হৃদমোহিনী পর্ব-৮+৯

0
504

#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮

মেঘমুক্ত আকাশ। মিষ্টি রোদের ঝলকানিতে দূরের বাড়িগুলো চকচক করছে। আকাশে উড়ে চলেছে সাদা বকের দল, তাদের গন্তব্য বহুদূর। ডানা মেলে ছুটে চলা সাদা বকের দলের এই দৃশ্যটা বেশ চমৎকার। আমারও ভীষণ ইচ্ছে করছে সব পিছুটান ছেড়ে, পার্থিব চাওয়া-পাওয়ার হিসাবনিকাশ চুকিয়ে দিয়ে ওদের সাথে অজানায় হারিয়ে যেতে। আচ্ছা ওরা বিশাল বিশাল নদী, সমুদ্রের ধারা পার হয় কীভাবে? আবার মনে হলো ওরা যেভাবেই পার হোক আমারও উচিৎ ওদের মতো হওয়া। নিজের জন্য? হ্যাঁ, নিজের জন্যই তো আমাকে বেঁচে থাকা দরকার। আমাকে আরো কঠোর হতে হবে, শক্ত হতে হবে। কারো দয়া বা করুণা আমি ডিজার্ভ করিনা। আমার দুর্বলতাটাকেই নিজের শক্তি হিসেবে ধরে নিয়ে ওই বক আর চিলেদের দলের মতো বহদূর অবধি যেতে হবে। ট্রিপিক্যাল বাঙালি নারী হয়ে থাকতেই চেয়েছিলাম সবসময়। এখন মনে হচ্ছে আমাকে বাংলা সিনেমার অবহেলিত নায়িকাদের মতো বেঁচে থাকলে চলবেনা। আমারই জন্য আমায় বাঁচতে হবে। ধূসর? কে ধূসর? আমারতো কেউ হয়না! কিন্তু তার জন্য ভেবে ভেবে মরিয়া হয়ে উঠছি কেন আমি? আমিতো কখনো এমন ছিলামনা। সবাই সবার প্রয়োজন মিটিয়েছে এবার আমি নিজের জন্যই বাঁচবো। আমি কোনো ফেলনা নই! মনে মনে এসব ভেবেই নিজের মাথাটাকে ঠান্ডা করলাম। আমাকে অনন্য অসাধারণ হতে হবে। হাজারো ভাবনায় এলোমেলো মাথাটা এখন একটু হলেও স্বস্তি পেয়েছে। শাড়ির আঁচলে আঙুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে আচারের বয়ামটা টেনে নিয়ে খেতে লাগলাম চেটেপুটে। মিঠা রোদ্দুরে গা ভিজিয়ে ছাদে বসে আচার খাওয়ার মজাই আলাদা। দূরের বালির মাঠগুলোকে কি শান্ত দেখাচ্ছে। তারপরই রেললাইন। ঝকঝকিয়ে ট্রেনগুলো যখন ছুটে চলে সেই দৃশ্যটা দেখলেও আজকাল মনের ভেতর সূক্ষ্ম সুখানুভূতি হয়। অজানায় হারিয়ে যেতে মন চায়।

আমের আচারের বয়াম প্রায় শেষের দিকে। শেষ অংশটুকু চামচে করে তুলতেই ছোটচাচী আমার হাত থেকে সেটা কেড়ে নিলেন। আমি প্রকৃতি দেখা বাদ দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাচীর দিকে তাকালাম।

-আর কত খাবি তুই? এবার তো পেটব্যথা করবে আরু।
আমি বিরক্ত গলায় বললাম, ‘কই অতো খেয়েছি? দু’চামচও হয়নি আর তুমি বলছো..’
-তোর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে নাকি?
-মাথা খারাপের কী হলো?
-সেই সকাল থেকে আচারের বয়াম নিয়ে ঘুরছিস আর খাচ্ছিস। পুরো বয়ামটা শেষ করে তুই বলছিস কিছু খাসনি?
-তাতে কী হয়েছে? আচারটা তুমি দিয়েছো? দারুণ খেতে। আসো তোমার হাতে একটা চুমু দিই…

ছোটচাচী দূরে সরে গেলেন। আমি আচারের বয়ামটা নিয়ে নিলাম জোর করে। তারপর শেষটুকুও মুখে পুরে একটা হাসি দিয়ে বললাম, ‘আহ! দারুণ খেতে।’

ছোটচাচী হেসে ফেললেন। রোদে মেলানো কাপড়গুলো বাস্কেটে ভাজ করে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর হয়েছে কী আরু?’
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। বোকার মতো বললাম, ‘কী হবে?’
-বলছি এতো আচার খাচ্ছিস কেন?
-আচার খেলে কিছু হতে হয় নাকি?
-না হয়না। কিন্তু জানিস তো অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালোনা?
-মানে?
-খাচ্ছিস তো আচার। পরিমিত খেলে একটা কথা ছিলো কিন্তু তুই পুরো এক বয়াম শেষ করলি কয়েক ঘন্টায়। এতে তোর খটকা লাগছেনা?
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘কীসের খটকা?’
ছোটচাচী বিরক্ত গলায় বললেন, ‘এখন আমায় বুঝিয়ে দিতে হবে কীসের খটকা? আজব তো!’
-যা বলার ক্লিয়ারলি বলোতো!
-তোর তো বিয়ে হয়েছে। জামাইকে জিজ্ঞেস করে নে। আমি বলবোনা বাপু।

ধূসরের প্রসঙ্গ উঠতেই আমি আর কথা বাড়ালাম না। ছাদ থেকে নেমে গেলাম। আজ তিনসপ্তাহ ধরে আমি আমাদের বাসায় আছি। ধূসর আমাদের বাসায় তিনদিন থেকে গেছেন। কিন্তু সেইরাতের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি ওনার সাথে কোনো কথা বলিনি। যোগাযোগ করার চেষ্টাও করিনি। মা-বাবা অবশ্য আমার খোঁজখবর নেন। ফোন দিলেই বাসায় যেতে বলেন। আমি এক্সামের দোহাই দিয়ে রয়ে গিয়েছি। অবশ্য কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে নয়। আমার সত্যিই এক্সাম ছিলো। ওদেরকে মাঝেমধ্যে ভিডিও কলে এড করি, কিশমিশকে দেখি। মা বাগানের নতুন গাছগুলো আমাকে ছবি তুলে পাঠায়। ও বাড়িতে কোনো ভালো রান্নাবান্না হলে দারোয়ান কাকাকে দিয়ে আমার জন্য পাঠিয়ে দেন। ওনারা সত্যিই বেশ অমায়িক এবং নরম মনের মানুষ। এর মধ্যে চার-পাঁচদিন ভিডিও কলে কথা বলার সময় ধূসর এসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে। হয়তো তার অর্নির চেহারাটা দেখার ইচ্ছে হচ্ছিলো। ভাব ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছিলো সে আমার সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু আমি সেরকম কোনো সুযোগই দিইনি। অবশ্য ওনি নাকি এখন ঠিক হয়ে গেছেন। বাবার সাথে ব্যবসার কাজও সামলাচ্ছে। নেশাভাং করা বাদ দিয়েছেন। আমি জানিনা মানুষটা আসলেই ঠিক হয়েছে কিনা। হলেই ভালো, ওনার প্রতি আমার সব দায়িত্ব আমি ভালোভাবেই পালন করার চেষ্টা করেছি। নিজের আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিতেও কার্পণ্য করিনি! এইতো ক’দিন আগে অর্নির জন্য কয়েকজন এতিম খাওয়ানো হয়েছিলো। ধূসর আর তাঁর পরিবারও এসেছিলো। আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করলেও ওই লোকের সামনে যাইনি। কী দরকার নিজেকে এতো সস্তা বানানোর? সে তার মতো থাকুক, আমিও থাকি!
সবশেষে এটাই বলতে হয়, যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে। আমি ভালো আছি।

ছাদ থেকে নেমে দেখি ড্রইংরুমে চাচা আর আব্বু বসে কথা বলছে। আমাকে নামতে দেখে কাছে ডাকলেন। আমি আব্বুর পাশে গিয়ে বসলাম। আব্বু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করছিলে?’
-ছাদে ছিলাম।
-ওহহ। তোমাদের মধ্যে সব ঠিকঠাক চলছে মা?
আমি অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাদের মধ্যে মানে?’
-তোমার আর ধূসরের মধ্যে?
-আমাদের মধ্যে তো তেমন কিছু হয়নি।
-দেখো আমি আমার একটা কলিজাকে হারিয়েছি, তুমিই এখন আমার সব। তাই কোনো সমস্যা হলে সবার আগে আমাকে জানাবে।

আমি মাথা নাড়লাম। আব্বু আবারও বললেন, ‘আসলে বাসায় এসে থাকছো তো ধূসরের বাবা ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো তুমি কবে যাবে। আমি বললাম তোমার যখন ইচ্ছে হবে তখনই। তারপর জিজ্ঞেস করলেন তোমার আর ওর মধ্যে কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা? আমিতো কিছু জানিনা তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম।

আব্বুর কথা শুনে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘নাহ। আমাদের মধ্যে কিছু হয়নি।’

রাতে ঘুমানোর আগে জানিনা আমার হঠাৎ কি হলো; আমি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিজের মাঝে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। আমার স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভালো হয়েছে, গায়ের রঙটা আরেকটু উজ্জ্বল। চুলগুলো কেমন ঝলমল করছে। শাড়িতে আমাকে পুরোদস্তুর অন্য একটা মানুষ লাগছে। অভিনেত্রী আমি? সবার সাথে এমনকি নিজের সাথেও প্রতিনিয়ত অভিনয় করে চলেছি আমি। ভাবনাচিন্তা বাদ দিয়ে যা কখনোই করিনি বা আমার পছন্দ নয় সেই কাজটাই করতে বসলাম। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চোখে কাজল দিলাম, ঠোঁটে লিপস্টিক দিলাম আর হালকা মেকআপ। পরবর্তীতে নিজেই অবাক হলাম। তৎক্ষনাৎ সবকিছু ধুয়েমুছে সবকিছু মুছে নিলাম। বিছানায় শুয়ে পড়ার পর মোবাইল অন করে গ্যালারিতে ঢুকলাম। আমার ফোনে আমার একটা ছবিও নেই। সব অর্নির ছবি, ওর আর ধূসরের বিয়ের। ধূসরের সাথে হাজারখানেক ছবি আছে ওর। সবগুলোতেই দুজনকে খুব সুখী সুখী দেখাচ্ছিলো। আমি অর্নির ছবিতে চুমু খেলাম। তারপর ক্যামেরা অন করে অনেকগুলো সেলফি নিলাম। বুঝতে পারছি আমার আজ প্রচন্ড মুড সুইং হচ্ছে।

ধূসরের নাম্বার আমার ফোনে আগেই সেইভ করা ছিলো। তবে কখনো কোনো কন্ট্রাক্ট করিনি। মাথায় হঠাৎ এক দুষ্ট বুদ্ধি এলো। আমি হোয়াটসঅ্যাপে আমার সবগুলো দাঁত বের করা ভ্যাবলাকান্তির মতো তোলা সেলফিগুলো ওনাকে সেন্ড করে দিলাম। বেচারা দেখুক, আমি ওনার বিরহে দিন কাটাচ্ছিনা। আমি চিল করছি…ভালো আছি, আনন্দে আর সুখ উথলে ওঠছে। আহা! এতো শান্তি লাগছে কেন? খুশিতে ড্যান্স করতে ইচ্ছে করছে। ওরেরে.. জীবনে এতো আনন্দ কেন? আমার তো লাফিয়ে লাফিয়ে ধূসরদের বাড়ি গিয়ে ওনার হ্যাবলাকান্তের মতো মুখটা দেখার ইচ্ছে হচ্ছে। এতোদিন তিনি আমাকে জ্বালাতে সাহায্য করেছিলেন, আর আমি ওনাকে জ্বলতে সাহায্য করলাম। রিভেঞ্জ অব নেচার। অতঃপর হাসতে হাসতে, উৎফুল্ল, প্রফুল্ল মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

চলবে…ইনশাআল্লাহ

#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯

রাতেরবেলা ওমন একটা কান্ড করায় সকালে খুব লজ্জা লজ্জা লাগলো আমার। মোবাইল অন করে দেখি ধূসর কয়েকটা বিরক্তিকর ইমুজি দিয়ে লিখেছে কী সমস্যা? আমি সিন করে রেখে দিলাম। কি বলবো? শুধু শুধুই একটা উদ্ভট কাজ করে বসলাম। সারাদিন শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলাম। কাজিনদের সাথে হৈচৈ করে কাটালাম রাতটা। এভাবেই দিনকয়েক কেটে গেলো। শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথে যোগাযোগ রাখলাম শুধু। ওনারা যাওয়ার জন্য অনেক জোরাজুরি করলেও আমি সাফ জানিয়ে দিলাম আমি ওই বাড়িতে আর যাবোনা। ওনারা খুব আপসেটা হলেন। কিন্তু আমি তাদেরকে বোঝালাম যে তাঁদের পুত্র যদি আমাকে মেনে নিতো তাহলে আমি অবশ্যই যেতাম। সে অর্নির স্মৃতি নিয়ে যখন বাঁচতে চায়, বাঁচুক। কারো বেঁচে থাকার অবলম্বনে আমিতো কোনোদিন বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে চাইনি, আর চাইবোওনা। আমাদের বাসায়ও জানিয়ে দিলাম আমি আর ওই বাড়িতে ফিরছিনা। কারণ হিসেবে আমি ওদেরকে ব্যাপারটা শর্টকাটে বলে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। ওরা আমার সিদ্ধান্তে একমত না হলেও জোর করে আমার উপর কিছু চাপিয়ে দেয়নি। আমি এতেই ভীষণ খুশি! নিজেকে বদলে নিলাম। শাড়ি পরা বাদ দিয়ে দিলাম। সালোয়ার কামিজে নিজেকে আগের মতো করে নিলাম। দীর্ঘ আড়াই মাস! এতগুলো দিন শাড়ি পরে কাটানোর পর কামিজ যখন পরলাম নিজেকে কেমন এলিয়েন মনে হচ্ছিলো।

তখন বোধহয় বর্ষাকাল। সারাদিন মেঘের গর্জন আর ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। এই অবস্থায় বাইরে বের হতে ইচ্ছে হয়না। ভার্সিটিতে কিছু কাজ সেরে অর্ধেক পথ রিকশা করে আসতেই আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ঝড় উঠলো। রিকশাওয়ালা আমাকে একটা গলির দোকানে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। তিনি চলে যেতেই দোকানদার দোকান বন্ধ করবেন তাই আমাকে চলে যেতে বললো, কারণ বৃষ্টিতে কাস্টমার পাওয়া যায়না। আমি বাধ্য হয়ে বেরিয়ে এলাম কিন্তু বুঝতে পারছিনা কী করবো। অবশ্য এই গলি ধরে দু’মিনিট হাঁটলেই ধূসরদের বাড়ি। এদিকে ক’দিন যাবৎ আমার শরীরও খারাপ, বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাত জ্বরে ভুগতে হবে। তাই না চাইতেও একপ্রকার বাধ্য হয়ে আমি শ্বশুরবাড়ি যাওয়াটাই সমীচীন বলে মনে হলো। ভেজা কাপড়েই গিয়ে উঠলাম ধূসরদের বাড়িতে। আমার হাতে দুটো ফাইল। সেখানে আমার একাডেমিক কাগজপত্র। ভাগ্যিস সেগুলো ভিজে নষ্ট হয়নি। ওদের বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে পৌঁছাতেই বাসা থেকে আম্মুর ফোন এলো। এই ঝড়বাদলের দিন কোথায় আছি না আছি খোঁজ নিচ্ছে। আমি বলে দিলাম বৃষ্টিতে আটকা পড়েছি, থামলেই বাড়ি ফিরে যাবো যেন চিন্তা না করে।

ফোন রেখে কলিংবেলে চাপ দিবার সময় নিদারুণ অস্বস্তিতে আমি বারবার গুটিয়ে যাচ্ছিলাম। তবুও সাহস করে কলিংবেল চাপলাম। কারো সাড়া পাওয়া গেলোনা। বেশ কিছুক্ষণ পর দরজা খুললো নিকিতা মা। আমাকে দেখে হঠাৎ এতোটাই এক্সাইটেড হয়ে গেলেন যে আমি যে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি তিনি তা লক্ষ্য না করেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমাকে একপ্রকার টেনেই ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি অতি আনন্দে আমার প্রশংসার ঝুড়ি নিয়ে বসলেন। ড্রইংরুম আর ডাইনিং রুম একসাথেই। আমি ঢুকতেই দেখলাম ডাইনিংয়ে ধূসর আর বাবা বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। মা-ও বোধহয় খাচ্ছিলো ওদের সাথে বসে, তাই দরজা খুলতে দেরি হয়েছে। আমাকে দেখে ওনারা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমি আস্তে করে মাকে বললাম আমার পোশাক ভেজা। এতোক্ষণে মা নজর দিলো আমার পোশাকে। হন্তদন্ত হয়ে তোয়ালে আনতে ছুটলেন; ধূসর আমার দিকেই চেয়ে আছে আর আমি অস্বস্তিতে গাট হয়ে যাচ্ছি। সাদা জামা ভিজে শরীরে আঁটসাঁট হয়ে লেগে প্রতিটি ভাঁজ বোঝা যাচ্ছে। আমি ওড়না দিয়ে ভালো করে ঢেকে নিলাম। ভেজা চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, ইতিমধ্যে ফ্লোর ভিজে গেছে। মা আমাকে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছিয়ে ড্রেসিংরুমে নিয়ে গেলেন। ড্র‍য়ারে যত্ন করে রেখে দেওয়া অর্নির জামাকাপড় থেকে লাল রঙের সালোয়ার-কামিজ বের করে দিলেন। আমি সেগুলো নিয়ে বাথরুমে ঢুকে একেবারে গোসল সেরেই বেরিয়ে এলাম।

তারপর মা জোরাজুরি করলেন খেতে যাওয়ার জন্য। বাবা নাকি সেই কখন থেকে আধখাওয়া প্লেট নিয়ে বসে আছেন। আমারও বেশ ক্ষিধে ছিলো বলে আমি রাজি হয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি সব আমার পছন্দের খাবার। ভুনা খিচুড়ি, ইলিশ মাছ ভাজা, আর মুরগীর ঝোল। আহা! বৃষ্টির দিনে এসব খাবার দেখলে জিভের জল বাঁধ মানতে চায় নাকি? সবার সাথে বসে খাওয়া শুরু করলাম। ধূসরের দিকে একবার চোখ পড়তেই দেখলাম তিনি খাচ্ছেন আর মনোযোগী চোখ দিয়ে আমার খাওয়া দেখছেন। ইচ্ছে হচ্ছিলো দু’টো কথা শুনিয়ে দিই৷ কিন্তু নিজেকে সংযত করে খাওয়ায় মন দিলাম। খেতে খেতে বাবার সাথে অনেক কথাই বললাম। মায়ের সাথেও অনেক গল্প হলো। কিন্তু ওনারা কেউই আমাকে প্রশ্ন করে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দেননি এটাই বাঁচোয়া। পেটপুরে খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে আসতেই কোথা থেকে “কিশমিশ” এলো। আমাকে দেখে কোলে উঠলোনা বরং দোতালার সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মা জানালো ওর পাঁচটা বাচ্চার কেউ-ই
নেই। দুজন মরে গেছে আর বাকিরা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। শুনে আমার খুব কষ্ট হলো। “কিশমিশকে” অনেক কষ্ট করে কোলে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলাম, হঠাৎ ও আমার হাতে আঁচড় দিয়ে রক্ত বের করে ফেললো। আমি ওকে ছেড়ে নামিয়ে দিলাম। আমার চিৎকার শুনে ধূসর এসে রাগান্বিত গলায় “কিশমিশকে” ধমক দিলো। ধমক শুনে ও এমনভাবে ধূসরের দিকে তাকালো যেন ধূসরকে ওর একদম পছন্দ হচ্ছেনা।
ধূসর এবার বিকট শব্দে চেঁচিয়ে বলল, ‘বেরুও এখান থেকে। দুষ্ট বিড়াল কোথাকার। খিমচি দিয়ে বেড়ায় যত্তসব বেয়াদব। আম্মু এটাকে এক্ষুনি বাড়ি থেকে বের করে দাও বলছি। আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছো এখন মারামারি, কাটাকাটি শুরু করেছে।’

কিশমিশ ভয় পেয়ে এবার দৌড়ে পালালো। আমি ওড়না দিয়ে খিমচি দেওয়া অংশটা চেপে বললাম, ‘সামান্য খিমচি দেওয়ায় বাড়ি থেকে বের করে দিতে হবে? আজব!’
ওনি বিরক্ত গলায় বললেন,
-তুমি বুঝবেনা। তোমার হাতে বেশি লেগেছে? দাঁড়াও আমি এন্টিসেপটিক নিয়ে আসি।
-না আমার বেশি লাগেনি। কিছুর প্রয়োজন নেই। অস্থির হবেন না।
ওনি অস্থির হয়ে উঠলেন খুব। শ্বাশুড়িমা এন্টিসেপটিক লাগিয়ে দিলেই ওনার অস্থিরতাটুকু কমে যেতে দেখলাম। আমি সোফায় আগের মতোই বসে মোবাইল টিপছি কেননা ওনার সামনে আনইজি লাগছে। এতোদিন পর দেখা তো তাই।

সারাদিন আর বৃষ্টি কমলোনা। সন্ধ্যা নামতেই আমার উৎকন্ঠা বেড়ে গেলো। মা আজ থেকে যেতে বললেন, আমি উপায় না পেয়ে বাসায় ফোন করে জানালাম। ছোটচাচ্চুকে পাঠাতে চাইলেন আব্বু, নিকিতা মা না করে দিলেন। অগত্যা এখানেই থাকতে হলো। “কিশমিশকে” নিয়ে আমি রাতে ওনার ঘরে থাকতে গেলাম। চাইলেও অন্য ঘরে থাকা যাবেনা। কারণ আমরা একসাথে সংসার না করলেও এখনো স্বামী-স্ত্রী। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে ওনি নড়েচড়ে হেলান দিয়ে বিছানায় বসলেন। তারপর তাকিয়ে রইলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাদুর কোথায়?’
ওনি ভাবলেশহীন কন্ঠে বললেন,
-কেন?
-বিছানা পাতবো নিচে।
-আচ্ছা, তোমার কি নূন্যতম সেন্স নেই?
আমি অবাক হয়ে বললাম,’মানে?’
-এইযে, তুমি সাদাকাপড় পরে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি এসেছো তোমার সবকিছু তো দেখা যাচ্ছিলো। কে বলেছে তোমাকে এসব পরতে? আর তুমি না শাড়ি পরতে? ওটা কি পরা বাদ দিয়েছো?

ছিঃ ছিঃ এসব কী কথাবার্তা ওনার। আমি তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সবকিছু দেখা যাচ্ছিলো মানে?’
-এটাও আমায় বলে দিতে হবে? তুমি কি বাচ্চা?
-আজব। ঝগড়া কেন করছেন? বাই দ্যা ওয়ে, আমি শাড়ি পরবো না কামিজ পরবো সেটা আমার ব্যাপার। আপনি মাথা না ঘামালেই খুশি হবো।
-কেন?
-কি যন্ত্রণা। আপনি দয়া করে চুপ থাকুন। আপনার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।
-তাহলে আমার ঘরে কেন?
-ঠেকায় পরে থাকতে এসেছি। এবার বলুন মাদুর, চাদর কী পাবো? নাকি এমনিই নিচে শুয়ে পড়বো?
ওনি ছোটছোট চোখ করে বললেন, ‘বিছানায় শুতে পারো।’
আমি হু হা করে হেসে বললাম,’আপনার পাশে শোয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। ওকে, তাহলে আমি ড্রইংরুমেই শুয়ে বসে রাতটা পার করে দেবো। চিন্তা করার কিছু নেই। আমি সকালে বৃষ্টি কমলেই বেরিয়ে যাবো।’

এই কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গেলেই ওনি আমার হাত পেছন থেকে টেনে ধরে বললেন, ‘আলমিরার উপর দেখো পাও কিনা। ওখানেই থাকার কথা।’

কথাটুকু কোনোরকমে শেষ করে ওনি বিছানায় বসে ম্যাগাজিন ঘাটাঘাটি করতে লাগলেন। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলমিরার দিকে এগিয়ে গেলাম। এতো উঁচুতে উঠে আমি দেখতে পারবোনা যে মাদুর আছে কিনা। তাই আশেপাশে তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের টুলটা এনে ওটার উপর উঠে দাঁড়ালাম। যতবারই লাফিয়ে লাফিয়ে আলমিরার ছাদটা দেখতে যাচ্ছি আমার কামিজ উপরে ওঠে পেটের একপাশ দেখা যাচ্ছে। আলমিরার আয়নায় চোখ পড়তেই দেখলাম ধূসর আমার পেটের দিকে চেয়ে আছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ওনি থতমত খেয়ে অন্যদিকে ঘুরলেন। রাগে শরীর জ্বলে গেলো। বজ্জাত কোথাকার।

অনেকক্ষণ লাফালাফি করেও নাগাল পেলামনা। উলটো যা হলো আমি সেটার জন্য প্রস্তত ছিলামনা। আমার ওড়না যে কখন ফ্লোরে পড়ে গেছে আর ধূসর ব্যাটা আয়না দিকে তাকিয়ে আছে আমার চোখে তা পড়লোনা। ব্যর্থ হয়ে থেকে নামার সময় টুলসহ কার্পেটের উপর পড়ে গেলাম আর তখনই খেয়াল হলো ধূসরের চাহনি। আমি চিল্লিয়ে উঠতেই ওনার ধ্যান ভাঙলো, আমি উঠে তাড়াতাড়ি ওড়ানা দিয়ে নিজেকে প্যাকেট করে ওনার দিকে হুঙ্কার ছাড়লাম। ওনি বোকাবোকা চাহনিতে স্বাভাবিকভাবেই বললেন, ‘এতো জোরে চিৎকার করলে কেন? আব্বু-আম্মু ঘুমাচ্ছে রুমে।’
-বেশ করেছি। আপনি একটা নির্লজ্জ।
-তাই? কী করেছি আমি?
আমি বলতে গিয়ে থামলাম। তারপর রাগের চোটে বলেই ফেললাম আমার দিকে বাজে নজরে তাকাচ্ছিলেন কেন?
ওনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন, ‘তুমি নিজে পেট দেখানোর জন্য সালোয়ারকামিজ পরো, ওড়না ফেলে দাও আর দোষ পড়লো আমার? যত দোষ নন্দ ঘোষ,বাহ!’
কটমট করে ওনার দিকে চেয়ে আমি একটা কাঁথা নিয়ে এমনিই ফ্লোরে শুয়ে পড়লাম। কি ঠান্ডারে বাবা! ওনাকে মনে মনে হাজারো গালি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম!

গঠনমূলক মন্তব্য জানাবেন আশা করি। সাজানো হয়নি সুন্দর করে। আপনারা ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!