বেলা শেষে শুধু তুমি পর্ব-৩০+৩১

0
521

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩০

নিজের স্ত্রী এর মুখে অন্য একটা পুরুষের নামটা শুনে যেন অভয়ের হার্টবিট এক সেকেন্ডের জন্য হলেও থমকে গেল। মূহুর্তেই অকারণেই ‘সায়ান’ নামটির প্রতি অসংখ্য ঘৃণা ও রাগ তৈরি হয়ে গেল অভয়ের মনে আপনা-আপনি। তার মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিল। সেটা হচ্ছে, ‘ঐশানী যেদিন জেনেছিল তার স্বামী মানে অভয়ের জীবনে অন্য কোনো নারী আছে তখনও ঐশানীর মনেও এমনই ঝড় এনেছিল?’
একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে অভয় নিজেকে শান্ত রেখে বলল…..
–“সায়ান? কে সায়ান?”
–“আমার অতীত! একটা কালো অধ্যায়। যেই অধ্যায়টা আমি চাইলেও আমার জীবন থেকে ছেঁটে ফেলতে পারি না।

আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগের কথা। গল্পটা একটু ভিন্ন ছিল। অভয় ও ঐশানীর গন্তব্য অন্য ছিল! তাদের পথ আলাদা ছিল।

অতীত…..
–“ঐশানী!! আজ নাকি তোর কলেজের ফার্স্ট ডে। প্রথম দিনেই লেট করবি তুই?”
–“নো ওয়ে মা! গতকাল এখানে শিফট হলাম ঘরদোর গুছিয়ে নিতে ক্লান্ত আমি। একটু দেরি হলে এমন কিছু হবে না।”
ঘরের দরজা লক করতে করতে ব্যাগ নিয়ে হেলেদুলে ড্রয়িংরুমে পা রাখে ঐশানী। আজ তার কলেজের ফার্স্ট ডে। গতকালই সিলেট থেকে এসে ওরা ঢাকা শিফট করেছে। ঐশানী ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। ফার্স্ট ইয়ার গ্রাম থেকেই কমপ্লিট করে এসেছে সে। বয়স তার উনিশে পা রেখেছে।

খাবার টেবিলে এসে বসে ঐশী। তাকে দেখার সাথে সাথে ঐশানী আঙ্গুল উঁচিয়ে হুমকি দেওয়ার মতো করে বলে…..
–“আমি আমার রুম লক করে দিয়েছি। তোর চোরের মতো স্বভাব তো কোনোদিনও যাবে না। তাই সিকিউরিটি ফার্স্ট। তবুও যদি রুমে ঢোকার চেষ্টা করিস তাহলে খারাপ হয়ে যাবে।”
ঐশী তখন ছোট হলেও ভারি দুষ্টু। দুই বোন একই ধাতু দিয়ে তৈরি যেন। সে ইচ্ছে করে কাঁদো কাঁদো মুখ করে মিসেস. দিশার দিকে তাকাতেই মিসেস. দিশা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলেন…..
–“ও ছোট ঐশানী। এমন করিস কেন ওর সাথে?”
–“যাকে নদীর ধারে কুড়িয়ে পেয়েছি তার সাথে এতো ভালো করে কথা বলা অসম্ভব!”

বলেই আর এক মূহুর্ত অপেক্ষা করে না ঐশানী। দ্রুত পায়ে দৌড়ে বাইরে চলে আসে। ঐশী রেগেমেগে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে থেকে একসময় চিল্লিয়ে ওঠে….
–“মা দেখো! আপু এসব কি বলে গেল?”
–“তুই তো জানিস ঐশী। ও এমনই বাদ দে। ও বললেই তো সব সত্যি হয়ে যাবে না।”

ঐশানী আজ বড্ড খুশি। কত দিনের স্বপ্ন বড় কলেজে পড়াবে সে! আজ পূর্ণ হয়েছে। খুশিতে গদগদ হয়ে কলেজের গেটে পা রাখে সে। ভালো করে প্রথমেই আশপাশটা দেখে নেয়। প্রথমেই তার নজরে আসে ডান দিকে ক্যান্টিন। তার আগে ক্যাম্পাস। বড় ঘাস ভরা মাঠের মাঝখানে চার তলার বিশাল বিল্ডিং। আচ্ছা সে কোনদিকে যাবে? এখনো ক্লাস শুরু হতে ত্রিশ মিনিটের মতো বাকি আছে। সে ডানদিকে ক্যাম্পাসের দিকেই পা বাড়ায়। সেখানে বেশির ভাগ স্টুডেন্ট গল্পতে মগ্ন! কাঁপা কাঁপা পায়ে ক্যাম্পাসের ভেতর যেতেই বেশ চিল্লাপাল্লা ও হট্টগোল শুনতে পায় সে। সবাই যে যার মতো গল্প মশগুল। সে একা কি করবে? ভেবেই ভারি অসহায় হয়ে পড়ে। এরই মাঝে তার চোখ যায় একটা ছেলের হাতে থাকা গিটারের দিকে। ছেলেটা সহ আরো কয়েকজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। কথাবার্তাও শুনতে পাচ্ছে সে।

–“সায়ান কোথায়? তোকে গিটার রাখতে বলে কোথায় হারিয়ে গেল?”
–“কি জানি! রাখতে বলে কোনো কাজ আছে বলেই ছুটে গেল।”
–“দেখ কোনো গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গেছে। পারসোনাল কাজ হচ্ছে এটাই।”
–“তোরাও না আধপাগল! সায়ান আর গার্লফ্রেন্ড? ওর গার্লফ্রেন্ড তো এই গিটার। যেটা ছাড়া একটা কদমও চলে না।”
বলেই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল একে ওপরের ওপর ছেলেদের দল। ঐশানী আগ্রহের সাথে গিটার টা দেখে নেয়। একেবারে কালো রঙের গিটার। যেন চকচক করছে। প্রতিনিয়ত যেন গিটার টা পরিষ্কার করা হয়। হঠাৎ করেই গিটার টা বেশ ভালো লাগল ঐশানীর কাছে। একটু মুচকি হেসে নিল। ছেলেগুলোর দিকে তাকাতেই হাসি উধাও হয়ে গেল তার। ছেলেরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

ঢক গিলে ঝড়ের গতিতে সোজা স্ট্রেইট হেঁটে ক্যান্টিনের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। সূর্যের অতিরিক্ত তেজ! একটা ঠান্ডা কোক খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলে মন্দ হয় না। ঐশানী কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে ক্যান্টিনে ঢুকল। দোকান থেকে একটা কোক কিনে নিয়ে এসে বসল খালি চেয়ার-টেবিলে। কোক খেতে খেতে ফোনের দিকে মনোযোগ দিল সে। বেশ কিছুক্ষণ ফোন ঘাটাঘাটি করার পর একটা মেয়েলি কন্ঠে মাথা তুলে তাকায় ঐশানী।
–“এক্সকিউজ মি!”
–“ইয়েস?”
–“আমি কি টেবিল শেয়ার করতে পারি? আসল সব চেয়ার-টেবিল বুকড হয়ে গেছে। তোমাকে দেখলাম একা বসে আছো তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

মিষ্টি হেসে বলে মেয়েটা। এক পলকে মেয়েটাকে দেখে নেয় ঐশানী। উজ্জ্বল শ্যামলা গড়নের, টানা টানা চোখ, খাঁড়া নাক বিশিষ্ট ছিমছাম মেয়েটা। মেয়েটার জবাবে ঐশানীও সুন্দর হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে….
–“অবশ্যই বসে পড়ো। তাছাড়া আমি এখানে কাউকে চিনি না। নতুন হলে যা হয় আরকি!”
–“ওহ তুমি নতুন? নাম কি তোমার? কোন ইয়ার?”
–“ঐশানী। ঐশানী আমার নাম। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার। আর ঢাকায় নতুন শিফট হয়েছি। তাই কলেজেও নতুন। আর তুমি?”
–“হোয়াট এ কোয়েন্সিডেন্স! আমিও ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে এবার। আর আমার নাম সীঁথি।”

আরো গল্প হলো তাদের মাঝে। ক্লাসমেট হওয়ায় বন্ধুত্বটাও তৈরি হয়ে গেল খুব সহজেই। ঐশানীর যতটুকু অসহায় মনে হচ্ছিল ততটুকুও নিমিষেই কেটে গেল। সীঁথি ঘড়ি দেখে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল….
–“এই ক্লাস শুরু হবে। আজকে যেই স্যার প্রথমে ক্লাস নেবে সেই স্যার সময়মতো স্টুডেন্টদের না পেলে ক্ষেপে ওঠেন। তাড়াতাড়ি চলো।”
ঐশানীও দেরি না করে ফোন টেবিল থেকে নিয়ে উঠে পড়ল। দুজন ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে ঘাড় ভরা মাঠের ওপর পিচঢালা হাঁটার জন্য সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকল। কিন্তু এরই মাঝে ঘটল একটা বিপত্তি! অদ্ভুতভাবে তাদের দুজনের সামনে পড়ে গেল একটা বড়সড় কৃত্রিম পেঙ্গুইন।

সীঁথি পেঙ্গুইনে হাত বুলিয়ে বলল….
–“রাস্তার মাঝে এটা কে রাখল?”
–“যেই রাখুক। কিউট না?”
হাসিমুখে পেঙ্গুইনটা দেখে বলল ঐশানী। ভালো করে পেঙ্গুইনের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সীঁথি জোরেশোরে বলে ওঠে….
–“হেই ওয়েট! এই কলেজে অদ্ভুত জিনিস এমনি এমনি ঘটে না। এর পেছনে অনেকাংশে সিনিয়রদের হাত থাকে।”
ঐশানী সেসবের কাছে গিয়ে ফোনটা বের করে বলে….
–“এর মাঝে সিনিয়র রা আবার কি করবে? লেটস টেক এ সেল্ফি! কাম।”

সীঁথি ঠাঁই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। ঐশানী মনের সুখে ছবি তুলে চলেছে। কেমন পোজ দিয়ে ছবি তুলবে সেটা ভেবে পাচ্ছে না সে। একসময় ছবি তুলতে তুলতে নিজের ঠোঁটজোড়া সরু করে পেঙ্গুইনের কাছে নিয়ে যায় ঠিক সেই মূহুর্তে পেঙ্গুইন ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা জীবন্ত মানুষ। তাও আবার একটা ছেলে। ছেলেটির ফর্সা মুখে বিরক্তির ছাপ। ঘেমে একাকার হয়ে গেছে।
–“আরে ইয়ার! এই আমাকে কোথায় ফাঁসিয়ে দিলি আমার দ্বারা এস…..”
কথাটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তার থুঁতনির একটু ওপরে ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে ফ্রিজড হয়ে এলো সায়ান।

ঐশানী ঠোঁট সরু করে পেঙ্গুইন জড়িয়ে ছবি তুলতে নিলেই ফোনের ক্যামেরায় একটা ছেলেকে দেখে সেকেন্ডেই ধড়ফড়িয়ে ছিটকে আসে ঐশানী। চোখজোড়া কপালে উঠে যায় তার। ওপরকে সায়ানের চোখজোড়াও চরকগাছে পরিণত হয়েছে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। সায়ান তো নড়তে চড়তেই ভুলতে বসেছে। জীবনে যা নয় তাই ঘটে গেল! আশেপাশের সকলে দৃশ্যটা দেখে হতবাক। বেশ দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে ভিডিও করতে থাকা সায়ানের ফ্রেন্ডের দলের মুখ হা হয়ে গিয়েছে। যে ভিডিও করছিল তার হাত থেকে ফোন পড়ে গিয়েছে। সবাই বলাবলি করছে, ‘দ্যা গ্রেট গিটারিস্ট সায়ান শেখ! যে কিনা মেয়েদের থেকে একশ হাত দূরে থাকে সে আজ একটা মেয়ের চুমু খেয়ে হতবাক!’

–“আমি তোমাকে বলেছিলাম যে এটা কোনো চাল হতে পারে। তুমি কলেজে নতুন। তোমাকে জ্বালানোর চেষ্টা তো এরা করবেই করবে। কিন্তু সায়ান ভাইয়া এমন করেছে তা মানা যাচ্ছে না।”
ঐশানীর কোনো ধ্যানই নেই। তার কাঁধে হাত দিতেই নড়েচড়ে ওঠে ঐশানী। আশেপাশে তাকিয়ে সবাইকে দেখে কি করবে ভেবে পায় না সে। চোখজোড়া খিঁচে দুটো হাত দিয়ে দুটো চোখ ঢেকে সায়ানের উদ্দেশ্যে এক নিশ্বাসে বলে ওঠে…..
–“আমি জানতাম না আপনি এর মধ্যে ছিলেন। আই এম সরি! আই এম রিয়েলি সরি! আমি বুঝতে পারিনি।”
বলেই দুটো পা যেদিকে যায় সেদিকেই ছুট লাগায় ঐশানী। ওকে এভাবে ছুটতে দেখে সীঁথিও তার পিছু নেই। জোরে চিল্লিয়ে ডাকতে থাকে…..
–“দাঁড়াও ঐশানী। পড়ে যাবে তুমি।”

পেঙ্গুইনের ভেতর থেকে বেরিয়ে লাফ দিয়ে নেমো আসে সায়ান। তার দুটো চোখ নিবদ্ধ সেই ছুট লাগানো মেয়ের দিকে। তার সরু চোখে চিকন চশমায় স্পষ্ট মেয়েটির রিফ্লেকশন পড়েছে। অস্ফুটস্বরে সে বলে ওঠে….
–“ঐশানী!”
থুঁতনি একটু ওপরে হাত রাখে সে। যেখানে ঐশানীর ঠোঁটজোড়ার স্পর্শ পেয়েছিল সায়ান। সেখানে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি! তার বন্ধুদের দৌড়ে আসার শব্দে পকেটে এক হাত গুঁজে পেছন ফিরে চোখ গরম করে তাকায় সে। চোখেমুখে রাগি ভাব দেখে থতমত খায় সকলে। গম্ভীরতা ও রাগের সাথে বলে….
–“এই প্লানটা কার ছিল?”

দৃষ্টি নামিয়ে সকলে সকলের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতে দিতে থাকে। সায়ান সূক্ষ্ম চাহনি নিয়ে মিরাজের(সায়ানের বন্ধু) দিকে তাকিয়ে বলে…..
–“ডেয়ার টা আমাকে তুই দিয়েছিলি না?”
–“হ…হ্যাঁ আমিই দিয়েছিলাম কি…কিন্তু এটা আমার প্লান ছিল না বিশ্বাস কর। এটা তো রাহিদের প্লান ছিল। ও আমাকে বলেছিল এই ডেয়ার তোকে দিতে।”
নাহিদের দিকে দৃষ্টি তাক করতেই নাহিদ তুতলিয়ে বলে….
–“আমার কোনো দোষ নেই। আমি তো জাস্ট ভেবেছিলাম নতুন মেয়েটা এসেছে। আমাদের ভালো করে চিনে রাখুক। আমি তো শুধু তোকে ভয় দেখাতে বলেছিলাম। আমি কি করে জানব ও তোকে চুমু টুমুর মতো ভয়ানক জিনিস দিয়ে বসবে?”

–“মেয়েটা কি তোর কথামতো কাজ করবে নাকি?”
ধমক দিয়ে বলে ওঠে সায়ান। নাহিদের জবান এতটুকুতেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। সায়ান আবার আশপাশটা দেখে নেয় ঐশানীকে দেখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পায় না। শান্ত হয়ে মিরাজের কাছে গিয়ে গিটারের ব্যাগ নিজের পিঠে নিতেই ঘন্টা পড়ে যায়। সায়ান সামনের দিকে এগোতে এগোতে বলে….
–“লেটস গো। ক্লাস শুরু হবে।”
সামনে দুই কদম যেতেই আবারও ঘাড় ঘুড়িয়ে নাহিদের দিকে তাকিয়ে সায়ান বলে…..
–“যেই ভিডিওটা করেছিস ওটা ডিলেট করে দিবি। গট ইট?”
নাহিদ মাথা নাড়াতেই সকলের ক্লাসরুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে।

ক্লাসরুমে বেঞ্চে মাথা ঠেকিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে ঐশানী। মনে মনে নিজেকে অজস্র গালি দিচ্ছে সে। তার পাশে বসে আছে সীঁথি। ঐশানীকে লজ্জায় মুখ তুলতে না দেখে সে বলে ওঠে…..
–“রিল্যাক্স ঐশানী। আমি তোমায় আগেই বলেছিলাম সাবধানে থাকতে। কিন্তু সায়ান আজ নিজে মেয়েদের জ্বালাতন করতে লেগেছে ব্যাপারটা উইয়ার্ড।”
ঐশানী রেগে মুখ ফুলিয়ে মাথা তুলে ফোঁস ফোঁস করে বলে….
–“কেন? উনি এমন কোন ভদ্রলোক? আজ যদি উনি আমার সাথে এমন না করত তাহলে না হয় ভদ্রলোক ভাবতাম।”

–“সায়ান। যার ওপর চেহারার আগে তার গিটারের সুর ও গানের কন্ঠ শুনে লোকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়। চেহারার কথা বাদই দিলাম। এই কলেজে এখনো এমন কোনো গিটারিস্ট নেই যে সায়ানের চেয়ে সুন্দর গিটার বাজাতে পারে। তার গলার সুর শুনে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে।”
এতটুকুই শুনে ঐশানীর বেশ আগ্রহ হয় সায়ানকে জানার জন্য। মনোরোগ দিয়ে শোনে সীঁথির বলা কথাগুলো।
–“যেই সায়ানের হাত অবধি আজ পর্যন্ত কোনো মেয়েকে ধরতে দেখা যায়নি সেই সায়ানকে আজ তুমি চুমু খেয়ে বসেছো। ভাবতে পারছো?”
সীঁথির কথায় একটু ঘাবড়ে ঢক গিলে ঐশানী। তার পর দম নিয়ে বলে….
–“দেখো ভয় দেখাবে না। আমি ভয় পাই না। দোষটা উনারই। তবুও আমি সরি বলেছি।”
সীঁথি মুচকি হেসে ক্লাসে মন দেয়।

ক্লাস শেষে অফিস রুমে ডেকে পাঠিয়েছে ঐশানীকে। ঐশানী সেদিকেই যাচ্ছে। কিন্তু অফিস-রুম কোনটা ভেবে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে সে। আশেপাশে কাকে জিজ্ঞেসা করবে তারও উপায় পাচ্ছে না। সকলে নিজের কাজে ব্যস্ত। এদিক-সেদিক ঘুরতে ঘুরতে ঐশানী এসে পৌঁছায় একটা ফাঁকা ক্লাসরুমের সামনে। সেদিক দিয়ে যেতেই ভেসে আসে গিটারের সুর। জানালা একটু ফাঁক করে অতি আগ্রহ নিয়ে ভেতরে চোখ বুলায় ঐশানী। সেই ছেলেটাই গিটার বাজাচ্ছে! সায়ান। কত সুনিপুণ ভাবে গিটারে সুর তুলছে সে। চশমার ভেতরে থাকা চোখজোড়া সায়ানের বন্ধ। এক মনোমুগ্ধকর সুর! সেই সুরে বেশির ভাগ মেয়ে ছুটে এসে দাঁড়ায়। ছেলেদের মাঝেও কেউ কেউ আসে।

গিটারের তারে সুর তুলতে তুলতে একসময় চোখ খোলে সায়ান। বাঁকা চোখে চোখ বুলিয়ে নেয় ক্লাসরুমের বাইরের দিকে। শেষ প্রান্তের জানালার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা ঐশানীকেও চোখ পড়ে তার। গিটার বাজানো থামিয়ে দেয় সায়ান। চশমা খুলে পকেটে ঝুলিয়ে গিটার একপাশে রেখে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসে বাইরে। সকলে দেখে হকচকিয়ে ওঠে। ঐশানী ঢোক গিলে স্ট্রেইট হাঁটতে শুরু করে। এই ছেলের ঝামেলায় আর জড়াতে চায় না সে। কিন্তু সকলকে আরেক দফা অবাক করে দিয়ে সায়ান জোরে ডেকে ওঠে….
–“হেই গার্ল! ওয়েট।”
ঐশানী ভাবে হয়ত অন্য কাউকে ডাকছে। সায়ান তাকেই বা ডাকতে যাবে কেন? তাই সে হাঁটতে থাকে। সায়ান আবার ডাকে…..

–“মিস. ঐশানী….!!”
থমকে যায় ঐশানীর দুটো পা। বুকটা ধুকপুক করতে থাকে। রোবটের মতো পিছন ফিরে তাকায়। সায়ান এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে। এতটুকু অবধি ঠিক থাকলেও ঐশানীর মনে হলো সায়ান অতিরিক্ত কাছে আসছে তার। ভয়ে মাথা ঘুরে আসে ঐশানীর। একপা একপা করে পিছিয়ে যায় সে। ভয়াতুর কন্ঠে বলে….
–“দে…দেখুন দূর থে…থেকেই যা বলবেন বলুন।”
সায়ান কি অন্য কারো কথা শোনার ছেলে? এগিয়ে আসতে আসতে এক পর্যায়ে ঐশানীর অতিরিক্ত ভয় পেতে দেখে তার বাম হাতে থাকা এসাইনমেন্টের খাতাগুলো ঐশানীর সামনে তুলে ধরে। ঐশানী নির্বাক হয়ে তাকায়।

–“এটা আমার এসাইনমেন্ট। তুমি আমায় করে দেবে তাও দুই দিনের মধ্যে। গট ইট?”
ঐশানী রেগে একাকার। নাক ফুলিয়ে বলে…..
–“আমি কেন আপনার এসাইনমেন্ট করতে যাব?”
–“করবে কারণ এটা তোমার শাস্তি আমাকে কিস করার। টেক ইট।”
ঐশানীর হাতে খাতাগুলো ধরিয়ে দিয়ে পেছন ঘুরে চলে আসে সায়ান। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মনে মনে সায়ানের গুষ্টি উদ্ধার করেন ফেলে ঐশানী।

চলবে……

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩১

সায়ান সেদিন জানতো না ঐশানী কেমন স্বভাবের মেয়ে। সেকারণেই হয়ত যেচে পড়ে ঐশানীর খপ্পরে পড়েছিল এবং তাকে এসাইনমেন্ট করতেও দিয়েছিল। ঐশানী এসাইনমেন্টের বদলে তার ফেবারিট ‘ডোরেমন’ এর ছবি খাতা ভরে এঁকে দেয়। যদিও তার হাত কাঁপছিল এগুলো করতে। সে জানে না এর পরিণাম কি হতে পারে! তার দুই দিন পর সায়ানকে খাতা দিয়ে দেয় ঐশানী। তখন আর এক মিনিটও দাঁড়ায় না। চলে আসে বাড়িতে। যমরাজের সামনে থাকলে প্রাণ নিয়ে নেওয়ার সম্ভবনা তো থেকেই যায়। ওইদিন ভাগ্যিস সায়ান খাতাগুলো জমা দেওয়ার আগে চেক করেছিল! নয়ত স্যারকে এসব আজেবাজে কার্টুন জমা দিয়ে কতই না অপমানিত হতে হতো!

খাতা জমা না দিয়েও সায়ান রেহাই পায় না স্যারের মেজাজ থেকে। স্যারের কাছে অপমানিত হয়ে ঐশানীর প্রতি রাগে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। কিন্তু ঐশানীর নাগাল পায়নি সে। ভয়ের চোটে ঐশানীকে দুটো দিন কলেজের আশেপাশেও দেখা যায় না। পরেরদিন সীঁথির কথায় ভয়ে ভয়ে কলেজে আসে ঐশানী। চোরের মতো মাথায় কাপড় দিয়ে কলেজের গেটে পা রাখতেই তার সামনে একজন পুরুষের পা দেখতে পায়। মাথা তুলে তাকাতেই বিষন্নতায় পরিপূর্ণ সায়ানকে দেখতে পায়। চশমা পড়ে না থাকায় সায়ানের চোখজোড়ায় স্পষ্ট তার প্রতি রাগ দেখতে পেয়ে ঢক গিলে বোকা হাসি হাসে সে। তা দেখে সায়ান ঘাড় কাঁত করে বলে….
–“আমাকে দেখে কি জোকার মনে হচ্ছে?”

–“ক…কই না তো! জোকার লাগবে কে…কেন?”
–“তাহলে অযথা হাসার কারণ কি?”
–“আ…আমি তো সবসময় হাসি। হাসিটা আমার স্বভাব।”
–“গুড। হাসলে ভালো লাগে তোমাকে। স্পেশালি গঁজ দাঁত থাকার কারণে। লুকিং সুইট!”
ঐশানী সায়ানের কথায় হালকা কেশে তাকায়। আসলে সায়ানের মুখে এমন কথা সে আশা করেনি। সায়ান আবার একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করে….
–“আমাকে ভয় লাগে?”
–“না তো।”
ঐশানী কখনই নিজের ভয়কে স্বীকার করার মেয়ে নয়। ভয়ে কাঁপা-কাঁপি করবার পরেও সে মুখ দিয়ে ‘না’ শব্দটাই উচ্চারণ করল। সায়ান দাঁতে দাঁত চেপে ধমক দিয়ে ওঠে…..

–“ইউ….!! এমন অবস্থা করব তোমার আমার ছায়া মারানোর সাহসটাও পাবে না। আমার এসাইনমেন্টের খাতায় ওসব আঁকার সাহস কি করে পাও তুমি?”
–“আপনি কি করে আমাকে আপনার এসাইনমেন্ট করতে বলতে পারেন? তাই আমিও ওসব এঁকেছি। নিজের এসাইমেন্টই স্কুলে ঠিকঠাক করতাম না! কলেজে এসে আপনার এসাইনমেন্ট করব? হাহ, বয়েই গেল।” (দাঁত কেলিয়ে)
ঐশানী আর কি বলবে তার ভাষা খুঁজে পেল না সায়ান। রাগে কিড়মিড় করে দাঁড়িয়ে থেকে অন্যদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।

ঐশানী হাফ ছেড়ে বাঁচে যেন। গলার একটু নিচে হাত রেখে বড় নিঃশ্বাস নিয়ে স্বস্তির হাসি নিয়ে সামনে এগোতে নেয়। কিন্তু আরেক বিপত্তি বাঁধে তার সামনে। কতগুলো ছেলে অভদ্রের মতো এসে দাঁড়ায় তার সামনে। ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে। এক মূহুর্তের জন্য মনে হয় যে এটা সায়ানের দল। তৎক্ষনাৎ মনে পড়ে এর মাঝে কেউই সায়ানের বন্ধু নয়।
–“কলেজে নতুন মনে হচ্ছে! তা কোন ইয়ার সুন্দরী কমলা?”
এদের মাঝে একটি ছেলের কথার ধরণ দেখে আপনা-আপনি চোখমুখ জড়িয়ে আসে ঐশানীর। ছেলেগুলো মোটেও সুবিধার নয়। তাদের দৃষ্টির ধরণও বাজে।

ঐশানী তাদের কথায় পাত্তা না দিয়ে একপ্রকার দ্রুত হেঁটেই সায়ানের সামনে এসে দাঁড়ায়। আচমকা সায়ানের সামনে পড়তেই ঐশানীর সাথে ধাক্কা লাগতে লাগতে নিজেকে সামলে নেয় সায়ান। ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। ঐশানীকে পেছনে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেও পেছন ফিরে তাকায়। ছেলেদের দল দেখে চোখমুখের ধরণ পাল্টে যায় তার। হঠাৎ ঐশানী সায়ানের শার্টের হাতা খামচে ধরতেই আশ্চর্যিত হয়ে তাকায় সায়ান। ঐশানী বিড়বিড়িয়ে বলে…..
–“ওদের নজর ভালো না। আপনি প্লিজ কিছু একটা করে ম্যানেজ করুন।”

সায়ানের হাসি পায়। মেয়েটির অসহায় কন্ঠে সত্যিই মানুষকে মায়ায় জড়িয়ে ফেলবে। তবুও তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য বলে…..
–“আমিও যদি ভালো না হই? ওদের দলের কেউ হই?”
–“হতেই পারেন না। আপনি তো ভালো ছেলে। আর আপনি মেয়েদের থেকে দূরে দূরে থাকেন।”
কোনোকিছু ভাবনাচিন্তা না করেই কথাটা গড়গড় করে বলে দিল ঐশানী। বলার পর বাঁকা চোখে তাকালো সে। আবার বলল…..
–“আপনি ম্যানেজ করুন না প্লিজ!”
–“ওদের নজর থেকে তোমাকে বাঁচিয়ে কি পাব?”

ঐশানী ভাবনায় পড়ে যায়। ঠোঁট কামড়ে অনেক কিছু চিন্তাভাবনা করতে শুরু করে। ততক্ষণে বদ ছেলেগুলো তাদের সামনে এসেই দাঁড়ায়। তাদের দলের একজন বলে….
–“কিরে, মেয়েটা নতুন না? তোর সাথে কেন? ওরে আমি পছন্দ করছি।”
–“মেয়েটা কেউ হয় নাকি তোর?”
তাদের কথায় সায়ান সোজা একটাই জবাব দেয়…..
–“সি ইজ মাইন। ও আমার গার্লফ্রেন্ড। অন্য কাউকে খুঁজে নে।”
ছেলেগুলো যতটা না অবাক হয় তার থেকে বেশি অবাক হয় ঐশানী। রোবটের মতো ঘাড় ঘুড়িয়ে সায়ানের দিকে তাকায় সে। লোকটা কি আজেবাজে কথা বলে চলেছে? সায়ানের তাতে কোনো ভাবান্তর হয় না।

অন্য ছেলে বলে ওঠে….
–“সত্যি নাকি?”
সায়ান জোরের সঙ্গে বলে….
–“মিথ্যা বলে আমার লাভ?”
ছেলেগুলো পেছন হটে যায়। সায়ান সামনের দিকে ঘুরে ঐশানীর দিকে এক পলক তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। তা দেখে পিছু পিছু ঐশানীও হাঁটতে থাকে। সে আস্তে করে প্রশ্ন করে…..
–“আপনি আমায় নিজের গার্লফ্রেন্ড কেন বললেন?”
–“কারণ ওরা অন্যের গার্লফ্রেন্ড দের ডিস্টার্ব করে না। ওরা মনে করে ভার্জিন মেয়েদের সাথে অশ্লীল আচরণ করে মজা পাওয়া যায়। আর অনেক মেয়ে তাদের আচরণে সাড়া দিলে…..”

–“হয়েছে হয়েছে যথেষ্ট বলেছেন। এবার চুপ করুন। অনেক শুনেছি।”
প্রবল ভাবে বলে ঐশানী। সায়ান ঠোঁট প্রসারিত করে একটু হেসে নেয়। ঐশানীর মনে আবারও প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিতেই বলে…..
–“ওরা এতোটা খারাপ তাও কেউ ওদের কিছু বলে না? আর বেশ কয়েকদিন হলো কলেজে আছি ওদের আজকের আগে তো দেখিনি।”
–“ওরা কলেজে সপ্তাহে একদিনই আসে। আর বড় বড় কলেজে এসব ছোটখাটো ব্যাপার। কেউ মাথা ঘামায় না। এমনকি কলেজের ডিরেক্টরকে বললেও মাথা ঘামাবে না।”
–“মা গো মা! এ কার মাঝে এসে পড়লাম আমি?
সায়ানের আরো হাসি পায়। সে নিজেও জানে না সে হাসির সাথে মেয়েটাকে নিজের হৃদয়ও দিয়ে দিতে চলেছে!

সময় কাটতে থাকে। দিন কাটতে থাকে। দুটো মানুষের মাঝে সেই বিশেষ অনুভূতিগুলো প্রখর হতে থাকে। তাদের মনে শতশত ভালোবাসা এসে জমা হয় একে ওপরের জন্য। শুধুমাত্র প্রকাশ করাটাই বাকি!

কলেজ থেকে ঠিক করা হয় পিকনিকে যাওয়া হবে। জায়গাটা রোজ গার্ডেন। একদিনের ট্যুর। কলেজ থেকে বছরে দুইবার পিকনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। একবার একদিনের ট্যুর আরেকবার বেশ কয়েকদিনের একসাথে। সকলে হৈ হৈ করে পৌঁছায় রোজ গার্ডেনে। সকলে যখন রোজ গার্ডেনে ঘুরতে ফিরতে ব্যস্ত তখন সায়ান ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত রোজ মানে ঐশানীকে দেখতে। ঐশানী বাঁকা চোখে সায়ানকে দেখছে। বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে সে। সায়ানের নজর থেকে লজ্জায় বাঁচতে চাইছে।

ঐশানী ও সীঁথির পিছু পিছু হাঁটছে সায়ান আর তার বন্ধুরা। ঘাসের ওপর পা ফেলে একেকজন ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়ে। সায়ান বসে গিটার নিয়ে। তাদের খানিকটা দূরে বসেছে মেয়েদের দল। ছেলেরা ছেলেদের মতো মেয়েরা মেয়েদের মতো গল্পের মশগুল হলেও ঐশানী আর সায়ানের চোখাচোখি হতেই থাকে। ঐশানী লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলেও সায়ান নির্লজ্জের মতোই চেয়ে থাকে। তার কোলে তার প্রিয় গিটার টি। নাহিদ এসব দেখে ফাইজলামি করে বলল….
–“আচ্ছা সায়ান একটা কথা বল?”
–“কি?”
ঐশানীতেই মশগুল হয়ে বলে সায়ান।

–“আমরা তো এতটুকু বুঝে গেছি ঐশানীর সাথে তোর…..”
সায়ান চোখ সরিয়ে নাহিদের দিকে তাকাতেই নাহিদের কথা বন্ধ হয়ে যায়। সায়ান তাকে সম্মতি জানিয়ে বলে….
–“কি বল! বলছিস না কেন? আমিও শুনব বল!”
–“বলছিলাম যে, ঐশানীর সাথে তো তোর ইয়ে হয়েই গেছে…..”
–“ইয়ে কি?”
নাহিদ ঢক গিলে বলে….
–“প্রেম মানে ভালোবাসা! এতদিন আমরা ভাবতাম গিটার ছাড়া তোকে কেউ পটাতে পারবে না। ঐশানী ইজ গ্রেট। তো এখন তুই তোর প্রিয় এর লিস্টে গিটার নাকি ঐশানীকে আগে রেখেছিস?”

সায়ান একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে ঐশানীর দিকে তাকায়। ঐশানী হাসছে। ওর হাসি দেখে আরো এক দফা প্রেমে পড়ল সায়ান। আনমনেই বলে ফেলল….
–“প্রেম আর ভালোবাসা এক নয়। তুই যাকে ভালোবাসিস তার প্রেমে সবসময় পড়বি। সেকেন্ডে সেকেন্ডে পড়বি প্রেমে। তার হাসি, তার কথা, তার চাহনি তার প্রত্যেকটা কদমেও প্রেমে পড়বি। কিন্তু সেটা যদি শুধু প্রেম হয় তুই শুধু তার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়বি। কয়েকদিন পর তোর ওই সৌন্দর্যের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে যাবে। এটা এদের মাঝখানে পার্থক্য! আর যদি গিটার আর ঐশানীর কথা বলিস তাহলে বলব এদের দুজনের জায়গায় আলাদা। কারো জায়গা আগে বা কারো জায়গা পড়ে নয়। ঐশানীর জায়গা আমার হৃদয়ে। আর এই গিটার আমার প্রিয় আর শখের জিনিস! নাথিং মোর।”

সায়ানের বন্ধুরা শুনে হাত তালি দিতে শুরু করে। অনেকেই মুখ দিয়ে সুর তোলে। সায়ান হকচকিয়ে গম্ভীর হয়ে পড়ে। মেরাজ সায়ানের কাঁধে হাত রেখে বলে….
–“দোস্ত ফাটিয়ে দিলি! এই একই কথা ঐশানীকে কবে বলবি?”
–“দিনক্ষণ ঠিক করে যেমন ভালোবাসা হয় না তেমনই দিনক্ষণ ঠিক করে ভালোবাসা প্রকাশ করাও যাবে না। এটা আপনা-আপনি হবে। আর এটা প্রকাশ করার জিনিস না। ভালোবাসা যত প্রকাশিত কম হবে ততই অনুভূতি বাড়বে।”

বর্তমান……
–“সব তো তাহলে ঠিকই ছিল ঐশানী! কি এমন হলো? তোমার ভাগ্য আমাকে বেছে নিল? সায়ানের আজ তোমার সাথে থাকার কথা। অথচ দেখো আমি আজ আছি তোমার সাথে।”
বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অভয়। এই দীর্ঘ নিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হতাশা আর যন্ত্রণা। নিজের স্ত্রী এর মুখে অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা শোনার যন্ত্রণা যেন মৃত্যু যন্ত্রণার সমান। ঐশানী তা বুঝতে পেরে থেমে যায়। অভয় মুচকি হেসে বলে…..
–“থামলে কেন বলো? ভালোই তো লাগছিল!”

–“মিথ্যে কেন বলছেন? আপনার দীর্ঘশ্বাস প্রমাণ করে দিচ্ছে আপনার কষ্ট। আর নিজের স্বামীর সামনে এসব বলতে আমার অস্বস্তিটাও কম হচ্ছে না।”
–“আমার ভালো লাগছে কারণ দ্যা গ্রেট ঐশানীও একজনকে ভালোবেসেছিল। বলা বাহুল্য, হয়ত এখনো ভালোবাসো। কারণ ভালোবাসা পাস্ট টেন্স হয় না। এটা সবসময়ের জন্য প্রেজেন্ট টেন্স। আমাকে না হক! কাউকে তো ভালোবাসো। এটা শুনে ভালোই লাগছে। আর তুমি আদোও কি আমায় স্বামী বলে মানো?”
ঐশানী থমকায়। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে অভয়ের দিকে। পানিতে নেতিয়ে পড়া অভয়ের চুল। অভয়ের দৃষ্টিতে কাতরতা থাকলেও মুখে এক অদ্ভুত হাসি! ঐশানীও যে অভয়কে স্বামী মানে। সেটা অভয়কে বলতে পারবে না। কখনোই না।

ঐশানী জোরালো ভাবে বলল….
–“আপনার কি মনে হয়?”
–“আমার মনে হওয়া না হওয়ার সাথে কিছু যায় আসে কি?”
ঐশানীর আবারও নিরব হয়ে যায়। তা দেখে অভয় বলে ওঠে…..
–“এই ওয়ান্ট টু নো ঐশানী। এমন কি কারণে নিজের এতো বড় ক্ষতি করেছো তুমি? কেনই বা তোমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল সায়ান?”

ঐশানী আবার অতীতে ডুবে যায়।
–“সব ঠিকঠাক চলছিল। কলেজের ক্যাম্পাসের পেছনে পুকুরের পাড়ে গান গাইতে গাইতে আমাকে তার মনের কথা বলায় খুশিতে সেদিন দিশেহারা হয়ে পড়ি। ভালোবাসা পথচলা শুরু হয়। আমরা দুজনে দুজনের সঙ্গে একটা ভালোবাসাময় পৃথিবী সাজিয়ে চলেছিলাম। এই স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে তিন মাস কেটে যায়। এতো সময়ের পর পরই সায়ানের পরিবর্তন ঘটে। আমাকে আগের মতো সময় দিতে চাইতো না। কলেজে আসতো না। হুটহাট মেজাজ গরম করত। আমার সাথে রুড বিহেব করত। এমনকি ওর কি হয়েছে জানতে গেলে ও একদিন সকলের সামনে আমায় অপমান করে। সেদিন এক পাহাড় অভিমান নিয়ে বাড়ি ফিরি। কিন্তু ভোরবেলা ওর ছোট ভাইয়া সজয় আমায় কল করে। সেটাই যেন ছিল কালো দিনের শুরু!”

–“কি এমন বলেছিল সজয়?”
আগ্রহ নিয়ে বলে অভয়।
–“সজয় আমাকে জানায় যে সায়ান হসপিটালে ভর্তি। গত পনেরো আগে সায়ান জানতে পেরেছিল তার একটা কিডনিতে পানি ঢুকে গিয়েছে এবং আরেকটা কিডনিতেও প্রায় পচন ধরেছে আর সেটা যদি ইমিডিয়েটলি চেঞ্জ না করা হয় তবে সে মারা যাবে।”
অভয়ের দম আঁটকে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়। উত্তেজিত হয়ে বলে…..
–“এ-কারণেই কি তুমি তোমার কিডনি ওকে ট্রান্সফার করে দিয়েছিলে?”

–“ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু এটা করা এতোটাও সহজ ছিল না। কারণ আমি জানতাম আমার পরিবার এটা করতে দেবে না। তাই আমি আমার পরিবারকে জানাই কোচিং থেকে পিকনিক ঠিক হয়েছে বেশ কয়েকদিনে। অনেক কষ্টে সীঁথিকে দিয়ে ম্যানেজ করিয়ে নিই। তবুও বাঁধা হয়ে দাঁড়ান ডক্টর। ডক্টর বলে, কিডনি চাইলেই যাকে তাকে দেওয়া যায় না। এর এতে আমার ঝুঁকি আছে। আমার বয়স ১৮ বছরের ওপরে হলেও আমি অপারেশন করার জন্য পরিপূর্ণ বয়সের নই। তাছাড়া অন্যকে কিডনি দেওয়ার জন্য ম্যাচ হতে হয়। আমি ডক্টরকে জানায় আমার এতে কিছুই যায় আসে না। আমি এখন এডাল্ট নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারি। সেদিন আমার আর সায়ানের কিডনি ম্যাচ করে। এটা কাকতালীয় নাকি ভাগ্য ছিল আমার জানা নেই। আমি বন্ড পেপারে সাইন করি। সায়ান তখন পুরোপুরি অজ্ঞান। ও জানেও না যে আমি আমার কিডনি ওকে দিচ্ছি। আমার অপারেশন। সায়ানের জ্ঞান ফিরে।”

–“তারপর? এখানেও সব ঠিক ছিল তাহলে? ও কি তোমায় কোনোভাবে ঠকিয়ে চলে যায়?”
ঐশানী ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে কাঁপতে থাকে। চোখ থেকে পানি পড়ে যায়। ওর এমন বেগতিক অবস্থা দেখে অভয় দ্রুত এসে ওর পাশে বসতেই অভয়ের হাত খামচে ধরে অভয়ের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ধরে। ঐশানী মৃদু চিৎকার করে কেঁদে দিয়ে বলে…..
–“হি ইজ এ চিটার! আমায় ঠকিয়ে চলে গেল সে। ও যখন জানতে পারে আমার বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে। আর একদিন হুট করেই নিখোঁজ হয়ে যায়। আমি পাগলের মতো খুঁজেছি ওকে সেই অবস্থায়। আমার অপারেশনে ঘা তখনও শুকায়নি। আমি তাকে না পেয়ে ছন্নাছারা হয়ে পড়ি। তখন আমার পাশে ছিল সীঁথি। আমার পরিবার যেন কেউ বুঝতে না পারে তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিই। কেটে গেল তিন মাস। আর….”

–“আর?”
–“ওর মৃত্যুর খবর আমি পেলাম।”
অভয় বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে যায়। ঐশানী প্রচন্ডভাবে কাঁপছে। অভয় দ্রুত উঠে ঐশানীর বাহু ঝাঁকিয়ে বলে…..
–“ঐশানী আর ইউ ওকে?”

চলবে….