হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে পর্ব-২৩

0
345

উপন্যাস:হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব:২৩

কত না বিচিত্র মানবের মন ও মনন।বাহিরে রিতি যাই হোক না ক্যানো ভেতরের রিতি একদমই অন্যরকম।এই জগতের বাইরেও তার ভাবনার একটা নিজস্ব ধরণী আছে। যে ধরণীর ধরন,ধারন,রকম সকম অন্য ধারায় প্রবাহিত হয় রিতির নিজের মর্জিমতো। সেখানে সে নিজেই একছত্র অধিপতি। সমাজবদ্ধ নিয়ম নীতির উর্ধ্বে রিতির আপনার পৃথিবী টা।সেই পৃথিবীতে রিতির একটাই আরাধ্য পুরুষ বিরূপাক্ষ। যে বিরূপাক্ষ কখনো চোখ রাঙায় না তার প্রেয়সীকে।ও চোখে নিজের প্রেমময় পৃথিবী দেখে রিতি।লাল সাদা শাপলা ফোটা দিঘীর টলটলে স্বচ্ছ জলে হাতে হাত রেখে পায়ের পাতা ভিজিয়ে বসে থাকে সময় অসময়।কোনো শাসন,বারণ নেই আছে শুধু মেনে নেওয়া,মানিয়ে নেওয়া শব্দটা সেখানে অচল।সেই পৃথিবীর বিরূপাক্ষ রাতের আঁধারে বক সাদা কাশবনে ঘুরে ঘুরে জোনাকি ধরে, দুহাত ভরে দেয় রিতির।সেই জোনাকির নীলচে আলোয় দেখা মানুষটার কপাল, নাকের চিকচিকে ঘাম মুছে দেয় নিজের বুকের আঁচল দিয়ে।জ্যোৎসনা রাতে নৌকা ভাসায় গভীর নদীতে।মাঝি হীন, বৈঠাবিহীন নৌকা তবুও বয়ে চলে ছলাৎ ছলাৎ জল তরঙ্গে টুং টাং শব্দ তুলে।সে শব্দের সুর লহরীতে মোহময় হয়ে ওঠে দুজনের প্রেমাভিসারের চন্দ্রিমা রাত্রি।সেই পৃথিবীতে কোনো ক্লেশ,ক্লান্তি নেই আছে শুধু সুখময় যাতনা আর মধুময় কিছু কামনা,বাসনা। সেখানে পৃথিবীর বিরূপাক্ষ এক অদ্বিতীয় প্রেমিক পুরুষ,যার চোখের তারায় শুধু একটি নামই জ্বল জ্বল করে সে রিতি।সেই অন্তঃপুর এ লাজ লজ্জার বালাই নেই,অবাধে মাতে নিষিদ্ধ, বিশুদ্ধ আচরণে।যেথা দ্বিধান্বিত অনুভূতির মরণ ঘটে অহরহ,প্রতিটা ক্ষণে জন্ম নেয় দ্বিধাহীন,সংকোচ হীন সব আবেগ,ক্রিয়া কর্ম।
হ্যা পৃথিবীটা রিতির একান্ত একার হলেও সেখানে ওরা শুধু দুজনই বাস করে। বিরূপাক্ষ তার স্বামী,তাই কল্পনা গুলোও বাঁধা অতিক্রম সকল চক্ষুলজ্জা,নিন্দার। সে পৃথিবীর মূল ফটকে সংযমের চাবিহীন তালা ভেদ করে ভাবনা গুলো বাইরে বেরোতে দেয় না রিতি।আর হয়তো দেবেও না কখনো।জানবে না কেউ এই শান্ত, বিজ্ঞ, পরিপূর্ণ,বুঝদার রিতির অন্দর মহলে এক, চঞ্চল , অবুঝ,আর একগুঁয়ে রিতির বাস।তার সকল চাওয়া, সকল উচ্ছলতা,আর সকল যেমন খুশি তেমন জেদ পূরনের একমাত্র আলাদীনের জ্বীন তার রূপ দা।রিতির এক কথায় রূপ দা আকাশের চাঁদটা এনে দেয়, তাঁরা গুলো কুড়িয়ে এনে রিতির রংমহল সাজায়।বুনো ঘাসফুলের মাল্য পরায় অবাধে।জরা,ব্যাধি,ক্ষুদা, তৃষ্ণার রাজত্ব সেখানে চলে না।তবে অভিমানের ফলন বেশ ভালো হয় সেখানে।

******
শাড়ির কুঁচি নেড়ে চেড়ে ঠিক করছিলো রিতি।একদম পরিপাটি রিতির নড়ন চড়ন আড়চোখে লক্ষ্য করছিলো বিরূপাক্ষ।বালিশে হেলান দিয়ে বা হাতের কনুই ঠেস দিয়ে কি একটা বই পড়ছে।মনোযোগটা ঠিক কিসের উপর স্পষ্ট করে বুঝার উপায় নেই।

বাহির সঙ্গী ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বললো রিতি,,,

রূপদা,একটু পরে যে ঔষধটা আছে মনে করে খেয়ে নিও।আমি বড়মাকে বলেই যাবো।আর সাবধানে চলবে কিন্তু,,

যাচ্ছিস তো এই তিন পা দূরে এমন ভাবে বলছিস যেনো আর ফিরবি না? তাচ্ছিল্য ভরে বলে বিরূপাক্ষ। কিন্তু নিজের বেসামাল কথাটায় নিজেই চমকে ওঠে।রিতির হাসি হাসি মুখটায় আঁধার নামে,একজনের তাচ্ছিল্য অন্য জনের বুকে বাজে,,,
সে তুমি বললেও যাবো, না বললেও যাবো। কিন্তু তোমার বিয়ের ভালো মন্দ খেয়ে, তোমার বউকে তোমার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তারপর না হয় যাবো? করুন হাসি লেগেই আছে রিতির ওষ্ঠপ্রান্তে।

বিরূপাক্ষ অপ্রস্তুত হয়ে পরে,একটা কথা বললে বাচাল মেয়েটা দশটা কথা শুনায়। ইদানিং যেনো একটু বেশিই মুখরা হয়েছে।না হয় মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে একটা কথা তাই বলে এত কথা শুনাবে?

অত কি ভাবছো?এবার এলাম দেরী হয়ে গেছে এমনিতেই। সিঁথিতে একচিলতে সিঁদুর ছুঁইয়ে বলে রিতি।তারপর বাহাতের শাখায় ছুঁইয়ে হাতটা কপালে ছোঁয়ায়।বিরূপাক্ষ ব্যপারটা দেখে ইদানিং খুব পুলক বোধ করে। সেদিন হঠাৎ প্রশ্ন করেছিলো রিতিকে এই ব্যপারে। কিন্তু আহম্মক বনে গেলো রিতির উত্তর শুনে,,
এগুলো ক্যানো পরিস বলতো?এত ভক্তি নিয়ে কপালে ঠেকাস,এর কি কোনো প্রয়োজন আছে?

আছে বৈ কি,, তোমার প্রয়োজন না থাকলেও আমার আছে।মানো আর নাই মানো সিঁদুর তো তুমি পরিয়েছো।তাই তার সঠিক মূল্যায়ন করা আমার পরম কর্তব্য মনে করি আমি।ছোট বেলায় অনেক কোলে কাঁখে নিয়েছো,বড়ো বেলায় একটু আশির্বাদ করো যেনো হাতে নোয়া আর কপাল জুড়ে এই সিঁদুর নিয়েই মরতে পারি।ডিভোর্স হলেও বা কি?রাঙানো সিঁথি আর কে রাঙাবে বলো?এ যে মুছবার নয়।

বিরূপাক্ষ স্তব্ধ হয়ে মিনিট কয়েক তাকিয়ে ছিলো সদা বিস্তৃত হাস্যরত রিতির দিকে।

হাতের বইটা বিছানায় ফেলে রাখে বিরূপাক্ষ।তার ভাবনার ফাঁকেই রিতি বেরিয়ে গেছে।ড্রেসিং টেবিলের সামনে ফোনটা বেজে উঠলো।রিতির ফোন।ভূলে ফেলে গেছে হয়তো।কল বেজেই চলেছে একটা চেনা শোনা সুরে। সেদিকে কোনো আগ্রহ নেই ওর। অবশেষে চার বারে ফোনটা রিসিভ করে,,ওপাশ থেকে একটা ছেলে কন্ঠ ভেসে আসছে, কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করেই কলটা ডিস্কানেক্ট করলো নাকি নেটওয়ার্ক জনিত সমস্যায় কেটে গেলো বুঝতে পারলো না বিরূপাক্ষ। মিনিটের মধ্যেই ম্যাসেজ ঢুকলো একটা,,
কৌতুহল বশত সেটা ওপেন করতেই দেখলো,একটু আগের নম্বরটাই,,,

ত্ররিতি, কয়েক দিন অনলাইনে আসো না।এ্যানি প্রবলেম?রাতে লাইনে এসে নক করো,কথা আছে,, খুব জরুরি।

আগ্রহের আতিশয্যে ফোনটা একটু ঘেঁটে দেখার বাসনা জমা হয় বিরূপাক্ষের মনে। কিন্তু সেটা সমূলে নির্মূল হয়,ফোনটা লক করা। কিন্তু বিরূপাক্ষের হতবাকের শেষ নেই, ফোনের ওয়ালপেপারে টাঙানো আছে তার নিজেরই একটা ছবি।স্লিভলেস টিশার্ট পরে ব্যালকনির চেয়ারে বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে সে।
নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোনে হাসি ছুঁয়ে যায়, মুচকি হাসি।ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে বাড়ির গেটের ভেতরে বড় আমগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে রিতি। কাজের ছেলে গনেশ দৌড়ে আসছে অন্দরমহলের দিকেই। নিশ্চয়ই মোবাইলের ডাক পরেছে।কথাটা মিথ্যে না,গনেশ হাঁপাতে হাঁপাতে ঘড়ে ঢোকার অনুমতি চাইলো দেড় মিনিটের মধ্যেই।উড়ে এলো নাকি কে জানে?

****
হ্যাল্লো ইয়াং ম্যান;পনেরো দিন তো হলো ।আর কতো এভাবে শুয়ে বসে?ঘড়ে প্রবেশ করেই হাস্য রসিকতার ফোয়ারা ছোটালেন নিহার আঙ্কেল। বিছানায় আধশোয়া বিরূপাক্ষ উঠে বসে হাসি মুখে।একয়দিনে নিহার আঙ্কেলের সঙ্গ তাকে বিশেষ ভাবে আন্দোলিত করেছে। ভীষণ ভালো আর স্নেহপরায়নতার প্রতীক এই নিহার আঙ্কেল। প্রথমদিন বিরূপাক্ষ অতিমাত্রায় ভদ্র এই মানুষটিকে মনে মনে হেয় ভেবেছিলো তা ভেবেই এখন লজ্জিত হয়।

থাকি না আঙ্কেল আর কটা দিন এই ভাবে। কাজের সময় তো পরেই আছে। তাছাড়া আপনি যেভাবে আমার সাথ দিয়ে চলেছেন তাতে আরো কিছু দিন অন্তত এভাবে থাকতে ইচ্ছে করে।হাসতে হাসতে বলে বিরূপাক্ষ। নিহার রঞ্জন বিরূপাক্ষের বাহুতে একটা চাটি মেরে বসে বিছানায়।

কিন্তু ইয়াং ম্যান আমার যে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে এলো। তাঁর গলায় বিষাদের সুর।

সে কি আঙ্কেল এত তাড়াতাড়ি কিভাবে কি? বিরূপাক্ষ আকাশ থেকে পরে।

মেয়াদ আছে ঠিকই কিন্তু রাহুলকে ফিরতে হবে বাবা,,, আমেরিকা থেকে জরুরী ইমেইল এসেছে।ইন্ডিয়া গিয়েই যাবে সেখানে।আর ফিরবে একেবারেই।তারপর বিয়ে থা করে ডাইরেক্ট সংসার জঞ্জালে ঢুকিয়ে দেবো।বাছাধন বুঝবে ঠ্যালা,,হা হা হা হা

রাহুলের বিয়ের কথায় হঠাৎ করেই রিতির মুখটা চোখে ভাসে বিরূপাক্ষের তাই সামনের মানুষটার প্রাণবন্ত হাসিটাও যেনো মেগা সিরিয়াল আলিফ লায়লার বদ জিনের বিদঘুটে হাসির মতো কর্ণে আঘাত করে।

ওহ্,, কিন্তু আর কটা দিন তো থাকতেই পারেন আঙ্কেল।সামলে নিলো নিজেকে।

বাচ্চা ছেলের মতন মন খারাপ হয়ে গেল তো?পরশু যাবো বাপের বাস্তুভিটা যশোরে , সেখান থেকেই ব্যাক করবো ইন্ডিয়াতে। তুমি যাবেতো বৌমাকে নিয়ে?আদ্র হয়ে আসে নিহার রঞ্জন এর কন্ঠস্বর। বিরূপাক্ষ অপ্রস্তুত হয়ে পরে,,,

যাবো আঙ্কেল,আর কিছু না হলেও আপনার সাথে সময় কাটানোর লোভে আমি অবশ্যই যাবো।

*****
আমির শেখের বৈঠক খানায় মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে রিতি এবং আমির শেখ।মাঝে অবস্থানরত টেবিলে দুটি দুধ সাদা চীনা মাটির চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে ফড়ফড় করে। প্রচন্ড কালবৈশাখীর ঠিক আগ মুহূর্তে পরিবেশ যেমন থমথমে থাকে তেমনি হাবভাব রিতির সমস্ত মুখমন্ডলে। আমির শেখ এই মিলিয়ে মোট তিনবার দেখলো রিতিকে।মেয়াটার চেহারা দেখলে যে কেউ পুনরায় আর একবার দেখার ইচ্ছা পোষন করবে। কিন্তু আমির শেখ খুব তোয়াজ করে এই গম্ভীর,অবিচল মেয়েটাকে।কারন অজানা।

আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে চাই আমি।ঘড়টা ফাঁকা হলেই ভালো হয়।

রিতির দৃঢ় অথচ মৃদু স্বরের মানে স্পষ্ট আমির শেখের কাছে।অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা সহচর চারজনকে চোখের ইশারা করতেই তারা প্রস্থান করে বিরস মুখে।

হ্যা এবার বলুন?
রিতি সরাসরি তাকায় আমির শেখের চোখের দিকে।

আপনার সাথে আমার ব্যাক্তিগত কোনো শত্রুতা আছে কি?

না তো!ছোট উত্তর আমির শেখের।

তাহলে আমার ব্যক্তিগত সুখ সুবিধার দিকে নজর ক্যানো দিয়েছেন? চোয়াল শক্ত হয়ে আসে রিতির

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না আপনার কথাটা?বললো আমির শেখ।

প্রভাকর রায় চৌধুরীর সাথে আপনার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আছে সেটা সবাই জানে। আপনার যাকে খুশি তাকে নিয়ে দল করেন তাতে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। রাজনীতিতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।কিন্তু আমার মাথায় টান পরলে আমি কাউকেই ছাড়বো না।আপনি ভালো মন্দ যাই হন। অহিংস রাজনীতি করতে কেউ পারে না। আপনিও পারবেন না কিন্তু সেই হিংসাত্মক খেলা যদি আমার সাথে শুরু করেন তাহলে তো মাথাটা আমার ব্যথা করতেই হবে তাইনা?

আমি এখনো কিছু বুঝতে পারলাম না।

জেগে জেগে যে ঘুমিয়ে থাকে তাকে তো কেউ জাগাতে পারেনি আর পারবেও না।যাক তাহলে খুলেই বলি।চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে রিতি, ঠোঁটের কোনে ক্রুর হাসি,,, দাদাভাই ভেবেছেন বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী নিছক দূর্ঘটনার স্বীকার হয়েছে তাই তিনি থেমে গিয়েছেন।আমিই তাকে বুঝিয়েছি ঐ দূর্ঘটনায় কারো হাত নেই।না হলে এতদিনে রক্ত গঙ্গা বইয়ে দিতেন তিনি। এবার আপনি বলুন তো সেটা কি আসলেই নিছক একটা দূর্ঘটনা ছিলো?দয়া করে অবাক হওয়ার ভান করবেন না প্লিজ।

পঞ্চাশ বর্ষীয়ান আমির শেখের লোম কূপ গুলো কেঁপে ওঠে রিতির বিচক্ষণতায়।ভেতরে যাই হোক না ক্যানো উপরে স্ট্রং পারসোনালিটি ধরে রেখেই জবাব দেন তিনি,,কি বলতে চান আপনি?একটু বেশি পরিমাণে বাড়াবাড়ি হচ্ছে না? গলায় পূর্ণ রোষ।

লালচে হয়ে আসে রিতির হলুদাভ মুখায়াবয়ব।চোখে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তার।এখনি যেনো সবকিছু ছাড়খার করে দিবে সেই অনলে,,,,মি:আমির শেখ, আমি আপনার শিক্ষক হয়ে হাতে কলমে কোনকিছু বুঝাতে আসিনি। শুধু একটু খানি সাবধান করে দিতে এলাম,,,এই হাতে যেমন কলম ধরতে পারি,তেমনি আঁশ বাটিটা ধরতেও অসুবিধা হবে না। খবরদার,,,ফের কখনো আমার স্বামী কিংবা তার পরিবারের কারো উপর যদি এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে,তবে মা সিংহ বাহিনীর দিব্যি দিয়ে বলছি, আপনার পালিত কুত্তাগুলোর ধর থেকে মাথাটা এক এক কোপে আলাদা করবো আমি।আর আপনার লিকু সরদার কে বলবেন,, তার জন্য নতুন বঁটির বায়না করেছি কামারের কাছে। এরপর তাকে অন্ধকার জেলে নয়, অন্ধকার কবরে বসে আজাব ভোগ করতে হবে।

বিস্ময়ে হতবাক আমির শেখ । অতটুকু একটা পুঁচকে মেয়ে তাঁর সামনে বসে এমন নিরব হুংকার ছাড়তে পারে তার স্বপ্নেরও অতীত।রাগে মাথাটা দপ করে জ্বলে ওঠে, তর্জনী উঁচিয়ে চেঁচাতেই,রিতি গলার স্বর বাড়িয়ে সটান দাঁড়িয়ে পরে,,,
সাবধান আমির শেখ,,,, রাজনীতি করছেন ভালো কথা কিন্তু জান,মালের নিরাপত্তা আগে নির্ধারণ করতে শিখুন।আর আপনার বিপুল নামের কুলাঙ্গারটাকে বলবেন সেদিন রাতের আঁধারে বিরূপাক্ষ তাকে না দেখলেও খবরটা আমার কাছে পরিষ্কার দিনের আলোর মতো।ওর চৌদ্দ গুষ্টির ভাগ্য ভালো আমার স্বামীর কিছু হয়নি,নইলে বরিশালের কোন নদী নালা ওকে বাঁচাতে পারতো।ঐ নদীর মাঝেই তার সলিল সমাধি করে দিতাম আমি।
অন্যায় বাদ দিয়ে ন্যায়ের রাজনীতি করেন জয় আসবেই আজ হোক কিংবা কাল। আসি আমি। কথাগুলো যেনো মনে থাকে। নিজের ব্যাগটা কাঁধে ঠিক করে নিয়ে রাজ রাজেশ্বরীর ঢংয়ে শব্দহীন পায়ে বেরিয়ে যায় রিতি।

আমির শেখ হতবিহ্বল রিতির শেষের কথাটা শুনে।যে কথা কেউ জানে না।এই মেয়েটা জানলো কিভাবে?আর ভাবতে পারছেনা আমির শেখ।এই মাথামোটা শুয়ো**বা** গুলোর জন্য তার সারাজীবনের স্বপ্ন সাধ সব যাবে। প্রচন্ড ক্রোধে সেগুন কাঠের তৈরি ভারী চেয়াখানা মাথার উপর তুলে ছুড়ে মারে দূরে।বিকট আওয়াজ করে কাঁচের সেন্টার টেবিল ভাঙার শব্দে দৌড়ে ঘড়ে ঢুকলো দেহরক্ষী চারজন।

আসলাম বিপুলকে বরিশাল থেকে চলে আসতে বলো।আর লিকু বুড়োটাকে খবর দাও। সাবধান করে দিও নইলে আমার হাতেই মরবে জানোয়ার গুলো।

*****
আর একটু খাও মা। কতদিন হলো নিজের হাতে খাওয়াইতে পারিনা।এমন শুকাইছো ক্যা মা?খাওনা কিছু?

পুলি পিঠার একটা অংশ গলাধঃকরণ করে বললো রিতি,,, তুমি কবে আমাকে মোটা দেখলে পিসি? তোমাকে চোখের ডাক্তার দেখাতে হবে। আরেকটা কামড় বসায় পিঠাতে।

হ হ।আমি তো খালি শুকনা দেখি তোরে।মাথা ছুঁইয়া ক তো দেহি ঐখানে খাস ঠিক কইরা?
তোমার মতো শত্রু আমার আরো দুজন আছে ও বাড়িতে,,এইখানে তোমার যন্ত্রণা ঐখানে তাদের যন্ত্রণা বুঝলে শান্তি নেই কোথাও আমার।একটু কড়া সুরেই বললো রিতি।

কিন্তু সুমিতা দেবীর ভালো লাগে এমন দুর্নাম।মুখে ফোঁটে সারল্য আর স্নেহ মাখা হাসি।

হ রে মা,শরীলডা ঠিক হইছে তার রূপ বাবাজির ?নিয়া আইতি একবার। পূজায় তো আইলোই না।

হুম,,,

একটা কথা কবি মা?

একহাজার কথা তো অনুমতি ছাড়াই শুনলে পিসি। রসিকতা করে রিতি।

অত হিসেব আমি বুঝিনা বাপু।কই কি বাবাজীর লগে ভাব সাব হইছে এট্টু?
রিতির দন্ত্যের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আবার দ্বিগুণ গতিতে চলতে থাকে।

কি হইলো কও মা?সভয়ে প্রশ্ন করে সুমিতা দেবী। মেয়েটার সাথে বেশী কথা বাড়ানোর সাহস হয় না তার।

কি যে তুমি বলোনা পিসি?জামাই মেয়ের মধ্যে ভাবসাব হয়েছে কি না তাও তোমাকে জানতে হবে?শাশুড়ি না তুমি?
ছদ্ম লজ্জায় বলে রিতি।সুমিতা দেবী একপাশ দিয়ে দেখার চেষ্টা করে রিতির প্রতিক্রিয়া অবশেষে নিরাশ হয়ে রান্নায় হাত চালান।কড়াইতে হাঁসের মাংস হয়ে এলো প্রায় অন্য চুলায় পিঠা তৈরির মাটির ছাঁচ।
পাতি হাঁসের ঝাল ঝাল করে রান্না করা মাংস আর চিতুই পিঠা রিতির সবচেয়ে প্রিয় খাবার।চালের গুঁড়া আগেই করা ছিলো রিতির আসার খবর শুনে পালের বড়ো হাঁসটা মেরেছে সুমিতা দেবী।

পিসি তোমার লাউ গাছে লাউ পরেনি? কুমড়োর ফুল ধরেছে কি?কথা ঘোরানোর চেষ্টা রিতির।
দেখি দাদুভাই কোথায় গেলো।একটু তাড়াতাড়ি করো পিসি বেলা যে যায়।রিতি বেরিয়ে আসে রন্ধনশালা থেকে।

সুমিদের উঠোন পেরিয়ে অমৃতা বৌদির ঘড়ে গিয়ে ঢোকে।অমৃতার ছ মাসের ছেলেটি ঝাঁপিয়ে পড়ে রিতির কোলে।রিতি পর পর কয়েকটা চুমু খায় বাবুটার গুলুমুলু গাল দুটোয়।আরো তিন চারটে ঝি বউ এসে যোগ দেয় ওদের হাস্য রসিকতার মধ্যে।বর নিয়ে কত রং ঢংয়ের মশকরা করে বৌদিরা ।ওরা বোঝেনা এই রসিকতা রিতির বুকে খুশির ঢেউ তোলে না।তোলে এক অসহনীয় অবাঞ্ছিত, অবহেলিত হওয়ার যন্ত্রণার কাঁপন।

বৌদিদি এরা সব গেলো কোথায়?এত নীরব ক্যানো সব?উপর থেকে নেমে বসার পেরিয়ে সোজা কিচেনে এলো বিরূপাক্ষ।

জয়া ফ্রিজ থেকে খাসির মাংস বের করে জলে ভেজায়।বিরূপাক্ষের স্বর শুনে হাসে খানিক,,,কার কার অভাব বোধ করছো ভাই?

কাউকেই তো দেখছি না।মা,আন্টি আর সবাই কোথায় গেলো?এক কাপ কফি যদি দিতে।বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।

শুধু কি কফির তেষ্টা?নাকি আর কারো দর্শনের তৃষ্ণা হুম!ভ্রু নাচায় জয়া।

বিরূপাক্ষ থতমত খায়।বৌদিদির ঘাড়েও কি আজকাল ঐ মেয়েটা ভর করেছে?

কফি দিলে দাও,না হলে গেলাম। অভিমান করে বিরূপাক্ষ।

আহারে ,,,বেচারা ,,,তুমি বসো আমি কফি দিচ্ছি।এতই যখন উতলা তাহলে ফোন ক্যানো করছো না?কল দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসতে বললেই হয় দিদিমনি গিরি ছেড়ে একটু বৌ গিরি করুক। লজ্জা নারীর ভূষণ হলেও তা মাঝে মধ্যে পুরুষ জাতিকেও নাস্তা নাবুদ করে তোলে। বিরূপাক্ষ বলে আমতা আমতা করে,,,

আমি কি একবারো বলেছি রিতির কথা?কি আমার বন্ধু হয়েছেন তার নাম অহর্নিশি জপতে হবে।

ওমা,,সে কি? আমি কখন বললাম রিতির কথা।স্কুলে দিদিমনির অভাব আছে।

নিজের বাক্যবাণে নিজেরই বেকুব বনে গেলো বিরূপাক্ষ।

খিল খিল করে হেসে ওঠে জয়া,,থাক থাক আর মুখ গোমড়া করতে হবে না। গিয়ে বসো আমি কফি নিয়ে আসছি।আর হ্যা তোমার শত্রু তার শাশুড়ি মাকে ফোনে জানিয়েছে দাদুভাইকে দেখতে গ্যাছে বাড়িতে।খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে যাওয়া বিরূপাক্ষের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে রইল জয়া,,,কে বলে বিরূপাক্ষ আগের মতো নেই?এইতো সেই অতীতের বিরূপাক্ষ।একটু অভিমান হলেই যে মুখ গোমড়া করে বসে থাকতো চিলেকোঠার ছাদে।বাড়িতে নতুন কোন আগুন্তক এলে লজ্জায় বৌদিদির পেছন ছাড়তো না।
আপন মনে বিরবির করে মগে কফি ঢালে জয়া।এত মানুষ আর শত কাজের ভীড়েও হঠাৎ হঠাৎ উদাস হয়ে পুরোনো স্মৃতির আঁকড়ে হাসে, চোখের জল ফেলে।বাবার বাড়ি থেকে ও নেই তার। মনের জ্বালা জুড়োবার মতো বিশ্বস্ত জায়গারও অভাব তার।হ্যা একমাত্র রিতিকেই বলতে পারতো দুঃখের কথা।তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারতো প্রাণ খুলে। বুকের ভেতরের খামচি মারা ভোঁতা যন্ত্রণা হয়তো কিছুটা লাঘব হতো তাতে। কিন্তু কি করে বলবে ? এটুকু একটা মেয়ে নিজেই তো বুকের ভেতর পাহাড়সম কষ্ট বয়ে বেড়ায়। স্বামীর যে বুকে এক সময় মাথা রেখে সকল দহন শীতল হতো সেই চিরশান্তির জায়গাতেও আজকাল ভাগীদার এর আনাগোনা টের পায় জয়া।যে মানুষটা একদিন শত ব্যস্ততায় ও জয়ার সামান্যতম মন খারাপের কথাও মন দিয়ে শুনতো,সেই মানুষটিই আজ তার মন খারাপের মিছিলের প্রধান ভাষ্যকার।

প্রায় আধা ঘন্টা খানেক পরে বাড়িতে ফিরেছে রিতি। পিসির হয়তো রান্না শেষ। কিন্তু উঠোনে পা দিতেই বেশ কয়েকজনের কথার আভাস পায় সামনের বারান্দায়।চেনা চেনা কন্ঠস্বর কানে আসে। উঁকি দিতেই চক্ষু চড়কগাছ।তিতলি,অহনা বসে আছে খাটে। রাহুল দাদুর পাশে আরেকটা চেয়ারে বসা।রিতিকে দেখে হই হই করে উঠলো অহনা এবং তিতলি।রিতি ভাবতেই পারেনি ওরা এভাবে এখানে আসবে,,

ক্যামন হলো রিতি? সারপ্রাইজটা ক্যমন দিলাম বলো? বললো তিতলি।

বৌমনি তোমাদের গ্রামটা কিন্তু ভারী সুন্দর।ভাগ্যিস গো ধরেছিলাম না হলে দাদা তো নিয়েই আসতো না।পাশ থেকে বললো অহনা।

রিতি ভীষণ লজ্জায় পরলো,,,আসলে আমারই তোমাদের নিয়ে আসা উচিত ছিলো। রাহুল বাবু যে,কাজটা করেছেন তার জন্য উনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু তোমরা জানলে কিভাবে যে আমি এখানে এসেছি?

তখন ফোনে বললে না আন্টিকে।আমি,অহনা পাশেই ছিলাম। রাহুল বাবুকে ধরে তবে পৌঁছলাম।
সুমিতা দেবী শোকেসে রাখা কাঁচের,চীনামাটির থালা,বাটি,গ্লাস ধুয়ে আনলেন কলপাড় থেকে। না না করেও খেতে হলো সবাইকে।গল্পে আনন্দে চললো খাওয়া দাওয়া।সুমিত দেবী অনেক দিন বাদে একসাথে এতগুলো পাতে খাবার পরিবেশন করলেন।আনন্দাশ্রুতে চোখ দুটো টলমল করে উঠলো তার। অবশেষে সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ আগে সুমিতা দেবীর টলমলে জল টুকু অনেক গুনে বৃদ্ধি পেয়ে ঝরে পরলো বুক বেয়ে। বিদায় বেলায় রিতিরও ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু ক্যানো সেটা অজানা। শশুর বাড়ি কাছে হোক কিংবা দূরে,বাপের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় বোধহয় এমনি হয় সব মেয়েদের।

বসার ঘরে চলছে গল্প-গুজোবে মেতেছে সবাই। রঘুনাথ ঢুকে ডাকলো রিতিকে। তিতলি, অহনার সাথে ফোনে কিছু একটা দেখে হাসছিল রিতি।ফিরে তাকায়,,

হ্যা দাদাভাই।কিছু বলবে?

এদিকে শোন একটু। গম্ভীর গলায় বললো রঘুনাথ।রিতি হাসিমুখে উঠে এসে দাঁড়ায় রঘুনাথের কাছাকাছি।নিচু গলায় বলে,,উপরে চলো।

বাধ্য ছেলের মতো রিতির পিছু পিছু হেঁটে ছাদের গিয়ে দাঁড়ায় রঘুনাথ।

ছাদে রাতে লাইট না জ্বললেও পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়।সেই আবছা আলোয় রঘুনাথের লালচে দৃষ্টি নজর এড়ালো না রিতির।

বলো কি বলবে? শান্ত স্বরে বলল রিতি।

বিজয়া তোকে কিছু বলেছে রিতি? গলায় স্পষ্ট তেজ।

কই না তো!কিছু বলার ছিলো কি? তাচ্ছিল্য ভরে বলে রিতি।

সত্যি করে বল রিতি।ক্রমশ উত্তেজনা বাড়তে থাকে রঘুনাথের।

কথা আস্তে বলো দাদাভাই।কেউ শুনলে অনাসৃষ্টির কিছু বাকি থাকবে না। তুমি জানো আমি মিথ্যা বলিনা। নিজের দাদাভাইয়ের নামে এমন কিছু বৌদিদির মুখে শোনার আগে ঠাকুর যেনো আমাকে মরণ দেয়।দাদাভাইয়ের চরিত্র নিয়ে সমালোচনা আমি শুনতে পারবো না দাদাভাই। রঘুনাথ বিস্ফোরিত নেত্রে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে রিতির দিকে।

তুই ক্যানো গিয়েছিলি সেখানে? গলার স্বর নেমে আসে।

তুমি কোন পঁচা শামুকে পা কাঁটছো সেটা নিজের চোখে দেখবো বলে?

ঠিকানা কে দিলো তোকে? বিস্ময় বেড়েই চলেছে রঘুনাথের।

তুমি তো জানো গোয়েন্দা হওয়ার কত শখ ছিলো আমার? জেঠুর কারনে তো সেটা আর হলো না।তাই বলে সেই মনটা তো আর হারায়নি।ক্রুর হাসি দিয়ে বলে রিতি।

আর যাবি না।কাউকে পাঠাবিও না।

কি করবে তুমি? ইকবালের হাত ভেঙে দিয়েছো আমাকেও মারবে?মারো।মেরেই ফেলো একেবারে কিচ্ছুটি বলবো না। কিন্তু বৌদিদির চোখের জলের কারনটাকে আমি সুখে থাকতে দেবো ভেবো না।

বাড়াবাড়ি করিস না রিতি।

মেরে পুঁতে দেবে আমাকে?দাও না। চিৎকার করে ওঠে রিতি।রাগে সর্বাঙ্গ কাঁপছে তার।

বুড়ি,,,আমি তোকে মেরে পুঁতে দেবো?এমন কথাটা বলতে পারলি? একটুও জিভে আটকানো না।খুব করুন শোনায় রঘুনাথের গলার স্বর।

আমি জানি দাদাভাই তুমি নিজের জীবন গেলেও আমার গায়ে একফোঁটা আঁচড়ও লাগতে দেবে না।তাহলে আমি তোমার জীবনটা নষ্ট হতে দেই কি করে বলোতো।কান্নায় কন্ঠ রোধ হয়ে আসে রিতির।

চলবে,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।