হোম পলিটিক্স পর্ব-০৯

0
238

#হোম_পলিটিক্স

#আফসানানীতু

#পর্ব_৯

দুপুর বারোটা…

আনোয়ারা রান্না ঘরে ঢুকে দেখেন রুচিতা রান্না করছে। – কী রান্না করছো রুচিতা?
– শফির জন্য একটু চিকেন স্যুপ করছি মা।
আনোয়ারা উঁকি মেরে পাতিলের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠেন।
– স্যুপ রান্না করছো না মুরগিদের জলকেলি করাচ্ছো! এই ট্যালটেলা পানি খেয়ে আমার ছেলের অসুখ তো আরো বাড়বে! এসব হাবিজাবি রান্না তোমাকে কে শিখিয়েছে?
– আব্বা একবার হসপিটালে ভর্তি ছিলেন তখন তো আমি এভাবেই ইউটিউব দেখে স্যুপ রান্না করে খাইয়েছিলাম আব্বাকে। অসুস্থ মানুষকে তো বেশি তেল মশলা দেয়া যায় না, তাই এভাবেই পাতলা করে স্যুপ রাঁধতে হয় মা।
– ছাই রাঁধতে হয়!
ভেঙচে ওঠেন আনোয়ারা।
– ধরো হসপিটালে একজন পেশেন্ট গেছে ক্যান্সারের ট্রিটমেন্টের জন্য আর আরেকজন গেছে পা ভেঙে। ডাক্তার কি দুইজনকে একরকম ওষুধ দেবে? আমার ছেলের হাত ভেঙেছে, কোমর না যে মসলাযুক্ত খাবার খেলে খাবার পর তার টয়লেটে যেতে সমস্যা হবে। এসব খাবার তুমি তোমার আত্মীয়-স্বজন হসপিটালে এডমিট হলে খাইও। আমার ছেলেকে বাবা এসব খাওয়াতে হবে না তোমার।
রুচিতা সুবোধ বালিকার মত চুলার নব ঘুরিয়ে সেটা বন্ধ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারা চিলের মতো চিৎকার করে ওঠেন।
– একি, চুলা বন্ধ করলে কেন?
শাশুড়ির চিৎকারে অপ্রস্তুত বোধ করে রুচিতা। বিড়বিড় করে বলে,
– আপনি যে বললেন শফিকে এই স্যুপ দিতে হবে না তাই…
– আহ্! দিতে হবে না বলতে বোঝাতে চেয়েছি এভাবে দিতে না। তাই বলে কি বলেছি শফিকে স্যুপই খাওয়াবো না! এমনিতেই আমার ছেলের শরীর থেকে গাদা গাদা রক্ত বেরিয়ে গেছে, ওকে শুকনা খাবার খাওয়ালে চলবে? ফ্রিজে দেখো ফ্রেশ ক্রিম রাখা আছে, নিয়ে এসো। এনে এটাতে এক কাপ ক্রিম ঢেলে দাও। আর একটু মেথি জিরে আর কাঁচামরিচ দিয়ে তাতে ফোড়ন দিয়ে দাও তাহলেই চলবে। আর শোন, বাটার নানের জন্য একটু খামিরও তৈরি কর। আমার শফি মুরগির স্যুপের সঙ্গে ঘরে তৈরি বাটার নান খুব পছন্দ করে। তা তাওয়াতে নান রুটি করতে পারো তো?

রুচিতার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করে। সে সত্যি এর আগে কখনো ঘরে নান রুটি তৈরি করেনি। কিন্তু তার শাশুড়ি তার স্যুপ রান্না দেখেই যেভাবে তাকে তিরস্কার করছেন তাতে এই অবস্থায় পারবে না এ কথাটা সে বলে কি করে! তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। আঁচল দিয়ে নার্ভাস ভঙ্গিতে সেটুকু মুছে সে কম্পিত কন্ঠে বলে,
– আপনি দেখিয়ে দিলে পারব মা।
আনোয়ারা এই না টুকু শোনার অপেক্ষাতেই ছিলেন।তিনি আরো দ্বিগুণ জোরে তিরস্কার করে বলেন,
– হায় আল্লাহ, এটাও পারো না! তা পারো কি শুনি? সারাদিন সেজেগুজে ঘুরতে? যাই বলি বল কিনা আপনি দেখিয়ে দিলে পারব। তা তোমার মা তোমাকে কিছু দেখিয়ে দেননি? জেনে শুনে এমন অন্ধ মেয়েটাকে আমার বাড়ি পাঠালো কেন বলো দেখি!

আনোয়ারার কথায় রুচিতার মন এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে তার মধ্যে তার মাকে নিয়ে কটাক্ষ করায় আর নিতে পারে না বেচারি। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। সে তাড়াতাড়ি আঁচল টেনে নিজের চোখ মোছে। তাই দেখে আনোয়ারা বিরক্ত কন্ঠে বলেন,
– কাজের মধ্যে পারো তো ওই এক নাকি কান্না কাঁদতে! কিছু বলার আগেই চোখের পানি নাকের পানি একাকার করে কাঁদতে বসে যাও। এই দিয়েই তো আমার ছেলেটাকে বশ করে রেখেছো। কি দেখে যে তোমাকে তোমার শ্বশুর ঘরে তুলেছেন আমি তা আজও খুঁজে পাই না। নইলে সুন্দরী মেয়ে কি আমার জ্ঞাতি গুষ্টিতে কম ছিল!
এমন সময় ডাইনিং থেকে মনির সাহেব উঁচু গলায় তার স্ত্রীকে ডাকেন।
– আনোয়ারা! কী হচ্ছে কী!
আনোয়ারা তাড়াতাড়ি দৌড়ে স্বামীর কাছে যান।
– ডাকছিলে?
– না ডেকে উপায় আছে? ওভাবে চিৎকার করছিলে কেন?
স্বামীর কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়েন আনোয়ারা।
– চিৎকার করছিলাম কোথায়? আমি তো রুচিতাকে স্যুপ রান্না করা শেখাচ্ছিলাম।
– তুমি যে ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলে সেটা তো আমি স্পষ্ট এখান থেকেই শুনতে পেয়েছি। আল্লাহ তো গলার ভেতরে মাইক ফিট করে দিয়েছেন, সেজন্য কোন কথাই ধীরে ধীরে বলতে পারো না! ভাগ্য ভালো যে এই পুরো বাড়িটা তোমার দখলে, ভাড়াটিয়া রাখলে তো এতদিনে সমাজে মুখ দেখাতে পারতাম না! আজকালকার যুগে ছেলের বউয়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?
– এভাবে মানে কিভাবে? আমি তো সবার সঙ্গে এভাবেই কথা বলি!
– মোটেই না! এমনিতেই মেয়েটার মনটা ভালো নেই। ওদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে হয়তো কোন ঝামেলা চলছে। কোথায় ছেলের সংসার বাঁচাবার জন্য সবদিক সামাল দেবার চেষ্টা করবে, না… উল্টো আগুনে ঘি ঢেলে বেড়াচ্ছো! তোমার আক্কেল জ্ঞান নাই?
– আমার আক্কেল জ্ঞান নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না! আগে তুমি নিজের আক্কেল জ্ঞান ঠিক করো। এনেছো তো রূপের বস্তা একটা! সাজগোজ ছাড়া যে কোন কিছুই পারে না! সামান্য একটু স্যুপ রাঁধতে দিয়েছি, তাও গিয়ে দেখি মুরগি যেন বাথটাবে সাঁতার কাটছে। এখন ওইটা ঠিক করে আমার ছেলে কিভাবে খাবে সেটা দেখাতে গেলেও আমার দোষ! বলবে আমি চেঁচামেচি করছি?
– চেঁচামেচি করছো বলেই তো বলছি।
– আমার কথা যখন এতই কানে বাজে তখন রুনা লায়লার মতো কাউকে বিয়ে করলেই পারতে। যে দিনে রাতে তোমাকে নেচে গেয়ে দেখাতো, আমাকে বিয়ে করতে গেলে কেন?
মুখ ঝামটে জবাব দেন আনোয়ারা।
কথার এই পর্যায়ে মনির সাহেবের রাগ চরমে ওঠে। তিনি ইচ্ছে করে ডাইনিং এর একটা চেয়ারকে আছড়ে দেন জোরসে। তাতে আনোয়ারা একটু ঘাবড়ে পিছে সড়ে যায়।
মনির সাহেব এবার স্ত্রীর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বলেন,
– যথেষ্ট হয়েছে, আর না!
বলে শোবার ঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও আবার ফিরে আঙ্গুল তুলে শাসান।
– আর না মানে একদম না! মনে থাকে যেন।

রুচিতার শশুর শাশুড়ি দুপুরের খাবার সেরে শফির জন্য খাবার নিয়ে হসপিটালে চলে গেছে। রুচিতা চেয়েও কোন কিছুই মুখে দিতে পারেনি। তার সবকিছুই কেমন বিস্বাদ ঠেকছে। শফির এক্সিডেন্টে রক্তে ভেজা শার্ট প্যান্ট বাড়িতে নিয়ে এসেছিল অভি। সেগুলো রাতভর ভিজিয়ে রেখে একটু আগে ধুয়েছে রুচিতা। ছাদে ছড়াতে গিয়ে আকাশী শার্টটায় এখনো হালকা রক্তের দাগ দেখে সে মনোযোগ দিয়ে সেটা পর্যবেক্ষণ করে। আচ্ছা শার্টটা শুকিয়ে গেলেও কি এই হালকা দাগটুকু দেখা যাবে? যদি দেখা যায় তাহলে হয়তো তাকে আবারো তার শাশুড়ির তীক্ষ্ণ বাক্যবাণের কবলে পড়তে হবে, যা এই মুহূর্তে নেবার মতো মন মানসিকতা তার নাই। তার মনে পড়ে যখন তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল বিয়েতে তার বাবা রাজি ছিলেন না। বলেছিলেন, “একটা মাত্র মেয়ে আমাদের। তাকে এত তাড়াতাড়ি পর করে দিতে চাইছ কেন জোছনা? থাকুক না আর কিছুদিন আমাদের সঙ্গে। এমবিএটা শেষ করুক, একটা চাকরি-বাকরিতে ঢুকুক। তারপর না হয় বিয়ের কথা ভাবা যাবে।” কিন্তু তার মা রাজি হয়নি। মা বলেছিল, এত ভালো ঘর-বর নাকি পাওয়া যাবে না আর এই সুযোগ হারালে।
আজকাল রুচিতার তার মায়ের এই কথাটা বেশ মনে পড়ে। আচ্ছা,এত ভালো ঘর বরের সত্যিই কি তার প্রয়োজন ছিল? নাকি আর কিছুদিন একা থাকাই তার জন্য ঠিক ছিল? হয়তো নিজের জন্য একটা চাকরি অন্তত খুঁজে নেয়া দরকার ছিল তার।পায়ের নিচে মাটি শক্ত না করে এভাবে নড়বড়ে অবস্থানে দাঁড়িয়ে অন্যের দয়ায় নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখাটা বোধহয় তার মত শিক্ষিত মেয়ের জন্য বোকামি হয়েছে।
আনোয়ারার কথা যদি সত্যি হয় আর বাড়ি ফিরে শফি যদি সেই আগের মতই আচরণ করে, তাহলে তাকে হয়তো সত্যি সত্যি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। কেননা এতটা বৈরী পরিবেশ নেওয়ার মতন মানসিক শক্তি তার নেই। সেই ছোটকাল থেকেই বড্ড আদুরে আর নরম স্বভাবের রুচিতা। তার পক্ষে কারো সাথে রূঢ় ব্যবহার করা যেমন সম্ভব না তেমনি অন্যের খুব বেশি রূঢ় আচরণও সে নিতে পারে না। আর তাই হয়তো তার শাশুড়ি পছন্দ করে না জানার পরও অল্পতেই তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে।

ভাবতে ভাবতেই রুচিতার চোখ আবারও ঝাপসা হয়ে আসে। সেই ঝাপসা চোখে নাফিসাদের বাড়ির ছাদে কারো উপস্থিতি টের পায়ে রচিতা। নাফিসা কি আজ বাড়িতেই? ওর কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হয়, তাই চোখ মুছে এগিয়ে আসে দেখতে।
নাফিসাদের ছাদে একজন মধ্যবয়স্ক নারী চাদর পেতে তাতে হলুদ মরিচ শুকাচ্ছেন। মুখাবয়বে নাফিসার সঙ্গে বেশ মিল দেখে রুচিতা আন্দাজ করে নেয় ইনি নাফিসার মা। সে গলা উঁচিয়ে বলে,
– আপনি বুঝি নাফিসার আম্মা?
সালেহা চোখ তুলে তাকিয়ে রুচিতাকে দেখে অল্প হাসে। তারপর আঁচলে হাত মুছে এগিয়ে এসে বলে,
– হ্যাঁ আমিই এই পাড়ার সবচেয়ে মুখরা মেয়ে নাফিসার মা। তুমি বুঝি রুচিতা?
রুচিতা হাঁ বোধক মাথা নাড়ে।
– নাফিসার মুখে তোমার গল্প অনেক শুনেছি!
– কী বলেছে নাফিসা? নিশ্চয়ই বলেছে পাশের বাড়িতে একটা মেয়ে আছে যে কথায় কথায় ছাদে উঠে কান্নাকাটি করে?
রুচিতা আসলে জানার চেষ্টা করে গতকালের ঘটনাটা নাফিসা তার মাকে জানিয়েছে কিনা।
সালেহা হেসে বলে,
– না এভাবে না বললেও তোমার কান্নাকাটির গল্প সে করেছে অবশ্যই। আর বলেছে তুমি দেখতে খুব সুন্দর!এখন দেখছি কথাটা মিছে বলেনি, তুমি সত্যি দেখতে খুব সুন্দর!
রুচিতা জবাবে লজ্জিত হাসি হাসে।
– তোমার হাজব্যান্ড এখন কেমন আছে?
– জ্বি ভালো।
– বাড়ি ফিরেছে?
– এখনো ফেরেনি। তবে শুনেছি প্রেসার কন্ট্রোলে থাকলে খুব তাড়াতাড়ি ডিসচার্জ করে দেবে।
– সে’ই ভালো! হাসপাতালের ডিউটি সত্যি বড় কষ্টের। তবু তো তোমাদের লোকজন আছে, আমারগুলো তো সব হনুমান! আমি বা ওর বাবা আল্লাহ না করুক হসপিটালে যদি ভর্তি হই, আমাদের ডিউটি দেওয়ার মতো কেউ নাই! নাফিসাকে পাঠালে সে ডাক্তারদের সাথে ঝগড়া শুরু করবে আর পরের দুইটা গেলে দুজনের মাঝে রেসলিং খেলা শুরু হয়ে যাবে!

রুচিতা হেসে ফেলে।
– নাফিসা আমাকে বলেছে যে ওরা তিন ভাইবোন খুব ঝগড়া করে।
– শুধু ঝগড়া? কখনো কখনো হাতাহাতিও করে। আমি বুঝে পাইনা আমার তিন ছেলে মেয়ে কোত্থেকে এতটা ঝগড়াটে হল? আমি কিন্তু এতটা ঝগড়াটে না, বিশ্বাস করো।
– তা আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়। আপনি দেখতে ভারী মিষ্টি!
– ও মা, মিষ্টির ডিব্বা নাকি আমাকেই বলে আমি মিষ্টি? যাক শুনে খুশি হলাম! দূরত্বের কারণে তোমার গাল চিপে দিতে পারলাম না, তবে এমন সুন্দর কথায় অবশ্যই তোমার গাল চিপে দেওয়া উচিত ছিল।
সালেহা রুচিতার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে প্রশ্ন করে,
– দুপুরে খেয়েছো?
রুচিতা এবার চমকে সালেহার দিকে তাকায় তারপর চোখ নামিয়ে মাথা নেড়ে জানায় খাইনি।
– কেন, খাওনি কেন?
– বাসায় কেউ নেই। একা একা খেতে ইচ্ছে করছিল না।
– নাকি মন ভালো না তাই!
রুচিতা এবার সালেহার প্রশ্নের জবাব দেয় না। সালেহা খানিকক্ষণ রুচিতার জবাবের অপেক্ষা করে বলে,
– দেখো, তোমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমার বলা বোধহয় ঠিক না। তবে নাফিসার কাছে যতটুকু শুনেছি তাতে আমার মনে হয়েছে তোমাকে কিছু কথা আমার বলা উচিত।
– কী আন্টি?
– শোনো, তুমি শিক্ষিত একটা মেয়ে। তোমাকে কেউ অকারণে দোষারোপ করলে চুপ থাকলে চলবে না এতোটুকু বুঝে নিও। ওই কবিতাটা শোনোনি? অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে দুজন সমান অপরাধী। সুতরাং কেউ তোমাকে মিথ্যে অপবাদ দিলে কিংবা অন্যায় ভাবে হ্যারাস করলে তার প্রতিবাদ করবে প্রথম থেকেই। নয়তো সেটা যদি বিশাল আকার ধারণ করে তখন কিন্তু তার প্রতিবাদ করলে ফলাফল খারাপ হবে। অনেক ক্ষেত্রে তখন প্রতিবাদ করাই সম্ভব হয় না, তাতে পুরো ব্যাপারটাই বিগড়ে যায়। কেননা মানুষ ততদিনে তোমার মৌনতায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে তাই হঠাৎ পরিবর্তন নিতে পারবে না।
রুচিতার মন এমনিতেই ভালো না তার ওপর তার বাবা-মা কেউ দেশে নেই বলে তার মনের কথাগুলো সে বলার লোক পাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় সালেহার কথায় তার মনটা আবারো আর্দ্র হয়ে ওঠে। নিজের অজান্তেই ফুঁপিয়ে ওঠে। কান্না জরানো কন্ঠে বলে,
– আন্টি, আমি আসলে এমন একটা সমস্যায় পড়েছি যার সমাধান আমি নিজেও পাচ্ছিনা। একজন মানুষ, যে আমাকে এত এত ভালোবাসতো সে রাতারাতি আমাকে এতটাই ঘৃণা করা শুরু করেছে যে আমাকে চোখের সামনেও নিতে পারছে না, সেখানে আমি কি প্রতিবাদ করব বলুন? আমি তো সমস্যাটাই বুঝতে পারছি না। এর সমাধান খুঁজবো কি করে আর প্রতিবাদই বা করব কিভাবে?
– একজন ভালোবাসার মানুষ তোমাকে হুট করে অপছন্দ করা শুরু করলে তার থেকে দূরে থাকাই ভালো। বুঝবে সেখানে অবশ্যই গুরুতর কোন কারণ রয়েছে। দূরত্ব অনেক সময় সম্পর্কের মানে বুঝিয়ে দেয়। তোমার হাজব্যান্ড বাড়ি এলে তার থেকে তুমি নিরাপদ দূরত্বে থেকো। তোমার শূন্যতাটুকু বাড়িতে এলে সে ঠিকই অনুভব করতে পারবে, দেখবে তখন সে নিজে থেকেই তোমার সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে চাইবে। তবে একটা জিনিস মনে রেখো, যেই সিদ্ধান্তেই যাও নিজের আত্মসম্মান বজায় রেখো। ওইটা কখনো বিক্রি করে দিও না। মেয়েদের হাতের পাঁচ তো শুধু দুটো জিনিস, এক শিক্ষা দুই আত্মসম্মান। এই দুটো জিনিস তোমার কাছ থেকে কেউ নিতে পারবে না, বাদবাকি আমাদের নিজেদের বলে তো কিছুই নেই! শ্বশুরবাড়ি, বাপেরবাড়ি, স্বামীর সম্পদ নয় তো বা বাবার বাড়ির সম্পদ… নিজের বলতে তো শুধু ওই এতটুকুই। ওইটুকুও যদি হারিয়ে ফেলো তাহলে থাকবে কি বল?
রুচিতা সালেহার দিকে তাকিয়ে তার চোখে অপার স্নেহ দেখতে পায়। সে প্রায় ফিসফিস করে বলে,
– একটু আগে আপনি আমার গাল চাপতে চেয়েছিলেন না? আর এখন আমার ইচ্ছে হচ্ছে দৌড়ে এসে আপনাকে জড়িয়ে ধরি। খুব ভালো লাগলো আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আন্টি, খুব ভালো লাগলো!
তার প্রায় ফিস ফিস করে বলা কথার বেশিরভাগটাই সালেহা বুঝতে পারেন না, তবে তিনি তার মানে বোঝার চেষ্টাও করেন না। শুধু দূর থেকে মেয়েটার কষ্টটুকু অনুভব করার চেষ্টা করেন সমস্ত স্বত্তা দিয়ে।

***

হসপিটালে আজ শফি আর অভির শেষ রাত। রাত দশটায় ডাক্তার এসে শফির সবকিছু পরীক্ষা করে মাথার ব্যান্ডেজ দেখে বলে গেছেন আর ভয় নেই, বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিতে। শুধু সপ্তাহ শেষে এসে মাথার পট্টি বদলে নিতে হবে। আর হাতের প্লাস্টার তো সময়ের আগে খোলাই যাবে না। এভাবেই থাকবে আরও এক মাস। কপাল ভালো হাত ভাঙ্গেনি, শুধু হাড়ে সামান্য চিড় ধরেছে।
রাত এগারোটা বাজতেই নার্স এসে কেবিনের বাতি বন্ধ করে হালকা একটা মিটমিটে আলো জ্বেলে দিয়ে গেছে। বলে গেছে রোগীকে ডিস্টার্ব করতে না। অভি অবশ্য শফির সঙ্গে কথা বলার মুডেও নেই, তার হাতে অনেক কাজ জমে আছে। তাই ল্যাপটপ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। হাতের কাজগুলো সারছিল, এমন সময় নাফিসাকে অনলাইনে দেখে বেশ অবাক হয় অভি। সেদিন কথা বলার একপর্যায়ে দুজন ভার্চুয়াল জীবনে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল একে অপরকে। তাই এখন তারা ফেসবুক ফ্রেন্ড। দেবে না দেবে না করেও অভি নাফিসাকে নক করে।
– এত রাতে এখনো জেগে?
পাঁচ মিনিট পর উত্তর আসে,
– এই নাফিসা রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমায় না বলেই তো তার সম্পদও নাই, স্বাস্থ্যও নাই!
– মানে?
– আপনি সেই বিখ্যাত রাইমসটা শোনেননি? আর্লি টু বেড এন আর্লি টু রাইজ…সেখানে বলেছে সকাল সকাল ঘুমালে আর সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলে স্বাস্থ্য পাবেন সম্পদও পাবেন। আমি সকাল সকাল ঘুমাতে যাই না বলেই স্বাস্থ্য সম্পদ কোনটাই পাই নাই। বুঝলেন এবার?
– একদম পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি।
– আচ্ছা,আপনাকে সব কিছু ব্যাখ্যা করে বলতে হয় কেন? আপনাকে ইঞ্জিনিয়ারের সার্টিফিকেটটা দিয়েছে কে ?
– যে’ই দেক, ভাগ্য ভালো আপনার হাতে ছিল না পাওয়ার! তাহলে তো আমি এই জীবনে ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতাম না।
– তাও বটে! বাহ্ খুব তো আমার উপর খবরদারি করছেন। তা আপনি এত রাতে হাসপাতালের ডিউটি ফেলে অনলাইনে কি করছেন?
– এখানেও পাহারাদারি করছি। হা হা! আর আপনি?
– আমি? একটা ডিম পেরেছি, তাতে তা দিচ্ছি নিয়মিত। তাই মাঝে মাঝে পড়া রেখে ফেসবুকে এসে চেক দিয়ে যাচ্ছি ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়েছে কিনা।
– কিহ্!
জবাবে নাফিসা কনফিউজিং কিছু ইমোজি টাইপ করে অফলাইনে চলে যায়। অভি স্ক্রিনের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। মেয়েটা বড়ই অদ্ভুত! একে বোঝা সত্যি দায়! কখনো কখনো মনে হয় নাফিসা তাকে পছন্দ করে, আবার কখনো কখনো মনে হয় নাফিসা ওকে বুদ্ধুরাম ছাড়া আর কিছুই ভাবে না।

নাফিসার সঙ্গে তার রসায়নের সমীকরণ মেলাতে মেলাতে কখন যে ল্যাপটপ খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল অভি বলতে পারবে না। হঠাৎ মোবাইলের টুংটাং শব্দে তার ঘুম চটে যায়। শব্দটা তার মোবাইল থেকে আসেনি সেটা সহজেই বুঝতে পারে অভি। কেননা মোবাইল তার বুক পকেটেই রয়েছে। শব্দটা খুব সম্ভবত শফির মোবাইলের। অভি আড়চোখে হাত ঘড়িতে দেখে, ভোর চারটা। এত সকালে শফিকে মেসেজ করবে কে? খুব ধীরে ধীরে শফি নিজের শরীরটাকে টেনে তুলে বালিশে হেলান দিয়ে বসে মোবাইল হাতে নিয়ে সেটা অন করে দেখে। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে তার মুখের অভিব্যক্তি বদলে যায়। বিশ্রাম নেয়া শান্ত মুখখানা ভয় কিংবা বেদনায় কুঁচকে যায়। হঠাৎ স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে অভির দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে সে ঘুমিয়ে আছে কিনা। অভি অবশ্য শফিকে উঠতে দেখেই আধ বোজা চোখে ঘুমের ভান ধরে শুয়ে ছিল। ঘরের অল্প আলোয় তাই শফি বুঝতে পারে না যে অভি জেগে আছে। সে আবারও স্ক্রিনের দিকে তাকায়, আঙ্গুল দিয়ে উপরে নিচে স্ক্রল করে। তারপর মোবাইলটা আবার বন্ধ করে বিছানাতে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে। শুকনো মুখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে অন্ধকারের দিকে।
শফির এমন আচরণে মনের ভেতর অসম্ভব সব সম্ভাবনা উঁকি দেয় অভিরূপের। আচ্ছা শফি কোন অনৈতিক বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েনি তো? কিংবা অন্য কোন ঝামেলায়… যার কারণে তার বিবাহিত সম্পর্ককে তুচ্ছ করতে হচ্ছে। কারণ ছাড়াই রুচিতার সঙ্গে সে দুর্ব্যবহার করে তাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও শফির মতো সহজ সরল ছেলেকে পরকীয়ায় আসক্ত কোন পুরুষের আসনে বসাতে পারে না অভি। নিজের উপর খানিকটা রাগ হয় তার। কেন যে কাল সে তার ভাইকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক করে দিল মোবাইলে! তা না করে যদি প্যাটার্ন লকটা শিখিয়ে দিত তাহলে গোপনে হলেও সে শফির মোবাইলটা চেক দিয়ে দেখতে পারতো ঘটনা কি। শফি মোবাইল যেভাবে আগলে রাখছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে সেখানে কোন ঘাপলা আছে। আগে সন্দেহ হলেও আজ এমন দৃশ্য দেখার পর ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, নিশ্চয়ই এই মোবাইলেই সমস্ত ঝামেলার চাবিকাঠি রয়েছে। অভি মনে মনে ঠিক করে যেভাবেই হোক তাকে জানতে হবে ব্যাপারটা কি।

বাকিরাতে তাদের দুই ভাইয়ের কেউই আর ঘুমোতে পারে না। একজন জানালা দিয়ে ভোর হওয়া দেখে আর আরেকজন তার ভাইয়ের মুখে কিভাবে ভোর থেকে রাত্রি নেমে আসছে ধীরে ধীরে… তাই দেখে কাটিয়ে দেয় পুরো সময়টা।

চলবে।