#হৃদয়_দহন
#মাশফিয়াত_সুইটি (ছদ্মনাম)
পর্ব:০৯(শেষ)
🍁🍁
খুব সাদামাটা ভাবেই সাদিক আর ঐশানির বিয়েটা হয়ে গেল পারিবারিক ভাবে। বাইরের লোক বলতে কিছু কাছের আত্মীয় স্বজন এবং রোদ্রিক আর মায়াকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।
ঐশানির পরনে জামদানি শাড়ি এবং সোনার কিছু গহনা হালকা মেকআপ এতে অনেক সুন্দর লাগছে। সাদিক ঐশানিকে আড়চোখে দেখছে আজ সে চোখ ফেরাতে পারছে না। ঐশানি নিচের দিকে তাকিয়ে,
– এমন করে কি দেখছো?
সাদিক মোহ ভরা কন্ঠে,
– তোমাকে।
– আগে কি কখনো দেখোনি নাকি?
– দেখেছি তবে এই রূপটা দেখিনি একটা মেয়ে যে এতো সুন্দর মায়াবতী হতে পারে তোমাকে না দেখলে হয়তো জানতে পারতাম না।
– তোমার সবকিছুতেই বেশি বেশি।
ঐশানি আর সাদিকের বিয়ে শেষ হতেই ওদেরকে একসঙ্গে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাবিনা আহসান বাকিদের খাওয়ানোর জন্য নিয়ে গেলেন। রোদ্রিক আর মায়া একসাথে এসে তাদের পাশে বসলো, রোদ্রিক মুচকি হেসে,
– কনগ্ৰাচুলেশন।
সাদিক আর ঐশানিও হাসলো, ঐশানি তাদের উদ্দেশ্য করে বললো,
– এবার আপনাদের পালা কবে আসবে? দাওয়াত কি পাবো।
রোদ্রিক মায়ার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে,
– খুব শিঘ্রই।
মায়া মুচকি হেসে ঐশানির দিকে তাকিয়ে,
– আজ আসি তাহলে দোয়া করি তোদের যেন সুন্দর একটা জীবন শুরু হয়।
রোদ্রিক আর মায়া ওদের দু’জনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। বাড়ি ফাঁকা হতেই ঐশানিকে সাদিকের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ঘরটা সাজানো হয়নি যেমন ছিল তেমনি আছে কিন্তু চারপাশটা পরিপাটি। এর আগেও ঐশানি এ ঘরে অনেক বার এসেছে কিন্তু আজ এক নতুন পরিচয়ে এ ঘরে পা রেখেছে আজ থেকে ঘরটা তারও।
কিছুক্ষণ পর সাদিক ভেতরে প্রবেশ করলো ঐশানি নড়লো না চুপচাপ বসে আছে। সাদিক গিয়ে পাশে বসে ঐশানির হাতটা নিজের হাতে আটকে,
– অবশেষে আমরা এক হতে পারলাম পরী।
– বেশিদিন থাকতে পারবো তো?
– আবারো এক কথা।
– না চাইতেই মনে চলে আসে এটাই তো বাস্তব।
– চল না আজ দু’জনে মিলে চন্দ্র বিলাস করি।
ঐশানি মুচকি হেসে সম্মতি দিতেই দু’জনে মিলে ছাদে চলে গেলাম আর তারপর কেটে গেল দেড়মাস। এই দেড়মাস অনেক ভালো কেটেছে দিনগুলো ছিল সুন্দর প্রত্যেক মূহুর্তের হাজারো স্মৃতি যা মনে পড়লে সব কষ্ট দূর হয়ে যায় বারবার আমার ঐশি পরীটাকে নতুন করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
– কিন্তু আপনার সঙ্গে আপনার ওয়াইফ ঐশানিকে কখনো দেখলাম না কোথায় উনি?
সাদিক তার সামনে বসা লোকটির দিকে তাকিয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে,
– বললাম না ওর ব্লাড ক্যান্সার ছিল তাও আবার লাস্ট স্টেজে, শেষে আর বাঁচানো গেল না আমাকে একা রেখে চলে গেল।
– মা*রা গেছেন!
– হ্যা চার বছর আগে এই দিনে হাসপাতালের বিছানায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আমাকে একা রেখে পরপারে চলে গেছে।
– আপনার ভেতরের যে এতোটা কষ্ট এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল কিন্তু আপনাকে দেখে তা বুঝাই যায় না এতোটা হাঁসি খুশি! তারমানে আপনি কি দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন?
সামনে বসা চোখে চশমা পড়া লোকটির দিকে তাকিয়ে এবার মুচকি হাসলো সাদিক। লোকটির মুখে অনেক প্রশ্নের ছাপ ভেসে আছে। সাদিক আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে ঠোঁটের কোণে হাঁসি ঝুঁলিয়ে,
– পরী হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যখন বুঝতে পারলো তার আয়ু ফুরিয়ে যাবে তখন মুখের অক্সিজেন মাস্কটা খুলে আমার হাতে হাত রেখে দুটো আবদার করেছিল।প্রথম আবদারটা ছিল আমি যেন কখনো তার জন্য কষ্ট না পাই সবসময় হাঁসি খুশি থাকি,নিজের পরিবারকে আগলে রাখি আর দ্বিতীয় আবদার ছিল আমি যেন আবারো নতুন ভাবে জীবন শুরু করি বিয়ে করে সংসার শুরু করি।
– রেখেছেন তার কথা?
– সব কষ্ট ভুলে তার স্মৃতি গুলো নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছি হাঁসি খুশি আছি পরিবারকেও আগলে রেখেছি কিন্তু বিয়ে করা হয়নি ওর জায়গা আর কাউকে দিতে পারবো না ওই সারাজীবন আমার অস্তিত্ব,মন এবং মস্তিষ্ক দখল করে থাকবে জায়গাটা শুধুই ঐশানির। এছাড়া যে মেয়েটা আমাকে অন্য কারো সঙ্গে সহ্য করতে না পেরে নিজের এতো বড় অসুখের কথা লুকিয়ে গেল তার মৃত্যুর পর অন্য কাউকে কিভাবে নিজের জীবনে আনবো।
লোকটি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাদিকের দিকে। সাদিক আবারো বলা শুরু করলো,
– ঐশির বাচ্চা অনেক পছন্দের ছিল ওর অনেক ইচ্ছে ছিল সে অসহায় বাচ্চাদের সাহায্য করবে ওর ইচ্ছেতেই এই এতিমখানাটা করেছিলাম আজ ও নেই কিন্তু আমি ঠিক সময় করে সপ্তাহে একদিন বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে যাই ওদের মধ্যে ঐশির ছোট বেলা খুঁজে পাই আজ ঐশির মৃত্যু বার্ষিকী তাই সব কাজ ফেলে এখানে চলে এসেছি এরাই আমার সুখ।
লোকটি নিজের চশমাটা খুলে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে তারপর বললো,
– সত্যি ভালোবাসা সুন্দর সবাই আপনার মতো ভালোবাসতে পারে না আমার স্ত্রীও মা*রা গেছে দু’মাস আগে অথচো পরিবারের চাপে বিয়ে করে নিয়েছি এক মাস হলো,নতুন বৌ এর জন্মদিন উপলক্ষে অসহায় শিশুদের কেক খাওয়াতে এসেছিলাম কিন্তু আপনার অতীত গুলো শুনে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে আমি হয়তো…
বাকি কথাটুকু আর বলতে পারলেন না একটা ভারি নিঃশ্বাস ফেললেন। সাদিক লোকটির ঘাড়ে হাত রেখে,
– সবার ভালোবাসা এক নয় আমি শুধু আমার ভালোবাসার ধরনটা বললাম আপনার ক্ষেত্রে হয়তো অন্য,সবাই সবার জায়গা থেকে সঠিক।
লোকটি পুনরায় চশমা পড়ে সাদিকের কথাগুলো শুনলো। একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে এসে সাদিকের হাত ধরে,
– সাদ আঙ্কেল খেলবে না?
– হ্যা মামনি খেলবো তুমি যাও।
এবার লোকটার দিকে তাকিয়ে,
– মি.আহাদ আজ তাহলে আসি ভালো থাকবেন।
লোকটাও সাদিককে বিদায় দিলো সাদিক এতিমখানার ভেতরে চলে গেল তাকে দেখেই বাচ্চারা চেঁচিয়ে উঠলো আনন্দে।
ঐশানি মা*রা যাওয়ার পর থেকেই গত চার বছর ধরে নিজের কষ্টকে ভুলতে এতিমখানায় কিছুটা সময় পাড় করে সাদিক।এই এতিমখানাটা ঐশানি গুরুতর অসুস্থ হওয়ার কিছুদিন আগে সাদিক কিনে নিয়েছিল। আজ ঐশানির মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে এখানে এসেছিল আর তখন পূর্ব পরিচিত মি. আহাদের সাথে দেখা হয় তাও অনেক বছর পর।
মি.আহাদ গাড়ি চালিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন এখনো তার কানে সাদিকের প্রতিটি কথা ভাসছে। একপর্যায়ে বাড়িতে পৌঁছে গেলেন তিনি দরজায় ধাক্কা দিতেই একজন সুন্দরী রমণী দরজা খুলে,
– বাড়িতে আসতে দেরি হলো কেন? কেক দিয়েছো বাচ্চাদের?
– হুম।
বলেই ভেতরে চলে গেলেন আহাদ। রমণী স্বামীর এমন নিস্তব্ধতায় চমকায়িত হলেন। আহাদ ঘরে এসে দরজা আটকে দিয়ে আলমারি থেকে একটা ছবি বের করে,
– আমাকে মাফ করে দিও কবিতা আমি হয়তো তোমাকে সত্যিকারের ভালোবাসতে পারিনি এতো তাড়াতাড়ি তোমাকে ভুলে গিয়ে তোমার জায়গায় অন্য কাউকে স্থান দিয়ে তোমাকে ভুলে গেলাম।
দরজায় টুকা পড়তেই দ্রুত ছবিটা লুকিয়ে রেখে হাঁসি মুখে দরজা খুললো আহাদ তার বর্তমান স্ত্রী তনু ব্রু কুঁচকে,
– কি হয়েছে তোমার? বাড়িতে এসেই এইভাবে দরজা আটকে দিলে আবার কি তোমার ওই মৃ*ত বউয়ের কথা মনে পড়েছে নাকি? দেখো আমি কিন্তু এসব সহ্য করবো না তোমার সবটা জুড়ে শুধু আমি থাকবো বুঝলে।
তনু কথাগুলো রেগে রেগে বলে রান্নাঘরে চলে গেল। আহাদ তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। সারাদিন বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে খাওয়া দাওয়া করে রাতে বাড়ি ফিরলো সাদিক। সাদিক সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছিল কিন্তু পেছন থেকে সাবিনা আহসান থামিয়ে দিয়ে,
– কিরে কোথায় ছিলি?কতবার ফোন করলাম ধরলি না।
– মা আজকের দিনটা কি ভুলে গেছো নাকি?
– এই দিনটি কি ভুলার মতো এই দিনেই তো সবকিছু তছনছ হয়ে গেল।
– আমি খেয়ে এসেছি ঘরে গেলাম ক্লান্ত লাগছে।
সাদিক যেতেই সাবিনা আহসান দুঃখের সহিত বলতে লাগলেন,
– সবার সামনে যতোই নিজেকে সুখী দেখাস না কেন তোর ভেতরের হৃদয় দহন আমার জানা আছে।
সাদিক ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে ছাদে চলে গেল, মোবাইলটা অন করতেই ওয়ালপেপারে ঐশানির ছবি ভেসে আসলো। হাঁসি গুলো মূহুর্তের মধ্যে চলে গিয়ে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে চোখে পানি টলমল করছে অভিমানী সুরে বলতে লাগলো,
– কেন এইভাবে একা করে চলে গেলি পরী? খুব কষ্ট হয়,তোর কথা বড্ড মনে পড়ে আমি তো তোর কথা রেখেছি আগের মতো হাঁসি খুশি আছি জীবনকে গুছিয়ে নিয়েছি তারপরও কেন তুই আমাকে তোর কাছে নিয়ে যাচ্ছিস না তবে যেখানে থাক ভালো থাক যতদিন বাঁচবো তোকেই ভালোবাসবো।
(~~সমাপ্ত~~)
[ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন]