হৃদকোঠোরে রেখেছি তোমায় পর্ব-২+৩+৪

0
326

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(২)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৩)
তরুনিমাকে এভাবে দৌড়ে চৌধুরী মেনশনের ভিতরে চলে যেতে দেখে তমালিকা ওর পিছনে যেতে নিলে সাগরিকার কন্ঠে “দাড়াও তমা বউমা” বাক্যটি শোনামাত্র তমালিকা সেইস্থানেই থেমে যান। সাগরিকা লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে তমালিকার সামনে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললেন…..

—“তরু দিদি ভাইকে এখন কিছুসময় একলা থাকতে দাও। নিজের মন ও মস্তিষ্কের সাথে বোঝা*পড়া করার একটা বিষয় রয়েছে। কারণ তরু দিদি ভাই আধঘন্টা পূর্ব পর্যন্তও ভেবেছিলো ওর বিয়ে কনক দাদু ভাইয়ের সাথে হবে। হুট করে সবটা এলেমেলো হয়ে গেলো। এখন আবার পারিবারিক সম্মান ও সম্পর্ক রক্ষার খাতিরে আমি আমার কুশল দাদু ভাইয়ের সাথে ওর বিয়ের বিষয় নিয়ে কথা উঠিয়েছি। এই সব কিছু একসাথে তরু দিদিভাইয়ের মন ও মস্তিষ্কের উপর আলাদা প্রভাব ফেলেছে। তাই এখন তরু দিদিভাইকে একলা থাকতে দেয়া উচিত আমাদের। আর এই সময়ের ভিতর আমাদের বড়দের একত্রে বসে আমার উঠানো প্রস্তাবটির বিষয় নিয়েও কথা বলা উচিত বলে আমি মনে করছি।”

সাগরিকার কথাগুলো শুনে তারেক বললেন….

—“কুশল বাবাকে নিজের মেয়ের জামাই হিসেবে অ*পছন্দ করার মতো কোনো কারণ আমাদের পরিবার কেনো এই পুরো শহরে বসবাসরত কোনো পরিবার বের করে তা তুলে ধরতে পারবে না। তাই কুশল বাবা আপনাদের কথানুযায়ী আমার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য রাজি হলে আমরা কেও কোনোরূপ দ্বিমত পেষণ করবো না বড় মা।”

তারেক এর মুখে এরূপ কথা শুনে সাগরিকা স্মিত হাসলেন। সেইসময় কুশলের মা সাবরিনা সাগরিকার পাশে এসে দাঁড়িয়ে থমথমে স্বরে বললেন….

—“কিন্তু সিকদার ভাইজান তরুনিমা তো আমার ছেলেকে বিয়ে করবে না বলে এক দৌড়ে বাসার ভিতরে চলে গেলো। এখন কুশল পরিবারের সম্মান ও সম্পর্ক রক্ষার কথা ভেবে তরুনিমাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হলেও আপনার মেয়ে কি পরবর্তীতে সম্মতি প্রদান করবে?”

তারেক ওনার স্ত্রী তমালিকার দিকে একপলক তাকালেন। তমালিকা স্মিত হেসে বললেন…

—“তরুর উপর দিয়ে অনেক ধ*কল গিয়েছে সন্ধ্যার পর থেকেই। তাই ও এখন ঠান্ডা মাথায় কোনো বিষয় নিয়ে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা না করেই হ্যা বা না সূচক মতামত জানিয়ে দিয়েছে। আমরা ওর এইসব মতামতকে ধরে বসে থাকলে তো চলবে না। আপনারা কুশল বাবার সাথে বিয়ের বিষয় নিয়ে কথা বলুন তারপর তরুর সম্মতি জেনে নেওয়ার জন্য বেশি সময় ন*ষ্ট করতে হবে না আমাদের।”

সেইসময় কুশলের ছোট বোন সন্ধ্যা চৌধুরী ওর মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…

—“কিন্তু তোমরা যেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষটির সাথে কথা বলবে বলে ঠিক করেছো সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি তার গুরুত্বপূর্ণ কাজের উদ্দেশ্যে গ্রামে গিয়েছে দুপুরের পর পরই। আর চৌধুরী বাড়ির সবাই খুব ভালো করেই জানো জনাব রওনাক আজমাইন চৌধুরী কুশলের কাছে তার গ্রামের মানুষদের সম*স্যা সমাধান এর গুরুত্ব পারিবারিক সম*স্যা সমাধান করার থেকে কয়েক শত গুণ বেশি।”

সাগরিকা লাঠিতে ভর দিয়ে ধীর পায়ে চৌধুরী মেনশনের ভিতরে যেতে যেতে বললেন…

—“সন্ধ্যা দিদিভাই…সাদিককে কল কর আর ওকে কুশল দাদু ভাইকে বলতে বল দাদীমা জরুরী বিষয়ে কথা বলার জন্য যতো দ্রুত সম্ভব ওকে বাসায় ফিরতে বলেছেন।

(৪)

তরুনিমা চৌধুরী মেনশনের ভিতরে নিজের জন্য বরাদ্দ করা ঘরটিতে এসে দরজা ভিতর থেকে আটকে দিয়ে মেঝেতে পায়চারী করতে করতে শরীরে থাকা ভাড়ি ভাড়ি অলঙ্কার গুলো একটা একটা করে খুলে রুমের মেঝেতে ছুঁ*ড়ে ফেলতে ফেলতে বললো….

—“বলি তারেক সিকদারের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য দুনিয়াতে কি পুরুষ মানুষের অ*ভাব হয়ে গিয়েছে! দাদীমা আমাকে যদি বলতেন , ‘তরু তোকে আফ্রিকার জ*ঙ্গ*লে আমৃত্যু বন*বাস দেওয়া হলো’ তাহলেও আমি নাচতে নাচতে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে সেখানে চলে যেতাম। কিন্তু দাদীমা ওনার ঐ খা*রু*শ, এক*রো*খা, রাগী, জে*দ্দী, অতি ভদ্র ও ভালো মানুষ নাতীকে আমার মতো নিষ্পাপ, মাসুম মেয়েটার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন কেনো? এই ব্যডাকে বোঝার বয়স থেকেই আমার দুই চোক্ষে স*হ্য হয় না তা কি তিনি জানেন না? জীবনে ফেলা আমার প্রতিটি কদমে কদমে বাবা-মা, চৌদ্দ গুষ্টির মুখে এই খা*রু*শ ব্যডার প্রশংসা শুনতে শুনতে কান, মাথা আর তাদের স্ব-স্থানে নেই। এখন যদি এই ব্যডা আমার জামাই হয় তাহলে তো এই চৌধুরী আর সিকদার বংশ আমাকে তাদের কথার জা*তাঁ*কলে আ*স্ত গমের মতো পি*ষে আটা বানিয়ে ফেলবে। না, না এমনটা তো হতে দেওয়া যাবে না। দরকার পড়লে আমি চিঠি লিখে এই সংসার ত্যগ করে আফ্রিকার জ*ঙ্গ*লের বনবাসীনি হয়ে যাবো তবুও ঐ খা*রু*শ*কে বিয়ে করবো না। হারগিজ নেহিইই………!”

(৫)

কিছুসময় পর সাদিক একজন গরীব চাষীকে সাথে নিয়ে কুশলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো…..

—“স্যার , উনি আপনার সাথে সাক্ষাতে কথা বলতে চাইছিলেন। গার্ডরা তাকে ভিতরে আসতে বাঁধা দেওয়ায় শোরগোলের সৃষ্টি হয়েছিলো।

চাষীটি কুশলকে দেখা মাত্র দৌড়ে কুশলের পায়ের কাছে এসে বসতে নিলে কুশল দ্রুত হাতে তার দুই কাঁধ ধরে তাঁকে থামিয়ে দিতে দিতে বললো….

—“আরে চাচা কি করছেন আপনি! আপনি আমার গুরুজন এভাবে আমার পায়ের কাছে বসবেন না।”

এই বলে কুশল চাষিটিকে ধরে নিজের পাশের সোফায় বসিয়ে দিলেন। চাষিটি কান্নায় ভে*ঙে পড়েছেন। কুশল তাকে শান্ত করার জন্য বললেন…..

—“চাচা , আপনি কান্না করবেন না। কান্না থামিয়ে আমাকে বলুন আপনার কি সম*স্যা হয়েছে। আমি আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করবো।”

চাষিটি কান্না করতে করতে বললেন….
—“বাবা , মেম্বার এর উ*শৃ*ঙ্খল ছেলেটা কয়েকদিন ধরেই স্কুলে যাওয়া-আসার পথে আমার ১৫ বছরের মেয়েকে উ*ত্ত*ক্ত করতো। আমার মেয়ে আমাকে বলায় আমি নিজে মেম্বার এর কাছে গিয়ে অনু*রোধ করেছিলাম তার ছেলেকে আমার মেয়েকে উ*ত্ত*ক্ত করা থেকে বি*র*ত থাকতে বলার জন্য। কিন্তু আজ আমার মেয়েটা স্কুল থেকে বাড়িতে ফেরার সময় মেম্বার এর ছেলে আমার মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওর স*র্ব*নাশ করে দিয়েছে। পরে আমার মেয়েটাকে নদীর ধারে ফেলে রেখে গিয়েছিলো। গ্রামের কিছু মানুষ মেয়েটাকে নদীর ধারে পরে থাকতে দেখে বাড়িতে এনেছিলো। মেয়েটার অবস্থা খুব খা*রাপ বাবা। গ্রামেই সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। কিন্তু তারা বলেছেন এখানে চিকিৎসা হবে না শহরে নিয়ে যেতে হবে। আমি আমার মেয়েটাকে নিয়ে কি করবো বাবা! আপনি আমাদের কাছে আল্লাহর পাঠানোর দূতের মতো, গ্রামের সবার বি*প*দে-আ*পদে আপনি সবসময় পাশে দাঁড়ান। আমার মেয়েটারে বাঁচান বাবা।”

চাষীর কথাগুলো শুনে রাগে কুশলের কপালের র*গ ফুলে উঠেছে ইতিমধ্যে। সোফার ২পাশের হাতলের উপর রাখা হাত দুটো মুষ্ঠি*বদ্ধ করে কুশল উচ্চস্বরে সাদিককে ডাক দেয়। সাদিক দ্রুত পায়ে হেঁটে কুশলের সামনে এসে দাঁড়াতেই কুশল বললো…

—“এক্ষুণি মালতি মায়ের সাথে কিছু গার্ডকে একটা গাড়িতে করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। সেখান থেকে চাচার মেয়েকে নিরাপদে শহরে নিয়ে গিয়ে শহরের সব থেকে বেস্ট ক্লিনিকে ভর্তি করাতে বলবে। মেয়েটার চিকিৎসায় যেনো কোনো রকম ত্রু*টি না হয়। দ্রুত যাও….!”

সাদিক কুশলের কথানুযায়ী কাজ করতে চলে যায়। কুশল চাষীটিকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“চাচা , আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়েকে সুচিকিৎসা দেওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে যাবে এক্ষুণি। ও সুস্থ হয়ে উঠবে খুব তাড়াতাড়িই ইনশাআল্লাহ।”

—“আল্লাহ তোমার অনেক ভালো করুক বাবা দোয়া করি।”

কিছুসময় পর সাদিক কুশলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো….

—“স্যার সব ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।”

কুশল সোফা ছেড়ে উঠে নিজের দাঁড়িয়ে দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির রেখে শান্ত স্বরে বললো….

—“সাদিক গাড়ি বের করো। চাচাকে সাথে নিয়ে একটু মেম্বার এর বাসাটা দর্শন করে আসি।”

কুশলের এই কথা শুনে সাদিক গাড়ি বের করতে সামনের দিকে যেতে যেতে বিরবিরিয়ে বললো…..

—“স্যারের এই শান্ত রূপ যে কতোটা ভ*য়ং*কর হতে পারে তা আমি খুব ভালো ভাবেই জানি। আজ মেম্বার এর বাসায় তার ছেলের জান ক*ব*জ করার জন্য আ*জ*র*’ই’ল যাবে এতোটুকু বলতে পারছি।”

চলবে ইনশাআল্লাহ….

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৩)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৬)
সাদিক দ্রুত পায়ে গাড়ির কাছে যেতে শুরু করে সেইসময় ওর ফোন বেজে উঠে। প্যন্টের পকেটে হাত দিয়ে ফোনটা বের করতেই দেখে ফোন স্ক্রিনে সন্ধ্যা ম্যডাম নামে সেইভ করা নাম্বার থেকে কল এসেছে। সাদিক ওর ভ্রু যুগল কিন্ঞ্চিত কুঁচকে নিয়ে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সন্ধ্যা বললো….

—“মেজো ভাইয়া কি আপনার সাথেই আছেন?”

—“জ্বি , ম্যডাম। স্যার তো আমার সাথেই আছেন। কোনো বিশেষ দরকার পড়েছে কি?”

—“হ্যা , অনেক জরুরী দরকার। আজ বড় ভাইয়ার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো তো তরুনিমা ভাবীর সাথে কিন্তু এখানে বড় ঝা*মে*লার সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। যার ফলে বড় ভাইয়ার সাথে তরুনিমা ভাবীর বিয়ে ভে*ঙে গিয়েছে। এখন এই স*ম*স্যা সমাধান করার জন্য দাদীমা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব মেজো ভাইয়াকে বাসায় ফিরতে বলেছেন। আপনি মেজো ভাইয়াকে বলুন আমার বলা কথাগুলো।”

—“ঠিক আছে ম্যডাম , আমি স্যারকে এক্ষুনি বলছি।”

—“হুম।”

এই বলে সন্ধ্যা কল রেখে দেয়। সাদিক ফোনটা পকেটে রেখে বললো….

—“সম*স্যার উপর সম*স্যা লেগেই আছে। না জানি বাসায় আবার কোন সম*স্যার সৃষ্টি হলো।”

এই বলে সাদিক আবারও উল্টোপথে হাঁটা ধরে কুশলের সামনে এসে দাঁড়ায়। এতোসময় পর সাদিককে গাড়ি ছাড়াই আসতে দেখে কুশল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে সাদিককে দেখে প্রশ্ন করলো….

—“কি হয়েছে সাদিক?”

সাদিক বললো…..
—“স্যার , তরুনিমা ম্যডামের সাথে কনক স্যারের বিয়ে ভে*ঙে গিয়েছে আর সেই কারণে বাসায় বড় ধরণের ঝামে*লার সৃষ্টি হয়েছে। তাই এই সম*স্যার সমাধান করার জন্য দাদীমা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনাকে বাসায় ফিরতে বলেছেন।”

কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“আগে চাচাকে নিয়ে মেম্বারের বাসাটা দর্শন করে আসি তারপর বাসায় ফিরবো। তোমাকে যেই কাজটি দিয়েছিলাম তা সম্পন্ন করো সাদিক।”

পারিবারিক সমস্যার কথা শুনেও কুশলকে নরমাল থাকতে দেখে অবাক মুখশ্রী করে ওর থেকে বেশ খানিকটা দূরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে রশিদ, খালেক, আমজাদ নামের তিনজন কর্মচারী। সেইসময় রশিদ ফিসফিসিয়ে বললো.…..

—“এতোগুলো বছর ধরে স্যারের সাথে কাজ করছি, উঠা-বসা করছি কিন্তু কখনও ওনাকে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত বা ভী*ত হতে দেখি নি। সব বিষয়েই স্যার নিজের মনের ভিতর এতো কন*ফি*ডেন্স ও শ*ক্তি কিভাবে যে বজায় রাখেন তা ভেবে বের করা মুশ*কিল।”

রশিদের পাশ থেকেই খালেক বললো….
—“হুম ঠিক বলেছো ভাই।”

কিছুসময় পরই সাদিক একটা ব্লাক বিএমডব্লিউ গাড়ি এনে কুশলের সামনে দাঁড় করায়। কুশলের ডান হাতের পার্শেই দাঁড়িয়ে থাকা একজন গার্ড এগিয়ে আসতে নিলে কুশল হাত উঠিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়।অতঃপর নিজেই গাড়ির দরজা খুলে চাচাকে পিছনের সিটে বসিয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটের পাশে থাকা সিটটিতে বসে পড়ে। অতঃপর সাদিক গাড়ি স্টার্ট করে। কুশলের গাড়ির সামনে ও পিছনে আরো ২টি গাড়ি ভর্তি গার্ডসরাও যাচ্ছে মেম্বার এর বাসার উদ্দেশ্যে।

কিছুসময়ের মধ্যেই ওরা মেম্বার এর বাসার সামনে এসে উপস্থিত হয়। সব গার্ডসরা গাড়ি থেকে নেমে বাসার চারপাশ ঘেরাও করে ফেলে। কুশল গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিয়ে বললো…

—“চাচা , নামুন।”

চাষিটি গাড়ি থেকে নেমে কুশলের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন….

—“বাবা , ঐ মেম্বারের ছেলেটা একদমই ভালো মানুষ না। আমার মাইয়াটার স*র্ব*নাশ করছে, মাইয়াটা এখন হাসপাতালে জীবন-মৃ*ত্যু*র সাথে ল*ড়া*ই করতেছে৷ তুমি ঐ উ*শৃং*খ*ল ন*ষ্ট মানসিকতার কা*পুরুষটাকে এমন কঠিন শা*স্তি দাও যেনো ওর শা*স্তি দেখে গ্রামে বসবাসরত বাকি ব*খা*টে , উ*শৃং*খ*ল কা*পুরুষগুলোর মনেও ভ*য়-ভি*তীর সৃষ্টি হয়।”

কুশল বললো…
—“ঠিক আছে, চাচা এখন ভিতরে চলুন।”

অতঃপর কুশল চাষিটিকে নিয়ে মেম্বার এর বাসার গেইট খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। চাষিটিকে আঙিনায় দাঁড় করিয়ে কুশল ওদের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। সাদিক কুশলের আরেক পার্শে এসে দাঁড়াতেই কুশল বললো……

—“সাদিক , ডাকো মেম্বার সাহেবকে।”

সাদিক মেম্বার এর রুমের দরজায় কড়া নাড়তে নাড়তে উচ্চস্বরে মেম্বারকে ডাকতে শুরু করে….

—“মেম্বার সাহেব…ও মেম্বার সাহেব…দরজা খুলুন…আপনার সাথে বিশেষ দরকার নিয়ে সাক্ষাৎ করার জন্য কুশল চৌধুরী স্যার এসেছেন।”

খাবার রুমে মেঝেতে স্ত্রী আমেনা বেগম ও একমাত্র ছেলে মুরাদ হোসেন এর সাথে বসে মহসিন মেম্বার রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। সেইসময় বাহির পথের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজের পাশাপাশি কুশল চৌধুরী এসেছেন এমনটা শুনে মহসিন অর্ধেক খাবার থাকা প্লেটেই হাত ধুঁয়ে দ্রুত উঠে এসে দরজা খুলে দিতেই কুশল চৌধুরী আর তার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট সাদিককে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জোরপূর্বক নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন…..

—“স্যার , আপনি! কোনো প্রয়োজন থাক……..

মহসিন মেম্বারকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে কুশল তাকে পাশ কাটিয়ে রুমের ভিতর প্রবেশ করে। কুশলকে রুমে দেখা মাত্র আমেনা বেগম উঠে ভিতরের রুমে চলে যান। মুরাদ সেখানেই দাড়িয়ে অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন কুশলের দিকে। কুশল কোনো কথা না বলে দ্রুত পায়ে মুরাদের কাছে গিয়ে নিজের বাম হাত দিয়ে মুরাদের কলার্ট শক্ত ভাবে ধরে ওকে টানতে টানতে রুমের বাহিরে আনতে শুরু করে। কুশলের এমন কাজে মহসিন অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে কুশলের পিছন পিছন রুম থেকে বের হয়ে বললেন…..

—“স্যার….স্যার আমার ছেলেটারে এভাবে টানতে টানতে বাহিরে আনলেন কেনো! কি করছে আমার ছেলে! স্যার ওরে ছাইড়া দেন।”

কুশল মুরাদকে আঙিনার মাঝে এনে কলার্ট ছেড়ে ধা*ক্কা দিতেই মুরাদ আঙিনার উপর উ*পুর হয়ে পড়ে যায়। অতঃপর কুশল আঙিনার উপর পরে থাকা একটা লাঠি হাতে উঠিয়ে নিয়ে মুরাদকে মা*র*তে শুরু করে। কুশলের করা প্রতিটি আ*ঘা*তে আ*ঘা*তে মুরাদ জোরে জোরে আ*র্ত*নাদ করতে শুরু করে। মহসিন এগিয়ে আসতে নিলে সাদিক তাকে আটকে দিয়ে বললো….

—“আপনার ছেলে আজ অত্যন্ত ঘৃ*ণ্য একটি কাজ করেছে তাই ওর ক*ঠিন থেকে ক*ঠিন*তম শা*স্তি প্রাপ্য। আপনি এখন স্যারের কাছে যাবেন না।”

মহসিন উচ্চস্বরে প্রশ্ন করলেন….
—“কি করছে আমার ছেলে?”

সেইসময় চাষিটি মেম্বারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন….
—“আপনার কা*পুরুষ ছেলেটা আমার বাচ্চা মেয়েটার স*র্ব*নাশ করে ওরে এতোটাই ক্ষ*ত-বি*ক্ষ*ত করে দিয়েছে যে আমার মেয়েটা এখন হাসপাতালের বিছানায় জীবন-মৃ*ত্যু*র সাথে ল*ড়া*ই করছে মেম্বার সাহেব। এই ক*’পুরুরষের কোনো মাপ হইবো না।”

চাষির কথা শুনে মহসিন স্ত*ব্ধ হয়ে যান। বাহির থেকে মুরাদের আ*র্ত*না*দ শুনতে পেয়ে মুরাদের মা আমেনা বেগম আর ঘরের ভিতর থাকতে পারলেন না। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসতেই আঙিনার মাঝে কুশলকে মুরাদের শরীর লাঠিকা*ঘা*ত করতে দেখে আমেনা বেগম ছুটে কুশলের পায়ের কাছে বসে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে অনু*রোধ করলেন…..

—“বাবা , আল্লাহর দো*হাই লাগে আমার পোলাটারে আর মা*ই*রো না। আমার পোলাটার শরীর ফা*ই*টা র*ক্ত ঝ*ড়*তাছে। আর মা*ই*রো বাবা। দয়াকইরা এই মায়ের অনু*রোধ রাখো বাবা, আমার পোলাটার জীবন ভি*ক্ষা চাইতাছি তোমার কাছে বাবা।”

আমেনা বেগম এর কথাগুলো কুশলের কান পর্যন্ত হয়তো পৌঁছায় তখনি যখন তার চোখের পানি কুশলের পায়ের উপর পড়তে শুরু করে। কুশল তৎক্ষনাৎ মুরাদকে মা*রা বন্ধ করে লাঠিটা অন্যপাশে ছুঁ*ড়ে ফেলে দিয়ে আমেনা বেগমের থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। আমেনা বেগম মুরাদের কাছে গিয়ে ওর মাথাটা নিজের কোলের উপর নিয়া কাঁদতে কাঁদতে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে ওর শরীরের র*ক্ত গুলো মুছতে শুরু করেন। মুরাদ য*ন্ত্র*ণায় মুখ দিয়ে গো*ঙা*নির মতো শব্দ বের করছে শুধু। মহসিন সাদিকের বাঁ*ধা ছাড়িয়ে ছুটে মুরাদের কাছে এসে বসে মুরাদের শারীরিক অবস্থা খা*রাপ দেখে অনু*রো*ধের স্বরে কুশলকে বললেন….

—“স্যার আমার ছেলেটা অনেক বড় অ*প*রাধ করে ফেলছে আমি মানছি। দয়াকরে ওরে প্রাণে মা*র*বেন না। আমার ছেলেটার অনেক য*ন্ত্র*ণা হচ্ছে। ওর শরীর ফা*ই*টা গেছে আপনার মা*ই*রে*র আ*ঘা*তে। অনেক র*ক্ত ও ঝড়তাছে। দয়াকরে আমার ছেলেটারে নিয়া হাসপাতালে যাইতে দেন।”

কুশল স্বাভাবিক কন্ঠে বললো….
—“ইচ্ছে তো করছিলো এই কা*পুরুষটাকে মা*র*তে মা*র*তে মে*রে ফেলি। কিন্তু একজন মায়ের আকূল অনু*রোধ আমাকে এই কাজটি করতে দিলো না। তবে ভাববেন না আপনার ছেলের শা*স্তি এতো অল্পতেই শেষ হয়েছে। এই মুহূর্তে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবেন কিন্তু ১ সপ্তাহ পর আবারও আপনার বাড়ির আঙিনাতে বিচারসভা বসবে। তখন এর আসল শা*স্তি*র ব্যবস্থা পুরো গ্রামবাসীর সামনে হবে। কোনো রকম চালাকি করে নিজের ছেলেকে কোথাও লুকিয়ে রাখার চেষ্টাও করবেন না। কারণ আপনাদের উপর আগামী ৭দিন আমার গার্ডদের ক*ড়া নজর থাকবে। সাদিক, একে হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।”

সাদিক মুরাদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে মহসিনের সাহায্য নিয়ে মুরাদকে উঠিয়ে বাড়ির বাহিরে নিয়ে যায়। আমেনা বেগম ও ওদের পিছন পিছন চলে যান। চাষিটি কুশলের সামনে এসে দাঁড়াতেই কুশল বললো….

—“চাচা , আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আগামী ১সপ্তাহের মধ্যে আপনার মেয়ে সুচিকিৎসা পেয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে আর তারপর ওর সামনে ওর সাথে হওয়া অ*ন্যা*য়ের বি*চা*রও হবে।”

চাষিটি ছলছল দৃষ্টি নিয়ে বললেন…..
—“তোমার মতো ছেলে যেনো প্রত্যেক ঘরে ঘরে জন্ম নেয় বাবা।”

অতঃপর কুশল চাষিটিকে নিজের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এরপর সাদিককে সাথে নিয়ে শহরে নিজের বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে কুশল।

২ঘন্টার পথ অতিক্রম করে অবশেষে কুশলের গাড়ি চৌধুরী মেনশনের ভিতরে প্রবেশ করে। কুশল গাড়ি থেকে নেমে সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। চারপাশে চোখ বুলাতেই দেখে কোনো আত্নীয়-স্বজনরা নেই। বিয়ের বাড়ির পরিবেশ কেমন থ*ম*থ*মে রূপ নিয়ে আছে। কুশল চৌধুরী মেনশনের মূল দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখে চৌধুরী ও সিকদার পরিবারের সকল সদস্যরা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছেন। সন্ধ্যা কুশলকে দেখা মাত্রই উচ্চস্বরে বললো….

—“দাদীমা , মেজো ভাইয়া এসেছেন।”

সন্ধ্যার কথা শুনে সকলেই কুশলের দিকে তাকায়। কুশল স্বাভাবিক মুখশ্রী করেই নিজের জন্য বরাদ্দ করা সোফায় এসে বসে। সেইসময় সাগরিকা কিছুটা ক*ঠো*র গলায় কুশলকে উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“তোমাকে আরো ৪ঘন্টা পূর্বে বাসায় ফিরতে বলা হয়েছিলো কুশল দাদুভাই। গ্রামে বসবাসরত সকলের স*ম*স্যা সমাধানে তুমি এতোটাই ব্যস্ত থাকো যে পারিবারিক সম*স্যা গুলোকে কোনোরূপ তো*য়া*ক্কা করো না।”

কুশল ওর শার্টের দুই হাতের কবজির বোতাম খুলে ভাঁজ করতে করতে কনুই পর্যন্ত আনতে শুরু করে। সাগরিকার কথাগুলো যে কুশলের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নি তা কুশলকে দেখে উপস্থিত সকলেই বুঝতে পেরেছেন। তাই সাগরিকা একবার হ*তা*শার নিঃশ্বাস ফেললেন। পরক্ষণেই তারেক বললেন….

—“বড় মা , কুশল বাবা অনেক সচেতন ও সু-বুদ্ধিসম্পন্ন ছেলে। যেই কাজটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কুশল বাবা আগে সেই কাজটি শেষ করে পরে বাকি কাজগুলোর দিকেও ফো*কাস করে। তাই এখন এসব বলে আর সময় ন*ষ্ট না করে আপনি বরং আসল বিষয় নিয়ে কথা বলুন।”

তারেকের কথায় সম্মতি জানায় উপস্থিত বাকিরাও। সাগরিকা শান্ত স্বরে সন্ধ্যায় হওয়া সকল ঘটনা কুশলকে খুলে বললেন। কুশল এখনও শান্ত থেকে চোখ বন্ধ করে ওর ঘাড়ে এক হাত রেখে ঘাড় এপাশ-ওপাশ নাড়াচ্ছে। কিছুসময় পর সাগরিকা আবারও কুশলকে উদ্দেশ্য করে বললেন…..

—“চৌধুরী বংশ ও সিকদার বংশের সম্মান এবং সম্পর্ক রক্ষা করার জন্য তোমাকে তরু দিদিভাইয়ের সাথে আজই বিবাহ বন্ধনে আ*ব*ব্ধ হতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো সমাধান আমাদের কারোর কাছে নেই।”

কুশল সোজা হয়ে বসে শান্ত স্বরে বললো….

—“ঠিক আছে , এই বিয়ে নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই।”

কুশলের সম্মতি পেয়ে উপস্থিত সকলের কলিজায় যেনো পানি এসে গিয়েছে। সাগরিকা বললেন….

—“কিন্তু তরু দিদিভাই তোমাকে বিয়ে করবে না বলে সেই সন্ধ্যা থেকেই নিজেকে ঘর*ব*ন্দী করে রেখেছে।”

—“তোমরা বিয়ের আয়োজন করো। আজ আর নতুন কোনো মেহোমানদের ডাকার প্রয়োজন নেই। কাজী সাহেবকে ডেকে পাঠাও। পরিবারের সকলের উপস্থিতিতেই বিয়ে হবে।”

এই বলে কুশল সোফা ছেড়ে উঠে সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় চলে যায়। সকলে কুশলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়।
সাবরিনা বললেন….

—“আমার ছেলে তো বিয়ে করার জন্য রাজি হয়েছে। এবার আপনাদের মেয়েকে কিভাবে রাজি করাবেন আপনারা?”

তারেক স্বাভাবিক কন্ঠেই বললেন….
—“কুশল বাবার বলা শেষ কথা শুনে বুঝতে পারলাম আমার মেয়ের বিয়ের জন্য রাজি হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।”

চলবে ইনশাআল্লাহ……….

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৭)
দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে কুশল সরাসরি তরুনিমার রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে দরজায় কড়া নেড়ে বললো…

—“তরুনিমা দরজা খুলো।”

বিছানার সাথে হেলান দিয়ে ঝিমাচ্ছিলো তরু। সেইসময় কুশলের কন্ঠে নিজের নাম ধরে ডাকতে শুনে তরুর ঝিমানো ভাব এক মুহূর্তে কেটে যায়। দুই পা ভাঁজ করে বাবুসাহেবের মতো বসে তরু নিজ মনে বিরবিরিয়ে বললো….

—“ব্যডা কি আমাকে তার গার্ড আর সেক্রেটারির মতো নিজের হুকুমের দা*স মনে করেছে নাকি যে দরজা খুলতে বলবে আর আমিও সুর সুর করে গিয়ে দরজা খুলে দিবো! আমি তরুনিমা সিকদার কারোর হু*কু*ম কখনও মানি না। কেও কিছু করতে বললে সেই কাজে আমার নিজের ইচ্ছেশক্তি কাজ না করলে আমি সেই কাজের দিকে ঘুরেও তাকাই না করা তো দূরের বিষয়। এখন আমার দরজা খুলতে ইচ্ছে করছে না। তাই আমি খুলবো না। খা*রু*শ ব্যডা দরজার ওপাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমায় ডাকতে ডাকতে শহীদ হয়ে গেলেও আমি দরজা খুলবো না।”

এই বলে তরুনিমা বিছানায় শুয়ে পরে। বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও তরুর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কুশলের চোখে-মুখে বি*র*ক্তি ভাব ফুটে উঠে। পরক্ষণেই কুশল শান্ত স্বরে বললো…

—“আমি ১ থেকে ১০ পর্যন্ত কাউন্ট করবো এর ভিতর যদি তুমি দরজা না খুলো তাহলে এরপর যা হবে তার জন্য তুমি নিজেই দা*য়ী থাকবে কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও ভালো ভাবে।”

কুশলের হু*ম*কির স্বরে বলা কথাগুলো শুনে তরু এক লাফে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে। ডান হাতের কনিষ্ঠা আঙুলের নখের আগাল দাঁত দিয়ে কা*ট*তে কা*ট*তে বললো….

—“এই খা*রু*শ ব্যডার কোনো ভরসা নেই। মুখে যা বলে কাজেও তাই করে দেখায়। তরু যদি বাঁচতে চাস তাহলে জোরপূর্বক হলেও দরজা খুলে দেওয়ার জন্য নিজের ইচ্ছেশক্তি জাগা নয়তো দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা এই কুশল চৌধুরী নামক আ*জ*রা*ই*লটি আজ তোর জান ক*ব*জ করেই হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।”

অতঃপর তরুনিমা দ্রুততার সাথে বিছানা থেকে নেমে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বুকের বাম পার্শে একটা হাত রেখে জোড়ে জড়ে বারকয়েক নিঃশ্বাস ফেলে বললো…..

—“তরু এই খা*রু*শ ব্যডার সামনে একদম নিজের ভ*য় প্রকাশ করবি না। সাহসের সাথে প্রতিটা কথা বলবি তাহলেই ব্যডা জ*ব্দ হবে। কি পেয়েছে টা কি! গ্রামের সবার উপর রাজ করে জন্য আমার উপরও রাজ করার চেষ্টা করবে! তা তো আমি হতে দিবো না।”

এই বলে তরু দরজা খুলে দিতেই দেখে দরজার বাহিরে দাড়িয়ে কুশল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। তরু নিজের ভিতরের ভ*য়কে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে কিছুটা কঠিন স্বরে বললো…

—“কি স*ম*স্যা আপনার হ্যা! এভাবে দরজা ধা*ক্কি*য়ে ডাকাডাকি করার মানে কি? দেখছেন যখন এতোবার ডাকাডাকি করার পরেও ভিতরের ব্যক্তিটি দরজা খুলছে না তারমানে সে দরজা খুলতে চায় না এই সামান্য বিষয়টুকু আপনার মাথায় ঢুকলো না! আর আপনার এই বুদ্ধিমত্তা নিয়ে চৌধুরী ও সিকদার বংশের ১৪ দু’গুণে ২৮ গুষ্টির মানুষ প্রশংসায় পন্ঞ্চমুখ হয়ে থাকে সবসময়! এই এই আপনি যান তো এখান থেকে। আপনাকে আমার দুই চো*ক্ষে স*হ্য হয় না।”

এই বলে তরুনিমা আবারও কুশলের মুখের উপর দরজা আটকে দিতে নিলে কুশল ওর ডানহাত বাড়িয়ে দরজা ধরে ফেলে তরুর দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো….

—“রওনাক আজমাইন চৌধুরী কুশলের মুখের উপর দরজা আটকানোর সাহস আজ পর্যন্ত কেও করে নি। আর সেই সাহস তুমি দেখাচ্ছো কি ভাবে!”

তরুনিমা দাঁতে দাঁত চে*পে বললো…
—“আমি আর সবার মতো আপনাকে ভ*য় পাই না তাই আপনার মুখের উপর দরজা লাগানোর সাহস ও আমি রাখি। দরজা থেকে হাত সরান আর আমাকে বি*র*ক্ত করিয়েন না।”

তরুর এমন কথায় রাগে বি*র*ক্তি*তে কুশল এবার নিজের শরীরের জোর প্রয়োগ করে এক ধা*ক্কা*য় দরজা খুলে ফেলে। তরু দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকায় সেই ধা*ক্কা*য় তাল সামলাতে না পেরে পরে যেতে নিলে কুশল তরুর হাত ধরে ফেলে। পরে যাওয়ার ভ*য়ে তরু চোখ-মুখ খিঁ*চে বন্ধ করে রেখেছে। পরক্ষণেই চোখ মেলে তাকাতেই কুশলকে নিজের হাত ধরে থাকতে দেখে তরু নিজের অবস্থান না বুঝেই অন্য হাত দিয়ে কুশলের হাতের উপর মা*র*তে মা*র*তে বললো…..

—“এই আপনি আমার হাত ধরেছেন কোন সাহসে! হাত ছাড়ুন বলছি।”

কুশল তরুর এমন কথা শুনে কপালে বি*র*ক্তির কয়েকটা ভাজ ফেলে মুখে কিছু না বলেই ওর হাত ছেড়ে দেয়। যার ফলে তরু ধ*প করে মেঝেতে পড়ে গিয়ে ব্য*থা*য় মুখ দিয়ে ‘আহহ মাগো কমোরটা ভে*ঙে গেলো মনে হয়’ বাক্যটি উচ্চারণ করে। কুশল তরুর দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে বললো…..

—“নিজের অবস্থান না বুঝে অন্যের দো*ষ খুঁজতে গেলে নিজেকেই ক্ষ*তি*র সম্মুখীন হতে হয় মিস.তরুনিমা সিকদার।”

তরু কুশলের কথার ভাজ বুঝতে পেরে বিরবিরিয়ে বললো….
—“তোরে কি আর সাধে আমি খা*রু*শ ব্যডা বলি! সুযোগ পেলেই জ্ঞাণের ঝুড়ি খুলে সকলের মাঝে তা বিরতন করতে বসে খা*রু*শ জ্ঞাণ দাতা কোথাকার।”

পরক্ষণেই তরু নিজের কমোরে একহাত রেখে অন্য হাতে ভর দিয়ে আলগোছে উঠে দাঁড়িয়ে বিছানায় গিয়ে বসতে বসতে বললো…..

—“আপনি যখন দেখলেন ই আমি আমার অবস্থান না বুঝেই আপনাকে আমার হাত ছাড়তে বলেছিলাম তারপরেও আপনি কেনো আমার হাত ছাড়লেন! আপনার মতো এমন আচারণের মানুষকে শত শত মানুষ যে কেনো নিজেদের বি*প*দ-আ*প*দের রক্ষক বলে মনে করেন আমি বুঝে উঠতে পারি না।”

কুশল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তরুর দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“তোমার মনে আমাকে নিয়ে যে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করেছে তা তুমি নিজ থেকে কাটিয়ে উঠতে না পারলে আমার ভালো দিক গুলো কখনও তোমার চোখে পড়বে না।”

কুশলের কথায় তরু কোনো প্রতিত্তুর না করে শুধু একবার মুখ বাঁ*কা*লো। কুশল এই রুমে থাকা ওয়ারড্রব এর উপর থেকে ফাস্টএইড এর বক্সটি হাতে নিয়ে বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়ে তরুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো…..

—“কমোরের উপর মুভ স্প্রে লাগিয়ে নাও ব্য*থা সেড়ে যাবে।”

তরু তেজ দেখিয়ে বললো……
—“আমার কোনো ঔষধ বা স্প্রের প্রয়োজন নেই। আপনার এই দয়াশীলতা এই ঘরের বাহিরে গিয়ে বাকি লোকদের ই দেখান আমাকে দেখাতে আসবেন না।”

তরুর কথা শুনে কুশল ফাস্টএইড এর বক্সটি বিছানার উপর রেখে দিয়ে বললো….

—“এখানে রাখা থাকলো ইচ্ছে হলে লাগিয়ে নিও আর ইচ্ছে না হলে লাগিও না। মানবিকতার খাতির সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব না।”

কুশলের এমন কথায় তরু কিছুটা অ*প*মা*নিত বোধ করলো। তাই দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে রাগে ফোঁ*স ফোঁ*স করে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। পরক্ষণেই কুশল আবারও বললো…..

—“নিচে সকলে তোমার আর আমার যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।”

তরু কুশলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো….
—“কেনো?”

—“আজ যেই সম*স্যার সৃষ্টি হয়েছে তা সমাধান করতে দাদীমা তোমার আর আমার বিয়ের কথা বলেছেন তা তুমি জানো নিশ্চয়ই!”

—“হুম , জানি। কিন্তু আমি এই কথা উঠার সাথে সাথেই সকলের সামনে বলে দিয়েছি আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।”

—“কিন্তু আমি বিয়ের জন্য সম্মতি জানিয়ে দিয়েছি সকলের সামনেই।”

তরু কিছুটা রাগ নিয়ে বললো….
—“আপনি সম্মতি জানালেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। আমি আগেও বলেছি আবারও বলছি আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না মানে পারবো না।”

কুশল শান্ত স্বরে বললো…..
—“আমাকে বিয়ে করতে না পারার একটা যুক্তিযুক্ত কারণ যদি তুমি বলতে পারো তাহলে আমি নিজ দায়িত্বে এই বিয়ের সম্বন্ধ ভে*ঙে দিবো। কোনো সম্পর্ক বা বংশ মর্যাদা রক্ষার কথা চিন্তা করবো না।”

কুশলের এমন কথায় তরু বিয়ে ভা*ঙা*র জন্য কি কারণ বলবে তা খুঁজে না পেয়ে বিরবিরিয়ে বললো….

—“এই খা*রু*শ ব্যডা এতোটাই গুছিয়ে চলাফেরা করে সবসময় যে এর বিরুদ্ধে একটা খা*রাপ রিপোর্ট বের করা সম্ভব না। তাহলে এখন এই বিয়ে ভা*ঙা*র জন্য আমি কি যুক্তিযুক্ত কারণ বের করবো!”

তরুর কোনো প্রতিত্তুর না পেয়ে কুশল আবারও বললো……..

—“এতোসময় ধরে ভেবেও আমাকে বিয়ে না করার জন্য কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ তুমি বের করতে পারলে না। তাহলে কেনো বার বার বলছো তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারবে না? যেই বাবা-মা তোমাকে জন্ম দিয়ে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন, সু-শিক্ষা দিয়েছেন, আদর-যত্ন-ভালোবাসার কোনো কমতি না রেখে তোমাকে এতো বড় করেছেন, যেই বংশের রক্ত তোমার শরীরে বইছে সেই বংশের সম্মান রক্ষা করা কি তোমার নিজ দায়িত্বের উপর পড়ে না! আমি আমার পরিবারের সকলকে ও এই চৌধুরী বংশকে অনেক ভালোবাসি তাই এই চৌধুরী বংশের সম্মানের উপর যেনো কখনও কেও একটা আঙুলও উঠাতে না পারে তার জন্য আমি জীবনে সবরকম পদক্ষেপ গ্রহন করতে রাজি আছি। একটু আগে যখন আমি বাসায় প্রবেশ করলাম তখন সকলের মুখে কোনো হাসি ছিলো না, বাবা-মায়ের ছোট্ট ভু*লের জন্য আজ এমন সম*স্যার সৃষ্টি হয়েছে আমি তা মানছি কিন্তু যখন দাদীমার মুখে সম্পূর্ণ ঘটনাটি জানতে পারলাম তখন মনে হলো দাদীমার নির্ধারণ করা সিদ্ধান্তটি মেনে নিলেই হয়তো সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠবে, বংশের সম্মান রক্ষা হবে, চৌধুরী বংশের সাথে সিকদার বংশের যুগ যুগ ধরে চলে আসা এতো ভালোবাসাময় সম্পর্কের বাঁধনটি আরো মজবুত হবে। তাই আমি নিজের জীবনের ভবিষ্যত নিয়ে এতো গভীর ভাবে চিন্তা না করে সকলের সামনে তোমাকে বিয়ে করার জন্য সম্মতি জানিয়ে দিয়েছি। আমার সম্মতি আছে জানতে পেরে সাথে সাথেই উপস্থিত সকলের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছিলো। আমার বলা কথাগুলো একটু ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভেবে দেখিও তারপরও যদি তোমার মন বলে আমাকে বিয়ে করা যাবে না তাহলে তুমি নির্দ্বিধায় সকলের সামনেই না সূচক জবাব জানিয়ে দিয়ে নিজের পরিবারকে নিয়ে চৌধুরী মেনশন থেকে চলে যেতে পারো কেও তোমাকে ২য় কোনো প্রশ্ন করে বি*ভ্রা*ন্ত করবে না। আমি নিচে যাচ্ছি, তোমার মতামত জানার জন্য সকলের সাথে সেখানেই বসে অপেক্ষা করবো।”

এই বলে কুশল তরুনিমার রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। তরু স্ত*ব্ধ দৃষ্টি নিয়ে কুশলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ…………..