হৃদয়ের ছোঁয়া পর্ব-১১

0
253

#পর্ব১১
#হৃদয়ের_ছোঁয়া
#অর্ষা_আওরাত

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের আভা ফুটে ওঠেছে চারদিকে। রৌদ্রজ্বল আকাশ এখন সচ্ছ পরিষ্কার। পাখিরা কিচির মিচির করে ডেকে জানান দিচ্ছে একটু পরেই বিকেলের শান্তময়ী রুপ কেটে গিয়ে হয়তো ধরনীর বুকে রাত্রি নেমে আসবে। এখনো কোনো কথার শেষ হয়নি গলির মোড়ে থাকা দোকানটির ভেতরের মানুষগুলোর। হৃদয়ের মনে প্রশ্নগুলো যেনো আর জট পাকিয়ে এক জায়গায়ই ঘুর পাক খাচ্ছে। শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না! ছোঁয়া কথা বলার জন্য কোনো বাক্য খুজে পাচ্ছে না! ছোঁয়া তো সব সত্যিই বলেছে তাহলে সামাদ কেনো বলছে অর্ধেক সত্যি? তাহলে কি আরো কোনো কিছু লুকিয়ে আছে এর পিছনে যা ছোঁয়ারও অজানা? ছোঁয়া দৃঢ় গলায় বলে ওঠলো,

–“আমি যা বলেছি বিন্দু পরিমানও মিথ্যা নাই। যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে এতো ভণিতা না করে আপনি সোজাসুজি বলে দিন কি বলতে চাচ্ছেন?”

তুমি যখন কিছুই বুঝতে পারছো না তাহলে কিছু কথা তোমাকে বুঝিয়ে দিই যা তুমি আদৌও বুঝোনি হয়তো।

–“সেদিন রাত্রেবেলা আমার এক বন্ধুর বিয়ে ছিলো। তাই সেই উপলক্ষেই আমরা ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম পার্টি করার জন্য। সেখানে আমরা সবাই একরকম ড্রেস পড়েছিলাম কালো রঙের আর মুখে মাস্ক পড়েছিলাম। পার্টিতে আমি কিছু খাবার আনতে যাই আর খাবার আনার আগে সাদাফ ওরা ড্রিংক করছিলো দেখেছিলাম। ওইদিন বৃষ্টির কারনে আসতে একটু দেরি হয়। যখন আসলাম তখন আলো ছিলো না অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিলো পুরো বাড়িটা হঠাৎই আমাকে পিছন থেকে কেউ ধাক্কা মেরে একটি মেয়ের উপর ফেলে দেয় আমি কিছু বলবো এর আগেই মেয়েটি চিৎকার করে মানুষ জড়ো করে ফেলে। যখন লোকজন আসলো আলোয় আমার সঙ্গে থাকা সাদাফ বা কাউকে দেখিনি আর। ঘটনা বোঝার আগেই সবাই মিলে আমাকে প্রচুর মারধর করে এবং শেষমেশ আমাকে পুলিশে দেয়। জেলেও গিয়েছিলাম তারপর অনেক কষ্টে আব্বুর সাহায্য জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসি। আর কেউ বিশ্বাস না করলেও ওইদিন আব্বু আমাকে বিশ্বাস করেছিলো। তারপর ঘটনা জানাজানি হতে দেয়নি আব্বু। কিন্তু ওইদিন আমি ছোঁয়াকে বারবার বলছিলাম আমি ওর সাথে কিছু করিনি। কেউ বিশ্বাস করেনি ওইদিন আমার কথা। আমার সাথে থাকা বন্ধুগুলোও না। তারা সবটা জেনেও আমার কথা বিশ্বাস করে নি সেইদিন বেইমানী করে নিজেদের বাঁচাতে ওইদিন চলে গিয়েছিলো আমাকে ছেড়ে। যার ফলস্বরূপ আমি মার খেয়ে বিনা দোষে হাজতবাস করি শুধুমাত্র ছোঁয়ার জন্য! এই হলো পুরো কাহিনী হৃদয় আর কোনো প্রশ্ন আছে এবার?”

উপস্থিত হৃদয় বা ছোঁয়া কারোরই কোনো কথা নেই আর। প্রত্যেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলো এবার সবটাই ভুলবোঝাবুঝি হয়েছে। ওইদিন সামাদ কিছু করেনি ছোঁয়ার সাথে। ছোঁয়া ভুল বুঝেছিলো সবটা। ছোঁয়া লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে। তার ভুলের কারনে সামাদকে এতোকিছু পোহাতে হয়েছে। নিজেরই নিজেকে দেখে লজ্জা লাগছে। কেউ কিছু বলার আগেই সামাদ আবারো বলে ওঠলো,

–“সাদাফই সেদিন শ্লীলতাহানি করতে চেয়েছিলো ছোঁয়ার আমি নই। আমাকে মিথ্যা দোষে দোষী বানিয়েছে তোর বউ। পরে সাদাফের বিরুদ্ধে আমি কিছু প্রমান জোগাড় করি এবং ও কিছুদিন আগে আবারো জেলে গিয়েছে একটি মেয়েকে উক্তত্য করার অভিযোগে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে খোঁজ নিয়ে দেখিস বা আব্বুকে জিগেস করে দেখিস। তো এবার বল আমার দোষ কি ছিলো?”

এবার ছোঁয়া ডুকরে কেঁদে ওঠলো! লজ্জায় মাথা নিচু রেখেই সামাদকে বললো,

–“আমি হাত জোর করে ক্ষমা চাইছি আপনার কাছে ভাইয়া। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। ওইদিন আপনারা সবাই এক রঙের জামা পড়েছিলেন বলে আমি চিনতে পারিনি কাউকে। সাদাফকে যখন আমি আহত করি তখন কিছু সময়ের জন্য ও আমার থেকে দূরে যায় এবং যখনি আলো আসে তারপর আমি আপনাকে দেখি এবং ভাবি আপনিই সেই লোক। তাই চিৎকার করে লোক জড়ো করি। পুরোটাই আমার ভুল বোঝার জন্য হয়েছে। এতে আপনার কোনো দোষ নেই। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিবেন।”

–আর কোনো কিছু না বলে ছোঁয়া মাথা নিচু করে রইলো।হৃদয় সামাদকে বলে ওঠলো,

–“এখন তো সবটাই শুনলাম পুরোটা হয়েছে একটা ভুল বোঝার কারনে। এতে ছোঁয়ার কোনো দোষ নেই রে। ও নিজেকে বাঁচাতে মানুষ জড়ো করে ছিলো। শুধু ছোঁয়া না ওর জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এটাই করতো। ও বুঝতে পারিনি ওটা তুই ছিলি না। আর তোর বন্ধুরা যদি তোর পাশে থাকতো সত্যি বলতো তাহলেও হয়তো এতোদূর অব্দি গড়াতো না কোনো কিছু। যাই হয়েছে তুই ভুলে যা? ছোঁয়ার হয়ে আমিও তোর কাছে ক্ষমা চাইছিরে তুই ক্ষমা করে দিস ছোঁয়াকে। অতীত ভুলে নতুন করে বাচঁ। আবারো বলছি ছোঁয়াকে ক্ষমা করে সবটা ভুলে যা।”

–“হৃদয় ওরা আমার নাম মাত্রই বন্ধু ছিলো। এর ভিতরে দু’জন রাকিব আর অন্তু সাহায্য করেছিলো আমাকে আর সাদাফ আর অয়ন ওদের আর তারপরে খুঁজে পাই নি। তুই ঠিকই বলেছিস হয়তো ওর জায়গায় অন্য কেউও থাকলে এটাই করতো। সাদাফদের বেঈমানির কারনেই ছোঁয়া আরো বেশি ভুল বুঝেছিলো আমাকে। পরিশেষে জীবনকে আর তিক্ত করতে চাই না। ছোঁয়া তোর ভালোবাসা হৃদয় ওর কষ্টে, আঘাতে তুই কষ্ট পাস এটা আমি একদিনে বুঝে গিয়েছি ভালো করে। যতোই হউক আমি তোকে কষ্টে রাখতে পারি না। তুই ভালো থাকিস ছোঁয়াকে নিয়ে আর ক্ষমার কিছু নেই। পারলে আমাকেও তোরা ক্ষমা করে দিস তোদের বিয়েতে ব্যাঘাত ঘটাবার জন্য।”

সবার মুখে হাসির রেখা দেখা দিলো। অবশেষে সকল ভুলবোঝাবুঝির সমাপ্তি ঘটলো। কিন্তু সমাপ্তি বললেই এতো সহজে সমাপ্তি হয়? সামাদ সোহার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখে চোখ রেখে কাঠ গলায় বলে ওঠলো,

–“সবচেয়ে অপরাধী তো তোমার কাছে আমি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি প্রতিশোধের নেশায় নিজেকে ভুলে গিয়ে তোমার সাথে কেবল ভালোবাসার নাটক করে গেছিলাম তোমার আপুর ক্ষতি করতে। এই কারনেই তোমার সাথে বলতে পারো একপ্রকার নাটকই করেছি আমি। এখন তোমরা যে যার মতন সুখে থেকো আমি কারোর ক্ষতি করবো না আর। আমি ভালোবাসি না তোমাকে সোহা! পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও দয়া করে। আমাকে ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করো। ভুলে যেও সামাদ নামে কেউ ছিলো। সামাদের অস্তিত্ব মুছে ফেলে এগিয়ে যাও নতুন উদ্যমে।”

–কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামাদ দরজা খুলে সেই জায়গা থেকে নিজেকে প্রস্থান করলো! সোহা কোনো কিছু বলছে না হয়তো বলার মতন শক্তি অবশিষ্ট নেই তার মধ্যে। যাঁকে ভালোবেসেছে সে শুধুমাত্র তাকে ব্যবহার করে গেলো নিজের প্রতিশোধের জন্য! হয়তো সবটা শ্রবন করে কিয়ৎক্ষনের জন্য মনে হয়েছিলো সকল ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে সবটা নতুন করে শুরু হবে। কিন্তু সোহার ধারনা ভুল প্রমানিত করে সামাদ চলে গেলো। কিন্তু সোহা সামাদকে সত্যিই ভালোবেসেছিলো যার দরুন এখন সামাদের বলা কথাগুলো শুনে তার হৃদমাঝারে কষ্টের ঝড় বয়ে যাচ্ছে! কষ্টগুলো কান্নায় রুপান্তর হয়ে গাল বেয়ে অশ্রু ঝড়ো যাচ্ছে। সামাদের যাবার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সোহা! হৃদয় আর ছোঁয়া চুপচাপ ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছোঁয়া সোহার কাঁধে হাত রাখতেই সোহা চিৎকার করে কেঁদে ওঠলো! ছোঁয়া সোহাকে কাঁদতে মানা করলো না! কষ্টগুলো কান্নায় রুপান্তর হয়ে ঝড়ে যাক একেবারে। এই কান্নায়ই যেনো শেষ কান্না হয় সামাদের জন্য।

#চলবে?
বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।