হৃদয়াবেগ পর্ব-২৫

0
485

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ২৫ (বোনাস)
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

আসলেই তো তার মাথায় তো এই প্রশ্ন উদয় হয়নি কেন তার ভাই বোন নেই? কেন একমাত্র সন্তান হওয়া সত্বেও বাবা তাকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলো? তাহমিদ পুনশ্চ জিজ্ঞেস করলো,

‘কখনো এই প্রশ্ন মাথায় আসেনি তাই তো?’

নাযীফাহ না বোধক মাথা নাড়ে।

‘তুই মামুর কততম সন্তান জানিস?’

নাযীফাহ চোখ পিট পিট করে বলল,

‘কততম আবার আমিই তো প্রথম।’

তাহমিদ মলিন, বিষন্ন হাসলো।

‘পঞ্চম সন্তান তুই। তোর বড় আরো চারজন ছিলো।’

বিস্মিত লোচনে তাকায় নাযীফাহ। দু’লাইনের কথা যেন তার হজম হচ্ছে না। দৃষ্টির ভাবভঙ্গি বলে দিচ্ছে চক্ষুদ্বয়ে হাজার প্রশ্ন। এই প্রথম কোনো চরম সত্যির মুখোমুখি হচ্ছে সে। বিষাদভারাতুর, বিবর্ন, থমথমে গলায় তাহমিদ পুনশ্চ বলল,

‘আমার জন্মের কয়েকমাস পরে মামি প্রথম সন্তানের জন্ম দেন।অদৃষ্টের কি পরিহাস জানিস? জন্মানোর এক ঘন্টা পরেই সে মা-রা যায়। মামিকে শান্ত করা যাচ্ছিলো না কিছুতেই। কেবল আমি তার কাছে থাকলেই একটু শান্ত থাকতো। মা তোদের বাড়িতে থাকে আমাকে নিয়ে পুরো ছয়মাস। ছয়মাস পরে মামি আবারও কনসিভ করে। এবারও ভাগ্য সহায় ছিলো না। প্রেগন্যান্সির চার মাসের মাথায় মিসক্যারেজ হয়ে যায়। সেই সময়টায় মামিকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে রাখা হতো। পরে ডাক্তার মামুকে কড়াকড়ি নিষেধ করে বেবির জন্য যাতে ট্রাই না করে। মামি যেন মেন্টাললি আরো স্ট্যাবল হয়। এসব কিছুই আমার অবগত ছিলো না।মায়ের মুখে শুনেছি। তবে তৃতীয় জনের সময় আমি কিছু কিছু বুঝতাম। তখন মনে হয় আমি ছয় বছরের। আবারও তোর একটা বড় ভাই হয়। সেদিন দেখেছিলাম মামিকে প্রাণখোলা হাসতে। প্রসব ব্যথা যেন ভুলে গিয়েছিল বাবুর মুখ দেখে। তবে ভাগ্য এবারও সহায় ছিলো না। পনেরো দিনের মাথায় হুট করে গলায় বান পড়ে মা’রা যায় সে। মামি যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়। আর মামু ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়লেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মামিকে আগলে নিয়েছিলো। মামি জানালার ধারে বসে অপলকহীন তাকিয়ে থাকতো বাইরে। আমাকে দেখলেই জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের ন্যায় ফুঁপিয়ে কাঁদত। এরপর ফাহিম হলো। ফাহিমের তখন সম্ভবত দশ মাস। মামি আবারও কনসিভ করলো। তবে এবার মামিকে জানানো হয়নি। মামির বোধ শক্তি ছিলো না। অনুভূতিহীন মানবীতে পরিনত হয়েছিল মামি। মামু শুধু আড়ালে কাঁদত। দুই মাসের মাথায় আবারও মিসক্যারেজ। মামি দুই দিন হাসপাতালে ছিলো। আমার এখনো মনে আছে হসপিটালের বেডে শুয়ে মামি মামুর হাতটা নিজের পেটের উপর রেখে বলেছিল, ‘এখানে আরো একজন ছিলো তাই না? কি এমন পাপ করেছি আমি? আমার সাথেই কেন এমন হচ্ছে?’ ডাক্তার বলেছিলো বেবির জন্য আর চেষ্টা না করে। মামির জীবন হু’মকির মুখে পড়বে। মামি মামুকে বলেছিল,

‘আমি তোমাকে সন্তান দিতে অপারগ। আমি তোমার সাথে থাকলে কখনো পিতৃত্বের স্বাদ নিতে পারবে না। তুমি বরং আবার বিয়ে করো।’

মামু সেদিন কিছু না বলে মামিকে জড়িয়ে ধরে শুধু কেঁদেছিল। এরপর তুই পেটে এলি। এটা পুরো অজ্ঞতাবশত। মামির লাইফরিস্ক আছে শুনে মামু বার বার এবোর্শনের কথা বলতো। মামি বাধ্য হয়ে আমাদের বাড়িতে ছিলো প্রায় তিনমাস। ওই তিনমাস মামু আমাদের বাড়ি থেকে তোদের বাড়ি শুধু যাতায়াত করতো।কিন্তু মামি রাগে অভিমানে কথা বলতো না। একটা সময় পর মামু ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল মামিকে নিয়ে গেলো। মামির যখন প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয় মামির মামুর হাত ধরে বলেছিলো,

‘আল্লাহর দরবারে শুধু দোয়া করেন আমরা যেন সুস্থ সবল অবস্থায় ফিরতে পারি। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।’

এবার ঘটেছিলো মিরাকল। দুইজনই সুস্থ ফিরলি। তবে মামু বলেছে তার আর সন্তানের দরকার নেই। একজনই আলহামদুলিল্লাহ। সন্তানের মতো সন্তান হলে একজনই যথেষ্ট। বড় হলে পড়াশোনা করে তুই নাকি চাকরি করবি তাদের দেখবি।

এমন পড়াশোনা করে দেখবি তুই? এই যে তুই গ্রামে থাকা কালীন এর গাছ ওর গাছ থেকে চুরি করতি কয়জন বিচার নিয়ে আসতো? হাতে গুনা কয়েকজন। কারন মামু এর মূল্য পরিশোধ করে দিতো মামু।’

কথা শেষ করে তাকালো তাহমিদ নাযীফাহ’র দিকে। ফুঁপিয়ে চলেছে সে। অর্ধেক শুনেই এই অবস্থা বাকি অর্ধেক শুনলে কি করবে? তবে আজ সে বলবে। কিছু কিছু কথা চেপে রাখা যায় না।

‘এখনই বন্যা করলে তো হবে না। আমার কথা এখনো বাকি।’

‘আমি আর কোনো মন খারাপের কথা শুনবো না।’

‘তবে আজ যে আমি বলবোই। বছর দুয়েক আগে যে মামু খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় ঢাকা নিয়ে আসছিলাম তোর মনে আছে?’

নাযীফাহ ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে,

‘হুম মনে আছে। বাবা খুব অসুস্থ হয়ে গেছিলো।’

‘মামুর একটা কিডনি বিকল।’

বিস্মিত চোখে তাকায় নাযীফাহ। না এবার আর নিজেকে সামলাতে পারবে না সে।দেহ কেমন অসাড়, নিশ্চল হয়ে গেছে। নাযীফাহ’র নিভু নিভু চোখ দেখে দ্রুত এগিয়ে এলো তাহমিদ। তাহমিদ কে চোখের সামনে দেখে শক্ত করে জাপটে ধরলো সে। একটা ভরসার স্থান দরকার ছিলো তার। যেখানে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দিতে পারবে। এই প্রশস্ত বুকটাই তার শান্তির জায়গা।

‘মানুষ একটা কিডনি দিয়ে চলতে পারে। তবে আরেকটা তো নাই তাইনা? তখন থেকে মা আর মামু সিদ্ধান্ত নেয় তোর সাথে আমার বিয়ে দিবে। হয়তো মামু আমাকে যোগ্য মনে করেছে। নয়তো ভেবেছে তুই আমার কাছে থাকলে সে নিশ্চিন্তে থাকবে।’

‘আমি বাবার সাথে একটু কথা বলবো।’

‘না, এখন কোনো কথা না।মামু বুঝে যাবে আমি তোকে সব বলে দিয়েছি।মামুর কড়া নিষেধ ছিলো তোকে যেন কিছু না বলি।’

তাহমিদের বুকটাকে আঁকড়ে ধরে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে নাযীফাহ। নাযীফাহ’র কান্না নিস্বন শুনে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন আমেনা বেগম। এসেই দেখলেন নাযীফাহ তাহমিদের সাথে লেপ্টে আছে। তাহমিদ আর আমেনা বেগমের দৃষ্টি বিনিময় হতেই তিনি চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? তাহমিদ আস্বস্ত করলো যে কিছুই হয়নি।

তাহমিদ নাযীফাহকে স্বাভাবিক করার জন্য বলে,

‘চিন্তা কর চারজনের পর তুই টিকলি শুধু আমাকে জ্বালানোর জন্য। সারাজীবনের মতো আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে খাওয়ার জন্য।’

____________________________________________

ইন্টারে ভর্তি হলে প্রথম বর্ষে সময় পেলেও দ্বিতীয় বর্ষ চোখের পলকে চলে যায়। আসলেও তাই হাতে গুনা দিনগুলো কেমন করে এক এক করে ক্যালেন্ডার থেকে বিদায় নেয়। ছিটকে পড়ে হিসেবের খাতা থেকে। এইতো ক’দিন আগে প্রথম বর্ষের সমাপনী পরীক্ষা দিলো। আর এখন নির্বাচনী পরীক্ষা। উত্তীর্ণ হলে বসা যাবে বোর্ড পরীক্ষায়। কতগুলো দিন চলে গেলো জীবনের খাতা থেকে। ঢাকা শহর মোটামুটি পরিচিত নাযীফাহ। এখন একা একা কোথাও গেলে সমস্যা হয়না। তাহমিদেরও এমবিএ কমপ্লিট। চাকরির চেষ্টা করছে। আজ নাযীফাহ’র নির্বাচনী পরীক্ষার শেষ দিন তাই জান্নাত আর নাযীফাহ প্ল্যান করেছে আজ দুপুরে রেস্টুরেন্টে খাবে। সবচেয়ে বড়কথা হলো আমেনা বেগম কয়েকদিনের জন্য গ্রামে গেছে। আর তাহমিদ বলেছে আজ পরীক্ষা শেষে নিতে আসবে না।কাজ আছে নাকি।

রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে মাত্রই রেস্টুরেন্টে ঢুকলো নাযীফাহ আর জান্নাত। তবে সামনের দৃশ্য দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না দু’জন। ভরা রেস্টুরেন্টে একজন মেয়ে তাহমিদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ভালোবাসা নিবেদন করছে আর তাহমিদ মুচকি হেসে ফুল গুলো গ্রহন করলো। হাত খামচে ধরলো নাযীফাহ জান্নাতের। চক্ষুদ্বয়ে বারিবিন্দুর আনাগোনা। এইতো বর্ষন হবেই তুমুল বেগে। জান্নাতও যেন বিশ্বাস করতে পারলো না ব্যপারটা। নাযীফাহ জান্নাত কে শান্ত গলায় বলল,

‘আমার শরীরে আর বিন্দু পরিমাণ শক্তি নেই। খাওয়ার ইচ্ছেও মাটি হয়ে গেছে। চল চলে যাই।’

জান্নাত নাযীফাহ’র হাতটা ধরে আস্বস্ত করে বলল,

‘আর একটু দেখ না স্যার কি করে। আমরা যা ভাবছি তা নাও তো হতে পারে।’

‘যাই হোক আমার আর কিছু দেখার শক্তি নেই। বাসায় বলেছেন আজ উনার ইমপোর্টেন্স কাজ আছে তাই নিতে আসতে পারবে না। এটাই সেই কাজ।’

বলেই এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। নাযীফাহ’র পিছু পিছু ছুটলো জান্নাতও। তাহমিদ অন্যকারো থেকে ফুল নেওয়া যে নাযীফাহ দেখে সেটা অজানাই থেকে গেলো তাহমিদের

রাস্তায় এলোমেলো হাঁটছে নাযীফাহ। আশপাশের সবকিছু বি’ষাক্ত মনে হচ্ছে। গাড়ির হর্ণ, জনকোলাহল একেবারে বি’ষিয়ে তুলছে। একটা শান্ত নির্জন পরিবেশ দরকার যেখানে একটু কান্না করা যাবে। একটু হালকা হওয়া যাবে।

#চলবে