হিমির নাকফুল পর্ব-০২

0
1908

#হিমির_নাকফুল(২য় পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

আসলেই কি সে এই খুনের ব্যাপারে জানে?

পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি মেয়েটি গাড়িতে করে চলে গেছে।আমি আর সেই মেয়েটির চেহারা দেখতে পেলাম না।

আমার মাথাটা তৎক্ষনাৎ ভাবে অচল হয়ে গেলো।ঝিম ধরেই বসে রয়েছি ল্যাম্পপোস্টের নিচে।তাহলে কি মেয়েটি সত্য বলতেছে?নাকি আমি ভুল শুনলাম?নাকি কোনো আত্মা আমাকে এভাবে কানে কানে বলে গেলো।

হিমির একটা স্বভাব ছিলো।কোনো বকা ঝকা করলেই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়।ওর রাগ ভাঙাতে আমার বড়সড় গিফট দিতে হয়।পাঁচশো একহাজার টাকার কাজ না।হয় ওকে নিয়ে ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়া লাগবে নয়তো সারাদিন ঘুরে ফিরে কেনাকাটা করে দেওয়া লাগবে।আমার বোনটা খুব আদুরে। ওর ছোট বেলায় বাবা আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছেন।বাবার অভাব কখনো বুঝতে দেইনি।খুব মেধাবী হিমি।পড়াশুনার দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে আছে।আমার মায়ের স্বপ্ন ছিলো হিমি ভালোমত পড়াশুনা করে সুন্দর একটা পজিশনে যাবে।মায়ের মুখ উজ্জল করবে।হিমি ঢাকায় সুনাম করা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছিলো।কিন্তু আমাদের রেখে হিমি আর সেই ভার্সিটিতে যায় নি।আমাদের আশেপাশের ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পরে এখানেই এডমিট করেছে।যখন ভার্সিটিতে এডমিট করাই তখন আমার চোখ বেয়ে অঝোরে পানি গড়িয়ে পরেছিলো।এই বুঝি আমার মায়ের স্বপ্ন পূরন হতে চলেছে।

আমার বোনকে যেদিন ভার্সিটিতে এডমিট করাই সেদিনের মত অতটা সুখি আমি আর আগে কখনো হইনি। আমি কখনো আমার নিজের বিলাসিতা খুঁজিনি কিন্তু আমার বোনের সমস্ত চাওয়া-পাওয়া পূরণ করেছি।

আমার বয়সটা অনেক হয়েছে। আমার মা আমাকে বার বার বলেছে বিয়ে করতে। আমার মা বয়স্ক হয়ে গেছে ঠিক মত কাজ করতে পারে না বা চলাচল করতে পারে না। তখন আমাকে বহুবার বলেছে আমি যেন খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে আসি। কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাই নি কারণ আমি আমার বোনের লেখাপড়া করাবো ওকে ভালো একটা ফ্যামিলিতে বিয়ে দিবো। সেজন্য টাকা উপার্জন করে বোনের বিয়ের জন্য রেখে দিতাম। আমি যতটা কষ্ট করেছি তা সবই আমার বোনের জন্য। আমার মত কষ্টটা যেনো আমার বোনের পোহাতে না হয় এটা আমি সারাটা জীবন চেয়েছি।

কিন্তু আজ আমার বোন জেলখানায় বন্দি। জানিনা আমার বোন খুনটা করেছে কিনা। নাকি আমার বোনকে কেউ ফাঁসিয়ে দিয়েছে? কিন্তু আমার হাতে তেমন কোন প্রমান নেই যে আমি আমার বোনকে এই শাস্তির হাত থেকে বাঁচাবো।

আমাদের মামাবাড়ি কবে গেছি তা আমার ঠিক মনে নেই। যখন হিমি খুব ছোট তখন হয়তো একবার গিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরে আর তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হয়নি। সব সময় টাকা উপার্জনের দিকটা আমি খুজতাম। কিভাবে আমি আমার সংসারটা চালাবো কিভাবে আমি আমার পরিবারের লোকজনের সকল চাওয়া পাওয়া পূরণ করব সেটা নিয়ে ভাবতাম সবসময়। মনে আছে যখন আমার বয়স সতেরো কি আঠারো হবে তখন থেকেই আমি ঈদ ভালোমতো কাটাতে পারিনি। আমি আমার পরিবারের প্রিয়জনদের ঈদের দিন সময় দিতে পারিনি।

এমন না যে আমি পড়াশোনা করিনি। এতটা কষ্ট করার পরেও আমি অনার্স পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি এরপরে আর পড়াশোনা চিন্তা মাথায় আনিনি। যদি আমি পড়াশোনা চিন্তা মাথায় আনতাম তাহলে আমি আমার বোনকে পড়াশোনা করাতে পারতাম না তাই নিজের পড়ালেখা বাদ দিয়ে আমি আমার বোনের পড়ালেখাটা চালিয়ে গেছি।

আমার মা মারা যাওয়ার পরে মামাবাড়ি থেকে লোকজন এসেছিল কিন্তু তাদের সাথে আমার কোনো কথাবার্তা হয় নি। আর মামা বাড়ির লোকজনের সাথে শুধু আমার মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু আমরা দুই ভাই বোনের সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না। কারন বিয়ের পর নাকি বাবা মামা বাড়ির লোকজনের সাথে ঝামেলা করেছিল। আর সেই ঝামেলার সূত্র নিয়ে মামারা আমাদের পরিচয় পর্যন্ত দেয়নি। তাইতো ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পরে মায়ের সাথে একবার গেছিলাম মামা বাড়িতে। আমার বোন হিমি তখন খুব ছোট কিন্তু কেউ একটা বার পর্যন্ত কোলে তুলে নি। মায়ের সাথে একরাত ছিলাম মামা বাড়িতে কিন্তু এসব দেখে আমাদের নিয়ে মা আমাদের নিজ বাড়িতে চলে আসে। তারপর থেকে আর আমাদের মামা বাড়ীতে যাওয়া হয়নি। আর তারপরে আমার মা আমাদের নিয়ে বা আমাদের বাসায় রেখে কখনো তার বাবার বাড়িতে যায়নি।

কিন্তু এখন আমার মামাদের সাহায্য খুবই দরকার। আমার মামারা যদি সাহায্য করে তাহলেই আমি আমার বোন হিমিকে জেলখানায বন্দি থেকে বাঁচাতে পারবো। এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। আমার মা ভালো একটা ফ্যামিলির মেয়ে একটা শিক্ষিত ফ্যামিলিতে আমার জন্ম মায়ের। মামারা ভালো পজিশনে সরকারি চাকরি করে। একমাত্র তারাই পারবে আমার বোনকে বাঁচাতে। আমি যেভাবেই হোক মামাদের কাছে সাহায্য চেয়ে তাদের সামনে হাত পাতবো। কারণ আমি চাই আমার বোন ফিরে আসুক নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে।একটা পৃথিবীতে বড় অভিমান নিয়ে চলে গেছে আমি আমার আরেকটা পৃথিবী হারাতে চাইনা।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন ফজরের আযান দিয়েছে তা আমি বুঝতে পারিনি। আমার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। ফজরের নামাজটা পড়ে আমি আমার মায়ের কবরের কাছে গিয়ে বসলাম আর বললাম…

– মা আমি আমার বোনকে বাঁচাতে পারছিনা আমার বোন যে সব জায়গায় খুনি প্রমাণিত হয়ে গেছে। আমি এখন কি করবো? তুমি আমাকে একটা উপায় দেখিয়ে দাও না!নইলে আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও মা। আমি এভাবে বেঁচে থাকতে আমি আমার বোনের কষ্ট সহ্য করতে পারবো না। জানিনা আমার বোন কতটুকু কষ্ট করতেছে আমার বোন যে একটা খাঁচায় বন্দী হয়ে গেছে। না কারো সাথে কথা বলতে পারছে,না কারো সাথে দেখা করতে পারছে। আমার এখন কি করা উচিত আমি আর সহ্য করতে পারতেছি না।

– এই মা তুমি যে অভিমান করে আমার কাছ থেকে চলে গেলে কই আমার কথা তো একটা বারও ভাবলে না। আমার বোন না হয় একটা ভুল করে ফেলছে। আমিও তো তোমার সন্তান তুমি কেন আমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেলে আমার যে আর কেউ নাই।
মা আমি অনেক আশা নিয়ে তোমার ভাইদের কাছে যাব আমি আমার বোনের সাহায্য চাইতে। তারা আমায় খালি হাতে ফিরিয়ে দেবে না তো?

মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে পিছন থেকে আমার কাকা ডাক দিল….

– হাবিব তুই এখানে কি করছো? তোর জন্য আমরা সারারাত অপেক্ষা করছি। তুই গেছিলি কোথায়?কয়েকবার এখানে আসলাম তখন তো দেখলাম না। কখন আসলি এখানে?

– কাকা আমি আমি হিমিকে জেলখানার বন্দী থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবো তো?

– হিমিকে ফিরিয়ে আনতে হলে যে আমাদের অনেক টাকার প্রয়োজন অতটা সামর্থ্য তো আমাদের নাই। আর বিশেষ করে এই সব ব্যাপারে তো অনেক ক্ষমতার প্রয়োজন । আমাদের কি সেরকম কেউ আছে? তার পরেও আমাদের হিমিকে ফিরে আনতে হবে। ভালো একটা উকিলের সাথে কথা বলে হিমির কেউস নিয়ে লড়তে হবে।

-দরকার হলে বাবার জমিয়ে রাখা সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে আমি আমার বোনকে ফিরাবো।

– তা ঠিক আছে তার আগে তো আমাদের ভালো একটা উকিল এর দরকার।

– কাকা আমি দরকার হলে আমি আমার মামাদের কাছে গিয়ে সাহায্যের হাত পাতবো।

– কিভাবে? তারা কি সাহায্য করবে? তারা তো সেই ছোটবেলা থেকেই তোদের দুই ভাই-বোনকে দু’চোখে দেখতে পারেনা আর তুই কিসের বিশ্বাস নিয়ে তাদের কাছে যাবি?

– হ্যাঁ আমি তাদের কাছে যাবো। তারা কিছু একটা তো বলবে।

– আচ্ছা বাসায় চল রাতে তো কিছু খাস নি। সকালের নাস্তা করবো। তারপরে যা ভাবার ভাববো এত টেনশন নিস না যা হবার হবে। আর মানুষের বিপদ তো কোন না কোনভাবে আসে। তার জন্য আমাদের হতাশ হলে চলবেনা। আমাদের এখন মূল উদ্দেশ্য হিমিকে কিভাবে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনবো?

বাসায় গিয়ে নাস্তা করে আমি আমার ফোনটা খুঁজলাম সেই এক মাস বা তার বেশি হয়ে গেল তারপর থেকে আর আমার ফোনের কোন খোঁজখবর ছিলনা। বিনা চার্জে ফোনটা আমার রুমে পরে আছে। ফোনটা কিছুক্ষণ চার্জে লাগিয়ে ফোনটা ওপেন করলাম।

ওপেন করার পর আমার ফোনে বহু মেসেজ আসলো।একটা নাম্বার থেকে মেসেজ গুলো পড়লাম মেসেজগুলো পড়ে লাস্ট মেসেজটা যখন পড়লাম তখন আমার চোখ ছানাবড়া বড় হয়ে গেলো আমার এখন কি করা উচিত আমি ভাবতে পারতেছি না।

তাহলে কি এই সেই….

[চলবে……]