হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে পর্ব-৩২+৩৩

0
373

উপন্যাস:হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে:চন্দ্রা।

পর্ব:৩২

এমন অনেক মানুষ আছে যারা বিষধর সর্পের মতো বিষাক্ত কিন্তু সাপের সাথে তাদের পার্থক্য একটাই সাপকে তার ফণায় হাত বুলিয়ে কখনো ও বশে আনা যায় না অথচ এইধরনের মানুষদের সাথে ভালো কথা বলে, সুন্দর আচরণ করে তাদের তালে তাল মেলালে দারুন বশ্যতা স্বীকার করে। আমির শেখ খানিকটা এই চরিত্রধারী মানুষ।
ভালোর ভালো,আর মন্দের যম।সকালের সেই অপমান এখনো হজম করতে পারেনি সে। সারাদিনে একফোঁটা দানা দাঁতে কাটেনি একফোঁটা জল মুখে স্পর্শ করেনি । অনুগত ভৃত্য এবং সহোচরেরা সব ভয়ে সিঁটিয়ে আছে,,এই বুঝি তাদের মধ্যের কারো প্রাণটা হ্যাচকা টানে কেড়ে নিলো ক্রোধউন্মত্ত প্রভুটি।

আসলাম এসে দাঁড়ায় আমির শেখের পাশে। সার্বক্ষণিক সঙ্গী সে।মাথা নুইয়ে ডাকলো মৃদু স্বরে,,,ভাই।এমন করে না থেকে কিছু একটা বলেন। একবার শুধু আদেশ করেন কি করতে হবে? নিজের জান বাজি রাখবো ভাই।
আমির শেখের মাঝে কোনো ভাবান্তর হলো না আসলামের কথায়। চোখ বুজে পরেই রইল ইজি চেয়ারে।

ভাই ভাবি সাহেবা খুব চিন্তায় আছেন। তিনি আপনার সাথে দেখা করতে চান ভাই। আসছিলেন একবার আমি ফিরায় দিয়েছি উনাকে।

লিকু সরদারকে খবর দাও আসলাম। জরুরী মিটিং ডাকো।ঢাকার নেটওয়ার্ক কাজে লাগাও। কিন্তু নিজে কিছু কইরো না।চোখ বন্ধ রেখেই নিচু কন্ঠে বললো আমির শেখ।

আসলাম মনে মনে শঙ্কিত হয়ে পরে।সে জানতো এমন কিছুই হয়তো ঘটবে,,

ভাই লিকু ভাই বাইরেই আছে।ডাকবো তারে?

হুম ডাকো। ওহ্ দাঁড়াও আগে বিবিজানের সাথে দেখা কইরে আসি। তিনি নাকি পেরেশানি তে আছেন।আগে ঘড় ঠিক করি,পরে দেখবো পর।

আসলাম সরে দাঁড়ায়।আমির শেখ মন্থর গতিতে হেঁটে যায় অন্দর মহলের দিকে।

আসলাম সেদিকে তাকিয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টিতে। রক্তের খেলায় মত্ত হতে চলেছে তার প্রিয় আমির ভাই। কিন্তু রক্ত ঝরবে কতজনের আর বুক খালি হবে কোন মায়ের তার হদিস জানে না সে।

*****
রাতের সাথে বাড়ছে কুয়াশার স্রোত আর তর তর করে বেড়ে চলেছে শীত। বকুল গাছটির সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে দুই মানব মানবী।কথা বার্তায় মনে হবে,নিত্য তাদের এই অভিসার।
বহুকাল ধরে যেনো চলে আসছে এমন কুয়াশাস্নান। মাটিতেই লেপ্টে বসে আছে দুজন।

যখন প্রচন্ড মৃত্যু ভয়ে দুচোখের জল ছেড়ে দিয়েছিলো নিরুপমা তখনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করে দুটি অক্ষরের একটা ফিসফিসানি শব্দ,,,নি…রু।নিরুপমা চোখের পাতা গুলো জোরে চেপে রাখে সেই ডাকটা শুনে।চোখ খুললেই বোধহয় এই মোহময় স্বর উধাও হবে। মুখের উপর চেপে রাখা হাতটা ততক্ষণে শিথিল হয়েছে।ঐভাবেই ঢলে পরে মানুষটার বুকের উপর।ভাবে মনে মনে,,এমন সৌভাগ্য আমার নয় গো,, তোমার বুকের উপর মৃত্যু সে তো শত শত জনমের পূণ্যির প্রয়োজন।অতটা আমি কোথায় পাবো?

অখিলেশ অস্থির হয়ে নিরুপমার মুখে আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে ডাকে,,এই নিরু! নিরুপমা,, শরীর খারাপ করছে তোমার ?কি হয়েছে বলো আমাকে?নিরু আস্তে ধীরে চোখ খোলে মানুষটার যে ভীষণ তাড়া সবকিছুতেই।একটু অসুস্থ হওয়ার ভান ধরে বুকে পরে থাকবে সে সুযোগ ও দিতে চায়না আজ। ধাতস্থ হয়ে দাঁড়ায় নিরু।

আসলে আমি এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। দেখলাম তোমার বারান্দায় আলো জলছে তাই,,, কৈফিয়ত দিতে বললো অখিলেশ।নিরু নির্বিকার।

আমি কি জানতে চেয়েছি ক্যানো এসেছো?

না মানে,,,মুখে আঁধার নামে অখিলেশের।

তোমার হাতের নিকোটিনের দুর্গন্ধ খুব লেগেছে আমার। শ্বাস তো প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো।মারতে চাও আমায়?

অখিলেশ সন্তোর্পনে সরে বসে।নিরু অনুধাবন করে শুষ্ক হাসে।সে একটু এগিয়ে বসে গা ঘেঁষে। হঠাৎ হাত বাড়ায় অখিলেশ এর বুকের দিকে। অনুসন্ধান চলে কিছু একটার। অখিলেশ অবাক হয় না একটুও।কারন নিরু তো এমনই নিজের কাঙ্ক্ষিত জিনিস নিজেই খুঁজে নিয়ে হাসিল করতে জানে। ভিখারির মতো হাত পেতে বা চেয়ে নেওয়া তার নীতি বিরুদ্ধ।

****
নিজের বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে বিরূপাক্ষ।রাগে দুঃখে চোখ দুটো জলছে তার। পাশেই ফোনটা ভাইব্রেশন হচ্ছে।কল করেছে বনলতা কিন্তু বিরূপাক্ষ এখন কথা বলার মতো অবস্থাতে আছে বলে মনে হয়না।তার পিতা কি করে পারলো অন্য বাড়ির একটা লোভী,চতুর মেয়ের সামনে নিজের ছেলেকে অপমান করতে,,
কিছুক্ষণ আগে রিতি অন্নপূর্ণা দেবীর ঘড়ে প্রবেশ করতেই ক্ষনকাল বিলম্ব না করে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পরে সে।গিয়ে দেখলো রিতি বসে আছে বাবার সামনে আর তার হাতে যে নীল রঙের ফাইলটা ছিলো সেটা বাবার হাতে। তিনি সাইন করছেন হাসি মুখে। বিরূপাক্ষ দ্রুত হাতে টেনে নেয় সেটা। ছেলের এমন অনাহুত কর্মে প্রভাকর রায় চৌধুরী বিস্মিত হলেন খানিক,রাগ হলো তারচেয়ে বেশি।তথাপি তিনি শান্ত স্বরে বললেন,,,এটা কি হলো?

বিরূপাক্ষ বাবার অগ্নিচক্ষুর তোয়াক্কা না করে নিজের অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে রিতির দিকে।রিতি তার দিকেই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। বিরূপাক্ষ তাকাতেই রিতি চোখ নামিয়ে নেয়,,,

বাবা তুমি কি জানো এটা কিসে সাইন করছো?এই মেয়েটা তার ছলাকলায় তোমাদের ভুলিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে আর তোমরা তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করছো?

প্রভাকর রায় চৌধুরী আর স্থির থাকতে পারেন না। উচ্চ স্বরে বলে ওঠেন,,,চুপ করো বেয়াদ্দব ছেলে, নিজের বাক্য সংযত করতে শেখো।এই তোমার উচ্চ শিক্ষার ধরন?এই তুমি মানুষ হয়েছো?কার সামনে কাকে কি বলতে হয় সেটাও শেখোনি?

নিজের অপমানে বিরূপাক্ষ জ্বলে ওঠে বারুদের মতো,,

বাবা আমাকে নিয়ে এত কিছু না বলে আগে তোমাদের বিশ্বস্ত জোচ্চোর মেয়েটার খবর নাও।ক্যানো সে সপ্তাহে তিন দিন শহরে যায়? সারাদিন কি এত কাজ শহরে তার।আর নিহার আঙ্কেলের ছেলে রাহুলের সাথে কিসের এত হাসাহাসির সম্পর্ক তার,,,

থামো অসভ্য ছেলে। নিজের বৌয়ের খবর তুমি বাপের কাছ থেকে নিতে এসেছো?এতই যখন গোয়েন্দাগিরি করো তো নিজে ক্যানো খবর নাও না তোমার ঘড়ের বৌ কোথায় কি করে বেড়ায়? একটা মেয়ের সম্মন্ধে কি ভাবে কথা বলতে হয় সেটাও জানো না তুমি?আর একটা কথা বললে তোমাকে থাপড়ে সিধে করবো আমি।

উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পরেছেন প্রভাকর রায় চৌধুরী।রিতি অসহায়ের মতো দরজার দিকে তাকায়,মনে মনে প্রার্থনা,বড়োমা এসে থামিয়ে দিক এই প্রলয়।

ছেলে পুনরায় মুখ খুলতে যেতেই বাবা থাপ্পর দিতে উদ্যত হন,,রিতি উঠে হাত ধরে থামায় তাঁকে,,মিনতি করে অশ্রুসজল চোখে,,

জেঠু একটু শান্ত হও।এমন করলে শরীর খারাপ করবে তোমার?

রিতির কথা বিরূপাক্ষের ক্রোধের অগ্নিতে ঘি ঢাললো যেনো,,,তেড়ে আসে রিতির দিকে,,

এই অসভ্য মেয়ে ,,, তুই আমাদের বাবা ছেলের মধ্যে কথা বলিস কোন সাহসে? থাপ্পর দিয়ে গাল ফাটিয়ে দেবো একদম।

অন্নপূর্ণা দেবী চিৎকার চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে ঘড়ে ঢুকলেন,,বিরূপাক্ষের কথাগুলো শুনে গিয়ে রিতিকে ধরেন।সে নড়ছে না একটুও।শুধু চোখ দিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝরছে অশ্রু হয়ে। অন্নপূর্ণা দেবীর সকল আশা নিভিয়ে দিয়ে তবে ছাড়বে এই ছেলে।

বাবা, মায়ের কথা, বংশের মানসম্মান এর কথা যে ছেলে ভাবে না।সে কখনোই সুপুত্র নয়। তোমার মতো একটা ছেলে না হয়ে এই মেয়েটার মতো একটা মেয়ে যদি তোমার মায়ের গর্ভে জন্ম নিতো তাহলে আমরা বেশি গর্ববোধ করতাম। বেরিয়ে যেতে হয় তুমি যাও এ বাড়ি থেকে,,,ও যাবে না কোথাও।

বিরূপাক্ষ হাতের ফাইলটি ছুঁড়ে ফেলে বেরিয়ে আসে ও ঘড় থেকে। ভীষণ রোষানলে পুড়তে থাকে।মা বাবার জীবনে ওর প্রয়োজন নেই।ভাবতেই ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
আসলে কি তাই?নাকি রিতির সাথে অন্যকারো হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি কল্পনা করে তার এ অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে?রিতির সুখের সাগরে অন্যকারো ডুব সাঁতার কল্পনা করে এ দগ্ধতার সৃষ্টি হয়?
কিন্তু এই রকম নির্বোধ জাতীয় কিছু লোক বুঝতেই চায়না নিজে অন্য মেয়ের সাথে হেসে হেসে পার করে দিতে পারে সারাদিন,স্বপ্ন দেখতে পারে সংসারের অথচ বৌ অন্য কারো সাথে হেসে কথা বললেও গাত্রদাহ হয়। কিন্তু ক্যানো?ব্যাথা কি তাদের নেই?জলুনী কি তাদের হয়না?
দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে উঠে দাঁড়ায় বিরূপাক্ষ ফোনটা নিয়ে কল করে একটা জায়গায়। কিছুতেই এই অপমান ভুলবে না সে।যার জন্য নিজের মা, বাবার কাছে আজ এতটা ঘৃণার পাত্র হতে হলো তাকে শেষ না করে ক্ষান্ত হবে না সে।এ বাড়ির ত্রিসীমানার মধ্যে কোনো নাম নিশানা থাকলে চলবে না ঐ মেয়ের।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বিরূপাক্ষ।

এভাবে কি খুঁজছো,,আমাকে বলো?

নিরুপমা হাত থামিয়ে বলে,,, অনেকদিনের অব্যবহারে জায়গা টা কি আমার অচেনা হয়ে গেলো অখিল?নাকি অন্য কারো ব্যবহৃত হওয়ায় আমার আয়ত্বে নেই?

অখিলেশ নিরুপমার বা হাতটা নিজের বুকেই চেপে ধরে বললো মৃদু হেসে,,, তোমার অপছন্দের জিনিস খুঁজলে কি এখানে পাবে?

অখিলেশ ডান হাতে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে নিরুপমার হাতে দেয়,,

এটাই খুঁজছো তো?নাও।

নাহ্।তুমিই একটা ধরিয়ে নাও। তোমার এখন প্রয়োজন তাই নয় কি?

অখিলেশ আরেক দফা অবাক হয়,,সে ভেবেছিলো নিরু বোধহয় এগুলো নিয়ে ফেলে দিয়ে বলবে,,আর কখনো খাবে না। আমার গন্ধ সহ্য হয়না।
কিন্তু না,অখিলেশের ভালো মন্দে এখন আর নিরুর কিছু যায় আসে না।নিরুর অলক্ষ্যে একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে অখিলেশ।
ভাবলেশহীন ভাবে বলে প্যাকেটটা যথাস্থানে চালান করে দিয়ে বলে,,
থাক,লাগবে না। তোমার সহ্য হবে না।

নিরু হাসে রুক্ষ হাসি। গাছের পাশ দিয়ে একচিলতে আলো এসে পরেছে তার মুখে।সেই আলোয় অখিলেশ লক্ষ্য করে করে নিরুর হাসি।ভেবে পায়না এই রস, কষ,বর্ন, গন্ধহীন হাসির কারণ,,,

আমার তো কতকিছুই সহ্য হয়না অখিল,, কিন্তু মানিয়ে নিতে না পারলে ও মেনে তো নেই।এই যেমন,, তোমার মুখে সেই অগোছালো দাঁড়ি, মাথায় আলুথালু রুক্ষ চুলের বাহার,, সিগারেটের আগুনে পোড়ানো কালো হয়ে যাওয়া আমার প্রিয় লালচে আভাযুক্ত ঠোঁট দুখানি। সবচেয়ে বড়ো কথা যে দুর্গন্ধের ভয়ে আমি কখনো পাবলিক বাসে উঠতেই পারতাম না।সেই নিকোটিনের ঝাঁঝালো গন্ধ এখন তোমার গায়ের আমাকে পাগল করা ঘ্রানটাও গ্রাস করে নিয়েছে।
অখিলেশ শোনে শুধু,, উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না,, উত্তর তো তার সাজানোই আছে।যার জন্য এত পরিপাট্য ছিলো একসময় সেই যখন নেই তাহলে পরিপাট্য ধুয়ে কি জল খাবে?
রাগও হয় মনে মনে,,মেয়ে জাতটাই অন্যরকম বোধহয়,,যে পাত্রে যায় সেখানকার আকার ধারণ করে। স্বামীর সোহাগের চিহ্ন বয়ে বেড়াবে অথচ,,প্রেমিকের স্মৃতি রোমন্থন বন্ধ করবে না।

যাক সে কথা,,বিয়ে ক্যানো করোনি?বয়সটা তো বসে নেই?

কে বললো বিয়ে করিনি?অবাক হওয়ার ভান করে অখিলেশ।

নিরুর ভেতর মুচড়ে ওঠে।কি এক ভোঁতা গভীর যন্ত্রণায় বুকটা টনটন করে উঠলো মুহুর্তেই। নিজেকে সামলে নিলো আপন মহিমায়,,,ফ্যাকাসে কন্ঠে বললো,, কিন্তু সেদিন মা যে বললো,,,নিরুর বুকে আশার আলোর সলতেটা শেষ হয়নি এখনো, শুধু তেল ফুরিয়েছে।একটু তেল ঢাললেই আবার মোলায়েম আলোয় আলোকিত হবে চারপাশটা।দৃঢ় বিশ্বাস তার,আর যাই হোক অখিলেশ মিথ্যা বলবে না।

বলেছিলাম বুঝি?মনে নেই তো।বাদ দাও।একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

হুম।

অদ্রিকার বাবা মানে তোমার হাজব্যান্ড,তিনি কি আছেন?আমতা আমতা করে বলে অখিলেশ

নিরুর চোখ জলে ওঠে,,, কিন্তু কিছু বলে না।

সেদিন মামনি বললো,,ও নাকি ওর বাবাকে দেখেনি কখনো! তুমি ও শাঁখা সিঁদুর পরো না। তিনি কি বেঁচে নেই?

বালাইসাঁট,,,,এমন কু লক্ষ্যুনে কথা মুখে এনো না,,, তিনি বেঁচে আছেন। আমার সন্তানের পিতা সে। তাঁর হাতের সিঁদুর কপালে জোটেনি আমার তাই তো পরিনা। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন, ভালো থাকবেন। আমাদের সাথে হয়তো নেই কিন্তু তিনি যে আছেন এইটুকুই শান্তি। উত্তেজিত হয়ে পরে নিরু।

অখিলেশের নিজ মুখনিঃসৃত দুরবাক্যের জন্য নিজেরই অনুশোচনা হয়,, নিরুপমার হাত দুটো ধরে জোর করে,, কাঁপছে নিরু,,

আমি ক্ষমা চাইছি নিরু। আমার এভাবে বলা উচিত হয়নি।প্লিজ শান্ত হও।প্লিজ!
নিরু লম্বা করে শ্বাস নেয়।অনেকটা স্থির এখন,,অখিলেশের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। অখিলেশ বসে থাকে আধোমুখে,,এত বয়স হলো এখনো সঠিক জায়গায় সঠিক বাক্যের প্রয়োগ শিখলো না। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই লজ্জিত। কিন্তু একটা ব্যাপার খুবই বুকে বাজে তার,যে স্বামী, স্ত্রী সন্তানের খবর নেয়না সেই স্বামীর প্রতি এখনো কতো টান নিরুপমার অথচ একদিন তাকেই নিরু চোখে হারাতো।কিই না করেছিলো তাকে পাওয়ার জন্য।

অনেক রাত হয়েছে,তুমি এখন যাও প্লিজ,, স্কুলের নাইট গার্ড মাঝে মধ্যে এদিকে আসেন, আমাদের এখানে এভাবে দেখলে খারাপ ভাববে।নিরুর কন্ঠের রুক্ষতায় চমকে ওঠে অখিল। দুঃখ ভালো করেই দিয়েছে নিজের অজান্তেই। কিন্তু নিরুপায় সে।নিরুর চোখের জল দৃষ্টি এড়ায়নি তার।উঠে দাঁড়িয়ে বলে,, আচ্ছা যাও ভালো থেকো।নিরু উল্টো ঘুরে দ্রুত পা বাড়ায়,, অখিলেশ নিজের দুঃখের সঙ্গী সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা ধরিয়ে লম্বা টান দিতেই ঝড়ের গতিতে ছুটে আসে নিরু,অখিলেশের মুখ থেকে জলন্ত সিগারেট টা টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দূরে। ঘটনার আকস্মিকতায় অখিলেশ বিস্মিত।
খবরদার আর কখনো এসব মুখে নিয়েছো তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।অন্যকে জ্বালিয়ে সুখ হয়নি তোমার? নিজের দেহ জ্বালাতে হবে?বোবা কান্নায় কন্ঠ রোধ হয়ে আসে নিরুপমার।
সেই পুরোনো ঝাঁঝালো মেজাজের নিরু ফিরে এসেছে। অখিলেশের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি নিরুপমার ঠোঁট দুটো কাঁপছে কান্নার তোড়ে।
আচমকা দুহাতে নিরুকে টেনে নিয়ে ওর প্রকম্পিত ওষ্ঠদ্বয় নিজের ওষ্ঠগত করে নেয় অখিলেশ। কিছু মুহূর্ত চলে দীর্ঘ চুম্বন।সেই বহুদিনের বহু কাঙ্ক্ষিত সুখ যেনো ফিরে এসে জুড়ে বসেছে আবার।
নিরু দৌড়ে চলে গিয়েছে নিজের ঘড়ে। অখিলেশ দাঁড়িয়ে ছিলো সেদিকে তাকিয়ে। সিগারেটের টুকরোটা তখনো জ্বলছে।সে হাঁটু গেড়ে বসে জলন্ত সিগারেটের টুকরোটা হাতে নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ায়।একটা টান দিয়ে অবহেলায় ধোঁয়াটুকু মুখ মুক্ত করে ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,,বন্ধু ঐ নেশার কাছে তোর নেশা কিছুই না।রাগ করিস না প্লিজ। দূরে ছুড়ে ফেলে হাঁটতে শুরু করে গন্তব্যের দিকে। বহুকাল পরে এমন শান্তির পরশ মেলেনি তার।

*****
সকালের ঝরঝরে আলোয় আলোকিত চারপাশ। নিত্যদিনের মতো প্রজ্জ্বলিত ধুপকাটির সুগন্ধিতে ঘুম ভাঙল বিরূপাক্ষের।সাথে আবছা আবছা প্রভাতী সংগীত ভেসে আসছে মন্দির থেকে।রিতির এই সুর খুব মনোযোগ সহকারে শোনে বিরূপাক্ষ।আজো তার অন্যথা হলো না।গত রাতের সেই সর্বনাশা ক্রোধটা খানিক প্রশমিত হয়েছে কিন্তু একেবারে মিলিয়ে যায়নি।নিজ প্রতিজ্ঞার কথা বিস্তৃত হয়নি সে। কিন্তু আজ কোনো কোন্দল করবে না রিতির সাথে।রিতির উপর রাগ তার দীর্ঘস্থায়ী হয়না।কারন অজানা। অনেক রাতে বনলতার সাথে কথা হয়েছে। আগামীকাল দেখা করবে বনলতা। ভাবতেই দেহের ভেতর ক্যামন একটা ভালোলাগার শীতলতম স্রোত বয়ে চলেছে।যেখানে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো সেই সুন্দর বনের কাছেই একটা দর্শনীয় স্থানে দেখা করবে বনলতা। বিরূপাক্ষ ফুরফুরে মেজাজে ব্রেকফাস্ট করে সবার সাথেই। গতকালের ঘটনার পরেও এমন নির্লিপ্ত ভাব ভীষণ ভাবায় রিতিকে। বিরূপাক্ষ রিতির দিকে একপলক তাকিয়ে ক্রুর হাসে মনে মনে,,,ভাবে,,
বনলতার সাথে দেখা করে আসার পথেই তোর ব্যবস্থাটা পাকাপোক্ত করে আসবো,আর মাত্র দুটো দিন এ বাড়ির খাবার খা আয়েশ মিটিয়ে।
খাওয়া শেষে যাওয়ার সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললো বিরূপাক্ষ রিতির উদ্দেশ্যে,,রিতি আমার জন্য কফি নিয়ে আয় তো।
আছ বেশ কয়েকদিন পরে বিরূপাক্ষ রিতির সাথে কথা বললো স্বাভাবিক ভাবেই।
রিতি অবাক হয়ে যায় এমন আহ্বান শুনে। প্রভাকর চৌধুরীর মুখটা কিন্তু থমথমে। তিনি নিজের ঔরষজাত সন্তানের বৈশিষ্ট্য খুব ভালো ভাবে জানেন আর এটাও জানেন গতরাতে তিনি যে কঠিন ব্যবহার করেছেন বিরূপাক্ষের সাথে,তার ফল ভুগতে হবে এই মেয়েটাকে।

রিতির স্কুলে যেতে দেরী হয়ে যাবে তাই নিজের খাওয়াটা শেষ না করেই উঠে পরলো।কফি বানিয়ে নিয়ে দ্রুত পদে চলে গেলো বিরূপাক্ষের ঘড়ে।ও জানে রূপদা আর যাই হোক নিজের অপমান অত সহজে ভোলার মানুষ নয়।ঝড় একটা উঠবেই জানে, কিন্তু কতবড়ো মাপের ঝড় সেটা জানে না রিতি

রিতির হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে আয়েশের সাথে ছোট্ট চুমুক দিলো বিরূপাক্ষ।
রিতি বেরিয়ে যাচ্ছিলো আটকালো বিরূপাক্ষ,,,
শোন তোর সাথে আমার কথা আছে,,

রূপদা আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।পরে বললে হতো না? বিনয়ের সাথে বলে রিতি।

না আগে আমার কথা শুনে যা। স্বাভাবিক ভাবেই বললো বিরূপাক্ষ।রিতি অবাক,,এত নরমাল বিহেভিয়ার?মানা যাচ্ছে না।

ঠিকাছে বলো। মৃদু হাসি রিতির ঠোঁটে।হাসছে বিরূপাক্ষ ও।

কাল আমার কেবিনেট থেকে সুন্দর একটা শার্ট প্যান্ট ব্লেজার বের করে রাখিস তো ঘসে মেজে। মিটমিট হাসি বিরূপাক্ষের ঠোঁটে।

ক্যানো বলতো?রিতি কনফিউজড।

যাবো দেখা করতে।তোর তো আবার পছন্দ,রুচি সবই ভালো।সে যেনো একপলকেই পছন্দ করে নেয়।

রিতির ললাটের ভাঁজ মিলিয়ে গেলো,,প্রচ্ছন্ন হেসে বললো,,,
সেই কথা,, আচ্ছা তুমি না হয় পাঞ্জাবি পরে যেও।ওতে তোমাকে মানায় ভালো। সুন্দর,সৌম্যকান্তি,প্রাণবন্ত লাগে।

তাই?সত্যি বলছিস? আচ্ছা তুই তাহলে দেখে শুনে একটা দিস।

রিতি সায় জানিয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি বজায় রেখে বেরিয়ে যায় দরজা খুলে।

রিতির বেড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই বিরূপাক্ষের মুখের হাসির ধরন পাল্টে যায় মুহুর্তেই। তারপর বলে আপন মনে,,

হাসছিস তো,,হেসে নে হেসে নে।তোর ব্যবস্থা করেই তবে ফিরবো আমি,,,,

চলবে,,,,,

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব:৩৩

শাওন আসিলো ফিরে,,সে ফিরে এলো না,,,
বরষা ফুরায়ে গেলো,,আশা তবু গেলো না,,,

কিংবা,

শাওনো রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে,,
বাহিরে ঝড় বহে,নয়নে বারি ঝরে,,,

শ্রদ্ধেয় কবি ও গীতিকারদের এই সৃষ্টি কি শুধুমাত্র শাওন কালের বিরহ বেদনায় মুহ্যমান হয়ে পরার জন্য নাকি আরো কারন আছে?শাওন কাল মানুষের মাঝে ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এটা ঠিক যেমন,,কাউকে ভালো লাগার চাদরে মুড়ে দিতে পারে আষ্টেপৃষ্ঠে আবার কেউ কেউ বিষন্নতার মহাকাব্যে একের পর এক পৃষ্ঠার সৃষ্টি করে যেতে পারে মনের গহীনে। বৃষ্টির ধারার মতো অবিরত ভাবে মনের মধ্যে সৃষ্টি হতে থাকে বিরহের ছন্দ,সুর,লয়,তাল।শীত কালের বৃষ্টি কি মানুষের মনে এই প্রেম,বিরহ বা আবেগঘন মুহূর্তের উন্মোচন করতে পারে?হয়তো না।সকাল থেকেই আকাশের সাথে মেঘের মান অভিমান চলছিলো কমবেশি। অবশেষে গোধূলি লগ্নে মেঘবতী জয়ী হয়ে কেঁদে কুটে ধরনী সিক্ত করলো। পৌষের মাঝামাঝি সময় হওয়ায় শীতের প্রতাপ বেশীই ছিলো।হালকা পাতলা বহতা সমীরণ আর ঝুমঝুম বর্ষা তা বাড়িয়ে তুললো দ্বিগুণ হারে। বহুকাল হলো এ এলাকার লোকজন এমন শীতকালীন বৃষ্টির প্রকোপে পরেনি কাজেই কষ্ট তো একটু হবেই।
নিজের শয়নকক্ষের দক্ষিণ মুখী জানালায় দাঁড়িয়ে আছে রিতি। বৃষ্টির হালকা ছাঁট এসে বিন্দু বিন্দু হয়ে জমছে সমস্ত মুখমন্ডলে। আঁখি পল্লবীতে যদিও শ্রাবণের নাচোন-কোদন, দৃষ্টি তার সুদূরে অবস্থিত বাড়ির মূল ফটকে। বাহিরের অশান্ত পরিবেশ তো কোন ছাড় তার দ্বিগুণ,চতুর্গুন চলছে মনের মাঝে।একটাই অবাধ্য দুশ্চিন্তা মাথা উঁচিয়ে চলছে সেখানে,,রূপদা ফিরবে তো আজ।নাকি ভাঙা মনে পরে থাকবে অন্য কোথাও।
সকালে বিরূপাক্ষ নিজেকে সাজিয়েছে তো রিতির পছন্দের পোশাকেই কিন্তু পাঞ্জাবি টা পরেনি।অতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভরে বলেছিলো বিরূপাক্ষ,,, এসব নাকি যতসব মিডলক্লাস পছন্দ।সেটা এখন পরে রয়েছে রিতির কাঁধের একপাশটায়। নতুন সুতো আর কাপড়ের হালকা গন্ধ এখনো রিতির ঘ্রানেন্দ্রীয় দিয়ে প্রবেশ করছে ফুসফুসের ভেতরে। কয়েকমাস আগে একটা বিশেষ দিনের সম্ভাবনায় এই পাঞ্জাবি টি নিজে পছন্দ করে কিনে রেখেছিলো রিতি। কিন্তু সেই দিনটি আর আসেনি তাই এটার ব্যবহার ও হয়নি।রিতি পাঞ্জাবি টায় আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
বিরূপাক্ষ রিতির দেওয়া পাঞ্জাবি টা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেও তাকে দিয়েই পোশাক পছন্দ করিয়েছে।রিতিও নিজের অপমান গায়ে লাগায়নি, অবশেষে বিরূপাক্ষের ক্যাবিনেট থেকে শ খানেক স্যুট টাইয়ের মধ্য থেকে একসেট বের করে দিয়েছে।
হ্যা দারুন মানিয়েছে বিরূপাক্ষকে।
নিজে রেডি হয়ে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল বিরূপাক্ষ, বিজয়ের হাসি হেসে তখন রিতিকে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,, রিতি তোর বর যাচ্ছে তার বৌয়ের সাথে দেখা করতে ,,নজর কাঁটা দিবি না?

রিতি একটু সরে বিরূপাক্ষের দিকে ঘুরে তাকায়,,,
কে তোমাকে নজর দেবে?অবাক হয় রিতি।

তুই যেভাবে দেখছিস তাতে তোর নজর থেকেই বাঁচা দায়। বিরূপাক্ষের কুটিল হাসি রিতির অন্তরে আঘাত হানে। কুঁচকানো ললাট মসৃন হয়,,,
এতই যদি নজর লাগার ভয়,,তাহলে ডেকেছো ক্যানো?আমি তো সেধে আসিনি।রিতি আর কথা বাড়ায়নি।এত আঘাত সইতে চায় না মন।দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে ও ঘড় থেকে।আসার সময় বিছানায় এলো মেলো হয়ে পরে থাকা পাঞ্জাবি টা আনতে ভোলেনি সে।তার কিছুক্ষণ পরেই নিজের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে বিরূপাক্ষ কে বেরিয়ে যেতে দেখেছে।
সত্যিই অপূর্ব সুন্দর লাগছে তাকে।নজর লেগে যাওয়ার মতোই সুন্দর। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে রিতির।ভাবে মনে মনে এত উচ্ছল হাসি কতক্ষন হাসবে রূপ দা??দেখা হবে তো তোমার বনলতার সাথে?

*****
বাহিরের পরিবেশ যতটা বিক্ষুব্ধ,আমির শেখের বৈঠক খানা তার চেয়ে বেশি অশান্ত।যাকে বলে,, নীরবতার সরগরম।কথা কাকলি যদিও তেমন নেই কিন্তু অভ্যন্তরে চলছে কথামালার অবাধ ফুলঝুড়ি।ঢাকা থেকে গেস্ট এসেছেন তিনজন।স্পেশাল গেস্টদের স্পেশাল খাতির যত্নের ব্যাবস্থা চলছে অন্দর মহলের রন্ধনশালায়।বাহারী খাবার এর ঝাঁঝ মাখা সুগন্ধে ম ম করছে বৈঠক খানা।
কথিত আছে সৃষ্টি কর্তা যখন কোনো সৃষ্টি,, বিশেষ করে কোনো মানব শিশুকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্য মায়ের গর্ভে প্রেরণ করেন তখন তার ভাগ্য তিনি নিজের হাতে লিখে দেন।তো আমির শেখ আজ এমন তিন বিখ্যাত, কুখ্যাত ব্যক্তিকে আহ্বান করেছে যারা কি না গোটা কতক কাগজের বিনিময়ে আল্লাহর সাথে পাল্লা দিয়ে তাঁর সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের ভাগ্য লেখে এবং তাও যদি তারা এদের টার্গেট হয়। উপর ওয়ালার সাথে এদের পার্থক্য এটুকুই তিনি জন্ম, মৃত্যু এবং বিবাহ এই তিন মিলিয়ে লেখেন তার সৃষ্টির কল্যাণে আর এই ব্যাক্তিরা শুধু তাদের মৃত্যু লেখে নিজেদের কল্যাণার্থে।কোন মায়ের বুক খালি হলো সেটা ভাবার সময় নেই কিন্তু নিজের ধনলক্ষী যে দিন দিন ফুলে ফেঁপে উঠছে এটুকুই যথেষ্ট।
কিছুক্ষণ চললো গোপন বৈঠক। অতঃপর সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একটা ছেলের মৃত্যুর দিন তারিখ ঘোষণা করলো এই তিন ব্যাক্তি শুধু মাত্র বেশি অংকের টাকার বিনিময়ে।ভাবলোও না এই অজ্ঞাত যুবকের মৃত্যুতে তার পরিবার, পরিজনেরা কি করবে?
হিংস্র মনের অধিকারী এইসব মানুষদের মতো দেখতে পশুগুলো শুধু ভাঙতেই জানে গড়তে জানে না।
****
অনু তোমার ছেলের মতিগতি কিন্তু ঠিক লাগছে না আমার।কি করতে চাইছে সে। একবার বুঝালেও তো পারো।

অন্নপূর্ণা দেবীর চোখের পাতা জড়ো হয়ে এসেছিল ঘুমে,, স্বামীর কথায় চোখ মেলে তাকালেন।ঘড়ে আলো তো নেই তবুও অন্ধকারে স্বামীর দিকে ফিরে শুধুই একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন।

এভাবে বড়ো বড়ো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লে কোন ফায়দা হবে? বিরক্ত ফুটে উঠল তাঁর কথায়।

অন্নপূর্ণা দেবী মিইয়ে যান স্বামীর কথায়,,,
কি করতে বলো আমাকে?মা হয়ে ছেলেকে আর কি ভাবে বুঝাবো বলো?সে কি এখন ছোট আছে?

যেভাবে বললে শোনে সেইভাবে ক্যানো বলনা? বিরক্তি বাড়ে প্রভাকর রায় চৌধুরীর গলায়।
মাতার চোখে ঘুম নেই সন্তানের চিন্তায়।এমন বৃষ্টি বাদলে ছেলে তাঁর ঘড়ে নেই ফিরবে কি না জানেন না তিনি।রিতি তো রাতের খাবারটাও খেলো না।মা হয়ে সন্তানদের এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হওয়াটা মেনে নিতে পারছেন না তিনি।
অবশেষে দরজায় খুট খুট শব্দ,, অন্নপূর্ণা দেবী সাড়া দিতেই বাইরে থেকে জয়া উচ্চস্বরে বলে গেলো,,,

মামীমা ভাই ফিরেছে।।।

****
মাঝে অতিবাহিত হয়েছে আরো পনেরোটা দিন।এই পনেরো দিনে মথুরাপুর,চন্ডীনগর গ্রাম সহ আশেপাশের এলাকায় ঘটে গেছে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।এমন ভীতি আর আতঙ্কিত এখানকার মানুষ এর আগে হয়েছে বলে মনে হয় না।দিনে দুপুরে রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে ধেয়ে আসা বড়ো বড়ো গাড়ির দিকে মানুষ জন তাকিয়ে থাকে কৌতুহলী হয়ে।এই বুঝি কিছু একটা ঘটলো। সাংবাদিকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লোকজন এর যাওয়া আসা বেড়েছে প্রভাকর রায় চৌধুরীর অন্তঃপুরে। তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তি,একাধারে উপজেলা চেয়ারম্যান।গেলো পরশু রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমির শেখ এর খামার বাড়ি থেকে তিনজন সাজাপ্রাপ্ত জেল পলাতক আসামি ধরা পরেছে। আমির শেখ অত্যন্ত চতুরতা এবং টাকার বিনিময়ে ব্যাপারটা থেকে গা বাঁচিয়েছে ঠিকই কিন্তু পুলিশের সজাগ দৃষ্টি সর্বদাই তার আশেপাশে ঘুরছে। এককথায় গৃহবন্দী হয়ে প্রতিশোধের আগুনে গুমরে গুমরে মরছে সে। নিজের অনুগত ভৃত্যরাও তাদের প্রভুর এই দুর্দিনে দুটো শান্তনা বাণী শুনাতে পারছে না।
কিন্তু প্রশাসনের একটাই দুশ্চিন্তা,সেটা হলো এই তিন ব্যক্তি যে আগ্নেয়াস্ত্র গুলি এনেছে সেগুলো উদ্ধার হয়নি যার কারণে বিপদাশঙ্কা বেড়েছে বৈ কমেনি। প্রভাকর রায় চৌধুরীর প্রেসার হাই। রঘুনাথ নিজের নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে রেখেছে সর্বদাই। কিন্তু কোনো সুরাহা এখনো হয়নি।

*****
সূর্যটা ঠিক মাথার উপর পূর্ণতেজে জ্বলছে।সুমিতা দেবী স্নান সেরে একটু সরিষার তেল মাখলেন হাতে, পায়ে, নাকে,মুখে।এটা তার পুরোনো অভ্যাস।হোক শীত কিংবা গ্রীষ্ম,স্নান শেষে তেল তাঁকে ঘষতেই হবে।আধ কাঁচা পাকা চুলের ওপর দিয়ে কাপড়ের আঁচলটা মাথায় টেনে ঢুকলেন রিতির ঘড়ে,,সেই সকালে একটুকরো রুটি খেয়ে ঔষধ খেয়েছে মেয়েটা।
মাথার উপর থেকে লেপটা টেনে সরিয়ে অসুস্থ রিতির এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে ডাকলেন স্নেহাদ্র কন্ঠে,,,ও মা উঠো,,বেলা যায় তো,গতরডা মুইছা দেই,উঠো মা।
সরিষার তেলের ঝাঁঝালো গন্ধে রিতির নাকের পাটা ফুলে ওঠে।আলগা হয় গভীর ঘুম।
ছোট বালতিতে গরম জল এনে তাতে গামছা ভিজিয়ে হাত মুখ মুছিয়ে ঘড় ছাড়েন সুমিতা দেবী।সেই সুযোগে পরনের পোশাক পাল্টে আয়নার সামনে দাঁড়ায় রিতি।। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই আঁতকে উঠে।চোখ দুটোতে সেই উজ্জ্বল সৌন্দর্য নেই আর।মরা মাছের ফ্যাকাশে চোখের মতো মনি দুটো আবছা হয়ে আছে যেনো। চোখের চারিধারে ডার্ক সার্কেল। গোলাপের শিশিরভেজা পাপড়ির মত ঠোঁট দুটো শুষ্ক হয়ে ফেটেছে কয়েক জায়গায়। সেখানে ব্যাথা অনুভব করে রিতি। জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালায় একবার। জিহ্বা টা মরুভূমি হয়েছে প্রায়।

গরম গরম ভাত আর থানকুনি পাতার কড়কড়ে করে ভাজা বড়া নিয়ে এসেছেন ন্ত দেবী।বাটিতে ফুলকপির ডালনা।
পড়ার টেবিলে সেগুলি রেখে রিতির চুল গুলো আঁচড়ে পরিপাটি করে দিতে দিতে ন্তঞবললেন সুমিতা দেবী,,,,
যে বিপদ গ্যালো মা,,গোবিন্দের মন্দিরে ন্তন্তষ্টষ্টন্ত ভোগ মানত করছি। তুই সাইরা ওঠ তারপর দিমু।
হাতে। মুখে রুচি নেই একটুও,মনটা তো তার চেয়ে তিক্ততায় ভরে আছে। মেয়েটার ঠান্ডার ধাত আছে।একটু বেশি ঠান্ডা লাগলেই গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।এবারও ঠান্ডা নেহায়েৎ কম লাগেনি। কিন্তু ভগবান রক্ষা করেছেন বলেই বাড়াবাড়ি রকমের কিছু হয়নি। সাধারণ জ্বরেই সীমাবদ্ধ আছে।

আসবো বোনটি,,, দরজায় অখিলেশ।

রিতির দৃষ্টি সেদিকেই।সুমিতা দেবী সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় আঁচলটা আরেকটু টেনে দেয়। অখিলেশ ভেতরে ঢুকে কাঠের ভারী চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে রিতির মুখোমুখি।
গায়ের এলোমেলো শালটি ভালো করে জড়িয়ে নেয় রিতি।অখিলেশের ওষ্ঠপ্রান্তে মলিন হাসি দৃষ্টি এড়ায়নি তার।

অখিল দা একদম খালি হাতে এলেন?রোগী দেখতে এলে ফলমূল, শাকসবজি আনতে হয় জানেন না বুঝি? সহাস্যে বললো রিতি।
অখিলেশের কোনো ভাবান্তর হলো না সে কথায়।
সিঁথি ক্যানো ফাঁকা বোনটি?এমনটা তোমাকে মানায়?এমন রংহীন জীবন তোমার নয়তো!!
রিতি ভেতরে ভেতরে সংকুচিত হয়ে পরে। শুরুতেই এমন বাক্য?

আমি জানি তুমি কি বলবে। কিন্তু রং হীন শুধু এপাশে নয় ওপাশেও চলছে সাদা কালোর খেলা।সহ্য করতে পারছো তুমি?

আমি তো আর দেখতে যাচ্ছি না।তাহলে সহ্য হবে না ক্যানো? মিইয়ে যাওয়া গলা রিতির।

হালকা শব্দে হাসলো অখিলেশ,,
ওহো দেখোনি তাহলে? তবে যে সেদিন শুনলাম,এই জ্বরের ঘোরে স্কুলে চলে গিয়েছিলে?আর তিনি নাকি আজকাল কফির মায়া ভুলে স্কুল গেটের সামনের দোকানের চা অমৃতের মতো পান করছে?
সেকি শুধু চায়ের টান নাকি অন্যকিছু?

আপনি কি প্রশ্ন পত্র রেডি করে নিয়ে আসছেন অখিল দা?

অখিলেশ জিভ কাটে,,না না। ভুল বুঝো না বোনটি।আমি তোমাকে, তোমাদের সুখী দেখতে চাই যে,, করুন সুর বাজলো অখিলেশের গলায়।

সে তো আমিও চাই অখিলদা। ছোট্ট অদ্রিকা জীবনে প্রথমবারের মতো তার জন্মদাতাকে বাবা ডেকে বুকে ঝাঁপিয়ে পরুক।যে আমার দাদার আসনে নিজের স্থান গেড়েছে সে সুখী হয়ে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে স্থির জীবন পার করুক।নিরু দিদির মতো ভালো একটা মেয়ে নিজের একটা সীকৃতি পাবে।

অখিল মনে মনে খানিক চমকে ওঠে,,এ কদিনে মনের মধ্যে যে সম্ভাবনাময় প্রদীপটা জ্বলছিলো সেটাও নিভলো যেনো এক পলকা বাতাসে,,মুষড়ে পরা গলায় বললো,
অদ্রিকার বাবা ফিরবে তাহলে? কিন্তু তুমি কি করে ফেরাবে বলো?সে তো তোমার কাজ নয়।
রিতির মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশার আলো জলে উঠলো।বুঝে নিতে একটুও দেরী হলো না,,এই অত্যন্ত ভালো এবং জাগতিক চিন্তা ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন লোকটি আজো বুঝতে পারেনি,যে শিশুটি বুকে আসলে তার এত শান্তি লাগে তার পিতা কে?যে শিশুটির মুখনিঃসৃত ধ্বনি কানে পরম সুখের সুর তোলে সে সুরের প্রধান উৎস কি?নিজেকে মিথ্যা গম্ভীরতায় মুড়িয়ে বললো,,
সে ঠিক।আমি চাইলে পারি না কিন্তু আপনি চাইলে অবশ্যই পারেন অখিলদা! ছোট্ট অদ্রিকার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে।

অখিল ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকে রিতির মুখপানে। মেয়েটার ভাষা আজ খুবই দুর্বোধ্য লাগছে তার।
রিতি আজ পনেরো দিন পরে ভীষণ আমোদ বোধ করছে এই সহজ সরল মানুষ টাকে খেলিয়ে।সত্যিই কি বোকা!!
নিরুপমা দি যে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাচ্ছে সেখবর রাখেন?
অখিলেশের বুকের ভেতর টা মুচড়ে ওঠে।একমূহুর্তের মধ্যে হাসি মাখা মুখটা ভেসে ওঠে মানসপটে।

ওহ!! ছোট একটা শব্দ নয় এক আকাশ আফসোস ঝরলো যেনো।

নিজেকে সামলে অন্য কথা তুললো সে,,,
এভাবে নিজেকে ক্যানো কষ্ট দিচ্ছো বোনটি?ফিরে চলো না সেখানে।প্রতিটি মানুষ যে মাথা খুঁড়ে মরছে ও বাড়িতে।তছনছ হয়ে গেছে সবকিছু।

সে বাড়িতে যাওয়ার আর অধিকার আছে আমার? অনেক দূর থেকে যেনো বললো কথাটা।
একটা কাগজ কলম কি সব কিছু শেষ করতে পারে? তোমার এমন বিবর্ণ রূপ বড়ো মা দেখতে পারছেন না। তিনি ও আজকাল বড্ড অগোছালো হয়ে গিয়েছেন।

পালঙ্কের সাথে হেলে বসে চোখ বন্ধ করে রিতি। এবার তার দারুন অসুস্থ লাগছে,,
কিছুক্ষণ কাটলো মৌনতায়,,

আমি যে রঙ হীন একটা দুনিয়া চাই অখিল দা।যেখানে এত এত বাহারী রঙের ছড়াছড়ি থাকবে না,থাকবে শুধু সাদা আর কালো। দুঃখের রঙ গুলো হবে শুধুই সাদা।তাই যদি না হয় তাহলে চোখের জলের কোনো রঙ হয় না ক্যানো বলুন তো। সেতো সাদাই। দুঃখের রঙ যদি নীল হবে তাহলে সে দুঃখে কান্না ক্যানো পায়?আঁখি ক্যানো তার রঙহীন সম্পদের অপচয় করে? ভালো বাসার রঙ হবে কালো,কারণ সাদা মনে দাগ কেটে যায় ভালোবাসা।সাদার উপর কালো রঙের আঁচড় যে খুব ফোঁটে।
শুষ্ক চোখে ঝর্ণা নামে রিতির। অখিলেশ অসহায়। কিছুই করার নেই তার যে যার জেদের কাছে পরাজিত।

****
টিনের চালার ছোট্ট ঘড়ের বেড়া জুড়ে ফাঁক ফোকর। উত্তরের হিম বায়ু আটকাতে সেই ফাঁকফোকরে নিজের পুরনো ছেঁড়া লুঙ্গি দিয়ে পর্দা টানিয়েছে বিনুদা।তেল চিটচিটে বালিশের উপর মুখের একপাশ চেপে ঘুমিয়ে আছে বিরূপাক্ষ। গায়ের উপরে একটা পাতলা কম্বল,তার উপরে শিমুল তুলার লেপ। লেপের কভার কেচে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছে বিনু দা।
অতি চেনা প্রিয় গন্ধে ঘুম ভাঙে বিরূপাক্ষের।
চোখ মেলতেই জ্বালা করে ওঠে।মাথার সামনে জ্যোতির্ময়ী নারী মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে রয় কয়েক মূহূর্ত।কল্পনা ভেবে ভ্রম হয়। কিন্তু না,কল্পনা নয়,,সত্যিই মা এসেছেন অভিমান ভুলে।

উঠে বসে হাতের চেটোতে চোখ মুছে বলে,,মা,,, তুমি এসেছো? এখানে কোথায় বসতে দেই বলোতো?
পরিপাটি ছিমছাম ছেলের মুখভর্তি কয়েকদিনের না কামানো দাঁড়ি, চুল গুলো উষ্কখুষ্ক, চোখে ঘুমহীনতার ছাপ স্পষ্ট,শরীরটাও ভেঙেছে খানিকটা।চোখ ফেটে জল আসতে চায় অন্নপূর্ণা দেবীর কিন্তু তিনি তো প্রকাশ করবেন না নিজের দূর্বলতা।কন্ঠে কাঠিন্য এনে বলেন,,আমি তোমার এখানে বসতে আসিনি বাবা,,
বিরূপাক্ষ মাকে দেখে যতটা স্বস্তি পেয়েছিল তা নিভলো তবুও জড়িয়ে ধরে মাকে। অন্নপূর্ণা দেবী আর নিজের কাঠিন্য বজায় রাখতে সক্ষম হয় না,,
ধরা গলায় বলেন,,,ফিরে চল বাবা,, নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নে খোকা।সব ঠিক হয়ে যাবে। ছেলেকে আঁকড়ে ধরেন অন্নপূর্ণা দেবী।

মা বনলতার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না এ কদিন।মনটা আমার পুড়ে যাচ্ছে। তুমি তো বোঝার চেষ্টা করো মা।
অন্নপূর্ণা দেবীর মনটা বিষিয়ে ওঠে। ছেলের মাথা এবং পিঠ থেকে হাত দুটো আস্তে সরে পরে,,
এখনো তুই বনলতার কথা ভাবছিস?ছি ছি,,এই ছেলে পেটে ধরেছি আমি? মনুষ্যত্বের জলাঞ্জলি দিয়ছিস তুই?অমন সোনার প্রতিমাতে তামাটে রঙ ধরেছে,সে তো তোর জন্যই। দেখেছিস একবার চোখের দেখা?তাকানো যায় না মুখের দিকে। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়।কই তার জন্য তো কোনো ভাবনা নেই তোর? কাঁদছেন অন্নপূর্ণা দেবী। বিরূপাক্ষ নীরবে শুনলো শুধু। কিছুই বললো না প্রতিউত্তরে।মা কি জানে তার ছেলেটা মনুষ্যত্বের টানে না গেলেও শুধু মাত্র একপলক দেখার জন্য কতকিছুই না করেছে।তার ফলস্বরূপ এই হাঁটুর ছাল উঠে যাওয়া দগদগে ঘা টা।

****
রাতের ঝকঝকে নীল আকাশে একফালি চাঁদ।খাটের লাগোয়া টিনের বেড়ায় দখিনা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে রিতি।ঘড়ে জ্বলে থাকা আলোটা বিরক্তিকর লাগে রিতির কাছে।এই আলো তাকে অবসন্ন নীরব নিশি জাগরণে ব্যাঘাত ঘটায় বার বার। কিন্তু আলোটা নেভাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন পিসি।তার নিষেধ অমান্য করলে শাস্তি স্বরূপ নিজে কেঁদে কুটে সারা হবেন।রিতি যেদিন থেকে জ্বরে পরেছে সেই থেকে এঘড়ের আলো নেভাতে দেয়না। অসুস্থ মানুষের ঘড় অন্ধকার থাকলে তাতে নাকি খারাপ কিছু চলাফেরা করে। পিসির কথায় হাসে রিতি।মনটা ভরে ওঠে গভীর আবেগে। পিসির এই কুসংস্কারের পেছনে যে তার জন্য অফুরন্ত স্নেহ লুকিয়ে আছে।

কি হইলো রে মা,,,জানলা খান খুইলা রাখলি ক্যান?যা হিম পরছে আবার ঠান্ডা লাগবো। জানালার পাল্লা দুটো আটকে দিয়ে বললেন সুমিতা দেবী।রিতির কপালে হাত দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,,
যাক, জ্বর আসে নাই আইজ।
কিছুক্ষণ একথা সেকথা বলে সে স্থান ত্যাগ করেন সুমিতা দেবী।রিতি ঘড়ের দরজার কপাট আটকে রুদ্ধ জানালা উন্মুক্ত করে। লোহার রডে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,,এখানে শুধু হিম বাতাস আসে না পিসি,, গভীর নিশিথে আমার প্রাণ শীতল করার কারনটাও আসে। নিঃশব্দে এসে নীরবে চলে যায়? কিন্তু সে কি জানে আমি শুধু অসুস্থতার জন্য নয়, তার আসার অপেক্ষায় নির্ঘুম থাকি।তার গায়ের গন্ধ সর্বাঙ্গে মাখি।
আমি যদি এতটাই অকিঞ্চিত তার কাছে তাহলে ক্যানো এই লুকোচুরি?ক্যানো এই গোপন দর্শন?
নিজের মনে সাত পাঁচ প্রশ্ন আবৃত্তি করে চলে রিতি। চাঁদটা তখন ঠিক মাথার উপর দাঁড়িয়েছে।

চাঁদের আলোর রূপালী জোছনায় ইটের ভাটার চুল্লির পাইপ গুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে আর কোনো আলোর দেখা মিললো না। কিন্তু অফিস রুমের পেছনে যে গুপ্ত কক্ষটি করেছিল আমির শেখ সেখান থেকে কোনো এক ফাঁক গলে একটা অনুজ্জ্বল আলোর রোশনাই আসছে।কি আজব!অন্যদিন সমস্ত ভাটায় বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বললেও ওঘড়ে কোনো আলো কেউ দেখেনি কিন্তু আজ সব আলো যেখানে ক্লান্ত হয়ে নিভে আছে , সেখানে ঐ আধার কুঠিরে আলো জলছে সাথে জ্বলছে নির্ঘুম কয়েকটি দো-পায়ে প্রাণীর হিংস্র চোখগুলো। অনেক সাধ্য সাধনা এবং সবার নজর এড়িয়ে আজ এই মিটিংয়ের ব্যাবস্থা করেছে আসলাম। আমির শেখ গম্ভীর হয়ে বসে আছে নিজের আসনে।সময় জ্ঞান যাদের নেই তারা কখনো আশানুরূপ কাজ করতে পারে না। আসলাম ভয়ে বার বার শুকনো ঢোক গিলছে।যদি না আসে সে?যাকে নিয়ে আমির ভাইকে এত আশা ভরসা দিলো সেই মানুষটি।

কি ব্যাপার আসলাম?তুইও কি সবার মতো আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে চাস? দাঁতে দাঁত পিষে বলে আমির শেখ।
আসলাম কুন্ঠিত বোধ করে,,

মাফ করবেন ভাই।তেনার না আরো আগেই আসার কথা ছিলো,,
চুপ কর আসলাম,,,,

রুমের সুরঙ্গের দরজার জুতোর খট খট শব্দ শুনে থেমে যায় আমির।কক্ষের সব কটা মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ সেদিকে ‌।আবছা আলোয় এক নারী দেহের অবয়ব স্পষ্ট হয়।কি লাস্যময়ী রূপ সে নারীর। আমির শেখের মতো বিশেষ ব্যক্তিত্বের পুরুষটিও তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। চোখের ক্রোধ ছাপিয়ে এক অপূর্ব মুগ্ধতা ভর করে কিন্তু তার মাঝেও একটাই প্রশ্ন উকি দিয়ে যাচ্ছে,,কে এই সুন্দরী রমণী?আর কিসের এমন শত্রুতা চৌধুরী পরিবারের সাথে যার কারনে খুনের মতো অপরাধ করতেও প্রস্তুত?ঐ নরম পেলব হাতে সোহাগের বদলে মরনাস্ত্র তুলবে?ক্যানো?

চলবে,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।