হৃদয় দহন পর্ব-০৮

0
334

#হৃদয়_দহন
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:০৮
🍁🍁
‘আমি জানতাম আমার ডাক শুনে তুই কখনো চুপ থাকতে পারবি না।’

ঐশানি অস্ফুট স্বরে,
– এ্যা সাদ ভাইয়া তুমি বাচ্চাদের মতো কেঁদে চোখ মুখের কি অবস্থা করেছ?

সাদিক হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে ঐশানির মুখে চুমু খেয়ে,
– কাঁদবো না? তুই এইভাবে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলি কতবার ডাকলাম কতো কষ্ট হচ্ছিল জানিস?

– খুব ভালোবাসো আমায়?

– হুম নিজের থেকেও বেশি।

– আফসোস এই ভালোবাসা হয়তো বেশিদিন আমার কপালে নেই।

– আবারো এসব বলছিস।

– সত্যিটা তো বলতেই হবে।

– আমি চাই না আর কোনো সত্যি শুনতে চাই না ভবিষ্যৎ জানতে শুধু চাই বর্তমানটা তোকে নিয়ে ভাবতে তোকে নিয়ে সুন্দর একটা সংসার বানাতে এবং সব স্বপ্ন পূরণ করতে।

ঐশানির চোখে পানি ঝলমল করছে, কান্নাজড়িত কণ্ঠে,
– সাদ ভাইয়া!

ইতোমধ্যে ভেতরে বাড়ির সবাই প্রবেশ করেছে সাদিক ঐশানির থেকে কিছুটা দূরে সরে গেল। একে একে সবাই ঐশানির সঙ্গে কথা বলে বাইরে চলে গেল। এবার রোদ্রিক ভেতরে প্রবেশ করলো, রোদ্রিককে দেখে সাদিকের বিরক্ত লাগা শুরু করেছে ঐশানি সাদিকের দিকে তাকিয়ে,

– সাদ ভাইয়া আমার রোদ্রিকের সাথে একটু কথা আছে।

– তো বল।

– তুমি যদি

– ওহ বাইরে যেতে হবে তো সরাসরি বললেই হয়।

বাইরে চলে গেল সাদিক। ঐশানি মুচকি হেসে রোদ্রিকের দিকে দৃষ্টি রেখে,
– একটুতেই রেগে যাওয়া সাদ ভাইয়ার ছোট বেলার স্বভাব।

রোদ্রিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ঐশানি ব্রু নাচিয়ে,
– কি ব্যাপার এইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন।

রোদ্রিক ঐশানির সোজাসুজি একটা চেয়ারে বসে,
– এখন শরীর কেমন আছে?

– আলহামদুলিল্লাহ।

– তোমার অসুস্থতার খবর জানতে পেরে ছুটে এসেছিলাম কিন্তু একটা ঘটনা দেখে খুব বিষ্মিত হলাম এখন খুব লজ্জা হচ্ছে কথা বলতে।

ঐশানি গম্ভীর মুখে,
– কি ঘটনা?

– সাদিকের কান্ড দেখে।

– ও আবার কি করেছে? খারাপ ব্যবহার করেছে আপনার সাথে?

– আরে না আমি বলতে চাচ্ছি সাদিক সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসে ডাক্তার যখন তোমার সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দিতে চাচ্ছিল না কতোটা পাগলামি করেছে ছেলেটা অনেক কেঁদেছে আর আমি কিনা কিছু দিনের অনুভূতি ভালো লাগা নিয়ে তোমার কাছে এসেছিলাম।

– আমি জানতাম সাদিক ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে কিন্তু এতোটা ভালোবাসে জানতাম না মাঝখানে অনেক ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল যার কারণে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু এখন সব ঠিক হয়ে গেছে জানতে পেরেছি কেন সে এমন করেছে।

– সরি।

– সরি কেন?

– তোমাকে বিরক্ত করলাম কিছু না জেনেই তোমার কাছে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করলাম।

– সরি আমাকে নয় মায়াকে বলা উচিত।

– মায়াকে…সরি! কেন বলবো?

ঐশানি ঠোঁটে হাসি প্রশস্ত করে,
– নিজের খুব কাছের একজন মানুষ আপনাকে মন প্রাণ দিয়ে চায় সেটাই জানেন না?

– মানে?

– মানেটা হচ্ছে মায়া আপনাকে ভালোবাসে কিন্তু আপনাকে মনের কথা বলার আগেই আপনি তাকে আমার কথা বলেছেন তাই মনের কথা মনেই রেখে দিয়েছে।

– কি বলছো!

– একটা কথা তো নিশ্চই জানেন বেস্ট ফ্রেন্ড এর মধ্যে সবকিছু শেয়ার করা হয় মায়াও আমাকে অনেক আগেই বলেছিল।

– তাহলে কেন আমাকে সাহায্য করলো সে আগেই বলতে পারতো তোমার আর সাদিকের কথা।

– জানলে তো বলবে, সাদ ভাইয়া আর আমার সম্পর্কের কথা কেউ জানতো না আমি কাউকে বলিনি তাই মায়া বলতে পারেনি, আর সেদিন আপনাকে আমিও সবটা জানাতে পারিনি কারণ সাদ ভাইয়া চলে এসেছিল।

রোদ্রিক হেসে,
– ধন্যবাদ সবটা জানানোর জন্য, তোমার আর সাদিকের ভালোবাসা পূর্ণতা পাক খুব শিঘ্রই বিয়ের দাওয়াত চাই।

ঐশানি মুচকি হাসলো, রোদ্রিক ঐশানির থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। রোদ্রিক যেতেই সাদিক ভেতরে এসে,

– এতক্ষণ ধরে কি কথা বললি দু’জনে?

– তোমাকে বলবো কেন?

– আমাকেই বলতে হবে।

– তুমিও তো রাইশার সঙ্গে..

আর কিছু বলতে পারলো না সাদিক ঐশানির ঠোঁটে আঙুল দিয়ে,
– বলেছি না এই নিয়ে কিছু শুনতে চাই না কেন এসব করেছি সবটাই জানিস তারপরেও অনেকবার মাফ চেয়েছি।

– হু।

– ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি আজ তোকে বাড়িতে নিয়ে যাবো।

– ডাক্তার রাজি হয়েছে?

– প্রথমে রাজি হয়নি কিন্তু পরে ঠিক মত পাল্টেছে।
________________
হাসপাতালের পার্ট চুকিয়ে ঐশানিকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। সাবিনা আহসান এবং রাহেলা রান্না ঘরে ব্যস্ত আজ তারা ঐশানির পছন্দের খাবার রান্না করছে। সাদিক বাড়িতে এসেও ঐশানির পাশে বসে আছে। ঐশানি বিরক্ত হয়ে,

– উফ সাদ ভাইয়া তোমার কি কোনো কাজ নেই ক্লান্তি নেই কখন থেকে আমার পাশে বসে আছো?

– কেন বিরক্ত লাগছে?

– হুম।

– আমার তো ভালোই লাগছে।

– গতকাল রাত থেকে তো ঘুমাওনি যাও এবার গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও।

– তোকে বিয়ে না করা পর্যন্ত বিশ্রাম নিচ্ছি না দরকার হলে এইখানে এইভাবেই বসে থাকব তোর বিরক্ত লাগলেও কিছু করার নেই।

– বিয়ের ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল সবকিছু জেনে নিজের জীবনের কিছু পাতা নষ্ট করার দরকার নেই।

– বললাম তো তোর কিছু হবে না।

– ডাক্তার বলেছে শুনোনি? ব্লাড ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে আছি বা*চাঁ*র সম্ভবনা নেই।

– একদম এসব কথা বলবি না কতবার বলতে হবে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে চাই না বর্তমানটা তোর সাথে উপভোগ করতে চাই।

– এতোটা ভালোবাসো আমায়?

সাদিক প্রশ্নের বিপরীতে মুচকি হাসলো। রাহেলা দরজায় টোকা দিয়ে,

– ঐশি মা সাদ বাবা তোমাগো ভাবী নিচে ডাকতাছে।

সাদিক হাঁক ছেড়ে,
– তুমি যাও আন্টি আমরা আসছি।

রাহেলা নিচে চলে যেতেই সাদিকও ঐশানিকে নিয়ে নিচে গেল। রাতের খাবার খাওয়ার জন্য সকলে খাবার টেবিলে উপস্থিত হয়ে সাদিক আর ঐশানির জন্য অপেক্ষা করছিল। সাদিক আর ঐশানি পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসতেই সাবিনা আহসান এবং রাহেলা মিলে পরিবেশন শুরু করলো। ওয়াহিদ আহসান ঐশানির দিকে হাস্যোজ্জল মুখে তাকিয়ে,

– এখন কেমন লাগছে মা? অসুস্থতা কি কমেছে?

ঐশানি হেসে জবাব দিলো,
– হুম আঙ্কেল।

সবাই নিজেদের মতো খাবার খাচ্ছে কিন্তু সাদিকের ভেতরে কিছু চলছে যার জন্য সে ঠিক মতো খেতে পারছে না। ঐশানি কনুই দিয়ে সাদিককে গুঁতো দিয়ে,
– সামনে খাবার রেখে কার কথা ভাবছো?

সাদিক ঐশানির কথায় কোনো পাত্তা না দিয়ে বাবার দিকে দৃষ্টি দিয়ে গম্ভীর মুখে,
– বাবা একটা কথা ছিল।

ওয়াহিদ আহসান মুখের খাবার শেষ করে,
– বল

– আমি ঐশানিকে বিয়ে করতে চাই কালকের মধ্যেই।

সবাই খাওয়া বন্ধ করে সাদিকের দিকে তাকিয়ে আছে। ঐশানিও হা করে তাকিয়ে আছে সে জানতো সাদিক তাকে বিয়ে করবে কিন্তু সবার সামনে এইভাবে বলে এবং কালকের মধ্যেই এটা ভাবতে পারেনি। সাবিনা আহসান বললেন,

– বিয়েতে কতো কাজ জানিস? কালকের মধ্যে কি করে?

– কোনো কাজ নেই কাজী এনে সহীহ ভাবে বিয়ে দিয়ে দিবে।

ওয়াহিদ আহসান হালকা কেশে,
– তোমাদের বিয়ে নিয়ে আমাদের কতো আশা আছে আর তুমি এভাবে বিয়ে করতে চাও?

– ঐশানি অসুস্থ জানো তো এসব হট্টগোল ওর জন্য ঠিক হবে না আর আমিও দেরি করতে চাই না তোমাদের বলে দিলাম কাল আমাদের বিয়ে দিতে হবে, তোমরা যদি না দাও তাহলে আমরা গিয়ে নিজেরাই করে আসবো।

সাদিক নিজের কথা শেষ করে ঘরে চলে গেল বাকিদের কোনো কথা শুনতে নারাজ সে। ঐশানির গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে গেছে সেও কোনমতে খেয়ে সবাইকে এড়িয়ে চলে গেল।
_______________
রাতের আঁধারে রকিং চেয়ারে বসে আছে রোদ্রিক, এক হাতে ধোঁয়া ওঠা গরম কফির মগ আরেক হাতে একটা ফাইল। কফিতে চুমুক দিয়ে ফাইলটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে,

– এই ফাইলটায় তোমায় সাইন করিয়েছিলাম যাতে তুমি আমার অনিচ্ছায় চাকরিটা ছাড়তে না পারো, দুই বছরের চাকরির কন্ট্রাক্ট ছিল কিন্তু তোমার আর সাদিকের ভালোবাসা দেখে এই কাগজ গুলো বৃথা মনে হচ্ছে তবে তোমরা ভালো থাকো।

রোদ্রিক কাগজগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিলো হঠাৎ দরজায় নক পড়তেই গম্ভীর কণ্ঠে,
-কে?

– আমি মায়া।

রোদ্রিক আগুনটা নিভিয়ে দরজাটা খুলে দিলো।মায়া ভেতরে প্রবেশ করে বিছানায় বসে পড়লো রোদ্রিক জিজ্ঞেস করল,
– কি রে এই রাতে তুই কখন এলি?

– সন্ধ্যায় এসেছি কিন্তু তুমি তো বাড়িতে এসেই ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলে তাই বিরক্ত করিনি।

– ওহ।

– তোমার আর ঐশানির প্রেম কেমন চলছে?

– প্রেম করার আগেই ছ্যাকা খেয়ে গেলাম।

– কিভাবে!

– তুই বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েও ঐশানির সম্পর্কে কিছু জানিস না।

– কেন কি হয়েছে?

– ঐশানি আর সাদিক দু’জন দু’জনকে অনেক ভালোবাসে আগে যদি জানতাম তাহলে কখনো ওদিকে পা বাড়াতাম না।

– আমাকে তো আগে কিছু বলেনি আমি জানলে তোমাকে বলতাম।

– তুইও তো অনেক কিছুই জানাসনি সারাক্ষণ সামনে থেকেও মনের কথা একবারও বললি না?

মায়ার মুখের হাঁসি মিলিয়ে গেছে ভয়ার্ত কন্ঠে,
– কি বলিনি?

– এই যে তুই আমাকে ভালোবাসিস! ঐশানি না বললে জানতেই পারতাম না।

মায়ার চোখের কোণে পানি চলে এসেছে, নিচের দিকে তাকিয়ে,
– বলার আগেই তো তুমি ঐশানির প্রতি তোমার অনুভূতি বলে দিয়েছিলে তারপরও কি নিজের মনের কথা বলা সম্ভব।

– সব দোষ আমার তবে বিয়ে করবি আমায়?

মায়া রোদ্রিকের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে রোদ্রিক হেসে,
– রাজি হয়ে যা সুযোগ কিন্তু সবসময় আসে না এছাড়া আমি কিন্তু তোর অভিমান ভাঙ্গতে পারবো না আগেই বলে দিলাম।

মায়া রোদ্রিকের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো,রোদ্রিক আলতো করে মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

ঐশানি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন কিন্তু তার এই ঘুমটা হুট করেই ভেঙে গেছে কারো গরম নিঃশ্বাসে। কারো গরম নিঃশ্বাস তার গলায় পড়ছে, কেউ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে ঐশানি চোখ জোড়া খুলে পাশে তাকাতেই চমকে গেল ডিম লাইটের আবছা আলোয় সাদিকের মুখটা বুঝা যাচ্ছে। ঐশানি হুড়মুড় করে উঠে যেতেই সাদিকও উঠে বসে,

– কি রে ঘুম ভেঙ্গে গেল?

– এতো রাতে আমার ঘরে কি করছো?

– তোকে দেখতে ইচ্ছে হয়েছে তাই চলে আসলাম।

– যদি কেউ দেখে ফেলে?

– দেখলে দেখুক আমার কি।

– তোমার কোনো লজ্জা নেই নির্লজ্জ।

– তোর জন্য যদি নির্লজ্জ হতে হয় তাহলে আমি নির্লজ্জ।

চলবে…….