হৃদয়াবেগ পর্ব-২৬+২৭

0
530

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ২৬_২৭
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

তাহমিদ কে নিজের হাত থেকে হাসিমুখে ফুল নিতে দেখে বিশ্বাসই করতে পারছে না সাবিহা। ফুলদানিতে রাখার জন্য এক গোছা গোলাপ কিনেছিল সে। হাতে ফুল আর রেস্টুরেন্টে তাহমিদকে দেখে এটাকে মোক্ষম সময় মনে করে ভালোবাসা নিবেদন করার।অনেক তো হলো এক তরফা ভালোবাসা। এখন সময় এসেছে অনুভূতি জানান দেওয়ার। সে আঠারো ক্রস করেছে এখন নিশ্চয়ই আবেগের বয়স বলে অজুহাত দিতে পারবে না। আহ্লাদিত, উৎফুল্লিত, আনন্দোচ্ছল সাবিহা। অধরে হাসি বজায় রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। তাহমিদকে ফুল নিতে দেখে তাহমিদের বন্ধুদের কপালে চিন্তার বলিরেখা ভাসমান হয়। তাদের জানামতে তাহমিদ নিজের স্ত্রীকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে।তাহলে?

‘ফুলকে মানুষ বরাবরই ভালোবাসে। আমিও তার উর্ধ্বে নই। তাছাড়া গোলাপ ভালোবাসার প্রতীক। গোলাপকে উপেক্ষা কেউ করতে পারবে না। ফুলকে ভালোবেসে তোমার হাত থেকে গোলাপগুলো নিলাম।’

মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো সাবিহার।

‘তোমাকে আজ পর্যন্ত আমি অন্য নজরে দেখিনি। যতদিন আমাদের গাইডলাইনে ছিলে ততদিন তোমাকে নিজের স্টুডেন্ট ব্যতীত আর কিছুই ভাবেনি। তার বাইরেও যদি ভাবতে বলো তাহলে বড়জোর বোন ভাবতে পারবো।আর কিছু না। এই তাহমিদ আপাদমস্তকে আজ অন্য কারো।পুরোপুরি অন্যকারো। তাহমিদ ষোড়শী কিশোরীর উন্মাদনায় মত্ত। আজ দেড় বছরের উপর হবে সেই আসক্তি থেকে সে বের হতে পারেনি। সময় গড়ানোর সাথে সাথে সেই আসক্তি ফিকে হওয়ার বদলে গাঢ় থেকে গাঢ় হয়েছে। তাহমিদের সবটা জুড়ে সেই কিশোরীর বসবাস। আমি ভালোবাসি তাকে।’

চুপসে গেলো সাবিহার মুখ। অন্ধকার ঘনীভূত হলো আননে। চক্ষুদ্বয়ে জমতে শুরু করেছে ব্যর্থতার অশ্রু। তাহলে কি সে নিজের মনের কথা বলতে দেরি করে ফেলল? রেস্টুরেন্টে থাকা সবাই মনযোগ দিয়ে দেখছে। আপাতত রেস্টুরেন্টের মধ্যমনি ওরা। নেত্রজল গন্ডদেশ স্পর্শ করতেই নিজের বাম দিয়ে মুছে ফেলে সাবিহা।

‘আপনি সরাসরি আমাকে রিজেক্ট করতে পারবেন না বলে এসব বলছেন তাই না স্যার? আমি আপনাকে সেই প্রথম থেকে পছন্দ করি স্যার। আমার এই অনুভূতিকে আপনি আবেগ বলে উড়িয়ে দিবেন বলে এতোদিন বলিনি। আমাকে রিজেক্ট কেন করছেন স্যার? আমি পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ি। আপনার পাশাপাশি হাঁটার যোগ্যতা নিশ্চয়ই আমার আছে?’

তাহমিদ শুকনো আর মলিন হাসলো।

‘ভালোবাসা কোনো যোগ্যতা দিয়ে হয়না। ভালোবাসা সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক ব্যপার। যারা যোগ্যতার ভিত্তি করে ভালোবাসার কথা বলে সেটা ভালোবাসা না। ভালোবাসা মুখ দেখে হয়না। আর না যোগ্যতা দেখে মুখ এসিডে ঝলসে যাওয়ার পরও মানুষ তার ভালোবাসার মানুষের সাথে সংসার করে। রোড এক্সিডেন্টে একটা হাত বা পা কা’টে ফেলে দেওয়ার পরও একসাথে পথ চলছে। হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার পরও সেই মৃত্যু পথযাত্রীকে মানুষ ভালোবাসার কথা বলে। এগুলো হচ্ছে আত্মতুষ্টি, আত্মতৃপ্তি। তারা কিন্তু পারতো এসিডে ঝলসে যাওয়া, হাত কে’টে ফেলা বা মৃত্যু পথযাত্রীকে ফেলে পুনশ্চ নিজেদের যোগ্য কাউকে বেছে নিতে। করেনি কেন জানো কারণ তারা ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষ যেমনই হউক কালো, ফর্সা, লম্বা, খাটো, ম্যাচিউর, ইমম্যাচিউর এগুলো ফ্যাক্ট না। ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকা, তার পাগলামি, হুট করে জড়িয়ে, ভালোবাসি বলা এসব হচ্ছে মানসিক শান্তি। খেয়াল করে দেখবে স্বামী স্ত্রী যদি সারাদিন ঝগড়াও করে তবুও কেউ কাউকে ছেড়ে যায় না। কারন দিনশেষে ওই পুরুষ ওই নারীতেই মত্ত। ওই নারীতেই আসক্ত সে। ওই নারীর সঙ্গ পেলেই সেই মানসিক শান্তি অনুভব করে। তুমি আরো আগে আমাকে নিজের মনের কথা বললেও আমি তোমাকে রিজেক্টই করতাম। তোমার জন্য আমি কখনো কোনো কিছু ফিল করেনি। আমার সকল আবেগ, অনুভূতি, অনুরক্তি সবকিছু আমার স্ত্রীর জন্য। তাহমিদ ওই একজনে সীমাবদ্ধ ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকতে চায়।’

‘স্ত্রী’ কথাটা শ্রবণগোচর হতেই বিস্ফোরিত চোখে তাকায় সাবিহা। তাহমিদ স্যার বিবাহিত সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। সাবিহার দৃষ্টির মানে বুঝতে পেরে তাহমিদ বলল,

‘একটা সময় তুমি যাকে আমার বোন বলেছিলে সেই কিশোরীই আমার স্ত্রী। আমার ইমম্যাচিউরড বাচ্চা বউ।’

‘স্যার আমি যে আপনাকে ভালোবাসি।’

‘মানুষ দেখছে সাবিহা। ডোন্ট বি আপসেট। পাগলামি করো না। আশা করবো পরেও কোনো রকম পাগলামি করবে না। তুমি আমার থেকেও বেটার কাউকে পাবে আমি এটা বলবো না। আপনি বলবো অপেক্ষা করো দেখবে কেউ একজন আসবে যে তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে।’

পুরো রেস্টুরেন্টে একবার চোখ বুলিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে সাবিহা। তাহমিদের মুখোমুখি আর সে হতে চায় না।কক্ষনো না।

বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মত্ত হলো তাহমিদ। তাহমিদের বন্ধুরা রগড় গলায় বলতে লাগলো,

‘বাব্বাহ্ আমাদের তাহমিদ তো সাচ্চা প্রেমিক পুরুষে পরিণত হয়েছে। আমাদের একটু শিখা প্রেম।’

সবার কথায় বিস্তৃত হাসে তাহমিদ। অপরিচিত একজন তাহমিদ কে ডাকতেই তাকায় তাহমিদ।

‘আপনার স্ত্রী খুব ভাগ্যবতী। আপনি তাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসেন।’

তাহমিদ নিঃশব্দে হেসে বলে,

‘সেক্ষেত্রে আমিও ভাগ্যবান। সেও কিন্তু আমাকে ভালোবাসে। তার কাছে আবেগ মানেই তাহমিদ। ভালোবাসা মানেই তাহমিদ।’

____________________________________________

সন্ধ্যায় বাসার সামনে এসে কপালে ভাঁজ পড়ে তাহমিদের। দরজায় এখনো তালা ঝুলছে। তারমানে এখনো নাযীফাহ বাসায় আসেনি।নাকি নিতুদের বাসায়। কোনো কিছু না ভেবেই সে নিতুদের বাসার কলিংবেল চাপলো। দরজা খুললো নিতুর মা।

‘এতোক্ষণে মিয়া বিবির আসার সময় হলো। তা দু’জন ঘুরতে গিয়েছিলে নাকি?’

‘নাযীফাহ আসেনি ভাবি?’

‘না তো, আসলে কি বলতাম নাকি। আমি তো ভাবলাম দু’জন হয়তো একসাথে ঘুরাঘুরি করতেছো।?

তাহমিদ চিন্তিত মুখে নিতুর মায়ের কাছ থেকে চাবি নিয়ে বাসায় এলো। বাসায় প্রায় ঘন্টা খানিক অপেক্ষা করলো।কিন্তু নাযীফাহ’র আসার কোনো নামগন্ধ নেই। আর সময় নষ্ট না করে সে বেরিয়ে পড়লো। এক এক করে কলেজ, কলেজের আশপাশ, কোচিং সেন্টারের আশপাশ খুঁজা শেষ। কোথাও নেই নাযীফাহ। তাহমিদের বড্ড নিজেকে অগোছালো আর পাগল পাগল লাগছে। এতোটা অসহায় সে আগে বোধ করেনি। কোনো বিপদ হলো না তো নাযীফাহ’র। নাযীফাহকে খুঁজে পাচ্ছে না এই খবরটা বাড়িতে জানাতেও তাহমিদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে। কি বলবে সে ফোন দিয়ে? ফুটপাতেই বিষাদভারাতুর, থমথমে মুখ নিয়ে বসে রইলো। অকস্মাৎ তাহমিদ পকেট হাতে মোবাইল ফোন বের করলো। কল লিস্টে গিয়ে জান্নাতের নাম্বার খুঁজতে লাগলো। কল লিস্ট দূরে থাক জান্নাত নামে কোনো নাম্বারই সেভ নাই। নাযীফাহ’র পার্সোনাল মোবাইল না থাকার কারনে মাঝে মাঝে তাহমিদের মোবাইল দিয়েই জান্নাতের সাথে কথা বলতো। তাহলে কই গেলো নাম্বার? মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে সে। কি করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য সে আপাতত। কিছু একটা মনে পড়তেই কাকে যেন কল করলো। ওপাশে ফোন রিসিভ হতেই তাহমিদ বলল,

‘শাওন ভাই নাযীফাহ’র সাথে যে জান্নাত থাকে তার নাম্বার আপনার কাছে আছে?’

এই রাতে বউয়ের বান্ধবীর মোবাইল নাম্বারের সন্ধান করাতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে শাওন সাহেবের।

‘হঠাৎ জান্নাতের নাম্বার কি দরকার?’

তাহমিদ মেঘমেদুর, নিস্তেজ গলায় বলল,

‘আমি নাযীফাহ কে পাচ্ছি না শাওন ভাই। অশান্তি লাগছে আমার। সেই কখন থেকে এখানে ওখানে খুঁজেই চলেছি। কোথাও নেই আমার নাযীফাহ। আমার নাযীফাহ’র কোনো ক্ষতি হলো না তো?’

আঁতকে ওঠেন তিনি। ঢাকা শহর কারো নিখোঁজ হওয়া মানে,,,,। না এমনটা যেন না-হয়।

‘ হায় আল্লাহ কি বলছো?’

‘হুম শাওন ভাই। জান্নাতদের বাসায়ও গিয়েছিলাম। আংকেলের নাম নিতেই বলল, লাস্ট মান্থে নাকি বাসা চেঞ্জ করেছে। নতুন বাসা কোন এরিয়ায় আমি জানি না। আমাকে একটু সাহায্য করেন না।’

‘আমি তো পার্সোনাল মোবাইলে কোনো স্টুডেন্টের নাম্বার রাখি না।যেই মোবাইলে স্টুডেন্টদের নাম্বার ওই মোবাইল আজ ভুলে কোচিং সেন্টারে ফেলে আসছি। আচ্ছা তুমি এখন কোথায় আছো?’

তাহমিদ ভাঙা গলায় বলল,

‘কোচিং সেন্টার থেকে পনেরো মিনিটের দূরত্বে।’

‘আচ্ছা তুমি থাকো। আমি আসছি।’

____________________________________________

ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা বিশ বাজে। মাত্রই খেতে বসেছে জান্নাতের পরিবার। আর সাথে নাযীফাহ। সবাই খাওয়া শুরু করলেও সে প্লেটে আঙুল নাড়াচাড়া করছিলো। জান্নাত বার বার আড়চোখে নাযীফাহ কে দেখছে। আচমকা জান্নাতের বাবার মোবাইল বেজে উঠলো। উনি বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করলেন।

‘মানুষজন আর ফোন করার সময় পায় না।’

জান্নাতের ভাই বলল,

‘বাবা তুমি বসো আমি নিয়ে আসছি। কোনো দরকারী ফোনও হতে পারে। বিশেষ দরকার ছাড়া কেউ এতোরাতে ফোন করবেনা।’

জান্নাতের ভাই রুমে গিয়ে জান্নাতকে ডাকতে লাগলো,

‘জান্নাত তোর কোচিং সেন্টার থেকে ফোন দিয়েছে। জরুরি দরকার নাকি।’

হাত থেমে যায় নাযীফাহ’র।সে নিশ্চিত এটা তাহমিদ ছাড়া আর কেউ না।চোখ মুখ স্থির হয়ে যায় তার। চোখ বন্ধ করে নিতেই চোখে ভেসে উঠলো দুপুরের দৃশ্য। জান্নাতেরও জানার বাকি রইলো না কে ফোন করেছে। বাবার সামনে অভিনয় করে বলে,

‘ইশ! আজ ভুলে স্যারের শীট গুলো নিয়ে আসছি হয়তো এজন্য ফোন দিয়েছে।’

বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে সবার অগোচরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।

‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে তাহমিদ বলল,

‘জান্নাত কোনো ভণিতা করবে না। শুধু হ্যা আর না বলবে। নাযীফাহ কি তোমার সাথে?’

নিশ্চুপ রইলো জান্নাত।

‘কি হলো জবাব দিচ্ছে না যে? আমার টেনশন হচ্ছে খুব। আশেপাশের সব খোঁজা শেষ। তোমাদের আগের ঠিকানায়ও গিয়েছিলাম। শ্বাস আঁটকে আসছে আমার। বলো না নাযীফাহ আছে নাকি নাই?’

‘আমাদের বাসায় আছে।’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। কিয়ৎকাল নীরব থেকে নিস্তেজ গলায় বলল,

‘আমাকে এভাবে হয়রানি করার মানে কি? নাকি তোমার একরাত থাকার কথা বললে দিতাম না?’

‘এমন কিছুই না।’

‘তাহলে?’

দুপুরের সমস্ত কথা খুলে বলতেই আহাম্মক হয়ে গেলো তাহমিদ।

‘আমার ফুল নেওয়া অব্দিই দেখেছো?’

‘জ্বি।’

‘পুরোটা দেখতে আমি করি।’

‘আমি বলেছিলাম ওকে।কিন্তু শুনেনি। আমাকে ফেলেই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ে। গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্য পাগলামি করছিলো।আমি জোর করে আমাদের বাসায় নিয়ে আসছি।’

‘আমি কি এখন তোমাদের বাসায় যেতে পারি?’

জান্নাত আমতা আমতা করে বলল,

‘আপনি এতোরাতে এখানে এলে বাবা মা নাযু কে খারাপ মনে করবে।ভাববে ঝগড়া করে চলে আসছে। আমি কাল সকাল সকাল নাযীফাহকে নিয়ে যাবো।’

‘তোমার বান্ধবীকে বলে দিও ভবিষ্যতে এমন করার আগে যেন আমাকে খু’ন করে তারপর যায়। অন্যথায় একবুক ভয় নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না।’

রাতে ঘুমানোর আগে নাযীফাহ ইনিয়ে বিনিয়ে হাজার বার জিজ্ঞেস করেছে জান্নাতকে। কিন্তু সে কিছুই বলেনি।শুধু বলেছে, সকালে রেডি থাকিস।

____________________________________________

সকালে বাসার সামনে নাযীফাহকে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় জান্নাত। নাযীফাহ হাজার অনুরোধেও সে আসেনি। তার কাছে মনে হয়েছে কপোত-কপোতীর মান অভিমানের সময় তার থাকা বড্ড বেমানান।

কাঁপা কাঁপা হাতে কলিংবেল চাপে নাযীফাহ। বুক ঢিপঢিপ করছে তার।

ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে আছে তাহমিদ। গায়ে থ্রি কোয়াটারে প্যান্ট আর একটা সেন্ডো গেঞ্জি। সারারাত ঘুমায়নি সে। একটা কথাই তার মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে, ‘নাযীফাহ তাকে অবিশ্বাস করে।’
কলিংবেলের শব্দে ধ্যান ভাঙে তার। দরজা খুলে হাত ভাজ করে দাঁড়ায় সে।

তাহমিদের উসকোখুসকো চুল। লাল আর ফোলা চোখ। মোটকথা বিধ্বস্ত চেহেরা দেখেই বুকের ভেতরপ ছ্যাৎ করে উঠে নাযীফাহ’র। অতঃপর পোশাকের দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নেয় সে। নিঃশব্দে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেই তাহমিদ ডাকে,

‘দাঁড়া।’

পা থেমে গেলো নাযীফাহ’র। তাহমিদের রাগ মিশ্রিত ডাকে আত্মা কেঁপে উঠে তার।

‘আমাকে ঠিক কতটা অবিশ্বাস করিস জানতে পারি কি?’

পিছু ফিরে তাকায় নাযীফাহ। তাহমিদ রুম থেকে গিয়ে মোবাইল আনলো। সার্চ লিস্টে গিয়ে ‘হেডেক’ নামে সেভ করা নাম্বারটায় কল দিলো। বার দুয়েক রিং হওয়ার পরে রিসিভ হলো। লাউডে দিলো তাহমিদ। একটা মেয়েলি কন্ঠ ঘুৃম ঘুম গলায় বলল,

‘আসসালামু আলাইকুম স্যার’

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। কাল যে তুমি আমায় প্রপোজ করেছো, আমি কি তোমাকে একসেপ্ট করেছি?’

ওপাশে নীরব রয় সাবিহা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘তাহলে তো হতোই স্যার। আমার এক তরফা অনুভূতিগুলো পূর্ণতা পেতো। আপনার স্ত্রী খুব ভাগ্যবান। আপনার সবটা জুড়েই শুরু সে। দোয়া করি সুখে থাকেন।’

কল কেটে নাযীফাহ’র দিকে তাকায় সে।নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে সে।

‘অর্ধেকটা দেখে কাউকে বিচার করবি না। দৃষ্টি অগোচরে আরো অনেক কিছু থাকে। তবে আমি বুঝে গেছি তুই আমাকে বিশ্বাস করিস না। ভালোবাসা, সংসার এসবে বিশ্বাসটা খুব জরুরি।’

‘আপনি কি করতেন, যদি দেখতেন পাবলিক প্লেসে কেউ আমাকে ভালোবাসা নিবেদন করছে আর আমি তা সাদরে গ্রহন করছি?’

অকস্মাৎ নাযীফাহ’র প্রশ্নে ভ্রুকুটি করে তাকায় তাহমিদ।

‘জানি না কি করতাম। তবে অবিশ্বাস করতাম না।’

‘ভুল, আপনিও অবিশ্বাস করতেন। আপনার যেমন আমার পাশে কাউকে সহ্য হয় না। আমারও তেমন। বলতে পারেন আপনি সবকিছু বুঝেন।কিন্তু আমি বুঝি না। ওই দৃশ্যটা আমার সহ্য হয়নি তাই পরে কি হয়েছে না দেখেই চলে এসেছি। আমি আপনাকে অবিশ্বাস করি না। করতে পারি না। যে মানুষ আমাকে তার সর্বস্ব দিয়ে আগলে রেখেছে। যে আমার জন্য নিজের জী’বন পর্যন্ত দিতে পারে তাকে অবিশ্বাস করার ক্ষমতা আমার নেই। আমার রাগ হয়েছিলো। খুব রাগ। আপনি কেন তার থেকে ফুলগুলো নিলেন। হারানোর ভয় কিন্তু সব প্রাণীরই থাকে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই।’

তাহমিদের বক্ষঃস্থল থেকে নির্গত হয় দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

‘আমার চাকরি কনফার্মেশন হয়েছে আজ। শুধু আমার না আমাদের ব্যাচের অনেকেরই হয়েছে। আবার কেউ কেউ চাকরির জন্য চেষ্টা করছে। চাকরি জীবনে পা দিলে কবে না কবে আবার দেখা হয় সেজন্য আজ বন্ধু বান্ধবেরা গট টুগেদারের আয়োজন করেছিলাম। ভেবেছিলাম সারারাত তোকে পুরো ঢাকা শহর নিশাচরের মতো ঘুরবো।এর আগেই সব ভেস্তে গেলো। নেক্সট মান্থে আমার জয়েনিং তাও চট্টগ্রামে। কোম্পানির সাব ব্রাঞ্চে। পারফরম্যান্স ভালো ছয়মাস পরে ঢাকার মেইন ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার করবে। ভালোই হল বল? এই খারাপ মানুষটাকে আর দেখতে হবে না।’

অবাক হয়ে তাহমিদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নাযীফাহ। কি বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। এই মানুষটাকে না দেখে নাকি ছয়মাস থাকতে হবে? কালরাতটাই তো বহু কষ্টে কাটিয়েছে সে।

‘পরের সপ্তাহে মা বাবা আর দাদি আসবে। আমি যতদিন থাকবো না মা বাবা এখানেই থাকবে তবে বাবা গ্রামে আসা যাওয়ার মধ্যে থাকবে। যেহেতু জমিজমা গ্রামে।’

নাযীফাহ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে। তাহমিদ রুমের দিকে পা বাড়িয়েও ফিরে আসে।

‘তাহমিদ শুধু তার বউকে ভালোবাসে। আর কাউকে না। তাহমিদের অন্তর্দেশে শুধু তারই আধিপত্য।’

অশ্রুসিক্ত নয়নে ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো নাযীফাহ’র।

____________________________________________

দুজনের নীরব মান অভিমান চলছে। তাহমিদ কথা বলে না নাযীফাহ’র সাথে। নাযীফাহ আগ বাড়িয়ে বললেও না। কয়েক বার সরিও বলেছে। কিন্তু কাজ হয়নি। পরীক্ষা আর রেজাল্টের মাঝামাঝি সময়টা বাসায় আছে নাযীফাহ। একটু একটু মোটামুটি সংসারের সব কাজই আয়ত্তে চলে এসেছে তার। ওয়াহিদার কাছ থেকে শেখা রান্না গুলো একটা একটা চেষ্টা করে ঠিকঠাক রান্নার জন্য। তাহমিদের সামনে দিলে সে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া জানায় না। চুপচাপ খেয়ে চলে যায়।

নিজের মতো করে গরুর মাংসের কষা করেছিলো সে। তাহমিদ কে দেওয়ার পর বিনাবাক্যে খেয়ে চলে যায়। নিজে যখন মুখে নিলো বুঝতে পারলো ঝালের জন্য এটা বি’ষে পরিণত হয়ে গেছে। অশ্রুসিক্ত চোখে তাহমিদকে গিয়ে বলল,

‘কে বলেছে এতো ঝাল আপনাকে খেতে? আপনার তো বেশি ঝাল সহ্য হয় না। এখন পেট খারাপ হবে।

তাহমিদ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল,

‘আমি কি খাবো না খাবো এটা নিশ্চয়ই কাউকে কৈফিয়ত দিবো না?’

নাযীফাহ পুনশ্চ বলল,

‘আপনি এমন কেন করছেন তাহমিদ ভাই? আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলেন না। আমার কষ্ট হয় তো।’

‘আমি কিছুই করছি না। দরজা আটকা আমি এখন বাহিরে যাবো।’

ঝাপসা চোখে নাযীফাহ তাকিয়ে রইলো তাহমিদের যাওয়ার পথে।

ওয়াহিদা, জামান সাহেব আর আমেনা বেগম এসেছেন ঢাকায়। বাসায় ফাহিমও এসেছে।কারন আগামীকালই তাহমিদ চট্টগ্রাম যাবে। ঢাকায় আসার পরই ওয়াহিদা দু’জনের মতিগতি দেখছেন। কেউ কারো সাথে কথা বলে না। তিনিও কিছু বলতে পারছেন না। মা হয়ে ছেলে আর ছেলের বউয়ের সাথে এসব নিয়ে কথা মানায় না। তাছাড়া কিছু কিছু ব্যপার স্বামী স্ত্রীর নিতান্তই ব্যক্তিগত। অভিমানে ভালোবাসা বাড়ে।

সকাল আটটা পনেরোয় ট্রেন। তাহমিদের সবকিছু গোছানো শেষ। এখনই রওনা হবে। স্টেশন অব্দি তাহমিদ বাবা আর ভাইয়ের সাথে যাবে । মা আর দাদির থেকে বিদায় নিলেও নাযীফাহ ‘র থেকে বিদায় নেয়নি সে। নাযীফাহ ভেবেছিল তাহমিদ বিদায় নিতে এলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে। ভালেবাসি বলবে। অভিমান ভাঙানোর সুযোগ পাবে। তার কিছুই হলো না। তাহমিদ বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায় সে। যতক্ষণ পর্যন্ত তাহমিদকে দেখা যায় ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলো সে। ভেবেছিল নিচ থেকে একবার তাহমিদ তাকাবে। চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করবে। আদৌ কি ভালোবাসাময় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলো তাহমিদ?

#চলবে