হৃদয় দহন পর্ব-০৭

0
362

#হৃদয়_দহন
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:০৭
🍁🍁
বাড়িতে এসে বিছানায় শুয়ে কান্না করছে ঐশানি এ কান্না থামার নয়। কি করবে সে ভেবে পাচ্ছে না কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,

– কেন আমার সঙ্গে এমনটা হলো কেন কি করবো আমি?

সাদিক বাড়িতে এসে ঐশানির ঘরের দরজা আটকানো দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেছে। দরজা ধাক্কা দিয়ে,

– পরী দরজাটা খোল আমি মানছি আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি এই জন্য আমাকে শাস্তি দে কিন্তু এইভাবে রাগ করে থাকিস না।

কোনো সাড়া শব্দ নেই,ঐশানি সব শুনেও চুপ করে আছে। সাদিক অনেকক্ষণ ডেকেও কোনো লাভ পেলো না নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে,বাড়ির বাকি সদস্যরা ইতোমধ্যে চলে এসেছে। শিহাব রুম্পার এমন কর্মকাণ্ড এখনো মেনে নিতে পারছে না তার মনে বারবার একটা কথাই ঘুরছে,

– কিভাবে পারলো রুম্পা আমাকে ঠকাতে?

সাদিক নিজের ঘরে চলে গেছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। ঐশানি কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি উঠে গেছে আবারো নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, রক্ত পরা থামছে না শরীরটাও দুর্বল হয়ে গেছে গতকাল রাত থেকে পেটে কিছু পড়েনি। সারাক্ষণ সাদিককে নিয়ে ভেবেছে তাই খাওয়ার ইচ্ছে মরে গেছিল, শরীর চলছে না বিছানা থেকে দাঁড়াতেই মাথাটা ঘুরিয়ে উঠলো চারিদিকে অন্ধকার দেখছে একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল ঐশানি।

বাড়ির সকলে অনেকবার ঐশানিকে ডেকে গেছে কিন্তু কেউ কোনো সাড়া শব্দ পায়নি। সবাই একা ছেড়ে দিয়েছে ভেবে নিয়েছে অভিমান কমলে ঠিক দরজা খুলে দিবে। আজকের রাতটা পার হয়ে গেল পুরো রাত সাদিকের চোখে ঘুম ছিল না নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল।

ভোরের আলো ফুটতেই আবারো ঐশানির ঘরের সামনে গেল সাদিক কিন্তু দরজা আগের মতোই বন্ধ। এবার একটু চিন্তা হচ্ছে তার দরজা ধাক্কা দিলো পূর্বের মতোই কোনো সাড়া শব্দ নেই। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো বাড়ির সবাই উঠে গেছে। সাদিকের চিন্তা বেড়ে গেছে বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে কিছুক্ষণ ভেবে সে সিদ্ধান্ত নিলো দরজা ভেঙে ফেলবে। যেই ভাবা সেই কাজ সাদিক দরজা ভাঙ্গার জন্য এগিয়ে গেল শিহাবও তাকে সাহায্য করলো।

দরজা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করতেই সাদিক ভয় পেয়ে গেছে। মেঝেতে ঐশানির নিথর দেহ পড়ে আছে, বিছানায় কিছুটা রক্ত লেগে আছে ঐশানির নাক মুখেও রক্ত শুকিয়ে আছে। সাদিক দৌড়ে গিয়ে ঐশানিকে অনেকক্ষণ ডাকলো কিন্তু সে উঠলো না শিহাব দ্রুত এম্বুলেন্সকে খবর দিলো কিছুক্ষণ পর এম্বুলেন্স চলে আসলো ঐশানিকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া হলো।
___________________
কেবিনের বাইরে কেউ বসে আছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সাদিক কেবিনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে কথা বলতে ভুলে গেছে। কিছুক্ষণ পর একজন ডাক্তার বের হলেন গম্ভীর মুখে, সাদিক উনার কাছে গিয়ে,

– আমার পরী কেমন আছে? জ্ঞান ফিরেছে? আমি দেখা করতে পারবো?

ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বলতে শুরু করলো,

– পেশেন্টের অবস্থা খুব খারাপ উনি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে আপনারা উনার অভিভাবক হয়েও কিভাবে এতোটা কেয়ারলেস ছিলেন কেন সঠিক সময়ে চিকিৎসা করাননি?

ডাক্তারের কথায় সবাই হা করে তাকিয়ে আছে ওয়াহিদ আহসান বললেন,
– ব্লাড ক্যান্সার! কিন্তু ঐশি তো আমাদের কিছু বললো না।

সাদিক বিচলিত কন্ঠে,
– প্লিজ ডাক্তার আপনি ওকে সুস্থ করে দিন যত টাকা লাগে আমরা দিবো।

– দেখুন সুস্থ করার মালিক সৃষ্টিকর্তা, সৃষ্টিকর্তাকে ডাকুন। ব্লাড ক্যান্সার মানেই মরনব্যাধী নয় সঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে হয়তো আজ উনার এমন অবস্থা হতো না কিন্তু উনাকে হাসপাতালে আনতে দেরি হয়ে গেছে উনি লাস্ট স্টেজে আছেন তবে আমরা একটা চেষ্টা করতে চাই অপারেশন থিয়েটার রেডি শরীরের রক্ত বদলাতে হবে।কিছু ফর্ম পূরণ করে আপনারা রক্তের ব্যবস্থা করুন তারপর আমরা আমাদের কাজ শুরু করবো।

ওয়াহিদ আহসান বললেন,
– যা করার দ্রুত করুন আমি ফর্ম পূরণ করছি শিহাব তুই রক্তের ব্যবস্থা কর।

বলেই কাউন্টারে চলে গেলেন,শিহাবও বের হয়ে গেল। সাদিক ডাক্তারকে অনুরোধ করে,

– একবার ওর সঙ্গে আমায় দেখা করতে দিন না তারপর না হয় অপারেশন থিয়েটারে নিবেন।

প্রথমে ডাক্তার রাজি না হলেও সবার অনুরোধে এবার রাজি হয়ে সাদিককে ঐশানির কাছে যেতে দিলেন।

মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো হাতে স্যালাইন সাদা বিছানায় শুয়ে আছে চোখ জোড়া বন্ধ পরনে হাসপাতালের নির্ধারিত রোগীদের পোশাক।চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, মুখটা শুকনো। ঐশানির এমন রূপ দেখে সাদিকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো ধীর পায়ে গিয়ে ঐশানির পাশে বসে ওর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে,

– পরী কথা বলবি না আমার সাথে? তোর এমন অবস্থা যে আমার ভালো লাগছে না খুব অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।

পিটপিট করে তাকালো ঐশানি, তাকে তাকাতে দেখে সাদিকের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাঁসি ফুটে উঠেছে। ঐশানির হাত নিজের গালের সাথে লাগিয়ে,

– তোর জ্ঞান ফিরেছে পরী এখন কেমন লাগছে?

– ভালো।

– এতো বড় একটা অসুখ তুই আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে গেলি কেন?

ঐশানি একবারও সাদিকের দিকে তাকায়নি অভিমানে এখনো অন্য দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে জবাব দিলো,

– তুমি খুশি হওনি আমার এমন মরনব্যাধী রোগ শুনে?

যন্ত্রনাদায়ক কন্ঠে সাদিক বললো,
– তুই এখনো আমার উপর রেগে আছিস? বললাম তো যা শাস্তি দিবি মাথা পেতে নিবো কিন্তু আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা একদম মনে আনবি না।

– আমি জানি আমার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে তাই মনে না আনলেও যেতেই হবে।

– তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।

– কারো জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না হয়তো তোমার আর আমার মিলন নিয়তির খাতায় লেখা ছিল না তবে চিন্তা করো না অনেক ভালো কাউকে হয়তো নিজের জীবনে পাবে আর তখন আমার কথা মনে থাকবে না।

সাদিকের চোখে নোনা পানি চলে এসেছে, কতোটা কষ্ট হলে একটা পুরুষ কাঁদে সাদিককে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ঐশানির হাতটা আরো শক্ত করে ধরে,

– কেন এসব বলছিস তোর কিছু হবে না ডাক্তার বলেছে একটা অপারেশন করবে। দেখিস তুই সুস্থ হয়ে যাবি আর তারপর তোকে কোথাও যেতে দিবো না।

– বাচ্চাদের মতো করো না, আমি চাই না তুমি আমার জন্য কষ্ট পাও আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাও হাসি খুশি থাকো।

সাদিক আর কিছু বলতে পারলো না ভেতরে ডাক্তার আর নার্স প্রবেশ করে তাড়া দিয়ে,
– পেশেন্টকে এবার অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে হবে।

সাদিক কিছু বললো না ভালোবাসার মানুষটির কপালে একটা চুম্বন করে বাইরে চলে গেল। ঐশানির অনেক কষ্টে হচ্ছে কিন্তু বাইরে থেকে নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছে। ঐশানিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বাইরে সবাই গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে বসে আছে সাদিক পাশের মসজিদে নফল নামাজ আদায় করতে চলে গেল তার বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তার কাছে চাইলে সবকিছু পাওয়া যায় তাই তো সে নামাজে প্রিয় মানুষটিকে চাওয়ার জন্য গেল।

একঘন্টা পর ডাক্তার ভেতর থেকে বের হলেন সবাই হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে,
– ঐশি কেমন আছে? ও ঠিক হয়ে গেছে তো?

– আমরা যথাযথ চেষ্টা করেছি শরীরের রক্ত চেঞ্জ করে দিয়েছি এবার আল্লাহ ভরসা।

সাদিক চলে এসেছে ডাক্তারের সব কথাই সে শুনেছে, কিন্তু কিছু বললো না থম মেরে বসে আছে। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত ডাক্তার কাউকে রোগীর সঙ্গে দেখা করতে দিবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
________________
ছুটি শেষ হওয়ার পরেও অফিসে না যাওয়ায় ঐশানির খবর নেওয়ার জন্য নিজের পি.এ কে জানালো রোদ্রিক। পি.এ ঐশানির খবর দিতেই ভেঙ্গে পড়ে রোদ্রিক,দেরি না করেই সোজা হাসপাতালে চলে আসে। কাউন্টারে সবকিছু জেনে তার অস্থিরতা বেড়ে গেছে। রোদ্রিক ঐশানির সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল কিন্তু ডাক্তারের এক কথা এখন দেখা করতে দিবে না।রোদ্রিকের দিকে সাদিকের কোনো খেয়াল নেই সে এক ধ্যানে ঐশানির কথা ভেবে যাচ্ছে।

আরো এক ঘন্টা কেটে গেল কিন্তু ঐশানির জ্ঞান এখনও ফিরেনি। সাদিক আর অপেক্ষা করতে পারছে না বারবার নিজের প্রেয়শিকে দেখার তিব্র ইচ্ছে হচ্ছে, এবার সে ডাক্তারের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই জোরপূর্বক ভেতরে চলে গেল।

ঐশানির হাত দুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে,
– চোখ খোল না পরী, তোর কিচ্ছু হবে না দেখ সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।

ঐশানি এখনো অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে, সাদিক ঐশানিকে ঝাঁকিয়ে,

– আমার কথা কি তোর কানে যাচ্ছে না কেন এইভাবে শুয়ে আছিস বুঝতে পারছিস না আমার কষ্ট হচ্ছে?

ডাক্তাররা অনেক চেষ্টার পরেও সাদিককে ঐশানির কাছ থেকে সরাতে না পেরে তার পরিবারকে অনুরোধ করলো যাতে তারা অন্তত বুঝিয়ে নিয়ে যেতে পারে কিন্তু তাতেও কাজ হলো না সাদিক এক নাগাড়ে নিজের মতো ঐশানির সাথে কথা বলে যাচ্ছে। আজ সবাই শুধু সাদিককে অবাক নয়নে দেখছে তারা কেউ এই সাদিককে চেনে না ঐশানির প্রতি এতোটা ভালোবাসা যা রোদ্রিকের চোখও এড়ায়নি।

ঐশানির জ্ঞান ফিরেছে চোখ খুলতেই সাদিকের এমন বিভৎস মুখশ্রী দেখে তারও খারাপ লাগছে। নিজের হাত দিয়ে সাদিকের চোখের পানি মুছে দিতেই সাদিক ভালো করে ঐশানির দিকে তাকালো। সাদিকের ঠোঁটে হাঁসি ফুটে উঠেছে, ঐশানির গাল দুটো আলতো করে ধরে,

চলবে…….