হৃদয়ের ছোঁয়া পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
699

#পর্ব১৪
#হৃদয়ের_ছোঁয়া
#অর্ষা_আওরাত

সেদিন সামাদ চলে যাবার পর আজ দেড়বছর হয়ে গেছে। এখন সোহা নিজেকে অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছে। নিজের পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী হয়েছে যার ফলে সামাদকে ভুলতে অনেকটাই কার্যকর হয়েছে সে। সামাদ এর বিয়ে হয়েছে দু মাস হবে। সেদিন এর পর থেকে আর একবারের জন্য ও সামাদ সোহার সামনে যায়নি। সামাদের বিয়ে পরিবারের থেকেই ঠিক করা হয়েছে। সবশেষে সামাদ বিয়ে করে এখন সুখেই রয়েছে। সেদিন বিয়ের দিন রাত্রেবেলা সামাদ ফোনে যার সাথে কথা বলছিলো সেটা অয়নই ছিলো! তার সম্পূর্ন বুদ্ধিতেই সামাদ এসব কান্ড ঘটিয়েছে! সাদাফ যে আসল দোষী সাদাফকে সাহায্য করতেই অয়ন সামাদকে উসকে দিয়েছিলো ছোঁয়ার বিরুদ্ধে যাবার! সামাদও প্রতিশোধের নেশায় অয়নের সব কথা শুনেছে। কিন্তু পরবর্তীতে অয়নও ছয়মাস আগে তার কর্মের জন্য জেলে গিয়েছে। শাস্তি পেয়েছে তার কৃর্তকর্মের। সোহাও সুখেই আছে বলা যায় কারন তার ভালো থাকার ওষুধ হয়তো সে পেয়ে গেছে তাই। আর অন্যদিকে হৃদয় আর ছোঁয়ার জীবনে আগমন ঘটতে চলেছে নতুন অতিথির। ছোঁয়ার প্রেগন্যান্সির নয় মাস চলছে হয়তো কিছুদিনের ভিতরেই নতুন অতিথির আগমন ঘটবে।

দুপুরের রৌদ্রের উত্তাপ গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। পাখিরা কিচিরমিচির করে মধুর সুরে ডেকে ওঠছে বারংবার। ধরনীতে শান্ত, নিস্তব্ধ রূপ ধারন করেছে। পার্কের মধ্যে বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছে সোহা কারো জন্য। সে মানুষটি এখনো আসে নি বিধায় তাকে শক্ত চেয়ারটাতে বসে থেকে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে। হাতে থাকা ঘড়িটি জানান দিলো আধা ঘন্টারও বেশি হয়ে যাচ্ছে সোহা বসে রয়েছে। এবার অপেক্ষায় বিরক্তি ধরে গেলো! চোখ মুখ কুঁচকে বসে আছে সোহা বিরক্তি নিয়ে! এর মধ্যেই আগমন ঘটলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটির যার অপেেক্ষায় সে ছিলো! মানুষটিকে সামনে দেখা মাত্রই তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশো যা কমার বদলে উল্টো বেড়েই যাচ্ছে! অদ্ভুহ শিহরন বয়ে যাচ্ছে সারা শরীর জুড়ে সামনে থাকা প্রিয়কে দেখে। মানুষটি শুভ্র রঙের একটি পাঞ্জাবী পরিহিতো। হাতে একটি ছোটো বাক্স দেখা যাচ্ছে যার ভিতরটায় কি আছে তা বাইরে থেকে দেখা সম্ভব নয়। সামাদের সাথে কখনো সেরম অনুভুতির সম্মুখীন হয়নি সোহা। যেমন অদ্ভুত অনুভুতির সম্মুখীন হচ্ছে সুমনকে তার সামনে দেখে। সুমন এসে সোহার পাশে বসলো। সোহা নিষ্পলক ভাবে কতোক্ষন পর্যবেক্ষন করলো মানুষটাকে। সুমনের মুখশ্রী আনন্দের ঝিলিক! মুখে হাসির রেখা টেনে সোহার উদ্দেশ্য বললো,

–“ম্যাডামের অবশেষে এই দেড় বছরে সময় হলো আমার সাথে একান্তে দেখা করবার। আমি তো ভেবেছি দিবস রজনী আমাকে অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতেই কেটে যাবে। তার দেখা বোধহয় আর পাবো না।”

সোহার মুখশ্রী তে বিরক্তিকর আভাস কেটে গিয়ে ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসির রেখা দিলো সুমনের কথায়। দেরি না করে হাতে থাকা গোলাপ ফুলটি হৃদয়ের সামনে ধরে নয়নযুগল বন্ধ করে বলে দিলো,

-“ভালোবাসি আপনাকে সুমন! এতোদিন উপলব্ধি করেছি সেটা হারে হারে। অতীত ভুলে গিয়ে নতুন করে আপনাকে ভালোবেসেছি আমি। বাকিটা পথ পাড়ি দিতে চাই শুধু আপনারই হাত ধরে আমার ভালোবাসা গ্রহন করবেন তো?”

সুমন হা হয়ে আছে! বিশ্বাসই করতে পারছে না সোহা তাকে ভালোবাসার কথা বলছে! হ্যাঁ এতোদিনে তাদের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে তবে সেটা বন্ধুত্বের দিক দিয়ে সেটা সোহা বলেছিলো। কিন্তু সেটা যে ভালোবাসায় এসে রুপান্তর হবে সেটা সুমন কল্পনাও করেনি। সোহার কথার উত্তর দিতে সুমন বলে ওঠলো,

–“অবশ্যই! তুমি যেমন আমার মনে ছিলে, এখনোও আছো আর ভবিষ্যতেও তুমিই থাকবে নিঃসন্দেহে। অবশেষে আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো সোহা। আমি বলেছিলাম আমার প্রেম সত্যি হলে তুমি আসবে ঠিকই। দেখো আজ সত্যি হলো সেটা তুমি আমার কাছেই আসলে।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~
সোহার বাড়ি পুরো রঙিন আলোয় সজ্জিত হয়েছে। পুরো বাড়িঘর ঝলমলে আলোয় আলোকিতো হয়ে রয়েছে। বাড়ি ভর্তি মানুষজন সবাই বিয়ে বাড়ি উপলক্ষেই সোহাদের বাড়িতে ভীড় জমিয়েছে! সবাই নানান কাজে ব্যস্ত মেহমান দের আপ্যায়ন করবে বলে। আর কিছু প্রহরের অপেক্ষা তার পরেই সুমন আর সোহার বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। কালকে ধুমধাম করে সোহার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান গেছে আজকে একটু পরে বিয়ের কার্যক্রম শুরু হবে। সেই কাজ কর্ম নিয়েই সবাই ব্যস্ত। সোহাও পুরনো বান্ধবীদের সাথে বসে খোশ গল্পে মেতে ওঠেছে। নয় মাসের উঁচু পেটটা নিয়ে একটি চেয়ারে বসে বসে সবার কার্যক্রম লক্ষ্য করে যাচ্ছে ছোঁয়া। খাবারের সুঘ্রান ভেসে আসছে রান্নাঘর থেকে। খাবারের ঘ্রান পেয়েই ছোঁয়ার পেটে ক্ষিদের উপদ্রব হলো। ছোঁয়া খাবার আনতে যেই রান্নাঘরে যাবে বলে চেয়ার থেকে ওঠেছে মাত্র তখনি কারো রুক্ষ কন্ঠস্বরের আওয়াজ পেতেই চেয়ার ধপ করে বসে পড়লো ছোঁয়া! সেই ব্যাক্তিটি আর কেউ না সে হলো হৃদয়। হৃদয় রক্ত চক্ষু করে তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার দিকে ডার অর্থ ছোঁয়া বুঝতে পেরে মিনমিন স্বরে হৃদয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে ওঠলো,

–“তুমি এভাবে তাকিও না। আমার খাবারের ঘ্রানে ক্ষিতে পেয়ে গেছে যে তাই তো আমি ওঠছিলাম খাবো বলে।”
-ছোঁয়ার করুন কন্ঠে খাবারের কথা শুনে হৃদয়ের রাগ গলে যেনো পানি হয়ে গেলো! হৃদয়ও চায় ছোঁয়া এখন প্রচুর পরিমানে খাওয়া দাওয়া করুক। তাই রাগ না করে কোমল স্বরে বললো,

–“তুমি রেগে যেও না। দেখো বিয়ে বাড়িতে অনেক লোকজন আছে তোমার যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে তাই তো আমি এরকম করছি। তোমার যখন ক্ষিদে পেয়েছে আমার সাথে রুমের ভিতরে চলো।”

ব্যস হৃদয় খুব সাবধানে ছোঁয়াকে রুমে বসিয়ে নিয়ে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে নিজ হাতে। ছোঁয়াও বেশ তৃপ্তি করেই খাচ্ছে হৃদয়ের হাতে। কিছুক্ষন পরেই বর এসেছে বলে হাকডাক শোনা গেলো বাহিরে। সোহাকে রেডি করা হচ্ছে। লাল রঙের টুকটুকে বেনারসি শাড়ি পড়িয়ে তার সাথে ম্যাচিং করে অর্নামেন্টস পড়ানো হয়েছে। মুখ ভর্তি ভাড়ি মেকআপ। সোহাকে একদম পুতুলের মতন লাগছে বিয়ের সাজে। তিন কবুল বলার মাধ্যমে সুমন আর সেহার বিয়ে হয়ে গেলো কিয়ৎক্ষন পূর্বে! এবার বধু বিদায়ের পালা। পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠেছে। সবার চোখে মুখে কান্নার ছাপ বিদ্যমান। সোহার বাবা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়ের যাওয়ার পানে। সোহার মা কান্না থামাতে পারছে না। ছোঁয়াও বোনকে বিদায় দিতে এসেছে। বোনকে একটু খানি জড়িয়ে ধরে রেখে তারপর সবার আড়ালে ভীড় মুক্ত জাযগায় গিয়ে দাঁড়ালো। আস্তে আস্তে বিয়ের সাজে গাড়িটি চলে গেলো সোহাকে নিয়ে! সবাই সোহার যাওয়ার পানে সজল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়েছে। ছোঁয়াও দূর থেকেই বোনের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রুমে চলে গেলো।

সব নিয়ম কানুন শেষ করে সোহাকে রুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সোহা অপেক্ষা করছে সুমনের আশার জন্য। সেহার অপেক্ষার প্রহর শেষ করে সুমন দরজা ঠেলে রুমের ভিকরে ঢুকলো। সোহার কাছে যেতেই সোহার ঘোমটা সরিয়র নিজের অধরযুগল সোহার ললাটে স্পর্শ করলো। সোহা লজ্জায় মাথা নুইয়ে রেখেছে। কিছুক্ষন পরেই সোহা সুমনের পা’জোড়ায় সালাম করলো। নিরবতা ভেঙে সুমন বলে ওঠলো,

–“ছাঁদে যাই চলো? আকাশে মস্ত বড়ো সুন্দর একটা চাঁদ ওঠেছে। চারিদিকে চাঁদের সৌর্ন্দয ঢেলে পড়ছে! তুমি যদি চাও আমরা কি আমাদের নতুন জীবন চাঁদটিকে ঘিরে শুরু করতে পারি?”

–সোহা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। সুমনও বুঝে গেলো মৌনতা সম্মতির লক্ষন।
দু’জন মিলে ছাঁদে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো চন্দ্রবিলাস করতে। এখন থেকেই তাদের নতুন জীবনের সুত্রপাত ঘটলো।

হাসপাতালের করিডোরে পাইচারি করে যাচ্ছে সমানতালে হৃদয়! প্রায় দু ঘন্টা যাবত পায়চারি করে যাচ্ছে কেবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে। সবাই বলছে হৃদয়কে চেয়ারে শান্ত হয়ে বসতে কিন্তু হৃদয় শান্ত হয়ে বসতে পারছে না! তার অবচেতন মন শান্ত হতে পারবে না যতোক্ষণ না পযন্ত ছোঁয়া আর তার বাচ্চা সুস্থ ভাবে বেরিয়ে আসে। হ্যাঁ ছোঁয়ার লেবার পেইন ওঠার পরপরই ছোঁয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। করিডোরে বসে থাকা বিদ্যমান সবার চোখে মুখে চিন্তার আভাস। সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে লাল বাতিটি বন্ধ করে একজন নার্স সাদা তোয়ালে করে একটি সদ্যজাত বাচ্চাকে নিয়ে আসলো সবার সামনে! হৃদয় সবার আগে নার্সের কাছে গিয়ে অতি সাবধানে নিজের মেয়েকে নিজের কাছে রাখলো। ডাক্তার বেরোতেই সবার এক প্রশ্ন “ছোঁয়া ঠিকআছে তো?”

ডাক্তার মুচকি হেসে সবাইকে জানান দিলো –“ছোঁয়া একদম ঠিকআছে তিনদিন পর ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন।”

ডাক্তারের কথায় সবার সস্তি মিললো! একে একে সবাই ছোঁয়ার জ্ঞান ফেরার পর ছোঁয়ার সাথে দেখা করতে যায়। সবশেষে হৃদয় তার মেয়েকে কোলে নিয়ে
ছোঁয়ার সঙ্গে দেখা করতে রুমের ভিতরে যায়। মেয়েকে দেখে ছোঁয়া আনন্দের রেশ ফুটে ওঠেছে চোখেমুখে। পরম যত্নে মেয়ের শরীরে আদরের হাত বুলিয়ে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রইলো। হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে হাসোজ্জল মুখ নিয়ে ছোঁয়া বলে ওঠলো,

–“তোমার আর আমার আমাদের দু’জনের অংশ হলো হৃদিয়া। আমাদের ভালোবাসা পূর্নতা লাভ করেছে হৃদিয়া কে আমাদের দু’জনের জীবনে আগমন ঘটিয়ে।এখন থেকে তুমি আর আমি বাবা মা হয়ে গেছি। অনেক দায়িত্ব বেড়ে গেলো তোমার। মেয়েকে সুশিক্ষায় বড়ো করে তুলতে হবে?”

–“হ্যাঁ তা নয় আমরা দু’জনে মিলেই ওকে যথাযথ ভাবে মানুষ করে তোলবো কিন্তু হৃদিয়া? হৃদিয়া ওর নাম! কখন ঠিক করলে তুমি বলো? নামটা বেশ চমৎকার না? তোমার আর আমার নামের মিল পাওয়া যাচ্ছে বেশ।”

হৃদয়ের কথায় এক গাল হেঁসে ছোঁয়া বলে ওঠলো,

–“হ্যাঁ তোমার নামের প্রথম অক্ষর আর আমার নামের শেষ অক্ষর মিলিয়ে ওর নাম রেখেছি। সোহার বিয়েতে যখন আমি বসেছিলাম তখনি নামটা ভেবে রাখি। আর দেখো আজকে আমাদের মেয়েই উপহার দিয়েছে আল্লাহ। আমার নাম ভেবে রাখাটা সার্থক হয়ে ওঠলো।”

ছোঁয়া আর হৃদয়ের কথা বলার মাঝখানে জোরে কেঁদে ওঠলো হৃদিতা! ছোঁয়া মেয়েকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। হৃদয় অপলক দৃষ্টিতে মা আর মেয়েকে দেখে যাচ্ছে। এখন থেকে ছোঁয়ার সাথে আরো একটি নতুন জীবন গেথে থাকবে তাদের জীবনে।
#সমাপ্ত

বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।