হৃদমাঝারে তুমি ছিলে পর্ব-০১

0
1318

হৃদমাঝারে_তুমি_ছিলে❤
#কায়ানাত_আফরিন
#পর্ব_১

”তুমি কি চাও যে এই ভরা প্ল্যাটফর্মের সামনে তোমায় কোলে তুলে নিয়ে যাই।”

সদ্য দেখা এই সুদর্শন ছেলেটার ঝাঁঝালো কন্ঠ শুনে চোখ ছোট ছোট হয়ে এসেছে মাইশার। এদিকে পেছনে ধেয়ে আসা ওই বরপক্ষের লোকগুলোর কথা ভুলে গিয়ে মাইশা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশ থেকে অর্পি আর আনান মাইশাকে দ্রুতকন্ঠে বললো,

–”ওই মাইশু ! কি ভাবছিস? জলদি ট্রেনে উনাদের সাথে উঠে পড়। নাহলে ওই বরপক্ষের লোকজনগুলো আমাদের খুঁজে পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

এই বলে অর্পি , আনান, সামাদ ট্রেনে উঠে যাচ্ছিলো কিন্ত মাইশা এখনও পৃথার হাত চেপে ঠায় হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। ট্রেন এখনি ছেড়ে দিবে।বিরক্ত হয় আয়াত। ওর সাথে থাকা শাওন আর তিথিও। একে তো আয়াত নিজ থেকে এসে ওদের সাহায্য করছে আর এই মেয়েটা ক্যাবলাকান্তের মতো ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াত এবার বিরক্ত হয়ে বললো,

–”বুঝেছি এভাবে নড়বে না।”

এই বলে আয়াত হুট করে কোলে তুলে নিলো মাইশাকে। মাইশাসহ বাকি সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ট্রেন ইতিমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে। আয়াত দ্রুতস্বরে বললো ,

–” জলদি সবাই উঠে পড়ো। ট্রেন নাহলে মিস হয়ে যাবে। ”

সবাই দ্রুত ট্রেনে চড়ে গেলো।অদূরেই পৃথা আর সামাদ দেখতে পারছে পান্জাবী-পাগড়ি পড়া সেই বরপক্ষের লোকগুলোকে। ট্রেনের স্পিড এবার বেড়ে যাওয়ার কারনে ওদের কাউকে আর ধরতে পারলো না সেই লোকগুলো। তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অর্পি, আনান , সামাদ আর পৃথা। আনান খুশিস্বরে সামাদকে বললো,

–”এবার পার্টি হবে ভাই ! তোর আর পৃথার বিয়ে কেউ আটকাতে পারবে না।”

এদিকে মাইশা এখনও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে। পৃথা আর সামাদ যেই পরিস্থিতিতে আছে তার থেকেও আরও অদ্ভুদ পরিস্থিতিতে পড়েছে মাইশা। কেমন যেন গায়ে হিম করা অনুভূতি।

.
——–কিছুক্ষণ আগের কথা——-

রাতের আধাঁরে বিয়ের শাড়ি পড়া এক কনেকে নিয়ে স্টেশনের দিকে এলোপাথাড়িভাবে দৌড় দিচ্ছে মাইশা আর ওর বন্ধুরা। একটু আগে বিয়ের কনেকে পালিয়ে নিয়ে আসার মতো এক ভয়ঙ্কর কাজ করেছে সবাই। পৃথা শাড়ি পড়ে সামাদের হাত ধরে কোনো রকম ছুটে চলছে। এদিকে পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে বরপক্ষের কিছু লোক আর পৃথার বড় ভাইয়েরা।আনান অস্থির হয়ে বললো,

–”আরে পায়ে গিট্টু লাগায় রাখছস সবাই? জলদি দৌড়া। পেছনের ওই কুত্তাগুলা ধরলে আমাদের কল্লা কাইট্টা দিবো।”

ইতিমধ্যে পৃথা পায়ে একটু ব্যাথা পেয়েছে। তবুও থামেনি কেউ। এখন থামার পরিবেশ না। যত্তদ্রুত সম্ভব ঢাকার ট্রেন ধরতে হবে। স্টেশনের সামনে পঞ্চগড় রেলস্টেশন সাইনবোর্ডটি দেখে বুকে আবারও আশার আলো জেগে উঠলো সবার। এদিকে পেছন থেকে কথা শোনা যাচ্ছে,
–”থামো সবাই! নাহলে গুলি করতে বাধ্য হবো।”

–বদমাশের দল ! এতক্ষণ গুলি করস নাই এখন কি করবি ব্যাটা? তোদের গুলি তোরাই খা !”

অর্পি বিক্ষিপ্ত সুরে বললো। অন্যসময় অর্পি এ কথা বললে সবাই হাসিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তো কিন্ত এখন হাসার সময় না। প্ল্যাটফর্মের জনসম্মুখের ভীড়ে লুকিয়ে পড়লো সবাই। এদিকে ওই লোকগুলো হন্য হয়ে ওদের খুঁজছে। স্টেশনের কিছু লোকজন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলো বিয়ের শাড়ি পড়া পৃথার সাথে ওদেরকে এভাবে দেখে। সামাদ তড়িঘড়ি করে বললো,

–”ঢাকার ট্রেন কোনটা আনান? জলদি উঠে পড়তে হবে তো।”

–”এনি প্রবলেম?”
হঠাৎ কারও শীতল কন্ঠ শুনে পিছে ফিরলো সবাই। লম্বাটে মুখাকৃতির এক সুদর্শন ছেলে হাতে পেপসির বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাধে একটা মাউন্টেন ব্যাগ। ছেলেটার সাথে রয়েছে আরও দুজন তার সমবয়সী যুবক-যুবতী। পৃথা এবার কাতর গলায় বললো,

–”ভাইয়া একটু জলদি বলবেন যে ঢাকার ট্রেনটা কোথায়?”

–”পালিয়ে এসেছো বিয়ের আসর থেকে?”

–”হ-হ-হ্যাঁ !” [পৃথা অপ্রস্তুত গলায় বললো]

–”ট্রেনে উঠলেই হবে? টিকেট না থাকলে ট্রেনের কনডাক্টর মশাই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে।”

এবার বিরক্ত হয়ে যায় মাইশা। ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–”আপনি আগে বলেন তো যে ঢাকার ট্রেন কোনটা?”

আয়াত আলতো হাসে। মেয়েটাকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যচ্ছে ভীষণ রেগে আছে। পেছন হৈ হুল্লোড়ের শব্দ পেয়েই হিম ধরে যায় সবার। এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে যেকোনো মুহূর্তেই লোকগুলো দেখে ফেলবে। আনান ছেলেটাকে বললো,

–”ভাইয়া টিকিট পরে দেখবোনে। আগে টেনে উঠে নেই। ওই কনডাকটর মশায়ের থেকে এরা বেশি ভয়ঙ্কর।”

–”হুম। বুঝতে পেরেছি।”

আয়াতের সাথে থাকা শাওন এবার বললো,

–”আমার সাথে চলো তাহলে। আমাদের ফার্সট ক্লাস কেবিনে তোমাদের ব্যবস্থা করে দেবো নে।”

ওদের কথা শুনে অবাক হলো মাইশা আর ওর বন্ধুরা। এরকম পরিস্থিতিতে যে এভাবে সাহায্য পেয়ে যাবে ওরা এটা ভাবতে পারেনি। সবাই তিথির পেছন পেছন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেও মাইশা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আয়াত তা দেখে বললো,

”তুমি কি চাও যে এই ভরা প্ল্যাটফর্মের সামনে তোমায় কোলে তুলে নিয়ে যাই?”

————বর্তমান————–

থাপ্পড়ের তুখর শব্দ উত্ত্যপ্ত হয়ে উঠলো ট্রেনের বিলাসবহুল এই কেবিনটা। ট্রেনের ঝকঝক শব্দের থেকে আয়াতের গালের থাপ্পড়ের শব্দটা কানের মধ্যে অদ্ভুতভাবে বেজে উঠছে। ইতিমধ্যে মাইশা কষে একটা চড় মেরেছে আয়াতকে। কেবিনের ভেতরে সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওদের দুজনের দিকে। আয়াতের মাথায় ধপ করে এবার আগুন জ্বলে উঠলো। জীবনে এত নাম যশ অর্জন করেছে অথচ কখনও ভাবতে পারেনি যে এমন পুচকে মেয়ের কাছে থাপ্পড় খেয়ে বসবে। আয়াত চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

–”কি হিসেব করে আমায় চড় মারলে তুমি?How dare you?”

–”ওই মিয়া ! আপনার তো সাহস কম না ; কি হিসেবে ভরা প্ল্যাটফর্মের সামনে আমায় কোলে তুলে এখানে আনলেন?”

–”তো কি করবো আমি? তোমাদের ধরার জন্য ওই লোকগুলো ধেয়ে আসছিল আর তুমি তো স্ট্যাচু আব লিবার্টির মতো দাঁড়িয়ে ছিলা।”

–”হ্যাঁ ছিলাম তো ? তাই বলে কোলে তুলে নিবেন?”

আনান এবার মাইশাকে বললো, ”তুই থাম বইন?ভুলে যাইস না আমরা এখন উনার কেবিনে আছি।”

মাইশা আরও জোরে চিল্লিয়ে বললো,
–”তো কি হইসে? এর জন্য কোলে তুলে নিবো? অসভ্য কোথাকার ! আপনাদের মতো ছেলেদের ভালোমতো চিনি। একটু হলেই মেয়েদের সাথে লুতুপুতু করতে মন চায়।”

আয়াতের চোখ মুখ এবার লাল হয়ে গিয়েছে। এককথায় ভয়ঙ্করভাবে ক্ষেপে গিয়েছে। আয়াতকে এভাবে রেগে যেতে দেখে শাওন বিড়বিড়িয়ে বললো,
–”হইসে কাম ! এবার এই মেয়েটা শেষ!”

–”এখান থেকে যেতে চাও নাকি এই মেয়েটাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিবে?”

আনান থতমত গলায় বললো,” ক-ক-কি?”

–”আমি কি নাইজেরিয়ান ভাষায় বললাম?হয়তো তোমরা যাও নাহলে এই ইডিয়েট মেয়েটাকে যেতে বলো।”

মাইশা বললো,
–”শুধু আমি কেনো? আমরা সবাই যাবো। আপনার মতো অসভ্যের কাছে কাউকে রাখবো না।”

–”ভেবে নিও কিন্ত।এই পুরো কেবিনেটটা আমাদের বুক করা। এখানে ১০ জন হলেও কোনো কনডাক্টর কিছু বলবে না কারন কেবিনেটের টিকেট আছে আমার কাছে। যদি বাইরে গিয়ে টিকেটহীন প্যাসেন্জারের মতো তোমরা ধরা পড়ে যাও অবস্থা খারাপ হয়ে যাবো কিন্ত।”

অর্পি থতমত গলায় বললো, ” না ! না ! আমরা এখানেই থাকবো। প্রয়োজন হলে আপনার হাত পাও টিপে দেবো।”

–এক চড়ে তোর সব’কটা দাঁত ফালায় দিমু কিন্ত অর্পি! আর তোরা সবাই আমার সাথে জেনারেল ওয়ার্ডে যাবি।”

আনান কপাল চাপড়িয় মাইশাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–”বইন ! তোর পায়ে পড়ি। দরকার পড়লে ভাইয়ার বদলে আমারে কইষ্ষা চড় মার। তবুও এখান থেকে বের হওয়ার নাম নিস না। অনেক ঝামেলা কইরা ঢাকা থেকে পৃথার বিয়ে আটকানোর জন্য পঞ্চগড় এলাম। এখন সুন্দরমতো ঢাকা গিয়ে ওর আর সামাদের বিয়ে দিয়ে দিলেই হবে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বুঝবান তুই। তবে এমন বাচ্চাদের মতো উঠে পড়ে গিয়েছিস কেন?”

মাইশা সাপের ফণার মতো ফোসফোস করছে। সামাদ আর আনান ছাড়া অন্য কোনো ছেলের সংস্পর্শ ওর কাছে বিরক্তিকর লাগে।অর্পি তখন বললো,

–”প্লিজ রিয়্যাক্ট করিস না মাইশু ! তাছাড়া দ্য গ্রেট আরহাম আয়াত ভাইয়া কত্ত ভালো। বর্তমানে পাবলিক ফিগার হওয়া সত্ত্বেও কি সুন্দরভাবে আমাদের হেলপ করেছে।”

”আরহাম আয়াত” নামটি শুনে দু’কদম পিছিয়ে গেলো মাইশা। ছেলেটার চেহারা এতক্ষণ চেনা চেনা লাগলেও নামটি শুনে স্পষ্ট চিনে ফেলেছে। বাংলাদেশের টপ 10 ট্রাভেল ভ্লগার দের মধ্যে আরহাম আয়াত একজন। ট্রাভেলের সকল এক্সপিরিয়েন্স শেয়ার করার জন্য একটি রেডিও অনুষ্ঠানে হোস্ট হিসেবে কাজ করছে সে।

অর্পির কথা শুনে আয়াতের রাগটা একটু হলেও কমলো। তারপর অর্পির কে উদ্দেশ্য বললো,

–”আমার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে ইনস্টাগ্রামে ফলো দিও কিন্ত।”

মাইশা এবার দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–”ওহ্ ! এজন্যই তো আমি বলি আপনার এমন চিপকা চিপকি টাইপ চিন্তাভাবনা কেনো? পাবলিক ফিগারদের এই একটা সমস্যা। সারাদিন শুধু মেয়েদের সাথে চিপকা চিপকি আর ঘেষাঘেষি করতে মন চায়। ইয়াক্ !

আয়াতের চোয়াল পুনরায় শক্ত হয়ে উঠলো। জীবনে এতটা অপমান আয়াত কখনোই হয়নাই যতটা এই কয়েক মিনিটে এই মেয়েটা করে ফেলেছে। আয়াত গম্ভীর স্বরে বললো,

–”গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার !”

সামাদ , পৃথা , আনান , অর্পি সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। মাইশা আগুনের ফুল্কির মতো একপলক তাকিয়ে নিলো ওদের দিকে। চাপা গলায় বললো,

–”তোরা যাবি?”

সবাই নিশ্চুপ। মাইশা বলে উঠলো,

–”সবগুলা বেইমান। তোরা একটাও আমার সাথে যোগাযোগ রাখবিনা । আমি একাই ঢাকায় চলে যাবো।”

মাইশা একথা বলেই হনহন করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো কেবিনেট থেকে। উচ্চশব্দে কেবিনের দরজাটি লাগিয়ে হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেলো পুরো পরিবেশটি। এতক্ষণ আয়াত আর মাইশার ঝগড়ার জন্য চারিদিকে উন্মাদনায় ছেয়ে গিয়েছিলো। আয়াত চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে সিটে বসে পড়ে। মেয়েটার কথাগুলো মনে করলেই চোখ-মুখ যেন লাল হয়ে যায়। পৃথা সামাদের এক হাত জাপ্টে বসে আছে। অর্পি আর আনান বসেছে কিছুটা দুরত্ব নিয়ে। আরহাম আয়াতের রাগ সম্পর্কে এর আগে বেশ কয়েকবারই শুনেছে ওরা। আর মাইশার সাথে এখন একজন গেলে আয়াত হয়তো রাগের বশে ওদের বের করে দিতে পারতো যা পৃথা আর সামাদের জন্য একেবারেই সেফ না। তাই আনান বিচক্ষণতার সাথেই সবাইকে চুপ থাকতে বললো।

–”লাইক সিরিয়াসলি ! ওই ঝগড়াটে মেয়েটা তোমাদের ফ্রেন্ড? আমি পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে ওকে কোলে নিয়েছি দেখে আমায় চড় মারলো?”

আয়াত শক্ত মুখে ওদের মুখে কথা ছুঁড়ে মারলো। সামাদ এবার আগ বাড়িয়ে বললো,

–”মাইশার পক্ষ থেকে আমরা সরি বলছি ভাইয়া। আসলে ও ছেলেদের থেকে সবসময় ১০ হাত দূরে থাকে শুধুমাত্র ওর আব্বু-ভাই আর আমাদের দুজনকে ছাড়া। তাছাড়া আমাদের জন্য ও অনেক স্ট্রেসে ছিলো।”

পৃথা এবার বললো,
–”হ্যাঁ ভাইয়া। আমি আর সামাদ আসলে দুজন দুজনকে ভালোবাসি। কিন্ত আমার বাবা নিজের অসুস্থতার নাম করে আমায় পঞ্চগড়ে আসতে বলে আর হুট করেই গ্রামের চেয়ারম্যান এর ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলে। তখন মাইশাই সব প্ল্যান করে সবাইকে সাথে নিয়ে এখানে এসে আমায় বিয়ের আসর থেকে পালাতে সাহায্য করে।”

আয়াত কিছু না বলে দেয়ালের সাথে ঝুলন্ত ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আয়াত কিছু একটা ভেবে টেবিল থেকে নিজের ক্যামেরা নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। শাওন তখন আয়াতকে বললো ,

–”মেয়েটাকে নিয়ে আসবি?”

আয়াত বিদ্রুপ স্বরে বললো,
”পাগল ! আমি নিজের থেকে ওই ইডিয়াট মেয়েটার কাছে যাবো? মেয়েটার কথাগুলো মনে পড়তেই মাথা আমার নষ্ট হয়ে যায়। এখন ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলবো । ওদের খেয়াল রাখিস।”

এই বলে আয়াতও বেরিয়ে গেলো। সবাই অবাকপানে তাকিয়ে থাকলো সেদিকে। আনান এবার বললো ,

–”এই জার্নিটা আমি আমার এই কচি জীবনে কখনোই ভুলমু না।”

————————————–

ট্রেনের ঝকঝক শব্দে মুখোরিত হয়ে গিয়েছে চারপাশ। চাদের ক্ষীণ আলো তীর্যকভাবে আছড়ে পড়ছে ট্রেনের বগিতে। একরাশ রাগ আর চিন্তা নিয়ে বুকটা দুরুদুরু করছে মাইশার। একে তো ওই আরহাম আয়াতের কাজটার জন্য রাগ আবার টিকেটহীন প্যাসেন্জার হওয়াতে মনে এক চাপা ভয়। উহ্ ! যেভাবেই হোক এইসব চিন্তাচেতনার উদ্রেক ঘটাতে হবে। ব্যাগটা সিটে রেখে ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়ালো মাইশা। সেখানে দাঁড়াতেই একরাশ ঠান্ডা হাওয়া স্পর্শ করে ওর সাহা দেহে। সাদা জামা পরিহিতা এই রমনীকে এখন যেন লাগছে শুভ্র পরী।
সবুজ সতেজ হাওয়ায় এই বিষাক্ত মনটা নিমিষেই মিলিয়ে গেলো।অন্ধকারে মাইশার ফোবিয়া আছে। কিন্ত চাঁদের আলোর প্রতিফলনে জায়গাটা মোটামোটি স্বচ্ছ।তাই মাইশা তেমন ভয় পেলো না। একটু উত্তেজনা নিয়ে ট্রেনের বাইরে উকি দেয় মাইশা। এতটাই বাতাস যে ঠিকমতো তাকাতেই পারছে না। কিন্ত তৎক্ষণাৎ পেছন থেকে কেউ ওর হাত টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসলো। খানিকটা অবাক হয়ে যায় মাইশা ঘটনাচক্রে।

পেছনে ঘুরতেই যেন ও স্তব্ধ হয়ে গেলো ।আয়াত নামের ছেলেটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে তীক্ষ্ণতার রেশ। চাঁদের ম্লান আলো ছেলেটার কালচে বাদামী চোখদুটো মোহনীয় করে তুলেছে। রেডিওতে ছেলেটার কন্ঠ যতটা না সুন্দর শোনা যায়, তার থেকেও যেন বহুগুণে সুন্দর দেখতে।একপলক ওর মোহনীয় সৌন্দর্যে হারিয়ে গিয়েছিলো মাইশা। ওর হাতটা এখন আয়াতের হাতে আবদ্ধ। আয়াত এবার চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

—”মরার শখ হয়েছে?এভাবে উঁকি দিচ্ছো কেনো? ভারী ডেন্জেরাস মেয়ে তো তুমি ! একমুহূর্তের জন্য স্থির থাকতে পারোনা।”

আয়াতের ক্রুড় গলায় ধ্যান ভাঙ্গে ওর। দেখতে মোহনীয় হলে কি হবে , কথাবার্তায় ততটাই রাগচাটা ভাব।

—”আমি মরি বা না মরি আপনার কি? আপনি আমার দায়ভার নিবেন? আর অসভ্যের মতো হাত ধরেছেন কেনো?হাত ছাড়ুন।”

আবারও ক্ষেপে গেলো আয়াত। আয়াত কখনই কোনো মেয়েদের সংস্পর্শে থাকে না । আর এই পুচকে মেয়েটা তো ননস্টপলি ওকে অপমান করে যাচ্ছে। আয়াত এবার ওর হাত চেপে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। রাগ এতটাই মাথায় চাড়া দিয়ে উঠেছে যে আয়াত এখন নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। দাঁতে দাঁত চেপে আয়াত বললো,

–”ছাড়বো না। কি করবে তুমি?”

–”হাত ছাড়ুন নয়তো ভালো হবে না।”

–”নিজেকে কি মনে হয় তোমার? মেয়েরা আমার সাথে একঝলক কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে আর তুমি পুচকে মেয়ে হয়ে আমায় অসভ্য বলছো?”

–”ওলে বাবা রে ! দেখা নাই বার্তা নাই হুট করে কোলে তুলে নিবে আমি অসভ্য বলবো না তো মহাপুরুষ বলবো?”

আয়াত আর মাইশা কেউই কাউকে ছাড়ছে না কথায়। ওদের চিল্লাচিল্লি শুনে ভেতর থেকে শাওন, তিথি , সামাদ, পৃথা, অর্পি, আনান সবাই বেরিয়ে পড়ে। দুজনের মধ্যে ভয়ংকর সংঘর্য লেগে গিয়েছে। আয়াত তবুও শান্ত হয়ে বললো,

–”হেই ইউ স্টুপিড গার্ল। লাস্টবার ওয়ার্নিং দিবো চুপ করতে। ফারদার তোমার মাথা চিবিয়ে খেতেও দুই মিনিট ভাববো না।”

–”আমিও দেখবো আপনি কিভাবে করেন? আল্লাহ আমারেও দাঁত দিসে। কামড়ে হাতের মাংস তুলে ফেলবো।”

আনান এবার ওদের দুজনের মাঝে গিয়ে বললো,

–”আল্লাহ তোরে দাঁত দিলে আমারে হাত দিসে। আর এই দুই হাত জোড় করে তোর কাছে রিকুয়েস্ট করলাম। তুই এবার থাম্।দরকার পড়লে আমারে থাপ্পড় , অসভ্য সব বল্। তবুও কামড়া কামড়ি করবি না।”

আয়াত এবার কোনোমতে নিজের রাগ দমিয়ে মাইশাকে বললো,

–”তোমার ফ্রেন্ডের জন্য তোমায় ছেড়ে দিলাম। নাহলে এই আরহাম আয়াত তার অপমান করা ব্যক্তিকে কখনোই ছাড়ে না।”

মাইশা কিছু বলতে গেলেই অর্পি তেড়েবড়ে ওর মুখ চেপে ধরলো। কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

–”অনেক কামড়াকামড়ি চিল্লাচিল্লি করার প্ল্যান করছিস। এবার আল্লাহর ওয়াস্তে থাম।”

মাইশা দমে গেলো অর্পির কথায়। এই ছেলের সাথে ফালতু ফালতু ঝগড়া করার কোনোই মানে হয়না।আয়াত এবার দ্রুত পায়ে কেবিনেটের ভিতর চলে গেলো। তিথি আর শাওন নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে সবার মুখপানে তাকিয়ে আছে। শাওন এবার বললো,

–”আয়াতের বেশ রাগ আছে জানি কিন্ত কোনো মেয়ের ওপর এতটাও ক্ষেপে যেতে দেখিনি।”

–”হুমমম ! তবে মেয়েটা কিউট না? রাগের মধ্যে আয়াতকে যেই কথাগুলো বললো ; সেই ছিলো। আমার তো দমফাটা হাসির অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো।”

শাওন হেসে দেয় তিথির কথায় । ব্যাপাারটা আসলেই মজার। আনান এবার হাত জোড় করে মাইশাকে বললো ,

–”আল্লাহর ওয়াস্তে এরপর একটা কথাও তুই বলবিনা। ভুলে যাইস না আগামীকাল অনেক কাজ আছে। সুতরাং উল্টা-পাল্টা কোনো কিছু বলবি আমি ভুলে যাবো তুই আমার ফ্রেন্ড। আরে বলদ ! একটা কঠিন পরিস্থিতিতে উনারা আমাদের হেলপ করেছে। আর তুই বাংলা সিনেমার মতো কাহিনী শুরু করেছিস কেন?আবাল কোথাকার !”

–”জীবনে কোনো মেয়ে তোর সাথে ঘেষাঘেষি করলে তখন বুঝবি ব্যাটা ! এখন ওই ”আরহাম আয়াতের” ওকালতি করতে হবে না।”

নিদ্রাহীন রাত। অল্প সময়ের মধ্যে অনেক ভয়ংকর ভয়ংকর কিছু হয়ে গিয়েছে। তবে এখন সব স্বাভাবিক। সবাই খোশগল্পে মেতে উঠলেও চুপ আছে মাইশা আর আয়াত। অর্পি মাইশার কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

–”দোস্তোওওও ! তুই কেমনে পারলি এই হ্যান্ডসাম ছেলেটাকে অসভ্য বলতে?আমারে কোলে নিলে আমি খুশিতে নাগিন ডান্স নিতাম।”

–”ইয়াক্। আমি মরে গেলেও এসব লুচুবাঘের দিকে চোখ তুলে তাকাবো না। লুইচ্চার বদনা একটা !😒”

~চলবে