হৃদয়াবেগ পর্ব-০১+০২

0
981

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০১
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

‘মা আর মামুর পাগলামির জন্য এখন তোকে বিয়ে করতে হয়েছে নাযীফাহ। আমি এখনই বিয়ে নামক বেড়াজালে আবদ্ধ হতে চাইনি।এখন বিয়ে করতে চাইনি এর মানে এই না যে আমি অন্য কারো সাথে কমিটেড। বিয়ে হলো একটা পবিত্র বন্ধন। ‘কবুল’ এই তিনটি শব্দের অনেক জোর। তুই জানিস আমি পড়ুয়া মানুষ। আমার দুনিয়া মানে পড়াশোনা। আমার স্বপ্নটা অনেক বড় নাযীফাহ। তাছাড়া তুইও অনেক ছোট।আবেগের বয়স তোর। মামু ভেবেছে আবেগের বসে যদি তুই কাউকে মন দিয়ে বসিস। সেই ভয় থেকে বিয়ের তোরজোর।’

এতটুকু বলে থামল তাহমিদ। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লাল জামদানী পরিধেয় নববধূ। যার সাথে সে ঘন্টা খানিক আগে ‘আকদ’ সম্পন্ন হয়েছে।আজকের আগ পর্যন্ত তাদের সম্পর্কটা ছিলো মামাতো বোন আর ফুফাতো ভাইয়ের। ঘন্টা খানিক আগে ‘কবুল’ নামক শব্দের জন্য সম্পর্কের মানেটাই বদলে গেলো। বর্তমানে এক হাত ঘোমটা দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি আর মামাতো বোন না তার বিয়ে করা বউ। ‘তার বিয়ে করা বউ’ মনে মনে কয়েকবার আওড়াল শব্দটা।আনমনে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখে গেলো তাহমিদের। গেলো ফেব্রুয়ারিতে তার তেইশ শেষ করে চব্বিশে পা দিলো। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে আর তার মা তাকে জিরুতে দিলো না। একেবারে ধরে বেঁধে নিজের ভাইঝির সাথে বিয়ে দিয়ে দিলো। চব্বিশ বছরের তাহমিদের সাথে পনেরো বছর বয়সী নাযীফাহ’র বিয়ে কেন দিলো সেটাই ভেবে পায় না সে। যে মেয়ে কি না এসএসসি পরীক্ষার্থী হয়েও এখনো সুযোগ পেলে গাছে চড়ে বেড়ায়। পাড়ার বাচ্চাদের সাথে মাঝে মাঝে মারবেল খেলে। মাঠে ফুটবল খেলে। সেই ইমম্যাচিউর বাচ্চা মেয়েটা নাকি তার বউ। গলা ঝেড়ে স্বাভাবিক হলো সে।

‘আমি নিজেই এখনো অগোছালো। আমি নিজেকে একটু গুছিয়ে নেই। তুইও পড়াশোনা কর। তোর মাঝে ম্যাচিউরিটি আসুক। অনুভূতি বুঝতে শিখ। ততদিনে আমারও একটা গতি হয়ে যাবে।’

তাহমিদ কথা শেষ করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। চৌকাঠ ডিঙানোর আগে পিছু ফিরে শান্ত স্বরে ডাকল,

‘নাযীফাহ?’

এমন কোমল গলা শুনে মাথা তুলে তাকাল নাযীফাহ। তাহমিদের এমন শান্ত ডাকে কিছু একটা ছিলো।

‘তুই ডানপিটে আমি জানি। শয়তানি তোর শিরায় উপশিরায়। আমার এসবে কোনো বাঁধা নেই। যার যার একটা স্বাধীন জীবন আছে। আমি চাই না জীবনের কোনো একটা সময় গিয়ে তুই বলিস যে, ‘আপনার জন্য আমার কৈশোরটা দূর্বিষহ কেটেছে।’ স্বামী হয়েছি বলেই যে অধিকার ফলাবো এমন পুরুষ আমি না। তবে এইটুকু মাথায় রাখিস তুই এখন আর তুই শুধু কারো মেয়ে না। কারো স্ত্রী আর কারো বাড়ির পুত্রবধূ। দুই বাড়ির সম্মান তোর হাতে। তোর মনে যেন অন্য কারোর জন্য অনুভূতি জন্ম না নেয়। ‘কবুল’ বলে যাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছিস তার মাঝেই যেন অনুভূতি সীমাবদ্ধ থাকে। কাল সকালে হয়তো ঢাকা চলে যাবো। এসএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত বাঁদরামি কম করে পড়াশোনায় মনযোগ দে। ভালো রেজাল্ট করতে হবে। মামুর একমাত্র সন্তান তুই। তোকে নিয়ে মামুর স্বপ্ন। আর নিজের যত্ন নিবি।’

আর দাঁড়ালো না সে। হনহন করে চলে গেলো বসার ঘরের দিকে। তাহমিদ যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচল সে। মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে আঁচল কোমড়ে গুঁজল। এতোক্ষণ ভালো মেয়ের মতো ঘোমটা দিয়ে থাকতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিলো তার। তাহমিদের সামনে যেতেই তার লজ্জা করে। বছরে দু’টো ইদ ছাড়া আর তাহমিদের সাথে তার দেখা হতো না। তাহমিদ শহরে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছে। আর সে থাকে গ্রামে। এতোক্ষণ তাহমিদ কি বলে গেলো সে দিকে তার ধ্যান ছিলো না। তার ধ্যান তো আব্বাস চাচার পেয়ারা গাছে ঝুলতে থাকা পেয়ারা জোড়ার দিকে। সকালে অংক প্রাইভেট শেষ করে দেখেছিলো। কেমন অসহায় মতো তাকিয়ে ছিলো নাযীফাহ’র দিকে। পেয়ারা দু’টো যেন কেঁদে কেঁদে বলছিলো,

‘আমাদেরকে তোর সাথে করে নিয়ে যা নাযীফাহ। এভাবে আর গাছে ঝুলে থাকতে ভালো লাগছে না।’

পেয়ারা দু’টো কথা বলছে ভাবতেই ফিক করে হেঁসে দিলো সে। বাড়িতে আসার পর তার মা আর তাকে বেরুতে দিলো না। না হলে এতোক্ষণে পেয়ারা তার পেটে চালান করে দিতো। কি কাঁদাটাই না কেঁদেছে সে। যখন শুনেছে তার বিয়ে। তাও কিনা তাহমিদ ভাইয়ের সাথে। উনার সামনে আসতেই তো নাযীফাহ লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে যায়। সবার সাথে বনলেও নাযীফাহ’র শুধু বনে না ফুফুর শ্বাশুড়ির সাথে। দেখা হলে সারাক্ষন শুধু ঝগড়া করে। এসব ভাবতে ভাবতে খাটে ধপাস করে শুয়ে পড়লো সে। তবে বাঁচা গেছে তাহমিদ ভাই বলেছে ও বাড়ি নাকি যেতে হবে না। কবে যেতে হবে সেটাও বলেনি। যদি কয়েকদিন পরে এসে বলে ও বাড়ি যেতে তখন কি হবে?

কিয়ৎকাল পরে কুটিল হেঁসে নাযীফাহ মনকে বুঝালো,

‘তখন না হয় কান্নাকাটি নামক মেলোড্রামা করে সব ভেস্তে দিবে।’ পাখার বাতাস গায়ে মাখিয়ে আরামে চোখ বুঁজলো সে।

____________________________________________

তাহমিদ এসে দাঁড়ালো বসার ঘরে। সেখানে আড্ডাতে মত্ত তার বাবা, মা এবং মামু। মামি নিশ্চয়ই রান্নাঘরে।তাদের কথার মাঝেই গলা ঝেড়ে নিজের উপস্থিতির জানান দিলো তাহমিদ। সবাই তাকালো তার দিকে। সে ধীর পায়ে তার মামুর কাছে গিয়ে বসল।

‘দুই ভাইবোন তো একেবারে ধরে বেঁধে আমাদের বিয়ে দিয়েছো। এখন দয়া করে সংসার করতে বলো না। নাযীফাহ একটু বড় হউক আমিও এমবিএ শেষ করে চাকরির খোঁজ করি। রগে রগে তোমার মেয়ের বাঁদরামি। আর এখনই সংসারের ভূত ওর মাথায় চাপাতে চাইছি না।’

এতটুকু বলে থামল সে। নিজের ভাগ্নের কথায় ঠোঁট প্রসারিত হয় খালেদ মোশাররফ এর।

‘এই না হলে আমার জামাতা।’

চোখ রাঙায় তাহমিদ।

‘ওহ মামু জামাতা বলবে না। আজকের আগে যেমন ভাগ্নে বলতে এখনো বলবে।’

কথার মাঝে ফোড়ন কাটে তাহমিদের মা ওয়াহিদা।

‘দেখ ভাই তুই যে আগে আমার মাটির ব্যাংকের জমানো টাকা গুলো চুরি করতি, মনে আছে?এখন আমি সেই সব টাকা উসুল করবো। যখন তোর মেয়েকে একেবারে আমার বাড়ি নিয়ে যাবো, তখন মোটা অংকের যৌতুক দিতে হবে।’

নিজের স্বামীকে ইশারা করে, ‘কি বলো তাহমিদের বাবা?’

জামান সাহেব গা ছাড়া ভাব নিলেন।

‘এটা তোমাদের ভাইবোনের ব্যপার এর মাঝে আমাকে টানছো কেন? ছেলে যে আমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেছে এতেই আমি শান্তি।’

খালেদ মোশাররফ চশমা পরিষ্কারের ভঙ্গিতে ফুঁ দিলেন।

‘দিলাম না যৌতুক। কি করবি?’

‘অ’ত্যা’চা’র করবো তোর মেয়েকে।’

বোনের কথায় হাসলো খালেদ মোশাররফ।

‘ভাইঝি বাদঁরামো করে হাত পা কাটলেও যে ফুফু পাগলের মতো ছুটে আসে। সে নাকি করবে অ’ত্যা’চা’র।’

‘তোর মেয়ে যে মায়ের আদল পেয়েছে। নাযীফাহ কাছে পাশে থাকলে মনে হয় আমার মা আমার কাছে আছে। শান্তি লাগে খুব।’

‘আমি কিন্তু কাল সকালেই ঢাকা ব্যাক করবো। এখন বিভিন্ন ভার্সিটি পরীক্ষা হচ্ছে। একজন কোচিং সেন্টারের শিক্ষক হিসেবে এই সময় আমার গ্রামে থাকা বেমানান।’

মা আর মামুর মন অন্যদিকে ঘুরাতে এই কথা বলে তাহমিদ। না হলে এখনই ম’রা বাড়ির মতো কান্না শুরু করবে।

‘সেকি কালই চলে যাবে?’

রান্নাঘর থেকে চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে বসার ঘরে আসতে আসতে বলেন ফাহমিদা বেগম।

‘হুম মামি। এখন ওদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। আমি একদিন এখানে থাকলে ওরা পিছিয়ে যাবে। মা বাবা চা শেষ কর তাড়াতাড়ি। বাড়ির পথে রওনা দিতে হবে।না হলে বেশি রাত হয়ে যাবে।’

‘কাল সকালে ঢাকা যাবি ঠিক আছে। এখান থেকেই না হয় সকালে চলে যাস।’

‘না মামু সব দরকারি জিনিস আমাদের বাড়িতে রয়ে গেছে।’

খালেদ মোশাররফের কথার উত্তরে বলল তাহমিদ।

‘আচ্ছা সে না হয় যাবে তোমরা। রাতের খাবারটা খেয়ে যেও।’ তাহমিদের কথা শুনে বলল ফাহমিদা বেগম।

‘না মামি তোমাদের উপর বিশ্বাস নেই। তোমরা কথা বলতে বলতে খাবার খাবে। আর রাত দশটা বেজে যাবে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোমাদের জন্য টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দিয়ে দিচ্ছি। মাউই মা আসলে কত ভালো ছিলো।’

‘মা তো আসতে চেয়েছিলেন। ঘরোয়াভাবে হউক আর যেমনই হউক বড় নাতির বিয়ে। কিন্তু অসুস্থতা আর হতে দিলো। তবে মা ভীষণ খুশি নাযীফাহ’র সাথে ঝগড়া করার জন্য আর বাড়িতে আসতে হবে না। ও বাড়িতে বসে বসে ঝগড়া করতে পারবে। কবে যে আমার ছেলের সুমতি হয় ঘরের বউকে ঘরে নেওয়ার আল্লাহ মালুম।’ তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন জামান সাহেব।

‘আপনারা চা শেষ করুন আমি খাবার প্যাক করছি।’ বলেই আবার রান্নাঘরের দিকে গেলো ফাহমিদা বেগম।

____________________________________________

রাতে খাওয়ার সময় মেয়েকে ডাকতে আসলেন ফাহমিদা বেগম। দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করে দেখেন মেয়ে তার সারা খাটে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমোচ্ছে। শাড়ি এলোমেলো। মেয়ের ঘুমের নমুনা দেখে শব্দহীন হাসলেন উনি। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ভাবলেন,

‘গায়ে গতরে বড় হলেও স্বভাব আচরণে এখনো বাচ্চা নাযীফাহ। অথচ এই অবুঝ মেয়েটারই নাকি বিয়ে হয়ে গেছে।’

‘নাযীফাহ?’ আলতো স্বরে ডাকলেন ফাহমিদা বেগম।

মায়ের ডাকে পিটপিট করে তাকালো সে।

‘রাতের খাবার খাবি না, মা?’

‘খাবো না মা। ঘুমুতে দাও।’ ঘুম ঘুম গলায় বলল নাযীফাহ।

‘রাতে ভাত না খেলে কিন্তু শরীর থেকে এক চড়ুই পাখির সমান মাংস কমে যায়।’

‘কমলে ভালো। কেউ আর আমাকে মুটি বলবে না। আমি গাছের মগডালে চড়তে পারবো।’

‘আল্লাহ এই মেয়ের ঘুমের মাঝেও এসব ভাবে। এই মেয়ে কবে বড় হবে? এর সমান অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে বাচ্চাও হয়ে গেছে। আর এই মেয়ে এখনো ছোট বাচ্চাদের মতো গাছে চড়ার কথা বলছে।’

কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে রুম থেকে প্রস্থান করলেন ফাহমিদা বেগম। মায়ের কথায় মুচকি হেঁসে আবার ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো নাযীফাহ।

____________________________________________

ভোরে নিজের সবকিছু গোছগাছ করছে তাহমিদ। একটু পরেই সে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। সকাল সকাল রওনা হওয়ার একটাই কারণ, আজকের ক্লাসটা যেন কোনোভাবে মিস না যায়। একটা বক্সে বিরিয়ানি নিয়ে তাহমিদের রুমে আসলেন ওয়াহিদা।

‘বাবা, ঢাকায় কি তোর কোনো পছন্দ আছে? নাকি আমরা আমাদের সবার সিদ্ধান্ত তোর উপর চাপিয়ে দিয়েছি?’

অকস্মাৎ মায়ের কথায় চমকিত হয় তাহমিদ।

#চলবে

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০২
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

মায়ের কথা শুনে তপ্ত শ্বাস ফেলল তাহমিদ।

‘এসব কথা বলে কি আর কোনো লাভ আছে? যা হওয়ার তো হয়েই গিয়েছে।’

ছেলের কথা শুনে থমকালেন ওয়াহিদা।

‘তার মানে কি তোর মতামত না নিয়ে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত তোর উপর চাপিয়ে দিয়েছি? তোর নিশ্চয়ই কোনো পছন্দ আছে, তাই না?’

মায়ের কথায় স্মিত হাসলো তাহমিদ। মায়ের হাত থেকে বিরিয়ানির বক্সটা নিয়ে মাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো।

‘নাতো আমার কোনো পছন্দ আছে আর না তোমরা তোমাদের মতামত আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছো। আসলে আমি বিয়ের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। সেটেল্ড হয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে তারপর এসব নিয়ে ভাবতাম আমি। বিয়ে তো আর ছেলেখেলা না। অনেক বড় দায়িত্ব। একটা মেয়ের বাবার পরে দায়িত্বটা কিন্তু তার স্বামীর কাঁধে এসে পড়ে। আর তোমার যে ভাইঝি মাশা-আল্লাহ। আল্লাহ রক্ষা করো। সে যতই ওই বাড়ি থাকুক না কেন ঢাকা গিয়ে কিন্তু আমায় টেনশনে থাকতে হবে। কারণ সে আমার স্ত্রী। তিন কবুল বলে তাকে আমি গ্রহণ করেছি। কখন কি করে বসে সেই আতংকে থাকতে হবে আমায়। সে যে কবে ম্যাচিউরড হবে আল্লাহ জানে।’

‘বড় ছেলে বিয়ে করতে চায় না। তাকে জোর করে বিয়ে দিলে। এইদিকে তোমার ১৯ বছর বয়সী ছোট ছেলে বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে আছে সেদিকে কি তোমাদের কোনো নজর আছে?’ দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হামি দিতে দিতে বললো তাহমিদ এর ছোট ভাই ফাহিম।

ফাহিম এডমিশন ক্যান্ডিডেট। ভাইয়ের আকদ এর জন্য বাড়িতে এসেছে। সেও তার ভাইয়ের সাথেই ঢাকা থাকে।

ফাহিম এর কথায় ভ্রুকুঞ্চন করে তাকায় ওয়াহিদা।

‘মাত্র এইচএসসি দিলি। এখনো ভার্সিটিতে এডমিশন নিলি না। এখনি বিয়ে? এই তোর বিয়ের বয়স হয়েছে?’

‘ওহ্ মা একটু আপডেট হও। আমার বয়সী অনেক ছেলে এক বাচ্চার বাপ হয়ে গেছে। আর আমি? বইয়ের সাথে সংসার করছি। জীবনটা ভাজা ভাজা।’

ওয়াহিদা দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

‘ আমার বাথরুমের স্যান্ডেল জোড়া কইরে?’

‘ভাইয়া আমি নিচে আছি। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।এই সাতসকালে জু’তার বারি খাওয়ার কোনো শখ নাই আমার।’ দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে গেলো ফাহিম।

মা আর ভাইয়ের কান্ডে শব্দ করে হাসলো তাহমিদ।

‘মা ছাড়ো তো ওর কথা। দাদি কি এখনো ঘুমোচ্ছে? আর বাবা?’

‘তোর দাদি রাতে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। শেষ রাত অব্দি ছটফট করছেন। আর তোর বাবা ফজরের নামাজে গিয়েছে। এখনো আসেনি।’

‘তাহলে তো বাবার সাথে আর দেখা হবে না। এখন বের না হলে প্রথম শিফটের বাসে উঠতে পারবো না। আর আমি ঢাকা পৌঁছে দাদির সাথে কথা বলে নিবো।’

ওয়াহিদা দোয়া পড়ে ছেলের গায়ে ফু দিলেন।

‘সাবধানে যাবি বাবা। আর ওই বাঁদরটাকেও দেখেশুনে রাখিস। আল্লাহ আল্লাহ করে বেরিয়ে পড়।’

কিছু পথ এগিয়ে গিয়েও তাহমিদ ওর মাকে পিছু ফিরে ডাকলো। ছেলের ডাকে তাকালো ওয়াহিদা।

‘কিছু বলবি বাবা?’

‘তোমার ভাইঝিকে নিজের যত্ন নিতে বলো। আর মন দিয়ে যেন পড়াশোনা করে। পাড়ার বাচ্চাদের সাথে খেলতে গিয়ে নিজের পড়াশোনার ক্ষতি না করে বসে।’

আর দাঁড়ালো না তাহমিদ হনহনিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেলো। ওয়াহিদা ছেলের এমন সুপ্ত অস্থিরতা দেখে নিঃশব্দে হাসলো।

____________________________________________

নাযীফাহ এবং তাহমিদের বিয়ের দু’দিন পার হয়ে গেছে। কোচিং সেন্টারে ক্লাস শেষ করে বাসায় যাবে তাহমিদ। আকাশে মেঘ ডাকছে। চারপাশ কেমন অন্ধকার হয়ে গেছে। রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে সে। হঠাৎই কেউ একজন বলল,

‘আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন?’

‘আরে সাবিহা যে, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো।?’

‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আমি তো ঢাবিতে চান্স পেয়েছি শুনেছেন নিশ্চয়ই?’

‘হুম, আতিফ ভাই বললো।আমাদের কোচিং সেন্টার থেকে অনেকেই চান্স পেয়েছে। চান্স পেয়েছো বলে বসে থাকলে হবে না মন দিয়ে পড়াশোনা করো।’

সাবিহা ব্যাগ হাতরে কিছু একটা বের করলো। তারপর তাহমিদের দিকে বাড়িয়ে দিলো সেটা।

‘ এটা আপনার জন্য স্যার। আপনি এভাবে গাইড না করলে কখনো এটা সম্ভব হতো না। তাই আমার তরফ থেকে ছোট্ট উপহার।’

‘এসবের দরকার ছিল না সাবিহা। তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করেছ। সে অনুযায়ী ফল পেয়েছো।’

‘উপহারটা নিলে আমি খুব খুশি হবো স্যার।’

অগত্যা তাহমিদ সাবিহার হাত থেকে গিফট বক্সটা নিলো। একটা রিক্সা আসতেই দ্রুত উঠে পড়লো।রিক্সায়। তাহমিদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে সাবিহা। সাবিহার সাথে থাকা মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো,

‘এটাই কি তোর সেই ক্রাশ?’

জবাবে মাথা নাড়লো সে। মেয়েটি পুনরায় বলল,

‘ কি এটিটিউড। আমার দিকে তাকলো না পর্যন্ত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মনের কথা বলে দে। না হলে এই এটিটিউড কিং কে অন্য কেউ নিয়ে যাবে।’

সাবিহা হেসে জবাব দিলো,

‘কেউ নিবে না। উনার কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। মেয়েদের দিকেও ভালো করে তাকায় না।’

‘তাহলে বলছিস না কেন?’

‘এখন নিজের মনের কথা প্রকাশ করলে বলবে এগুলো আমার আবেগ। তাই অপেক্ষা করছি সঠিক সময়ের।’

____________________________________________
জানালা কিঞ্চিৎ ফাঁক করে ঝড়ের তান্ডব দেখছে নাযীফাহ। বজ্রপাতের আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। হঠাৎই কিছু একটার কথা মনে পড়তেই দৌড় লাগালো সদর দরজার দিকে। বসার ঘরে নকশিকাঁথায় ফুল করছিলো নাযীফাহ’র মা ফাহমিদা। মেয়ের এমন দৌড় দেখে ভ্রু কুঁচালেন তিনি। নাযীফাহকে দরজার ছিটকিনি খুলতে দেখে দৌড়ে গেলেন মেয়ের কাছে।

‘নাযীফাহ এই ঝড়ের মধ্যে তোমাকে ভিজতে হবে না। সব সময় পাগলামি করে না।’

‘আমি বৃষ্টিতে ভিজবো না মা।’

‘বৃষ্টিতে ভিজবে না তাহলে বাইরের দিকে ছুটছো কেন?’

রান্নাঘরের সামনে বিলম্বো গাছে ঘুঘু পাখির বাসা। দু’টো বাচ্চা আছে। আমি ওগুলো নিয়ে চলে আসবো। নাহলে এই ঝড়ের মাঝে পাখির বাচ্চা দুইটা ম’রে যাবে মা।’

মেয়ের এমন কথায় তেতে উঠলেন ফাহমিদা বেগম। চোখ রাঙানি দিয়ে বলেন,

‘সব সময় তোমাকে পাগলামি করতে হবে। বাইরে ঝড় হচ্ছে। বজ্রপাতের শব্দে ঘরে থেকেও ভেতর কেঁপে উঠছে। আর তুমি বাইরে যাবে। যাও নিজের রুমে যাও।নাহলে তোমার বাবাকে ডাকবো।’

মন খারাপ করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। প্রায় ঘন্টা খানিক তান্ডবের পরে ঝড় থামলো। প্রকৃতি তার ভয়ংকর রূপ দেখিয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হতে শুরু করেছে। ঝড় থামতেই নাযীফাহ একছুটে ঘর থেকে বের হলো। রান্নাঘরের সামনে গিয়ে হাঁপাতে শুরু করলো সে। বিলম্বো গাছের নিচে তাকাতেই কান্না করার উপক্রম হলো তার। পাখির বাসাটা উল্টে নিচে পড়ে আছে। পাশেই মা পাখিটার নিথর প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে। মা পাখিটা চাইলেই উড়ে যেতে পারতো। সন্তানের মায়ায় এখানেই থেকে গেছে। মা বুঝি এমনই হয়। নাযীফাহ যতই বাঁদরামি করুক না কেন পশুপাখি কে কখনো কষ্ট দেয় না।
পাখির জন্য মন খারাপ করে সেদিন আর কারো সাথে কথা বলেনি নাযীফাহ।

____________________________________________

গিফটের বক্সটাকে অবহেলায় খাটের এককোণে রাখল তাহমিদ। ধূলোবালিময় ক্লান্ত দেহটা নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো।শাওয়ার নিয়ে বাইরে আসতেই দেখতে পেলো ফাহিম গিফট বক্সের রেপিং পেপার খুলছে। সেসবে পাত্তা দিলো তাহমিদ। বক্সটা খুলেই ফাহিম বলল,

‘ওয়াও ব্র্যান্ডেড ওয়াচ। কে দিলো ভাইয়া?’

‘স্টুডেন্ট।’

‘কি উপলক্ষে?’

‘ঢাবিতে চান্স পেয়েছে তাই।’

‘যাই বলো ভাইয়া চয়েসটা কিন্তু সেই।’

‘তোর ভালো লাগলে তুই রেখে দে।’

‘তোমার স্টুডেন্ট তোমাকে গিফট করেছে৷ আমি কেন নিবো?’

তাহমিদ বিড়বিড় করে বলে,

‘শিক্ষক হিসেবে দিয়েছে নাকি অন্য কিছু হিসেবে দিয়েছে আমি ভালো করেই জানি। মানুষের চোখ দেখলে বোঝা যায়। এতটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার হয়েছে।’

ফাহিম ভ্রুকুটি করে বলে,

‘কিছু বললে ভাইয়া?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাহমিদ বললো,

‘আমি ঘড়ি হাতে দেই না তুই রেখে দে।’

____________________________________________

ঘনিয়ে এলো নাযীফাহ’র এসএসসি পরীক্ষা। হাতে গুনে আর মাত্র চার দিন। আজ অংক প্রাইভেটে স্যার বুঝিয়ে দিয়েছেন কিভাবে ওএমআর শিট পূরণ করতে হবে, কিভাবে লিখতে হবে। প্রাইভেট শেষ করে বাড়ি এসে দেখে ফাহিম আর তার দাদি এসেছে। ফাহিমের দাদি আমেনা বেগম নাযীফাহ কে দেখেই ডাকলো। নাযীফাহ নাকমুখ কুঁচকে বলল,

‘তোমার সাথে ঝগড়ার মুড আমার নাই বুড়ি।’

‘কেন কি হয়েছেরে ছুড়ি?’

‘স্কুল জীবন শেষ গো বুড়ি। আমার আর স্কুল থেকে আম চুরি করে খাওয়া হবে না।’

দন্তহীন মুখে আমেনা বেগম বললেন,

‘বেঁচে থাকা আমার সার্থক। এই প্রথম শুনলাম কোনো মেয়ে তার শ্বশুরবাড়ির লোকদের সামনে চুরি করতে পারবে না বলে আফসোস করছে।’

‘যাও তো বুড়ি এজন্য তোমার সাথে আমি কথা বলি না।’

‘এই বুড়ি যখন আর থাকবে না তখন এই বুড়ির মর্ম বুঝবি। বুড়ির জন্য কাঁদবি সারাক্ষণ।’

আমেনা বেগমের কথা শুনে নাযীফাহ্ উনার পাশে গিয়ে বসল।

‘আমি তোমাকে বুড়ি বলে ডাকি, সারাক্ষণ ঝগড়া করি বলে তুমি রাগ করো?’

নাযীফাহ’র মাথায় হাত বুলিয়ে আমেনা বেগম বলেন,

‘রাগ করলে কি আর তোকে নাতবউ করি? তোর সাথে ঝগড়া করতে আমার বেশ লাগে।’

‘তাহলে তুমি ম’রা’র কথা বললে কেন?’

‘আর কত থাকবো? আমার সাথের কেউ আর বেঁচে নেই। তোর দাদা শ্বশুরের জন্য মাঝে মাঝে ভেতরটা হুঁহু করে উঠে। কতদিন দেখিনা সেই মুখ।’

‘দাদা তোমায় খুব ভালোবাসতো?’

দুই পলিথিন চিপস, চানাচুর, চিড়াভাজা চকলেট নাযীফাহ’র কাছে রেখে বলল,

‘দুই পেত্নী আবেগের কথা বাদ দাও। আপা এই যে নেন এগুলো আপনার জামাই জান পাঠাইছে।এগুলো গ্রহণ করে আমাকে উদ্ধার করেন।’

‘বলবো একশোবার বলবো তাতে তোর কি ফাহিম্মা?’

‘পাইলাম না ইজ্জত পাইলাম না। বয়সে বড় হওয়ার পরও তুই করে বলে।’

নাযীফাহ দাঁত কেলিয়ে বলে,

‘সম্মান দিয়ে কথা বলবি ফাহিম্মা। আমি তোর একমাত্র শহুরে বড় ভাইয়ের বউ।’

‘এ্যাহ্ আইছে আমার ভাবি সর সামনের থেকে।’

ফোন বেজে উঠলো ফাহিমের। ফাহিম কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন বাড়িয়ে দিলো নাযীফাহ’র দিকে। নাযীফাহ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ফাহিমের অভিমুখে। ফাহিম চোখের ইশারায় বলল কথা বলার জন্য। কানে ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশের কণ্ঠস্বর শুনে হৃদপিণ্ড তড়িৎ গতিতে লাফাতে শুরু করে নাযীফাহ’র।

#চলবে