হৃদয়ের রং জানে না পর্ব-০৪

0
58

#হৃদয়ের_রং_জানে_না < চতুর্থ পর্ব >
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৭>
এরপর প্রায় দশ ঘন্টা কেটে গেছিলো | ঘড়িতে এখন রাত বারোটা | রূপকথা এখনো ওই ড্রইং রুমের সোফাটাতে চুপচাপ বসে | কিছু না খেয়ে | অনন্তর মার্ এবার এই দৃশ্য দেখে খারাপ লাগতে শুরু করেছে | রূপকথার শুকনো থমথমে মুখটার দিকে আর তাকাতে পারছে না যেন | ঠিক এই সময়েই ছিটকিনি খোলার শব্দটা কানে এলো | অনন্তর মা খেয়াল করলো অনন্ত দরজা খুলে আবার নিজের ঘরে চলে গেলো আনমনে | না , অনন্তর মা এবার আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে ওর কাছে গেলো | তবে মায়ের কাছে কিছু শোনার আগেই অনন্ত বলে উঠলো ,
” এতক্ষনে নিশ্চয়ই চলে গেছে সে | যাই হোক , ভালো হয়েছে | আর মা , কেন তুমি আমার ব্যাপারে একটা বাইরের মেয়েকে জানাতে গেলে ? যে কি না নিজে এতগুলো দিন আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ না রেখে কাটিয়ে দিলো ! কি দরকার ছিল আমার এক্সিডেন্টের ব্যাপারে ওকে বলার ! ওর সিম্প্যাথির কোনো দরকার নেই আমার |”
অনন্তর মা এতক্ষন চুপ ছিল | কিছু না বলে শুধু শুনছিলো ওর কথাগুলো | কিন্তু এবার আর নিঃস্তব্ধ থাকতে পারলো না | অনন্তর মুখের ওপর বলে উঠলো ,
” তুই যাকে বাইরের মেয়ে বলছিস সে যদি শুধু তোকে সিম্প্যাথি দেখানোর জন্য আজ এখানে আসতো তা হলে সেই দুপুর থেকে রাত বারোটা অব্দি না খেয়ে ড্রইং রুমে বসে থাকতো না | তোর দরজা খোলার অপেক্ষায় | আর দু বছর আগে রূপকথা কেন গিয়েছিলো সেই কারণটা কিন্তু তুই জানিস না | কোনো কিছু না জেনে ওকে এতো কিছু শুনিয়ে দেয়াটা কি ঠিক ?”
না , এই প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না অনন্ত | আর রূপকথা এতক্ষন ধরে কিছু না খেয়ে ওর জন্য বসে আছে শুনে হঠাৎ ভাবনাগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেলো যেন ওর | মনে পরে গেলো সেই বাবা মারা যাওয়ার দিনগুলোর কথা | সেই সকালটার কথা | যখন রূপকথা না খেয়ে শুকনো মুখে ওর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল | তাহলে কি আজও কিছু বদলায়নি ! আজও রূপকথা ওর জন্য সেই একই রকমভাবে ভাবে ! কথাটা মনে হতেই ও হাত দিয়ে হুইল চেয়ারের চাকাগুলোকে যত টুকু সম্ভব তাড়াতাড়ি ঘুরিয়ে ড্রইং রুমে গেলো | আঁধো অন্ধকারের মধ্যে রূপকথার শুকনো মুখটা ও স্পষ্ট দেখতে পেলো এরপর | হালকা ঘুমিয়ে পড়েছে এখন | সোফায় আলতো করে শরীরটা এলানো ওর | অনন্ত এবার রূপকথার সামনে গিয়ে ওর হাতটা ধরে একটু ঝাঁকালো , আর তন্দ্রাটা কেটে সঙ্গে সঙ্গে ও চমকে উঠলো |
অনন্ত এসেছে ওর সামনে | দু বছরের তৈরী কাঁচের দেয়াল ভেঙে | রূপকথা এই মুহূর্তে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না | তখন অনন্তই বলে উঠলো ,
———- ” তুই এতক্ষন ধরে এখানে বসে আছিস ! বাড়ি যাসনি কেন ?”
রূপকথা এর কি উত্তর দেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না | তাই নিরুত্তরই থেকে গেলো | অনন্ত খেয়াল করলো রূপকথার মুখটা কেমন অন্ধকার হয়ে এসেছে | চোখ দুটো ভিজে গেছে জলে | এই দৃশ্য দেখে এখন হঠাৎ সকালের কথাটা মনে পরে গেলো ওর | একটু কি বেশিই রুড ছিল তখন ! কথাটা ভাবতেই অনন্ত এবার কিছুটা নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো , ——–
” খেয়েছিস কিছু ? ওঠ ওঠ , খেতে চল আমার সাথে |”
কথাটা শেষ করেই অনন্ত এবার রূপকথার হাতটা ধরে টানলো , ওকে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে যাওয়ার জন্য | কিন্তু রূপকথা এবারও সোফা থেকে উঠলো না | তবে ঘরের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠলো হঠাৎ ,
” তোমাকে চ্যারিটি কেস ভেবে দেখতে আসিনি আমি | শুধু দেখবো বলে দেখতে এসেছি | তবে তুমি যদি না চাও , আমি তোমাকে আর কখনো ডিস্টার্ব করবো না | আমার নিজের লোকই আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় না | মামা মামী তো এখন চিনেও চেনে না | সেরকম তুমিও !”
না , কথাটা আর শেষ করতে পারলো না রূপকথা | অনন্ত এবার বেশ দৃঢ় গলায় ওকে থামিয়ে দিলো | ওর গলার আওয়াজটা আবার ভীষণ কঠিন হয়ে গেছে এই মুহূর্তে | বেশ রেগেই তাই বললো,———- ” শাট আপ .. তোর এতদিন বাদে এটা মনে হলো যে তোর মামা মামী আর আমি একই ? যদি তোর সাথে যোগাযোগ না রাখতে চাইতাম তাহলে তোকে পাগলের মতন খুঁজতাম না এতদিন ! তবে ভুলটা প্রথম থেকে আমারই ছিল | সব সময় মনে হয় একটু বেশিই ভালো থেকেছি তোর সাথে | তাই এতো সাহস বেড়েছিল , যে কিছু না বলে ভ্যানিশ হয়ে গেলি | তবে আর না | এই দু বছরে আমি অনেক চেঞ্জ হয়ে গিয়েছি | এবার যদি তুই আমাকে না জিজ্ঞেস করে এই বাড়ি থেকে বাইরে পা রাখার কথাও ভেবেছিস , তাহলে দেখে নিবি , আমি কতটা খারাপ হতে পারি | এবার চল খেতে | অনেক রাত হয়েছে | আর এটা আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি না | বলছি |”
কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে শেষ করেই অনন্ত রূপকথার হাত ধরে টানলো এবার , বেশ জোরে | না , রূপকথা এখন না উঠে থাকতে পারলো না আর | তবে খুব অদ্ভুত লাগছিলো হঠাৎ | আজও যে অনন্তর মনে এতটা অধিকারবোধ কাজ করে ওর জন্য এটা জেনে ! আর রূপকথা সেটা অস্বীকারও করতে পারলো না এখন | তবে হঠাৎ মনে হচ্ছিলো সারাদিনের অপেক্ষার পর পুরোনো অনন্তকে আবার ফিরে পেয়েছে নিজের কাছে | একদম বিনা নোটিশে |
<৮>
সেই রাতে রূপকথা অনন্তদের বাড়িতেই থেকে গেছিলো | আসলে ওর আর কখনোই মামা মামীর বাড়িতে ফিরে যাওয়া হবে না | সন্ধ্যেবেলা মামী নিজে দায়িত্ব নিয়ে অনন্তর মা কে ফোন করে রূপকথাকে নিজের কাছে রেখে দিতে বলেছে | এমন কি ওরা রূপকথার থাকার ঘরটাও এই দু বছরে ভাড়া দিয়ে দিয়েছে , যাতে ও আর কখনোই ওই বাড়ি ফিরতে না পারে | অনন্ত রাতে ডিনারের পর কথাগুলো জানতে পেরেছিলো | রূপকথা সেই সময় খেয়াল করেছিল অনন্তর মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে | সত্যি , অবাক লাগছিলো রূপকথার আজ | প্রত্যেকটা মুহূর্তে | যতবার অনন্তকে দেখছিলো মনে হচ্ছিলো এতদিন বাদেও এই ছেলেটা ওকে নিয়ে এতটা ভাবে ! এতটা চিন্তা করে ! হিসাবের বাইরে লাগছিলো সব কিছু | আসলে ও তো ভেবেছিলো এই দু বছরে অনন্তর জীবনের মতন মন থেকেও ওর অস্তিত্ব মুছে যাবে পুরোপুরি | কিন্তু আজ বুঝলো , রূপকথা নিজের জায়গা হারায়নি কখনো | তবে আজ রাতে শুয়ে শুয়ে এটাও মনে হচ্ছিলো আর দু বছর আগের মতন না বলে চলে যাওয়া যাবে না এরপর | আর সেটা ঠিক ও হবে না | যে মানুষটা ওকে নিয়ে এতটা ভাবে , সে শুধু ভালোবাসতে পারেনি বলে সব যোগাযোগ শেষ করে দেয়া কোনো ঠিক কাজ নয় | তবে এই মুহূর্তে হঠাৎ মিথিলার কথাগুলোও মনে পরে গেলো রূপকথার | ও অনন্তর সাথে যোগাযোগ রাখলে মিথিলা রেগে যাবে না তো ! ওদের দুজনের রিলেশনে যেন কোনো প্রব্লেম না হয় ওর জন্য ! অনন্ত যে মিথিলারই , এটা রূপকথা অনেকদিন আগেই বুঝে গেছে | আর এতসব জেনে বুঝে রূপকথা কোনোদিনই নিজের ফিলিংসের কথা জানতে দেবে না অনন্তকে | মিথিলা এই ব্যাপারে একদম নিশ্চিন্তই থাকতে পারে | কথাগুলো এইবার ওদের দেখা হলে ও মিথিলাকে বোঝাবে |
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সেইদিন রূপকথার চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছিলো আস্তে আস্তে | ক্লান্ত শরীরটা স্বপ্নের দেশে চলে গেছিলো তারপর | ঘুম ভাঙলো অনন্তর গলার আওয়াজ শুনে | ঘড়িতে তখন সাড়ে আটটা | রূপকথা অনন্তকে কফি হাতে সামনে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়ে খাটে উঠে বসলো | তারপর একটু ইতঃস্তত করে বললো ,
” তুমি আবার কফি নিয়ে কেন আসতে গেলে ? আমার শরীরটা ক্লান্ত ছিল বলে মনে হয় এতক্ষন ধরে ঘুমোচ্ছিলাম | নইলে সাতটায়ই উঠে পরি |”
অনন্ত এবার একটু হেসে উত্তর দিলো ,
” হ্যাঁ. ঠিক আছে | একদিন এইটুকু দেরীতে উঠেছিস বলে এতো এক্সপ্লিনেশন দেয়ার কিছু হয়নি | আর কফি নিয়ে এসেছি তো কি হয়েছে ? আমি চলতে পারি না বলে কি এইটুকু কাজও করতে পারবো না !”
অনন্তর এই শেষ কথাটা শুনে রূপকথার মুখটা এবার হঠাৎ থমকে গেলো | চোখ চলে গেলো অনন্তর নিথর দুটো পায়ের দিকে | আর মুখে অন্ধকার এসে ভিড় করলো |
অনন্ত ব্যাপারটা বুঝে পরিস্থিতিটাকে হালকা করার জন্য আবার বলে উঠলো ,
” আরে মজা করছিলাম আমি | এতে এতো সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই | নে, এবার কফিটা খা , নইলে ঠান্ডা হয়ে যাবে |”
কথাটা শোনার পর থেকে রূপকথার ভেতরটা এখন খাঁ খাঁ করলেও মুখের অন্ধকার সরিয়ে অল্প হেসে বললো ,
” বুঝলাম | আমি কিন্তু জানি তুমি খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে | ফিজিওথেরাপিটা এবার রেগুলারলি করতে হবে কিন্তু | নইলে ছাড়ছি না | আর মিথিলাকেও দলে নিয়ে নেবো আমার | দু জনে মিলে জমিয়ে শাসন করবো তোমাকে | ঠিক না হয়ে যাবে কোথায় দেখি!”
কিন্তু কথাগুলো শুনে অনন্তর মুখটা এবার গম্ভীর হয়ে গেলো | একটু সময় নিয়ে থেমে থেমে বললো,
” মিথিলার সাথে আমার আর কোনো রিলেশন নেই | ছ মাস আগে এক্সিডেন্টের পরই ব্রেক আপ হয়ে গেছে | আসলে ওর বাবা মা চায়নি কোনো ইনভ্যালিড ছেলের সাথে ওর সম্পর্ক থাকুক | হ্যাঁ, ও চাইলে হয়তো জোর করে থাকতো পারতো ! কিন্তু কি দরকার এতো ঝামেলায় গিয়ে | তার থেকে আমাদের মধ্যে যা কিছু ছিল সেটাকে ভুলে যাওয়া অনেক সহজ | ”
কথাটা শেষ করে অনন্ত এবার একটু জোর করে হাসলো , আর খেয়াল করলো সকালের নরম আলো জানলা দিয়ে এসে লাগছে রূপকথার মুখে | তাতে কি ওর মুখটা আরো করুণ মনে হচ্ছে ! ওর চোখ দুটো কি এখন চিকচিক করছে জলে ! তাহলে কি অনন্তর কষ্টে কারোর চোখে জল আসে ! প্রশ্নগুলো একসঙ্গে মনে এসেই মিলিয়ে গেলো ওর | আর তার মাঝেই রূপকথা ঘরের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে আস্তে গলায় আনমনে বলে উঠলো,
” আমার থাকা উচিত ছিল | ওই সময়টায় আমার তোমার সঙ্গে থাকাটা উচিত ছিল |”
অনন্ত ওর কথাটা শুনে এবার নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে অনেকদিনের জমানো প্রশ্নটা করে ফেললো রূপকথাকে | ওর চোখের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো , ———-
” তাহলে চলে গেছিলিস কেন ? কি হয়েছিল যার জন্য দু বছর তোকে এতো দূরে থাকতে হলো ?”
প্রশ্নটা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য রূপকথা নির্বাক হয়ে গিয়েছিলো | কিন্তু আজ অনন্তর সামনে কিছুতেই মিথ্যে বলতে পারবে না ও | আবার সত্যিটাও বলার নেই | তাহলে কি উত্তর দেবে ! এইসব ভাবতে ভাবতেই অনন্তর মার্ আওয়াজ কানে এলো হঠাৎ | রান্নাঘর থেকে রূপকথাকেই ডাকছে এখন | ব্যাস, আর অপেক্ষা না করে রূপকথা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো | তারপর অনন্তর সামনে কথা ঘুরিয়ে বললো , ——- ” কাকিমা ডাকছে | মনে হয় কোনো দরকার আছে | যাই দেখে আসি |” …
কথাটা শেষ করেই ও আর অনন্তর প্রত্তুত্যরের অপেক্ষা না করেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো | তবে অনন্তর এই মুহূর্তে বুঝতে বাকি রইলো না রূপকথা নিজেকে অদ্ভুতভাবে আড়াল করার চেষ্টা করছে ওর সামনে | তার মানে কি ওর জীবনে এমন কোনো কথা আছে যা অনন্তকেও বলা যায় না ! এমন কি ঘটনা আছে যেটা অনন্তকেও শেয়ার করা যায় না ! আগে তো দিন থেকে রাত , প্রত্যেকটা মিনিট সেকেন্ডের হিসেবে দিতো রূপকথা ওকে | তাহলে আজ কি হলো ! ওদের মাঝে এতো দূরত্ব কোথা থেকে চলে এলো ! না কি এই দূরত্বটা দু বছর আগেই তৈরী হয়েছিল , অনন্ত আজ খেয়াল করলো ! প্রশ্নগুলো একসঙ্গে এসে জড়ো হয়েছিল সেইদিন ওর মনে | কিন্তু কিছুতেই কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলো না যেন | তবে এই প্রশ্নগুলোর সাথে একটা অদ্ভুত কষ্ট এসেও জমা হয়েছিল ভেতরে | কারোর দূরে চলে যাওয়ার কষ্ট | কিন্তু কি অদ্ভুত ! এরকম কষ্ট তো মিথিলার সাথে ব্রেক আপের দিনও হয়নি ওর ! আজকের এই কষ্ট, এই খারাপ লাগাটা যেন একেবারে আলাদা , একদম নতুন অনন্তর কাছে |
চলবে।