হারিকেন পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
4233

#হারিকেন (সাজু ভাই সিরিজ)
#পর্ব:- ১০ (সমাপ্ত)

মারিয়াকে জোর করে পাশের রুমে রেখে রোহান যখন দরজা খুলে দিল তখন সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ দেখে সে চুপসে গেল। তাকে এক সেকেন্ড সময় না দিয়ে তারা সঙ্গে সঙ্গে রুমের মধ্যে প্রবেশ করলো। রোহান তখন অসহায়ের মতো চারদিকে তাকিয়ে পালানোর সুযোগ খুঁজছে। পাশের রুম থেকে মারিয়াকে বের করে এনে হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল পুলিশের মধ্যে একজন।

– মারিয়া বললো, আপনারা ঠিক সময়ে এসেছেন অফিসার কারণ একটু দেরি হলেই ওই শয়তানটা আমাকে মেরে ফেলতো। ওকে তাড়াতাড়ি এরেস্ট করুন, আমার অসুস্থ স্বামী হাসপাতালে আর সে আমাকে এখানে তুলে এনে অত্যাচার করছে।

– একজন পুলিশ বললো, আপনাকে সহকারে নিয়ে যাচ্ছি কোন চিন্তা করবেন না।

– মানে?

– আপনাদের দুজনের জন্য সাজু সাহেব এবং ওসি সাহেব দুজনেই অপেক্ষা করে আছে।

– মানে? সাজু বেঁচে আছে?

– জ্বি মেডাম।

– কিন্তু কীভাবে? তাকে খুন করেছে না জুলি?

– এতকিছু বিশ্লেষণ করলে তো চলে না মেডাম, তাড়াতাড়ি চলুন।

রোহান তখন অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো ভাবেনি এমন কিছু হবে। সাজু ভাই বেঁচে আছে এটা তাকে বেশি অবাক করছে, এতক্ষণে বুঝতে পারছে সাজুর প্ল্যান। সাজুর প্ল্যান অনুযায়ী পুলিশ তাহলে তাদেরকে ফলো করতে করতে এখানে চলে এসেছে, ইসস সে আগে টের পেল না কেন?

★★

বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে কবিতার কথা নিয়ে ভাবছিল সাজু, কিন্তু এমন সময় মোবাইলে তার বাবার নাম্বার দিয়ে কল এসেছে। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পরার জন্য একটু পর পর পরিচিত নাম্বার দিয়ে পরিচিতজনরা কল দিচ্ছে। সাজু তাদের সবার সঙ্গে একই জবাব দিচ্ছে, সাজুর মনে হচ্ছে যে খুব তো বিপদ হয়ে গেল।

– হ্যাঁ বাবা?

– কিরে সাজু? বাংলাদেশের মধ্যে তোর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে গেছে কেন?

– বাহহ তুমিও লন্ডনে বসে পেয়ে গেলে?

– ফাজলামো বন্ধ কর, কেন এমন ছড়িয়ে গেছে?

– একটা জরুরি কাজ আছে তাই খবরটা ছড়িয়ে দেবার দরকার ছিল।

– কিন্তু এটা অন্যায়, মানুষের মনের মধ্যে ব্যাপার নিয়ে খুব আতঙ্ক হতে পারে। যদিও তুমি তো আর দেশব্যাপী পরিচিত কেউ নয় কিন্তু যারা তোমার রিলেটিভ তারা তো ভয় পেয়েছে। যেমন আমাকে আমার এক বন্ধু কল দিয়ে বললো যে তুমি নাকি মারা গেছ।

– সরি বাবা, আমি এখনই সকল চ্যানেলে সত্যি কথা প্রচার করতে বলছি।

– তুই কি অসুস্থ সাজু?

– হ্যাঁ বাবা একটু অসুস্থ।

– আর কতবার বলবো যে এসব একঘেয়ে জীবন বাদ দিয়ে এখানে চলে আয়।

– আমার দেশ ছাড়তে ইচ্ছে করে না বাবা।

– তাহলে ঘুরতে আয়, কতদিন হয়ে গেল তোর সঙ্গে দেখা হয়না।

– আচ্ছা এবার এই মামলার নিষ্পত্তি হলেই দেখি একবার ইউরোপ থেকে ঘুরে আসবো।

– সত্যি তো?

– তোমার সঙ্গে আমি কখনো মিথ্যা কথা বলি?

– কিন্তু এই মৃত্যুর খবর?

– হাহাহা, বাবা তুমিও না।

– আচ্ছা এখনই খবর পরিবর্তন করতে বল নাহলে কিন্তু যারা এখনো জানে না তারাও জেনে যাবে৷

– একটা কথা বলতে তোমাকে আমি নিজেই কল দিতাম বাবা।

– কি কথা?

– আমার এক বন্ধু কলেজ জীবনে মারা গেছে মনে আছে? শফিক নাম তার।

– হ্যাঁ।

– ও মারা যায় নাই, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নড়াইলের একটা গ্রামের মধ্যে আছে। সেখানে সবকিছু ঠিক আছে কাজকর্ম করতে পারে কিন্তু কথা বলতে পারে না আর কাউকে চিনতে পারছে না।

– বলিস কি? কীভাবে জানলি?

– কিছুদিন আগে আমার বন্ধু সজীব এর কাছে একজন কল দিয়ে বলেছিল। আমি কক্সবাজার গিয়ে সেখানে দেখা করেছিলাম, ব্যস্ততার জন্য বেশি আলোচনা করিনি। আর এখনো রকি সজীব কারো কাছে বলিনি, এখন আমি শফিকের জন্য বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চাই। তুমি একটু সাহায্য করলেই কিন্তু আমি সফল হবো, জানো তো সবকিছু?

– আচ্ছা ঠিক আছে, তুই বরং বাংলাদেশের কোন ভালো হসপিটালে আগে ভর্তি কর। তারপর তারা কি বলে সেগুলো জেনে আমাকে জানাস, আমি ব্যবস্থা করবো।

– মেলা মেলা ধন্যবাদ বাবা।

ওসি সাহেবকে বলে যে যে চ্যানেলে মৃত্যুর খবর প্রচার হয়েছে তাদেরকে সত্যিটা বলা হলো। মানে সাজু মারা যায় নাই বরং বেশি অসুস্থ, আর সেটাই প্রচার হতে লাগলো সবজায়গা।

– কবিতা বললো, এবার একটু চোখ বন্ধ করবেন প্লিজ? আপনি তো অসুস্থ সাজু সাহেব।

– হঠাৎ করে আপনি?

– তো কি করবো? অসুস্থ শরীরে এভাবে কেউ কি রাত জাগে নাকি?

– আজকে রাতে বের হতে হবে, তাই ঘুমিয়ে গেলে চলবে না।

– মানে? কোথায় যাবে?

– যিনি ডাক্তার সাহেবকে খুন করেছে।

– মারিয়া আর রোহান নয়?

– না আরেকজন আছে।

– কে সে?

– তুমিও সঙ্গে যাবে তাই তখনই দেখবে।

– এখন বলো।

– না।

★★

রোহান আর মারিয়াকে জেলে নেবার পর বিভিন্ন কিছু সামলাতে রাত প্রায় শেষ হয়ে গেছে। ওসি সাহেব যখন বাসায় ফিরলেন তখন রাত সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। তিনি ভেবেছিলেন সাজু হয়ত ঘুমিয়ে গেছে, কিন্তু তিনি ফ্রেশ হয়ে বসতেই যখন সাজু তৈরী হয়ে বের হয়ে এলো তখন অবাক হয়ে বললো:-

– আপনি ঘুমাননি?

– স্যার আপনি সবসময় আমাকে তুমি আর আপনি বলে ঘুলিয়ে যাচ্ছেন কেন?

– মনে থাকে না।

– থানার খবর কি?

– একদম ফাটাফাটি, উঁহ অনেকদিন পর মাথার মধ্যে থেকে চাপ কমলো।

– ডাক্তারের সাহেবের সেক্রেটারিকে কে খুন করেছে সেটা কি জানা গেছে?

– হ্যাঁ রোহান স্বীকার করেছে, কিন্তু জাফর ডাক্তার কে খুন করার কথা তারা তিনজনের মধ্যে কেউই স্বীকার করে না।

– আচ্ছা সমস্যা নেই, আপনি চলুন আমার সঙ্গে।

– কোথায়? আর আপনি তো অসুস্থ।

– কিছু হবে না স্যার, আমি ঠিক আছি। কিন্তু এখন দেরি হলে আরেকজনকে ধরতে কষ্ট হবে।

– কোথায় যেতে হবে আমাদের?

– ডাক্তারের সেক্রেটারির বাড়িতে।

– সেখানে কেন?

– আপনি সেই সেক্রেটারির এবং তার স্ত্রীর সিমের কল লিস্ট যোগাড় করেছেন, মনে আছে?

– হ্যাঁ, কিন্তু?

– কাউকে বলিনি তাই তো?

– হ্যাঁ।

– আচ্ছা চলুন তারপর বলছি, অবশ্য সে কোথাও পালাতে পারবে না কারণ সজীব অলরেডি তার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে।

– পাহারা দিচ্ছে? আপনি তো আমাকেই বলতে পারতেন।

– দরকার হলে অবশ্যই বলতাম, আর তাছাড়া সেই রেকর্ডস তো আজকে সন্ধ্যা বেলা দিলেন তাই তীর ছোড়ার সময় লাগে।

– বুঝলাম না।

– রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে, চলুন।

★★★

থানার মধ্যে এখন চারজন আসামিকে মুখোমুখি বসিয়ে রাখা হয়েছে। ওসি সাহেব, সাজু ও সজীব তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু চেয়ার আছে তবুও বসছে না কেউ।

– সাজু তখন সেক্রেটারির স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো, যার জন্য আপনি আপনার স্বামীর বদলে নিজেই খুন করলেন। সেই কিন্তু আপনার স্বামীকে খুন করেছে, কত অদ্ভুত তাই না?

– চুপচাপ।

– আপনি ডাক্তার সাহেবকে কেন হত্যা করেছেন বলবেন? সবাই আমরা আগ্রহী।

– টাকার জন্য।

– কে টাকা দিয়েছে?

– রোহান সাহেব।

– কীভাবে যোগাযোগ হলো? ফোনে কথা হয়েছে?

– জ্বি, আমার স্বামীকে প্রথম ইনি কল দিয়ে বলে যে সকালে অপারেশন হবার আগেই ডাক্তারকে খুন করতে হবে। বিনিময়ে টাকা দেবে, অনেক অনেক টাকা, ২০ লাখ টাকা। কিন্তু আমার স্বামী রাজি হচ্ছিল না, তারপর সেই ভদ্রলোক আমার স্বামীকে বলে যে সে যদি রাতের মধ্যে কক্সবাজার যেতে পারে তাহলে ৫০,০০০ টাকা দেবে। তখন আমার হাসবেন্ড রাজি হয়ে গেল।

– কিন্তু আপনি তার মোবাইল থেকে নাম্বার বের করে রেখে দিলেন, তারপর আপনার স্বামী চলে যাবার পরে আপনি কল দিলেন ওই নাম্বারে। এটা কিন্তু আমরা আপনার ও আপনার স্বামীর নাম্বারে কললিস্ট দিয়ে বের করছি। আর দুজনেই একই নাম্বারে কথা বলেছেন, যেহেতু আপনার স্বামী আমাকে আগেই বলেছি যে তাকে কল করা হয়েছে এবং তিনি টাকা গ্রহণ করার সময় তাকে ভালো করে দেখতে পারে নাই। তাই ওটাই খুনির নাম্বার ভেবে নিয়েছি আমরা, কিন্তু সেই নাম্বারে আপনার কল দেখে অবাক হলাম।

– কিন্তু ও আমার স্বামীকে হত্যা করবে ভাবতে পারিনি, বিশ্বাস করুন।

– আপনি যদি একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের স্বামীকে খুন করতে পারেন তাহলে ইনি পুরুষ হয়ে কেন পারবে না?

– চুপচাপ।

– আপনার স্বামী যেদিন খুন হয়েছে সেদিন এই রোহান নামের ভদ্রলোক আপনার বাসায় গিয়ে কথা বলেছিল তাই না?

– জ্বি।

– তখন কি তাকে চিনতেন আপনি?

– আগে চিনতাম না, কিন্তু তিনি কল দিয়ে যখন বললেন যে পুলিশ আমার কাছে পৌঁছে যাবে বা আমাকে সে ধরিয়ে দেবে। তখন আমি তাকে আমার বাড়িতে প্রবেশ করতে দেই, আমার স্বামী ঘুমিয়ে ছিলাম।

– আপনি আপনার স্বামী হত্যার বিরুদ্ধে কোন মামলা করতে চাননি।

– ইনি বলেছিলেন যে আমি যদি কিছু করি তবে আমার খুনের কথা বলে দেবে।

– আপনি খুন করতে এতটা সহজে রাজি হয়ে গেলেন কীভাবে?

– আমার একটা সন্তান ছিল, সে মারা গেছে ওই জাফর ডাক্তারের অবহেলার কারণে।

– সেজন্য জানের বদলে জান? আপনি কি এখন আপনার পরিণাম ধারণা করতে পারেন?

– জ্বি পারি।

– ঠিক আছে, অপেক্ষা করুন বাকিটা আদালত সিদ্ধান্ত নেবে।

★★★

থানা থেকে বের হয়ে গেল সাজু সজীব কবিতা। রকি ও হাসান সাহেব একটু আগে চট্টগ্রামে এসে পৌঁছেছে কিন্তু এখন তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। মামলার বিষয় এখনো অনেককিছু ধোয়াশা হয়ে আছে, সেটা নাহয় আদালত খুঁজে দেখবে।

রাহাত সাহেবকেও গ্রেফতার করা হয়েছে কারণ তিনি মাদকদ্রব্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দুই কোটি টাকার জন্য তাদের নিজেদের মধ্যে চলেছে এক অদ্ভুত ষড়যন্ত্র। মাঝখানে সাজু লোকটা মার খেয়ে ভর্তা হয়ে গেল আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে।

একটা বিষয় ভালো হয়েছে, কবিতার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। লামিয়া নামটা হারিয়ে গিয়ে সেই পুরনো সম্পর্ক উঠে এসেছে। তারা দুজনেই কি একসঙ্গে থাকবে? নাকি দুজনেই এভাবে আলাদা থাকবে, কে জানে?

ভাগ্যে কি আছে?

#সমাপ্ত (হ-য-ব-র-ল)

যাইহোক, খারাপ ভাবে শেষ করার জন্য সবাই মাফ করবেন। আমি জানি খারাপ হয়েছে তবুও বলতে চাই “আমি নিরুপায়” ।

লেখা:- মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)