ভালোবাসি তারে পর্ব-১৪

0
5630

ভালোবাসি তারে

১৪.
ঝুম বারবার আড়চোখে নিঝুমকে দেখছে। লম্বা লম্বা নিশ্বাস নেওয়ার দরুণ নিঝুমের ঘেমে যাওয়া প্রশস্ত বুক বারবার উঠানামা করছে। অশান্ত লাগছে তাকে। নিজের মনে সাহস জুটালো ঝুম। ঢোক গিলে মৃদু স্বরে বলল,
— “পানি পান করবেন?”

নিঝুম নিরুত্তর। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে নিঝুমের দিকে এগিয়ে দিলো ঝুম। আগের ন্যায় বলল,
— “পানি।”

নিঝুম সতর্ক চোখে মাথা নত করে থাকা ঝুমকে দেখল। বিনাবাক্যে ঝুম থেকে পানির গ্লাস নিয়ে নিলো। পরপরই এক নিশ্বাসে পান করে ফেলল পানিটুকু। তারপর ঝুমকে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— “শাড়ি পড়লে না কেন?”

ঝুম ঠোঁট কামড়ে রাখে। মনে মনে কিছু একটা ভাবে। তবে মুখে কিছু বলতে পারে না। নিঝুম স্থির চোখে তাকায় ঝুমের দিকে। ম্লান কণ্ঠে বলে,
— “আম্মু আশা করেছিল তুমি শাড়ি পড়বে। অনতত আম্মুর মন রাখার জন্যে হলেও শাড়িটা পড়া উচিত ছিল তোমার।”
ঝুমের ভীষণ রাগ হয়। কত বড় মিথ্যুক নিঝুম! মনে আছে একটা, অথচ বলছে আরেকটা! ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগে নি ঝুমের। মুখে অসন্তুষ্টির ছাপ ফুটে উঠল তার। পরক্ষণেই নিঝুমের স্থির চোখের চাহনী উপেক্ষা করে সরাসরি নিঝুমের চোখাচোখি হয়ে বলল,
— “আন্টি আমাকে কিছু বলবে না শাড়ি না পড়লে।”
প্রায় সাথে সাথে আবারো চোখ নামিয়ে ফেলে ঝুম। ওই গম্ভীর চোখে বেশিক্ষণ তাকানোর সাহস নেই ঝুমের। এদিকে নিঝুম অবাক হয়ে ঝুমকে দেখছে। ছোট্ট মেয়েটা কথা শিখে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ লাগলো নিঝুমের স্বাভাবিক হতে। এবং তারপরই কাঠিন্য গলায় বলল,
— “আমি বলছি তোমাকে শাড়ি পড়তে। নিশ্চয়ই এবার আর কোনো অজুহাত দেবে না?”

ঝুম কিছু বলল না। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো নিঝুমের দিকে। এ মুহুর্তে ঝুমকে দেখে হাসি পাচ্ছে নিঝুমের। দম ফাটানো হাসি! কোনোরকম নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল নিঝুম। গম্ভীর ভাব বজায় রেখে বলল,
— “যাও! সবাই অপেক্ষা করছে।”
ঝুম প্রশ্ন করে,
— “আপনি যাবেন না?”
— “পরে যাবো। তুমি যাও।”

ঝুম মাথা নত অবস্থায় সায় জানায়। নিঝুমকে পেছনে ফেলে সামনে আগাতে থাকে। কয়েক কদম এগিয়েই আবারো পেছন ফিরে সে। নিঝুমকে তখনো স্থির চোখে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুক কেঁপে উঠে ঝুমের। দ্রুত হাঁটা শুরু করে। নিঝুম এমন কেন? চেনা দুষ্কর তাকে।

________________

দুপুরের মধ্যভাগ। ক্ষুধায় পেটে ব্যথা করছে ঝুমের। কাউকে বলতেও পারছে না ক্ষুধার কথা। বাধ্য হয়ে বিষণ্ণ মনে একপাশের চেয়ারে বসে কোকাকোলা একটু একটু করে পান করছে ঝুম। খানিকটা দূরেই নিঝুমকে দেখা যাচ্ছে। মুখে মুচকি হাসি রেখে মিসেস সানজিদার সঙ্গে কথা বলছে সে। ঝুম হাসিটার পানে চেয়ে! হঠাৎ মিসেস সানজিদা ডেকে উঠলেন তাকে। ঝুম তখন তাকিয়ে দেখছিল নিঝুমকে। তিনি ঝুমকে ডাকায় নিঝুমও ঝুমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। চোখাচোখি হতেই লজ্জা পায় ঝুম। হালকা কেঁশে হাতের পানিয়-র গ্লাসটা চেয়ারে রেখে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় মিসেস সানজিদার কাছে। মিসেস সানজিদা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,
— “তুই তো এখনো খাবার না খেয়ে আছিস, তাই না ঝুম? নিঝুম? তুই বরং ঝুমকে নিয়ে খেতে যা। আমি এদিকটা সামালাচ্ছি।”

নিঝুম ঝুমকে একপলক দেখে নেয়। কিছু না বলেই সামনের দিকে আগাতে থাকে। ঝুম প্রথমে বোঝে না সে কি করবে! পরক্ষণেই নিঝুমের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করে। নিঝুম অনেক দ্রুত হাঁটছে। ঝুম নাগাল পাচ্ছে না। ঝুম এবার মৃদু চেঁচিয়ে উঠে,
— “ডাক্তার? একটু দাঁড়ান, প্লীজ!”

নিঝুম যেন শোনে না কথাটা। ঝুম আরেকবার ডাকতেই স্থির হয়ে দাঁড়ায়। ঝুমের দিকে তীক্ষ্ণ চাহনী ছুড়ে মারে। অনেকটা দৌঁড়ানোর মতো করে নিঝুমের পাশাপাশি এসে দাঁড়ায় ঝুম। এতটুকুতেই যেন হাঁপিয়ে গেছে সে। দীর্ঘ নিশ্বাস নিতে নিতে বলে,
— “আপনি এত তাড়াতাড়ি হাঁটেন কিভাবে? আমি তো নাগালই পাচ্ছিলাম না।”
নিঝুম শান্ত গলায় বলে,
— “দৌড়ানোর কি আছে? আস্তে ধীরে আসতে। আমি তো কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না।”
ঝুম জবাব দিতে পারে না। আমতা আমতা করতে শুরু করে। হালকা লজ্জা লাগছে তার। নিঝুম মনে মনে আওড়ায়, ‘লাজুককন্যা!’ পরপরই বলে,
— “চেয়ার নিয়ে ওদিকটায় বসো। আমি দুজনে খাবার নিয়ে আসছি।”
নিঝুম চলে যেতে নিলে ঝুম দ্রুত বলে,
— “আমি আসি?”
নিঝুমের ছোট্ট জবাব,
— “না।”
ঝুমের রাগ হয়। মনে মনে অনেকগুলো বকা দেয় নিঝুমকে। এলোমেলো পায়ে নিঝুমের বলা জায়গায় চেয়ার টেনে বসে পরে।

নিঝুম আসে আরো ৫মিনিট পর। দুহাতে দুটো খাবারের প্লেট তার। ঝুমের পাশে বসে ডান হাতের প্লেট-টা এগিয়ে দেয় নিঝুম। চোখের ইশারায় নিতে বলে। ঝুমও নিয়ে নেয় প্লেট-টা। খেতে খেতে ঝুম বলল,
— “আপনি কি আর গ্রাম ঘুরে দেখবেন না নিঝুম ভাইয়া? শুধু তো ঝর্ণাই দেখেছেন। এখানে আরো সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে।”

নিঝুমের মন-মেজাজ হঠাৎ-ই বিগড়ে যায়। ঝুমের মুখে ‘নিঝুম ভাইয়া’ ডাকটা শুনতে একটুও ভালো লাগে না নিঝুমের। অদ্ভুদভাবে ভীষণ রাগ হয়। এবারো হচ্ছে। ঝুমকে বকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোন অধিকারে বকবে? কিংবা বকার কোনো কারণ আছে কি? হয়তো আছে। তবে সেটা শুধু নিঝুমের ক্ষেত্রে! নিঝুম জবাব দেয় না ঝুমের কথায়। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে খেতে শুরু করে। খাবারও যেন বিষাক্ত মনে হচ্ছে এখন। বিষাক্ত লাগছে সবকিছু।

________________

অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে। আস্তে আস্তে সব মেহমান চলে যাচ্ছে। তবে তাদের কিছু গুঞ্জনও শোনা গেল। কেউ কেউ জমিদার বাড়ির সুনাম করল তো, কেউ-বা এই বলে দুর্নাম করল,
— “মেঘলা হইলো জমিদার বাড়ির কাজের লোক। এই মাইয়্যার বিয়া এত দুমধাম কইরা করার কিহ্ আচে? জমিদারেরই-বা অনুষ্টান করার দরকার কিহ্? সব যে মাইনসেরে(মানুষকে) দেখাইতে করতাছে তা কি আমরা বুজি না?”
অথচ এতে জমিদার বাড়ির কারো কিছু যায় আসে না। কথাগুলো কানেই নেয় নি তারা। সবাইকে তো আর খুশি করা যায় না। সবার মন-মানসিকতা এক না! তারা যা ভাবার ভাবুক!

ঝুম অনুষ্ঠানের একদম শেষ পর্যন্ত রইলো জমিদার বাড়ি। এখন সে তীব্রভাবে ক্লান্ত। ক্লান্তিতে কোথাও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। আবার বসতেও পারছে না। বসলেই চোখে ঘুম নেমে আসছে। এসবে বড্ড বিরক্ত ঝুম। ক্লান্তিতে শরীরের সর্বশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। মিসেস সানজিদার কাছে গিয়ে ঝুম বলল,
— “আমি এখন চলে যাই আন্টি?”
মিসেস সানজিদা কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন,
— “যেতে পারবি? তোকে তো ক্লান্ত দেখাচ্ছে। দাঁড়া! আমি ড্রাইভারকে বলছি, তোকে দিয়ে আসবে।”

ঝুম কথার পিঠে আর কিছু বলে না। এখন নিজের বাসায় যেতে পারলেই বাঁচে! যাওয়ার সময় উঠানের সরু রাস্তায় নিঝুমের সাথে দেখা হয় তার। নিঝুম বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। নিঝুমকে দেখে ঝুম দাঁড়িয়ে যায়। নিঝুমও দাঁড়ায়। নিঝুম প্রথমে প্রশ্ন করে,
— “চলে যাচ্ছো যে? ক্লান্ত?”
ঝুম হালকা স্বরে বলল,
— “হ্যাঁ।”
— “আচ্ছা, তাহলে যাও।”
ঝুম মাথা নাড়ায়। চলে যেতে নিলে নিঝুম আবার বলে,
— “কালকে গ্রাম ঘুরবো ঝুম। দশটায় নদীর পাড়ে অপেক্ষা করব।”
শুনে ঝুম মুচকি হাসে। হাসিটা যেন নিঝুমকে তার প্রতিউত্তর দিয়ে দিয়েছে নিমিষেই।

______________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা