হৃদকোঠোরে রেখেছি তোমায় পর্ব-৫+৬+৭

0
248

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৫)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৮)
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছেন চৌধুরী ও সিকদার পরিবারের সকল সদস্যরা। সেইসময় কুশলকে একলা সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসতে দেখে সাবরিনার পাশে বসারত ওনার ছোট জা কামিনী সাবরিনার দিকে কিছুটা হেলে ফিসফিসিয়ে বললেন….

—“মেজো ভাবী…আপনার ছেলে তো একাই সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসতেছে। চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে সিকদার ভাইজানের মেয়েকে সে মানাতে সক্ষম হয় নি।”

কামিনীর এরূপ কথা শুনে সাবরিনা সিঁড়ির দিকে লক্ষ্য করতেই কুশলের গম্ভীর মুখশ্রী দেখে বললেন….

—“কখনও কোনো খুশির বিষয় ঘটলেও তো কুশলকে খুব একটা হাসি-খুশি মুখশ্রী নিয়ে থাকতে দেখলাম না এতোগুলো বছরে। তাই ওর চেহারার এই গম্ভীর ভাব দেখে সিকদার ভাইজানের মেয়ের সম্মতি হলো নাকি হলো না তা বোঝা সম্ভব না। আর তাছাড়া ঐ মেয়ে যেই পরিমাণ ঘাড়*ত্য*ড়া স্বভাবের এতো সহজে রাজি হবে না বলেই আমার মনে হয়। দেখা যাক কুশল কি বলে।”

সাবরিনার কথা শেষ হওয়া মাত্রই কুশল ড্রয়িংরুমে নিজের জন্য বরাদ্দ করা সোফায় গিয়ে বসে পরে। কুশলের মুখ থেকে তরুনিমা কি বলেছে সেই উত্তর জানার জন্য ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সকলেই উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে৷ সেইসময় সাগরিকা শান্ত স্বরে কুশলকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন….

—“কুশল দাদুভাই….তরু দিদিভাই বিয়ের জন্য শেষ কি মতামত জানালো তোমায়?”

কুশল স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো…
—“সেটা তরুনিমার মুখেই শুনে নিতে পারবে দাদীমা। কিছুসময় অপেক্ষা করো।”

কুশলের এমন কথা শুনে সকলের মুখেই কিছুটা চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে। তমালিকা বললেন….

—“আমি বরং তরুর কাছে গিয়ে ওকে রাজি করানোর চেষ্টা করে দেখছি একবার।”

এই বলে তমালিকা সোফা ছেড়ে উঠতে নিলে কুশল বললো….
—“আর কাউকে ওর কাছে গিয়ে বিয়ের বিষয় নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন নেই আন্টি। আপনি বসুন, আপনার মেয়েকে একাই তার জীবনের এই বিষয় নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে দিন। তবে একটা কথা বলে রাখছি, আজ যদি তরুনিমা ওর শেষ সিদ্ধান্ত হিসেবে আমাকে বিয়ে করবে না বলেই চূড়ান্ত করে তাহ……”

কুশলকে ওর পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই তরুনিমা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে উচ্চস্বরে বললো…..

—“থামুন মি.কুশল চৌধুরী। আপনাকে এখন আর পুরো কথা শেষ করতে হবে না। কারণ আমি আমার যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা নিয়ে ফেলেছি।”

তরুনিমার কন্ঠ কর্ণপাত হতেই সকলে তরুর আসার দিকে দৃষ্টি স্থির করে। তরু ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“আমি তরুনিমা সিকদার নিজের সজ্ঞানে থেকে ঠান্ডা মস্তিষ্কে চিন্তা-ভাবনা করার পর এই সিদ্ধান্তে মনঃস্থির করেছি যে, আমি মি.রওনাক আজমাইন চৌধুরী কুশলের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজি আছি। হ্যা, আমি সন্ধ্যার সময় সকলের সামনে ওনাকে বিয়ে করতে পারবো না বলেছিলাম ঠিকই কিন্তু গত ২-৩ঘন্টা যাবৎ চিন্তা করার পর বুঝতে পারলাম আমাদের ২বংশের মাঝে যেই স*ম*স্যার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান করতে একটি সঠিক পদক্ষেপ গ্রহন করা উচিত। যেহেতু আমার শরীরে সিকদার বংশের র*ক্ত বইছে সেহেতু এই বংশের সম্মান আর এই বংশের সাথে জড়িয়ে থাকা অন্য বংশের সম্মান ও তাদের সাথে সম্পর্কের বন্ধন রক্ষা করা আমার দায়িত্বের মাঝে পড়ে। তাই আমি দাদীমার নেওয়া সিদ্ধান্তকে স্বইচ্ছায় মেনে নিয়েছি। আপনারা সবাই বিয়ের আয়োজন করতে পারেন।”

তরুনিমাকে বিয়ের জন্য সম্মতি প্রদান করতে দেখে উপস্থিত সকলের মুখেই হাসির রেখা ফুটে উঠে। তরু কুশলের দিকে তাকাতেই দেখে কুশল নিজের দৃষ্টি মেঝেতে স্থির করে রেখেছে ওর মুখে কোনো চিন্তা বা আনন্দের বা আফসোসের ছাপ ফুটে উঠে নি। পরক্ষণেই তরু নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। সাগরিকা হাসিমুখে বললেন…..

—“তারেক, সায়মন তোমরা দ্রুত কাজী আনার ব্যবস্থা করো। বউমারা তোমরা এখনও বসে আছো কেনো? আমার হবু নাতবউ কি এমন বেরঙিন সাজে বিয়ের আসরে বসবে? যাও গিয়ে সবথেকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় গহনা পড়িয়ে সাজিয়ে আনো আমার হবু নাতবউকে। সন্ধ্যা দিদিভাই তুমি অনন্যা দিদিভাইকে নিয়ে যাও। ওকেও খুব সুন্দর করে সাজিয়ে আনো। আর কনক দাদুভাই তুমি আর কুশল দাদুভাই রুমে গিয়ে সুন্দর শেরওয়ানি পড়ে তৈরি হয়ে এসো। আজ চৌধুরী বাড়িতে আমার দুই নাতীর একসাথে বিয়ে হবে।”

সাগরিকার বলানুযায়ী সকলে সকলের কাজের উদ্দেশ্যে একে একে ড্রয়িংরুম ত্যগ করে।

(৯)
১ঘন্টা পর……
চৌধুরী মেনশনের ডান সাইডে কনক আর তরুনিমার জন্য সাজানো বিয়ের আসরটিতেই পুনরায় কনক-অনন্যা আর কুশল-তরুনিমার বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মন্ঞ্চের মাঝ বরাবর ফুলের পর্দা দেয়া যার দুইপাশে ২টি বড় সোফা রাখা আছে। একপার্শে বর, বরের বাড়ির ১-২জন সদস্য ও কাজী সাহেব বসতে পারবেন আরেকপার্শে কণে ও কণের বাড়ির ১-২জন সদস্যরা বসতে পারবেন। আর মন্ঞ্চের সামনে বাকি সদস্যদের বসার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

কনক চৌধুরী পরিবারের ১ম নাতী হওয়ায় কনক আর অনন্যার বিবাহকার্যই ১ম এ সম্পন্ন করা হবে বলেই মনঃস্থির করেছেন মধ্যবয়সের সকল সদস্যরা। লাল ও সবুজের সংমিশ্রণে তৈরি ডিজাইনার লেহেঙ্গা ও চৌধুরী বংশের ঐতিহ্যবাহী স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে ভিষণ সুন্দর ভাবে অনন্যাকে সাজিয়ে দিয়েছেন সাবরিনা এবং কামিনী দু’জনে মিলেই। অন্যদিকে অনন্যার সাথে ম্যচ করে লাল ও সবুজের সংমিশ্রণে তৈরি ডিজাইনার শেরওয়ানি পড়ে তৈরি হয়েছে কনক। অনন্যার পরিবারের কোনো সদস্য বিয়ের আসরে উপস্থিত না থাকায় সাবরিনা নিজেই অনন্যাকে নিয়ে মন্ঞ্চে উঠে কণের স্বস্থানে বসিয়ে দিয়েছেন। আর কনকের বাবা সায়মন কনককে নিয়ে বরের স্থানে বসিয়ে দিয়ে নিজেও ওর পাশেই বসে পড়েন। সাগরিকা লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে মন্ঞ্চে উঠে অনন্যার পাশে বসে পড়েন। কনক ও অনন্যা দু’জনের মুখশ্রীতেই ফুটে আছে তৃপ্তির হাসি। ভালোবাসার পূর্ণতা হলে যে কতোটা আনন্দ হয় তা কেবল ২জন ভালোবাসার মানুষই অনুভব করতে পারেন। কনকের হাতের বাম পার্শে কাজী সাহেব বসে পড়েন। অতঃপর কনক ও অনন্যার বিবাহকার্য শুরু হয়। ২৫লক্ষ টাকা দেনমোহরনা ধরে ইসলামিক শরিয়ত মেনে কবুল বলে কনক-অনন্যা বৈবাহিক বন্ধনে আবব্ধ হয়। পরক্ষণেই আইনত ভাবে বৈবাহিক বন্ধনে আবব্ধ হতে রেজিস্ট্রি কাগজে সিগনেচার করে কনক ও অনন্যা দু’জনেই। ইসলামিক শরিয়ত ও আইনত নিয়ম মেনে অবশেষে কনক-অনন্যার বৈবাহিক কার্য সুসম্পন্ন হয়। বৈবাহিক কার্য সম্পন্ন হতেই কনক আর অনন্যা একসাথে মন্ঞ্চ থেকে হাত ধরে নেমে মন্ঞ্চের সামনে ব্যবস্থা করা বসার স্থানে বসে পড়ে।

সাগরিকা, সাবরিনা ও তমালিকাকে উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“সাবরিনা বউমা….তমা বউমা ভিতরে গিয়ে এখন তরু দিদিভাইকে নিয়ে এসো। আর সায়মন, তারেক তোমরা গিয়ে কুশল দাদুভাইকে নিয়ে এসো। ওদের বিবাহটি সুসম্পন্ন হলেই আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবো।”

সাগরিকার কথানুযায়ী ওনারা সকলেই চৌধুরী মেনশনের ভিতরে চলে যায় কুশল-তরুকে আনার উদ্দেশ্যে।

বেশ কিছুসময় পেরিয়ে যাওয়ার পর ওনারা ৪জন কুশল আর তরুকে না নিয়েই বিয়ের আসরে উপস্থিত হলে উপস্থিত বাকিরা প্রশ্নসিক্ত দৃষ্টি নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়। সাগরিকা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওনাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন….

—“কি ব্যপার…তোমরা একাই চলে আসলে যে? কুশল দাদুভাই আর তরু দিদিভাইকে সাথে নিয়ে আসার জন্যই তো তোমাদের ভিতরে পাঠালাম।”

সাবরিনা বললেন….
—“কি করে সাথে আনবো ওদের মা! আমরা গিয়ে দেখি কুশল আর তরুনিমা ওরা কেউই নিজেদের রুমে নেই। পরে পুরো চৌধুরী মেনশনের ভিতরে খুঁজে দেখলাম ওদের কোথায় পেলাম না।”

পাশ থেকে সায়মন বললেন…..
—“আমি কুশলকে কল করেছিলাম বেশ কয়েকবার কিন্তু প্রতিবারই ওর ফোন বন্ধ দেখিয়েছে।”

তমালিকা নিজের হাতে থাকা ফোনটি সামনে ধরে বললেন….
—“তরু তো ওর নিজের ফোনটা রুমেই ফেলে রেখে গিয়েছে।”

ওদের কথা শুনে উপস্থিত সকলেই অনেক অবাক হয়ে যায়। সাগরিকা নিজের চেহারায় চিন্তার ছাপ ফুটিয়ে বললেন….

—“বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলে এভাবে কাওকে কিছু না জানিয়েই দু’জনে একসাথে কোথায় চলে গেলো আশ্চর্য বিষয় তো…..!”

চলবে ইনশাআল্লাহ……..

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৬)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৯)
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন সাগরিকা চৌধুরীর বড় ছেলে রায়হানুল চৌধুরী। ২০ বছর পূর্বে যখন রায়হানুলের স্ত্রী রুবিনা চৌধুরীর সন্তান প্র’স’ব করার সময় হয়ে এসেছিলো সেইসময় তিনি ব্যবসার বিশেষ কাজে শহরের বাহিরে ছিলেন। পরবর্তীতে স্ত্রীর শ*ঙ্কা*জ*নক অবস্থার কথা জানতে পেরে দ্রুত গাড়ি ড্রাইভিং করে বাসায় ফেরার পথে ট্রাকের সাথে এ*ক্সি*ডে*ন্ট করে মাথায় গু*রু*তর আ*ঘা*ত পান। বড় ধরণের সা*র্জা*রির মাধ্যমে রায়হানুলকে প্রাণে বাঁচাতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে তিনি কো*মায় চলে যান। আর আজ দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ কো*মায় আছেন তিনি৷ ২০ বছর পূর্বের সেই কালদিনে রুবিনাও সন্তান প্র*স*ব*কালীন সময় মৃ*ত সন্তানের জন্ম দিয়ে মা*রা গিয়েছিলেন। রায়হানুল কো*মা থেকে ফিরে আসবেন, আবারও পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হয়ে উঠবেন সেই আশা মনের ভিতর পুষে রেখে তার চিকিৎসা আজও চালিয়ে যাচ্ছেন চৌধুরী বংশের সদস্যরা। রায়হানুলের চিকিৎসার যেনো কোনোরকম ত্রু*টি না হয় তাই তাকে হাসপাতালেই রাখা হয়েছে দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ। পরিবারের ছোট-বড় সদস্যরা মাঝেমধ্যে হাসপাতালে এসে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে যান।

ঘড়িতে তখন রাত ১১ টা বাজে………
রায়হানুলের কেবিনের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে কুশল আর তরুনিমা। ওদের সাথে রায়হানুলের চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকা ওনার বন্ধু খালেকুজ্জামান নামের একজন মধ্যবয়সের ডাক্তার ও ২জন মধ্যবয়সের পুরুষ ওয়ার্ডবয়ও ছিলেন। দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ ওনারাই রায়হানুলের চিকিৎসা ও দেখাশোনার দায়ভার সামলিয়ে এসেছেন। তরুনিমা রায়হানুলের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওনার স্থির হয়ে থাকা মুখশ্রীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। কুশল নম্রস্বরে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বললেন…..

—“খালেক আঙ্কেল আমি বড় বাবাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছি।”

কুশলের এমন কথা শুনে খালেক অনেক অবাক হয়ে যায়। পাশাপাশি খালেকের চেহারায় চিন্তার ছাপ ও ফুটে উঠে। খালেক অবাক স্বরে বললেন….

—“কেনো কুশল বাবা হঠাৎ রায়হানুলকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলছো যে! আমরা তো চিকিৎসায় কোনো ত্রু*টি রাখি নি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে ওর দেখাশোনার দায়ভার ও আমাদের উপরেই বর্তে দিয়েছিলেন তোমার মা সাবরিনা চৌধুরী। আমরা নিষ্ঠার সাথেই সেই দায়িত্ব পালন করে এসেছি।”

কুশল স্বাভাবিক কন্ঠে বললো….
—“আপনাদের চিকিৎসা ও দেখাশোনার দায়িত্ব পালনে কতোটুকু নিষ্ঠা ছিলো তা নিয়ে আমি কোনো প্রশ্ন বা অভিযোগ উঠাচ্ছি না। একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষও যদি দীর্ঘসময় ধরে চারদেওয়ালের মাঝে ব*ন্দী হয়ে থাকে তাহলে সেও ধীরে ধীরে অ*সুস্থ হয়ে পড়বে। দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ বড় বাবা কো*মায় থাকায় এই হাসপাতালের চার দেওয়ালের মাঝেই ব*ন্দী হয়ে আছেন। তার মাঝে এতোগুলো বছরে একটাবারের জন্যও কোনো রকমের ইম্প্রুভমেন্ট আমরা কেও দেখি নি। তাই বড় বাবাকে আর হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে রাখার প্রয়োজনও আমি মনে করছি না। আজ বড় বাবাকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। অতঃপর পরিবারের সকলের মাঝে থাকলে, খোলা-মেলা পরিবেশের মাঝে থাকলে যদি সামান্য তমোও ইম্প্রুভমেন্ট হয় ওনার মাঝে এটাই আমাদের কাছে অনেক বড় পাওয়া হবে।”

—“কিন্তু…বিনা চিকিৎসায় রায়হানুলের শারিরীক অবস্থা বর্তমানের থেকে আরো বেশি খা*রা*প হতে পারে। কুশল বাবা, আমি তোমাকে অনেক বিচক্ষণ ছেলে বলেই মনে করি। তাই তোমার থেকে এমন সিদ্ধান্ত শোনার আশা আমি করি নি।”

কুশল খালেকের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো….
—“চিকিৎসা বন্ধ থাকবে এমন কথা তো আমি বলি নি আঙ্কেল।”

—“আমার পক্ষে এতো বড় হাসপাতালের দায়ভার ছেড়ে দিয়ে রায়হানুলের চিকিৎসা করতে তোমাদের বাসায় গিয়ে থাকা তো সম্ভব হবে না কুশল!”

কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“আপনি বড় বাবার চিকিৎসা করতে না পারলেও আমাদের বিশেষ কোনো স*ম*স্যা*র সম্মুখীন হতে হবে বলে মনে হয় না আমার। বড় বাবার চিকিৎসার জন্য আমি অন্য কোনো ডাক্তারের ব্যবস্থা করে নিতে পারবো।”

কুশলের এমন কথা শুনে খালেক দ্রুত কন্ঠে বলে উঠলেন….
—“না , তুমি এমনটা করতে পারো না।”

কুশল ভ্রু কিন্ঞ্চিত কুঁচকে নিয়ে বললো….
—“কেনো! করতে না পারার কি আছে?”

কুশলের প্রশ্নে খালেক কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো….
—“কারণ , রায়হানুলের চিকিৎসার দায়ভার দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ আমিই সামলে এসেছি তাই হুট করে ওর চিকিৎসার দায়ভার অন্য কাওকে দিয়ে দিলে তা আমার সম্মানের উপর আঙুল উঠানোর সমতুল্য হবে।”

কুশল ওর ঠোঁটে আলতো হাসি ফুটিয়ে বললো….
—“আঙ্কেল….আপনার বয়স তো কম হলো না। ১-২ বছরের মধ্যেই আপনাকে এই চিকিৎসালয় থেকে রিটায়ার্ড নিতে হবে। তখন আপনার অবর্তমানে বড় বাবার চিকিৎসার দায়ভার ঠিকই অন্য কাওকে দিয়ে দিতে হবে। বিগত বছর গুলো ধরে বড় বাবাকে সুস্থ করে তোলার জন্য অনেক চেষ্টা ও পরিশ্রম করেছেন আপনি। আমার মনে হলো এবার আপনার বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। আর কুশল চৌধুরী যখন কোনো সিদ্ধান্তে নিজের মনঃস্থির করে তখন দুনিয়া উ*ল্টে গেলেও সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হ*টে না। শেষ আরেকটা কথা বলছি, আপনার সম্মানের উপর আঙুল উঠানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই। দ্রুত বড় বাবাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাগজপত্রগুলো রেডি করুন, আমার হাতে বেশি সময় নেই।”

কুশলের কথাগুলো শুনে খালেক আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। অতঃপর খালেক আর কোনো উপায় না পেয়ে পুরুষ ওয়ার্ড বয়দের উদ্দেশ্য করে বললেন…..

—“তোমরা পেশেন্টের সবকিছু গুছিয়ে দাও।”

খালেকের কথানুযায়ী পুরুষ ওয়ার্ডবয় দু’জন রায়হানুলের সব জিনিস পত্র গুছাতে শুরু করে। খালেক রায়হানুলের কেবিন থেকে বেড়িয়ে এসে নিজের এফ্রণের পকেট থেকে ফোনটা বের করে কাওকে কল করে।

(১০)
চৌধুরী বাড়ির বিয়ের আসরে সকলেই চি’ন্তিত মুখশ্রী নিয়ে বসে আছে। পরবর্তীতে কুশলকে আরো বেশ কয়েকবার কল করেও ফোন বন্ধ পেয়ে আরো বেশি হ*তাশ হয়েছে সকলে। সায়মন পায়চারি করতে করতে রাগী স্বরে বললেন….

—“মানছি তরুনিমার মাঝে থেকে এখনও বাচ্চাসুলভ স্বভাবগুলো পুরোপুরি ভাবে কাটে নি কিন্তু কুশল! কুশলকে তো আমরা অনেক সিনসিয়র আর সুবিদ্ধিসম্পন্ন ছেলে বলে মনে করেছিলাম। তাহলে ও এমন দায়িত্ব*জ্ঞান*হী*নের মতো কাজ করতে পারলো কি করে! ওর থেকে অন্তত এমনটা আশা করি নি আমি।”

সেইসময় সাবরিনা তমালিকা আর তারেককে উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“বিয়ে না হতেই আপনাদের মেয়ে আমার এতো দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন ছেলেকে দায়িত্ব*জ্ঞান*হী*ন বানিয়ে ছাড়লো। না জানি বিয়ের পর ওর সাথে থাকতে থাকতে ছেলেটাকে আরো কতো কথা শুনতে হবে।”

তমালিকা কিছু বলতে নিলে তারেক তাকে থামিয়ে দিয়ে ইশারায় প্রতিত্তুর করতে না করে। কামিনী নিজের লম্বা চুলের বিনুনিটি ঘাড়ের ডান পার্শে নিয়ে হাত দিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে বললেন….

—“মেজো ভাবী একদম ঠিক কথা বলেছেন। এর আগে কখনও কুশলকে এমন দায়িত্ব*জ্ঞান*হী*নের মতো কাজ করতে দেখি নি আমরা। আপনাদের মেয়ের সংস্পর্শে আসতে না আসতেই ওর মাঝে এমন পরিবর্তন। না জানি ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে।”

কামিনীর এমন কথায় তমালিকার শরীর রাগে জ্ব*ল*ছে। স্বামীর নি*ষে*ধ মান্য করতে হচ্ছে জন্য সব রাগ নিজের মধ্যেই হজম করে নিতে হচ্ছে তমালিকাকে। ওদের আরো কিছুসময়ের কথোপকথনের মাঝেই কুশল আর তরু রায়হানুলকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে নিয়ে বিয়ের আসরে উপস্থিত হয়। কুশল আর তরুর সাথে রায়হানুলকে দেখামাত্রই সাগরিকা, কামিনী, রিজভী, সায়মন, সাবরিনা সহ সকলেই যেনো অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যান। কারোর মুখে খুশির ছাপ ফুটে নেই। ফুটে আছে শুধু অবাক আর চিন্তার ছাপ। কামিনী ওনার স্বামী রিজভীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে কপালের উপর চিন্তার ভাজ ফেলে ফিসফিসিয়ে বললেন….

—“তোমার ভাতিজা হঠাৎ বড় ভাসুরকে বাসায় নিয়ে আসলেন কেনো গো?”

রিজভী শুকনো ঢোক গি*লে বললেন…
—“কুশল যেই কাজই করে তার পিছনে বড় কোনো উদ্দেশ্য থাকে। হুটহাট কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো ছেলে সে নয়। জানি না বড় ভাইয়াকে বাসায় নিয়ে আসার পিছনে কুশলের উদ্দেশ্য কি রয়েছে। তবে কেনো জানি না আমার মন ভিষণ কু*ডাক ছাড়ছে।”

কামিনী জোর পূর্বক নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে বিনুনি নাড়াতে নাড়াতে বললেন….
—“নিজের মনকে সংযত রাখো আর চেহেরা থেকে চিন্তার ছাপ কাটিয়ে হাসি হাসি মুখে থাকো। নয়তো বাকিদের মনে আমাদের এমন চাল-চলন নিয়ে স*ন্দে*হ জাগবে।”

সাগরিকা স্তব্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন কুশল, তরু আর রায়হানুলের দিকে। পরক্ষণেই সায়মন কুশলকে উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“কাওকে কিছু না জানিয়ে গুরুজনদের থেকে অনুমতি না নিয়েই তুমি বড় ভাইজানকে বাসায় নিয়ে আসলে কেনো কুশল?”

কুশল সায়মনের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো…

—“কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বা কোনো কাজ করার জন্য আমি কারোর থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করি না তা আপনি খুব ভালো করেই জানেন।”

সকলের সামনে কুশলের বলা এমন কথায় সায়মন বেশ অ*প*মা*নিত বোধ করে প্রতিত্তুর করতে নিলেই সাবরিনা তাকে থামিয়ে দিয়ে হাসিমুখে ওদের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললেন….

—“আহা তোমরা বাবা-ছেলেতে এভাবে কথা বলে নিজেদের মাঝে মনো*মা*লি*ন্যের সৃষ্টি করো না তো। কুশল বাবা তুমি যা করেছো একদম ঠিক করেছো। এই পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে থাকেন ই বা কতোদিন! বড় ভাইজান কো*মায় থাকার কারণে হাসপাতালের চার দেওয়ালের মাঝেই নিজের জীবনের এতো গুলো বছর কাটিয়ে দিলেন। এখন জীবনের বাকি সময়টুকু না হয় নিজের বাসায় পরিবারের সাথে থেকেই কাটিয়ে দিবেন। কুশল বাবা, তুমি বড় ভাইজানকে একেবারের জন্যই হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে এনেছো তো?”

কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“হুম বড় বাবাকে হাসপাতাল থেকে একেবারের জন্যই ছাড়িয়ে এনেছি।”

—“আচ্ছা , অনেক সময় তো পেরিয়ে গেলো এখন না হয় তোমাদের বিবাহকার্য শুরু করা যাক!”

কুশল আর তরুনিমা একে-অপরের দিকে একপলক তাকিয়ে সাথে সাথেই দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিলেন। পরক্ষণেই কুশল রায়হনুলের হুইচেয়ারের দুইপাশ ধরে মন্ঞ্চের সামনে এনে থামিয়ে দেয়। তারপর কুশল মন্ঞ্চে উঠে নিজ আসনে বসে পরে। তরুনিমাও মন্ঞ্চে উঠে নিজ আসনে বসে পরে। অতঃপর সমস্ত রকম নিয়ম-কানুন মেনে কুশল-তরুর বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়। বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়ে গেলে সকলেই বিয়ের আসরের স্থান ত্যগ করে চৌধুরী মেনশনের ভিতরে প্রবেশ করে।

দু’জন পুরুষ সার্ভেন্টকে রায়হানুলকে তার নিজ কক্ষে যত্নের সহিত শুইয়ে দিয়ে আসার হুকুম দেয় কুশল। সাগরিকা শান্ত স্বরে বললেন….

—“কনক দাদুভাই তুমি অনন্যা দিদিভাইকে নিয়ে এবার নিজের রুমে যাও। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম করো তোমরা।”

সাগরিকার কথানুযায়ী কনক আর অনন্যা নিজেদের রুমে চলে যায়। ওরা চলে যেতেই সাগরিকা আবারও বললেন….

—“কুশল দাদুভাই তুমিও তরু দিদিভাইকে নিয়ে নিজের রুমে যাও। আর বাকিরাও যার যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম করো।”

অতঃপর ধীরে ধীরে সকলেই ড্রয়িংরুমের স্থান ত্যগ করে নিজ নিজ রুমে চলে যায়। সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় পরনে থাকা ভাড়ি লেহেঙ্গাটি দু’হাতে উঁচু করে ধরে হাঁটার চেষ্টা করেও বারবার পায়ের সাথে বে*জে যাওয়ায় তরুর হাঁটতে ভিষণ ঝা*মে*লা হচ্ছিলো। কয়েকটা সিড়ি পার করতেই লেহেঙ্গার সাথে পা বে*জে তরু প*ড়ে যেতে নিলেই পিছন থেকে কুশল বা’হাতে তরুর কমোর জড়িয়ে ওকে ধরে নেয়। ভ*য়ে তরু নিজের চোখ-মুখ খিঁ*চে বন্ধ করে নেয়। পরক্ষণেই নিজে শূন্যে ভেসে আছে এমন ভাব উপলব্ধি করতেই তরু চোখ মেলে তাকায়। চোখ মেলে তাকাতেই তরু দেখে কুশল তাকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়েছে। তরু ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে কুশলের দিকে তাকিয়ে বললো…..

—“এই আপনি আমাকে কোলে নিয়েছেন কোন সাহসে! নামান বলছি।”

তরুর কথায় কুশল কোনো গুরুত্ব না দিয়ে ওকে কোলে নেওয়া অবস্থাতেই একের পর এক সিঁড়ির ধাপ পেড়িয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। তরু আবারও বললো…..

—“ভালো হচ্ছে না কিন্তু, আপনাকে আমি আমায় নামিয়ে দিতে বললাম তো। আমার কথা কি আপনার কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না?”

কুশল নিজের দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির রেখে কদম ফেলতে ফেলতে শান্ত স্বরে বললো…..

—“সন্ধ্যার পর একবার পরে গিয়ে কমোরে বেশ আ*ঘা*ত পেয়েছিলে, আমার উপর থাকা রাগের কারণে তখন ঔষধ ও লাগাও নি। একটু আগে আবারও লেহেঙ্গার সাথে পা বেজে প*রে যেতে নিয়েছিলে, আমি ছিলাম বিধায় তোমাকে পরে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে নিতে পেরেছি। এখন নামিয়ে দেওয়ার পর আবারও যদি লেহেঙ্গার সাথে পা বে*জে পরে যেতে নাও তাহলে কিন্তু আমি আর তোমাকে ধরতে যাবো না। তখন এতো উঁচু থেকে নিচে পরে গেলে তোমার শরীরের কয়টা হাড় যে ভে*ঙে যাবে তা তুমি গুণে শেষ করতে পারবে কি! এর থেকে ভালো হয় ছ’ট-ফ’ট না করে নিজের মুখটা বন্ধ রাখো। আমি সারাজীবন ধরে তোমাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো না। সঠিক সময় হলে ঠিকই নামিয়ে দিবো।”

কুশলের কথাগুলো শুনে তরু আর কোনো প্রতিত্তুর না করে শুধু মুখ বাঁ*কা*য়।

চলবে ইনশাআল্লাহ………

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৭)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১১)
সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠা মাত্রই কুশল তরুকে নিজের কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বললো…

—“এবার সাবধানে হেঁটে রুমে এসো। আশা করছি এখন এই সমান জায়গায় পরে গিয়ে শরীরের আর কোনো অংশ ভে*ঙে ফেলবে না।”

তরু চোখ ছোট ছোট করে কুশল এর দিকে তাকিয়ে বললো….
—“আপনি এমন ভাবে বলছেন যেনো আমি ইচ্ছে করেই পরে যাই আর শরীরে ব্যথা পাই!”

—“সেটা তুমিই জানো কি করো তুমি।”

কথাটি বলেই কুশল ওর রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তরু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কুশলের যাওয়ার পানে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে বললো….

—“এই খা*রু*শের সাথে এখন থেকে এক রুমে থাকতে হবে আমায়! ব্যডা তো আগে আগেই নিজের রুমে চলে গেলো। তারমানে তো উনি বিছানায় শুয়ে পড়বেন। এই খা*রু*শের সাথে বাধ্য হয়ে রুম শেয়ার করলেও বিছানা শেয়ার করতে পারবো না আমি। তরু এভাবে বাঁশের খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত রুমে যা আর বিছানাটা দখল করে নে।”

এই বলে তরু দু’হাতে লেহেঙ্গার দু’পাশ তুলে ধরে দ্রুত পায়ে কুশলের রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিছুসময় পর তরু রুমের ভিতর প্রবেশ করতেই দেখে কুশল রুমের ভিতরে নেই। তরু কুশলের রুমটা ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে দেখে। রুমের ভিতর রাখা সব আসবাবপত্র ও জিনিসপত্র খুব পরিপাটিভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা রয়েছে। আলিশান বিছানার ডানপার্শে একটা মাঝারী সাইজের হেলানো সোফা রাখা রয়েছে। একজন মানুষ একটু কষ্ট করলেই সেখানে ঘুমাতে পারবে। তরু বিছানা থেকে একটা বালিশ আর কম্বল নিয়ে সেই শোফার উপর রাখতে নেয়। সেইসময় কুশল তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসে। পরণে তার একটা কালো রংয়ের হাফ হাতা টি-শার্ট আর কালো রংয়ের একটা ট্রাউজার রয়েছে। কুশলের উজ্জ্বল শ্যম শরীরে কালো রংটি একটু বেশিই মানিয়েছে। পরক্ষণেই কুশল তরুর দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো….

—“অতোটুকু সোফায় শুয়ে আরাম করে ঘুমাতে পারবে না। বর্তমানে আমি তোমার স্বামী হই তাই আমার থেকে আলাদা ভাবে নিরাপত্তা নেওয়ার প্রয়োজন নেই তোমার। নির্দ্বিধায় বিছানায় শুয়ে ঘুমাতে পারো।”

তরু ভ্রু যুগল কুঁচকে কুশলের দিকে তাকিয়ে বললো…..
—“আপনাকে কি একটা বারের জন্যও আমি বলেছি যে এই সোফায় আমি ঘুমাবো!”

—“তাহলে বালিশ, কম্বল এসব ওখানে রাখছো কেনো?”

—“এই সামান্য বিষয়টুকুও আপনার মাথায় ঢুকছে না।”

কুশল তোয়ালেটি চেয়ারের উপর রেখে বিছানার দিকে অগ্রসর হতে হতে বললো……
—“আমি অনেক ক্লান্ত তরুনিমা, এখন আর নিজের বিষয় নিয়ে ম*ন্দ কথা শোনার ইচ্ছে আমার নেই।”

তরু দ্রুত স্বরে বললো…..
—“এই আপনি ওখানেই দাঁড়িয়ে যান। বিছানায় উঠবেন না একদম।”

কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“বিছানায় উঠবো না মানে! বললাম তো আমি অনেক ক্লান্ত। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে, কথা না বাড়িয়ে আমাকে ঘুমাতে দাও আর নিজেও ঘুমিয়ে পড়ো।”

—“বললাম তো আপনি বিছানায় উঠবেন না।”

কুশল তরুর দিকে শান্ত দৃষ্টি স্থির করে বললো….
—“তাহলে এখন তুমি আমায় কি করতে বলছো! বিছানায় না উঠলে আমি ঘুমাবো কোথায়?”

—“কেনো এই যে এই সোফায়, আপনি এখানে ঘুমাবেন আর আমি বিছানায় ঘুমাবো৷”

—“হোয়াট! ওতোটুকু সোফায় কোনো মানুষ ঘুমাতে পারে নাকি?”

—“সেটা দেখার বিষয় তো আমার না। আপনি একটু আগে বললেন না আপনি আমার স্বামী হন তাই আপনার থেকে আলাদা ভাবে নিরাপত্তা নেওয়ার প্রয়োজন আমার নেই! আপনি হয়তো একটা কথা ভুলে গিয়েছেন তাই কথাটি আপনাকে মনে করিয়ে দেই। আপনার আর আমার বিয়ে স্বাভাবিক ভাবে হয় নি। আপনি খুব ভালো করেই জানেন আপনাকে আমি দুই চোক্ষে স’হ্য করতে পারি না। দুই বংশের সম্মান ও সম্পর্ক রক্ষার কথা চিন্তা করেই বাধ্য হয়ে আপনাকে বিয়ে করেছি। বাধ্য হয়ে আপনার সাথে রুমও শেয়ার করতে হচ্ছে। কিন্তু এই চারদেওয়ালের ভিতরে না আছে কোনো সম্পর্কের চিন্তা আর না আছে কোনো বংশ মর্যাদার চিন্তা। তাই এই চারদেওয়ালের ভিতর আপনি আমার উপর নিজের স্বামীর অধিকার খাটানোর চেষ্টা ও আমার উপর হুকুম চালানোর চেষ্টা ভুল করেও করবেন না। যতোসময় আপনি আমার পাশাপাশি থাকবেন ততোসময় আমি নিজেকে নিজের কাছে সবথেকে বেশি অনিরাপদ বলে মনে করি।”

তরুনিমার মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে কুশল এর চেহারায় রাগ ও বি*র*ক্তির ছাপ ফুটে উঠে। কুশল নিজের কমোরের পিছনে দু’হাত রেখে শান্ত স্বরে বললো…..

—“বিয়েটা স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভিক যেভাবেই হোক না কেনো হয়েছে। তাই ইসলামিক শরিয়ত ও আইনত নিয়ম মাফিক চারদেওয়ালের ভিতরে বা বাহিরে তোমার উপর নিজের জোর খাটানোর সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে মিসেস. তরুনিমা চৌধুরী। নারীরা পুরুষের শক্তির নিকট অত্যন্ত দূর্বল। আমি চাইলেই এই মূহূর্তে তোমার উপর নিজের শারিরীক শক্তি প্রয়োগ করে নিজের অধিকার বুঝে নিতে পারি। কেও আসবে না তোমার নিকট সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। আগামীকাল সকালেও যদি তুমি তোমার উপর আমার শারিরীক অধিকার খাটানো নিয়ে কারোর কাছে অভিযোগ করতেও যাও কেও তোমার কথা শুনবে না। শুনলেও পরমুহূর্তে তোমাকেই এমন অভিযোগের জন্য কড়া কথা শুনাবে। কিন্তু একটা কথা কি জানো! কোনো নারীর দূর্বলতা জানার পর তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তার উপর নিজের অধিকার খাটানোর মতো জ*ঘ*ন্য ইচ্ছে শক্তি আমার মধ্যে কাজ করে না। আমি সর্বদাই সব বয়সের নারীদের সম্মান করি। এটাই আমার সুশিক্ষার মাঝে পরে। তুমি আমার সাথে এক বিছানায় থাকতে কমফর্টেবল ফিল করো না এটা আমাকে ভালো ভাবে বললেই পারতে। ফ্রেশ হয়ে নিশ্চিন্ত মনে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি সোফাতেই এডজাস্ট করে নিবো।”

তরুনিমা স্ত*ব্ধ দৃষ্টি নিয়ে কুশলের দিকে তাকিয়ে ওর বলা কথাগুলো শুনলো। কুশল সোফার কাছে এসে দাঁড়িয়ে তরুর সামনে তু’রি বাজাতেই তরুর ধ্যন ভে*ঙে যায়। তরু কুশলের দিকে একপলক তাকিয়ে কিছু না বলে বিছানায় গিয়ে উঠে বসে। কুশল ওর ট্রাউজারের পকেট থেকে ফোনটা বের করে সোফায় বসে ফোন স্ক্রোলিং করতে শুরু করে। কিছুসময় পর ওদের দরজায় নক করার শব্দ হলে কুশল শান্ত স্বরে বললো…

—“ভিতরে আয় সন্ধ্যা।”

কুশলের কন্ঠ শুনামাত্র সন্ধ্যা ওদের রুমের ভিতরে প্রবেশ করে। তরুনিমা সন্ধ্যার দিকে তাকাতেই দেখে সে হাতে করে কিছু সাধারণ সালোয়ার-কামিজ-ওড়না নিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা কাপড় গুলো বিছানার উপর রাখতে রাখতে বললো….

—“ভাবী এই ভাড়ি লেহেঙ্গা পড়ে তো ঘুমাতে পারবে না তুমি। আমি আমার নতুন কিছু সালোয়ার-কামিজ নিয়ে এসেছি। ফ্রেশ হয়ে এগুলোর মাঝে একটা পড়ে নাও।”

তরুনিমা শান্ত স্বরে সন্ধ্যাকে প্রশ্ন করলো…..
—“আমার জন্য এতো রাতে এতো গুলো সাধারণ কাপড় কি তুমি স্বইচ্ছায় নিয়ে আসলে নাকি তোমাকে নিয়ে আসার জন্য কেও বলেছে সন্ধ্যা?”

তরুর এমন প্রশ্ন শুনে সন্ধ্যা কুশলের দিকে তাকায়। তরুও সন্ধ্যার দৃষ্টি লক্ষ্য করে কুশলের দিকে তাকায়। কুশল ফোনের উপর নিজের দৃষ্টি এমনভাবে স্থির করে করে রেখেছে যেনো সে ব্যতিত এই রুমজুড়ে এই মুহূর্তে আর কোনো মানুষের উপস্থিতি নেই। কুশলকে বালিশ, কম্বল নিয়ে সোফায় বসে থাকতে দেখে সন্ধ্যা যা বোঝার তা ঠিকই বুঝতে পারে। সন্ধ্যা কুশলকে যথেষ্ট ভ*য় পায়। তাই তরুর প্রশ্নের কোনো প্রতিত্তুর না করেই তৎক্ষনাৎ ওদের রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। তরুনিমা বিছানা থেকে নেমে কাপড় গুলো হাতে নিয়ে আলমারি খুলে সেখানে রাখতে রাখতে বললো….

—“আমার বিষয় নিয়ে এতো চিন্তা করার কিংবা আমার প্রতি এতো সহানুভূতি দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই আপনার। আমার কিসে সুবিধা হবে আর কিসে অ*সুবিধা হবে তা আমি নিজেই বুঝে নিতে পারবো।”

তরুর এমন কথাগুলো যে কুশলের উপর কোনো প্রভাব ফেলে নি তা কুশলকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কুশল তরুর কথার কোনো প্রতিত্তুর না করে বালিশ ঠিক করে কম্বল গায়ে জড়িয়ে ওভাবেই কষ্ট করে শুয়ে পড়ে। তরু আর কিছু না বলে এক সেট জামা হাতে নিয়ে আলমারি বন্ধ করে ওয়াশরুমে চলে যায়। বেশ কিছুসময় ধরে ফ্রেশ হয়ে তরুনিমা ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এসে দেখে সোফার বাহিরে মেঝেতে কুশলের একটা পা আর একটা হাত ঝুলে আছে। কুশলকে দেখেই তরু বুঝতে পারছে এতো ছোট সোফায় শোয়ার জন্য ভিষণ বেগ পেতে হচ্ছে কুশলকে। তরু সে বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে বিছানায় উঠে নিজের মতো শুয়ে পড়ে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……………..