হৃদমাঝারে তুমি ছিলে পর্ব-২+৩

0
796

#হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤
#পর্ব_২+৩
#কায়ানাত_আফরিন

–”তুই কি জানিস যে তোরে বিয়ের আসর থেকে নিয়ে আসতে গিয়ে আমাদের জান পালাই পালাই করছিলো?”

মাইশা সরু চোখে বললো পৃথাকে। পৃথা এখনও বিয়ের শাড়ি পড়া অবস্থায় বসে আছে। অন্য কোনো সময় এমন ভারী সাজঁ বেশ অসহ্যকর লাগলেও এখন পৃথার মনে শান্তি। হয়তো জীবনের বড়সড় এক শঙ্কা থেকে পালিয়ে আসার জন্য এমন মনে হচ্ছে।পৃথা মিহি গলায় বললো,

–”এভাবে বলছিস কেন?”

আনান এবার ভ্রু কুচকে বললো,
–”তো কিভাবে বলবে ও? তোর বাপ ভাইগুলা আস্ত একটা রামছাগলের খামার তুই জানোস? নাহলে কিভাবে ওই ৪৪ বছরের বুইড়া বেডার সাথে তোর বিয়ে দেয়ার জন্য উইঠা পইড়া লাগলো? আর বেডাটাও নাইলে কি? অনার্সে পড়ুয়া এক কচি মেয়ের সাথে বিয়ে করবো?আইসে বিয়ের শখ কত! আমার এক নানী আছে। জামাই মরছে ১০ বছর আগে। সেই মহিলার সাথে বিয়ে দিলে পুরাই ফুলকলি জুটি হইবো।”

–”এমনে ওই বুইড়া জামাইয়ের কথা বলিস না আনান। দেখ আমাদের পৃথু বেবি রাগ করতাছে।”

বলেই মুখ টিপে হাসে অর্পি। একই সাথে বাকিরাও। আয়াত ওদের কান্ডকারখানা দেখে বেশ মজা নিচ্ছে। পৃথা কাদো কাদো গলায় বললো.

–”তুই আমার বাপ-ভাইদের রামছাগল বললি আনান?”

–”শুধু তাদের না। তোরেও বলবো। রামছাগলী। তোর ওই হারামজাদা ভাইগুলা এত কিছু করে ফেলছিলো আর তুই কুম্ভকর্মের মতো কিছু বলিসনাই কেন? বলতে পারতিনা যে তুমি সামাদকে ভালোবাসিস?”

–”সেম এজ রিলেশন মেনে নিতো না ওরা।”

–”এখন বিয়ে করলে মানবে?তোদের পিরিত দেইখা আমার গার্লফ্রেন্ড পটানোর শখ মিটে গেসে। তোর জন্য এই সামাদ কুত্তাটা পাগলের মতো ছটফট করছিলো। পরে মাইশা এসে তোরে ভাগানোর প্ল্যান করলো আর সব ব্যবস্থা করলাম আমি।”

–”বলো কি আনান? এই দস্যু মেয়ে এতো প্ল্যান করেছে? আমি তো ভেবেছিলাম ও শুধু কোমড় বেধেঁ ঝগড়াই করতে পারে?”

আয়াত বিদ্রুপ সরে মোবাইল স্ক্রল করতে করতে করতে কথাটি বললো। মাইশা একটা মেকি হাসি দিয়ে বললো,

–”শুধু ঝগড়া না, ভালো থাপড়াথাপড়িও করতে পারি। এই কথাটা বললেন না মিস্টার?”

–”আমিও মানুষ তুলে সেইভাবে আছাড় মারতে পারি। আল্লাহ চাইলে অবশ্যই তোমায় দেখাবো।”

সবাই মুখ টিপে হাসছে ওদের এরকম কথা শুনে। শাওন ওদের দিকে কিছুক্ষণ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

–”তোমাদের স্টোরিটা ইন্টেরেটিং। কারন আমি কখনোই বউ পালানোর এই বিষয়টা সামানাসামনি দেখিনি। আর সেম এজ রিলেশনে এই জিনিসটা আরও বেশি মজার।তোমাদের সাহসীকতার তারিফ করতে হবে।”

–”ইন্টার ফার্স ইয়ার থেকে আজ ৫ বছর ধরে আমাদের বন্ডিং ভাইয়া। এত সহজে একে অপরকে ছেড়ে যাবো না।” [সামাদ]

আয়াত নির্বিঘ্ণে মোবাইল স্ক্রল করে যাচ্ছে। এতক্ষণ ওদের কথাবার্তার দিকে মনোযোগ থাকলেও এখন তা নিক্ষেপ করেছে মোবাইলের দিকে। অর্পি তখন আয়াত,শাওন আর সামাদের উদ্দেশ্যে বললো,

–”আপনারা পঞ্চগড়ে কোনো বিশেষ কাজে এসেছেন ?”

–”আসতে চায়নি। আমাদের ঘাড় টেনে নিয়ে আসা হয়েছে।” [তিথি]

–”মানে?”
অবাকের রেশ ধরে প্রশ্ন করলো মাইশা।তিথি কিছু বলতে যাবে শাওন হাতের ইশারায় তিথিকে থামিয়ে দেয়। শাওন তারপর মাইশার দিকে নির্বিকার চোখে তাকিয়ে বললো,

–”এইযে একটু আগে যেই ছেলেটাকে তুমি অসভ্য বললেনা; সেই ছেলেটার জন্য। আসলেই একটা অসভ্য ছেলে। ভোর রাতে আমার বাসায় চোরের মতো এসে মুখে পানি ছুঁড়ে মেরে একপ্রকার টেনেহিচড়ে আমায় কমলাপুর রেলস্টেশনে নিয়ে আসলো। তেমনিভাবে তিথিকেও।আমরা তখনও থম মেরে ছিলাম যে হচ্ছেটা কি । পরে শুনি এই ভবঘুরে আয়াত মশাইয়ের মাঝরাতে ”কাঞ্চনঝঙ্গা” দেখার শখ হয়েছে।”

আয়াত সামাদের কথা শুনলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। কেননা সামাদই একমাত্র মানুষ যার সাথে আয়াত কখনোই উচ্চস্বরে কথা বলে না বা চেষ্টাও করে না।

–”কাঞ্চনঝঙ্গা? এটা আবার কি?”
মাইশা প্রশ্ন করলো শাওনকে।

–”ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ে এই মেয়ে নাকি বউ পালানোর জন্য এসেছে। আর এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান সম্পর্কেই নাকি জানেনা। টু মাচ স্ট্রেন্জ?”

আয়াতের বাকা কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে যায় মাইশা। আবারও গর্জে বলে,

–”এই মেয়ে এই মেয়ে করছেন কেন? আমার নাম আছে। আবারও এই মেয়ে ডাকলে আবার মোবাইল ছুঁড়ে ফেলে দিবো।”

পরিস্থিতি আবারও গরম হয়ে ওঠার আগেই সব সামলে নিলো শাওন। মাঝে মাঝে আয়াতের এসব এরোগেন্ট কাজকর্মের জন্য চিন্তা হলেও এখন আর ভ্রুক্ষেপ করে না। শাওন প্রখর গলায় আয়াতকে বললো,

–”এরকম করছিস কেনো তুই? চুপচাপ মোবাইল চালা নয়তো ঘুমিয়ে পড়। কথা বাড়াবি না।”

–”তোর কথা কোন জন্মে শুনছি আমি?তুই তোর কাজ কর। আমি আমার কাজ করছি।”

আয়াতের কথায় পাত্তা না দিয়ে শাওন আবার মাইশার দিকে তাকালো। তারপর বললো যে,
–”কাঞ্চনঝঙ্গা একটা পাহাড়ের নাম যা ইন্ডিয়ার বর্ডারের সামনে আছে। সকালে এর মোহনীয় রূপ যে কাউকে আকৃষ্ট করতে বাধ্য। আর এর একঝলক সৌন্দর্য বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলা থেকে চমৎকারভাবে দেখা যায়। আর আমাদের আয়াত মশাই এইটা দেখার জন্যই আমাদের ছোবল মেরে এখানে নিয়ে আসে।”

–”আপনার ভ্রমণ করতে খুব ভালোলাগে ভাইয়া?”
পৃথা আয়াতকে প্রশ্ন করে।

–”ট্রাভেলিং আমার একপ্রকার নেশা। অনার্সে পড়াকালীন সময়েই আস্তে আস্তে এসব শুরু করি আর আমার ট্যুরমেট বানাই শাওনকে। ইউ নো হোয়াট ; শাওন আমার ভাইয়ের চেয়েও বেশি। লাইফের এক একটা সুন্দর মোমেন্ট আমি দুইটা জিনিসের সাথে উপভোগ করার চেষ্টা করেছি। ওয়ান ইজ মাই ফ্যামিলি এন্ড আদার শাওন।”

আয়াতের এই কথায় ফুটে উঠেছে একরাশ মুগ্ধতা। মাইশা সবার চোখের আড়ালে একটা মিহি হাসি ফুটিয়ে তোলে এমন আড়ষ্ট কন্ঠ শুনে। ছেলেটার কথাবার্তা এতটাও করলা টাইপ না যতটা মনে হয়। আবার মনে হয় যে এই ছেলের থেকে হয়তো করলাও মিষ্টি।

–”আপনার কি ট্রাভেলিং টাকেই ক্যারিয়ার বানানোর ইচ্ছে ভাইয়া?” [আনান]

–”এখনও ওমনভাবে ভাবি নি। মাস্টার্স ফাইনাল দেবো। আপাততো এক্সামের আগে এটাই আমার লাস্ট ট্যুর। আর রেডিও তে আমি জাস্ট পার্টটাইম RJ হিসেবে কাজ করি তবুও তারা আমায় হাতছাড়া করতে চাচ্ছেনা তাই এটাই আপাদত টার্গেটে রাখি বাকিসব আল্লাহ ভরসা।”

–”আপনার কন্ঠ ভাইয়া নেশাধরানোর মতো। এরকম সুন্দর কন্ঠের মানুষ যে নাকি রাতারাতি পপুলার টপ টেন ট্রাভেল ভ্লগারদের মধ্যে আছে তাকে কেউ হাতছাড়া করতে চায়?”
অর্পি খুশিতে কদাচিত হয়ে কথাটি বললো। আয়াত মুচকি হেসে মোবাইল স্ক্রল করে যাচ্ছে যেন অর্পির এই কথাগুলো ওর জন্য নিয়মিত বাণী। মাইশা এবার জানালার দিয়ে বাইরে তাকালো। অন্ধকারের হাতছানিতে আকাশে ক্ষণে ক্ষণে মেঘ গর্জে উঠছে।হয়তো সামনের সময়টাকে বৃষ্টির ঢল নামবে। পরিবেশটা খারাপ না। নিত্যনতুন সাধারণ দিনের মতো এটা হলেও সদ্যপরিচিত এই মানুষগুলোর প্রতি ওর অনুভব হচ্ছে প্রবল কৌতুহল। এটা কি তবে নতুনভাবে কোনো কিছু সূচনার ইঙ্গিত হবে?

————————————

নিরবিচ্ছিন্ন রাত। কেবিনেটের সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। সারারাত বৃষ্টির ঢল নামার পর শেষ প্রহরে অনুভব হচ্ছে শীতলতা।মাইশা জানালা দিয়ে নিদ্রাহীন চোখে স্টেশনের দিকে তাকালো। বৃষ্টির কারনে রেলপথে একটি বৈদ্যুতিক খাম্বা পড়ে যাওয়ায় ট্রেন এখন সিরাজগন্জ স্টেশনে থেমে আছে। সেখানে এখন কাজ চলছে। মাইশা জানালা দিকে হালকা উকি মারলো প্ল্যাটফর্মের দিকে। তেমন জনমানব নেই। ট্রেন থেকে কিছু মানুষ নেমে এদিক ওদিক ঘুরছে। বৃষ্টির কারনে রাস্তা কেমন যেন পিচ্ছিল। একপলক সবার তিকে তাকিয়ে নিলো মাইশা। প্রচন্ড বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্ত সবাই ঘুমের তলদেশে। তাই আনানের বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে মাইশা ফিসফিসিয়ে ডাকলো ,

–”আনান?”

আনান যেন হুঁশে নেই। সামাদের কাঁধে মাথা দিয়ে যেন মরার মতো ঘুমিয়ে আছে। মাইশা আবারও ডাকলো,

–”আরে ওই আনান?”

মিহি কন্ঠ শুনে হালকা একটু নড়ে উঠলো আনান। ঘুমে ঢুলু ঢুলু হয়ে হঠাৎ বলে ফেললো,

–”আম্মু আমি বিয়া করবো না।”

চোখে সুক্ষ্ণ ভাজ পড়লো মাইশা। মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। ইচ্ছে করছে আনানকে ঠাসিয়ে চড় মেরে দিয়ে এসব দেওভূত উড়িয়ে দিতে। মাইশা বিড়বিড়িয়ে বললো,

–”তুই ঘুমা ব্যাটা। আমি একাই গেলাম।”

নিজের সাইড ব্যাগ নিয়ে সন্তর্পণে কেবিনেটের বাইরে পা রাখলো মাইশা। নিরবিচ্ছিন্নভাবে ট্রেন থেকে বের হয়ে একটা সতেজ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। বৃষ্টির আমেজের কারনে ঝিরঝিরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। হঠাৎ মাইশার হুমায়ূন আহমেদের ”শ্রাবণমেঘের দিন” উপন্যাসের ছোট একটি লাইন মাথার মধ্যে ঘুরপাক করতে থাকে। যদিও সম্পূর্ণ মনে না থাকায় জিনিসটি স্মৃতিতে আনতে চাইলো না মাইশা। উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে গভীরভাবে আশপাশ তাকাতেই দেখতে পেলো স্টেশনের শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। চমৎকার! আসলে ও এই জিনিসটাই অন্তরে অন্তরে খুঁজেছিলো । পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে ধীরপায়ে এগোতে থাকলো মাইশা দোকানটির দিকে।

–”চাচা? কড়া লিকারের একটা চা দেন তো?”

টঙের মুরুব্বি লোকটা একটা সৌজন্যের হাসি হাসলো। তারপর কেটলির গরম পানি একটা ছোট কাপে ঢালতে ঢালতে বললো.

–”বসো মা। আমি কইরা দিতাছি।”

বাতাসের তালে তালে বৃষ্টির মৃদু ঘ্রাণ আসছে। সেই সাথে হালকা দোল খেয়ে উঠয়ে টঙে ঝোলানো হলুদ বাতিটা। মাইশা নিষ্পলকভাবে কিছুক্ষণ সেই বাতিটার দিকে তাকিয়ে রইলো। এই রঙের মতো ওর জীবনটাও হয়তো স্বচ্ছে। ওর ধ্যানের মধ্যেই টঙের চাচা মাইশাকে বললো,

–”চায়ে চিনি কেমন দিমু মা?”

মাইশা যখন এর উত্তর বলতেই যাচ্ছিলো তখন পেছন থেকে ভেসে আসলো এক শক্ত পুরুষালি কন্ঠ,

–”কম চিনি দিও চাচা। এমনিতেও যেই মিষ্টি মাইয়া ; এর মধ্যে আবার মিষ্টি খাইলে তো ডায়বেটিকস হইয়া যাইবো।”

ভ্রু কুচকে পেছনে তাকালো মাইশা। তিন-চারজন জোয়াল ছেলেপেলে বিদঘুটে হিসি দিয়ে ওর মুখ বরাবর বেঞ্চে গিয়ে বসলো। মাইশার একটু অস্বস্তি হয়। যদিও প্ল্যাটফর্মে আশেপাশে গুটিকয়েক মানুষ আছে তবুও স্বস্তি পেলো না মাইশা। তাই উদ্ভ্রান্ত ভঙ্গিতে বললো,

–”জলদি চা দেন তো চাচা?”

–”ওই চাচা মাইয়্যারে জলদি চা দাও। দেখনা ;চা খাওয়ার লেইগা উতলা হইয়া গেসে?”

ছেলেগুলার কথা শুনে মাইশার গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে রাগে-ক্ষোভে। কথাবার্তা শুনে গায়ে যেন আগুন ধরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। তবুও এখন কথা বাড়ালেই কথা হবে তাই দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকার চেষ্টা করলো। অল্প সময়ের মধ্যেই ওয়ান টাইম কাপে চা প্রস্তুত করে ফেললেন চাচা। মাইশা টাকা দিয়ে চা নিয়ে উঠে যেতে নিলেই ওর ব্যাগের এক প্রান্ত খপ করে ধরলো একজন।মাইশা ক্ষোভ স্বরে বললো,

–”এগুলা কি ধরনের অসভ্যতা?”

–”কথা না কইয়াই যাইবা? আমগো লগে কিছুক্ষণ কথা কও।”

–”ব্যাগ ছাড়ো।”

ছেলেগুলা বিশ্রি চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মাইশা আবারও বললো,”ব্যাগ ছাড়বে নাকি না?”

–”না ছাড়ুম না। কি করবা?”

–”ওকে ফাইন।”

মাইশা একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে হাতের গরম চা টা যে ওর ব্যাগ ধরেছিলো ওর গলার কাছে ঢেলে দিলো। চায়ের তাপমাত্রা ছিলো প্রায় ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর এই গরম চায়ের স্পর্শে যেন হামাগুড়ি দিতে ছেলেটি। মাইশা চেচিয়ে বলে উঠলো,

–”হাতের পুতুল পাইছোস আমাকে?আমাকে চার-পাঁচজন সাধারন মেয়ের মতো ভাবিস না।”

–”অনেক তেজ না তোর কথায়? আজ আমরা সবাই তা ভুলায়া দিবো। ”

এই বলে আরেকজন হাত খপ করে ধরে ফেললো। মাইশা মুচড়ামুচড়ি করছে কিন্ত ও জানে যতই চেষ্টা করুক না কেন; এতগুলো ছেলের সাথে পারা সম্ভব না। ওর দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মনে আচমকাই আশার আলো ফুটে উঠলো এক পরিচিত কন্ঠে,

–”ওর হাত ছাড়ো।”

মাইশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই অন্তরে অন্তরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।আয়াত দাঁড়িয়ে আছে। স্টেশনের টিমটিমে লাইটে ওর চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আয়াত আসলে এখানে এসেছিলো শাওনের জন্য সিগারেট কিনতে। কিন্ত মাইশাও যে এখানে আছে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারনা ছিলো না ওর। ছেলেটা হাত ছাড়ছে না দেখে আয়াত এবার মাইশার হাত ছাড়িয়ে নিলো।
ওদের মধ্যে একজন বললো,

–”তুই কোন মুভির হিরো রে? এভাবে নাইকারে বাচাতে আইসোস।”

আয়াত বিদ্রুপ হাসি হাসে। ছেলেটার কলার ঠিক করতে করতে বলে,

–”না আমি হিরো আর না এই বদমাইশ মেয়েটা আমার হিরোইন। আমি হিরো হলে তোর নাকে ঘুষি দিয়ে………….চেহারাটা অষ্টমআশ্চর্য বানিয়ে দিতাম।ইউ নো হোয়াট ! আমি রেগুলার জীম করি ম্যান।”

মাইশার চোখ এবার যেন বেরিয়ে আসার মতো উপক্রম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ও আয়াতের দিকে। কই ভেবেছিলো এখানে ঢিসুম ঢিসুম হবে আর হলোটা কি। আয়াত এবার বলে উঠলো,

–”এই মেয়েটার মধ্যে কি আছে হ্যাঁ? জানো ! ও একটা জংলি বিড়াল? একটু আগে তোমারই এক সাঙ্গকে গরম চা ছুঁড়ে মেরেছে তো ভাবো আর কি কি করতে পারে?আমাকে তো আমার হাত কামড়ে মাংস তুলে ফেলার থ্রেড দিচ্ছিলো…….”

–”স-স-সত্য?”
ঢোক গিলে বললো ছেলেটা।

–”আরে হ্যাঁ। এখন চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো কেটে পড়ো। আর হ্যাঁ , পারলে এসব জংলী বিড়াল থেকে ১০০ হাত দূরে থাকবে।”

–”খোদার কসম বস ! আরজীবনেও মাইয়্যা মাইনষের পিছে লাগমু না।”

–”এইবার আসছো লাইনে। যাও যাও। সবগুলা কেটে পড়ো।”

সবগুলো ছেলেপেলে আস্তে করে কেটে পড়ে এখান থেকে। মাইশা নির্বাক শ্রোতার মতো আয়াতের কথাগুলো শুনছিলো। এতক্ষণ ইনডাইরেক্টলি মাইশাকে অপমান করেছে আয়াত এটা ভাবতেই মাইশার চোখ ছোট হয়ে যায়। আয়াত শাওনের জন্য সিগারেটের প্যাকেট কিনে মাইশার দিকে তাকিয়ে বললো,

–”এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”

–”আপনি একটু আগে কি বললেন?আমি জংলী বিড়াল?আর ওই অসভ্য গুলারে নাক ফাটালেন না কেনো?”

–”আমি কেনো খামোখা ওদের নাক ফাটাতে যাবো? সিনেমার হিরো পাইসো আমারে?”

–”সিনেমার হিরোদের মতো হুট করে কোলে তোলার মতো ভয়ঙ্কর কাহিনী করতে পারেন তো ওদের নাক ফাটাতে পারেন না?বিরক্তিকর………….”

–”তখন তো আমারে চড় মেরে আমার ফর্সা গাল লাল করে দিয়েছিলে আর এখন হাতে মেহেদি লাগায় রেখেছিলে নাকি?”

চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নেয় মাইশা। এই ছেলের সাথে ঝগড়া করার মতো শক্তি মাইশার আর নেই। আয়াতের হাত থেকে নিজের ব্যাগ নিয়ে তেড়েমেড়ে ট্রেনের দিকে এগোতে থাকে। আজ দিনটাওর কাছে দুর্বিসহ লাগছে। একে তো যুদ্ধবিগ্রহ করে বিয়ের আসর থেকে কনেকে নিয়ে পালানো , আবার আয়াতের সাথে বিরল সংঘর্ষ, সবশেষে ওই বখাটে ছেলেপেলের কান্ডকারখানা। তবে কথা আছে না , ”উপরওয়ালা যখন দেয় ; কপাল ফাইড়া দেয়” । এই বাণীটা মাইশা আজ হারে হারে টের পাচ্ছিলো। দুর্ঘটনা যেনো ওর পিছুই ছাড়ছিলো না। এর মধ্যে আবার হলো আরেক ঘটনা।

রাস্তা পিচ্ছিল থাকায় পা ফসকে পড়ে গেলো মাইশা। সাদা জামার এক তৃতিয়াংশে কাদা লেপ্টে আছে। রাতের নিকষ আধাঁরে প্ল্যাটফর্মে পড়ে গিয়ে গলা ফাটিয়ে কাদতে মন চাচ্ছে ওর। কিন্ত এমন ২০ বছরের তরুণীকে লোকে যদি এভাবে কাদতে দেখে তবে নির্ঘাত সবাই হাসিতে ফেটে পড়বে।

মাইশা উঠার চেষ্টা করলেও উঠতে পারলো না। পায়ে ভয়ংকর ব্যাথা পেয়েছে। ঠোঁট কামড়ে নিজের ব্যাথা সহ্য করার চেষ্টা করতে থাকলো মাইশা।

–”হাত ধরে আমার উঠার চেষ্টা করো।”

মাইশা মাথা উঠিয়ে দেখে আয়াত দাঁালো। লেমন কালারের টিশার্টটি আধাঁরে যেন জ্বলজ্বল করে উঠছে। মুখে নির্লিপ্ততার ভাব স্ষ্ট । মাইশা কিছু না ভেবে আয়াতের হাত ধরে ওঠার চেষ্টা করলো কিন্ত ব্যর্থ। উল্টো আয়াতের ডান হাতে কাদা মেখে গিয়েছে।

মাইশা কাদো কাদো স্বরে বললো,

–”উঠতে পারছি না-তো?”

হাটু ভেঙ্গে নিচে ঝুকলো আয়াত। মাইশার মুখের অনেকটা কাছাকাছি। এহেন কান্ডে মাইশা ভড়কে গেলো। তাই অবাক নয়নে আয়িতের দিকে তাকানো অবস্থায় খানিকটা মাথা পিছিয়ে নিলো । মাইশা অপ্রস্তুত কন্ঠে বললো,

–”ক-ক-কি হ-হয়েছে?”

–”একটা জংলী বিড়াল কোলে নেওয়ার অপরাধে আমার কিউট গালে হাত তুলেছিলো। তাই এখন মেয়েদের কোলে নিতে আমার ভয় হয়। কি করা যায় বলতো?”

মাইশার চোখ এবার সত্যিই অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আয়াতের ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপ হাসি। মাইশা পারলে এবার সত্যিই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেদে ফেলবে।

–”আপনি সত্যিই একটা খারাপ। রাত-বিরাতে একটা মেয়ে বিপদে পড়েছে আর আপনি মজা নিচ্ছেন?”

–”তো আমি কি বলেছি রাত-বিরাতে তোমায় বিপদে পড়তে?এত শখ হয়েছিলো চা খাওয়ার?”

–”লাগবে না আপনার হেল্প। আপনি শুধু আনান বা সামাদকে ডাকুন।”

মাইশার বিক্ষিপ্ত কন্ঠ। আয়াত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”পা ভাঙলো তবুও মচাকালো না।”
কথাটি বলে আয়াত হুট করে কোলে তুলে নিলো মাইশাকে।মাইশার জামার খানিকটা কাদা আয়াতের টিশার্টে লেগে গেলেও আয়াত কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না। মাইশা একটু অস্বস্তির সাথে আয়াতের গলা জরিয়ে ধরেছে। এদিকে পায়ের রগে টনটন ব্যাথা হচ্ছে। একটু আধটু চিলিক দিতেই আয়াতের টিশার্ট খামচেধরলো। আয়াত তা দেখে বললো,

–”ব্যাথা করছে?”

–”হুম”

–”শাওন পায়ের মোচ ঠিক করতে পারে। So Don’t be worry………….আর আল্লাহর ওয়াস্তে ট্রেনে আর ঘ্যানড় ঘ্যানড় করো না।”

মাইশা কিছু না বলে আয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। গালের চাপ দাঁড়িটা আয়াতের মুখে সুন্দরভাবে বসে আছে। শরীরের ঘ্রাণটাও বেশ সুন্দর। এতক্ষণ চুলগুলো কালো রঙেরমনে হলেও চাদের প্রতিফলনে বোঝা যাচ্ছে একটু লালচে ভাব আছে। চোখের পাপড়িগুলো মেয়েদের মতো লম্বা না হলেও বেশ ঘন । মাইশা মনে মনে ভাবলো,

–”ছেলেটা আসলেই সুন্দর !”

–”আমায় স্ক্যান করা শেষ হলে চোখ ফিরাও। এভাবে তাকিয়ে থাকলে হাত ফোসকে আমার কোল থেকে পড়ে যাবে।এখন পা তো গেছেই ; সাথে কোমোড়ও যাবে। তারপর তো আমার বিরুদ্ধে রাগের বশে কিস (জিভ কেটে) আই মিন কেস করবে।”

লজ্জায় অন্যদিকে তাকালো মাইশা। মুখে বিরক্তির ভাব স্পষ্ট । আজ সারাদিনটাই অদ্ভত গিয়েছে মাইশার। এতটা বিভ্রান্তিকর পরিবেশে এর পূর্বে মাইশা কখনোই পড়েনি। নাক ফুলিয়ে মাইশা বিড়বিড়িয়ে বললো,

–”অসভ্যতায় ডাবল পি.এইচ.ডি করেছে এই বদমাইশটা😒।

.
.
~চলবে