরাজের মন চায় আসতে। তবে মস্তিষ্কে ভিন্ন কথ বলে। বাড়ি ফিরে টান হয়ে শুয়ে পরে আবরাজ। আজ ফেরার পথে অরির ক*বর জিয়ারত করে এসেছে। না চাইতেও চোখে বৃষ্টি নেমেছে। একটা শীতল স্রোত নেমেছে পিঠ বেয়ে। কেউ যেন বলছিল ভালো আছে অরি। অন্তত এই দুনিয়ার থেকে ভালো। সেই থেকে কেমন যেন লাগছে ওর। মনে হচ্ছে ভাই হিসেবে কতটা পেরেছিলাম আমি?
ছেলেটার বিষণ্নতা পার হলো। একটা সময় বিশ্বাসে এলো সৃষ্টিকর্তা চেয়েছেন অরি ভালো থাকুক। তিন বেলা আধপেটা হয়ে না থাকুক। শুরুতেই দুটো গোলাপ গাছ লাগিয়েছিল আবরাজ। সেগুলোতে ফুল ফুটেছে। লাল লাল ফুল যেন অরির হাসির মতো কব*রকে আলোয় পূর্ণ করেছে। ভালো লাগে দেখতে। ছোট সময় মনে হতো কব*রস্থান মানেই ভয়ের কিছু। অথচ এখন মনে হয় বড্ড আপন। সেখানে শুয়ে আছে প্রিয়জন। নিজের লোক। যারা ভালোবাসে আমাদের। খাঁটি ভেজালহীন ভালোবাসা। এর ই সাথে আরেকটা বিষয় অনুভব করেছে আবরাজ। আমাদের ভালোবাসা সময়ের সাথে সাথে কমতে থাকে। মনের দিক থেকে না হলেও স্বাক্ষাৎের দিক থেকে কমতে থাকে। সময় আর পরিবেশ আমাদের ব্যস্ত করে তুলে। আগে অরির সাথে নিয়মিত দেখা করত আবরাজ। অথচ গত কিছু সপ্তাহ দু একদিন পর পর দেখা হয়েছে। এসবে মেয়েটির অভিযোগ হলো কি না জানে না আবরাজ। জানার উপায় নেই। তবে ভেতরটা বলে রাগ করে নি অরি। সে জানে তার ভাই কেমন। ভাই তাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। তবে সময় এই ভালোবাসায় ঘুন ধরাতে চাচ্ছে। বুদ্ধিমতি অরি। সে ঘুন ধরতে দিবে না। বরং অপেক্ষা করে থাকবে ভাইয়ের জন্য। কেন এমন মনে হয় জানে না ছেলেটা। একটা হীম শীতল বাতাস এসে স্পর্শ করে ওকে। এখান থেকে অরির কব*রটা বেশী দূরে নয়। জানালা দিয়ে তাকালে প্রাচীর গুলো দেখা যায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিরে আসে আবরাজ। রান্না বসায়। ফেরার পথে মাছ এনেছে। সেই মাছের ঝোল রান্না করে। খাওয়ার সময় গলা দিয়ে নামছিলই না। পুরোটা সময় পরিবারের স্মৃতি ওকে চেপে ধরে। মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর কেউ সুচ ফুটাচ্ছে। সারারাত খারাপ লাগল। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আবরাজ বুঝল আপনজনের শূন্যতা। এসব ওকে পোড়াচ্ছে। জীবনে একা বেঁচে থাকা সত্যিই কঠিন। ভীষণ কঠিন।

পর পর তিন দিন নাইট ডিউটি করেছে আবরাজ। সমস্যা হচ্ছে দিনে ঘুম আসে না। রাতে তো প্রশ্নই উঠে না। এসবের প্যারায় ডুবে এক সন্ধ্যায় বের হয়ে এলো। বের হয়ে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে একটা চায়ের দোকান। সেখানে এক বৃদ্ধ চা বিক্রি করেন। পরিবার পরিজন আছে কি নেই জানা নেই। হয়ত আছে তবে সময়ের সাথে হারিয়ে গেছে। চায়ের দোকানটা নিম্ন আয়ের মানুষ গুলার আড্ডাস্থল। আবরাজের গায়ে ফর্মাল পোশাক। ছেলেটা বসতেই কিছু লোক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল। এর আগেও এমন হয়েছে। প্রথম দিকে আনইজি লাগলেও এখন স্বাভাবিক ই লাগে। বৃদ্ধ চা দিলেন। ছোট ১৪ ইঞ্চির টিভিটা চলছে। ক্রিকেট খেলা। গত দিনের ম্যাচের হাইলাইট। সেসব ই দেখছে তুমুল উৎসাহে। একটা উইকেট পরতেই পাশ থেকে একজন গালি দিয়ে বসল “হা*লার পুতেরা খেলবার ই পারে না।”

আরেকজন বলল “বা*ল খেলে।”

আরও কিছু অকথ্য ভাষা চলে এলো। এসব দেখে হতাশ হলো আবরাজ। কত রঙের মানুষ আমাদের দুনিয়ায়। চা শেষ করে উঠে যাচ্ছিল ওমন সময় ঘটনা টা ঘটনা। পর পর তিনটে ছয় এলো বাংলাদেশ টিমের। ওমনিই উল্লাসে মেতে উঠল লোকগুলো। আরও একবার বিস্মিত হয় আবরাজ। ফেরার পথে একটা শিক্ষা গ্রহণ করে। “তোমার ভালো গুণের পরিমান অনেক বেশি হলেও যদি সামান্য পরিমান খারাপ গুণ থাকে সেটাই তোমাকে হাসির পাত্র বানাবে!”

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ