হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে পর্ব-৩০+৩১

0
341

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব:৩০

আহা কি ভাল বাসিতাম কি গভীর উৎফুল্ল আর হৃদ কম্পন নিয়া,,,

তব দুটি করোজ্জল আঁখি বার বার চাহিয়া চাহিয়া দেখিতাম প্রিয়া,,,

বহুদিনের এক পুরোনো পত্রিকার পাতা থেকে উচ্চ স্বরে উক্ত কবিতাটি পাঠ করে চলেছে অখিলেশ। ইংরেজিতে লেখা কবিতা কেউ একজন বাংলায় অনুবাদ করে ছাপিয়েছে।
সবে সকাল দশটা ছাড়িয়েছে।চারজন রুমমেটের মধ্যে শহীদ নামের ছেলেটা তখনো ঘুমে।পাতলা কাঁথার তলায় তার বিরক্তির শেষ নেই।অখিলেশের অতি উচ্চমাত্রার কবিতাবৃত্তি তার নিদ্রায় অতিমাত্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে চলেছে।ঘুমিয়েও সুখ নেই তার অথচ বিছানায় যাবে সবার আগে। সারারাতের কুম্ভকর্ণের ঘুম ঘুমোবে আর উঠবে সবার পরে। নিজের কৃত কাজের জন্য নিজেরই মাথা খুঁড়ে মরতে ইচ্ছা হলো শহীদের কারন অখিলেশের ঐ কবিতাটা কাল সন্ধ্যায় তারই হাত ধরে পৌঁছেছে এখানে। বন্ধু বাৎসল্যের খাতিরে কতগুলো ভাজা বাদাম কিনে এনেছিলো ঐ পেপারের ঠোঙায় করে।মাথার উপরে চুন-সুড়কি উঠা দেওয়ালে বয়স্ক ফ্যানটাও সঠিক তেল মবিল এবং যথাযথ পরিচর্যার অভাবে ঘুরছে একান্ত নিরুপায় হয়ে।তারই বহিঃপ্রকাশ ঘ্যাড়ঘেড়ে কান জ্বালানো শব্দ। সবুজ নামের ছেলেটা পাড়ার টাইম কলে লম্বা লাইন পেরিয়ে স্নান সেরে হন্ত দন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো সবে। পরনের গামছাটা আধো ভেজা।হাতের নিংড়ানো হাফ প্যান্টটা কাঠের চেয়ারে ফেলে পরিমরি করে টিশার্ট পরলো একটা। অখিলেশের সে দিকে কিঞ্চিত মাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজের মনে আবৃত্তি করে চলেছে সে। কিন্তু ওদিকে নিজের চেয়ারে বসে বই পড়ছিলো মধূসুদন নামের ফাস্ট ইয়ারের ছেলেটা।সে এখন পড়া শোনা স্থগিত রেখে দেখছে সবুজের কার্যকলাপ,,,

কি ব্যাপার দাদা,,এই ভাবে সাজুগুজু করছো ক্যানো? তোমার নাকি ক্লাসের দেরী আজ? কৌতুহলী মধু।

সবুজ প্যান্টের ভেতর থেকে সবে গামছাটা টেনে বের করছে তখনি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।দ্রুতহস্তে প্যান্টের জিপার টেনে নিয়ে বললো সবুজ,,যা না ভাই মধু দরজাটা খুলে দে।স্বচ্ছ অনুরোধ রুমের বড়ভাইয়ের। তারচেয়ে বড়ো ব্যপার হলো মধু কথাটায় যেনো এক বালতি মধু উপড়ে পরলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে গেলো মধু।তারও আনাড়ি কৌতুহল কম নয়। দরজার ও পাশের আগন্তুককে দেখে নিজের পরনের লুঙ্গির দিকে তাকালো একপলক।সেটা হাঁটুর উপর গিট দিয়ে বেঁধে রাখা। লজ্জিত মুখে গিট খুলতে খুলতে মৃদু হেসে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিলো আগন্তুককে। বিনিময়ে মিষ্টি হাসির ঝলক উপহার দিয়ে সটান নিসংকোচে ঘড়ে ঢুকলো নিরুপমা জুতায় খট খট শব্দ তুলে। এখানে যে গোটা কতক যুবক ছেলের বাস তার কোনো জড়তা নেই তারমধ্যে,,
অখিলেশ নিজের মনে কবিতা আবৃত্তি করছিলো। অত্যধিক আধুনিক পোশাক পরিহিতা নিরুপমাকে দেখে টনক নড়লো তার।মনের মধ্যের কবিত্ব রসবোধ উধাও হয়ে সেখানে বিরক্তির চেয়ে রাগটাই বেশি হলো মেয়েটার নির্লজ্জতা দেখে।ক্যাম্পাসে জ্বালিয়ে সুখ হয়না তার, সরাসরি ব্যাচেলরদের ম্যাচে আসতে হলো? এখানকার লোকেরা কি ভাববে?নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের ম্যাচ বাড়ি এটা।এখানে কাজের চেয়ে পরনিন্দা পরচর্চা বেশিই হয়। অতিরিক্ত রসবোধ কি না এদের।এই সংবাদ টাও রসের হাঁড়িতে এতক্ষণে হয়তো জমা পরে গেছে।এতদিনের সভ্য, সৎচরিত্র অখিলেশকে কি ভাববে সবাই?হায় ভগবান,,, মেয়েটা আমার মান সম্মান নিয়ে তবে ছাড়বে।মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে অখিলেশ। হঠাৎ খেয়াল হলো নিজের পরিধেয় বস্ত্রের দিকে। এবার অখিলেশ এর ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করছে জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে।একটা পুরোনো রঙ জ্বলা গামছা পরে আছে শুধু। মেদহীন শরীরের ফর্সা ত্বকে বুকের উপর ঘন কালো পশম গুলো না থাকলে হয়তো পাঁজরের হাড়গুলো গুনে বের করা যেতো।অখিলেশের সামনেই শহীদের সিংগেল খাটের ছোট্ট বিছানা। সেখানেই পায়ের উপর পা তুলে বসে মিট মিট করে হাসছে নিরুপমা। দৃষ্টি নিবদ্ধ অখিলেশে।হাই হিলের উপরে হাঁটুর উপর পর্যন্ত মসৃন ধবধবে সাদা পা দুখানি দৃশ্যমান নিরুপমার।যা দেখে চোখ দুটো ধক করে জ্বলে ওঠে অখিলেশের।

সে এমনিতে ভালো,শান্ত মেজাজের ছেলে কিন্তু একবার রেগে গেলে ভালো মন্দ জ্ঞান থাকতো না ওর। সেদিন চরম ভাবে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো নিরুপমাকে। রুমের ঐ কটা ছেলের সামনেই অতটা অপমান সহ্য হয়নি নিরুপমার। আর অখিলেশের সামনে আসেনি বেশ ক’দিন। কিন্তু কথায় আছে না দূরত্ব বাড়লে গুরুত্ব বাড়ে।অখিলেশের মধ্যে মন নামক যে বস্তুটি ছিলো তা শর বেঁধা পাখির মতো ছটফট করতে শুরু করেছিলো নিরুপমার অসহ্যকর বিরক্তিগুলোর অভাবে। কিন্তু নিরু তো ভার্সিটিতে ও আসতো না। অখিলেশ সারাদিনে তাও দুই বেলা খেতো।ঐ কদিন তার থালার ভাত কড়কড়ে হতো,পাতলা ডাল পরে থাকতো বাটির তলাতেই। অকারণে ক্ষয় করতো চটি জুতোর তলা।এদিক ওদিক নির্বিকার ঘুড়াঘুড়ি। বিরূপাক্ষ আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকায় অতটা জানতো না। একদিন অখিলেশের রুমমেট সবুজ ফোনে জানায় কথাটা। বিরূপাক্ষ ততক্ষনাৎ ফোন করে নিরুর মোবাইলে কিন্তু ফোন রিসিভ করে নিরুর মা অনিতা দেবী। তিনি জানান নিরু গতকালই হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরেছে। প্রচন্ড জ্বর আর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে নিরুকে হসপিটালাইজড করা হয়েছিলো এবং আই,সি,ইউ তে ছিলো চারদিন।
অখিলেশ শুনতেই উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়েছিলো নিরুদের বিলাসবহুল বাড়িতে জীবনে প্রথমবারের মতো।সাথে ছিলো বিরূপাক্ষ ।অখিলেশের পাগলপনা দেখে বিরূপাক্ষ মুচকি হেসে ওর কাঁধে হাত রেখে শুধু বলেছিলো,,,বন্ধু,,চুল দাঁড়ি রেখে দেবদাস গিরি তোমার ঘুঁচলো তবে,,,

সেই থেকে অখিলেশ নিরুপমার দ্বৈত প্রেমের যাত্রা শুরু।তারপর থেকে নিরুকে আর ওয়েস্টার্ন পোশাকে দেখেনি কেউ।দামি গাড়িতে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে আসেনি আর নিরু।দামী রেস্টুরেন্ট এর বদলে অখিলেশের সাথে গিয়েছে সস্তা ছা-পোষাদের হোটেলে।একে একে নিজের সবটুকু দিয়েছে অখিলেশকে,অখিলেশের অনিঃশেষ ভালোবাসার মধ্যেও সামান্য হীনমন্যতা কাটাতে নিজেকে প্রমাণ করেছে সর্বস্ব দিয়ে,পেয়েছেও কম নয়। জীবনের সর্বাধিক অমূল্য সম্পদ টুকু যে অখিলেশের দেওয়া। একজীবনের সবটুকু প্রত্যাখ্যান অখিলেশ দিয়েছে,সাথে নারীত্বের অপমান ফ্রি।যে ফুলটা মালা গেঁথে অতি যত্নে বুকে রাখার কথা ছিলো তা পায়ে দলেছে একটা অযথা বাহানায়।আসলেই কি অখিলেশ নিরুকে কখনো বুক থেকে সরাতে পেরেছে?যে বুকে একটু আশ্রয়ের জন্য নীরু আজো আশ্রয়হীনের মতো ঘুরছে। রাতের নিকষ কালো আঁধারের সাথে নিজের রং হীন অশ্রুর মিলকরণ করছে!তক্কে তক্কে দগ্ধ হয়ে মরছে।
মানব জীবনে কতই না রঙের ব্যাবহার। কিন্তু কালো রঙের ব্যবহার টা না করলে কি সৃষ্টিকর্তার চলতো না।কই রঙধনুর সাতটি রঙেও তো কালো রঙটা নেই। সেখানে কালোটা জুড়ে দিয়ে মানুষের জীবনে সর্বক্ষনিক আলোটা অব্যহত রাখতে পারতেন না তিনি?তাহলে হয়তোবা আলোর মর্ম উপলব্ধি হতো না ঠিক ভাবে।

*******
অখিলেশ বুটিকহাউসের মেইন কাজের জায়গায় দাঁড়িয়ে কাজ দেখছে মহিলাদের।সুমি মেঝেতে বসে কি যেন করছে। রুমের দরজায় একটা লম্বা চওড়া অবয়ব দেখে হাতের কাজ থামিয়ে থম মেরে গেলো কয়েকজন মহিলা।সুমি তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে দাঁড়িয়ে গেলো সসম্ভ্রমে।
আরেহ্,, আমাদের রূপ কুমার যে?কি ব্যাপার বলতো? অখিলেশ উক্তিটি করে এগিয়ে গেলো বন্ধুর দিকে।

এইতো চলে এলাম। এখানে যে এত সুন্দর কাজ হয় জানতাম না তো।বললো বিরূপাক্ষ।

দাদা ক্যামন আছেন?সুমি উঠে এসেছে।

হ্যা ভালো আছি।তো তোমাদের কাজকর্মগুলো দেখতে পারি তো নাকি সুমি?

সে কি কথা দাদা? আপনি দেখবেন,তাও আবার অনুমতি নিয়ে? আসুন ভেতরে।
অখিলেশ দা আপনি একটু ঘুড়িয়ে দেখান প্লিজ।
বড়ো বড়ো তিনটি রুমে এই বুটিকের কাজ গুলো হয়। অখিলেশ বিরূপাক্ষকে নিয়ে শেষের রুমটায় ঢুকতেই চাপা গুঞ্জন শোনা যায়।কয়েকটা মেয়ে বিরূপাক্ষের দিকে আড়চোখে চেয়ে মিট মিটিয়ে হাসছে।ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বিরূপাক্ষ এগিয়ে যায় সেদিকে। নির্লিপ্ত গলায় হেসে বলে ,,,,কি ব্যাপার তোমরা এইভাবে হাসছো ক্যানো?আমাকেও বলো।
মেয়ে কটি অপ্রস্তুত হয়ে পরে।জড়সড় হয়ে দাঁড়ানো দেখে বলে বিরূপাক্ষ,,,এত সংকোচের কিছু নেই।বলে ফ্যালো তো, আমিও একটু যোগ দেই তোমাদের হাসিতে।

একেতো বয়সে অনেক ছোট মেয়েগুলো তায় আবার সামনে স্বয়ং বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী দাঁড়িয়ে।তার গল্প কমবেশি সবাই ভালো করেই জানে।যারা কখনো দেখেনি তারাও আজ দেখে নিচ্ছে বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী কে।সব চেয়ে বড় কথা এই লোকটাই তাদের ফেরেশতার মতো রিতি আপাকে বিয়ে করে মেনে নেয়নি।
মেয়ে গুলোর অসহায়ত্ব বুঝে পাশ থেকে একজন বয়স্ক মহিলা বললেন,, আপনে আমাগো রিতি আফার বর।তাই অরা এমনে দেখতেছে।বিরূপাক্ষের হাস্যোজ্জল মুখটা হঠাৎ করে ফুটো বেলুনের মতো চুপষে গেলো।মনে মনে আওড়ায়,,ওহ্ মাই গড,,এখানেও রিতি আফা?জাস্ট আনবিলিভেবল।

কথায় আছে সুন্দর কিছু দেখলে বা শুনলে মনের মধ্যের অসুন্দর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তেমনি রিতির উল্লেখ হতেই বিরূপাক্ষের মধ্যে যেরূপ একটা বিতৃষ্ণা ভাব উদয় হয়েছিলো, এখানে গ্রাম্য মেয়ে ও নারীদের করা অতি সূক্ষ্ম এবং সুন্দর হাতের কাজের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের কাছে তা বিলীন হলো এক লহমায়।বিরূপাক্ষ প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে নিজের মধ্যের অনুভূতি গুলো প্রকাশ করছে বন্ধু অখিলেশের কাছে,,,
বন্ধু,, এখানে যে এত ভালো হাতের কাজ করা হয় বুঝিনি তো!আমি বিশ্বাস করতে পারছি না বিশ্বাস কর।

অখিলেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসে।একটু আগে রিতির কথা শুনে বিরূপাক্ষের মুখের ভাবটা তার দৃষ্টি এড়ায়নি।

এতো অল্প কিছু রূপ,, জনপ্রিয়তার শীর্ষে যে বস্ত্র গুলো।মহিলারা বাহারী সুতায় করেছে সেগুলো বাক্সবন্দী হয়ে গেছে।কাল পরশুর মধ্যে সেল হবে। দেশের বড়ো বড়ো শহরের দেশীয় বস্ত্রের মলগুলোতে এখানকার হাতের কাজ করা কাপড়ের চাহিদা ব্যপক বেড়েছে জানিস? শুধু এইটা না ওদিকে তাঁত বস্ত্রের গুনগত মান ও অন্যান্য গুলোর চেয়ে ভালো। শুনেছি এই জানুয়ারি থেকে ইন্ডিয়াতে ও রপ্তানি করা হবে।সে ব্যবস্থাও চলছে।
অখিলেশের মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে দেখায়।এ কয়দিনেই জায়গাটাকে আপন করে ফেলেছে সে।

বিরূপাক্ষ হা করে শুনছিলো সব।সে জানতো না এতকিছু।এ যেনো রূপকথার গল্প সব।ক বছরেই গ্রামটা সত্যিই অনেক উন্নত হয়েছে।

কিন্তু অখিল তোদের মালিককে তো দেখলাম না কোথাও? সেদিন দাদাভাই বললো মায়ের নামের প্রতিষ্ঠানটি হলেও তারা কেউ মালিক নয়? তিনি কি এখানে আছেন এখন?দেখাটা করেই যাই কি বলিস?একটা ধন্যবাদ তো তাঁকে দিতেই হবে। আমার মায়ের নামে এত কিছু করছে। একপ্রকার জনসেবামূলক কাজ তো বটে।হাসছে বিরূপাক্ষ। অখিলেশ পরেছে মহাবিপদে।রূপকে যে বলা নিষেধ।

কথাটা তুই সত্যিই বলেছিস রূপ।এটা কারো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হলেও এখানে রঙিন কাপড়ের উপর সুতোর বুননের মতো অসহায়, দরিদ্র পরিবারের নারী ও মেয়েরা তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর স্বপ্ন বুনে চলে। কথাটা ঘুরিয়ে নেয় অখিলেশ।

আপনার মাকে, মানে মাসিমাকে অনেক শ্রদ্ধা করে ভালোবাসে সে আর মাসিমাও তাকে খুব স্নেহ করেন তাইতো স্নেহের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করছে তাঁর নামে এসব করে। চলুন অখিল দা একটু চা জলখাবারের ব্যবস্থা হয়েছে।বললো সুমি।

অফিস রুমে বসার ব্যবস্থা হয়েছে তার। ছিমছাম সাধারণ একটা অফিস ঘড়ও যে এতটা ভালো লাগতে পারে বিরূপাক্ষের জানা ছিলো না।ঘড়ে মাত্র দুটি চেয়ার থাকায় তাকেই বসতে দিলো রিতির চেয়ারে। বিরূপাক্ষ ঘোর আপত্তি ধোপে টিকলো না।বসতেই হলো সেখানে। অতঃপর ফ্লাক্স থেকে গরম চা এবং প্লেটে কিছু বিস্কুট কেক দিয়ে চললো অতিথী আপ্যায়ন।

তাহলে সুমি,, তোমাদের মালিকের সাথে দেখা হবে না বুঝি?আক্ষেপ করে বিরূপাক্ষ।

ক্যানো হবে না দাদা,,মন থেকে চাইলে সবই হয়।তবে কথা হলো তিনি তো তেমন একটা এখানে আসেন না। কর্মচারীবৃন্দের উপর তার অগাধ বিশ্বাস কি না।যেমন আজকাল আমার আর অখিলদার উপর সব ছেড়ে ছুড়ে নিশ্চিত আছে।নিজে আছে স্বামী সংসার নিয়ে।কাজ তো আর কম নয় তাঁর। নিজের বেফাঁস কথায় জিভ কাটে সুমি।বিরূপাক্ষের পুরু লালচে ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি।

ও তাহলে তোমরা সব মালিক নয়,মালকিনের অধীনে আছো? ভালো ভালো।ফিচেল হেসে বলে বিরূপাক্ষ।কথায় কথায় চললো বেশ খানিকক্ষণ। বিরূপাক্ষ চেয়ারটাতে যেনো এটে সেঁটে গেড়ে বসেছে, উঠার নাম গন্ধ নেই। এদিকে বার বার হাতের ঘড়িতে সময় দেখছে সুমি।রিতির আসার সময় যে ঘনিয়ে এলো।কি হবে যদি বিরূপাক্ষের মুখোমুখি হয় এখানে? লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প কোথায় যাবে তখন?

অখিলেশ,সুমি যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই ঠিক হলো দরজায় দেখা দিলো রিতির চাদঁপনা মুখটি।ওকে দেখে ভেতরের তিনজন যেমন চমকে উঠলো, তার চেয়ে বেশী চমকালো,থমকালো রিতি বিরূপাক্ষ কে তার চেয়ারে বসা দেখে।মনের মধ্যে সুখের পাখিটা ডানা ঝাপটে উড়ে গেলো দূরে কোথাও। এতদিনে আসনখানা তার যোগ্য সঙ্গী পেয়েছে।অতি বিচক্ষণতার সাথে ডাকলো রিতি,,,সুমি একটু দরকার ছিলো বলেছিলাম না তোকে আসবো বিকেলে?আসবি একটু এদিকে?
সুমি যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো,,,

হ্যা হ্যা বল।চল ওদিকে যাই।সুমি দ্রুত হেঁটে বেরিয়ে গেলো রিতিকে নিয়ে। একেবারে পৌঁছালো শেষ সীমানায় স্টোর রুমের বারান্দায়।যেখানে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় প্রস্তুত কৃত সবকিছু।

*****
রিতি যেদিন বিরূপাক্ষের রুম ত্যাগ করেছে সেদিন থেকে রাত হলেই বিরূপাক্ষ ব্যস্ত হয়ে পরে বনলতাকে নিয়ে। গভীর রাত পর্যন্ত ব্যলকনিতে মানুষের গন্ধ থাকে।মৃদু স্বরে কথার আওয়াজ শোনা যায় বাইরে থেকেও।
একদিন তো জয়া বলেই বসলো সবার সামনে,,,কি ব্যপার ভাই আজকাল তোমার ব্যলকনিতে গভীর রাতে পুরুষ ভূতের হাসির আওয়াজ পাচ্ছি?রিতি ডাইনিংয়ে সবে জলের গ্লাসটা মুখে ধরেছিলো সাথে সাথেই জল তালুতে উঠে মরি মরি অবস্থা। ভীষণ বিষম খেয়ে কাঁশতে কাঁশতে শেষ। বিরূপাক্ষ বাঁচলো সে যাত্রায় সবাই ব্যস্ত হয়ে পরলো রিতিকে নিয়ে।জয়া অবাক হয়ে ভাবলো মনে মনে,,এর আবার কি হলো?একজনেরটা অন্যজনে ট্রান্সফার? দারুন!

******
নিশুতি রাত।আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। চারিদিকে ঘন কুয়াশার কুন্ডলী পাক খেয়ে চলেছে।একটা পাতলা সোয়েটার পরে ব্যালকনির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিরূপাক্ষ।শীতল বাতাসের হালকা ছোঁয়া গায়ে কাঁটা দিচ্ছে মাঝে মাঝে, বুকের মাঝে চাপা উত্তেজনা। মুঠোফোনটা বাঁ কানে নিয়ে কথা বলছে সে। একজনের কন্ঠঝংকার অন্যজনকে শিহরিত করে তুলছে মাঝে মধ্যে।
বিরূপাক্ষ এবং বনলতা নিত্যরাতের মতো আজো ফোনাভিসারে কান ভাসিয়েছে।

আমার কথা আপনার মনে পরে না তাই না? আবদারে পূর্ণ স্বর ওপাশে।

বিস্মৃত হলে তবে তো মনে পরবে।ভুলতেই যদি না পারি তবে মনে করবো কোথা থেকে বলো?আবেগী গলায় বলে ওঠে বিরূপাক্ষ।
শুনছো বনলতা? আছো তো? পুনরায় বলে।

হুম,,হ্যা আছিই তো, বলুন না?মৃদু স্বরে বলল বনলতা

একটা আবদার রাখবে প্লিজ?না করো না বনলতা।

ঐ একটি কথা বাদে আর যা বলবেন শুনবো আমি বলুন!বললো বনলতা।

আমি আমার বনলতাকে কল্পনা থেকে বাস্তবে রূপ দিতে চাই। একটি বার দেখা করা যায় না? একবার সামনে আসতে বাধা কি?

বিরূপাক্ষের অনুনয়ে মন গলে বনলতার।

কবে দেখা করতে চান বলুন?

বিরূপাক্ষের যেনো বিশ্বাস হতে চায় না তার ইচ্ছেতে বনলতার সায় দেখে,,,,

সেটা নাহয় তুমিই ঠিক করো তোমার সুবিধা মতো।কাল,পরশু অথবা আর দু একটা দিন পরে?

এত তাড়া রূপ কুমার? বনলতার নিচু শব্দের হাসি বিরূপাক্ষের কানের পর্দা ভেদ করে বুকের মাঝ বরাবর গিয়ে থামে।সেখান থেকে ঠিক বাঁয়ে মোড় নেয়।

হা হা হা,,এই নামে ক্যানো ডাকো আমায়? নিজেকে রূপকথার রাজ্যের রাজকুমার মনে হয় যে।বাকী রইলো তাড়ার কথা?সে তো আরেক ঝামেলা,,স্বনামে বেনামে দুই দুটো বৌ যার সে এখনো একা একা ঘুমায় ভাবতে পারো তুমি?মাঝে মধ্যে ভার্জিনিটির সমাপনী ঘোষনা করতেও স্বাধ জাগে জানোতো?বয়স তো গেলো প্রায়।
রসিকতার ছলে কথা গুলো বললেও ওপ্রান্তে বনলতার মৃদু হাসির ঝংকার আর শোনা যায় না।হাসির বদলে এক দীর্ঘশ্বাস এর হা হুতাশ সেখানে।বিরূপাক্ষ বিচলিত হয়ে পরে তার অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য।
আসলে দিনের আলোয় মানুষ মনে জমে থাকা যে কথা গুলো বলতে পারে না অস্বস্তিতে সেই কথা গুলোই আবার আবেগে জর্জরিত হয়ে নিশুতি রাতে অনর্গল বলে যেতে পারে।

বনলতা আমি কি তোমায় আঘাত দিয়ে ফেললাম?কষ্ট পেলে?শঙ্কাযুক্ত স্বর বিরূপাক্ষের।

নাহ্।কষ্টকে আমি যেচে পরে আলিঙ্গন করে চলেছি।এতে কারো দ্বায় নেই।এতো অবশ্যম্ভাবী।

আমার কিন্তু সত্যিই খারাপ লাগছে বনলতা।অযথাই কষ্ট দিলাম তোমায়।আচ্ছা এরপরে আর,,,,
কথা শেষ করতে দেয়না বনলতা,,শ্লেষের হাসি হেসে বলে,,,,
এত বিচলিত হওয়া মানায় না আপনাকে,, “আপনি তো দস্যু বনহুর। আপনার একপাশে নূরী অন্যপাশে মুনিরা”
পার্থক্য শুধু নিঃসঙ্গ নিশীথে শয্যাসঙ্গী কেহ নাই। শব্দ করে হাসে বনলতা। অন্ধকারে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ভ্রু চুলকে নেয় বিরূপাক্ষ।ভাবটা এমন যেনো, এখনি তাকে নতুন আলট্রা মডার্ন ডিজাইনের একটা পোশাকের ডিজাইন করতে হবে।তথাপি মৃদু হাসি তার মুখেও,,,

তোমার এই দস্যু বনহুর কে?যার একপাশে নূরী অন্যপাশে মুনিরা?

হাসির শব্দ প্রলম্বিত হয় বনলতার,,,

একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রোমেনা আফাজ কর্তৃক সৃষ্ট এক বিশেষ চরিত্রের নাম বনহুর। একজন দস্যু কিন্তু তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক।গরীব দুঃখী মানুষের বন্ধু আর অসৎ,পাপীদের যমদূতের মতো।অন্যদিন বলবো আপনাকে।আজ থাক।

আচ্ছা।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পাশের আরাম চেয়ারে বসে পরে বিরূপাক্ষ। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পা দুটো ব্যাথায় গাঁট হয়ে আছে তার।

আরো কিছুক্ষণ চলে ফোনালাপ।রাত বাড়ে সাথে বেড়ে চলে দুইপ্রান্তে দুজন মানব মানবীর হৃদস্পন্দন।
কথা শেষে নিজের অজান্তেই মোবাইলটা বুকের বা পাশে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে বিরূপাক্ষ।ভাবনারা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে মস্তিষ্কের ভেতরে। বনলতার কন্ঠে সে স্পষ্ট অভিমান,ক্ষোভ টের পেয়েছে রিতির প্রতি। কিন্তু রিতি তো কখনো এমন মনোভাব পোষণ করে না বনলতার প্রতি।তবে কি স্বামীর ব্যাপারে সব মেয়েরাই একটু হিংসুটে হয়?রিতি তো তাকে স্বামী মানে না,সেজন্যই বোধহয় বনলতার জন্য তার হিংসে হয় না। নিজের মনকে এভাবেই প্রবোধ দেয় বিরূপাক্ষ। কিন্তু রিতি কে যে একটি বার দেখতে ইচ্ছে করছে ভীষণ,,,সন্ধ্যা থেকে দেখা মেলেনি মহারানীর।যে ভাবা সেই কাজ,,উঠে ছুটে যায় রিতির ঘড়ের সামনে। দরজায় কান পাতে খুব সতর্ক হয়ে।ঘুমন্ত মানুষের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ। ফিরতি পা বাড়ায় বিরূপাক্ষ কিন্তু মনটা ভীষণ জেদি হয়েছে আজকাল তার যে রিতির দর্শন চাই ই চাই।হালকা ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে যায়,যাক কপাল ভালো।ওপাশ ফিরে মাথার নিচে বাঁহাত টা দিয়ে ঘুমাচ্ছে রিতি, ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বিরূপাক্ষ।রিতির সামনে গিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। জ্বালিয়ে রাখা ড্রিম লাইটের হালকা আলোয় অপরূপ লাগছে রিতিকে তারচেয়ে বেশী লাগছে নিস্পাপ। বিরূপাক্ষের মনে এখন কেউই নেই বোধহয়। চোখের তারায়,পাতায় এবং মণিতে শুধুই রিতি।একগাছি চুল কপাল বেয়ে নাকের উপর পরে আছে রিতির। বিরূপাক্ষ আনমনে হাত বাড়িয়ে সেগুলো সরিয়ে দিতেই নড়ে ওঠে রিতি।ঘোর কাটে তখনি আর মন মহাশয়ের জেদের ও পরিসমাপ্তি ঘটে।বেডের পাশে ছোট্ট টেবিলে রিতির ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠতেই বিরূপাক্ষের দৃষ্টি তার দিকে পরে। রাহুলের নম্বর থেকে মেসেজ এসছে। সেখানে লেখা,,,

পরিকল্পনা কতদূর এগোলো রিতি।আমি যে তোমার গ্রীন সিগন্যাল এর অপেক্ষায় আছি।আর দেরী সইছে না।

চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে পরে বিরূপাক্ষ।প্রবল শক্তিতে হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে অগ্নিচোখে তাকায় রিতির ঘুমন্ত মুখের দিকে।
মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,,কি পরিকল্পনা করেছে এরা?কি এদের অভিসন্ধি?জানতেই হবে।

চলবে,,,,

উপন্যাস :হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব:৩১

ও মা,নে এবার একটু ছাড়তো আমায়।নিজে কাপড়টাও ছাড়িসনি।হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নে মা। (কথাগুলো অন্নপূর্ণা দেবী বললেন রিতিকে।)

পেট আমার খিদে তোমার লেগেছে? এবার পা টা নাড়িয়ে দ্যাখোতো ব্যাথা কমেছে কি না?
ভেষজ গাছ গাছালির তৈরী তেল মালিশ করছে রিতি অন্নপূর্ণা দেবীর পায়ে। দুপুরে বাথরুমে পা পিছলে পরেছিলেন।বা পাটা সামান্য ফুলেছে।

এইতো নড়ছে । তুই যা তো এখন।একটু কিছু মুখে দে। নিজের পা নাড়াতে লাগলো অন্নপূর্ণা দেবী।

রিতি বিরক্ত সূচক শব্দ করে মুখ দিয়ে,,,

অত নেড়ে চেড়ে দেখাতে হবে না।আমি জানি তুমি জোর করে করছো।কতটা ফুলেছে আর ব্যাথা হয়নি? তুমি বললেই মানবো আমি?
কি যে তুমি করো না বড়ো মা,একটু সাবধানে চলবে তো নাকি?

শুধু শুধু মুখ চালাস নে।এখনো ডাক্তার হোসনি যে,দেখেই সব বুঝে যাবি। আমার কিন্তু রাগ হবে।মধুর হাসি তাঁর মুখে অথচ কন্ঠে ছদ্ম উষ্মা।

আর ডাক্তার! পড়াশোনা এরকম চললে কম্পাউন্ডার ও হতে পারবো না দেখো।

এত মুখ চললে পড়াশোনা হবে কি করে বল?একই ভাবে বললেন অন্নপূর্ণা দেবী।

রিতিও হাসে,,,আমি শুধু মুখ চালাই না।হাত ও চলছে দেখো না।আর রাগ করবে বেশ কথা।এত হাসতে হবে ক্যানো হ্যা?মুখ রাখবে গম্ভীর।হি হি হি

নিজের চালাকি ধরা পরায় রিতিকে টেনে নেন নিজের কাছে। রিতির অগোছালো চুলে বিলি কেটে বলেন,,তুই ভালো করেই জানিস তোর সাথে রাগ করতে পারি না আমি, তাইতো দিনে দিনে এত খামখেয়ালি পনা দেখাচ্ছিস বল?
বড়োমার বুকে মাথা রেখে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো রিতি।লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বললো,,, খামখেয়ালি পনা তোমরা সবাই দেখিয়ে চলেছো তোমার ছেলের সাথে।তার ভুক্তভোগী হচ্ছি আমিও। ছেড়ে দাও না তার মতো করে। শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছো!তার যেথায় সুখ সেথায় যাক না?

সে যদি যেচে পরে কষ্ট পায় তো তার দ্বায় আমাদের নয়।রইলো বাকী তোর কথা?তুই এখানে আমার কাছে থাকবি। দরকার নেই আমার অমন ছেলের যেখানে যায় যাক।
গম্ভীর গলায় বলেন অন্নপূর্ণা দেবী।

রিতি অনুধাবন করে, আগের রাগটা ফেইক হলেও বড়োমার এই গাম্ভীর্য অভিনয় নয়।

নিজের ছেলেকে দূরে সরিয়ে অন্যের মেয়েকে কোলে টানছো ক্যানো বড়োমা? তুমি জানো না এক গাছের ছাল অন্য গাছে কখনোই লাগে না।আমি কি তোমাকে তোমার ছেলের মত ভালোবাসতে পারবো?

এক গাছের ছাল অন্য গাছে লাগে না ঠিকই কিন্তু এক গাছের কলম অন্য গাছে লেগে কত সুন্দর ফুল,ফলে ভরিয়ে দেয় দেখিস নি?

দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে রিতি। এদের বুঝিয়ে লাভ নেই।
****
আমির শেখের বৈঠক খানায় থমথমে পরিবেশ।পিনপতন নীরবতা যাকে বলে ।একটা মাছি পরার শব্দও নেই সেখানে।স্বয়ং প্রভাকর রায় চৌধুরীর পদধূলি পরেছে। চাট্টিখানি কথা নয়।নানা ধরনের ফল,ফলাদি এবং শুকনো খাবারের প্লেট ভর্তি করে রাখা হয়েছে সামনের টেবিলে।একপাশে প্রভাকর রায় চৌধুরী বসে আছেন, পাশের চেয়ারে রঘুনাথ ।চোখ দুটো তার রক্ত জবার রং ধার করে এনেছে।রঘুনাথের ক্রুর দৃষ্টি ঘুরছে আমির শেখের আশে পাশের লোকজন এর প্রতি। সেখানে মুখ নিচু করে লিকু সরদার দাঁড়িয়ে।

টেবিলের অন্যপ্রান্তে আমির শেখ বসে আছে অত্যন্ত মার্জিত ভঙ্গিতে।প্লেটের খাবার ছুঁয়েও দেখলেন না প্রভাকর রায় চৌধুরী। নিজের ভেতরের আভিজাত্য পূর্ণ সেই গমগমে সুর বের করলেন যে স্বরের ভয়ে শত্রু পক্ষের হৃদয় প্রকম্পিত হয়।যে সুরে হাজারো মানুষ তাদের আস্থা,ভরসা খুঁজে পায়।

কি হে আমির,,এত জরুরি তলব ক্যানো?সেধেই শত্রু পক্ষকে সাদর সম্ভাষণ?তা,, জরুরী কথাটা বলার জন্য তোমার আরো সময় চাই?আমি কিন্তু অত সময় দিতে পারবো না।
গলায় গম্ভীরতা থাকলেও ঠোঁটে সুদৃঢ় তাচ্ছিল্য ভরা হাসি হাসি।

আমির শেখ নড়ে চড়ে বসলো। নিজের সার্বক্ষণিক হাসি ঠোঁটের কোনে লেগেই আছে তার,,,

মি:রায় চৌধুরী, আপনি যে আমার আমন্ত্রণ রক্ষায় আপনার মূল্যবান সময় ব্যয় করলেন তার জন্য আমি চির কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি।

ভ্রুদ্বয় মৃদু কুঞ্চন করে তাকালেন প্রভাকর রায় চৌধুরী,, ঠোঁটের হাসি অব্যহত রেখে বললেন,, তোমার আমন্ত্রণ রক্ষার্থে এসেছি কি না জানি না।তবে হ্যা নিজের স্বার্থ রক্ষায় মাঝে মধ্যে শত্রুর গুহায় প্রবেশ করতেই হয়।

***
আসবো রূপ? দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি চায় অখিলেশ।

আমার রুমে প্রবেশ করতে তোর পারমিশন লাগবে?

আগে একবার এসেছিলাম, ফোনে কথা বলছিলি তাই বিরক্ত করিনি।বিরূপাক্ষের পাশে বসে অখিলেশ।

কি রে আপসেট লাগছে তোকে?কিছু কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো অখিলেশ।

নাহ! তেমন কিছু না।তিতলির সাথে কথা হলো।উদাস সুরে বলে বিরূপাক্ষ।
অখিলেশ যেনো নিভলো একটু।বিরূপাক্ষের প্রতি তিতলির একতরফা ভালোবাসার প্রতক্ষ্যদর্শী সে নিজেই।একসময় মনে হতো বিরূপাক্ষ ও বুঝি তিতলিকে ভালোবাসে।এমনকি বন্ধুমহলে বা কলেজ পাড়ায় কথাটা বেশ আড়ম্বরের সাথেই আলোচিত হতো। বিরূপাক্ষ হেসে উড়িয়ে দিলেও তিতলি সেই আলোচনা, সমালোচনা সাদর সম্ভাষণে কুড়িয়ে নিতো।

হ্যা!আমাকেও কল করেছিলো কিন্তু ধরতে পারিনি।কি হয়েছে বলতো? এখন ফোনে পাচ্ছি না। বললো অখিলেশ।

ওর আশির্বাদ হয়ে গিয়েছে কাল। সামনের মাসে বিয়ে।ছেলে আমেরিকা সেটেলড্।বৌকে সেখানেই নিয়ে যাবে।

এত সহজে রাজী হয়ে গেল তিতলি? অবাক হয় অখিলেশ।

কিছুক্ষণ আগে,,,
বনলতার সাথে কথা শেষ করেই দেখলো বিরূপাক্ষ তিতলির পনেরো টা মিসড্ কল।কলব্যাক করবে তখনি পুনরায় রিং বাজে।

হ্যা তিতলি বল ক্যামন আছিস?

যাক অবশেষে পেলাম তোকে!লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বললো তিতলি।

সরি রে।আমি কথা বলছিলাম। তারপর বল।বললো বিরূপাক্ষ।

রূপ গতকাল আমার এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেলো।বয়স তো কম হলো না।বাড়ি থেকেও চাপ দিচ্ছে কি করবো বল?

বিরূপাক্ষের বুকের ভেতর ক্যামন যেনো খচ করে উঠলো। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সহাস্যে বললো,,, অভিনন্দন দোস্ত!এত ভালো একটা খবর তুই আজ দিচ্ছিস আমাকে?তোর তো শাস্তি পাওনা হয়ে গেলো রে!রেডি থাকিস।উচ্ছাস প্রকাশ করে বিরূপাক্ষ।

আমি তোকে খুব ভালোবাসি রে রূপ!গলা ধরে আসে তিতলির।
বিরূপাক্ষের উচ্ছাসে ভাঁটার টান।ওপাশে তিতলির নাক টানার শব্দ।

তিতলি প্লিজ!তুই আমার সবকিছু জেনে বুঝেও একথা বলছিস?আমি হয়তো তোকে ঠিকঠাক বুঝিয়ে উঠতে পারিনি।
বিরূপাক্ষের কোমল স্বরে ওপ্রান্তে ফোঁপানির আওয়াজ বাড়ে। কিছুক্ষণ কাটে মৌনতায়।

কি বুঝিনি বল?বুঝেছি বলেই নিজের এমন জীবন্ত মৃত্যু মেনে নিয়েছি। কখনো নিজের ভালোবাসার টানে আর আবেগের বশে যাতে তোর পথে বাঁধা হয়ে না দাঁড়াই তার জন্য এই ব্যবস্থা।আমিও মানুষ রূপ।কখনো যদি সহ্য করতে না পেরে তোকে আবার চেয়ে বসি?এই ভয় থেকে বাঁচতে আজ শূন্য মনে অন্য একজনের ভবিষ্যত এর দাম্পত্য জীবন আঁধার করতে চলেছি।তারপরেও বলবি আমি বুঝিনি তোকে?
আমি মরলে কোথাও না কোথাও তুই অপরাধবোধে ভুগবি রে।নইলে আমার কষ্ট রাখার জায়গা নেই।কবেই জীবন থেকে মুক্তি নিতাম!কান্নায় কন্ঠ রোধ হয়ে আসে তিতলির।

তিতলি,,বাবু শোন আমার কথা প্লিজ!এমন করিস না।দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে একসময়।

রূপ এখনো সময় আছে।একটু ভাবলি না আমার কথা। এতকিছু জানিস বুঝিস।এত বুদ্ধি তোর। একবার ভাবলি না আমি যে তোকে ছাড়া রিক্ত,নিঃস্ব, শূন্য।কান্নায় ভেঙে পড়ে তিতলি। বিরূপাক্ষ নির্বাক।যেদিন কুয়াশা মোড়ানো হিমশীতল নিশিতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে বিরূপাক্ষকে প্রথম এবং শেষ বারের মত প্রেম নিবেদন করে বিনিময়ে প্রত্যাখ্যান পেয়েছিলো তিতলি সেদিনো এভাবে কাঁদেনি মেয়েটি।
বিরূপাক্ষ অপেক্ষা করে ক্ষনকাল।বুকটা তারও হু হু করে ওঠে।কিছু না হোক বন্ধু তো। ধাতস্থ হতে সময় দেয় তিতলিকে।মেয়েটা এতটাও দূর্বল নয় জানে সে। কিন্তু হৃদয় যেখানে ভেঙে চুরমার সেখানে মনের জোর থাকে কি করে?

শোন রূপ আমি তোর পিছু ছেড়েছি তোর ঐ জংলি লতাপাতার জন্য নয়।রিতি মেয়েটা খুব ভালো।ওকে তুই ঠকাস নে প্লিজ।যাকে চিনিস না,জানিস না তার জন্য এত দায়িত্ববোধ,এত দরদ তোর?আর যে রত্ন না চাইতেও পেয়েছিস তার এত অযত্ন অবহেলা করিসনা। আমার কথাটা একটু ভেবে দ্যাখ,ঠকবি না।ও মেয়ে তোর উপযুক্ত হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করছে প্রাণপনে।মনটা তার মেরেই ফেলেছিস, কিন্তু পঁচতে দিস নে রূপ।

তিতলি থাক না এসব কথা। নিজেকে নিয়ে একটু ভাব এখন।বললো বিরূপাক্ষ।

ফোসকা পরলো তো।যা খুশি কর। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস,, তুই যদি ভালো না থাকিস,আমি কিন্তু নিজের আবেগ সামলাতে পারবো না বলে দিলাম।কি করবো নিজেও জানি না। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল তিতলি।
লাইনটা কেটে দিলো তিতলি।

আমার মনে হয় তিতলি ঠিক বলেছে রূপ। তুই আরেকবার ভেবে দ্যাখ। নির্লিপ্ত গলায় বলে অখিলেশ।

তোরা সবাই মিলে বনলতার বিরুদ্ধাচরণ করছিস ক্যানো বলতো অখিল?আমি তোদের বন্ধু,,রিতি নয়।আমি যাকে নিয়ে ভালো থাকবো তোরা ও তাকেই চাইবি সেটাইতো স্বাভাবিক।

বিরূপাক্ষের গলায় বিরক্তির প্রকাশ টের পায় অখিলেশ।শুষ্ক হেসে বলে,,,সে তো অবশ্যই। কিন্তু আমার মনে হয়।তোকে কেউ ঘুরাচ্ছে।
প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি বিরূপাক্ষের,,

মানে কি ?

তুই বলিস মেয়েটা তোর গতিবিধি,নড়ন চড়ন সব লক্ষ্য করে,সব জানে।তার মানে সে তোর আশেপাশেই আছে তাহলে দেখা না দিয়ে কানামাছি খেলছে ক্যানো তোর সাথে?

বিরূপাক্ষের মসৃন ললাটের ভাঁজ লক্ষ্য করে পুনরায় বলে অখিলেশ,,দেখা করতে বল তোর বনলতাকে,আজ নয়তো কাল।দেখে নে একবার আসলেই কি সে তোর সেই বনলতা নাকি বনলতার অন্তরালে অন্য কেউ?
অখিলেশ এর কথাগুলো মনে ধরে বিরূপাক্ষের। মুখমণ্ডল ঝলমল করে উঠল কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। পুনরায় ভ্রুদয় কুঁচকে বলে,, কিন্তু আমি তাকে অবিশ্বাস বা সন্দেহ কোনোটাই করতে চাই না।সে দেখা করতে রাজি হয়েছে তো।

******
তুমি ভাবলে কি করে তোমার এই অন্যায় প্রস্তাবের সমর্থন করবে প্রভাকর রায় চৌধুরী। নিজের অতীত ভুলো না বাচ্চা। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে এখনো রাজাকারদের লিষ্টে তোমার বাবা, দাদার নাম পাওয়া যাবে তা ভুলো না। কঠিন কন্ঠঝংকার প্রভাকর রায় চৌধুরীর।

আমির শেখ থমথমে মুখে বসে আছে বুকের উপর দুহাত বন্ধন করে।

আজ তুমি দু’পয়সার মালিক হয়েছো ঠিকই কিন্তু ভুলে যাও ক্যানো তোমার বাপ আমার জমিতে কামলা খেটেছে একসময়।সেটা বেশি দূরের কথা কথা নয়। ভুলে গিয়েছো তুমি?একটা কথা শুনে রাখো,,, ময়ূর পুচ্ছ পরলেই কাক কখনো ময়ূর হয়না। তোমাকে জনগণ চায় না সেটা বোঝো না।আর আমি তাদের উপর তোমার বোঝা চাপিয়ে দেবো তেমন রাজনীতি আমি করি না। তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে প্রভাকর রায় চৌধুরীর ঠোঁটে।পাশে বসে রঘুনাথ নিজের গোঁফে তা দিয়ে ফিচেল হাসে।

নিজের কর্মচারী এবং দেহরক্ষীদের সম্মুখে এমন অপমান আমির শেখকে ধুলোয় মিশিয়ে দিলো মুহূর্তেই।এত এত অপমান সে ভাবতেও পারেনি।বুক থেকে হাত দুটো আগেই টেবিলের নিচে চলে গিয়েছে।সে দুটো দেখলে যে কেউ একটা একটা করে শিরা উপশিরা গুলো গুনে বের করে দিতে পারতো। চোখদুটো দিয়ে যেনো ইটের ভাটার চুল্লী জ্বলছে।

তাহলে আমির,,আশা করি উত্তর পেয়ে গ্যাছো? তুমি বুদ্ধিমান ছেলে,ম্যাট্রিকে তিনবার ফেল করলেও ব্রেইন তোমার খুব শার্প ,এর চেয়ে বেশি নিশ্চয় বুঝাতে হবে না?আর একটা কথা,,, আগুন ভাটাতেই সীমাবদ্ধ রাখবে। নাহলে শেষে অকাল অন্ধ হয়ে যাবে।
আর কালবিলম্ব না করে নিজের দু চারজন অনুসারীদের নিয়ে প্রস্থান করেন প্রভাকর রায় চৌধুরী।
এখানে আমির শেখ শুধু এবারের নির্বাচনে তাকে সাপোর্ট করার প্রস্তাব রেখেছিল প্রভাকর রায় চৌধুরীকে।এই সামান্য প্রস্তাবে এমন অসামান্য অপমান পাবে স্বপ্নেও ভাবেনি।

প্রচন্ড ক্রোধে গর্জে ওঠে আমির শেখ।তখনি পুনরায় প্রবেশ করে রঘুনাথ।সেই পুরোনো হিংস্র নজরে কক্ষের সবাইকে প্রতক্ষ্য করে একবার।সেই টেবিলের উপর দুহাত ভর দিয়ে উপুড় হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,,, আমির শেখ,, তোমার চেলা চামুন্ডা গুলো কে একটু সামলে চলতে বলো।না হলে ইলেকশন অব্দি অপেক্ষা করতে পারবো না আমি।তার আগেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে তোমার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা। নিজের দেহের ব্যাথা নিশ্চই মিলিয়ে যায়নি এখনো।
দরজার দিকে পা বাড়িয়ে পুনরায় ফিরে তাকালো,,আর একটা কথা,, আমার ভাইয়ের দিকে ফের যদি কেউ শকুনের নজর দেয় তো মা সিংহ বাহিনীর দিব্যি,,তাকে আমি শকুনের আহার বানিয়ে তবে শান্ত হবো।মনে রেখো কথাটা।

কিছু মনে করবো ক্যানো বল। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। নিশ্চয়ই আমার খারাপ চাইবি না।বললো বিরূপাক্ষ।

যাক তাহলে। শুনে খুশি হলাম।

আচ্ছা চল ছাদে যাই। শিশির মেশানো হাওয়ায় গায়ে মেখে সিক্ত হয়ে আসি।দাহ তো তোরও কম নয়। রসিকতার আভাস বিরূপাক্ষের কন্ঠে। অখিলেশ সেটা গায়ে মাখলো না। বললো অনুরুপ রসিকতায়,,,

আমার সাথে সিক্ত হয়ে লাভ কি তোর?শুধু শীতলই হবি, উষ্ণ যে করতে পারে তাকে নিয়েই না হয় যা।ডেকে দেই?

ঠান্ডা বেশ ভালোই পরবে এবছর।দাদুভাইয়ের জন্য কিছু গরম কাপড় আনিস তো নিরু। বিছানায় কম্বল পেতে দিয়ে বললেন অনিতা দেবী।

ল্যাপটপে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই উত্তর দেয় নিরু,,হ্যা মা। তোমারও তো লাগবে।

বিকেলে অখিলেশ এসেছিলো। বেশকিছু সময় থেকে চলে গেল। দাদুভাই তো ওকে ছাড়তেই চাইছিল না। ছেলেটাকে দেখলে চোখের জল বাঁধ মানে না আমার।আদ্র স্বর অনিতা দেবীর।

কিবোর্ডের উপর নিরুপমার আঙুল থামে। চোখ থেকে চশমাটা খুলে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে।নাহ্ আজ আর কাজ হবে না।দফারফা শেষ।

বাবুকে একটু সামলে রেখো মা।ওকে পেলেই এভাবে বিরক্ত করে।কি জানি কি হয়তো বিরক্ত হয় মুখে বলতে পারে না।যে চাপা স্বভাবের মানুষ। অস্ফুটে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে নিরু।

আমার তো তা মনে হয়না বাপু।যতক্ষন থাকে কোলে নিয়ে বুকের কাছে লেপ্টে রাখে।

তবুও মা,, অদ্রিকার অভ্যেস হয়ে গেলে বিপদ হবে।পরে সামলাতে পারবে না। বাচ্চা মেয়েটা কষ্ট পাবে।প্রয়োজনে একটু শাসন করলেই পারো।

সে তুমি করো মা,, অতটুকু মেয়েকে ধমকে কোন লাভ আছে?এতবড়ো বুঝবান মেয়েকেই বুঝিয়ে উঠতে পারলাম না আজও।যে মেয়ে জন্ম থেকে আজ অবধি বাপ কি জিনিস,দেখতে কেমন হয় বুঝলো না,সে তো স্নেহ পেলেই ঝুঁকবে তাকে আমি রুখতে পারি না।আর রক্তের টান বলেও তো একটা ব্যপার আছে।
নিজের কথায় নিজেই সচকিত হন অনিতা দেবী।
নিরুপমা অসহায়ের মতো উচ্চ স্বরে বলে,,

আহ্ মা একটু চুপ করো না তুমি?এভাবে খুঁচিয়ে কি লাভ পাও শুনি? আমি তো পাথর নই, মানুষ।কটা দিন সময় দাও,এই ঠিকানা ছাড়ছি আমি।
নিরু বেরিয়ে আসে রুম থেকে,,অনিতা দেবী অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।দু ফোঁটা জল গড়ায় তাঁর চোখ ফেটে,,আজও রাতে খাবে না মেয়েটা।এভাবে কি মানুষ বাঁচে?যা করার আমিই করবো মা।তোর কষ্টগুলো আমি বেচেই দেবো দেখিস এবার। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে চোখের জল মুছে নেন অনিতা দেবী।

*****
রাতে খাওয়ার পর ছাদে গিয়েছিলো বিরূপাক্ষ।বনলতার সাথে কয়েকমিনিট ফোনালাপ সেরে ঠান্ডার কাছে পরাজয় স্বীকার করে সবে নেমেছে দোতলায়। হঠাৎ হাসির রোল কানে আসতেই ঘুরে তাকায়।বাবা, মায়ের রুমের সামনের করিডোরে পশ্চিমমুখী হয়ে ফোনে কথা বলছে রিতি।হাসির তালে শরীর দুলছে লাউ লতার মতো।বিরূপাক্ষের গা জ্বলে ওঠে অমন হাসির বহর দেখে। টুকরো টুকরো কথা কানে আসতেই আগ্রহ বাড়ে আরো ভালো করে শোনার। নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে যায় বারান্দার পশ্চিম দিকে।

শরীর হীম হতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নিরু।পাতলা শাল খানি কখন যেনো সরে গেছে গা থেকে বুঝতেই পারে নি।ভালো করে জরিয়ে নেয় সেটা। সামনের এক টুকরো উঠোনের শেষ প্রান্তে একটা বহু পুরোনো বকুল গাছ।বলতে গেলে এবাড়ি থেকে বেরোনোর পথের শুরুতেই গাছটা।হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি গাছের ওপাশে দেখে চমকে ওঠে নিরু।গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় বারান্দার শেষ সীমানায়।ভয়,আশঙ্খা এবং কৌতুহল মিলে যেনো উত্তেজনা বাড়তে থাকে।না মূর্তিটি নড়ছে না আর।ঘড়ের সামনে জ্বলে থাকা আলোয় ছায়াটা খুব ভালো দেখা যাচ্ছে।ছায়াটা যে পুরুষ মানুষের তা বুঝতেই গায়ে কাঁটা দিলো নিরুর। অঘটনের ভয়ে নাকের নিচে ঘাম জমতে শুরু করেছে রিতিমত।গলা দিয়ে স্বর বেরোতে চাইছে না অথচ পা দুটো চলছেই। দেখতেই হবে কে এই এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আছে?কি তার অভিসন্ধি?

আরে রাহুল বাবু উদ্দেশ্য যদি দৃঢ় হয় তাহলে সফলতা আসবেই।এত চিন্তা ক্যানো করছেন? সবকিছু ঠিকঠাক হবে দেখবেন।আজ জ্যাঠা বাবুর কাছ থেকে সই সাক্ষর নিয়ে কাজ কিছুটা এগিয়ে নেবো আর রইলো বাকী বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী।সেটাও হবে একটু সবুর করুন আর বিশ্বাস রাখুন আমার উপর।আমরা সব কিছু পাল্টে নতুন করে যাত্রা শুরু করবো।

রিতির এহেনো কথায় বিরূপাক্ষের পা থমকে যায়।তবে কি সত্যিই তাদের সম্পত্তির লোভে রিতি এখানে পরে আছে?এবাড়ির কাউকে ভালোবেসে পরে নেই এখানে। স্বামীর ঘড়ে দাঁড়িয়ে প্রেমিকের সাথে ভবিষ্যত পরিকল্পনা? দারুন!
বিরূপাক্ষ রিতির কাছ ঘেঁষার আগেই দরজার ভারী পর্দা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে রিতি। বিমূঢ় এর মতো দাঁড়িয়ে থাকে বিরূপাক্ষ। এলোমেলো চিন্তা গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।সেকি এগিয়ে গিয়ে আটকাবে এই দূর্মতি নারীকে। বাবার মতো বিচক্ষণ মানুষ ও কি এর ছলাকলা কিছুই ধরতে পারছে না?মা তো নাহয় স্নেহে অন্ধ। বিরূপাক্ষ আর ভাবতে পারে না,প্রবল রোষে এগিয়ে যায় পিতার শয়ন গৃহাভিমুখে।একে রুখতেই হবে,,প্রয়োজনে পিতার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে এই লোভী মেয়েটার অকাজ গুলো। কিন্তু বুকের ভেতর এত তোলপাড় চলছে করানো?আর কিসের এত ধুকপুকানি?সেতো চায়ই রিতি এখান থেকে বিদায় হোক যেনোতেনো প্রকারে।তবে মনের মাঝে খুশির ফোয়ারার বদলে দুঃখের আগুন ক্যানো জ্বলছে তার?

শব্দ হীন পায়ে হালকা আলো আঁধারির মাঝে এগিয়ে বকুল গাছটির কাছে যেতেই পেছন থেকে অত্যন্ত রুক্ষ কঠিন হাতে কেউ একজন মুখ চেপে ধরেছে সজোরে ,সাথে নাকেও হালকা চাপ পরতেই চোখে ফোঁটে মৃত্যুর ভয়।এই বুঝি খেলা সাঙ্গ হলো তার।ঘ্রানেন্দ্রীয় সংকুচিত হয়ে আসে নিকোটিনের ঝাঁঝালো গন্ধে।এমন জীবন মরনের মাঝামাঝি থেকেও গা গুলিয়ে বমি পাচ্ছে নিরুপমার। নিকোটিনের গন্ধে ওর বমি পায় সবদিনই। এতকিছুর পরেও নিরু উপলব্ধি করতে পারে,,শত্রু তাকে একহাতে বেষ্টিত করে অন্য হাতে মুখ চেপে ধরে আছে শুধু।বাজে কোন ছোঁয়া নেই কিন্তু কোমলতা আছে অনেক খানি।স্বস্তিতে চোখ বোজে,যাক,, বেঘোরে প্রাণটা গেলেও সম্ভ্রমটুকু হয়তো বাঁচবে।সেই একটাই আরাধ্য পুরুষ ছাড়া অন্য কেউ তাকে ছুঁয়েছে ভাবলেই গা ঘিন ঘিন করে ওঠে ঘৃনায়,,,,, কিন্তু এ ছোঁয়ায় ঘিনঘিনে কোন অনুভূতি নেই ক্যানো?হয়তো মৃত্যুর কাছাকাছি বলেই,,,,

চলবে,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।

ভালো থাকবেন সবাই।