হৃদমোহিনী পর্ব-০৭

0
488

#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭

ওনি তৎক্ষনাৎ আমার কাছে এসে আমাকে টেনে তুললেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তার মানে বিয়েরদিন রাতে…’
-হুঁ। সেদিনও।
ওনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন। মাথা চেপে ধরে জোরেই বললেন, ‘তুমি সত্যিই একটা সুবিধাবাদী লোভী মেয়ে আরুণী। তোমার প্রতি আমার ধারণাগুলো একটু হলেও পাল্টেছিলো কিন্তু সেসব তুমি নিজেই ভুল প্রমাণ করে দিলে। আমি বারবার তোমাকে জিজ্ঞেস করার পরেও তুমি আমাকে প্রশ্নের উত্তর দাওনি আর আজ এসব বলছো! কী করে পারলে আমার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিতে? বলো.. ‘

আমি শুধু চুপ করে ওনার কথাগুলো শুনে গেলাম। ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেওয়ায় খাটের কোণাতে পড়ে মাথায় বারি খেয়েছি, তার উপর চশমাও নেই। মাথাসহ পুরো শরীর বড্ড ব্যথা করছে, শরীর অসাড় হয়ে আসছে। মাথাটা ভার ভার লাগছে। আমি কাঁদছিনা একটুও। ভীষণ খারাপ লাগছে কিন্তু ওনাকে সেটা বুঝতে দিচ্ছিনা। ঠিক আগের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ে শরীরে কাঁথা টেনে নিলাম। আস্তে করে বললাম, ‘এখন কিছু বলতে পারছিনা। আমি ঘুমাবো।’
-বলার মতো কোনো মুখ নেই বলেই লুকাচ্ছো।
-আমি কথা বাড়াতে চাচ্ছিনা, আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।
-ভালো মানুষ সাজা হচ্ছে তাইনা? বেশ ভালো এক্টিং!
-হুঁ। জানেন তো, আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিলো হিরোইন হওয়ার। কিন্তু অভিনয় জিনিসটাকে আমার এতো অপছন্দ যে হিরোইন হওয়াটা আর হয়ে উঠেনি।
-ভিলেন হয়ে আমার জীবনে প্রবেশ করেছো..
-এতকিছু জানিনা। লাইটটা অফ করে দিন। ঘুম পাচ্ছে আমার।
ওনি আমার নরমাল বিহেভিয়ারে আরো রেগে গেলেন। একগ্লাস পানি এনে আমার উপর ছুঁড়ে মারলেন। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। শাড়ি ভিজে একাকার। ওনার দিকে মিটিমিটি করে তাকানোর চেষ্টা করছি। জানিনা তখন আমার কী হলো আমি ওনাকে কাছে টেনে আনলাম এবং ওনার ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিলাম। ওনাকে জাপটে ধরলাম এমনভাবে যে আমাকে ছাড়াতেই পারছেননা। নিজের এতো শক্তি দেখে আমিই অবাক। খানিকক্ষণ পরে ওনাকে ছেড়ে দিয়ে দেখলাম ওনি রাগী এবং বিস্মিত চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ধমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কী করলে তুমি আরুণী?’
-আদর করলাম।
-তোমার সাহস তো কম নয়!
-জি। আমি বড্ড সাহসী।
-এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দেবো অসভ্য মেয়ে।
আমি বিকারগ্রস্ত মানুষের মতো বললাম, ‘আমি কাছে গেলেই অসভ্য আর আপনি আমার কাছে এলে সেটা সভ্য বুঝি?’
-তোমাকে আমি এই অধিকার দিইনি যে আমার সাথে এমন করবে।
-আমিও দিইনি। ফ্রি-তে আমায় ইউজ করেছেন সবাই, এবার আমি খানিকটা উসুল করলাম।
-বাজে মেয়ে কোথাকার।
-যান তো। ঘুমিয়ে পড়ুন। বেশি রাত জাগা ভালো নয়।
-তোমার পারমিশন নিয়ে চলতে হবে নাকি?
আমি দুর্বোধ্য হাসলাম। মাথাব্যথা ক্রমশই বাড়ছে। ভীষণ ক্লান্তিতে আর এক পা-ও ফেলবার শক্তি নেই আমার। ধপ করে নিচে বসে পড়লাম। অবশেষে চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো আর আমি জ্ঞান হারালাম!

ড্রিম লাইটের নীলাভ আলোয় ঘরটাকে মায়াপুরী লাগছে। চারপাশের গুমোট অন্ধকার আর জানালা দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসে আমি শিউরে উঠছি বারবার। মাথাটা ভার হয়ে আছে। শরীর নাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। একি! আমি নড়তে পারছিনা কেন? আরও একবার ঘরটা পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলাম আমি।বিছানায় শুয়ে আছি। অবাকের চরম শিখরে পৌঁছালাম যখন দেখলাম আমি ধূসরের বুকে শুয়ে আছি। ঘেমেনেয়ে একাকার আমি। বেশ ভালোই লাগছিলো এভাবে থাকতে। মৃদু আলোয় ওনার মুখটাকে কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। চুলগুলো কপালের কাছে লেপ্টে আছে। আমি হাত দিয়ে সরিয়ে দিলাম। খপ করে আমার হাত চেপে ধরে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন, ‘ঘুমাও অর্নি!’

আমার মনে পড়ে গেলো কিছুক্ষণ আগের কথা। এখনো অর্নি? আরুণী তাঁর কিছুই নয়? তৎক্ষনাৎ আমি ওনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। তাতে ওনার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ কচলে উঠে বসে বাতি জ্বালালেন। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘ঠিক আছো এখন?’
-কেন? আমার কী হয়েছিলো যে আমি ঠিক নেই বলে মনে হলো?
-তুমিতো জ্ঞান হারিয়েছিলে!
-ওহহ! বিছানায় এলাম কীভাবে?
ওনি কাচুমাচু করে বললেন, ‘আমি নিয়ে এসেছি।’
আমি কড়া চোখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’
-তোমাকে অসুস্থ দেখাচ্ছিলো। ভাবলাম নিচে শুলে কষ্ট হবে, তাই নিয়ে এসেছি!

হায়! ধূসর, আপনি শুধু আমার শারীরিক কষ্টটার কথাই ভাবলেন? আমার মনের উপর দিয়ে যে কালবৈশাখি ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছেন না কেন? আপনার নামটার মতোই কি আপনার হৃদয়েও ধূসর মেঘের রুপ ধারণ করেছে? এতো নিষ্ঠুর কেন আপনি? কথাগুলো মনে আসতেই আমার চোখ ভিজে উঠলো। ছোট্ট করে বললাম, ‘থ্যাংকস।’
বলেই নিচে এসে শুয়ে পড়লাম। ওনি বললেন, ‘চাইলে ওপরে এসে শুতে পারো।’
-আমি এখানেই ঠিক আছি। আপনি আজ ছাইপাঁশ গিলেননি?
ওনি ধীর কন্ঠে বললেন, ‘না খাইনি।’
-ভালো।
খানিক নিরবতা পালন করে ওনি জিজ্ঞেস করলেন,
-তোমার কী শরীর খারাপ? জ্ঞান হারিয়ে ফেললে যে?

এত খোঁজ নেওয়ার কিছু নেই বলে আমি পাশ ফিরে শুলাম। সারাটারাত নির্ঘুম কাটলো। চোখের পানিতে বালিশ ভিজে একাকার। ধূসর বিছানায় ঘুমে মগ্ন। সব কথা বলে দিয়ে নিজেকে একটু হালকা লাগছে। কিন্তু আর নয়! আর কিছুদিন ধূসরের সামনে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো। কাল বাড়ি যাবো ভেবেই কান্নাটা আরও গাঢ় হলো।

সকালবেলা খুব স্বাভাবিকভাবেই সবার সঙ্গে বসে নাস্তা খেলাম, ঘর গুছালাম। বাগানের গাছগুলোতে পানি দিয়ে এলাম। সম্প্রতি আমি একটা বিড়াল পুষি। নাম রেখেছি “কিশমিশ”। ও একমাত্র আমার সময় কাটানোর প্রধান মাধ্যম। ধূসর দুচোখে ওকে সহ্য করতে পারেনা। বিড়াল দেখতে পারেনা এমনটা নয়, শুধুমাত্র এটা আমার বলেই। তার উপর একদিন ওর কোলে উঠে মলত্যাগ করেছিলো, একদিন খিমচা দিয়েছে, বারান্দার গাছগুলো কামড়িয়ে ফালাফালা করেছে আর একবার ওনার ভাগের ইলিশ মাছটা খেয়ে নিয়েছিলো। তারপর থেকেই ” কিশমিশ” ওনার শত্রুতে পরিণত হয়েছে। কাল সন্ধ্যায়ও “কিশমিশকে” ধমক দিয়েছে কারণ বেচারির বেবি হবে। ওকে বাইরে কোথাও রেখে আসতে বলেছে। আমি আর মা ওনার প্রতিবাদ করেছি আর বাবার বকা শুনে ওনি “কিশমিশকে” বের করে দিতে পারেননি। আমি বিজয়ীর হাসি হাসছিলাম আর ওনি চোখ রাঙিয়ে বলেছিলেন, ‘কিশমিশের সাথে তোমাকে বের করে দিতে পারলে শান্তি পেতাম। দুজনেই অসহ্য!’

আজ “কিশমিশকে” ফেলে যেতে হবে খুব খারাপ লাগছে। ওকে খাবার দিতেই ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকালো যেন কিছু বলতে চায়। তখন ধূসর সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো। “কিশমিশ” একবার ওনার দিকে একবার আমার দিকে তাকায়৷ ধূসরকে নামতে দেখে আমি সেখান থেকে চলে এলাম। আমাদের বাসার সবার জন্য মা নানারকম খাবার-দাবার, দই-মিষ্টি, দিয়ে দিলেন। ধূসরও যাবে। সন্ধ্যায় আমরা রওয়ানা হলাম। মা বারবার বলে দিলেন খুব তাড়াতাড়ি যেন ফিরে যাই।

গাড়িতে আমি পেছনের সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম। পুরোটা সময় সন্ধ্যাবেলার শহরটাকে উপভোগ করে রাত আটটায় আমাদের বাসায় এসে পৌঁছালাম। আব্বু-আম্মু, চাচীমা, ফুপিরা আমাদের দেখে খুব খুশি হলেন। ঘটা করে খাবারের আয়োজন করলেন। আমি স্বাভাবিকভাবেই সবার সাথে বসে খেলাম। ধূসরও। কথাবার্তা খুব কমই হলো সবার সাথে৷ কিন্তু ধূসরের সাথে আজ সারাদিনেও আমি একটা কথা বলিনি। আমার বকবক শুনে এতোদিনে অভ্যাস, হঠাৎ করেই কথা বন্ধ করে দিয়েছি এজন্য হয়তো ওনার খুব আনইজি লাগছিলো। দু’বার আমার সাথে কথা বলতে এসেছিলো। আমি এড়িয়ে গেছি। কি দরকার কথা বলে মায়া বাড়ানোর? রাতেরবেলা আমি আম্মুর সাথে ঘুমানোর বায়না করলাম। সবাই ধূসরের সাথে থাকতে জোর করছিলো, কিন্তু আমি সেকথায় পাত্তা না দিয়ে মায়ের সাথে ঘুমাবো বলে গো ধরলাম। বাধ্য হয়ে আব্বু অন্যঘরে চলে গেলেন। রাতেরবেলা আম্মুকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলছি। আম্মু গভীর ঘুমে মগ্ন, একহাতে আমায় আগলে রেখেছে। মনে জমে আছে ধূসরের প্রতি হাজারো অভিমান৷ ওনি তো একবার হলেও বলতে পারতো ওনার সাথে থাকতে! প্রতিরাতে নেশার ঘোরে হলেও আমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতেন। ওনি কি কখনোই বুঝতে পারবেননা আমি এতে কতোটা সুখী ভাবতাম নিজেকে? এই দুইমাসে আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছেন ওনি! এটা কী ওনি জানতে পারবেননা কোনোদিন?

মানুষের জীবন কতই-না বিচিত্র! ধূসরের মতো এরকম একটা মানুষকে সবাই নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে আশা করে, কিন্তু আমি কখনোই করিনি। এরপরও নিয়তির লিখন মেনে নিয়েছি। কিন্তু ওনার এই দুর্ব্যবহার আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। অথচ আমাদের মেয়েদেরকেই সবসময় সবকিছু মানিয়ে চলতে হয়। কারণ আমাদের ধৈর্যশক্তি বেশি। এই ধৈর্যশক্তির কারণেই কি আমাকে সব অন্যায়,অবহেলা মুখবুজে সহ্য করতে হবে? একটা শিক্ষিত, স্টাবলিশ মেয়ে হয়েও আমাকে সবাই প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে যাচ্ছে। কেন? আমার কি মন নেই? আমার চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারেনা? সেটা কী অপরাধ? অর্নি তো মরে গিয়ে বেঁচে গেলো আর আমি? ওর বোন বলেই সব এসে আমার ঘাড়ে পড়লো। আমি এতসব যন্ত্রণা নিয়ে কি করে বেঁচে থাকবো? মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। আমি মরে গেলে কি ওনি খুব সুখে থাকবে? ওনার হৃদয়ের মোহিনী তো অর্নিই থাকবে! আমি কখনো অর্নির সাথে ওনার হৃদয়ে জায়গা নিতে পারবোনা?

চলবে…ইনশাআল্লাহ