হারিকেন পর্ব-০৯

0
2108

#হারিকেন (সাজু ভাই সিরিজ)
#পর্ব:- ০৯

– রোহান ছেলেটাকে আগেভাগে সন্দেহ করিনি কারণ তার মধ্যে তেমন বৈশিষ্ট্য ছিল না। কিন্তু সে এমন কাজ করে দিব্যি পরিস্কার হয়ে সকলের সম্মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক শ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন ওসি সাহেব।

– সাজু বললো, আপনি এখন শুধু রোহানের উপর নজর রাখুন তারপর দেখবেন বাকি সদস্যরা সব এমনিতেই সনাক্ত হবে।

– চারিদিকে তোমার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে গেছে বলে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়ে গেছে। তুমি এখন ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো আমি আবার একটু থানায় যাবো।

– কবিতাকে ডাক দিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলেন, আর আমার জন্য একটা কাগজ কলমের ব্যবস্থা করুন। আমি কিছু প্রশ্ন লিখে দিচ্ছি, আর থানায় গিয়ে সেগুলো সব জুলির কাছে জিজ্ঞেস করবেন।

– আচ্ছা ঠিক আছে।

– ওসি সাহেব এবার একটু আমতাআমতা করে বললো, একটা কথা বলবো সাজু সাহেব?

– জ্বি বলেন।

– কবিতা মেয়েটার সঙ্গে তোমার কিরকম সম্পর্ক তা জানি না, কিন্তু যেহেতু তুমি অসুস্থ তাই ঘুমাতে গিয়ে দুজনে কি একরুমে থাকবে নাকি আলাদা? না মানে হঠাৎ করে তোমার কিছু দরকার হলে তো তখন ডাকলেও পাবে না।

– আচ্ছা আপনি চিন্তা করবেন না, আপনি আমার আর কবিতার জন্য একটা রুমই ব্যবস্থা করুন। সে তো হাসপাতালে কেবিনে আমার সঙ্গে একা একা থাকতো তাহলে এখানে সমস্যা কি?

– আচ্ছা ঠিক আছে তাই হবে।

★★

মারিয়া আর রোহানের মধ্যে এখনো আলোচনা চলছে, তারা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে না। মারিয়া বারবার পালিয়ে যাবার কথা বলে কিন্তু রোহান সেটা এড়িয়ে যায়।

– মারিয়া রেগে গিয়ে বললো, দুই কোটি টাকার জন্য এখন নিজেদের দুজনের জীবন রিস্কের মুখে ঠেলে দিতে চাই না। তারচেয়ে বরং আমরা দুজন পালিয়ে যাই, পার্টি যেহেতু পরিচিত আছে সেহেতু টাকা অবশ্যই আসবে।

– রোহান বললো, তাহলে তুমি বরং হাসপাতালে থাকো তারপর আমি বের হয়ে গেলে তুমি কালকে সকালে বের হবে। একসঙ্গে বের হলে আমাদের সন্দেহ করতে পারে, আর এখান থেকে এমনিতেই লুকিয়ে বের হতে হবে। বলা তো যায় না, এতক্ষণে নিশ্চয়ই জুলি সবকিছু বলে দিয়েছে।

– অসম্ভব, তুমি এটা কীভাবে বলতে পারো রোহান সেটাই বুঝতে পারছি না। তুমি একা পালিয়ে গিয়ে আমাকে কেন ধরা পরতে বলছো? আমাকে তুমি বিপদে রেখে নিজে কেন সরে যাবে?

– ওহ তুমি বুঝতে পারছো না ভাবি।

– আমি কিছু বুঝতে চাই না, তোমার ভাইয়ের জন্য নয় বরং তোমার জন্য কিন্তু আমি এতদিন তোমার পরিবারের সঙ্গে আছি। নাহলে বছর খানিক আগে সেই চাঁদপুরের মোসাদ্দেকের সঙ্গে চলে যেতাম, তার কিন্তু এসব জমজমাট ব্যাবসা।

– রোহান রাগান্বিত হয়ে বললো, তাহলে দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও তোমার মোসাদ্দেকের কাছে গিয়ে থাকো, আমাকে বলো কেন?

– এভাবে কথা বলো কেন রোহান?

– তুমি আমার কোন কথা শোননা তাহলে এভাবে না বলে উপায় আছে?

– আমি তোমার কথা শুনি না?

– মোটেই না।

– তুমি কি ভুলে গেছো তোমার কথামতো তোমার ভাই রাহাতকে আমি রিক্সা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিছিলাম। পিছন থেকে গাড়ি আসছে দেখে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিছিলাম কিন্তু কপাল ভালো বলে বেঁচে গেল।

– সেই সময় মরে গেলেই ভালো হতো, তাহলে এই ডাক্তারের মৃত্যুর ঘটনা শুরু হতো না। কারা যে ডাক্তারকে খুন করেছে আর তাদের জন্য সকল প্ল্যান ভেস্তে যাচ্ছে।

– রাহাতকে শেষ করে দিলে সবচেয়ে ভালো হতো কিন্তু তোমার জন্য সম্ভব হলো না। নাহলে তো তাকে আমি নিজেই কেবিনে বসে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে পারি।

– তোমার সবসময় মাথা মোটা, রাহাত ভাই মারা গেলে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা উঠাবে কীভাবে?

– আর এখন বিপদ ঘনিয়ে আসছে সেটা থেকে মুক্তি পাবে কীভাবে?

– তুমি একটু কথা কম বলো তো।

★★

হাজতের মধ্যে জুলির মুখোমুখি বসে আছে ওসি সাহেব, তার হাতে সাজুর করা কিছু প্রশ্নের কাগজ। জুলিকে খুব ভালো করে এক কাপ কফি খেতে দেওয়া হয়েছে, কফি শেষ হলেই তাকে সিরিয়াল অনুযায়ী প্রশ্ন করা হবে।

শরীরে ক্লান্তি আর কান্না করতে করতে চোখগুলো লাল করে বসে ছিল জুলি, তাই কফি সামনে পেয়ে সবকিছু ভুলে কফি খেতে লাগলো।

– ওসি সাহেব বললো, আমি কি তোমাকে এবার প্রশ্ন করতে পারি? মানে সবকিছু সঠিক উত্তর দেবে তো তুমি?

– মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো জুলি।

– ভেরি গুড, তুমি আর রোহান সাহেব মিলে রাহাত সাহেবকে হত্যা করতে চাও কেন? নিশ্চয়ই এতে তোমাদের স্বার্থ আছে, সেই স্বার্থটা কি?

– আমি জানি না।

ওসি সাহেব তখন একটা হাতুড়ি নিচ থেকে তুলে টেবিলের উপর রেখে বললো:-

– শুনতে পারিনি আবার বলো।

– রাহাত ভাই, রোহান এবং মারিয়া এরা সবাই মিলে মাদকদ্রব্যের ব্যাবসা করে গোপনে।

– কি…? মারিয়া…?

– জ্বি স্যার, মারিয়াও যুক্ত আছে। কিছুদিন আগে ওরা মিয়ানমারের এক ব্যাবসায়ীর সঙ্গে বেঈমানী করে দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। সবগুলো টাকা ব্যাঙ্কে রাখার কথা ছিল কিন্তু সেটা নাকি রাহাত ভাই একাই হজম করতে চায়।

– দুই কোটি টাকা…?

– জ্বি স্যার, আমি রোহানকে ভালবাসি, আমরা দুজন মিলে পরিকল্পনা করেছি ওই টাকা আমরা যেভাবেই হোক হাতিয়ে নেবো তারপর আমরা পালিয়ে যাবো অন্য কোন শহরে কিংবা ভারতের বর্ডার পার হয়ে।

– তাহলে ডাক্তারের খুন করেছ কেন?

– মারিয়া জানে যে টাকা ব্যাঙ্কে রাখা হয়েছে কিন্তু আসলে তা নয়, রাহাত ভাই একদিন মোবাইলে কার সঙ্গে যেন বলছিলেন যে ” টাকা তালা মেরে চাবিটা ‘হারিকেন’ এর মধ্যে লুকিয়ে রাখ। ” সেই কথা রোহান শুনে ফেলেছিল এবং তখনই বুঝতে পারে যে টাকা ব্যাঙ্কে নেই। আর এতগুলো টাকা হঠাৎ করে ব্যাঙ্কে রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব না।

– তারপর?

– প্ল্যান করে রাহাত ভাইকে খুন করার চেষ্টা করে মারিয়া, কারণ দেড় বছর ধরে রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশি ভালো নয়। কিন্তু রাহাত ভাই যখন বেঁচে গেল তখন পরিকল্পনা করতে গিয়ে রোহানের হঠাৎ মনে পরে টাকার কথা। ভাই যদি মারা যায় তাহলে টাকা বের করার আর কোন ব্যবস্থা নেই। সেজন্য ডাক্তারের কাছে আমরা গেছিলাম একটা প্রস্তাব নিয়ে, রোগী অপারেশন থিয়েটারে রেখে তাকে ভয় দেখিয়ে টাকার সন্ধান বের করতে বলা হলো ডাক্তারকে।

– তারপর?

– কিন্তু ডাক্তার রাজি হলো না, কারণ তিনি যদি অপারেশন করতে জান সেখানে তখন অনেকেই থাকবে। সেই সময় এসব জিজ্ঞেস করার কথা তিনি অস্বীকার করেন এবং বেশি বাড়াবাড়ি যদি করি তাহলে পুলিশে দেবে এমন হুমকি। রোহানের মনে ভয় ঢুকে গেল এবং সে শেষ রাতের দিকে প্ল্যান করলো সকাল বেলা অপারেশন হবার আগে ডাক্তারকে খুন করা হবে। আমি তখন কক্সবাজার ছিলাম কারণ দ্বিতীয় ডাক্তারকে রাজি করানোর চেষ্টা করছি। রােহান বলেছিল যে যদি কক্সবাজার এর ডাক্তার রাজি হয় তাহলে চট্টগ্রামের জাফর চৌধুরীকে কিডন্যাপ করা হবে।

– তাহলে জাফর চৌধুরীকে খুন করেছে কে?

– আমরা জানি না স্যার, পরিকল্পনা অনুযায়ী খুন করার কথা ছিল মারিয়ার। কিন্তু তার আগেই কে যেন খুন করে চলে গেছে, আমরা সবাই তখন খুব অবাক হলাম।

– সাজু সাহেবকে এসবের মধ্যে জড়াবার কোন দরকার ছিল কি? তোমরা তো রাহাতকে খুন করে দেবে তাহলে রক্তের জন্য নিশ্চয়ই তাকে এখানে ডাকোনি।

– না, রোহানের এক বন্ধু মাস তিনেক আগে সাজু ভাইয়ের জন্য ধরা পরেছে নরসিংদী শহরে। তার জন্য প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে রোহান ও অন্যান্য কে। সেজন্য সাজু যেহেতু মারিয়ার প্রক্তন স্বামী তাই তাকে কৌশলে আনা হয়েছে।

– মারিয়া কি রোহানকে নিয়ে পালাতে চায়?

– হ্যাঁ, মারিয়ার ইচ্ছে হচ্ছে সে রোহানকে নিয়ে ওই টাকাসহ পালিয়ে যাবে। কিন্তু রোহান সেই কখনো করবে না, কারণ আমরা অন্য পরিকল্পনা করি।

– কি পরিকল্পনা? সাজুকে খুন করে আর রাহাত ভাইকে খুন করে সকল দোষ মারিয়ার ঘাড়ে দিয়ে আমি আর রোহান পালিয়ে যাবো।

– ও মাই গড, তোমরা মারিয়াকে ব্যবহার করে তারপর তাকেই ফাঁসিয়ে দিতে চাও?

– আমার এতটা সাহস ছিল না, রোহানকে খুব ভালবাসি বলে সে আমাকে দিয়ে এতকিছু করায়।

– তোমরা তিনজন যদি হাসপাতালে ডাক্তার খুন না করে থাকো, তাহলে কাজটা করলো কে?

– আমি সত্যি সত্যি জানি না।

★★

হাসপাতাল থেকে চুপিচুপি বের হয়ে যখন একটা সিএনজি নিয়ে রোহান ও মারিয়া রওনা দিল তখন পুলিশও পিছনে তাড়া করেছিল। কিন্তু আগ্রাবাদ পার হয়ে চৌমুহনী মোড়ে এসে কোনদিকে গেছে সেটা আর বুঝতে পারলো না।

রাত 1:00 am.
একটা ফাঁকা রুমের মধ্যে হাত পা বাঁধা অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে মারিয়া। তার পাশেই হাতে একটা “হারিকেন” নিয়ে বসে আছে তার স্বামীর ছোটভাই বা তার দেবর রোহান। রোহানের মুখের মধ্যে পিচাশের মতো হাসি দিয়ে ভর্তি, পুরনো একটা প্লাস্টিকের হারিকেন হাতে নিয়ে বারবার নড়াচড়া করছে। মারিয়া মুখ তারই ওড়না দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে রোহান, যন্ত্রনায় চোখ দিয়ে পানি বেয়ে পরছে।

রোহান তখন ডানহাতে হারিকেন ও বাম হাত দিয়ে মারিয়া বুকে হাত দিয়ে বললো:-

– মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছে কি ভাবি?

– মুখ বন্ধ তাই গোঙানির শব্দ হচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে সে কিছু বলার প্রাণপণ চেষ্টা করছে।

– রোহান আবার বললো, এই হারিকেনের মধ্যে তোমার স্বামী দুই কোটি টাকার চাবি লুকিয়ে রেখেছে ভাবি। আমি অনেক আগেই মানে যেদিন অপারেশন হয়েছে সেদিনই টাকার খোঁজ পেয়ে গেছি। কিন্তু তোমার প্রাক্তন স্বামী সাজুকে দেখে তাকে মারার পরিকল্পনা এসে গেল। এখন তো সে মরে ভুত হয়ে গেছে ভাবি, আর ভাইও এখন মনে হয় সুস্থ হচ্ছে। আর আমি এই ফাঁকে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাবো, হাহাহা।

মারিয়া গোঙানির শব্দ দেখে রোহান তার মুখের ওড়নার বাঁধন খুলে দিল।

– মারিয়া বহুকষ্টে বললো, বিশ্বাসঘাতক।

– হাহাহা, ভাবি এটা তোমার মুখে মানায় না কারণ যে মেয়ে নিজের স্বামীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। তার সঙ্গে যদি আমিও একটু করি তাহলে ক্ষতি নেই, বরং লাভ আছে।

– তুমি আমাকে অন্য কিছু বলেছিলে।

– আমি তো জুলিকে নিয়ে চলে যেতে চেয়েছিলাম ভাবি, তোমাকে? কখখনো নিতাম না। সাজুর বাচ্চা সাজু মরছে, আমি মেলা মেলা খুশি। আচ্ছা ভাবি, হাসপাতালের ডাক্তারকে তুমি খুন করেছ তাই না?

– না না না, আমি তাকে খুন করিনি।

– তাহলে কে করেছে?

এমন সময় দরজায় ঠকঠক করে জোরে জোরে শব্দ হতে লাগলো, রুমের মধ্যে বিছানায় বসে দুজনেই একসাথে আঁতকে উঠল।

কে এসেছে? কে?

চলবে…
লেখা:-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)