#হৃদমাঝারে_শুধুই_তুই
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-১৮
চোখ তুলে দেখো না কে এসেছে,
নতুন করে আবার বিয়ের সানাই
বেজেছে,
তুলে নিয়ে যাবো যখন ভালোবেসেছি
……
সকালটা শুরু হলো শব্দদূষন দিয়ে!মেজাজের বিরিয়ানি রান্না শুরু ওখানেই।চোখ বন্ধ রেখে পাশের বালিশ কানে নিয়ে চেচিয়ে বললাম,
-রাহাত!!!গান থামা!সকাল সকাল কি শুরু করলি?
গান থামার নামই নেই।উশখুশ করছি বিছানায়।নাহ্!বাইরে থেকে তো গানের শব্দ ভেতর আসবে না।বুঝলাম এটা মোবাইলে বাজছে,আর সে মোবাইলটা আমার কানের কাছেই। ঘুমঘুম চোখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে পাশ ফিরে মোবাইল হাতে নিয়ে তাকালাম ওটার দিকে।তৎক্ষনাৎ সকালটা মাটি হয়ে গেছে আমার।ডিসপ্লেতে আরমানের ছবিটা দেখে একপ্রকার আতকেই উঠলাম।এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো যেনো উনি আমার পাশেই শুয়ে আছেন।ধরফরিয়ে উঠে বসে মোবাইল দেখে দম মেরে বসে রইলাম কিছুক্ষন।
ওয়েলপেপারে আরমানের হাসোজ্জ্বল চেহারা।হলুদ পান্জাবিতে এক অমায়িক হাসি নিয়ে।মনে হচ্ছে যেনো বাস্তবেই আমারই দিকে তাকিয়ে আছেন উনি,অনেকটা কাছে।অ্যালার্ম টোন হিসেবে গানটা বাজছিলো।বন্ধ করতে গিয়ে আরেকদফা শক পেলাম।অ্যালার্ম টেক্সট হিসেবে লেখা,
“গুড মর্নিং ম্যাডাম!প্রি ম্যারেজ হানিমুন শেষ,বাকিটা না হয় ঢাকাতেই… ”
টেক্সটটা পড়তেই আরমানের দুষ্টু হাসি চোখের সামনে ভেসে উঠলো।দিনের সাথে রাগের শুরু।উফ্!এই লোকটা আমাকে না জ্বালিয়ে শান্তি পায় না নাকি?নিশ্চিত এই অ্যালার্ম টোন আর টেক্সট আরমানই সেট করেছেন।কিন্তু ওনার ছবি?এটা কোথা থেকে আসলো?রাহাত তুলেছে!হ্যাঁ।এটা ওনার কালকে হলুদ পান্জাবি পরা ছবি।নির্ঘাত ওর কাছে ফোন দিছিলাম তখন এই কাজ করছে ও।আমার ফোন নিয়ে এতোসব করলেন কখন উনি?আর এই টেক্সট?এর মানে কি?প্রি ম্যারেজ হানিমুন?এই ওয়ার্ড আছে কোথাও?আর বাকিটা ঢাকাতে মানে?উনি কিভাবে ঢাকাতে পাবেন আমাকে?আর কি করতে চলেছে লোকটা?
বিছানায় বসে বসে ভাবনায় ডুব দিলাম।শিমুলদের বাড়ি থেকে মামা আর আরমান ড্রিংক করেছিলো,লোকটা কোলে করে বাসায় এনেছিলো আমাকে,ওনাকে ওনার রুমে পৌছে দিলাম।উনি!উনি তো তারপর বললেন উনি ড্রাংক ছিলেনই না,এক্টিং করছিলেন।আমি চামুচ হাতে মারতে গেলাম ওনাকে আর উনি দরজা লক করে দিলেন।তারপর?তারপর কি হলো?ওহ্!হ্যাঁ।আমি পিপাসায় কিছু একটা খেয়ে ড্রয়িংয়ে সোফায় বসে ছিলাম।তারপর?আর কিছু মনে পরছে না।মনে নেই কেনো?রুমে কি করে আসলাম আমি?
ধুউউর!লোকটা তোকে জ্বালাচ্ছে মিথি।ব্যাটার এই গুজবে কান দিস না।কিন্তু রুমে আসলাম কি করে?মামা বা মামী এনেছে হয়তো।এতো ভাবার কি হলো এখানে?নিজেকে বুঝিয়ে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগটা আরেকবার চেক করে নিলাম।আগেরদিনই গুছিয়েছি ওটা। মামী ব্রেকফাস্টের জন্য ডাক লাগাতেই রুমের বাইরে বেরোলাম।
ড্রয়িংরুমে এসে দেখি আরমান সোফায় বসে রাহাতকে ওনার ল্যাপটপে কিছু দেখাচ্ছেন।গায়ে আটকানো কানো নেভি ব্লুর চেইকের শার্টটা ভালোই মানিয়েছে তাকে।দেখে মনে হচ্ছে একদম রেডি হয়ে বেরিয়েছেন রুম থেকে কোথাও যাবেন বলে।কোথাও যাবেন উনি?যাক!যখন খুশি যেখানে খুশি যাক।কিন্তু তাতে আমার কি?আমার সামনে না আসলেই হলো।মামা পাশে বসেই পেপার পরছিলেন।এগিয়ে গিয়ে বললাম,
-গুড মর্নিং মামা।
মামা মাথা তুলে বললেন,
-মর্নিং।
আমি কিছুটা কপাল কুচকে তাকালাম।কাল যা যা ঘটিয়েছেন উনি,তাতে এতো স্বাভাবিক থাকাটা অস্বাভাবিক লাগছে আমার।নাকি ওনার কিছু মনে নেই?তাই হবে।আমিই বা আর মনে রেখে কি করবো?মামীকে তো দেখাতে পারলাম না ওই লোকটার জন্য।রাহাত বললো,
-মিথিরানী?গুড মর্নিং।
-গুড মর্নিং।
আরমান ল্যাপটপে চোখ রেখেই বললেন,
-ভেরি গুড মর্নিং!
আসছে ভেরি গুড মর্নিং জানাতে।অ্যালার্ম টোন,টেক্সট আর ডিসপ্লে ফটো দিয়ে সকালের বারোটা বাজিয়ে বলতে আসছে ভেরি গুড মর্নিং!
-আপনাকে বলি নাই।
উনি ওভাবে থেকেই বললেন,
-আমি তোমাকেই বলছি।
আমি হা করে তাকালাম তার দিকে।মামার দিকে একপলক তাকিয়ে দেখি সে যেনো কিছু শুনতেই পাননি।বললাম,
-মামা?বাস কয়টায়?
মামা পেপারটা ভাজ দিতে সেন্টার টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন,
-বাস দিয়ে কি হবে?
ভ্রুকুচকে তাকালাম।মামার মনে নেই নাকি আজ আমি ঢাকায় ফিরছি?বললাম,
-বাস দিয়ে কি হবে মানে?আজই তো ঢাকা যেতে হবে আমাকে!
মামা হাত দিয়ে সোফায় বসার জন্য ইশারা করলেন।মুখে বললেন,
-হুম।জানি তো!কিন্তু আজই কেনো?আর দুটো দিন না হয়..
ওভাবে দাড়িয়ে থেকেই বললাম,
-না মামা।কালই রিয়াপির অফিসে ফার্স্ট ডে!
-এই রিয়াপি কে?
আরমানের সোজা প্রশ্ন।মামা বললেন,
-মিথির বড় কাকু কবির রহমানের মেয়ে রিয়া।বলতে পারো মিথির সবচেয়ে কাছের!
-সবচেয়ে কাছের?ও জায়গাটা আমার।রিয়া,টিয়া কেনো হতে যাবে সবচেয়ে কাছের?
আরমানের বিরবির করে বলা কথা আমার কর্নকুহরে ঠিকই গেলো।মামাকে দেখলাম কি একটা ফাইল দেখছেন।রাগী গলায় বললাম,
-রিয়াপির নামটাকে ভাঙানোর সাহস হয় কি করে আপনার?
-ভাঙাই নি,টিয়া ইজ অলসো আ নাইস নেইম।বাই দ্যা ওয়ে,এটাই লেগেছে?জায়গা দখল করবো সেটাতে লাগেনি?
-দেখুন,আপনি কিন্তু…!
-ও পরে দেখবো।তা রিয়াপির জয়েনিং ডেট কাল!তাতে তোমার যাওয়ার এতো তাড়া কেনো?
আরমান ল্যাপটপেই চোখ রেখে কথা বলছেন।বললাম,
-নান অফ ইউর বিজনেস!
-আমার বিজনেসের এরিয়া কতোদুর তার ধারনা নেই তোমার।তাই ওভাবে বলছো।
মামার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-কি হলো মামা?কিভাবে যাবো?আর থাকবো না এখানে।
-আমি কি একবারো বলেছি থাকতে হবে তোমাকে?জানিতো বিষয়টা যখন রিয়া,তুমি কতোটা সেন্সিটিভ!বসো এখানে।
এগিয়ে গিয়ে বসতে বসতে বললাম,
-যাবো কিভাবে?
-আরমানের সাথে!
বসা আর হলো না আমার।দাড়িয়ে গিয়ে চেচিয়ে উঠলাম,
-কিইইইই?
-হ্যাঁ।
-ওনার সাথে কেনো যাবো আমি?
-ও তো ঢাকাতেই ফিরছে আজ,কাজ শেষ বলে।বাসা থেকে গাড়িও পাঠিয়েছে ওর।এখন তুমিও ঢাকাতেই যাচ্ছো এক বাসা থেকেই,আমিই বললাম মিথিকে তাহলে একটু পৌছে দাও।ও থাকতে তোমাকে একা বাসে ছেড়ে খামোখা টেনশনের পাহাড় মাথায় তুলতে যাবো কেনো?
অগ্নিচক্ষু করে আরমানের দিকে তাকালাম।উনি নিজের কাজে ব্যস্ত।মামার এই সিদ্ধান্তে তার কোনো অবদান নেই তা কি করে সম্ভব?দাতে দাত চেপে বললাম,
-পায়ে হেটে চিটাগাং টু ঢাকা যাবো তাও এ লোকের সাথে আমি যাচ্ছি না!
আমার কথায় কারো কোনো রিয়্যাক্টই নেই।আবারো চেচিয়ে বললাম,
-মামা,আমি যাবো না এর সাথে।
-কান্ট হেল্প।এটা দুলাভাইয়ের সিদ্ধান্ত।
দুলাভাইয়ের সিদ্ধান্ত মানে?আব্বু কেনো এসবে?চেচিয়েই বললাম,
-হোয়াট?আব্বুর ডিসিশন মানে কি?সে কি করে…
-কথায় কথায় বলে ফেলেছি আরমান গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে এখান থেকে।সেই বললো তোমাকে যদি নেয় তবে ওর গাড়িতেই পাঠাতে।
এবার মামার উপর রাগের পাহাড় তৈরী হলো।এসবে আব্বু কেনো?নিজেও ওই লোকের মায়াজালে ফেসেছে,আবার আব্বুকেও…না না না!এসব হতে দেওয়া যাবে না।বললাম,
-তো আব্বু বলছে একটা অচেনা লোকের সাথে চলে যেতে?আর…
আমার ফোনটা বেজে উঠলো।আব্বুর নাম্বার।একপলক মামা আর আরমানের দিকে তাকালাম।যে যার কাজে ব্যস্ত।ওখান থেকে কিছুটা সরে এসে কলটা রিসিভ করলাম।
-আসসালামু আলাইকুম আব্বু।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।কেমন আছো?
-জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনারা সবাই?
-হ্যাঁ,সবাই ভালো আছি।বেরোচ্ছো কখন?
-ম্ মামা বলছে বাস নেই।
-তো বাসে কেনো?তুমি তো আরমানের গাড়িতে আসবা!
আব্বুর কথায় মুখ আপনাআপনিই হা হয়ে গেলো আমার।উনি আরমানকে কি করে চেনেন?কি হচ্ছে টা কি?মনে হচ্ছে আমি এদের দুনিয়ার কেউ নই।নয়তো একরাত না,কিছুদিন বা কয়েক বছর শীতনিদ্রায় ছিলাম যার কারনে আমাকে নিয়েই আমার অগোচরে এতোসব হয়ে গেলো আর আমি টেরও পাইনি।কথাটা হলো আব্বু এসবে..?
-কি হলো?
-ন্ না মানে আব্বু,ওনাকে চেনেন আপনি?
-না চেনার কি আছে?আফরোজ জামানের ছেলে,অতোবড় জার্নালিস্ট!যাইহোক,অতো কথা বাড়িও না।চুপচাপ আরমানের সাথেই বেরিয়ে পরো।আর সাবধানে এসো।রাখছি।
তার কথার উপর কথা বলার সাধ্যি আমার নেই।আস্তে করে হুম বলে ফোনটা কেটে দিলাম।মনে হলো অদৃশ্য কেউ আমার কানে ঠাটিয়ে চড় মেরে দিয়ে গেলো আর বললো “হু হা হা,তোর কোনো ভ্যালু নাই।এবার যা সারা রাস্তা ওই লোকের জ্বালা সইতে সইতে!”ভেবেছিলাম এখান থেকে গেলেই বাচি।কিন্তু না!এই লোকটা একদমই পিছু ছাড়ছে না।পিছন ফিরতেই কারো বুকের সাথে বারি খেলাম।দাতে দাত চেপে বললাম,
-হোয়াটস্ ইউর প্রবলেম?এ নিয়ে হাজারবার ধাক্কা লাগলো আপনার সাথে।এভাবে খাম্বার মতো দাড়িয়ে থাকা ছাড়া কোনো কাজ নেই আপনার নাকি?
আরমান মুচকি হেসে বললেন,
-আই নো মাই কাজ ভেরি ওয়েল।তোমাকে এতো চিন্তা করতে হবে না।
পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলাম।উনি বললেন,
-কি বললেন আমার হবু শশুড়মশাই?
গা জ্বলানো কথা বলতে লোকটা এক্সপার্ট।পিছন ফিরে আঙুল উচিয়ে বললাম,
-দেখুন আলতুফালতু কথা একদম বলবেন না।আমার আব্বু আপনার কোনো শশুড়মশাই হয় না।
-ওই হলো হলো!একই হলো!আগে উডবি আছে তাই।যাই হোক যাচ্ছো তো তুমি?
চুপ থাকলাম।আরমান মাথার চুল উল্টিয়ে ভাব নিয়ে একটা টেডিস্মাইল দিয়ে বললেন,
-কাজ কোথায় কখন কিভাবে কাকে দিয়ে হাসিল করাতে হয় তা এই ইশতিয়াক আরমান খুব ভালোভাবেই জানে মিস।ডোন্ট আন্ডারেস্টিমেট দ্যা পাওয়ার অফ আ…
আমার দিকে ঝুকে বললেন,
-রোমান্টিক লাভার!
বিরক্তি নিয়ে চলে আসলাম ওখান থেকে।লোকটা মামাবাসার সবার সাথে আমার বাসাতেও যে বশীকরন বিদ্যা চালিয়েছে তা বুঝতে পারছি।কিন্তু কিভাবে?কখন হয়ে গেলো এতোকিছু?আব্বুই বা ওনাকে এতো ভালোভাবে চিনে গেছেন কিভাবে?সবটা গুলিয়ে যাচ্ছে!!!
——————🍁
ব্রেকফাস্ট শেষে ব্যাগ নিয়ে মামাবাসার বাইরে বেরিয়ে এলাম।মামা,মামী রাহাতকে বিদায় জানিয়ে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও আরমানের সাথে তার গাড়িতে চড়েছি।উনি ড্রাইভ করছেন,আমি ব্যাকসিটে রাগে ফুসছি।মামাবাসা একটা আড়াল হতেই আরমান গাড়ি থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-হেই?তোমার ড্রাইভার লাগি আমি?
-মানে?
-ফ্রন্টসিটে বসো।
-আপনার গাড়িতে বসেছি তাই শুকরিয়া করেন।যাবো না ফ্রন্টসিটে!
-এক্ষুনি তোমার আব্বু মামা দুজনকে কল করে বলবো মিথি গাড়ি থেকে নেমে যেতে চাইছে।ওর নাকি জঙ্গলে যেতে ইচ্ছা করছে এখন।এন্ড ট্রাস্ট মি,আমি যা বলি ওনারা তাই বিশ্বাস করে।
শুধু রাগী এক্সপ্রেশন ছাড়াটা আর কিছুই দিতে পারলাম না তাকে।গাড়ি থেকে নেমে ফ্রন্টসিটে ওঠার জন্য গাড়ির দরজা খুললাম।উঠে বসার আগে বললাম,
-আমার কিছু শর্ত আছে।
-হুট!তোমার শর্ত আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না।ওঠো।
কিছুটা আকুতির স্বরে বললাম,
-প্লিজ!
উনি স্টেরিংয়ে হাত রেখে বিরক্তি নিয়ে বললেন,
-হোয়াট?
-আপনি আমার গায়ে পরবেন না,মামা আব্বুকে নিয়ে থ্রেট দিবেন না,বিরক্ত করবেন না আমাকে,বেশি কথাও বলবেন না,মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাবেন,আমি গাড়িতে নেই এমনটা ভাববেন।
উনি থুতনিতে আঙুল দিয়ে বললেন,
-ইউ শুড বিকাম এয়ারহোস্টেজ!
সরু চোখে তাকালাম।উনি হেসে বললেন,
-একটাও মানবো না।বাড়াবাড়ি করলে এখনই ফোন লাগাবো।
আগেই বোঝা উচিত ছিলো,কথা শুনবেন না উনি!হতাশার শ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠে বসলাম।উনি মৃদ্যু হেসে গাড়িটা স্টার্ট দিলেন।একদম জানালা ঘেষে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি।সবুজ পাহাড়ের পাশ দিয়ে বাকা বাকা মোড় নিয়ে গাড়িটা যাচ্ছিলো।দুরে তাকালে সীমাহীন আকাশ মাটিতে নেমে আসার দৃশ্য।আর কাছে নিচে তাকালেই গভীর মরন খাদ!প্রানভরে শ্বাস নিয়েছি আমি এই সাতদিনে।শহরের কোলাহলের বাইরে প্রকৃতিতে মিশে থাকার সুযোগ!মিস করবো এগুলোকে।খুব মিস করবো।
-গান গাও?
-মুড নাই।
-কেনো?
-আপনার সাথে যাচ্ছি তাই।
-আনরোমান্টিক মেয়ে একটা!শোনো এবার গান না গাইলে…
-মামাকে না হয়য় আব্বুকে ফোন করবেন,তাইতো?
-না।সামথিং মোর ইন্টারেস্টিং।তোমাকে নিয়ে ঢাকা না ফিরে কক্সবাজার ট্যুরে যাবো।বাসায় কিছু বললে বলবো গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে।ফিরতে লেইট হবে।হোয়াট সে?
অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে।এই লোকটার মাথায় এতোসব বুদ্ধি ঘোরপাক খায়?কিভাবে?আমিই পাশ কাটাতে পারি না?হাউউউ?
-কথা আমিও বলতে জানি।আব্বুকে বলে দিবো যে আপনি…
-ওওওলে আমাল তোতাপাখিতা!কওওওতো কথা বলতে পালে!তো বলবা!সমস্যা কি?কিন্তু কথা হলো,কি করে বলবা?তোমার মোবাইলটা কই?
হন্তদন্ত হয়ে কাধে ঝোলানো সাইডব্যাগে মোবাইল খুজতে লাগলাম।ওটা নেই।কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে ওই ব্যাগেই নিয়েছি মোবাইল আমি।আরমান বললেন,
-নিজের জিনিসগুলো একটু সামলে রাখতে শেখো প্রিয়ু!
আমি আরমানের দিকে তাকালাম।উনি কথাটা বলে একহাতে স্টেরিং ধরে অন্যহাতে আমার মোবাইল নারছেন।আমি হাত বাড়িয়ে নিতে গেলেই উনি সেটা সরিয়ে নিয়ে বললেন,
-ব্যাড গার্ল!ড্রাইভিংয়ের সময় জ্বালাচ্ছো!
-আপনি আমার ফোন কখন নিয়েছেন?
-বেখেয়ালি মেয়ে,তা টের পাবা কেনো?
-তারমানে এভাবেই ফোন নিয়ে আপনি আমার ফোনে কাল অ্যালার্ম,টেক্সট আপ ওয়েলপেপার সেট করে দিয়েছিলেন?
উনি হাসলেন।বললেন,
-কাল রাতের কথা মনে আছে তোমার?
-মনে না থাকার কি?মাতালের নাটক তো কম করেন নি।ইচ্ছা তো করছিলো মাথা ফাটিয়ে দি আপনার!
-আর তারপর?
-তারপর মানে?
উনি ব্রেক কষে গাড়িটা থামালেন।বললেন,
-আমাকে মারতে না পেরে রাগ মেটাতে তুমি নিজেও ড্রিংক করে নিয়েছিলে।ড্রয়িংরুমে নাচতেছিলে!কলমদানি পরার শব্দ শুনে বাইরে বেরিয়ে দেখি ম্যাডাম বোতল মাথায় নিয়ে ঘুরতেছে।
চোখ বড়বড় হয়ে গেলো আমার।এসব কি শুনছি?কি বলছেন উনি?আমি কালরাতে ড্রিংক করেছি??তাইতো মনে নেই কিকরে রুমে আসলাম!আর কি কি করেছি?আল্লাহ!মান সম্মান বাচাইয়ো!কাপাকাপা গলায় বললাম,
-ত্ তা তারপর?
উনি বাকা হাসি দিয়ে বললেন,
-খুব আদর করেছো আমাকে।আর আমিও…
-চুপ!একদম বাজে বকবেন না!আমি ওমন কিছুই করিনি!
-ইউ রিমেম্বার?
চুপ মেরে গেলাম।উনি জোরে হেসে দিয়ে বললেন,
-হ্যাংওভার কাটাতে লেবুপানি দিয়েছিলাম।পুরোটাই আমার গায়ে ফেলে দিয়েছিলে!
ফিক করে হেসে দিলাম।তারপরই মুখটা চেপে ধরলাম।তবুও হাসি আটকাতে পারি নি।যাই হোক,কিছু একটাতে তো তাকে বিব্রত করেছি।উনি বললেন,
-ওভাবে হেসো না।বিয়ে বিয়ে পায়!
আপনাআপনি হাসি থেমে গেলো আমার।গম্ভীরভাবে বললাম,
-ফোনটা দিন।
-গান বলবে?
-না বলেছি তো!
-গাড়ি তবে একচুলও এগোবে না।
অসহ্যকর একটা লোক।এর ধমকিগুলোর জন্য একে টেরোরিস্টের দলে ফেলে দিতে ইচ্ছা করে।বিরক্তি নিয়ে বললাম,
-গাড়ি স্টার্ট দিন।গাইবো গান!
উনি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে হেসে গাইতে লাগলেন,
—চিপাক চিপাক কে চালতি হে কাভি কাভি দো রাহে,
—জুরে জুরে কুছ য়েসে কি লাগাহো যেয়সে গাম!
(এটা আমার মনের কথাই ছিলো😒চিপকু লোক একটা!😐)
—ডাবল ডাবল হো মিঠি যো কাভি কাভি তাকলিফে,
—কিসি কি সাঙ্গ মে চালনে সে হুয়ি হাফ সে…স গুনা জায়াদা !
গানটার লিরিক্স শুনেই উনি হো হো করে হেসে উঠলেন।প্রথমে বিরক্তি নিয়ে দেখলেও কিছুটা সময় পরই তার হাসিটা দেখতে ভালো লাগা শুরু করে দিলো।উনি জোরে শব্দ করে হাসতে হাসতে গাড়ি চালাচ্ছেন আর তা দেখে আমার অজান্তে ঠোটের কোনে হাসি ফুটছে।উনি হাসি থামিয়ে আমার দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন,
-এজন্যই তোমাকে এতো ভালোবাসি।তোমার পাগলামিগুলোকে ভালোবাসি।
ওনার মুখে ভালোবাসি কথাটা শুনে কোথাও কিছু হয় আমার।হয়তো মনের ভেতরে তোলপাড় চলে,নয়তো হার্টবিট বাড়ে,নয়তো দম বন্ধ লাগে।কথা ঘোরাতে বললাম,
-আ্ আপনি আমাকে পাগল বললেন?
উনি আবারো আমার দিকে কিছুক্ষনের জন্য তাকালেন।ঠোট টিপে হেসে গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিলেন।আমিও রাগ নিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম।
—————🍁
সকাল সকাল মায়ের সাথে গৃহযুদ্ধ শেষ করে বাজারে এসেছে রিয়া।গৃহযুদ্ধের কারন ও অফিস একা যাবে তবে বাজারে একা কেনো যাবে না!যদি আজ থেকে একাকি কেনাকাটা করতে না শেখে,ওকে একাকি অফিসের জন্যও নাকি বেরোতে দেওয়া হবে না।কিছুটা জেদ দেখিয়েই বাজারে চলে এসেছে।উদ্দেশ্য মিথির জন্য গিফট কেনা।দুটো দোকান ঘুরে একটা টেবিলক্লক কিনে নিলো ও।ওর ঘুম ভাঙাতে গিয়ে মিশু,আন্টি দুজনেই দিনে তারা দেখে।মোবাইলের অ্যালার্ম বন্ধ করার আলসেমিতে দু দুবার ফোনটাই ছুড়ে ফেলেছিলো ও।তার জায়গায় ওর দেওয়া গিফট থাকলে ও কখনোই সেটা ছুড়ে ফেলবে না।
সুন্দরমতো রেপিং পেপারে মুড়িয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য রিকশা ডাক দিলো রিয়া।রিকশা আসার আগেই ওর সামনে একটা গাড়ি এসে দাড়ায়।গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে দিয়ে ভেতর থেকে আদিব মুচকি হেসে বললো,
-হ্যালো মিস রিয়া!
রিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদিবের দিকে।লোকটা এতোটা হাসিখুশি কিভাবে থাকে সবসময়?সামনে থেকে যে রিকশাটাকে রিয়া ডেকেছিলো ওই রিকশাওয়ালা বলে উঠলো,
-যাইবেন না?
ঘোর থেকে বেরিয়ে কিছু বলার আগেই আদিব মাথা নেড়ে রিয়াকে থামতে বলে।তারপর গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে বললো,
-মামা,আপনি চলে যান।উনি যাবেন না।
রিয়া আরেকদফা অবাক হলো।আদিবের দিকে জিজ্ঞাসাসুচকভাবে চাইতেই ও গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললো,
-ড্রপ করে দেওয়ার অনুমতি আছে?
-না মানে স্যার,আপনি..
-ও,এই পাব্লিক প্লেসেও স্যার বলছেন?এজন্যই না করছেন?ইটস্ ওকে।
-না না।আসলে আমি..
আদিব ভ্রুকুচকে বললো,
-নানা?
রিয়া পুরোই বোকা বনে গেছে।আটকে গেছে একদম।আদিব হেসে দিয়ে বললো,
-লল।ভয় পেয়ে যান সহজেই আপনি।গাড়িতে আসবেন না?
সরাসরি মানা করতে রিয়ার রুচিতে বাধলো।সৌজন্যের হাসি দিয়ে চুপচাপ উঠে বসলো ও গাড়িতে।আদিব গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
-ডোন্ট ফিল অকওয়ার্ড মিস রিয়া।এখন তো আমরা অফিসে নেই।তবে পরিচিতো।লিফট দিতেই পারি আপনাকে।ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড,লেটস্ বি ফ্রেন্ডস্?
উত্তরে রিয়া মৃদ্যু হেসে আস্তে করে মাথা উপরে নিচে নারলো।আদিব বললো,
-সো,শুধু রিয়া বলে ডাকতে পারি?
এবারও রিয়া মাথা নেড়ে সায় দিলো।আদিব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো,
-আমাকে চেনাজানা সবাই আদিব বলেই বেশি ডাকে।চয়েজ ইজ ইউরস্।আদিব বা মাহির যেকোনোটাই বলতে পারো।অবশ্য যতোদুর তোমাকে চিনলাম,তুমি মেবি স্যার ছাড়া কিছু বলে ডাকতে পারবে না আমাকে!
রিয়া এবার একটিু জোরেই হেসে দিলো।সাথে আদিবও।আর পাঁচটা বসের মতো না ওর মাহির স্যার তা ও আগেরদিনই বুঝেছে।খুব সহজে সবার সাথে মিশতেও পারে,আবার সাবলিল ভাষায় সবার অস্বস্তিটাকেও দুর করতে পারে।বেশ অনেক কথা বলতে বলতেই রিয়াকে বাসা অবদি নামিয়ে দিলো আদিব।
—————🍁
-আই ফিল বৌভাতের জন্য শশুড়বাড়ি যাচ্ছি!
আবারো আরমানের সেই গা জ্বালানো কথা!কটমটে চোখে তাকালাম তার দিকে।এই কিছুটা পথ চুপই ছিলেন উনি।হয়তো এটুকো সময় মাথায় ছিলো সেইফ জার্নির ব্যাপারটা।তবে আড়চোখে যে কয়বার তাকিয়েছি তার দিকে,চোখাচোখি হয়ে গেছে আমাদের।উনি কিছু না বলে শুধু হেসে আবারো গাড়ি চালানোতে মন দিয়েছেন।আর আমি থতমত খেয়ে আবারো মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়েয়েছি।
ঢাকায় ঢুকে পরেছি আমরা।আর কিছুক্ষনের পথ,তাই আমার বাসা।তারপর আমি নেই।তখন এতোটুকো অনুশোচনা হবে না তার?এতোসব বলে,করে জ্বালিয়েছেন আমাকে!
-গাড়ি থামাই?কিছুটা একান্ত সময় কাটাই দুজন।কি বলো?
কিছু বলার আগেই ওনার ফোন বাজলো।রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিয়ে বললেন,
-হ্যাঁ,বরকত মামা।তুমি কতোদুর?
-মোটামুটি আইসা পরছি আরমান বাবা।তুমি?
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-এইতো,চলেই আসলাম।ভেবেছিলাম বেশ বড় জার্নি।সময়টা কিভাবে কেটে গেলো টেরই পাইনি।
আমি চোখ পাকিয়ে ওনাকে সামনে তাকাতে বললাম।উনি করলেনও তাই।ফোনে বললেন,
-মামা,তুমি বাসার সামনের মোড়ে দাড়াইয়ো,আমি ওখান থেকেই পিক করে নেবো তোমাকে।
-আইচ্ছা।
আরমান ফোন রেখে বললেন,
-তোমার সাথে একা একা আসবো বলে ড্রাইভার মামাকে বাসে পাঠিয়ে দিয়েছি।এখন বাসায় তো তাকে ছাড়া ঢোকা সম্ভব না।এমন কতো কিই তো করলাম।আর তুমি?না বুঝলে আমার ভালোবাসা,না বুঝলে তুমি ভালোবাসো!স্বীকারটাও করলে না!এমন না হয় যখন স্বীকার করতে চাও,তখন আমিই না থাকি!যখন বুঝবে ভালোবাসো,তখন আমাকেই না আবার হারিয়ে ফেলো!
ওনার কথায় ভেতরটা ধক করে উঠলো।কোনো এক অদ্ভুত,অজানা,অচেনা আশংকার চাদর যেনো চারদিক থেকে ঘিরে ধরতে শুরু করলো আমাকে।ভালোবাসি না,তবে হারানোর আশংকা কেনো???
#চলবে….