বেলা শেষে শুধু তুমি পর্ব-২৮+২৯

0
545

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৮

বাস স্ট্যান্ডে এসেছে সবাই। রোদকে বারবার আড়াল করার চেষ্টা করছে অনিন্দিতা। বিকেল হলেও কড়া রোদ যেন পিছু ছাড়বার নয়। ভ্রুযুগল বিরক্তে কুঁচকে গেছে তার। এমন সময় তার মাথার ওপরে ছাতার নিয়ে দাঁড়াল কেউ। ছাতার মালিক কে দেখতে ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছন বেঁকে তাকায় অনিন্দিতা। ইশানকে দেখে তার চোখমুখের বিরক্তির ছাপ দূর হয়ে যায়। গম্ভীর হয়ে আসে চেহারা। ইশান এসেছে সবাইকে পৌঁছে দিতে। অনিন্দিতা সেটাই জানে। হালকা কেশে সে গম্ভীরতার সাথে বলে……
–“লাগবে না আমার ছাতা। তুমি তোমার কাছে রাখো।”

–“তুই কি মনে করিস নিজেকে? আমি তোর জন্য ছাতা ধরে আছি? মা বলেছে তোরা যতক্ষণ আমাদের গ্রাম ও জেলার মধ্যে আছিস ততক্ষণ যেন তোদের কোনো সমস্যা না হয়। হলে তো আমাদেরই বদনাম হবে না? সেকারণে ছাতাটা ধরে আছি। নয়ত তোর মতো ছাগল ছানার মাথার ওপর ছাতা ধরতে বয়েই গেছে আমার।”
–“হয়েছে তোমার? এখন চুপ করো। মাথাব্যাথা ধরে যাবে তোমার কথাবার্তা শুনলে।”
বলেই অন্যদিকে তাকায় অনিন্দিতা। কয়েকদিন ধরে ইশান বেশ খেয়াল করছে অনিন্দিতা সকলের সাথে ভালো করে কথা বললেও তার সাথে রেগে রেগে কথা বলে! মেয়েটার কোন পাকা ধানে সে মই দিয়েছে কে জানে!

অভয় বড় বড় লাগেজ বাসের ভিতরে রেখে সবাইকে বাসে উঠতে বলে। ঐশানী সহ সকলে বাসে উঠে পড়ে। অনিন্দিতা হনহনিয়ে বাসে উঠে পড়ে সবার আগেই। নিজের সিট দেখে বসে পড়ে। বাস ছাড়বে কিছুক্ষণের মাঝেই। চোখ বন্ধ করে সিটে গা এলিয়ে বসে থাকে অনিন্দিতা। অনুভব করে পাশে এসে কেউ একজন বসল। হবে হয়ত কোনো তার মতোই প্যাসেঞ্জার। জানালার দিকে মাথা এলিয়ে দিল সে। বাস ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে। অনিন্দিতা হালকা জানালা দিয়ে মাথা বের করে ইশানকে দেখার চেষ্টা করছে। ও কি আছে? নাকি চলে গেছে? এখন কেন যেন তার মনে হচ্ছে সে নিজের অনুভূতি না জানিয়ে ভুলই করেছে।
–“আমাকে খুঁজছিস নাকি? আমাকে খুঁজতে খুঁজতে তোর মাথা কেটে পড়ে নিচে।”
চমকে কেঁপে উঠে নিজের পাশের সিটে তাকায় অনিন্দিতা। ইশান হাসি ঝুলিয়ে রেখে তারই দিকে তাকিয়ে আছে।

–“তু….তুমি এখানে? তোমার না বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা? আমাদের সাথে যাচ্ছো!”
–“কেন যেতে মানা করছিস?” (ভ্রু কুঁচকে)
–“আসলে তা নয়। তুমি আমাদের সাথে যাবে সেটা তো জানতাম না।”
বিস্ময়ের সঙ্গে বলে ওঠে অনিন্দিতা। এক মূহুর্তের জন্য পাশে থাকা মানুষটাকে স্বপ্নের মতোই মনে হলো তার। ইশান তাকে বিদ্রুপ করে বিদ্রুপাত্মক কন্ঠে বলল…..
–“জানবি কি করে? আমার খোঁজ খবর নেওয়ার তোর সময় আছে? একদিন দেখা যাবে আমি কে তাও চিনতে পারবি না। আমি তো ঢাকায় যাচ্ছি একটা কাজে। ইন্টারভিউ আছে চাকরির। ওখানে চাকরি হয়ে গেলে শিফট হয়ে যাব কোনো ফ্লাটে।”
অনিন্দিতা গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকে। একদিকে তার আনন্দই হচ্ছে। মানুষটা তার চোখের সামনে বেশ কয়েকদিন থাকবে। এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে?

বাসে মাস্ক পড়ে বসে রয়েছে এক দম্পতি। দুজন যেন দুজনের চরম শত্রু। দুজন দুজনের দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন দুজনে যেকোনো সময় যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। মাঝে মাঝে মেয়েটা মুখ থেকে অদ্ভুত শব্দ বের করে রাগ প্রকাশ করছে। এই অদ্ভুত দম্পতি আর কেউ নয় ঐশানী ও অভয়। ঐশানীর ফোলা নাক আর অভয়ের ফোলা গালের জন্য মাস্ক পড়ে বের হওয়া ছাড়া বিকল্প পদ্ধতি পায়নি দুজন। অভয় একসময় বিড়বিড় করতে করতে হিসহিসিয়ে বলে…..
–“সব তোমার জন্য হয়েছে। এভাবে শোধ নেয় কেউ? হৃদয়হীন মেয়ে।”

ঐশানী তা শুনে ঠাট্টা করে অদ্ভুত কন্ঠস্বরে ব্যঙ্গ করে বলে….
–“ওহ হো! সব আমার দোষ! আমি হৃদয়হীন? আর নিজে? নিজে যে আমার নাক দেখে মিটমিটিয়ে হাসছিলেন তখন? যা হয়েছে বেশ হয়েছে। নিজেই একটা হৃদয়হীন লোক। আপনাকে আরো কয়েকটা মৌমাছি হুঁল ফুটিয়ে দিলে বেশ হতো।”
–“আরো একবার হুঁল ফুটিয়ে দিতে এসেছিল তো মৌমাছি। তুমিই তো মৌমাছিকে কাজটা করতে দিলে না। কেন দিলে না?”
অভয়ের প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ঐশানী। একটু ভেবে উত্তর দেয়…..
–“ওই এ…এমনিই। আমি আপনার মতো নিষ্ঠুর তো নই। দয়াময়ী, মায়াময়ী আমি।”

–“মোটেও না। এর উত্তরটা আমি জানি। বলব?”
ঐশানীর কানের কাছে এসে অতি শান্ত ও শীতল কন্ঠে কথাটি বলে অভয়। ঐশানী হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করে অভয় কি ভাবছে তার সম্পর্কে? অভয় হাফ ছেড়ে বলে…..
–“কারণ আমার কষ্টে তুমি কষ্ট পাও। আমার আঘাত লাগলে যন্ত্রণা তুমি পাবে। তুমি এতোটাই সেলফিশ যে তোমার যন্ত্রণা লাগবে সেকারণে তুমি আমায় আঘাত পেতে দেখতে পারো না। ইউ আর সো সেলফিশ ঐশানী।”
–“যত্তসব বাজে কথা।”
জানালার ওপর হাত রেখে কনুই বের করে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে ঐশানী।

অভয়ও ঐশানীর সোজাসুজি মুখ রেখে বাইরের দিকে পর্যবেক্ষণ করে বলে…..
–“ইউ মিন টু সে আমার আঘাত লাগলে তোমার কিছুই হবে না।”
–“না।”
ঐশানী যে অতিকষ্টে নিজের কন্ঠস্বর থেকে ‘না’ শব্দটি বের করল তা বুঝতেই পারল অভয়। ফট করে বলল….
–“মরে গেলেও না?”
দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে অভয়ের দিকে তাকায় ঐশানী। সরাসরি ডান হাত অভয়ের শার্টের কলারে হাত রেখে বলে….
–“আপনি….. আপনি একটা বাজে লোক!”

অভয় অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটা কতটা ভয়ানক! কত সহজে তার কলারে হাত দিয়ে ঝাঁকাতে লাগল যেন আস্ত একটা গুন্ডি! ঐশানী কলার থেকে হাত সরিয়ে চোখও সরিয়ে নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যদিকে তাকায়। অভয় ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে….
–“আমি এমন কিছুই করিনি তোমার সাথে যে ‘বাজে লোক’ উপাধি পাবো। এমন কিছু বলিও নি। কি বলেছি বলো?”
–“আপনি কি চুপ করবেন?”
ঐশানী প্রচন্ড রেগে আগুন হয়ে পড়েছে। অভয় ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বলল….
–“ওকে দেন! চুপ।”
ঐশানী ঠান্ডা মাথায় বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে।

বাসে বমি করতে করতে অনিন্দিতার অবস্থা বেশ কাহিল হয়ে পড়েছে। এখনো দুই ঘন্টাও হয়নি বাসে ওঠার। তার মাঝেই চার বার বমি করে ফেলেছে সে। অবশেষে দুর্বল হয়ে জানালায় মাথা লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে ক্লান্তি নিয়ে বসে থাকে সে। ইশান তার কাঁধে হাত রেখে ডাকতেই সে ক্লান্তির আবেশে বলে….
–“ইশান ভাইয়া, আমি এখন ঝগড়া করার মুডে নেই। একা ছাড়ো।”
–“আরে গাঁধি আমাকে কি নিজের মতো ঝগড়ুটেই মনে করিস? তাকিয়ে দেখবি তো একবার?”
ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই অনিন্দিতার চোখে সামনে আবিষ্কার হয় একটা পানির বোতল। তা অনিন্দিতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ইশান বলল….

–“লেবুর পানি খা। ভালো লাগবে।”
–“তোমার তো বমি করার অভ্যেস নেই। তাহলে লেবু পানি আনলে কেন?”
–“আমি জানি আমার পাশে তো একটা মৃগী রোগী বসবে। কারণ আমাকে তো আর কেউ ঠাঁই দেবে না। শেষমেশ তোর পাশেই বসতে হবে। এখন পানিটা খা। নয়ত দেখা যাবে বমি করে আমার জামা মাখিয়ে ফেললি।”
অনিন্দিতা অভিভূত হয়ে কিছুক্ষণ ধরে ইশানের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর অন্যদিকে ঘুরে ইশানের অজান্তে মুচকি হাসে সে। তার ভীষণ ভালো লেগেছে। কারণ একটাই। অনিন্দিতা জানে ইশান তাকে কেয়ার করছে। আর মানুষ যারতার প্রতি কেয়ারিং হয় না। কিছু বিশেষ মানুষ থাকে। সেইসবের মানুষের প্রতি আপনা-আপনি যত্নশীল হয়ে ওঠা যায়।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধ্যার আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে কালো ঘন মেঘ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে। বর্ষার সময়। ঘন ঘন বৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বাসে অনেকটায় পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে সবাই। কিছুক্ষণ আগেই রেস্ট নিয়ে আবারও বাস চলতে শুরু করল। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল একসময়। পানির ঝাপটা জানালা দিয়ে আসতেই চোখ বুঁজে ঐশানীর হাত নিজের বুকে নিয়ে থাকা অভয় চোখ খুলে সোজা হয়ে বসল। ঐশানীরও ঘুমটা যেন পরিপূর্ণ হলো না। মুখে বৃষ্টির পানি পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠতে উঠতে বলল….
–“বাসের ছাঁদ ফুটো হয়ে গেছে। বাসের ছাঁদ ভেঙে পড়বে!”

চোখ খুলে আশেপাশে তাকাতেই সবটা স্বাভাবিক দেখে জানালার দিকে তাক করে তাকালো ঐশানী। বাইরের পরিবেশটা অসাধারণ! কিন্তু পানির ঝাপটা চোখেমুখে পড়ায় বিরক্তির ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে জানালা বন্ধ করতে লাগল অভয়। ঐশানী কড়া গলায় বলল….
–“একদম বন্ধ করবেন না জানালা! আমি বৃষ্টি দেখব।”
–“সেটা তো জানালা বন্ধ করেও করা যাবে ঐশানী। এভাবে ভিজলে তো ঠান্ডা লাগবে তোমার। আর শ্বাশুড়ি মায়ের থেকে শুনেছি তোমার অল্পতেই ঠান্ডা লাগে।”
–“আপনিও যদি এখন জ্ঞান দিতে শুরু করেন মায়ের মতো তাহলে আপনাকে মা বলে ডাকব।”

অভয় ক্ষেপে উঠে ক্ষিপ্ত গলায় বলে….
–“হোয়াট রাবিশ!!”
–“আমার মুখ থেকে মা না শুনতে চাইলে চুপ থাকুন।”
অভয়ের কথায় কোনোরকম পাত্তা না দিয়ে মাথা জানালা দিয়ে বের করে বৃষ্টি ভরা পরিবেশে শ্বাস নেয় ঐশানী। আনমনে বলে….
–“কি সুন্দর গন্ধ বৃষ্টির!”
তা শুনে অভয় হেসে ঠাট্টা করে বলে….
–“অদ্ভুত তোমার কথা! বৃষ্টির গন্ধ আছে?”
–“হু আছে। আপনার মতো নিরামিষ লোকের বোঝার ক্ষমতা নেই। যারা বৃষ্টিপ্রেমী তারাই এই গন্ধ পায়। বৃষ্টির অদ্ভুত মাতাল করা গন্ধ রয়েছে।”

–“যেমন তোমার শরীরে এক মাতাল করা ঘ্রাণ আছে সেরকম?”
ঐশানী লজ্জায় একাকার হয়ে হকচকিয়ে তাকায়। কি বলে এসব লোকটা? অকপট ভাবে লজ্জায় ঢোক গিলতে গিলতে মিইয়ে যায় সে। অভয় বাঁকা হেসে বাইরে তাকায় একবার আর একবার তার স্ত্রীর দিকে। হালকা ভিজে চুল গালে লেপ্টে থাকা দৃশ্যটা তার কাছে বড়ই মোহনীয় লাগল!

বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাতটা বেশ গভীর হয়। প্রায় সাড়ে দশটা বেজে যায়। সকলে ক্লান্ত। কারো শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই যেন। সব থেকে ক্লান্ত ঐশানী। তার পায়ের ধাপ ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। তার এই অবস্থা দেখে মিসেস. তনয়া নিজ হাতে ঐশানীকে খাইয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেন।
সকলেই বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বাড়িতে ফিরেছিল। ঐশানীও তাই। বরণ আরো বেশি। একটা শাওয়ার নিলে মন্দ হয় না। একেবারে শাওয়ার নিয়ে শোয়ার জন্য আসে ঐশানী। ভিজে চুল নিয়ে এসে বেডে শুয়ে পড়ে ঐশানী। চুল শুকিয়ে নেওয়ার মতো শক্তি ওর আর নেই। পাশেই উপুড় হয়ে আছে অভয়। হয়ত ঘুমিয়েও পড়েছে।

একদম কিনারায় শুয়ে বালিশ চেপে নিজেও চোখ বন্ধ করে ঐশানী। কিছুক্ষণ পরই নিজের ঘাড়ে এক তপ্ত নিঃশ্বাস পেয়ে শিহরণ বয়ে যায় শরীরে। তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে দুটো হাত। তড়তড় করে ঘামতে শুরু করে সে। তার বুঝতে বিন্দুমাত্র সময় লাগে না যে অভয় ঘুমায়নি। অস্বস্তি নিয়ে বলে….
–“কি হচ্ছেটা কি? সরে ঘুমান। এটা গ্রামের খাটের মতো ছোট না যে চিপকে ঘুমাতে হবে।”
–“তাতে কি? একবার যখন একে ওপরের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমিয়েছি তখন সারাজীবন এভাবে ঘুমাতে বাঁধা কীসের?”
–“আ…আপনি এভাবে জড়িয়ে ধরে থাকলে আমার অস্বস্তি হয়।”
–“তবে অভ্যেস করে নাও।”
ঐশানী চেয়েও পারে না অভয়কে সরাতে। তার মনটা সায়ও দেয় না। থাক না কিছু সুন্দর মূহুর্ত! তৈরি হক কিছুটা কাছাকাছি আসার গল্প।

সকাল সকাল অভয়ের অফিসে যাবার পর কোথাও যাবার জন্য তৈরি হয়ে নেয় ঐশানী। গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিচে নেমে আসে সে। নিচে মিসেস. তনয়া বসে বসে রেনুর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। যত আজগুবি কথা রেনুর সাথে করে উনি স্বস্তি পান। ঐশানীকে দেখে কথা থামিয়ে উনি প্রশ্ন করে উঠলেন….
–“কোথাও যাচ্ছো ঐশানী?”
–“হ্যাঁ আম্মু, আসলে আমার একটা বান্ধবী কল করেছিল। আমাদের কলেজে পরিক্ষা হবে কয়েকদিন পর। অনেকদিন কলেজ এটেন্ড করিনি। আজ আমাদের এডমিট কার্ড দেওয়ার কথা। সেটা নিতেই যাচ্ছি।”

–“অভয় যাওয়ার আগে বলতে পারতে। ও পৌঁছে দিতো।”
–“না না! তার কোনো দরকার নেই। উনার কাজ আছে তো। আমি একাই যেতে পারব। আমার একটু দেরিও হতে পারে। চিন্তা করবেন না।”
মিসেস. তনয়া হাসি মুখে বলেন…..
–“ঠিক আছে। সাবধানে যেও।”
ঐশানীও হেসে বেরিয়ে আসে। অটো ধরে কলেজের দিকে যায় সে।

দুপুর হবার পরেও ঐশানীও কোনো খবর নেই। মিসেস. তনয়া চিন্তায় পড়ে গেলেন। ঐশানী বলেছিল দেরি হতে পারে। কিন্তু এতোটা দেরি হবে ভাবেনি সে। বসে বসে চিন্তা করতে করতে বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছেন। অনিন্দিতা তার মায়ের মুখ থেকে কথাটা শুনে বেশ চিন্তিত। খাওয়াদাওয়ার সময় হয়ে এলো। তবুও মেয়েটি আসার নাম নেই। অনিন্দিতা ফোন দিয়ে ঐশানীর নম্বর বন্ধ পেয়েছে। সেকারণে চিন্তা আরো বেড়ে গেল ওর। হটকারিতায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল সকলে। বাড়িতে ইশানও নেই। সে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছে।
–“মা, তুমি একবার আমায় বলবে না? তাহলে আমিও ভাবির সাথে যেতাম।”
উদ্বিগ্ন হয়ে বলে ওঠে অনিন্দিতা। মিসেস. তনয়া উদাসীনতার সাথে বলেন….
–“গল্প করতে করতে এতো খেয়াল করিনি। আসলেই ভুল হয়েছে। আজকালকার যুগ ভালো নয়। মেয়েটার জন্য মনটা হাসফাস করছে আমার রে অনি!”

–“ভাইয়াকে কি খবর টা জানাবো?”
–“জানি না। শুধু ঐশানীর একটা খবর পেলেই চলবে আমার।”
মিসেস. তনয়ার সাথে কথাবার্তা বলে পারমিশন নিয়ে অনিন্দিতা বেরিয়ে পড়ে ঐশানীর কলেজের উদ্দেশ্যে। সেখানে কোনো খবর পায় কি না সেটা জানতে যায় অনিন্দিতা। তারও ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।
প্রায় এক ঘন্টা পর বাড়ি ফিরে অনিন্দিতা। মিসেস. তনয়া ড্রয়িংরুমে পায়চারি করছিলেন। অনিন্দিতাকে দেখে উনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। আশেপাশে ঐশানীকে দেখতে না পেয়ে বলেন…..
–“ঐশানী কোথায়? ওকে আনিস নি সাথে?”

অনিন্দিতা নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ থাকে। কাঁপা কাঁপা সুরে বলে…..
–“ওখানে ভাবি নেই মা। ওখানে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ওখান থেকে বেরিয়েছে প্রায় ৩ ঘন্টা!”
–“কি বলছিস? কোথায় গেল মেয়েটা? এখন কি করব? ওর কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
অতি মাত্রায় উত্তেজিত হয়ে বলেন মিসেস. তনয়া। অনিন্দিতা এর কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। ওর সন্দেহের তীরটা অভয়ের দিকে যাচ্ছে। তার যথেষ্ট কারণ আছে। এমনটা হয়নি তো? যে অভয় সায়রাকে ভুলতেই পারেনি আর সেখান থেকে কষ্ট পেয়ে ঐশানী কোথাও চলে গিয়েছে? আরো নানান চিন্তায় বিপাকে পড়ে যায় অনিন্দিতা।

চলবে…..

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৯

বিকেল হয়ে এসেছে। ড্রয়িংরুমে কপালে হাত ঠেকিয়ে চিন্তার ভঙ্গিতে বসে আছেন মিসেস. তনয়া। উনার সামনে পায়চারি করে যাচ্ছে অনিন্দিতা। তার হাতে ফোন। ঐশানীর নম্বর বারংবার ডায়াল করেও রেসপন্স পাচ্ছে না সে। ইশান ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে অনেকক্ষণই হলো। বাড়িতে এসে এই পরিস্থিতির কথা শুনে সেও চিন্তিত হয়ে পড়ে। গলার নিচে খাবার নামাতে পারেনি কেউই। মিসেস. তনয়া ইশানকে বারবার খেতে বললেও খায় না সে। সবাইকে রেখে কি করে একা একা খেয়ে নেবে?
–“আর কোনো আশা দেখতে পাচ্ছি না রে অনি। ঐশানীর নিশ্চয় কোনো সমস্যা হয়েছে। বিপদ হয়েছে। ওর মা-বাবাকে কি জবাব দেব? মেয়েটাকে ঠিক মতো আগলে রাখতে পারলাম না।”

কান্না জড়িত কন্ঠে মিসেস. তনয়া কথাগুলো বলতেই অনিন্দিতা হালকা বিরক্তি নিয়ে বলে……
–“মা! তুমি একটু বেশিই ভাবছো। কান্না শুরু করো না। ভাবির কিছু হয়নি। নিশ্চয় কোনো কাজে আটকা পড়েছে।”
–“যদি তাই হতো ফোন করে অন্তত জানাতো। আমার মনে হচ্ছে নির্ঘাত মেয়েটার সাথে কোনো উল্টাপাল্টা কিছু হয়েছে।”
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মিসেস. তনয়া।
অনিন্দিতা ফোন রেখে দ্রুত ছুটে আসে পানি নিয়ে। মায়ের হাতে পানি ধরিয়ে দ্রুত বলে……
–“ভাবির কিছুই হবে না। কান্না থামিয়ে পানি খাও। আর কিছু মুখে দাও। দুপুরে কিছুই খেলে না।”

মিসেস. তনয়ার ভাবান্তর হলো না। পানির গ্লাস মুখে নিতেই সদর দরজা পেরিয়ে হনহনিয়ে ভেতরে ঢোকে অভয়। তার চেহারার দশা দেখে সকলেই আঁতকে ওঠে। ইশান অভয়কে খবর দিতেই সে দেরি না করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অভয় তখন হসপিটালে ছিল। ওর ডক্টর বন্ধুর সাথে ঐশানীর লুকিয়ে খাওয়া ঔষুধের ব্যাপারে আলোচনা করছিল সে। খবর পাওয়া মাত্র ঐশানীর কলেজেও গিয়েছিল সে কিন্তু কলেজ বন্ধ! সেখান থেকে বাড়িতে ঢুকে পড়ে সে। এলোমেলো চুল, চোখমুখ লাল, ব্লেজারের বোতাম খোলা। এককথায় ঐশানীর খবর পেয়ে অগোছালো হয়ে পড়েছে সে। ইতিমধ্যেই যেন হারিয়ে ফেলেছে নিজের অস্তিত্ব! তার মনটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে বলে চলেছে….
–“এবার তুই তোর ভালোবাসা হারিয়েই ফেললি অভয়। চিরতরে হারিয়ে ফেললি।”

বুকে তার চিনচিনে ব্যাথা! বেশ কয়েকটা শ্বাস নিয়ে বলল……
–“ঐশানী ফিরেছে?”
অনিন্দিতা ঢোক গিলে বলে….
–“না ভাইয়া। এখনো ফেরেনি।”
–“তো ও যখন কলেজে যেতে বের হচ্ছিল তখন তুই কি করছিলি? ঘোড়ার ঘাস কাটছিলি? কেন যেতে পারিসনি ওর সাথে? হ্যাঁ? বল কেন যেতে পারিসনি?”
গলা ফাটিয়ে রাগে চিৎকার করে কথাগুলো বলতেই সকলে চমকে ওঠে। অভয় রেগেমেগে চিৎকার করে কথা বলার মতো ছেলে না। এমনকি রাগলে সে রাগটাও প্রকাশ করে অবধি। আজ সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কথায় আছে, যখন বিষয়টা জীবনে ব্যাপার হয় তখন মানুষ কি করবে বা কি বলবে সকল জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আর অভয়ের কাছে ঐশানী তার জীবনের থেকে কম কিছু নয়।

দুইহাত দিয়ে মাথার চুল পাগলের মতো আউলিয়ে বেশ শান্ত হয়ে পড়ে সে। অভয়ের আচরণের কূলকিনারা বুঝতে পারছে না কেউই। ইশান বিস্ময়ের সুরে বলে….
–“তুই ঠিক আছিস অভয়?”
অভয় শান্ত ভঙ্গিতে সকলের দিকে তাকায়। ইশানের প্রশ্ন উপেক্ষা করে অনিন্দিতাকে কটাক্ষ করে বলে ওঠে…..
–“কখন বেরিয়েছিল ঐশানী?”
–“ওই ভাইয়া তুই পরপরই বেরিয়েছিল।” (ভয়ে ভয়ে)
–“ওহ তাহলে অনেক সকালে! আর আমি একটু আগে খবরটা পেলাম! কেন? বলো! মা, এতোক্ষণেও তোমরা আমায় কিছু জানাও নি কেন? এতোটা ইরেসপন্সিবল কি হও তোমরা?”

সকলে অভয়ের চিৎকারে কুঁকড়ে যায়। মিসেস. তনয়া অসহায় ভঙ্গিতে বলেন….
–“আমি মানা করেছি কারণ তুই চিন্তা….. ”
–“থাক! এখন আর কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমি বাইরে যাচ্ছি। ইশান, তুই কি যাবি?”
ইশান দ্রুত মাথা দুলিয়ে উঠে আসে। অভয় ততক্ষণে বেরিয়ে যায়। ইশানও যায় পিছু পিছু।

গাড়িতে দুজনে উঠতেই গাড়ি স্টার্ট দেয় অভয়। গ্যারেজ পেরিয়ে গাড়ি মেইন লোহার গেইট অবধি পৌঁছাতেই গেটের সামনে এসে একটা অটো থামে। অটো থেকে অভয় ও ইশানকে অবাক করে দিয়ে বেরিয়ে আসে ঐশানী। হাতে তার এডমিট কার্ড সহ আরো কাগজপত্র। ইশানের মুখ অটোমেটিকলি খুলে যায়। অভয় গাড়ি থামিয়ে দিয়ে ঐশানীকে ভালো করে দেখে নেয়। হ্যাঁ, ওটা ঐশানীই! গাড়ির দরজা খুলে ঝড়ের গতিতে ঐশানীর সামনে অভয় দাঁড়িয়ে পড়ে। অটোর ভাড়া মিটিয়ে সামনে তাকাতেই ভড়কে উঠে দুই ধাপ পিছিয়ে যায় ঐশানী। বিকেল গড়িয়ে চারিদিকে আলো প্রায় নিভে এসেছে। এসময় এভাবে অভয়কে একটা অবয়বের মতোই লাগবে! ভালো করে ঐশানী লক্ষ্য করে মানুষটা অভয়।

–“ওভাবে কেউ দাঁড়ায়? ভূত টূত ভেবে যে কেউ পালিয়ে যাবে। আমার মতো সাহস দেখিয়ে সবাই মুখটা ভালো করে দেখবে না আপনার।”
–“কোথায় ছিলে?”
অভয়ের কথাগুলো ভূতুড়ে ভূতুড়ে শোনালো। গলাটা ভীষণ ভার! ঐশানী এক হাত দিয়ে সব কাগজ ধরে পায়ের আঙ্গুল দিয়ে একটু উঁচু হয়ে অন্যহাত দিয়ে অভয়ের গাল ও চুল স্পর্শ করে বলে….
–“এই আপনি সত্যিই অভয় তো? নাকি কোনো ভূত শ্যামলা ঘোড়ার রুপ ধরে এসেছে। গলার স্বর কেমন যেন শোনাচ্ছে।”

–“ইশান! তুই গাড়ি নিয়ে ভেতরে যা। আমি ওকে নিয়ে পড়ে আসছি।”
ইশানের বুঝতে দেরি লাগল না যে ঐশানীর ওপর দিয়ে অভয় নামক ঝড়টা উপচে পড়তে চলেছে। গাড়ি থেকে নেমে তাড়াতাড়ি করে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল….
–“স্বামী-স্ত্রী এর চুল ছিঁড়াছিঁড়ির মাঝে আমার না থাকায় ভালো। শেষমেশ আমাকে নিয়েও চুল ছিঁড়াছিঁড়ি লাগবে তখন আমার যতটুকু চুল অবশিষ্ট আছে তাও থাকবে না। তখন আমাকে বিয়ে করবে কোন যুবতী?”
গাড়ি ইউটার্ন নিয়ে গ্যারেজের ভেতরে ঢুকে গেল ইশান।

ঐশানী অভয়ের হাবভাব বুঝতেই পারছে না। লোকটার কি হয়েছে? সরু চোখে তাকিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলে….
–“কি হয়েছে আপনার? কোনো সমস্যা? এমন লাগছে কেন আপনাকে?”
কথাটা শেষ হতে না হতেই ঐশানীর ডান গালে সজোরে চড় পড়ল। আকস্মিক ঘটনায় কিছুটা দূরে ছিটকে গিয়ে গালে হাত দিয়ে ছলছল নয়নে তাকায় সে। বুঝার চেষ্টা করল আজ সে কি এমন করেছে যার কারণে অভয়ের হাতে তৃতীয় বারের মতো চড় খেতে হলো? বাড়িতে ফিরতে দেরি হয়েছে বলে? অস্ফুটস্বরে বলে….
–“আ…আপনি….”
পুরো কথাটা বলতেই দেয় না অভয়। গর্জে ওঠে সে….

–“শাট আপ! একদম চুপ। কি ভাবো তুমি নিজেকে হ্যাঁ? মিনিমাম সেন্স টুকুও মাথার মধ্যে নেই? ও তা থাকবে কি করে? তোমার মাথায় তো সারাদিন এটা ঘুরতে থাকে যে, আমার থেকে কি করে মুক্তি পাওয়া যাবে? আমার থেকে কি করে ছাড়া পাবে? তাই না? আরে আমার কথা বাদ দাও। বাড়িতে মা আছে, অনি আছে। অন্তত ওদের কথা একবার ভেবে দেখতে। একবার কল করে বলতে পারতে তোমার আসতে দেরি হবে। তুমি জানো? তোমার চিন্তায় ওরা খাবার অবধি খেতে পারেনি। মা তো কান্না করতে বসেছে।”
ঐশানী হতভম্ব হয়ে যায়। আবারও বলতে নেয়…..
–“আমি কল করতে পারিনি আমার ফোন…..”
–“হুঁশশ! কোনো সাফাই গাইবে না। এখন যা বলার মাকে গিয়ে বলো। লেটস গো!”

ঐশানীর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে অভয়। বাড়িতে ওরা ঢুকতেই ঐশানীকে দেখে যেন সকলে প্রাণ ফিরে পায়। সতেজ হয়ে ওঠে। মিসেস. তনয়ার কাঁদো কাঁদো মুখে হাসি ফুটে ওঠে। উচ্ছ্বাসের সাথে দাঁড়িয়ে পড়েন উনি। আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন…..
–“ঐশানী!”
ঐশানীকে টানতে টানতে এনে সামনে ছুঁড়ে ফেলে অভয়। রেগেমেগে বলে…..
–“এইযে তোমার ইরেসপন্সবল ছেলের বউ। সারাদিন বাইরে কাটিয়ে একবারও ফোন করার প্রয়োজনবোধ কর নি। তার জন্য তোমরা না খেয়ে বসে ছিলে। কি জিজ্ঞেস করবে তোমরাই করো।”
বলেই আবারও ঝড়ের বেগে বাইরে বেরিয়ে যায় সে।

মিসেস. তনয়া এগিয়ে এসে ঐশানীর দিকে তাকিয়ে বলেন…..
–“একটা কল করতে পারতে। তাহলে এভাবে চিন্তা হতো না আমাদের।”
–“আমাকে কেউ বলারই সুযোগ দিতে চাইছে না। আমি এডমিট কার্ড নিয়ে রিনির বাড়িতে গিয়েছিলাম। এতোদিন কলেজে যেতে পারিনি। পড়ার জন্য নোট নিতে গিয়েছিলাম। আর আমি তো আপনাদের কল করতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু গতকাল ফোনে চার্জ দেওয়া হয়নি। ফোনটা বের করতে আবার হুট করে কাঁদায় পড়ে যায়। তবুও কল করতে পারতাম কিন্তু আপনাদের কারোর নম্বরই আমার মুখস্থ নেই।”

–“তাহলে তোমার মা-বাবার নম্বর তো মুখস্থ ছিল ভাবি। তাদের কল করে জানিয়ে দিতে বলতে।”
অনিন্দিতার বলা কথাগুলো মাথাতেই আসেনি ঐশানীর। এক হাত দিয়ে নিজের কান ধরে সকলের সামনে বিনীত সুরে বলে…..
–“আই এম সরি। আমি বুঝতে পারিনি এতোটা দেরি হবে। আর আপনারা এতোটা চিন্তা করবেন। আর বিশেষভাবে মা! আপনাকে সরি। কিছু খেয়ে নিন। আর কখনো এমন হবে না।”
মিসেস. তনয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। হতাশ হয়ে বললেন….
–“সরি বলে কি হবে? দোষটা হয়ত আমাদেরই। আমরাই হয়ত তোমার আপন হতে পারিনি। এটা আমাদের দোষ। রেনু, আমার খাবারটা ঘরে নিয়ে আয়।”

বলেই আস্তেধীরে ড্রয়িংরুম ত্যাগ করলেন মিসেস. তনয়া। উনার কথায় অভিমানের ছাপ পেলো ঐশানী। সত্যি সে আজ বড্ড বোকামি করে ফেলেছে। সকলকে চিন্তায় ফেলেছে। নিজেকে মনে মনে বকতে থাকে সে। অনিন্দিতা ঐশানীর উদ্দেশ্যে নরম সুরে বলে….
–“মা একটু অভিমান করেছে। দুঃখ পেয়েছে। তাই ওসব বলে ফেলেছে। চিন্তা করো না। একটু সময় দাও ঠিক হয়ে যাবে। তুমি কিছু খেয়েছো?”
–“হ্যাঁ ওই রিনির বাড়িতে হালকা খাইয়ে দিয়েছে।”
–“তাহলে ওপরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। আর ভাইয়া অনেক রেগে আছে। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলো। রাগ ভেঙে যাবে।”
ঐশানী মাথা নাড়ায়। অনিন্দিতা রান্নাঘরের দিকে ছুটে যায়।

বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে শাড়ি পড়ে এসে হাফ ছেড়ে বসল ঐশানী। চেহারায় তার উদাসীন ভাবটা লেগে আছে। যেন সে কিছু নিয়ে বড়ই উদাসীন। বাইরে বয়ে যাওয়া জোড়ালো বাতাস ঘরটাকে ঠান্ডা করে দিলেও ঐশানীর মন অবধি কিছুতেই ছুঁতে পারছে না। বাইরে হয়ত কিছুক্ষণ পর ঝড় উঠবে। তবে ঐশানীর মনে ঝড়টা শুরু হয়ে গেছে। চোখে পানি টলমল করছে। মুখ নড়াতেই ডান গালে ব্যাথা পায় ঐশানী। গালে হাত দিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলে ওঠে….
–“ইশশ… ওই হাতুড়ি মার্কা হাত দিয়ে মারলে কি গাল আর থাকে? গালটা থেঁতলে যায়নি এটাই অনেক।”
কিছুক্ষণ থেমে বাইরের পরিবেশ দেখে আবারও বলে…..
–“বাইরে তো ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে। শ্যামলা ঘোড়া কি আজ বাড়ি আসবে না?”

মুখ থেকে কথাটি না ফুরাতেই দরজা খোলার শব্দ ভড়কে গিয়ে দুটো গালে হাত দিয়ে ঢেকে বসে থাকে ঐশানী। অভয় সেদিকে লক্ষ্য না করে টাওয়াল নিয়ে চলে যায় সোজা ওয়াশরুমে। হাফ ছেড়ে কিছুক্ষণের জন্য বাঁচলেও কিছুক্ষণ পরেই অভয় বাথরোব পড়ে বের হতেই আবারও আগের মতো গাল ঢেকে বসে থাকে সে। অভয়ের চোখের দিকে তাকানোরও সাহসটুকু পাচ্ছে না সে। অভয় আরো ইচ্ছে করেই তার সামনে সামনে পায়চারি করে নিজের চুল মুছছে। তবুও তাকাতে পারছে না ঐশানী। হয়ত তার রাগ দেখে ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা। পাওয়ায় স্বাভাবিক। অভয় দুম করে ঐশানীর সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে। কেঁপে উঠে তাকায় ঐশানী। অনুভূতি শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অভয়ের দিকে। সযত্নে ঐশানীর গালে হাত রাখে অভয়। তার ঠান্ডা হাতের স্পর্শে নড়তেও ভুলে যায় ঐশানী। বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বলে….
–“খুব লেগেছে?”

–“আপনার ওই ডাম্বেলের মতো হাত আমার গালে পড়লে লাগবে না?” (ভীতি নিয়ে)
–“রাগটা দমাতে পারিনি। তুমি কি জানো? তোমায় না পেয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছিলাম। মনে হয়েছিল তুমি আমার থেকে দূরে চলে গেছো। তোমাকে আর চোখের দেখাও দেখতে পারব না। যতটুকু ছুঁতে পারি ততটুকুও পারব না। আমাকে একটা কল করে নিলে কি এমন ক্ষতি হতো?”
–“আপনার ফোন নম্বর আমার কাছে আছে? কখনো দিয়েছেন?”
অভয় চুপ করে গেল। তারপর বলল….
–“তুমিও তো কখনো আগ্রহ দেখিয়ে ফোন নম্বরটা নিতে আসোনি। তাহলে তুমিই ভাবো আমাদের সম্পর্কের গভীরতা!”

–“সম্পর্কে গভীরটা ফোন নম্বর বা অন্যকিছু দিয়ে হয় না। সম্পর্কে গভীরতা মন দিয়ে হয়। আর আমি মনে করি এই গভীরতাটুকু আমাদের মাঝে যথেষ্ট আছে।”
অভয় একটু এগিয়ে গিয়ে উপুড় হয়ে ঐশানীর ডান গালে যেখানে মেরেছে সেখানে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। ঐশানী এতে খামচে ধরে অভয়ের হাত। চোখমুখ খিঁচে ফেলে সে। ঐশানীর মুখোমুখি হয়ে অভয় তার দুটো হাতই ওর কানের নিচে চেপে ধরে। তার চোখে শীতলতার আবেশ! কন্ঠেও রয়েছে শীতলতা।
–“তাহলে তুমি বলছো আমাদের মাঝে সম্পর্কের গভীরতা আছে? এ কেমন গভীরতা ঐশানী? যেখানে তুমি আমায় কিছুই বলতে চাও না? যেখানে তুমি আমায় ভরসা করে নিজের মনের সকল কথা উজাড় করে দিতে পারো না?”

ঐশানী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সরে বেডের ওপরে পা উঠিয়ে বসে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বলে…..
–“আমার মাঝে এমন কোনো গোপন কথা নেই যে আপনাকে বিশেষ করে কিছু বলতে হবে।”
–“আছে। তুমি বলতে চাও না। কারণ আমাদের বিয়েটা বিয়েই মনে করো না। প্রতিটা মূহুর্তে মুক্তি চাও। আচ্ছা বিয়ের এতোদিন হয়েও তোমার মনে আমি জায়গা করে নিতে পারিনি? যেমন তুমি আমার মনে পেরেছো? ছিটকে এক কোণে ফেলে দিয়েছো মোহ নামক জিনিসটাকে।”
ঐশানী নির্বাক হয়ে হাঁটুতে হাত রেখে বসে থাকে। উত্তর আর মেলে না। উত্তর না পেয়ে শান্ত অভয় উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ঐশানীর বাহু ধরে টেনে নামিয়ে আনে। তার বাহু জোরে চেপে ধরে বলে…..

–“আমি কি এতোটাই খারাপ স্বামী হিসেবে? এতোটাই অধম? যে তুমি আমাকে মেনে নিতে পারো না? বলো?”
ঐশানী না বোধক মাথা নাড়ায়। মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকিয়ে বলে…..
–“না আপনি খুব ভালো মানুষ অভয় কিন্তু….. ”
–“এই কিন্তু! এই কিন্তু শব্দটা আমার আর তোমার মাঝখানে পাঁচিল। ভালো মানুষ বললে না আমায়? হয়ত এটাই আমার দোষ। তাই না? তুমি বোঝো না? তোমার একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি পাগল। অতিতে যাই হোক না কেন #বেলা_শেষে_শুধু_তুমি। বর্তমান, ভবিষ্যত শুধু তুমি।”
ঐশানী চোখ বন্ধ করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। অভয়ের কথা এড়িয়ে গিয়ে বলে….
–“বাথরোব ছেড়ে কাপড় পড়ে নিন।”

অভয় ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ছেড়ে দেয় ঐশানীকে।
–“স্বামী মানে পৃথিবীর সব থেকে বড় বন্ধু! যাকে সবকিছু বলা যায়। কিন্তু তুমি তা মনে করো না। করলে আমার কাছ থেকে এতো বড় বিষয় লুকিয়ে যেতে না।”
ঐশানী আশ্চর্য হয়ে যায়। অভয় কি বলতে চাইছে। তার কোনো গোপন কথা? আগ্রহের সাথে বলে….
–“কি কথা?”
–“এরমানে এখনো তুমি সব লুকিয়েই যাবে। অনেক হয়েছে এবার আমি জানতে চাই! জানতে চাই কীসের এতো লুকোচুরি।”

বলেই অভয় দ্রুত নিজের ফোন বের করে একটা ছবি বের করে ঐশানীর সামনে ধরে। সেখানে স্পষ্ট ঐশানীর প্রতিনিয়ত খাওয়া ঔষুধের ছবি। একবার ছবি আরেকবার অভয়ের দিকে লক্ষ্য করে ঐশানী। অভয় কি সব জেনে গেল। তবুও সে দৃষ্টি সরিয়ে না জানার ভান করে বলল…..
–“এসব কি?”
–“নাটক করা বন্ধ করো। এটা কি তুমিও জানো। এই ঔষুধের ছবি আমি তোমার থেকেই পেয়েছি। আর ডক্টরের কাছ থেকে জানতে পেয়েছি এই ঔষুধ তারাই সেবন করে যাদের একটা কিডনিতে সমস্যা থাকে বা একটা কিডনি থাকে না। তাদের অন্য একটা কিডনি নিয়ে খুব সতর্ক থাকতে হয়। আর সামান্য সমস্যা হলেই ঔষুধ সেবন করতে হয়। তোমার কি হয়েছে ঐশানী।”

মুখে হাত চেপে ধরে টলটলে চোখে চেয়ে থাকে ঐশানী। যা নিয়ে ভয় পাচ্ছিল সেটাই ঘটল। অবশেষে। অভয় জোরে চেঁচিয়ে বলে…..
–“এখন আমি জানতে চাই ঐশানী। আজ আমাকে তোমায় সব বলতেই হবে। এট এনি কস্ট!”
ঐশানী বুঝে গেল চুপ থেকে আজ আর কোনো লাভও হবে না। মুখ থেকে হাত সরিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল…..
–“তাহলে শুনুন। আমার একটা কিডনি নেই।”
অভয় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। থেমে থেমে বলে….
–“মানে?”
–“সায়ান…..!!”

চলবে……

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন]