#সেদিন_মুষুলধারে_বৃষ্টি_ছিল
part–10
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
সেকেন্ড বাসর রাতে মুহিব মুখ-চোখ শক্ত করে বিছানার এক কোণায় বসে আছে। চোখে বেদনা ভরে উঠছে তার। সে ফোস করে একটা শ্বাস ফেলল। রাত সাড়ে বারোটা বাজে সেজুতির আসার নাম-গন্ধ নেই। বাসার পরিবেশ ও চুপচাপ। বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে না কারো। লাইট ও বুঝি নেভানো। তাহলে সেজুতি কোথায়? তাকে একা রেখে কই গেল? মুহিব উঠে দাড়ালো। নাহ এভাবে তো একা একা থাকা যায় না। কিছু একটা করতেই হবে তাকে। একবার দরজা খুলে বাইরে গিয়ে কি কাউকে জিজ্ঞেস করবে সেজুতি কই?
মুহিব বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়াতেই খট করে দরজা খোলার আওয়াজ হলো।
সেজুতি খুব সাবলীল ভাবে ভেতরে ঢুকল। তাকে বেশ হাসি-খুশি লাগছে।নিশ্চয়ই ওই বদ কাজিনগুলোর সঙ্গে হাসাহাসি করছিলো।
মুহিব ও তাকে দেখে বেশ স্বস্তি পেল৷
সে জিজ্ঞেস করলো, এতোক্ষন কোথায় ছিলে?
সেজুতি রুমে এসে ঢুকল কিন্তু মুহিবের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না।
মুহিব আবারো জিজ্ঞেস করল, কি হলো কথা বলো? চুপ আছো কেন?
সেজুতি আলমারির দিকে এগিয়ে গেল।
মুহিব সেজুতির দিকে নজর দিলো। সে বৌভাতের শাড়ি খুলে হালকা রঙের একটা সুতি ফতুয়া বা কূর্তি পড়েছে। গায়েও সুতি ওড়না জড়ানো। শাড়ি বদলে ফেলেছে দেখে মুহিবের মন খারাপ হলো। সে এখনো এই গরমের মধ্যে পাঞ্জাবি-জিন্স পড়া৷ দিনাজপুরে শীতে যেমন হাড়ভাঙা শীত নামে তেমনি বৈশাখ আসার আগেই আম পাকা গরম পড়ে যায়! সেজুতির রুমে এসিও নেই।
মুহিব এতোই ঘেমেছে যে তার পাঞ্জাবির পেছনটা ঘাম দিয়ে ভিজে জুবুথুবু! অথচ সেজুতি শাড়ি বদলে আরামদায়ক জামা পড়ে কাজিন নিয়ে ঘুরঘুর করছে। হাসি-তামাশা করছে। আবার চুল ও অর্ধ ভেজা মানে গোসল সেরে ফেলেছে ইতিমধ্যেই! ওহ মাই গড! এতোকিছু কখন করলো?
মুহিবের ধ্যান ভাংলো যখন সেজুতি শব্দ করে বাথরুমের দরজা লাগালো।
ওহ তো সে আলমারির দিকে এগুচ্ছিল না বরং বাথরুমের দিকে যাচ্ছিলো।
মুহিব আরো অস্থির হয়ে গেল। রুম আসলো কি? এসেই বাথরুমে ঢোকা — এ কেমন আচরণ? সে এবারে রুমের এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি শুরু করলো। তার মুখ অত্যন্ত গম্ভীর!
সেজুতি পাচ মিনিটের মধ্যে বের হয়ে বেশ বড়সড় একটা ঝটকা খেল।
মুহিব সিগারেট খাচ্ছে আর সারা রুম জুড়ে পায়চারি করছে। এ পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু হাটতে হাটতে সিগারেটের ছাই মেঝেতে ফেলে দিচ্ছে বড্ড আয়েশ করে৷
অন্য দিন হলে এই কাজের জন্য সেজুতি কিছু কথা শুনিয়ে দিত মুহিবকে। কিন্তু আজকে কথা বলা মানেই তাকে প্রশ্রয় দেয়া। তাকে প্রশ্রয় দেয়ার কোন মানেই হয় না!
কাউকে প্রশ্রয় না দেওয়া বা ইগনোর করার মূলে হলো কথা না বলা বা কম বলা!
সে মুহিবকে পাশ কাটিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে চুল আছড়াতে লাগলো।
মুহিব বিছানায় গিয়ে বসে সুন্দর করে একটা হাসি দিলো। সে এমন জায়গায় বসেছে যেখান থেকে আয়নায় প্রতিবিম্ব হয়ে তাকে সেজুতি দেখতে পাবে৷ কিন্তু নাহ এতো সুন্দর করে হাসি দেয়ার পরও সেজুতির কোন ভাবান্তর নেই। সে আপন মনে চুলে বেনী করায় ব্যস্ত! এরপর মুখে লোশন মাখতে লাগে।
মুহিব খুকখুক করে কাশতে লাগে। তাও হেলদোল নেই সেজুতির।
এবারে মুহিব বলতে আরম্ভ করলো, পৃথিবীতে তো ইনভিজিবেল হওয়ার কোন ট্যাবলেট বিজ্ঞানীরা বানায় নি এখনো তাই না?
সেজুতি কিছু না বললেও মুহিবের উদ্ভট কথায় ভ্রু কুচকাতে বাধ্য হলো।
মুহিব আবারো বলল, সেই ট্যাবলেট খেয়ে তো আর আমি অদৃশ্য হয়ে যাইনি যে তুমি আমাকে দেখতে পারছো না? নাকি আমি অদৃশ্য মানব? হু?
সেজুতি একটা হাই তুললো।
মুহিব তা দেখে নরমসুরে বলে উঠে, ঘুম পাচ্ছে অনেক? পাওয়ারই কথা! রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। আসো ঘুমাতে যাই। আমারো ঘুম পাচ্ছে।
এইটুকু বলে মুহিব চিটপাটাং হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সে ডান পাশে শুলো যেন সেজুতি বাম পাশে শুতে পারে৷
কিন্তু সেজুতি তাকে অবাক করে দিয়ে রুমের বাইরে যেতে লাগলো। আস্তে করে সে দরজা খুললো।
তা দেখে মুহিব বেশ আওয়াজ করে বলে উঠে, এই কই যাও তুমি?
সেজুতি ঠান্ডা গলায় বলে উঠে, আজকে আমরা কাজিনরা ছাদে প্রজেক্টর লাগিয়ে কাভি খুশি কাভি গাম মুভিটা দেখব। আমার আসতে আসতে সকাল হয়ে যাবে৷ আপনি চাইলে দরজা লাগিয়ে দিতে পারেন।
এরপর মুহিবের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে, গুড নাইট মুহিব।
মুহিব হতভম্ব হয়ে যায়। কাভি খুশি কাভি গাম দেখার জন্য সেজুতি তাকে একা ফেলে চলে গেল। যতোই হোক আজকে তাদের সেকেন্ড বাসর রাত! এমন কাজ করতে পারল সেজুতি? বিবেক বাধা দিলো না? সে তার জায়গায় হলে কোন দিন এমন পাষাণের মতো আচরণ করতে পারত না! বরং সারারাত জড়িয়ে ধরে মিস্টি প্রেমময় গল্প করে কাটিয়ে দিত! তা না সে কিনা মুভি দেখতে গেল। তাও শাহরুখের মুভি! আরে ভাই! শাখরুখের মধ্যে কি আছে যা তার মধ্যে নেই? মুহিব কি কম সুদর্শন নাকি? মুহিবের এই মূহুর্তে শাহরুখকে নিজের মেইল ভারসন অফ সতিন মনে হচ্ছে!
সে বিছানায় উপর শুয়ে বিড়বিড় করে বলে, আমার জীবনটাও কাভি খুশি তো কাভি গাম!
এরপর এক দন্ড চুপ থেকে মনে মনে বলে উঠে, কাজল-শাহরুখের কেমেস্ট্রি দেখে যদি একটু রোমান্টিক হতে শেখে সেজুতি তাও লাভ!
তারপর তারাও কাজলের কাছ থেকে ইন্সপায়ারড হয়ে সরিষাক্ষেতে ওড়না নিয়ে দৌড়াদৌড়া করবে।
কিন্তু কথা হচ্ছে শীতের দিকে সরিষার ফসল হয়। এখন এই এপ্রিল মাসে বোধহয় সরিষা ভেঙে তেল ও উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল! এখন তার ওড়না নিয়ে দৌড়ানোর ইচ্ছার কি হবে?
ইচ্ছা ভঙ্গ হতে চলল এটা ভাবতেই কষ্ট পেল মুহিব।
কিন্তু সে সেজুতিকে এমন একটা চমৎকার রাত্রিতে তাকে ফেলে একা একা কাভি খুশি কাভি গাম সিনেমা দেখার জন্য ক্ষমা করবে না। কোন দিনই ক্ষমা করবে না। নো! নেভার!
সে চোখ বুজে ফেলে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুহিব ঘুমিয়ে গেল। একটা সময় তার ঘুম গভীর হতে লাগে।
★★★
জুই বসবাস করছে আমেরিকা শহরের নিউইয়র্কে। সে ম্যানহাটন দ্বীপের উত্তরে দিকের এক জায়গায় থাকছে বিগত চারবছর ধরে। সে যেই এপ্যান্টমেন্টে থাকছে সেটা একটা সুন্দর ও চমৎকার ছবির মতো! ছবির মতো স্বচ্ছ ও শুভ্র তাদের এলাকাটা। সে হাউস নং ৩৬ এ থাকে। বারোতলায়।
পাশেই একটা বড় পার্ক। বাচ্চারা সেখানে খেলছে। কিছুই দেখা যায় না। বাচ্চাগুলোকে পিপড়ার মতো লাগে।
পার্কের পাশেই ফ্লাওয়ার শপ। ফ্লাওয়ার শপটার ডেকোরেশন অদ্ভুত সুন্দর! মিস্টার এন্ড মিসেস জন এই ফ্লাওয়ার শপের ওনার। দোকানের নামটাও খুব সুন্দর! লা’মর। এর মানে কি জুই জানে না! কিন্তু নামটা তার দারুণ লেগেছে।
ফ্লাওয়ার শপের পাশ বেয়ে চলে গেছে পিচ ঢালা রাস্তা। রাস্তা ঘেষে রেইন ট্রি, ক্রিসমাস ট্রি বেয়ে উঠে। তার কিছু দূরে একটা গির্জা। গিজার পাশে রয়েছে বিশাল বড় এক ক্যাকটাস গাছ।এই ক্যাকটাসের বয়স নাকি প্রায় একশ বছর। তারপরই শুরু হয়ে যায় স্কুল, কলেজ, অফিস, ট্রেন-বাস স্টেশন। কাচাবাজারের দোকান। ডিপার্টমেন্ট স্টোর। বাস স্টেন্ডান হতে খানিকটা দূরেই হসপিটাল এবং রেস্তোরা। বিভিন্ন ক্যাটাগরির রেস্তোরা আছে
চীনা, জাপানিজ, ইন্ডিয়ান, কোরিয়ান, ইটালিয়ান হরেক রকম দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যায় সেগুলো রেস্টুরেন্টে।
জুই আজকেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে পার্কের দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও উচ্চতার জন্য কিছুই বোঝা যায় না। তাও জুই বুঝতে পারলাও, লাল টিশার্ট পড়া অভিক তার ফ্রেন্ডদের সাথে খেলা করছে। ফুটবল খেলছে তারা। অভিককে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে বেশ মজা পাচ্ছে। অভিকের একজন আফ্রিকান ফ্রেন্ড আছে। নাম মেবি মালিশা বা মরিশা। খুব মিল তাদের!
জুই অভিকের কাছ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। অভিকের দিকে তাকিয়ে থাকলেই তার কান্না পায়।
হুয়াই সি এস বিহেবিং লাইক এ ব্রাউন মম?এই যে গরমে অভিক ঘেমে গেছে তার মন চাচ্ছে ছুটে গিয়ে তার বেবিকে এসিতে এনে বসিয়ে ঠান্ডা জুস খেতে দিক।
জুই রুমে এসে নিজের চুল বেধে নিল। তাকে বেরুতে হবে। পরনে তার স্লিভলেস শার্ট আর টাইট জিন্স।
তাকে হসপিটাল যেতে হবে। আচ্ছা আজকে অভিককে সঙ্গে নিলে কেমন হয়? সে বোর ফিল করবে নিশ্চয়ই! করুক!
আজকে জুই অভিককে নিয়ে সারা দিন ঘুরবে। আজকের দিনটা স্মরণীয় করে রাখবে। যেন স্বর্গে গেলেও তার এই স্মৃতি মনে থাকে৷ বাংলাদেশে লিগ্যাল নোটিশ ও পাঠাতে হবে। অনেক কাজ বাকি। তাও আজকে সে অভিককে নিয়ে ঘুরবে। মাকে নিয়ে অভিকের কিছু স্মৃতি তো থাকা চাই। যেন অনেক বছর পর কোন অলস দুপুরে মাকে নিয়ে ভাবলে কিছু মনকাড়া দৃশ্য ভেসে উঠে!
জুই গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে লিফট দিয়ে নিচে নেমে, গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করল, এরপর গ্যারেজের গেট লাগিয়ে পার্কের সামনে গিয়ে অভিক ধরে এনে গাড়িতে বসালো।
অভিক নাক ফুলিয়ে বলে উঠে, মাম্মা দি এস নট ডান!
জুই গাড়ির এসির স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল।
এই হাসিটা এতোটাই প্রানবন্ত ছিলো যে জুই নিজেই আচমকা কেদে দিল। তবে সেটা নিরব কান্না!
হসপিটালে সে অভিককে কোলে বসিয়ে ডক্টর এলবার্টের অপেক্ষা করছে।
জুই এমন ভাবে শক্ত করে অভিক কে ধরে বসে আছে যে অভিকের শ্বাস আটকে যাচ্ছে।
এলবার্ট এসে বেদনা ভরা মুখে বলে, দেরি করার জন্য দুঃখিত লেডি।
জুই মুচকি হেসে বলে, ইটস ওকে ডক্টর! আপনি দয়া করে রিপোর্ট গুলো দেখে আমাকে কৃতজ্ঞ করুন।
এলবার্ট হেসে রিপোর্ট দেখতে লাগলো।জুইয়ের পরশুদিনের টেস্টের রিপোর্ট। আজকেই এসেছে। রিপোর্ট গুলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
জুই শক্ত করে অভিক জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে একাধারে।
এলবাট বলে উঠে, আই এম সর্যি মিস জুই! কিভাবে বলব বুঝে পাচ্ছি না,,,,,
— অপারেশন সাকসেস হওয়ার চান্স কত পার্সেন্ট ডক্টর?
— টুয়েন্টি!
জুই চোখ বন্ধ করল। গাল বেয়ে পানি পড়ছে তার। অভিক অদ্ভুত নজরে মাকে দেখছে।
জুই শান্তসুরে বলে, বাট ইটস আমেরিকা!
— আমেরিকায় কি অপারেশন আনসাকসেসফুল হতে পারেনা?
— আমেরিকাতেও মৃত্যু আসে। তাই না ডক্টর?
— সব ঈশ্বরের ইচ্ছা মাই ডার্লিং!
জুই আচমকা হুহু করে কাদতে লাগে। এই মূহুর্তে যে-কেউ তাকে দেখে মুগ্ধ হবে। এতো অপূর্ব লাগছে তাকে। কোথায় যেন বাঙালী আভা ফুটে উঠছে।
কাদছে জন্যই কি তাকে বাঙালী আর দশটা মেয়ের মতো লাগছে?
এলবার্ট ঘাবড়ে গেল। কি বলে সান্ত্বনা দিবে জুইকে? এ যে এক ভয়াবহ রোগ!
জুই যেমন হুট করে কেদে দিয়েছিল তেমনি হুট করে কান্না থামিয়ে হেসে অভিককে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে, আইসক্রিম খাবে বেবি? কফি ফ্লেবারের?
অভিক মায়ের গালে চুমু খেয়ে বলে, আমি কিছুই খাব না মাম্মা। প্লিজ ডোন্ট ক্রাই!
— মাম্মা ইস নট ক্রায়িং বেবি।
চলবে।