হৃদমোহিনী পর্ব-০৬

0
486

#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬

দিগন্তজুড়ে আঁকা সাতরঙা হাসিমাখা রংধনু। ভোরবেলায়ই আকাশের এমন রুপে মুগ্ধ হলাম। শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি হয়েছিলো। ঠান্ডায় জমে যাবার মতো অবস্থা তখন। কম্বল মুড়ি দিয়েও দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি৷ হঠাৎ কফির তৃষ্ণা পেলো আমার, উঠে নিচতলার রান্নাঘরে গেলাম। কাউকে দেখতে না পেয়ে নিজেই একমগ কফি তৈরি করলাম। চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি, খেতে দারুণ লাগে আমার। আজকের ধোঁয়া উঠা গরম কফিটার দিকে তাকিয়ে ওর খুব ইচ্ছে করছে ধূসরের উপর ছুঁড়ে ফেলতে। কিন্তু তিনি এখন সামনে নেই। নাহলে ঠিকই ওনার হাতে ফেলতাম আর পোড়া লাল চামড়াটা দেখতাম মন ভরে। ব্যাটা আমার সাথে পাঙ্গা নিস? নেশাখোর! মনে মনে হাজারো গালি দিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার নিজেকে খুব হালকা লাগছে। কেমন পৈশাচিক আনন্দ হলো আমার। কিন্তু ভাবনাটাকে দমিয়ে রেখে আকাশের সৌন্দর্য দেখায় মনোযোগী হলাম। পূর্ব দিকে লালচে-সোনালি সূর্যদেব উঁকি দিচ্ছে। বৃষ্টিতে সতেজ হওয়া প্রকৃতি বাতাসে দুলছে। বাগান থেকে ভুরভুর করে আসছে হাসনাহেনার সুবাস। ধূসরের নাকি খুব অপছন্দ এই সুবাসটা। কারণ তিনি জানেন আমার খুব ভালোবাসে হাসনাহেনার সুগন্ধ। আর যেটা আমার পছন্দ সেটা ধূসরের কোনোদিনই পছন্দ নয়। বিপরীত মেরুর একজন মানুষ সে। আজকের ভোরটা আমার জীবনের সেরা সকালের সূচনাগুলোর একটি যেন! মনটা আজ ভীষণ উৎফুল্ল কোনো এক অজানা কারণেই।

বাবা-মা ফিরেছেন তিনদিন হলো। ওদের সামনে ধূসর আমার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহারই করেননি। তিনি বুঝাতে চান যে ওনি ভালো হয়ে গেছেন। এমনকি আমাকে ওনার ঘরে থাকার পারমিশন অবধি দিয়েছেন। যদিও সম্পর্কটা আমাদের ভেঙ্গে যাওয়ারই মতোন। আমি ওনার খুব করে খেয়াল রাখছি, ওনার পোশাক-আশাক ধুয়ে দিই, পছন্দের খাবার তৈরি করি, ভালো ব্যবহারও করি। ওনি এগুলোর কোনো দামই দেননা। দুপুরে মায়ের সাথে হাতে হাতে ঘর গুছিয়ে দিচ্ছিলাম, ধূসর বাবার সাথে এক আত্মীয়ের বিয়ে খেতে গেছে। যেতে তো রাজিই হননি, জোর করেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ধূসর কী এখনো আগের মতোই?’

-নাহ৷ পাল্টেছে তো খানিকটা।
-কবে যে পুরোপুরি শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে!
-খুব দ্রুতই। আমি চলে গেলেই বোধহয় ওনি ঠিক হয়ে যাবেন।
মা চমকে বলল, ‘তুমি চলে গেলে মানে?’
আমি হেসে বললাম, ‘আসলে ওনিতো আমার জন্যই এমন করে। তাই বলছি আমি দূরে চলে গেলেই ভালো।’
-এটা হয়না কিছুতেই। সে মানুক আর না মানুক তোমাদের দুজনের বিয়ে হয়েছে। অর্নির প্রতি ও যতোটা সিরিয়াস ছিলো, তোমার প্রতি ততোটাই থাকা উচিৎ।
-ওনি সিরিয়াস হবেননা মা।
মা আর্তনাদ করে বললেন,
-তাই বলে তুমি চলে যাবে? তুমিও কী মানোনা ও তোমার স্বামী?
আমি খানিক চুপ থেকে ক্ষীণ কন্ঠে বললাম, ‘বিয়ে যখন হয়েই গেছে আমি মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছি এবং করছি। কিন্তু ওনি তা করছেননা। আর এমন হলে কোন সম্পর্ক টিকবে আপনিই বলুন?’
-তুমি কী বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে চাও?
আমি বললাম, ‘নাহ, শুধু দূরে চলে যেতে চাই।’
-কেন মা?
-যেখানে আমার সম্মান নেই সেখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
মা অপরাধী গলায় বললেন, ‘আমাদের প্রতি তোমার কোনো অভিযোগ থাকলে নিদ্বির্ধায় বলে ফেলো মা, শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবো। আসলে ছেলের জন্যই আমাদেরকে স্বার্থপর হতে হয়েছে।’

আমি মায়ের কাছে গিয়ে ওনার হাতদুটো মুঠোয় নিলাম। হাসিমুখে বললাম, ‘আপনাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই আর কেনই-বা থাকবে বলুন তো? আপনারা যথেষ্ট ভালোবাসেন আমায়, আমি শুধু আপনার সাইকো ছেলেটার কথা বলছি। দেখেন না আমাকে দেখলেই এমন করে তাকায় যেন চিবিয়ে খেতে পারলে ওনার মন-মস্তিষ্ক শান্তি পাবে। রাত হলেই মাতাল হয়ে আমার কাছে আসবে, দিন হলেই বলবে তোমাকে আমার চাই-না! বলুন তো আমি কী এতোই ফেলনা?
কথাগুলো বলেই খেয়াল করলাম ওনার চোখে পানি। কেঁদে কেঁদেই আমাকে বললেন,
-তুমি যা-ই বলো, আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবেনা। নাহলে আমিই এবার ঘর-সংসার ছেড়ে বনবাসী হবো। ছেলে থাকুক তার ইগো নিয়ে।
-আপনারা কেন ছেড়ে যাবেন? এটা আপনার বাড়ি, আপনার সংসার।
-আমার দিন ফুরিয়ে গেছে এখন তো সবই তোমার।
আমার ছেলেকে ভুল বুঝোনা তুমি মা, দরকার হলে আমি ওকে বোঝাবো।
-তার দরকার নেই৷ ওনি ওনার মতো চলুক। জানেন সেদিন আমায় কী বললো?
মা উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী?’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাকে সেদিনের ঘটনাটা খুলে বললাম। শুনেই মা রেগে গেলো। তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে বলল, ‘মানে? কী ভেবেছেটা কী ও? জীবনটা এতোই সহজ? তোমাকে সে বিয়ে করেছে আর বাচ্চা মানবেনা? আরুণী? তুমি কী ওকে বলোনি যে সেদিন রাতে কী হয়েছে তোমাদের মধ্যে?’

আমি মাথা নিচু করে না বোধক জবাব দিলাম। ওনি আমার কাঁধে হাত রেখে গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বলে দাও মা।’
-বলে দেব?
-হুঁ। তারপর জানে ও কী করবে৷
-ওনি কিন্তু আমাকে কয়বার জিজ্ঞেসও করেছিলেন এ বিষয়ে।
-তুমি বলোনি কেন?
-যদি আমাকে সুবিধাবাদী ভাবে!
-ভাবাভাবির কিছু নেই৷ ওর উপর অবশ্যই তোমার অধিকার আছে। তুমি সুবিধার হও আর যা-ই হও সে কেন তোমাকে জোর করলো? দোষটা সম্পূর্ণ ধূসরের।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘মানে?’
-সে কেন নিজেকে সামলাতে পারলোনা!
-থাক মা।
-তোমাদের বিয়ে হয়েছে এতোদিন হলো। তোমার বাবা ফোন করেছিলো, ওই বাসায় তো যাওয়া হয়নি এখনো। ধূসর ফিরুক ওর সাথে কথা বলে দেখি!
-ওনি যাবেনা আমি নিশ্চিত।
-আমার উপর ছেড়ে দাও বিষয়টা।
-আচ্ছা।
রাতেরবেলা ঘুমানোর জন্য আমি নিচে বিছানা করছি এমন সময় ধূসর ঘরে আসলেন। চোখেমুখে বিরক্ত ভাব, যেন এই দুনিয়ার সব প্রাণী, আকাশ-বাতাস ওনাকে জ্বালাচ্ছে। দরজা লাগিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকলেন। গোসল সেরে বেরুলেন। পরণে টাওয়াল। আমি চোখমুখ কুঁচকে বললাম, ‘আপনার কী কোনো লজ্জা নেই? নির্লজ্জ কোথাকার।’
ওনি রেগে বললেন,
– এখানে নির্লজ্জের কিছু নেই। বাট ইউ আর শেইমলেস ইউরসেলফ..
-আপনার মাথা।
-বাড়ি যাবে বলে খুব আনন্দ হচ্ছে তাইনা? যাবে তো যাও, মাঝখান থেকে আমায় ফাঁসিয়ে দিলে।
আমি ভাব নিয়ে বললাম,’বিয়ে করেছেন আর ফাঁসবেন না, এমনটা হয় নাকি? কিছুদিন পর তো আমার আঁচল ধরে বসে থাকবেন, চোখে হারাবেন!’
ওনি জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বললেন,
-নো নেভার।
-দেখা যাবে।
ওনি হুট করে আমার চশমা খুলে নিয়ে মেঝেতে আছাড় মারলেন, যার ফলে সেটা ভেঙ্গে গেলো। আমি রেগে বিছানা থেকে উঠে ওনার সামনে দাঁড়িয়ে চিল্লিয়ে উঠলাম। একটানে ওনার টাওয়াল খুলে দিয়েই বুঝতে পারলাম কি ভয়ানক কান্ড করে বসেছি! ওনি আহাম্মকের মতো চেয়ে আছেন আমি ভয়ে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছি। মনে মনে সব সূরা আওড়াতে লাগলাম। ইয়া আল্লাহ মাফ করুন, এটা আমি কী করে বসলাম?

ওনি দ্রুত টাওয়ালটা পরে নিয়েই রেগে বললেন, ‘হোয়াট দ্যা হেল আরুণী? তোমার মাথায় কী সেন্স নেই? এতোবড় ধ্যাড়ি মেয়ে হয়েও এসব করতে তোমার লজ্জা করলোনা? আমার মানসম্মান নিয়ে টানাটানি! থাপ্পড় খাবার খুব শখ হয়েছে বুঝি? আন্সার মি…

আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম, ‘আপনি আমার চশমা ভাঙলেন কেন?’
-তেজ কমবেনা তাও। স্টুপিড কোথাকার।
আমি জ্বলে উঠলাম। কটমট করে বললাম, ‘আপনার নিজের দোষটা দেখে পরে আমার উপর চিৎকার করবেন বুঝলেন? ইউ আর সো..’
বাক্যটা শেষ না করেই চুপ করে গেলাম। গিয়ে মেঝেতে পাতানো বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ওনি ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি কাঁথার ভিতর মুখ লুকালাম। ওনি ততক্ষণে বিছানায় উঠে বসেছেন। ডিংক্স নেওয়ার পায়তারা করছেন। মায়ের কথাগুলো মনে হতেই কিছু একটা ভাবলাম।

হঠাৎ করেই আমি কাঁথার ভিতর থেকে মুখ তুলে বললাম, ‘রাতে এসব গিলবেননা। এইসময় আপনি নিজের মধ্যে থাকেননা। যদি কিছু ঘটে যায় তখন কিন্তু আমার দায় নেই, এই তিনদিনও আপনি মাতাল হয়ে কতকিছু করেছেন। এবার এসব বন্ধ করুন।’
ওনি অবাক হয়ে বললেন, ‘কতকিছু করেছি মানে?’

আমি শান্তস্বরেই বললাম, ‘একজন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা হয়, আপনি তা-ই করেছেন। তাই আজ সতর্ক করে দিলাম। ডোন্ট কাম টু মি…’

ওনি তৎক্ষনাৎ আমার কাছে এসে আমাকে টেনে তুললেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তার মানে বিয়েরদিন রাতে…’
-হুঁ। সেদিনও।
ওনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন। মাথা চেপে ধরে জোরেই বললেন, ‘তুমি সত্যিই একটা সুবিধাবাদী লোভী মেয়ে আরুণী। তোমার প্রতি আমার ধারণাগুলো একটু হলেও পাল্টেছিলো কিন্তু সেসব তুমি নিজেই ভুল প্রমাণ করে দিলে। আমি বারবার তোমাকে জিজ্ঞেস করার পরেও তুমি আমাকে প্রশ্নের উত্তর দাওনি আর আজ এসব বলছো! কী করে পারলে আমার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিতে? বলো..

গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে…ইনশাআল্লাহ