হাতে রেখো হাত পর্ব-৯+১০

0
177

#হাতে_রেখো_হাত ( ৯ )

চোখে হঠাৎ কিছু পড়েছে। জ্বালা করছে বেশ। মনে হচ্ছে বিষা*ক্ত কোনো গ্যাসের প্রভাব। কাজ শেষে ফিরছিল আবরাজ। আজ একটু বেশিই রাত হলো। প্রায় দশটা বেজে গেছে। অথচ কাজ শেষে সাতটায় বাড়ি ফেরার কথা। এক বন্ধুর সাথে অনেক দিন পর দেখা। আড্ডা দিতে গিয়েই এই বিলম্ব। লেট হওয়ায় শর্টকাট নিয়েছিল। পথে ধোঁয়ার আবিষ্কার। একটু ভয় হয়। তবু এগিয়ে চলে। ধোঁয়া গুলো ক্রমশ জড়িয়ে নিচ্ছিল ওকে। আবরাজ অনুভব করে বিষয়টা ভালো দিকে যাচ্ছে না। যতক্ষণে ফিরে যাওয়ার কথা মাথায় আসে ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়। ছেলেটার গলা শুকিয়ে আসে। ধীরে ধীরে চোখ দুটো ভীষণ জ্বালা হয়। আর তারপর ই নিস্তেজ হয়ে আসে শরীর।

আবরাজের জ্ঞান ফিরে পরদিন ভোর পাঁচটায়। মাথার কাছে বসা একজন নার্স। হাল্কা ঝিমুনি এসে গেছে। ছেলেটা শুরুতেই বুঝতে পারে না। একটা দ্বিধা নিয়ে উঠতে বসে। হাতে লাগানো ক্যানেলায় টান পড়তেই আর্তনাদ জেগে উঠে। ধরমরিয়ে উঠেন নার্স। “কি হলো, কি হলো, আপনি উঠছেন কেন? শুয়ে থাকুন।”

উত্তর দেয় না আবরাজ। নার্স ব্যস্ত গলায় ডাকে “ওয়াড বয়, ওয়াড বয়। দ্রুত ডক্টর কে ইনফর্ম করো। পেসেন্টের সেন্স এসেছে।”

ওয়াড বয় চলে যায়। হসপিটালের ফিনাইলের গন্ধটা নাকের ফাঁকা দিয়ে ধীরে ধীরে গলায় এসে ঠেকছে। একটা তিক্ত স্বাদ অনুভব হয়। সাথে মাথায় প্রবল যন্ত্রণা। অজান্তেই চোখের কোণে জল নামে।ছেলেটার হাতের একটা অংশ থেকে ক্রমশ পুরো শরীর অবশ হতে শুরু করে। একটা সময় পুনুরায় জ্ঞান হারায়।

দুদিন পর ফের জ্ঞান আসে আবরাজের। এর মাঝে অনেকবার জ্ঞান এলেও প্রতিবার কয়েক সেকেন্ড পর পর ই জ্ঞান হারিয়েছে। ছেলেটা এখন কিছুটা সুস্থ। একটা ভালো ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে। নার্স ধরে বসালো। আবরাজ এবার মৌন রইল। শরীরে অতো জোর নেই। নার্স পিঠের কাছে বালিশ রেখে বলল “আপনি নিশ্চয়ই খুব ই ভালো মানুষ। কিংবা আপনার উপর কোনো পবিত্র আ*ত্মার দোয়া রয়েছে। নতুবা এত কম সময়ে কোনো বড় ক্ষতি ছাড়া বেঁচে যাওয়া সম্ভব নয়।”

নার্স কি বলেছে শুনেনি আবরাজ। ওর শরীর মন কোথাও একটা ডুবে আছে। এক একটা অংশ যেন ব্যথায় টনটন করছে। একটা সুক্ষ্ম স্রোত নেমে যাচ্ছে কান বেয়ে। ছেলেটা বার কয়েক শ্বাস নিল। চোখ বন্ধ করতেই একটা হাত স্পর্শ করল গাল। “কেমন আছো তুমি?”

সীরাতের কণ্ঠ! আবরাজ তখনি চোখ খুলতে পারল না। সময় নিয়ে চাইতেই দেখতে পেল সীরাতের মুখ। মেয়েটা কেমন যেন রুগ্ন। চোখের নিচে কালি। যেন ঘুমোয় নি কিছুদিন। আবরাজ কথা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু অনুভব করল মুখ দিয়ে একটা কথাও আসছে না। কথা না বলতে পেরে নিজেকে পাগল পাগল অনুভব হয়। হাত দিয়ে ইশারা করে। একটা যন্ত্রণার স্রোত নামে। ছেলেটা ব্যকুল হয়। সীরাত আগলে ধরে। পিঠে হাত বুলায়। “শর্টটাইম কথা বলার শক্তি হারিয়েছ তুমি। চিন্তা নেই ঠিক হয়ে যাবে। একটু শান্ত হও।”

সময়টা ঝড়ো হাওয়ার মতো। আবরাজ শান্ত হতে পারছে না। পর পর অস্থির হয়ে উঠে। তখুনি কেবিনে আসে ওর চাচার বাড়ির সব সদস্য। একটু আগেই খবর দেওয়া হয়েছে ওনাদের। আবরাজ কিছুতেই স্বস্তি পেল না। শরীরের সমস্ত ব্যথার থেকেও অধিক যন্ত্রণা কথা না বলতে পারা। সীরাত সবটা জানালো। আনিসুল সাহেব ব্যস্ত হলেন। তিনি চান সুস্থ হোক আবরাজ। যত দ্রুত সম্ভব সুস্থ হোক। বিলম্ব না করে ডাক্তারের নিকট গেলেন ওনারা। রুবি কিছুটা ভয় পেয়ে আছে। ওর চোখ দুটো কেমন নেতিয়ে এসেছে। রুস্মি এসে সীরাতের পাশে দাঁড়াল। চিন্তা গলে পরছে কণ্ঠে “কবে নাগাদ সুস্থ হবে কিছু বলেছেন ডাক্তার?”

“না। তবে দশ পনেরো দিন লাগতে পারে।”

দশ পনেরো দিন! সময়টা সত্যিই বিশাল নয়। তবে দুঃখের সময় দীর্ঘ হয়। রুস্মির কপাল জুড়ে ভাঁজ। আবরাজের আকুল হওয়া দৃষ্টির পানে তাকাতেই কেমন যেন করে উঠে বুক!

.

বাড়ি নিয়ে আসা হয় আবরাজকে। ডাক্তার বলেছেন রেস্ট প্রয়োজন। সাথে দরকার ফুরফুরে হাওয়া। প্রকৃতির আলোতে থাকলেই সুস্থ হয়ে যাবে। এ ছাড়াও কিছু ঔষধ দেওয়া হয়েছে। সেসব ওর শরীরে থাকা বিষাক্ত পদার্থের প্রভাব বিস্তার করতে দিবে না। যত্ন নিতে হবে। সারাক্ষণ কাউকে না কাউকে পাশে থাকতে হবে। ডাক্তার প্রথমে বলেছিলেন নার্স রাখার কথা। তবে বাঁধ সাজে রুস্মি। ওর মতে বাহিরের মানুষ না রাখাই ভালো। বাড়ি গেলে সবার যত্নে সুস্থ হয়ে উঠবে দ্রুত। ডাক্তার এ বিষয়ে সহমত দেন। অতঃপর ওকে নিয়ে আসা হলো। বাড়িতে আসা মাত্রই মনে হলো শরীরের আর্ধেক রোগ সেরে গেছে! আবরাজের ভালো লাগছে এখন। রুস্মি ঘর গুছিয়ে দিল। পরিপাটি সুন্দর এক ঘর। রেবেকা স্যুপ এনেছেন। নিজ হাতে খাইয়ে দিলেন। রুবি ও কিছুটা সাহায্য করছে। এসব যদিও ভালো লাগে না তবু করছে সে। অনেকটা দায়সাড়া ভাবে। রুস্মি কাপড় গুছিয়ে কাবাডে রাখছে। আবরাজ কিছু বলতে চাইছে তবে মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। ছেলেটার শরীরে যন্ত্রণা এসে ভর করে। রুস্মির চোখে পরতেই রুস্মি বলে “কিছু লাগবে?”

হাতের সাহায্যে খাতা কলম আনতে বলে আবরাজ। রুবি নিয়ে আসে। রুস্মির হাতে তুলে দিয়ে চলে যায়। রুস্মি বসে পাশে। কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে “লিখে জানাও।”

আবরাজ লিখল “অরির ছবি আনো নি?”

হতাশ চোখে তাকালো রুস্মি। আবরাজ উৎসুখ দৃষ্টি মেলে। মেয়েটার থেকে উত্তর না পেয়ে হাল্কা হাতে ধাক্কা দিল। রুস্মি বলল “কাল গিয়ে নিয়ে আসব।”

মন খারাপ নামে আবরাজের মনে। জানালা গলিয়ে তাকিয়ে থাকে। এখন সম্ভবত সন্ধ্যা। এই অসময়ে রুস্মিকে একা পাঠানোও ঠিক হবে না। কাল ই বা যাবে কি করে? ও পথে নানান লোকের চলাচল। কে কখন কোন অঘটন ঘটিয়ে দিবে কে জানে?

খুব দ্রুত সুস্থ হচ্ছিল আবরাজ। এর ই মাঝে একদিন কল করে সীরাত। কল রিসিভ করে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে না পারাটা ফের ঝড় নামায় চিত্তে। একটা নিদারুণ ব্যথা ক্রমশ টুঁটি চেপে ধরে। মনে হয় এই বুঝি সব শেষ!

সেদিন কথা হলো না ওদের। খুব ই খারাপ লাগে। দুদিন বাদে আসে সীরাত। ছেলেটা তখন ঘুমিয়ে জল। রুস্মি গল্প জুড়ে দেয়। হরেক রকমের গল্প। রুস্মিকে চারটে বই উপহার দিয়েছিল সীরাত। সব গুলোই যুদ্ধ আর দেশের নানান বিষয় নিয়ে লেখা। একটা একটা সৌন্দর্য আর দেশপ্রেম রুস্মির হৃদয়ে নতুন ছন্দ তুলেছে। এই যে আগে দেশাত্মবোধক গান শোনা হতো না তবে এখন শুনে। রোজ নিয়ম করে। আগে প্রেমের উপন্যাস ভালো লাগলেও ইদানীং মেয়েটির থ্রিলার পড়তে ইচ্ছে হয়। গোয়েন্দা সিরিজ গুলো ভালো লাগে। তবে কোন বই কিনবে ঠিক করতে পারে না। সীরাত লিস্ট করে দেয়। মেয়েটার সাথে পুরোপুরি মিশে গেছে রুস্মি। আবরাজের ঘুম ভাঙে খানিক বাদে। নাস্তার টেবিলে আসতে চাইলে সীরাত জানায় সে নিজ থেকে দেখা করে আসবে। আবরাজ সবে উঠে বসেছে। পাশে গরম গরম স্যুপ। সীরাতকে দেখে খুশি হয়। হাতের ইশারায় ডাকে। সীরাত বসে। আবরাজের শুকনো মুখে হাত বুলিয়ে বলে “তোমাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না।”

একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছড়িয়ে পরে পুরো ঘরময়। খাতায় লিখে আবরাজ “আমি ও চাই দ্রুত সুস্থ হতে। আচ্ছা বলো তো আমি কি করে হসপিটালে এলাম। আমার কাছে সবটা কেমন অস্পষ্ট লাগছে।”

#হাতে_রেখো_হাত (১০)

শ্বাস নিতে কিছুটা সমস্যা হয় আবরাজের। চিকিৎসা চলছে। বিগত একটা সপ্তাহ সব থেকে বেশি খেয়াল রেখেছে রুস্মি। মেয়েটা সহজ সরল আর শুদ্ধ। সর্বদা সব দিকে খেয়াল তার। ঔষধ গুলো নিয়মের এক সেকেন্ড এদিক সেদিক ঘটে নি। ডাক্তার বলেছেন দ্রুতই সুস্থ হতে পারবে। বিশেষ গ্যাস সম্পর্কে ইতোমধ্যেই আলোড়ন চলছে। চারপাশে খবরটা যেন ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে গেছে। অফিসার আবুলের আসার কথা। ভদ্রলোক আসবেন বিধায় নাস্তার আয়োজন করা হচ্ছে। হরেক রকমের স্ন্যাকস। ভদ্রলোক এলেন একটু লেট করে। সন্ধ্যা পেরিয়ে মোটামুটি রাত সাড়ে আটটা বেজে গেছে। সোফায় বসে চা শেষ করে বললেন “তোমার বিগত দিন সম্পর্কে খোঁজ নিতেই একটু লেট হলো। এখন বলো কেমন আছো? ”

“আল্লাহর রহমতে ভালো আছি স্যার।”

“ভালো তো থাকতেই হবে আবরাজ। তুমি জানো দেশের পরিস্থিতি। গার্ডরা পেয়েছে তোমায়। ভাগ্যিস টহল দিচ্ছিল তারা। নতুবা নিশ্চিত ছিল তোমার ধ্বং*স।”

“কিন্তু স্যার, আমি বুঝতে পারছি না। বিষাক্ত গ্যাস কেন ছড়িয়েছে। আর কারাই বা ছড়িয়েছে।”

“ইনভেস্টিগেশন চলছে। আশা রাখা যায় দ্রুতই কিছু বিষয়ে অবগত হওয়া যাবে।”

আবরাজকে চিন্তিত দেখাল। অফিসার আবুল চারপাশে চোখ বুলিয়ে বললেন
“বাড়িটা ভীষণ সুন্দর। তোমার চাচার প্রভাব আর দৌলতের প্রতীক।”

জবাবে আবরাজ হাসল। সত্যি বলতে আনিসুল সাহেব শুরুতে ছিলেন সাধারণ এক কর্মজীবী। শিক্ষিত আর ভদ্রতার মাঝে থাকা প্রলোভনটা হঠাৎ ই উদয় হলো একদিন। ভাইয়ের টাকা মে*রে দিয়ে ব্যবসা শুরু। এভাবেই আজ বাড়ি, গাড়ি, প্রচুর সম্পদ উপার্জন করেছেন। এসব প্রথম দিকে পীড়া দিত খুব। তবে আবরাজের বাবা ছিলেন শান্তিপ্রিয় মানুষ। তিনি ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নিলেন না। বরং পরিবারকে নিয়ে ফের শুরু করলেন পথচলা। এসব ভেবে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবরাজ। খানিক বাদে রেবেকা এসে বলেন ডিনারের কথা। ডিনারে উপস্থিত ছিলেন সবাই। প্রতিটা মানুষের আচারণ ছিল নম্র। অফিসার আবুল কিছুটা স্বস্তি পেলেন এই ভেবে, সব হারিয়ে হলেও আবরাজের একটা পরিবার হয়েছে। নিজের পরিবার।

পরদিন সকালের কথা। বাগানে জল দিচ্ছে রুস্মি। পাশে বসে ম্যাগাজিন পড়ে রুবি। মেয়েটার এই কর্ম। ফ্যাশনের প্রতি ঝোঁকটা ও বিশাল। ইতোমধ্যেই স্কুলের প্রোগ্রামে মডেলিং করেছে। লম্বাটে দেহ আর লাবন্যময় ত্বকের অধিকারী হওয়াতে কিছু শো করার ও সুযোগ এসেছিল। তবে না করে দেয়। রুবির মতে এসব ছোট খাটো কাজ সে করবে না। সোজা সাপ্টা টিভি চ্যানেল গুলোর প্রোগ্রামে অংশ নিবে। সেই নিয়েই নানান জল্পনা কল্পনা। রুস্মির পানি দেওয়া শেষ। গাছ গুলো ছাঁটাই করার সময় রাস্তার পাশে ফুলের গাড়ি দেখতে পায়। নানান রকমের ফুলের মাঝেও চোখ আটকে যায় এক কোণে থাকা কিছু সাদা গোলাপের দিকে। এত সুন্দর লাগছিল যে রুস্মি ভুলেই যায় যাওয়ার কথা। যখন খেয়াল হয় ছুটে আসে। ফুল গুলোতে হাতের ছোঁয়া দিতেই মনে আসে আবরাজের কথা। সে বহু আগের কথা। আবরাজ সাদা গোলাপ পছন্দ করত। এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল ওদের পরিবারের সকলে। সেখানে একটাই সাদা গোলাপ ছিল। ফেরার পথে ছেলের জন্য তা নিয়ে আসেন চাচিজান। সেই ফুল ভালো লেগে যায় রুস্মির। প্রথম বারের মতো সাদা গোলাপ দেখেছে সে। সেই সাদা গোলাপের মোহে ডুবে যায়। বায়না ধরে নিবে বলে। চাচিজান ঋনাত্মক কোনো প্রতিক্রিয়া করেন নি। আবরাজের প্রিয় ফুল চলে আসে রুস্মির কাছে। প্রচন্ড মন খারাপ হয় আবরাজের। বয়স অল্প। বাচ্চা ছেলে তখন। তবু মায়ের সিদ্ধান্তের উপর টু শব্দ অবধি করে নি। কতটা নম্র আর আনুগত্য ছেলেটা সেদিন ই বুঝে এসেছিল। রুস্মি দেখেছিল ঘরের এক কোণে বসে কাঁদছে আবরাজ। সেদিন খুব খারাপ লাখগেও রুস্মির ছোট মন নিজের ভালো লাগার ফুলটি আবরাজকে দিকে এগিয়ে দিতে পারে নি। স্বার্থপর হয়েছিল সেদিন। সেসব ভেবেই কেঁপে উঠে রুস্মি। ফুল গুলোর দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয় শুধু আবরাজের জন্যই সৃষ্টি এই সৌন্দর্য্য।

কপালে হাত রেখে কিছু একটা ভাবছিল আবরাজ। আধশোয়া হয়ে। পেছন থেকে রুস্মির ডাক ভেসে এলো। “আসব?”

অদ্ভুত শুনালো কথাটা! ঘরে আসার জন্য রুস্মি কখনো কি অনুমতি চেয়েছে? কই না তো। আজ কেন চাইছে? নড়েচড়ে উঠে ছেলেটা। কপাল থেকে হাত সরিয়ে বলে
“এসো।”

আশ্চর্যের বিষয়ে হচ্ছে অনুমতি দেওয়ার পূর্বেই এসে গেছে রুস্মি। হয়তো মনোযোগ পাওয়ার বিশেষ কোনো টেকনিক ছিল এটা। আবরাজ ঘাটালো না। খুব সকাল নয় তবে আকাশ কিছুটা মেঘলা। তাই কেমন যেন অনুভব হয়।

“তারপর বলো, কি খবর তোমার?”

“আমার খবর? আমি অসুস্থ নাকি তুমি?”

“অসুস্থ না হলে কি খবর দেওয়া যায় না?”

“সেসব বাদ। অতো গভীর কথা আমি বুঝি না। তুমি বলো, নাস্তায় কি খাবে আজ।”

“রোজ যা খাই। ডাক্তার তো চার্ট করেই দিয়েছেন।”

অসহায় চোখে তাকালো রুস্মি। যা এড়াতে পারে নি আবরাজের চোখ। স্বল্পভাসী অথচ স্পষ্টবাদী মেয়েটা ও যে এমন বিব্রত হতে পারে তা জানা ছিল না। মেয়েটা চটপট কথা বদল করতে চাইল। “মা বলছিল বিকেলে তোমায় নিয়ে ঘুরে আসতে।”

জবাব দিচ্ছে না আবরাজ। রস্মি যে অন্য কিছু বলতে চাইছে তা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় নি। তবু সে কথা বাড়ালো না। রুস্মি চা দিয়ে চলে যায়। আবরাজ ভাবনায় পরে। মেয়েটার মাথা কি ঠিক আছে?

আবরাজ সম্পর্কে একটা ধারণা জন্ম নিয়েছে রুস্মির মনে। ছেলেটা নিশ্চয়ই কানা। এই যে সকাল সকাল ফুল গুলো রেখে এসেছে। অথচ ছেলেটা এখনো দেখে নি। এখন প্রায় দুপুর। ফুল গুলো নেতিয়ে এসেছে। টেবিল থেকে চটপট তুলে নিতেই আবরাজের কণ্ঠ “ওগুলো নিচ্ছো কেন?”

ভরকে যায় রুস্মি। ব্যলকনি থেকে বেরিয়ে আসে আবরাজ। মাথার চুল গুলো আদ্র। সবে গোসল করেছে। লম্বাটে ছেলেটার শরীর থেকে মিষ্টি এক সুবাস নাকে এসে লাগে। সেটা কল্পনা নাকি জানে না রুস্মি। ওর কি হলো কে জানে ধরমরিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যেন বৃষ্টির পর নেমে আসা রোদ্রের জলক। হুট করে উঠে হুট করেই পালিয়ে যায়।

.

বিকেলে আবরাজ, রুবি আর রুস্মি বের হলো। বাসা থেকে দশ মিনেটের হাঁটা পথ। তারপর ই একটা মাঠ। শহরের এপ্রান্তে এমন একটা জীবন্ত মাঠ সত্যিই অবিশ্বাস্য! কচি কচি ঘাস। এক পাশে কিছু লম্বা লম্বা গাছ। এই ব্যস্ত ধুলোবালি ভরা ইট পাথরের শহরের মাঝে এমন এক স্নিগ্ধ মুগ্ধতা সত্যিই অবিশ্বাস্য ব্যপার। রুবি এসে থেকে ফোনে মগ্ন। এই সুন্দর পরিবেশ ওকে ছুঁতে পারল না! অন্যদিকে রুস্মি মুগ্ধতায় হারিয়ে। উপন্যাস পড়ে পড়ে মনের ভেতর এক নতুন পৃথিবীর উদয় হয়েছিল। যে পৃথিবীটা ব্যস্ত শহরের সাথে ভীষণ অমিল। আজকের এই মুগ্ধতা উপন্যাসের পাতায় বর্ননা করা সুন্দর বিকেলটার মতোই। রুস্মি কিছুটা দূরে এসে দাঁড়িয়েছে। এদিক সেদিক তাকায় আবরাজ। সীরাত ফোন করেছিল। বলল আশেপাশেই আছে। এখনি চলে আসবে। মেয়েটা আসে কিছু সময় বাদেই। গায়ে জগিং স্যুট। ঘামে চুপচুপে শরীর।

“কেমন আছো তুমি?”

“ভালো। জগিং করছিলে?”

“হ্যাঁ। সকাল বিকেল দুই টাইম। না হলে শরীরে জ্যাম ধরে।”

“এত প্রেসার নিও না। হীতে বিপরীত না হয়।”

“কিছু হবে না। তোমায় বলেছিলাম নিয়মিত হাঁটতে। অথচ তুমি ঘরের কোণে বসে থাকলে। ঘরকুনো হলে কিন্তু সুস্থতা আসবে না। এই যে আজ কত সুন্দর আর স্নিগ্ধ লাগছে।”

কথার মাঝে ছেলেটার নিকটে এসে গেছে সীরাত। দূরত্ব খুব ই সামান্য। সীরাতের মুখে একটা মায়া আছে। যে মায়া ভাবাতে বাধ্য করে প্রায়শই। দারুণ কোনো সুন্দরী নয় মেয়েটি।অথচ দেশের প্রতি নিখাদ তার ভালোবাসা। পকেটে রুমাল ছিল। সেটাই এগিয়ে দিল আবরাজ। ঘর্মাক্ত মুখটা মুছে নিয়ে ফেরত দিতে চাইলেই আবরাজ বলে
“রেখে দাও।”

“রুমাল রাখতে নেই। ঝগড়া হওয়ার সম্ভবনা আসে।”

“আমাদের হবে না। নিশ্চিত থাকো।”

কথার পৃষ্ঠে কথা বলে নি সীরাত। বরং চুপটি করে রেখে দিয়েছে। রুস্মি এতক্ষণে ওদের দেখতে পেল। কাছে এলো। কুশলাদি করল।
“স্ট্রিট ফুড খাবে তোমরা?”

“খাওয়া যায়।”

“না, না খাওয়া যাবে না।”

“কেন রুস্মি?”

“ওকে ডাক্তার প্রপার ট্রিটমেন্টে রাখতে বলেছেন। নতুবা সমস্যা হতে পারে।”

হাসল সীরাত। রুস্মির গালে হাত রেখে বলল “বাহ সব দিকে নজর দেখছি।”

রুস্মি কিছু একটা বলেছে। কিন্তু সেটা শুনতে পেল না কেউই। সীরাত আর আবরাজ হেঁটে চলেছে। হাতে কিছু হলুদ গোলাপ। রুস্মির শরীরের প্রতিটা নিউরন যেন নিজেকে বলছে “মানুষটা কবে তোর মনের দখল করে নিল?”

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ