হ-য-ব-র-ল পর্ব-০৭

0
3016

#গল্পের_নাম:|| হ-য-ব-র-ল ||
#লেখনীতে: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_______০৭

‘অজান্তা,আমার ঠোঁট পুড়ে গেছে।চিকিৎসা দাও!’

রোদ্দুরের দ্বিধাহীন কন্ঠ শুনে অহির চোখ দুটো যেন ছানাবড়া হয়ে গেল।এরকম একটা কথা তবুও কেমন সাবলীল ভাবে বলছে।এই ছেলেকে সে হাড়ে হাড়ে চিনে গেছে।বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার।কোন দুঃখে যে সে ডাক্তারি পড়তে গেছিল!

‘কি হলো অজান্তা?জ্বালাপোড়া করছে তো!’

অহি রোদ্দুরের হাত দুটো সরিয়ে উঠার চেষ্টা করলো।পারলো না।বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘কাঁধ ছাড়ুন!উঠতে দিন!’

‘আগে তুমি ঠোঁটের চিকিৎসা দাও!’

‘এইবার কিন্তু ঘুষি খাবেন বলছি।ছাড়ুন!’

রোদ্দুর ছাড়লো না।অহি ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।এই ছেলের সাথে সংসার করতে গেলে যে তাকে কতরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।সর্বোপরি তার ডাক্তারি জীবনের দফারফা হয়ে যাবে।একের পর এক অজুহাতে শুধু চিকিৎসা চাইবে।আজ হাত কেটে গেছে, কাল পা কেটে গেছে, পরশু জ্বর বাঁধিয়েছে,তরশু আঙুল পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে ইত্যাদি।কে যে তাকে ডাক্তারি পড়ার পরামর্শ দিয়েছিল!

সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার রোদ্দুরের ঠোঁটের দিকে তাকালো।গলার স্বর নামিয়ে বলল,

‘ঠোঁট পুড়েছে কিভাবে?’

‘অন্যমনস্ক হয়ে গরম চায়ে চুমুক দিয়েছিলাম।’

রোদ্দুরের হাত ঢিলে হয়ে এলো।অহি এক লাফে উঠে বসলো।হাতের ব্যান্ড খুলে মাথার খোলা চুল পেঁচিয়ে বলল,

‘এক কাজ করুন।অন্যমনস্ক হয়ে আরেক কাপ ধোঁয়া উঠা গরম চায়ে চুমুক দিন।ঠিক হয়ে যাবে।’

রোদ্দুর ধপ করে উঠে দাঁড়ালো।গলা উঁচিয়ে বলল,

‘তুমি চিকিৎসা দিবে কি না সেটা বলো।’

‘কি চিকিৎসা দিবো বলুন। শুনি!’

‘ডক্টর তুমি না আমি?আমায় জিগ্যেস করছ কেন অজান্তা?আমি হলাম পেশেন্ট।মানে রোগী!আর তুমি ডাক্তার!চিকিৎসা তুমি দিবে।’

‘আমি আপনাকে চিকিৎসা দিতে পারবো না।’

‘চিকিৎসা দিবে না মানে?ডক্টর হয়েছ কি গরুর ঘাস কাটার জন্য?তোমার সব সার্টিফিকেট আমি পুড়িয়ে ফেলবো।’

অহির হাসি পাচ্ছে খুব!তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বেশ স্বাভাবিক রইলো।চোখ সরু করে বলল,

‘পুড়িয়ে ফেলুন না!বারন করেছে কে।’

রোদ্দুর এলোমেলো ভাবে কিছুক্ষণ কেবিনে হাঁটাহাঁটি করলো।তারপর অহির সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো।কিছুক্ষণ অহির মুখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।তারপর ডান হাতের আঙুল উঁচিয়ে বলল,

‘তুমি ভয়ংকর নিষ্ঠুর!ঠোঁট পোড়ার সাথে সাথে তোমার প্রতি আমার সব অনুভূতি পুড়িয়ে ফেললাম অজান্তা।এই মুহূর্ত থেকে তোমার প্রতি আমার সব ফিলিংসে ফোসকা পড়ে গেল।আমি আর তোমায় ভালোবাসি না।’

‘এত দ্রুত ভালোও বেসে ফেলেছিলেন মি. রোদ্দুর হিম?আপনার ফিলিংস তো দেখি মডার্ণ সাইন্সকেও হার মানাবে।’

‘চুপ!এই মুহূর্ত থেকে তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ।অল অভার!আমি চলে যাচ্ছি।’

যাচ্ছি বলেও রোদ্দুর যাচ্ছে না।এই মানুষটা এত্তো ফানি!রেগে গিয়ে তাকে আরো ফানি লাগছে।অহি ঠোঁট টিপে হেসে বলল,

‘যাচ্ছি বলেও যাচ্ছেন না কেন?’

রোদ্দুর আর অপেক্ষা করলো না।গটগট করে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।সে চলে যেতে অহি ফিক করে হেসে ফেলল।সে বেশ বুঝতে পারছে আজকের পর থেকে তার জীবনটা অন্য রকম হয়ে গেল।আজকের পর থেকে বাকি জীবন টা রোদ্দুর তার ভালোবাসার খুঁনসুটি আর পাগলামিতে ভরিয়ে রাখবে সবসময়।কিছুক্ষণ পর সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।টানা দরজায় হাত রেখে বন্ধ করতে শেষ মুহূর্তে রোদ্দুর ধরে ফেলল।অহি কপাল কুঁচকে বলল,

‘আবার কি চাই?’

রোদ্দুর কাঠ গলায় জবাব দিল,

‘কি চাই মানে?আমার জিনিস নিতে এসেছি।ব্লেজার ফেরত দাও!’

অহি দ্রুত গিয়ে ব্যাগের চেইন টেনে ব্লেজার বের করলো।রোদ্দুরের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল,

‘এই নিন!’

রোদ্দুর এক হাতে ব্লেজার চেপে ধরে রাগান্বিত চোখে অহির দিকে চেয়ে রইলো।সে দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অহি দরজা বন্ধ করতে নিল।শেষ মুহূর্তে রোদ্দুর আবার পা দিয়ে বাঁধা দিল।অহি বিস্ময় নিয়ে তাকাতে বলল,

‘আমাকে খেয়ে ছেড়ে দিবে তা তো হবে না অজান্তা?’

‘অ্যা?আপনাকে কখন খেলাম আবার?’

‘পানি!পানি খেয়েছ।আমার টাকায় কেনা পানি খেয়েছ।পানি ফেরত দাও!হাবিজাবি পানি হলে চলবে না।আমার চাই মিনারেল ওয়াটার।’

অহি রোদ্দুরের শেষ কর্মকান্ড দেখতে চাচ্ছে।আরো কি কি পাগলামি করে তার যবনিকা টেনে ছাড়বে।সে প্রায় দৌঁড়ে গিয়ে সিটের পাশ থেকে পানির বোতল এনে রোদ্দুরের দিকে বাড়িয়ে দিল।বলল,

‘এবার বিদেয় হন!’

রোদ্দুর বিদেয় হলো না।কয়েক সেকেন্ড দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থেকে আচমকা অহিকে ঠেলে সরিয়ে কেবিনে ঢুকে পড়লো।

ট্রেন ঝিকঝিক শব্দ তুলে এগিয়ে চলেছে।লোহায় লোহায় টক্কর লেগে সৃষ্ট শব্দটা ইতোমধ্যে গানের সুর নিয়েছে যেন।দীর্ঘক্ষণ শোনার ফলশ্রুতিতে অহির মনে হচ্ছে সে চমৎকার একটা সুর শুনছে।ট্রেন মৃদু কাঁপছে।সেই কাঁপুনির সাথে পাল্লা দিয়ে অহির বুকটাও দুরুদুরু কাঁপছে। নিজেকে ধাতস্থ করে সে বলল,

‘ভেতরে এলেন কেন?আবার কি চাই?আরো কিছু পাবেন?’

রোদ্দুর আড়চোখে অহির দিকে তাকালো।কিন্তু ঘুরে দাঁড়াল না।হাতের ব্লেজার চেপে ধরে বলল,

‘আমি আর কিছু পাব না।তুমি পাবে!’ছ’ বগিতে অন্ধকারে ভয় পেয়ে তোমায় জড়িয়ে ধরেছিলাম।এবার তুমি আমায় একবার জড়িয়ে ধরো।শোধ বোধ হয়ে যাবে।আমি কারো কাছে ঋণী থাকতে চাই না।’

‘কিহ!’

রোদ্দুর ঘুরে দাঁড়াল।অহির অস্থিরতা মাখা মুখের দিকে চেয়ে বলল,

‘আমি এখনো শেষ করিনি।তোমায় কোলে তুলে ১৮ নাম্বার কেবিন থেকে ১৩ নাম্বার কেবিনে নিয়ে গেছি।এত কষ্ট করতে হবে না তোমার।তুমি শুধু আমায় কোলে তুলে এই কেবিনে একটা চক্কর দিবে।পারবে না?’

অহি ছিটকে দু পা পিছিয়ে গেল।অগোছালো ভাবে বলল,

‘আপনি একটা আজব প্রাণী!’

‘আজব হলেও আমি একটা প্রাণী।তোমার মতো নিষ্ঠুর উদ্ভিদ নই।আমার প্রাণ আছে!তুমি একটা প্রাণহীন,হৃদয়হীন ইউক্যালিপটাস!’

অহি মৃদুস্বরে হেসে ফেলল।রোদ্দুরকে থামিয়ে দিতে হবে।নইলে ননস্টপ বকবক করতে থাকবে।সে কয়েক পা এগিয়ে রোদ্দুরের কাছাকাছি দাঁড়াল।খুব কাছে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা রোদ্দুরের বুকে চেপে ধরলো।

রোদ্দুর অস্থিরতা নিয়ে তাকাল অহির দিকে।তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে।শরীরের কাঁপুনি টের পাচ্ছে।অহিকে এত কাছে অনুভব করে অস্থিরতা বেড়ে চলেছে যেন।গলা শুকিয়ে আসছে।অহির নরম হাতের নিচের হার্টটা ছিটকে বের হয়ে আসতে চাইছে যেন।সে ছটফট করতে করতে বলল,

‘ও মাই গড!ক-কি করছ কি, অজান্তা?’

অহি বাম হাতে রোদ্দুরের হাত চেপে ধরলো।ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল,

‘এত ভয় কেন পাচ্ছেন?চিকিৎসা দিতে চাচ্ছি।ঠোঁটের!’

‘চিকিৎসা লাগবে না।আমি সুস্থ।একদম সুস্থ।’

হড়বড় করে বলে রোদ্দুর এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। পিছিয়ে যেতে ফ্লোরে থাকা ব্যাগের সাথে লেগে উল্টে পড়ে গেল।অস্ফুটস্বরে মৃদু আর্তনাদ করে মাথা চেপে ধরলো।সিটের কর্ণারে লেগে মাথা ঠুকে গেছে।

অহি হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ব্যথা পেয়েছেন?কোথাও লেগেছে?’

অহি কাছে এগিয়ে যেতে রোদ্দুর বাম হাত উঁচিয়ে বলল,

‘কাছে আসবে না অজান্তা।একদম কাছে আসবে না বলছি!’

অহি বারণ শুনলো না।এগিয়ে গিয়ে রোদ্দুরের হাত সরিয়ে মাথায় আস্তে করে চাটি মারলো।রোদ্দুরকে আরেক দফা লজ্জার সাগরে চুবিয়ে মারতে সে রোদ্দুরের কপালে চুমু খেল।

৮.

হাজেরা বেগম নুডলসের বাটি অহির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

‘ছোট বৌমা।তুমি বেশি করে খাও!’

অহি অস্বস্তি নিয়ে বাটিটা হাতে নিল।রোদ্দুরের মা তো তার আর রোদ্দুরের ব্যাপারে কিছুই জানে না।অথচ কোন এক অদ্ভুত কারণে তিনি প্রতিটা কথার সাথে সাথে ছোট বৌমা, ছোট বৌমা শব্দটি যুক্ত করছেন
তাকে বৌমা বলে ডাকছেন।অহি ভুলটা শুধরে দিল না।ডাকুক না!কিছু ভুল ভালো লাগার জন্ম দেয়।এই মানুষটাকেও সে প্রচন্ড রকমের ভালোবেসে ফেলেছে।

সে চামচের ডগায় পেঁচিয়ে কিছুটা নুডলস মুখে পুড়লো।চিবোতেই তার স্বাদটা টের পেল।এতকাল যাবত বাইরের যাচ্ছে তাই খাবার খেয়ে মুখ পঁচে গেছে।মনে হচ্ছে বহুদিন পর এত সুস্বাদু খাবার খাচ্ছে।সে দ্রত অর্ধেক বাটি খালি করে বলল,

‘আন্টি আপনার রান্নার হাত চমৎকার।’

হাজেরা বেগমের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।রান্না নিয়ে কেউ প্রশংসা করলে তার ভীষণ ভালো লাগে।তিনি অহির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘আরো অনেক খাবার আছে।ধীরে সুস্থে খাও।অনেক দূরের পথ সেজন্য খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছি।তাছাড়া বড় বৌমার এখন ঘন ঘন খাওয়া প্রয়োজন।’

অহির ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে গেল।বোতল খুলে একটু পানি খেল।খোলা দরজা দিয়ে একবার বাইরে তাকাল।রোদ্দুরকে চোখে পড়ছে না।হয়তো লিরা ভাবীর কেবিনে!

হাজেরা বেগম অহির প্লেটে কষানো মাংস তুলে দিয়ে বলল,

‘ছোট বৌমা!শুনলাম হিম নাকি ছবিতে অভিনয় করবে?’

‘হ্যাঁ,আন্টি।ঠিকই শুনেছেন!’

‘তোমার শ্বশুর মশাই রাজি তো?উনি হ্যাঁ বলে দিয়েছে?’

অহি মাথা নেড়ে স্মিত হাসলো।আশ্যস্তের সুরে বলল,

‘হ্যাঁ,আন্টি।আপনি চিন্তা করবেন না একদম।’

অহির খাওয়া শেষে দুজন একত্রে বক্সে খাবার গুছিয়ে রাখলো।হঠাৎ রোদ্দুর দরজার বাইরে থেকে বলল,

‘অজান্তা,তোমায় লিরা ভাবী ডাকে।’

হাজেরা বেগমের সম্মতি নিয়ে অহি কেবিনের বাইরে এলো।বাইরে থেকে দরজা টেনে লিরা ভাবীর কেবিনের দিকে পা বাড়াতে রোদ্দুর ওড়নার নিচের ঝুলন্ত অংশ টেনে ধরলো।অহি সকৌতুকে বলল,

‘সমস্যা কি?’

রোদ্দুর এলোমেলো সুরে বলল,

‘বুকে ব্যথা করে অজান্তা।’

‘করুক!আরো কত রকমের অসুখ করবে এখন আপনার!আপনার কোনো চিকিৎসা আমি করছি না।’

অহি ওড়না টেনে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল।কয়েক পা যেতে আবার হাতে টান অনুভব করলো।তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।হাসিটুকু নিমেষে শুষে নিয়ে রোদ্দুরের কম্পনরত হাতের দিকে এক পলক তাকাল।হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বিস্ময়মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,

‘একি!তুমি আমার মেয়ের হাত ধরে টানাটানি করছ কেন?ওর হাতটা কি টানাটানির বস্তু?দড়ি পেয়েছ নাকি?ছাড়ো বলছি!বেয়াদব ছেলে।’

অহি রোদ্দুর দুজন চমকে তাকিয়ে দেখলো লুৎফর রহমান কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে।তার পাশে টুপি পরিহিত রোদ্দুরের বাবাও কৌতূহল নিয়ে চেয়ে আছে।

(চলবে)