হোম পলিটিক্স পর্ব-০৮

0
243

#হোম_পলিটিক্স

#আফসানানীতু

#পর্ব_৮

নাফিসাকে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে দেখে ভীষণ বিরক্ত বোধ করেন সালেহা।
– কিরে নাফিসা! তুই সামান্য কটা জিনিস আনতে গিয়ে একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলি? আর এই দুই আড়াই ঘন্টা বাদে ফিরে এলি তাও খালি হাতে! ব্যাপার কি রে? নাফিসা শুকনো মুখে ঘরে ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে। সে যে শুধু রুচিতাকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছে তাই নয়, তাকে একেবারে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে তারপরে এসেছে। একজন ক্রন্ধনরত মানুষকে সান্ত্বনা দেয়া মানে হচ্ছে খানিক সময়ের জন্য হলেও তার দুঃখের ভার নিজের কাঁধে বহন করা, তাই বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার।
– আর বলো না আম্মা, ভীষণ ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলাম। বেরোতেই পাশের বাসার আপুর সঙ্গে দেখা, ওই যে তোমাকে বললাম না সেদিন শাবানার মত আপুটা…
সালেহা মেয়ের কথায় মাথা নেড়ে জানান তার মনে পড়েছে।
– আমাকে দেখে উনি তো ভীষণ রকম জোরাজোরি করলেন তাদের গাড়িতে করে যেতে, বললেন তার হাজবেন্ড হসপিটালে আছে উনি সেখানে যাচ্ছেন যাওয়ার পথে আমাকে স্টোরে নামিয়ে দিয়ে যাবেন। আমি ভাবলাম ভাড়াটা বাঁচাতে পারলে সমস্যা কই? কিন্তু ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়ে দেখি সেটা তখন বন্ধ। উনি বললেন, আমার সঙ্গে চলো তোমার ভাইয়াকেও দেখে আসবে আবার ফেরার পথে না হয় তোমাকে অন্য কোন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে নিয়ে যাব।

কথার এই পর্যায়ে সালেহা তার মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে তীব্র কণ্ঠে বললেন,
– আর তুই অমনি তাদের সঙ্গে গাড়িতে চড়ে বসলি? তোর এত সাহস কোত্থেকে হয় নাফিসা? মাত্র পরিচয় হয়েছে যে মানুষটার সঙ্গে তার সঙ্গে টপ করে গাড়িতে উঠে চলে গেলি? কোন বিশ্বাস আছে যে সে তোকে জায়গা মত নিয়ে যাবে? যদি তোকে অন্য কোথাও নিয়ে যেত? তাদেরকে পার্সোনালি চিনিস তুই?
– ধুর আম্মা, তুমি না সব কিছুতেই বেশি বেশি ভয় পাও!
– মোটেই না! আমি এমন অনেক ঘটনা জানি বলেই তোকে সাবধান করছি। দেখ, তুই বড় হচ্ছিস। তোকে এসব ব্যাপারে আরও বেশি সাবধান হতে হবে।
– আচ্ছা হলো তো! এখন পুরোটা বলতে দাও।
নাফিসা এরপর পুরো ঘটনাটা সালেহাকে খুলে বলে। তাই শুনে সালেহা খানিকক্ষণ কি যেন ভাবেন, তারপর মেয়েকে বলেন,
– বেচারি তাহলে ভালো ঝামেলাতেই পড়েছে,তাই না?
– হ্যাঁ। উনি তো বলছেন উনার সাথে নাকি উনার হাজবেন্ডের কোন ঝামেলাই হয়নি, অথচ লোকটা তাকে দেখে যে পরিমাণ চেঁচামেচি শুরু করেছিল!
– এই কাজটা করা ঐ ছেলের মোটেও ঠিক হয়নি। ছেলেটার তার বউয়ের সাথে যতই ঝামেলা থাক সবার সামনে এরকম চিৎকার চেঁচামেচি করবে কেন? তারা স্বামী-স্ত্রী, শান্তি মতন বসে দুজন আলাপ করলেই হত।
-ঠিক বলেছ! তুমি বাবা তোমার বউয়ের সঙ্গে চু*লাচু*লি করো, কি*লাকি*লি কর… যা খুশি কর না তোমাকে মানা করছে কে? তবে সেটা ঘরে গিয়ে একান্তে করো। সবার সামনে বিশেষ করে আমার মত অপরিচিত লোকের সামনে হাসপাতালে উনাকে এভাবে অপমান করার কোন মানে হয়? বুঝলা আম্মা, তার ভাগ্য ভাল যে রুচিতা আপু তার বউ। আমি হলে…
সালেহা হেসে ফেলেন।
– তুই হলে কি করতি?
– হাসপাতালের বেডেই ওরে ধরে আচ্ছা মত পি*টায় আসতাম। বাদবাকি মলম পট্টি লাগানোর জন্য তো হসপিটালের ডাক্তাররা আছেনই। সবার সামনে তুই আমাকে ব*কতে পারলে আমি তোরে মা*রতে পারবোনা কেন?
– তা তো তুই পারবিই। গু*ণ্ডি একটা!
বলে মেয়ের মাথায় আলতো করে একটা চা*টি মারেন সালেহা। তারপর বলেন,
– যা এবার ফ্রেশ হয়ে নে। আজকে আর স্পেশাল কিছু পাবি না, গরুর মাংস আর খিচুড়ি। চলবে?
– চলবে মানে? দৌড়াবে!
নাফিসার কথায় সালেহা হাসেন।

দুপুরে ভরপেট খেয়ে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে নাফিসা। আজ তার বেশ শান্তি শান্তি লাগছে। কারণ দুটো, এক পিয়া অবশেষে আজকে বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছে। দুই রুমন আজ তার দাদীর বিছানায় ঘুমিয়ে পরাতে অনেকদিন বাদে সে তার নিজের বিছানাটা নিজের মতো পেয়েছে। দুপুরে ঘুমের অভ্যাস নেই নাফিসার। তবে দুপুরে খাবার পর বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি দিতে ভালই লাগে তার। নাফিসার নিজেরও মনের অবস্থা খুব একটা ভালো না। সকালের ব্যাপারটা যতবারই তার মনে পড়ছে ততবারই রুচিতার করুণ মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

বাড়ি ফিরে সে পিয়ার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করেছিল।
– বুঝলি পিয়া, বিয়ের ভাবনা চিন্তা ক্যানসেল।
– কস কি!
– ভাবতেছি পড়াশোনাই করব। পাশ করি ফেল করি সব আল্লাহর হাতে। কিন্তু বিয়ের প্যারা নেওয়া যাবে না। পরীক্ষায় ফেল করলে লোকে কয়েকদিন শুধু ফেলটু বলবে, কিন্তু দিনে রাতে এভাবে তো আর কেউ কথা শোনাবে না।
নাফিসা বুঝে পায়না একটা মানুষ কি করে এমন অপমান নিতে পারে! বিয়ে ব্যাপারটাকে সে যতটা সহজ ভেবেছিল দেখা যাচ্ছে সেটা ততটাই জটিল।
– শোন তোকেও বলি, তুইও বিয়ার চিন্তা বাদ দে। জাফরকে লাইফ থেকে এক উ*স্ঠা দিয়া সরায় ফেল।
এতক্ষণ পিয়া খুব মনোযোগ দিয়ে নাফিসার কথা শুনছিল। কিন্তু জাফর সম্পর্কে নাফিসার এমন মন্তব্যে মুহূর্তেই পিয়ার চেহারা বদলে কঠিন হয়ে যায়।
– আচ্ছা, তুই জাফরকে নিতে পারিস না কেন বলতো?
– পরের বাচ্চা আমি কেন নিতে যাব?
– ঢং কম করিস! আমি কি বুঝাইছি তুই ঠিকই বুঝছিস।
– নিতে পারি না কেন শুনবি? কারণ গত তিন দিন আগে সে আমাকে বলছে দুইদিন সময় নেবে চিন্তা ভাবনার। তারপর থেকে ওই ব্যাটা আমাকে আর ফোন দিতেছে না। অথচ চব্বিশ ঘন্টায় চব্বিশবার তোরে ফোন দেয় আর ট্যা ট্যা করে কাঁদে। এইটা কি কোন পুরুষ মানুষের লক্ষণ? ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা কোথাকার!
মূলত এই বক্তব্যের পরই পিয়া রাগ করে চলে গেছে। নাফিসাও তাকে আটকাইনি। যাক বাবা তবু তো একটু নিশ্চিন্তে নিজের বিছানায় শোয়া যাবে। গত তিন দিন ধরে তো সে প্রায় ঝুলে ঝুলে ঘুমাচ্ছে রাতে। কেননা পুরো বিছানা রুমন আর পিয়া দখল করে রাখত। তাছাড়া পিয়া যে সন্ধ্যা হলেই তাকে ফোন দেবে আর কালকে কলেজ গেলেই তার কাঁধে পুনরায় মামদো ভূতের মত চড়াও হবে, এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত।

জাফরের কথা মনে পড়তেই হঠাৎ করে মনে পড়লো ভয়েজ মেসেজগুলোর কথা। তাইতো, ওগুলোর কথা তো সে বেমালুম ভুলে বসে আছে। নাফিসা তার ফোনটা নিয়ে কানে ইয়ার প্লাগ গুঁজে ভয়েস মেসেজ তিনটা শোনে। প্রথমবার শোনার পর মেসেজগুলোর মাঝে তেমন কোন বিশেষত্ব খুঁজে পায় না সে। তবে বোঝা যাচ্ছে, যে এই মেসেজগুলো পাঠিয়েছে সে কথা বলার সময় তার আসল কন্ঠ লুকাবার অনেক চেষ্টা করেছে। নাফিসা তবু মেসেজগুলো মন দিয়ে শোনে। হঠাৎ তিন নাম্বার মেসেজটাতে যেয়ে থমকে যায় নাফিসা। তার মনে হল লোকটার কথার পেছনে আরো কিছু লোকের কথা শোনা যাচ্ছে। নাফিসা ফুল ভলিউমে কান খাড়া করে শোনে, তবু ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় না। তবে কেউ কাউকে ডাকছে বা এমন কিছু এতটুকু বোঝা যায়। হঠাৎ নাফিসা লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। আরো কয়েকবার কান খাড়া করে শোনে মেসেজটা। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সম্ভাবনায়। বিড়বিড় করে আপন মনে বলে,
– যাক, তবু একটা সূত্র তো পাওয়া গেল।

***

বিকেলে বাড়ি ফিরে গা গোসল দিয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিল অভিরূপ। হাসপাতালের ডিউটিটা শুধু বসে থাকার কাজ হলেও বড্ড বিরক্তিকর। যদিও কেবিনে আরেকটা বেড ছিল, কিন্তু অভির হাসপাতালের বেডে শুতে কেমন যেন অস্বস্তিবোধ হয়। তাই সে সোফায় আর চেয়ারে বসেই পুরো সময়টা কাটিয়েছে। বিকেলে তার বাবা গিয়ে তাকে ছুটি দিয়েছে। বলেছেন বাড়ি এসে ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমিয়ে রাতে আবার যেতে। অবশ্য অভি বুঝতে পারছিল তার মা আর বাবা কিছুটা সময় তার ভাইয়ের সঙ্গে কাটাতে চাইছে। হয়তো সকালের ব্যাপারটা কোনোভাবে তাদের কানে গেছে কিংবা রুচিতাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে দেখে সন্দেহ করেছে। অভিরূপ ক্লান্ত ছিল বিধায় ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামায়নি, সোজা বাড়ি ফিরে এসেছে।

দরজায় টোকার শব্দে তাকিয়ে দেখে রুচিতা দরজায় দাঁড়িয়ে।
– চা খাবে অভি?
– দিতে পারো এক কাপ।
রুচিতা চা নিয়েই এসেছিল। কাপটা অভির দিকে বাড়িয়ে ধরে। অভি তাকিয়ে দেখে রুচিতার চোখ লাল আর ফোলা ফোলা। হাসপাতালেই গরম আবহাওয়ার কিছুটা টের পেয়েছে সে। তার মায়ের মুখ থমথমে ছিল এবং বারবার জিজ্ঞেস করছিল সকালে কি হয়েছে। অভি ব্যাপারটা খোলাসা না করলেও টের পেয়েছে তার মা সব জানে। খুব সম্ভবত এইটা ইয়ামিনের কাজ। হয়তো সে’ই ফোন করে তার খালাকে জানিয়ে দিয়েছে পুরো ব্যাপারটা। রুচিতার জন্য খুব মায়া হয় অভির। সে নিজেও পুরো দিনে তার ভাইকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছে। শফি এমনিতে বেশ শান্ত মানুষ কিন্তু আজ পুরো দিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে অস্থির অস্থির করেছে। বারবার কেন যেন ফোনটা চেক দিচ্ছিল সে। সবচেয়ে অবাক হয় যখন সে বলে তার ফোনটা কিভাবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক করতে হয় সেটা যেন তাকে একটু দেখিয়ে দেয় অভিরূপ। এই ব্যাপারটাও অভির কাছে খুব অদ্ভুত লাগে। কেননা শফি কখনোই নিজের ফোনের ব্যাপারে খুব একটা মনোযোগী না। সেখানে ফোন লক করার মত এত জটিল কি ঘটেছে ভেবে পাইনি সে সারা দিনে।
– তুমি চা খেয়েছ ভাবী?
রুচিতা হালকাভাবে মাথা নাড়ে। যার উত্তর হ্যাঁ কিংবা না দুটোই হয়।
– ভাবী মন খারাপ করোনা, ভাইয়ার শরীরটা ভালো না দেখে হয়তো এমন করছে। দু-একদিনের মধ্যেই দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
রুচিতা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
– কেউ বিশ্বাস করছে না, কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো অভি… শফির সঙ্গে আমার কোন ঝামেলা হয়নি! পরশুদিন বাসা থেকে সে হাসিমুখে বেরিয়েছিল।
“কেউ বিশ্বাস করছে না” কথাটা কানে বাজে অভিরূপের। সে রুচিতাকে আশ্বস্ত করে বলে,
– আমি বিশ্বাস করি ভাবী, হয়তো অন্য কোন ঝামেলায় আছে ভাইয়া। সেজন্যই অকারণে তোমার উপর রাগ করছে। জানোই তো আমরা তার উপরেই অকারণে রাগ করি যাকে আমরা বেশি ভালোবাসি বা যার উপর আমাদের অধিকার বেশি থাকে।
যদিও যুক্তিটা ভীষণ খোড়া শোনায় তবু আপাতত অভির মাথায় এর বেশি কিছু খেলে না।
রুচিতা তার জবাবে কিছু বলে না, তবে অভির শেষ কথাটা যে তারও মনপুত হয়নি সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যায়। সকাল থেকে এই পর্যন্ত তার শ্বাশুড়ি তাকে হাজার বার বলে ফেলেছেন যে তার কারণেই শফির আজ এই অবস্থা। নিশ্চয়ই সে এমন কিছু করেছে যার কারণে তার ছেলে এক্সিডেন্ট করেছে এবং এখন এমন আচরণ করছে। আনোয়ারা তো এমনটাও বলেছেন যে, যদি তার ছেলের কিছু হয় তাহলে রুচিতাকে নাকি চোদ্দ শিকের ভাত খাইয়ে ছাড়বেন তিনি। কথাগুলো মনে হতেই রুচিতার চোখ আবারও জলে ঝাপসা হয়ে আসে। তাই দেখে অভি নরম কন্ঠে বলে,
– তুমি এক কাজ কর, ঘরে গিয়ে কিছুটা সময় ঘুমাও। তোমার রেস্টের প্রয়োজন। কেঁদে কেঁদে চোখগুলো তো একেবারে লাল হয়ে ফুলে গেছে! আর কেঁদো না, প্লিজ! সব সমস্যারই সমাধান আছে, একটু সময় লাগবে হয়তো এই যা।
রুচিতা উঠে তার ঘরে চলে যায়, আর অভি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ছাদে চলে আসে। বসন্তের মৃদু বাতাস তার মনটাকে আরো আর্দ্র করে দেয়। রুচিতার কান্না ভেজা মুখটা মনে পড়ে খারাপ লাগে তার।
এমন সময় শুনতে পায় কেউ একজন বলছে,
– আপনার ভাই এখন কেমন আছেন?
তাকিয়ে দেখে নাফিসা তাদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে।অভি এগিয়ে যায় তার সঙ্গে কথা বলতে।
– আছে সকালের মতোই। এখন বাবা আর মা ডিউটি দিচ্ছে, তাই বাড়ি এসেছি। রাতে আবার যাবো। আপনার কী খবর? আপনার নাকি ক’দিন বাদে পরীক্ষা, আপনি সন্ধ্যাবেলা ছাদে কী করেন?
– মুরুব্বীদের মতন কথা বলবেন না তো! সন্ধ্যা হলেই বই নিয়ে বসতে হবে এমন কথা কোথায় লেখা আছে? কোন আইনে আছে সন্ধ্যাবেলা পড়তেই হয়? আমি পড়ি গভীর রাতে আর খুব সকালে। তাছাড়া আপনার তো কোন ছোট ভাই বোন নেই তাই বুঝবেন না, পড়তে বসলেই যদি কেউ স্পাইডারম্যানের মতো জাম্প করে আপনার বই খাতার উপর পড়ে আর পাঁচ মিনিট পরপরই নাফুদি আমার পেন্সিল কই আমার ইরেজার কই বলে চেঁচামেচি করে তখন আপনারও মনে হবে সন্ধ্যেবেলা না পড়ে নিশুতি রাতে পড়তে বসা ভালো। অবশ্য বলে লাভ নেই,আপনি এগুলো বুঝবেন না। আপনাদের সাজানো গোছানো সংসার, সেইখানে এমন অভিজ্ঞতা না হওয়াই স্বাভাবিক।
– আর আপনাদের বুঝি বেশ এলোমেলো সংসার? নাফিসার কথায় ভীষণ মজা পায় অভি।
– এলোমেলো না হলেও উল্টোপাল্টা তো বটেই। বাড়ির সবাই স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক, যার যা খুশি করে! বিশেষ করে আমরা তিন ভাইবোন কেউ কখনো এক মতে সম্মতি দিতে পারি না, একজন ডান বললে আরেকজন অবশ্যই বলবে বাম… এভাবেই চলবে। বলতে পারেন ভাই বোন একে অপরের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করাটা আমাদের একটা হবি। যাইহোক, আমার কথা বাদ দিন। আপনাকে কিন্তু আমি মনে মনে খুঁজছিলাম।
– আমার সৌভাগ্য! তা কেন জানতে পারি?
– আপনার কাছে একটা ব্যাপার জানার ছিল।
– কী?
– আপনি তো আইটি বিভাগে আছেন, তাই না?
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা ধরেন একটা ভয়েস মেসেজের পেছনে কিছু কথা হচ্ছে, সামনের মানুষটার বলা কথাটুকু সরিয়ে ওই কথাটুকু শোনা সম্ভব?
– খুব সম্ভব! পেছনের ভলিউম ফ্রিকোয়েন্সি বাড়িয়ে দিয়ে…
নাফিসা তাড়াতাড়ি হাত উঁচিয়ে অভিকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
– ব্যাস ব্যাস আর ব্যাখ্যা করতে হবে না! আপনার ওইসব বৈজ্ঞানিক কটোর মটর শব্দ আপনার বুকপকেটেই রাখুন। আমাকে শুধু বলুন আপনি পারবেন কিনা?
– পারবো, তবে তার আগে আমাকে ম্যাসেজটা শুনতে হবে। কিন্তু ব্যাপার কী বলুন তো?আপনি কি পড়াশোনা ছেড়ে শেষমেষ ডিটেকটিভগিরি ধরলেন?
নাফিসা ঠোঁট উল্টে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে,
– মনের দুঃখ আর কি বলবো বলেন! ভেবেছিলাম পড়াশোনা করব না যেমনেই হোক এই চার মাসের মধ্যে ভালো দেখে একটা ছেলে জোগাড় করে বিয়ে করে ফেলব। কিন্তু তা আর হল কই!
– সমস্যা কোথায়? ভালো ছেলে পাচ্ছেন না, নাকি অন্য কোন ঝামেলায় পড়েছেন?
– মানে আজ সকালে যা দেখলাম এরপর বিয়ে করার শখ আমার মিটে গেছে! বিয়ে করার মানে যদি এই হয় যে দশ জনের সামনে যখন তখন আমাকে অপমানিত হতে হবে, আর আমাকে নিজের সংসার বাঁচাতে সেই অপমান ট্যাবলেটের মতো কুৎ করে গিলে খেতে হবে। তার চেয়ে ভালো ভাই আমি পড়াশোনাই করি। কমসে কম জীবনে পরীক্ষা নামক শুধু একটাই প্যারা থাকবে। বিবাহিত জীবনে তো দেখছি হাজারটা প্যারা!
অভি একটু অপ্রস্তুত কন্ঠে বলে,
– সকালের ঘটনাটার জন্য আমি সত্যি দুঃখিত! আপনার সামনে এমন একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যাবে ভাবতে পারিনি।
– আমার সামনে কি ঘটেছে সেটা ভাবা বাদ দিন। আপনারা ভাবুন আপনাদের ভাবীর সঙ্গে আপনারা কতটা অবিচার করলেন তাই নিয়ে। আপনার ভাইয়ের যদি কিছু বলারই থাকতো সেটা গোপনেও তো বলতে পারতো। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে ঘরে বসেই তো চুপচাপ আলাপটা সারতে পারতো। আপু গিয়েছিলেন যখন আপনারা বেরিয়ে গেলে তারা কেবিনেই শান্তিমত কথা বলতে পারতো, এভাবে তাকে অপমান করার কি দরকার ছিল? আপনার ভাইয়ের এই কাজটা আমি সত্যি মেনে নিতে পারিনি!
– ব্যাপারটা আমাকেও ভীষণ ভাবাচ্ছে বুঝলেন। ভাইয়া কিন্তু এমন না, আমি আজ পর্যন্ত কখনো ভাইয়াকে এতটা রাগ করতে দেখিনি। আর ভাবীকে আমি যতটুকু জানি, ভাবী এমন মেয়ে না যে এমন কিছু করবে যার কারণে কারো এত রাগ হতে পারে।
– তাই তো! রাগ উঠলেই দেখাতে হবে?
– কেন, আপনি দেখান না?
অভি এবার সুযোগ বুঝে নাফিসাকে পাল্টা প্রশ্ন করে।
– আমার কথা বাদ দিন। তবে এতটুকু বলতে পারি আমি কখনো মানুষকে ছোট করি না, যে নিজ থেকে ছোট হতে চায় তার কথা আলাদা।
কথা ঘোরানোর জন্যই অভি বলে,
– তো বিয়ের চিন্তা তাহলে মাথা থেকে বাদ দিয়েছেন?
– আলবৎ! অত ঝামেলা নিয়ে লাভ আছে? আমি ভাই এখন থেকে পড়াশোনা করব। পাস করাটা অতি জরুরী।
অভি হেসে ফেলে।
– তার মানে ফেল করার সমূহ সম্ভাবনা আছে?
নাফিসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
– একমাত্র পড়ালেখার ব্যাপারে আমি নিজেকে কখনো বিশ্বাস করতে পারি না বুঝলেন। হয়তো ফুল কনফিডেন্স নিয়ে ঢুকেছি অংকে একেবারে শতভাগ একশো পাবার মতো কন্ডিশন, তারপর দেখা যায় কোন রকমে টেনেটুনে পাস করেছি। আবার অনেক সময় দেখা যায় কিছু না পড়ে এমনি চলে যাই পরীক্ষা দিতে, কিন্তু চোখ বুঁজে আশি পার্সেন্ট মার্কস আমার উঠে আসে। তাই এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছিনা। তবে ফেল করার সম্ভাবনা ছিল।
– ছিল বলতে?
– মানে এখন আর নেই, এখন যেভাবেই হোক টেনেটুনে হলেও পাস আমাকে করতেই হবে। নয়তো আম্মাই হয়তো ধরে বেঁধে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে পারে। আদু বোন টাইপ মেয়ে কে ঘরে পুষে বলুন?
হঠাৎ কথার মাঝে অভির দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায় নাফিসা,
– তা আমার বিয়ে নিয়ে আপনার এত আগ্রহ কেন শুনি?
– না, দেখছিলাম একটা মেয়ে তার ক্যারিয়ার নিয়ে কতটা ভাবে!
– মানে কি? আপনার কি ধারণা মেয়েরা ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবে না?
– আমার আসলে মেয়ে বন্ধু কম ছিল তাই এই ব্যাপারে জানা হয়নি। আপনার কাছ থেকেই প্রথম ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো যে মেয়েরা তার ক্যারিয়ার নিয়ে কি ধরনের চিন্তা করে।
– ভুল ভাবলেন কিন্তু। মেয়েরা ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবে তবে মেয়েরা একটু ইমোশনাল তো তাই তারা ক্যারিয়ারের আগে ব্যক্তি জীবন নিয়েও ভাবে। দুটো একসাথে মিলিয়ে তারা জীবন নিয়ে ভাবে। শুধু ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবে ছেলেরা, স্বার্থপর ভাবনা।
– তাই? তা এই স্বার্থপর লোকদের কারো সঙ্গেই তো বিয়ের ভাবনায় ছিলেন পরীক্ষা থেকে রেহাই পেতে।
অভি কটাক্ষ করতে ছাড়ে না।
– তো কি করব? মেয়ে বিয়ে করবো?
নাফিসার সোজাসাপ্টা প্রশ্নে উল্টো অভি নিজেই হকচকিয়ে যায়।
– না মানে, ছেলেদের এত খাটো করে দেখছেন তাই বললাম!
– ছেলেদের খাটো করে দেখছি না বরং আপনি মেয়েদের খাটো করে দেখছেন বলে আপনাকে জানালাম যে মেয়েরা আপনাদের থেকে চিন্তাভাবনায় আরো বেশি গোছানো।
অভি এবার নিজের ভুলটা বুঝতে পারে।
– সরি, আসলে আপনাকে হার্ট করার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না।
– আমি হার্ট হইওনি। আমাকে বাংলা মুভির শাবানা ভাববেন না, আমি হলাম অপু বিশ্বাসের মতন দৃঢ় প্রত্যয়ী… যে যাই বলুক আমি আমার মতন চলি। মানে তালগাছের মালিকানা আমারই থাকে। তাছাড়া আপনাকে আমার এখন প্রয়োজন, তাই খোঁচাখুঁচি যতই করেন না কেন সেগুলোকে বেশি পাত্তা দেয়া যাবে না, আমি বাস্তববাদী মানুষ।
– প্রয়োজন?
কথাটা কানে বাজে অভিরূপের।
– আপনাকে বিয়ে-শাদী বা ভালোবাসার চিন্তা করছি এমনটা ভুলেও ভেবে থাকলে ভুলে যান। এমন বোকা বোকা কোন ভাবনাই আমার মাথায় নেই। আপনাকে আমার প্রয়োজন ওই মেসেজটার কথাগুলো উদ্ধারের জন্য।
অভি জবাবে মুচকি হেসে চায়ে চুমুক দেয়। সত্যি বলতে এক মুহূর্তের জন্য সে সত্যিই এমনটা ভেবেছিল। তাকে হাসতে দেখে নাফিসা খোঁচা মেরে বলে,
– কি, মন খারাপ হয়ে গেল? এমন কোন উদ্দেশ্য ছিল নাকি?
– উদ্দেশ্য থাকলেই বা! পাত্তা দিতেন?
– জীবনেও না! বিয়ের আগে প্রেম… এইসব কুচিন্তা ভুলেও ভাববেন না। আমি প্রেমে বিশ্বাসী না। কাউকে পছন্দ হলে সোজা গিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসব তারপর তিনবার কবুল কবুল কবুল…খতম! তবে এখন বিয়ের চিন্তাও ক্যান্সেল করেছি।
– আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আমিও বিয়ের চিন্তা অনেক আগেই ক্যানসেল করেছি।
নাফিসা চোখ কপালে তুলে বলে,
– বলেন কি? আপনার সমস্যা কোথায়? ছ্যাকা ট্যাকা খেয়েছেন নাকি?
অভি রেলিঙে পা ঝুলিয়ে বসে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
– এই ব্যাপারটা আমি আপনার সঙ্গে শেয়ার করতে পারছি না বলে সত্যি দুঃখিত!
– কোন সমস্যা নেই, শেয়ার করতে না চাইলে করবেন না!
নাফিসা মিষ্টি করে হেসে অভির দেখাদেখি রেলিঙে পা ঝুলিয়ে বসে।
নাফিসা এতো সহজে সমস্যা নেই বলাতেই হয়তো অভির ইচ্ছে হয় কারণটা তাকে জানাতে। কিন্তু সে চাইলেও হয়তো বলতে পারতো না যে তার মায়ের কারণে সে আপাতত বিয়ে করতে চাচ্ছে না। নিজের মায়ের ব্যাপারে অন্যের কাছে কিছু বলতে বড্ড বিবেকে বাঁধে। তবে নাফিসার মুখের হাসিটা দেখে অভির মনটা কেমন কেমন করে, হঠাৎ করেই বড্ড আপন মনে হয় মেয়েটাকে। মনে হয় মেয়েটা যদি প্রেম বা বিয়ের ভাবনা ক্যান্সেল না করত ব্যাপারটা তাহলে খুব একটা মন্দও হতো না। হঠাৎ করেই নাফিসাকে খুব কাছের কেউ মনে হয় তার, ইচ্ছে হয় তার হাতটা ধরে চোখে চোখ রেখে উজাড় করে বলতে মনের সব কথা।

চলবে।