হিমির নাকফুল পর্ব-০১

0
2679

#হিমির_নাকফুল (প্রথম পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda .

বিয়ের আসর থেকে আমার বোনকে পুলিশ এরেস্ট করেছে!

বর পক্ষকে আমি কি জবাব দিবো বুঝতে পারতেছি না।আমাদের বাবা নেই।আমরা দুইটা ভাই বোন।আমার মা সে’ও অসচ্ছল। বয়সে ভারী হওয়াতে এখন আর ঠিক মত চলাচল করতে পারে না আগের মত।

ঘরোয়া ভাবেই সামান্য আয়োজনে আমার বোনের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।আমার বোন প্রথমত বিয়ে করতে চায়নি।একপর্যায়ে বোনকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিয়েতে রাজী করানো হয়েছে।

আর আজ কিনা সবার সামনেই আমার বোনকে পুলিশ এরেস্ট করে আমার বোনকে সবার সামনে থেকেই নিয়ে চলে গেলো।
পুলিশের কাছে এর কারন জিজ্ঞেস করাতে বললো আমার বোন নাকি কোন ছেলেকে খুন করেছে গতকাল রাতেই।

বাড়িতে হইচই শুরু হয়ে গেলো।আমিও পুলিশের পিছন পিছন থানার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।অন্যদিকে মায়ের কি অবস্থা আমি জানি না।

থানায় আমার বোনকে না রেখে কোর্টে পাঠিয়ে দিলো পুলিশের হেফাজতে।থানায় গিয়ে এই কেইসের ডায়েরিটা বের করে জানতে পারলাম এক ধনী ফ্যামিলির ছেলেকে আমার বোন খুন করেছে।

কল রেকর্ড অনুযায়ী আমার বোন যে খুনি তা প্রমান হয়েছে।কিন্তু আমি কখনোই বিশ্বাস করি না এই খুনটা আমার বোন করেছে।কারন আমি আমার বোনকে চিনি,ওর এতোটা সাহস কখনোই হবে না।

কিন্তু আমার কিছুটা খটকা লাগলো।বিয়ের সাজগোজের জন্য গতকাল রাতে ওর বান্ধুবীদের সাথে পার্লারে পাঠানো হয়েছিলো।বাসায় অনেকটা লেইট করে এসেছে।

আমার একমাত্র বোন হিমি।অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়াশুনা করে।নামীদামী ভালো একটা ভার্সিটিতে পড়াশুনা করে।আমি জানতে পারলাম যে ছেলেটি খুন হয়েছে ওরা একই ডিপার্টমেন্টে পড়াশুনা করে।ওদের নাকি দুই বছরের সম্পর্ক ছিলো।

তার চাইতে অবাক হলাম যে ছেলেটি খুন হয়েছে ওর মোবাইলে আমার বোনের বাজে ভিডিও। পুলিশ কয়েক সেকেন্ড ভিডিও চালাতেই আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেলো।

বেশ কয়েকদিন যাবত সেই ছেলেটি আমার বোনকে ব্লাক মেইল করতেছিলো।কল রেকর্ড শুনে জানতে পারলাম আমার বোন হিমি ওকে খুন করার হুমকি দিয়েছে।ছেলেটি যখন খুন হয়েছে তার কয়েক ঘন্টা আগেও আমার বোনের সাথে তর্কাতর্কি হয়েছে।এক পর্যায়ে সেই ছেলেটি আমার বোনকে হুমকি দেয় যে সেই মুহুর্তে তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা না দিলে নাকি এইসব বাজে ভিডিও ভাইরাল করে দিবে।আমার বোন পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে রাজী হয়নি।সন্ধার পরে নাকি আমার বোনের সাথে দেখা করতে এসেছিলো।
যার প্রমান কল রেকর্ডে রয়েছে।খুনটা হয়েছে আনুমানিক রাত সাড়ে নয়টার দিকে।

খুনটাও বেশ সুক্ষ্ম ভাবে করা হয়েছে।পোস্টমর্টেম অনুযায়ী রিপোর্টে বলা হয়েছে। কোল্ড ড্রিংকস এর সাথে বিষাক্ত ট্যাবলেট মিষিয়ে এই খুনটা করা হয়েছে।ছেলেটি বাইক চালিয়ে কিছুদুর যেতেই এক্সিডেন্ট হয়ে রাস্তায় পরে ছিলো।কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ জানিয়েছে ওই টাইমে কোনো বড় পরিবহন চলাচল করেনি।মাঝ রাস্তায় বাইক নিয়ে এই ভাবে পরে থাকতে দেকে এক অটো চালক ছেলেটিকে মেডিকেলে নিয়ে যায়।ডাক্তার মৃত ঘোষনা করে।কিন্তু ছেলেটির শরীরে কোনো ক্ষতের দাঁগ রয়নি।তাই তো পুলিশের সন্দেহ হয়।পাঠিয়ে দেয় পোস্টমর্টেম করাতে।

পুলিশ ভালোভাবে তদন্ত করে ফোনের কল রেকর্ড ফেইসবুক আইডি ঘাটাঘাটি এই খুনের ঘটনা জানতে পারে।সব কিছু শিওর হয়েই আমার বোনকে এরেস্ট করেছ।

আমার বোনকে নির্দোষ করার জন্য আমি এক এসআইকে সাথে নিয়ে সেই পার্লারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।সেখানে গিয়ে যানতে পারি আমার বোন পার্লারে গেছে রাত দশটার দিকে।এবং ওর সাথে কেউই ছিলো না।অথচ আমি জানতাম গতকাল আমার বোন ওর বান্ধুবীদের সাথে নিয়েই পার্লারের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলো।

পার্লারের মেয়েটির কথা শুনে পুলিশ এখন নিশ্চিত যে এই খুনটা আমার বোনই করেছে।

আমি সেখানেই ঢলে পরলাম।কি করবো বুঝতেছিনা।নিজেকে একটু ঠিক করে আমি বাসায় ফিরে আসলাম।বাসায় ফিরে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না।বাসা ভর্তী মানুষ।খাটলায় শুয়ে আছে আমার মা।

মা!
এই মা?
কি হয়েছে তোমার?
এইভাবে শুয়ে আছো কেনো?
প্লিজ কথা বলো মা!

নাহ আর মা আর কথা বলতে পারলো না।আমার মা আমাকে ছেড়ে এই পৃথিবী থেকে চলে গেছে।বড্ড অভিমান নিয়ে চলে গেছে আমার মা।সবাই মুখ চেপে কান্না করতেছে।

কিন্তু আমার চোখ থেকে একটাফোটা জল আসলো না।অনেক চেষ্টা করেছি মায়ের জন্য একটু কাঁদি।কিন্তু হাজারো চেষ্টা করে আমি আমার মায়ের জন্য এক ফোটা জল বের করতে পারলাম না।

আমার মাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কবরে শুইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম।নাহ এই লোক সমাজের মাঝে আর আমার মাকে রাখা ঠিক হবে না।লোকজনে আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে হিমিকে নিয়ে বাজে কথা বলবে।মনে মনে ছি ছি করে আমার মাকে অনেক কথা শুনিয়ে যাবে।আমার মা অপমানিত হবে।

জানাজা শেষ করে মায়ের খাটলা নিয়ে কবরের দিকে হাটতেছি।আমার কাধটা বাকা হয়ে যাচ্ছে।আমি আর হাটতে পারছি না।

হস্পিটালের বেডে চারিপাশে আমার আত্মীয় সজনদের দেখতে পেলাম।আমার চোখ দুটো শুধু হিমিকে আর আমার মাকে খুজে বেড়াচ্ছা।কারন তারা যে আমার দুই পৃথিবী। হঠাৎ করেই আমার মনে হলো আমার মা যে আর এই পৃথিবীতে নাই।মানে একটা পৃথিবী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।হস্পিটালে আর একটা মূহুর্ত দেড়ি না করে আমি আমার মায়ে কবরের উদ্দেশ্য বের হলাম।কেউই আমাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলো না।মায়ের কবরের কাছে গিয়ে আমি আমার মাকে কি বলবো সেটাই খুজে পেলাম না।সেখান থেকে উঠে হিমির সাথে দেখা করার উদ্দেশ্য হাটা শুরু করলাম।

কেউ আমাকে আটকাতে সাহস পেলো না।হিমিকে এই খবরটা দেওয়া খুব জরুরি। হিমি এখন দুইটা খুনের আসামি। প্রথমত ওর প্রেমিকাকে খুন করেছে,দ্বিতীয়ত আমার মাকে খুন করেছে।

থানায় গিয়ে অনেক কষ্টে অনুমতি পেলাম হিমির সাথে দেখা করার জন্য।

হিমির সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি।হিমি আমাকে দেখে কান্না করলো।আমি কিছুই বলতে পারছি না।আমাকে দেখে হিমি চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো…

-ভাইয়া আমি অনিককে খুন করিনি।অনিক আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো ঠিকই কিন্তু ওর সাথে আমার দেখা হয়নি।আমি ওর ভয়েই পার্লারে দেড়ি করে গিয়েছিলাম।তুমি তো আমার ভাই,প্লিজ তুমি আমাকে বিশ্বাস করো।আমি জানি তুমি আমায় বিশ্বাস করবে।ভাইয়া অনিকের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো,কিন্তু আমায় ব্লাক মেইল এর পরে ওকে ঘৃনা করি।

-এই ভাইয়া কথা বলো না কেন।ভাইয়া!

-তুই আমার মাকে মেরে ফেলছিস।তুই খুনি। তুই খুন করেছিস আমার মাকে।আমি আর তোর ভাইয়া না।তোর সামনে আমি আর আসবো না।আমি তোর শাস্তি চাই।শুধু শাস্তি চাই।

-না আমার মায়ের কিছুই হতে পারে না।প্লিজ তুমি আমাকে এখান থেকে বের করো। আমি আমার মায়ের কাছে যাবো।প্লিজ ভাইয়া!

-চুপ,একদম চুপ!মা নামটা তুই মুখে আনবি না।তুই আমার মাকে শেষ করে দিয়েছিস।আমার মা এখন শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।মা নাম মুকে নিয়ে তার শান্তিটা কেড়ে নিবি না।এখন তুই অপেক্ষা কর,তোর শাস্তি কখন পাবি।

হিমি আর কিছু বলতে পারলো না।আমার সামনে থেকে গুটিগুটি পায়ে হেটে আমার চোখের আড়াল হয়ে গেলো।রাস্তায় বেড়িয়ে হাটছি আর চিৎকার দিয়ে কাদঁছি।আমার আত্মীয় স্বজনেরা আমার পিছুপিছু হাটছে।কি হতে কি হয়ে গেলো?এক নিমিষেই আমার পরিবারটা শেষ হয়ে গেলো।

আমিও মরে যাবো আমার তো আর কেউ নাই।আমি একা থেকে কি করবো?মাঝ রাস্তা দিয়ে হাটছি গাড়ি আসলেই তার নিচে ঝাপ দিবো।কিন্তু পারলাম না।ফিরে আসলাম রাস্তার পাশে।আমি মারা গেলে আমার মায়ের জন্য কে দোয়া করবে?মায়ের কবরটার পাশে কে যাবে?মায়ের সাথে কে কথা বলবে?না আমি পারি না আমার মাকে কষ্ট দিতে।

গাড়িতে করে আমায় বাসায় নিয়ে এসে ডাক্তার ডাকলো।সব কিছুই চোখের সামনের দেখতেছি কিন্তু কিছু বলার বাঁক শক্তি হারিয়ে ফেলছি।

ডাক্তার আমায় ট্রিটমেন্ট করে সব সময় ঘুমের ঘোরে রাখতো।এভাবে একমাস হয়ে গেলো।আমার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি দিনদিন।

লোক মুখে শুনতেছি আদালত হিমিকে যাবতজীবন কারাদণ্ড দিয়েছে।হিমিকে খুব মিস করছি।শোকেসে রাখা এলবামটা বের হরে হিমিকে আর মাকে দেকতেছি।চোখের পানিতে এলবাম ভিজে যাচ্ছে।

আমার এই অবস্থা দেখে আমার ছোট কাকা আর কাকি আমার বাসায় এসে থাকতেছেন।সব সময় আমার খেয়াল রাখতেছেন।

খাবার বেড়ে কাকি আমাকে ডাকছেন।চেয়ায়ে বসে পাশের চেয়ারে হিমিকে আর আমার মাকে দেখতে পেলাম।হিমি আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর আমার মা বার বার খেতে বলতেছে।আমার কাকার হাতের স্পর্শে কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসলাম।আমার দিকে তাকিয়ে কাকা বল উঠলেন…

-হাবিব, হিমিকে তো আদালত যাবত জীবন কারাদণ্ড দিলো।কিন্তু আমার মনে হয় না হিমি এই খুনটা করেছে।তুই যদি কোনো উকিলের সাহায্য নিতি তাহলে হয়তো হিমি মুক্তি পেতো।

-হিমি খুনি, ও আমার মাকে খুন করেছে।কিসের জন্য সাহায্য নিবো?

-এখন হয়তো রাগের জন্য বলতেছিস,কিন্তু পরে তুই ঠিকই তোর বোনকে মনে করবি।

-ও আর আমার বোন নেই।আমি ওর ব্যাপারে কিছু শুনতে চাচ্ছি না।প্লিজ কাকা চুপ করেন।

আমার কাকা আর আমার কথায় কিছু বলতে পারলেন না।চুপচাপ খাচ্ছেন।কিন্তু আমার গলা দিয়ে খাবার নামছে না।ভাতের মধ্যে হাত নড়াচড়া করে উঠে গেলাম।

রাত নয়টার দিকে কাউকে না জানিয়ে রাস্তা বেয়ে হেটে চলছি।একটা ল্যাম্পপোস্ট এর আলোর নিচে বসে সিগারেট ফুকছি।

পিছন থেকে কেউ একজন আমার কাধে হাত রেখে বললো..

-আমি এই খুনের আসল রহস্য জানি!সব কিছুই আমি জানি।

কথাটা আমি মালুম করলাম না।পরক্ষণেই আমার সেন্সে কাজ করলো।একটা মেয়ে আমাকে এই কথাটা বলেছে এতোক্ষন?

পিছনে তাকিয়ে দেখি………

[চলবে……]