হৃদমাঝারে শুধুই তুই পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
1240

#হৃদমাঝারে_শুধুই_তুই
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
অন্তিম পর্ব

কারো জীবন থেমে থাকে না।বয়ে চলে সময়ের স্রোতে। ” চট্টগ্রামে চোরাচালানের ঘাটি উদ্ধার,ছবি প্রকাশকারী সাংবাদিক নিখোজ ” সেদিন আরমানের খবর দেখে আমার জীবনও থেমে গিয়েছিলো।হয়তো চিরতরেই থেমে যাচ্ছিলো।আপি বলেছিলো চারচারটে দিন নাকি শুধু চিৎকার করে আরমানের নাম নিতে নিতেই সেন্সলেস হয়ে যেতাম আমি।ডক্টর এজন্য নাকি ঘুমের ঔষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতো আমাকে।মানুষটা সত্যিই আমাকে ভালোবাসি বলার সুযোগ দিলো না।

কিন্তু উপর ওয়ালা অন্যকিছুই ভেবে রেখেছিলো আমার জন্য।রিয়াপি আর আদিব ভাইয়ার ভালোবাসা বিয়ে নামক পুর্নতা পেলো আজ।পারিবারিকভাবে হলেও,আদিব ভাইয়া আপিকে ভালোবাসে।আর আপিও ভাইয়ার কথা বলেছে আমার কাছে।এজন্যই ভাইয়া প্রোপোজ করার দিনই কবির আঙ্কেলকে সিভি দেখিয়েছিলো ও।উপলব্ধি করেছিলো,ও ভালোবাসে আদিব ভাইয়াকে।আর আমার?ভালোবাসা কি না এই একটা প্রশ্ন নিজের মনের কাছে রেখেছিলাম বলেই হয়তো এতোটা কষ্ট পেতে হয়েছিলো।ভালোবাসি বললে হয়তো এতোটা কষ্ট পেতে হতো না।

ইয়া লম্বা ঘোমটা টেনে ফুলের বিছানায় বসে ভাবতে থাকা এসব কথায় ইতি টানে দরজা খোলার শব্দ।চুপচাপ উঠে গিয়ে সামনের মানুষটাকে সালাম করতে পা বাড়ালাম।এসবে তো বিশ্বাস ছিলো না আমার কোনোদিনও।তবে এখন আমি চাই এই মানুষটার জন্য ঠিক তার মনের মতো হয়ে উঠতে।নিজের খামখেয়ালি বৈশিষ্টগুলোর জন্য তো হারিয়েছিলাম,এবার না হয় গুছানো স্বভাবের হয়ে সবটা নিয়ে বেচে থাকবো।

শেরয়ানি,পায়জামা পড়া মানুষটার সামনে সালাম করার জন্য ঝুকতেই সে আমার কাধ ধরে ফেললো।দাড় করিয়ে দিলো আমাকে।মাথা নিচু করে রইলাম আমি।লজ্জা না। বরের সাথে চোখ উচিয়ে কথা বলবো না সেই রীতি মানতে।উনি শান্তভাবে বললেন,

-এসব কবে থেকে মানতে শুরু করেছো তুমি?

-যেদিন থেকে হারানোর ভয় মনে ঢুকেছে।

-ভালোবাসো না,ভয় পাও কেনো?

-কতোটা ভালোবাসি তা বুঝাতে পারি না বলে হয়তো।

আরমান শক্ত করে জরিয়ে ধরে ঘাড়ে নাক ডুবালেন আমার।খামচে ধরলাম তার শেরয়ানি।নিখোজের আটদিন পর হাতেপায়ে একগাদা ব্যান্ডেজ নিয়ে পুলিশ বাসায় পৌছে‌ দিয়ে যায় ওনাকে।আমার অবস্থা শুনে তখন তখনই আমাদের বাসায়ও গিয়েছিলেন।চেয়েছিলেন সুস্থ্য হয়ে তারপর যাবেন,কিন্তু আপির কাছে আমার কথা শুনে হয়তো থাকতে পারেননি।সেদিন জ্ঞান ফেরার পর তাকে জড়িয়ে খুব কেদেছিলাম।বকেছিলামও তাকে।সুস্থ্য থাকলে হয়তো মারও লাগাতাম।কিন্তু নিজের সে স্বভাবটাকে যে পাল্টে নিয়েছি আমি।ভালোবাসি তাই!আমার হৃদমাঝারেও শুধু সে বুঝতে পেরেছিলাম তাই!আরমান আমার চুলে ঠোট ছুইয়ে দিয়ে বললেন,

-এতোটা দেরি কেনো করলে মিথি?

কান্না পাচ্ছিলো আমার।নাক টেনে বললাম,

-সরি।আর ভুল হবে না।

উনি হেসে আমার নাকে নাক ঘষলেন।বললেন,

-হয়েছে!বাচ্চাদের মতো কেদোনা।

আরমান আবারো জরিয়ে ধরলেন আমাকে।শক্ত করে ধরে আছি তাকে।কিছুটা চুপ থেকে উনি আবারো বললেন,

-যদি আমি ফিরে না আসতাম?

তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দুরে সরে গিয়ে বললাম,

-আমিও মরে যেতাম।আর আজও যদি আপনি ওইসব কথাই বলেন তো সত্যি বলছি,আজরাতেও বেরিয়ে যাবো আমি!

উনি হেসে এগিয়ে এসে হাত ধরে ঘুরালেন আমাকে।পেছন আবারো জরিয়ে ধরে কাধে থুতনি ঠেকিয়ে বললেন,

-বউটার বড্ড বেশি জেদ!তুমি জানো?তোমার সেদিন পাগলামি করে নাগরশালে তোলা সেই ছবি কতো কাজের ছিলো?তুমি যাতে এসবে না জরাও তাই তোমার ক্যামেরার গুলো ডিলিট দিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলাম ওগুলো। ঢাকায় ফিরেই আমি ওটা নিয়ে আর্টিকেল লিখে জমা দিয়ে দেই।আর সেটা দেখে তোমার মামা আইনি স্টেপ নিয়ে ওই স্মাগলারগুলোকে ধরে ফেলে।

আমি কিছুটা গম্ভিরভাবেই বললাম,

-আর ওগুলোর জন্যই ওরা আপনার এতোবড় ক্ষতির চেষ্টা করে!

উনি হাসলেন।বললেন,

-ওদের গ্যাংয়ের কয়েকজন বাইরে ছিলো।পেপারে দেখেছে আর্টিকেলটা আমি কভার করেছি,তাই সেদিন তোমাদের বাসা থেকে ফেরার পথেই কিডন্যাপ করে নিয়েছিলো।ওরা ঢাকার বাইরে রেখেছিলো আমাকে।বোঝোই তো,ভিনদেশী জাতের মুলা!ব্যাটারা আরো বেশ কয়েকটা পুলিশ, সাংবাদিক,ব্যবসায়ীদেরও ধরে ধরে এনেছিলো।টর্চার করতো খুব।কথা ছিলো তোমার মামাকে ধরবে তারপর দুজনকে একসাথে মারবে।তার আগ অবদি শুধু ফিজিক্যালি টর্চার করেছে।

আমি পেছন ফিরে আরমানের গালে একহাত রাখলাম।এসব কথার মাঝেও ওনার চোখেমুখে শুধুই‌ ভালোবাসা আকা।বললাম,

-খুব লেগেছিলো আপনার তাইনা?এতোবড় রিস্ক‌ কেনো নিতে গিয়েছিলেন বলুনতো?

-কি করবো ম্যাডাম?চাকরিটাই এমন!আমি জানতাম এমনটা হবে,তাই আগে থেকেই পুলিশকে জানিয়ে রেখেছিলাম।কিন্তু ওরা যখন দুদিন পরেও খোজ লাগাতে ব্যর্থ হয়,আমার প্রেসের এক কলিগ ওদের প্রেসারাইজ করতে আমার নিখোজ হওয়ার খবর প্রিন্ট করে দেয়।নইলে বাসায়ও তো বলেই রেখেছিলাম আমি যখন তখন বাইরে যাবো যাতে আম্মু বা বাকি সবাই টেনশন না করে।

-হোয়াট আবাউট মি?

-তুমি তো ভালোই বাসতে না আমাকে।হাড়গোড় ভাঙার পর মেবি করুনা হচ্ছে তোমার!

আজও বাদ যাবে না ওনার আমাকে রাগানোর চেষ্টা চালানো।কিন্তু দোষ তো আমারো আছে।মুচকি হেসে ওনাকে ছেড়ে রুমের লাইটটা অফ করে দিলাম।আবছা আলোতে দেখলাম আরমানের চোখ বড়বড় হয়ে গেছে।আমি ওনার হাত ধরে ব্যালকনিতে নিয়ে আসলাম।আকাশে একফালি চাদ হাসছে।তারা নেই।নিচে বাগানের কয়েকটা লাইট জ্বালানো।

এসবের আলোতেই দেখতে পেলাম আরমান ভ্রুকুচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।আমি তার দিকে তাকাতেই ভ্রুজোড়া নাচিয়ে বোঝালেন কি হয়েছে।ব্যালকনির গোলাপ গাছে থাকা একটা গোলাপ নিয়ে ভারি লেহেঙ্গা পরা অবস্থাতেই আরমানের সামনে হাটু গেরে বসলাম।আরমানের চোখেমুখে বিস্ময়।যেনো অসম্ভব কিছু দেখে ফেলেছেন উনি।যা দেখে হাসি পাচ্ছিলো।তবুও নিজেকে সামলে বললাম,

-আর দশটা বাঙালী মেয়ের মতো আমিও নীল শাড়িতে সেজে নীল পান্জাবী পরা আপনারই‌ সাথে রিকশা করে রাতের শহর ঘুরতে চাই।আপনার সাথে ম্যাচিং জামাকাপড় পরে সবার সামনে আমরা যে কাপল সেরকম শো অফ করতে চাই।আপনার বুকে হাত রেখে সে হাতের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করতে চাই।কখনো বৃষ্টিতে আপনার সাথে মাঝরাস্তায় ভিজতে চাই।ঝাল খেতে পারিনা তো কি,আপনার টাকায় পথের ধারে ঝাল ফুচকা খেতে চাই যার প্লেটটা আপনিই ধরে থাকবেন।কোনো এক অলস বিকেলে আপনার হাত ধরে ফাকা রাস্তায় হাটতে চাই,নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে বসে থাকতে চাই আরমান।সবটা!সবটা আপনার মনের মতোন করে সাজাতে চাই।ভালোবাসি আপনাকে আরমান।ভীষন ভালোবাসি!

আরমান হতবাক হয়ে দাড়িয়ে আছেন।যেনো পজ বাটন অন করা কোনো রোবট বা স্ট্যাচু।হাতে থাকা গোলাপটা দিয়ে ওনার হাতে বারি লাগালাম।উনি ধ্যান ভেঙে হাত উপরে তুলে বললেন,

-আরেহ!গোলাপের কাটায় লাগলো তো!তারমানে এটা বাস্তব?এই‌ মেয়ে!তুমি প্রোপোজ করছো আমাকে?

আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই আরমান হেসে হাতে নিলেন গোলাপটা।উঠে দাড়াতে যাবো তখনই উনি চেচিয়ে বললেন,

-ওয়েট ওয়েট!উঠো না।

হতাশ আমি।এইভাবে এইসাজে বসে থাকা যায়?কেনো এভাবে থাকতে বলছেন উনি?আরমান একটু হেসে গোলাপটার কাটা ছাড়িয়ে মুখে নিয়ে ধরলেন।তারপর কোলে তুলে‌ নিলেন আমাকে।রুমের দিকে এগোচ্ছেন উনি,ওনার গলা জরিয়ে ধরে চোখের ভাষা পরার চেষ্টা করছিলাম।সে চোখজোড়া যেনো বলে চলছে,

‘ যামিনী,তুমি যেমন,আমি সেভাবেই. ভালোবাসি তোমাকে।নিজেকে পাল্টাতে হবে না তোমার।শুধু ভালোবেসো।আমার ভালোবাসাকে রঙিন করে জীবনের ক্যানভাসে এটে দিও,তাতেই হবে। ‘

আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে গোলাপটা মুখ থেকে নামিয়ে পাশের ড্রয়ারের উপর রাখলেন আরমান।আমার মাথার ঘোমটা খুলে দিয়ে সামনে দাড়িয়ে গেলেন।আমার দুপাশ দিয়ে বিছানায় হাত রেখে ঝুকে দাড়ালেন।চোখ নামিয়ে নিলাম আমি।উনি বললেন,

-পড়ে নিয়েছো চোখের ভাষা?নাকি মুখেও বলবো?তুমি যেমন,সেভাবেই তুমি আমার!কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই আমার যামিনীর!

মনে মনে এমনটাই ভেবেছিলাম ভেবে একটু হাসলাম।উনি বললেন,

-আত্মসমর্পন করেছো ম্যাডাম।এতোদিন একপাক্ষিক লাভার,ফিয়ন্সের ভালোবাসা দেখেছো।আজ তবে বরের রোমান্টিক আদরগুলো সহ্য করো।

আর সম্ভব নয়!মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে এবার।কান গরম হয়ে গেছে,গালও।টের পাচ্ছি আমি।লজ্জায় দু হাতে মুখ ঢেকে নিলাম।আরমান পাশে বসে কানে স্পর্শ করতেই সর্বাঙ্গে শিহরন বয়ে গেলো একরকম।উঠে আসতেই উনি হাত ধরে বললেন,

-জঙ্গলের সে রাতের মতো আজও পালিয়ে যেও না যামিনী!এ দুরুত্ব বরই কষ্টদায়ক!

ফ্রিজড্ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম।তার বাহুডোরে আচমকাই আবদ্ধ হয়ে গেলাম আমি।চোখ খোলার সাহসটুকো পাচ্ছিলাম না।তবুও একপলক তাকিয়ে তার ঘোর লাগা গভীর চাওনি দেখে আবারো চোখ নামিয়ে নিলাম।কোনো কথা বলিনি আর।শুধু তার ভালোবাসায় ঘেরা মুহুর্তগুলোকে নিজের করে নিলাম।

🍂
সাতবছর পর….
🍂

-মনিমা,ও মনিমা।তোমার পচা ছেলে মেরেছে আমাকে।

ইশিকার কথা শুনে রিয়াপি খুন্তি হাতে রান্নাঘরে থেকে তেড়ে এগিয়ে আসলো।ছবছরের ছেলে রাদিব দৌড়ে আমার পিছনে লুকিয়ে বললো,

-মামনি,তোমার মেয়ে এই বয়সেই এক নম্বরের মিথ্যেবাদী হয়েছে।কিছু বলো ওকে!খালি আম্মুর হাতে আমাকে মার খাওয়ানোর ধান্দা খোজে ও।

ইশিকা এগিয়ে এসে বললো,

-মাম্মাম,এই রাদ ভাইয়া খালি মারবে আমাকে আর আমাকেই‌ মিথ্যেবাদী বলবে।ও মাম্মাম,মাম্মাম,তুমি না আমার মাম্মাম।রাদ ভাইয়াকে ভালোবাসো কেনো এতো?ও তো পচা ছেলে একটা!

রিয়াপি এগিয়ে এসে আমার পিছন থেকে রাদিবকে বের করার জন্য উকিঝুকি দিতে দিতে বললো,

-ওটাকে বের করো তো পাখি!বাসায় থাকলেই মেয়েটাকে জ্বালাবে।এতো দুষ্টু কেনো ও।রাদিব!বের হও মামনির পেছন থেকে!বের হও!!

রাদিব আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরলো আমাকে।কিন্তু আপি তো নাছোড়বান্দা।ধরবেই ওকে।আর জানি ধরলেই মারও লাগাবে।আমি হেসে বললাম,

-ছেড়ে দাওনা আপি।এই ইশু,তোকে কখন মারলো রাদ?

ইশিকা আমতা আমতা করতে লাগলো।বুঝলাম মিথ্যে বলেছে।রাদিব বললো,

-দেখেছো মামনি,ও বলতেও পারছে না।মিথ্যে বলছে ও!আম্মুকে বলো না।এই আমার মতো ভদ্র ছেলে দুনিয়াতে আর এক পিসও পাবে না তোমার রিয়াপি!

আমি আর আপি চোখ বড়বড় করে একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম।ঠিক এই কথাটাই সাতবছর আগে আদিব ভাইয়া আমাকে বলেছিলো।ইশিকা মুখ‌ বাকিয়ে বললো,

-হ্যাঁ হ্যাঁ,ভদ্র না ছাই!হুটহাট মার লাগায় আমাকে!আসছে ভদ্র!

এবার শুধু আমার অবাক হবার পালা।এই কথাটা আমি আরমানকে শুনাতাম,এখনো শুনাই।কিন্তু মারের জায়গায় অন্য কথা রেখে।ইশিকা কি করে বলছে এসব? ওর তো জানার কথা না।ওর সামনে কখনো‌ বলিনি।রিয়াপি ইশিকার সামনে হাটু গেরে বসে বললো,

-এই কথা কোথায় শুনেছো তুমি ইশু বেবি?

-এই কথা তো মাম্মাম বাবাইকে বলে।আমাকে…

আমি তাড়াহুড়ো করে ওর মুখ চেপে ধরলাম।আপির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে মাথা হেলেয়ে ঠোট বাকিয়ে হাসছে।ইশিকাকে বললাম,

-এই,ত্ তুমি মিথ্যে বলো কেনো?আ্ আর রাদ কখন মারলো তোমাকে?

-মা্ম্মাম,ও আমাকে মারে।আবার নামও ভাঙায়।সত্যি বলছি।

রাদিব বললো,

-এই‌ ইশু,তোর নাম কখন ভাঙালাম আমি?

-হুহ!ভাঙাও তো!মাম্মাম,জানো রাদ ভাইয়া বলবে কি হিশু বেবির নাম ভাঙানো বিরাট মজার ইশু।

-আর তুই‌ যে আমাকে‌ খাদ ভাইয়া ডাকিস,তার বেলায়?

আপি আর আমি হাসতে গিয়েও হাসলাম না।আপি সিরিয়াসভাবে বললো,

-নাম ভাঙানো পাপ রাদ!ওসব বলতে নেই।সরি বলো ইশুকে।

ইশিকাকে কি বোঝাবো?যেমন বাপ তার তেমন মেয়ে।আপির কাছে থাকা নিয়ে এতোটা জেলাস সে সবসময় টিয়াপি বলতো ওকে।যদি কোনো ছেলের চক্করে পরতাম,কি করতো আল্লাহ মালুম।ইশিকাকে বললাম,

-ইশু,সরি বলো রাদ ভাইয়াকে।আর কোনোদিন যেনো এসব না শুনি।

সরি তো বললো দুজনে,কিন্তু এই মৈত্রিচুক্তি দুমিনিটও যাবার নয় তা আমি আপি দুজনেই জানি।বললাম,

-ব্যস!অনেক হয়েছে ইশিকা।ঘরে যাও তুমি।আজকে জ্যাক এন্ড জিল রাইমস্ ফুল শুনতে চাই আমি।

-ওটা ওর বাবাই ওকে আগেই শিখিয়েছে!

আরমান কলারের কাছের বোতামটা খুলতে খুলতে বাসার ভেতরে ঢুকছেন আর কথাটা বলছেন।ইশিকা দৌড়ে গিয়ে ওনার কোলে উঠলো।রাদিব ওখানে দাড়িয়েই গাল ফুলিয়ে বললো,

-এজন্যই আব্বুকে বলি কাকাইয়ের সাথে অফিস যাও।ছুটি নিলে একসাথে নিও।আমি কারো কোলে যেতে পারি না।

আমি আর আপি হেসে দিলাম ওর কথায়।আরমান এগিয়ে এসে ব্যাগটা সোফায় রেখে আরেক হাতে ওকেও কোলে তুলে নিলো।ইশিকা বললো,

-বাবাই,এই পচা ছেলেটার কথায় ওকেও কোলে কেনো নিলে তুমি?মনিমা আর কাকাই কতো ভালো,তাদের ছেলেটাই‌ হয়েছে পচা।

-ইহ!তোর থেকে তো মামনি আর কাকাই ভালো।তুইই হয়েছিস মিথ্যেবাদী!

ওদের ঝগড়া আবার শুরু।আদিব ভাইয়া এতোক্ষনে রুম থেকে বেরিয়ে আসলেন।বললেন,

-রুমে কাজ করা যাচ্ছে না রাদিব তোমার গলার আওয়াজে।রিয়া,একে কিছু বলো না কেনো তুমি?

আপি গলা খেকিয়ে বললো,

-একদম কাজ দেখাতে আসবা না।এতোই কাজ অফিসে গিয়ে করো।বাসায় কি?আমিও তো বসে নাই।

-হ্যাঁ।বিয়ের আগে চাকরি করতে দিবে এমন শর্ত দেওয়া পাব্লিকটা খুন্তি হাতে এইসব শোনাচ্ছে আমাকে।হাউ ফানি।

-তো বাপ ছেলেতে মিলে তো কম জ্বালাও নি,ছবছরে রাদিব আর তারআগে..

আপি আটকে গেলো।আমি আর আরমান খুব কষ্টে হাসি আটকে আছি।এখন হাসলেই দুটো ভালোমতো লজ্জা পেয়ে যাবে।আদিব ভাইয়া গলা ঝেড়ে বললো,

-রাদিব,চলো রুমে।

-না।কাকাইয়ের কোলে থাকবো।

আদিব ভাইয়া হনহন করে পা বাড়ালো রুমের দিকে।আপিও কিচেনে ঢুকলো।আরমান ইশিকা আর রাদিবকে নামিয়ে রুমে চেন্জ করতে চলে গেলেন।ড্রয়িংরুমে বাবা,আম্মু সবটাই দেখে শুধু হাসছিলেন।আমি চায়ের কাপ নিয়ে এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে।আম্মু বললো,

-তোরা দু বোন আমার সংসারকে ভরিয়ে দিয়েছিস মা।দোয়া করি,ভালো থাক এভাবেই।

হেসে তার পাশেই বসলাম।এবাসায় আব্বু আম্মুর কমতি খুব কমই মনে হয়েছে।ওনারা এতোটাই ভালোবাসেন আমাদের।রিয়াপি মিনিপ্লেটে বিস্কুট নিয়ে এসে দিয়েই চলে যাচ্ছিলো।বাবা বলে উঠলেন,

-রিয়া,এখানে বস না।

আপি আচলে হাত মুছে বাবার পাশে সলো।বাবা বললো,

-জানিস তো,আদিবটার বাবা আমার বিজনেস পার্টনার ছিলো ঠিকই কিন্তু আমি ওকে ভাই হিসেবেই দেখতাম।ওদের কার এক্সিডেন্টের পর সবসময় চেষ্টা করতাম আদিবকে বুঝানোর আমরা ওকে ভালোবাসি, কিন্তু ছেলেটা নিজের মধ্যে সে চাপা কষ্টটা নিয়েই থাকতো।তুই ওর জীবনে এসে সবটা অনেক সহজ করে দিয়েছিস মা।

আপির চোখ ভরে উঠলো।বললো,

-ওভাবে কেনো বলছেন বাবা।এটা তো আমারও পরিবার।আর আমিও তো…

-হ্যা হ্যাঁ।এটা সবার পরিবার।আমি বাদে।

সবার চোখ দরজায়।আরিশা এসেছে সাথে ওর বর রায়হান।দুবছর আগে আমারই ভার্সিটির ব্যাচমেট রায়হানের সাথে ওর বিয়ে হয়ে যায়।রায়হান খুব ভালো বন্ধু ছিলো আমার।আমার সাথে একসাথে যাতায়াতের সময় আরিশাকে দেখে ভালো লেগেছিলো ওর।প্রোপোজ করতেই আরিশা হ্যা বলে দিয়েছিলো।তিনবছর চুটিয়ে প্রেম করে বিয়ে করলো দুজনে।ওদের প্রেমের সবটাই জানতো আরমানসহ সবাই।বর্তমানে রায়হান একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করে।সব মিলিয়ে ভালোই আছে। ভেতরে ঢুকে সবার সাথে কুশন বিনিময় করলো ওরা।আড্ডায় মেতে উঠলো পুরো পরিবার।

সবার সাথে আড্ডা শেষে রুমে ঢুকে দেখলাম ইশিকা ঘুমিয়ে গেছে।আরমানের কোলেই ঘুমাবে ও সবসময়।মাম্মাম নাকি ফেয়ারি স্টোরি বলে না ওকে,বাবাই শুনায়,তাই।সারাঘরে চোখ বুলিয়ে আরমানকে পেলাম না।ওয়াশরুমেরও দরজা খোলা।চোখ গেলো ব্যালকনিতে।দুহাত পকেটে গুজে আকাশ দেখছেন উনি।গুটিগুটি পায়ে নিশব্দে তার পেছনে এসে দাড়ালাম।আকাশে চাদ নেই আজ।না তারা।মেঘও করেনি।তবে কি দেখছেন উনি?আরমান ওভাবে তাকিয়েই বললেন,

-আড্ডা শেষ?

মুচকি হাসলাম।জানিনা কিভাবে আমার উপস্থিতি সবসময় টআমি।পেয়ে যান উনি।পাশে দাড়িয়ে বললাম,

-কিভাবে বোঝেন আপনি যে আমি এসেছি?

উনি শব্দহীন হাসলেন।বললেন,

-বিয়ের এতোবছর পরও বুঝলে না?

-বুঝলাম ভালোবাসেন।কিন্তু এভাবে সিক্সথ্ সেন্স আমার কাজ করে না কেনো?

আরমান পিছন ফিরে একপা উচিয়ে রেলিংয়ে ঠেকিয়ে দাড়ালেন।আঙুলে থুতনি ধরে চিন্তার ভাব করে বললেন,

-ঠিকই বলেছো।কেনো কাজ করে না বলোতো?একটু হুট করেই কাছে আসলে,স্পর্শ করলে,কোমড় জড়িয়ে ধরলে আজও আতকে ওঠো।যেনো পরপুরুষ এসেছে।

গাল ফুলিয়ে বললাম,

-পরপুরুষের কথা কেনো আসছে?আগে থেকেই আপনার স্পর্শে এলোমেলো লাগে নিজেকে।

-ওমা,এ মেয়ে তো রাগ করে ফেললো!

-তো,আমি বললাম কি আর আপনি বললেন কি?

-ইউ নো?তোমার সব প্রশ্নের খোলাখুলি উত্তর আমি ওই‌ একদিনই দিয়ে দিয়েছিলাম।আফসোস,মনে নেই তোমার।

অবাক হয়ে বললাম,

-কবে?

-চিটাগাং থাকতে।শিমুলের বিয়ের দিন যে ড্রিংক করেছিলে তুমি,ওইদিন।

পায়ের আঙুলে ভর করে দাড়িয়ে উচু হয়ে আরমানের কাধের উপর দিয়ে দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,

-ইউ ওয়ান্ট মি টু ড্রিংক এগেইন?

আরমান চোখ বড়বড় করে বললেন,

-মানেএএএএ?

বিরক্তি নিয়ে একপলক তাকালাম তার দিকে।মন ছোট করে হাত সরিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম।বিরবির করে বলছিলাম,

‘ হাদাটা বিয়ের পর বুদ্ধু হয়ে গেছে।কে জানে ওনার সো কলড্ হৃদমাঝারে নতুন কেউ ঢুকে পরেছে হয়তো!আনরোমান্টিক একটা! ‘

আরমান আচমকা পিছন থেকে হাত টেনে কোমড় জড়িয়ে কাছে একদম কাছে টেনে নিলেন আমাকে।কিছুটা চমকে উঠলাম।উনি আমার কপালের চুলগুলো কানে গুজে দিয়ে দুহাতে গাল ধরলেন আমার।কপালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-খুব ভালোবাসি তোকে।সেদিন সেই রাতে তোর দেখা না পেলে হয়তো এ অনুভুতিগুলো থেকে বঞ্চিত হতাম।ঘন জঙ্গলে শুকনো পাতায় পায়ের সুর তুলে এসে আমার জীবনকে ভরিয়ে দিয়েছিলো এই যামিনী।তোর আগমনে সবটা রঙিন হয়ে উঠেছে আমার।এই হৃদয়ে শুধু তোকেই আগলে রাখতে চাই যামিনী।আজীবন বলতে চাই,এই হৃদমাঝারে শুধুই তুই!শুধুই‌ তুই!!!

ভালোবাসার এ সম্বোধন নতুন আমার।নতুনভাবে তার সঙ্গায় ভালোবাসার ব্যাখা খুজে পেলাম আমি।তার টি শার্টটাকে আকড়ে ধরে তারই কথাগুলো হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দনে এটে দেওয়ার জন্য মনে মনে বলে উঠলাম,

‘ সৌভাগ্যবতী আমি।আমি যেমন,তেমনটাই নিয়ে তার হৃদমাঝারে শুধুই আমি। ‘

~সমাপ্ত