#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩২
ঐশানীকে শুইয়ে দেয় অভয়। বড় বড় শ্বাস ফেলছে ঐশানী। আর চোখ থেকে গড়িয়ে পানি পড়ে যাচ্ছে অনবরত। অভয় বুঝতেই পারছে না ঐশানীকে কি করে স্বাভাবিক করবে। ঐশানীর মাথায় হাত বুলিয়ে সে বলে উঠল…..
–“তুমি চোখ বন্ধ করো। তোমার অবস্থা ঠিক নেই। প্লিজ চোখ বন্ধ করো।”
ঐশানী মাথা নাড়ায়। দুর্বল কন্ঠে বলে ওঠে….
–“আমি কষ্ট পাচ্ছি এটা ভাববেন না। এতোদিন চাপা কষ্ট পেয়ে এসেছি আমি। এই চাপা যন্ত্রণা কাউকে বলতে চাইনি। কিন্তু আজকে আপনাকে বলে নিজের কষ্ট কমিয়ে নিয়েছি। আচ্ছা, যাদের মনের কথাগুলো বললে কষ্ট কমে যায় তারা খুব আপন হয় তাই না?”
অভয় কিছুক্ষণ একনাগাড়ে ঐশানীর দিকে তাকিয়ে থেকে ছোট্ট করে বলে…..
–“হুম।”
–“তাহলে আপনি আমার আপনজন।”
বলেই অভয়কে দুটো হাত ধরে জড়িয়ে ধরে ঐশানী। অভয়ের হার্টবিট ফাস্ট হয়ে চলতে থাকে। হার্টের সংকোচন ও প্রসারণের প্রত্যেকটা ধাপ যেন ঐশানীর নামেই। অভয় শান্ত ভঙ্গিতে শুধু অনুভবই করে। প্রথম অভয়কে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরেছে ঐশানী। এর চেয়ে সুন্দর হয়ত আর কোনো অনুভূতি হয় না। অভয় শুনতে পায় ঐশানী অস্পষ্ট কন্ঠে কিছু একটা বলছে। কান পেতে দেয় অভয়।
–“সায়ান চলে গেছে। আপনি যাবেন না! হি ইজ লায়ার। সায়রাকে যদি আপনি ভালো না-ই বাসেন তাহলে আপনি শুধু আমার থাকবেন। ঠিক আছে?”
অভয়ের সবটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। তবে ঐশানীর কথার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে বেদনাদায়ক দিনগুলোর প্রতিটা যন্ত্রণা। লুকিয়ে আছে অভয়কেও হারিয়ে ফেলার ভয়। অভয়ের হৃদয়কে প্রশান্ত করতে এতোটুকুই কথা যথেষ্ট ছিল। তবে সায়ান মারা গেল কি করে? এটা জানার জন্যেও মনটা আনচান করছে অভয়ের। একটা মেয়ের এতোটা ভালোবাসা পাওয়ার পরেও পূর্ণতা পেল না। একদিকে ভালোই হয়েছে। যদি ভাগ্যটা এমন না হতো সে কখনো ঐশানীর দেখা পেতো না আর না জীবনের মানে খুঁজে পেতো। অভয় ঐশানীর চুলের ভেতরে আঙ্গুল চালিয়ে বলে…..
–“কিন্তু সায়ান কি করে মারা গেল?”
ঐশানী তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে নাক টেনে নিজের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি হাতের পিঠ দিয়ে মুছে নিল। পাশের ল্যাম্পশিট থেকে ফোনটা হাতিয়ে নিয়ে বলে……
–“আমার ফোনে এখনো সেই ভয়েজ নোট টা আছে। এটা আমাকে ওর ছোট ভাই সজয় দিয়েছিল ওর কথাতে। শুনবেন?”
অভয় সম্মতি জানাতেই ভয়েস নোটে ক্লিক করে ঐশানী। অভয় দুরুদুরু মন নিয়ে উঠে সোজা হয়ে বসে। প্রথমেই সায়ানের গিটারের সুর কানে আসে তাদের। গিটারের সুর সত্যিই অস্বাভাবিক মুগ্ধকর! তারপর একটা পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসে।
–“গিটারের সুর শুনে নিশ্চয় তোমার চিনতে বাকি নেই যে আমি কে! এই ভয়েস নোট টা তোমার কাছে তখনই পৌঁছাবে যখন আমি এই সুন্দর ভুবন ছেড়ে পরপারে চলে যাব। হ্যাঁ ঐশানী তুমি ঠিকই শুনেছো। জানি তোমার কাছে আমার কথাগুলো দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। বিগত কয়েকদিন ধরে কিডনি নষ্ট হবার খবর পেলেও যেই কয়টা দিন আমি তোমার সাথে খারাপ আচরণ করেছি তার পেছনেও কারণ ছিল। কিডনি নষ্ট হওয়ার সাথে সাথে আমার আরেকটিও রোগ ছিল যার নাম আলসার। এর কারণে আমি কিছু খেতে পারতাম না। প্রথম প্রথম বিষয়টাকে পাত্তা না দিলেও বাড়াবাড়ি হলে আমি ডক্টরের কাছে যাই। টেস্ট করিয়ে জানতে পারি আমার আলসার হয়েছিল এবং সেটা এতোটাই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে যে পচন ধরেছে সেখানে। আর কিডনির সমস্যা তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে আমার বাঁচা খুবই মুশকিল। আমার ওই রোগটার কথা কেউই জানতো না। শুধু জানতো কিডনি নষ্ট হবার কথা। আর তুমি কেন এক কথায় কিডনি ট্রান্সফার করার সিদ্ধান্ত নিলে? এতো ভালোবাসতে কে বলেছে তোমায়? আমি তো বাঁচবই না। সেকারণেই কিডনি আমাকে দেওয়ার পর তোমার কাছে রাগারাগি করেছিলাম। আর নিখোঁজও হই ঠিক সেই কারণেই। আমি জানতাম আমার মৃত্যু নিকটে। ওহ হ্যাঁ, আমার অন্য কিডনিটাও পঁচে গেছে। সেখান থেকে তুমি যেই কিডনি আমায় দান করেছো সেটাতেও পচন ধরেছে। আমাকে ক্ষমা করো ঐশানী। তোমার জীবনে আমার এন্ট্রি নেওয়ায় সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। আমি জানি তুমি আমাকে ভুলতে পারবে না। কিন্তু তোমায় ভুলতে হবে। যেই মানুষ তোমার ভাগ্যে নেই তাকে মনে রেখো না। আমি আশা করছি তোমার জীবনেও একদিন এমন কারোর সাথে পরিচয় হবে সে তোমায় ভালোবাসায় রাঙিয়ে দেবে। সে তোমার ভাগ্য হবে। তোমার ভালোবাসাও হবে। ভালো থেকো। শেষমেশ এতটুকু বলতে চাই যে, তোমায় ভালোবেসেই আমি মরতে চাই।”
সায়ানের শেষ কথা শুনে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসে অভয়ের। বুকের ক্ষীণ যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়। তবুও নিজেকে শান্ত অবস্থায় রাখে অভয়। ঐশানী কান্নাসুরে বলতে শুরু করে…..
–“সেদিনটা এমনই দিন ছিল জানেন? ঝড়ো হাওয়া বইছিল। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। সীঁথির সঙ্গে ডক্টরের কাছে নিজের চেক-আপ করতে এসেছিলাম। হঠাৎ সজয়ের নম্বর থেকে ভয়েজ নোট টা আসে। এগুলো শোনামাত্র সীঁথি হতভম্ব হয়ে পড়ে আর আমি তখন দুঃখে দিশেহারা। সেদিন শুধু পাগলের মতো সায়ানকে এদিক-সেদিক গিটার ঘাড়ে করে নিয়ে যেতে দেখতাম। ছুটে যেতেই সে হারিয়ে যেতো।”
–“তাহলে এই ছিল তোমার গিটারকে ঘৃণা করার কারণ?”
ঐশানীর দিকে মাথা নিচু করে প্রশ্ন করে ওঠে অভয়। ঐশানী মাথা দুলিয়ে বলে……
–“হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম বিয়েই করব না। তার কারণে এতোকিছু করেছিলাম। তবে আপনাকে এতোবড় সত্যি বলতেও পারিনি। তাই অনেক উপায়ে বিয়ে আটকানোর চেষ্টা করেছি। মনে আছে আপনার? বিয়ের দিনে আপনি খবর পেয়েছিলেন বিয়ের আগে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি? সেদিন গুমরে গুমরে কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর বিয়ের দিন রাতে আপনি আমায় বললেন যে আমি নাকি ভালোবাসা বুঝি না! ভালোবাসা হারানোর কষ্ট বুঝি না এসব বলেছিলেন না? কিন্তু ভালোবাসা কি সেটা জানি অভয়। ভালোবাসা হারানোর কষ্ট আমার থেকে বেশি আর কেউ জানে না। কেউ না। এই কষ্ট টা আমি বুঝি সেকারণেই আপনাকে আর সায়রাকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। নয়ত আমি কি পাগল? নিজের পারসোনাল জিনিসই অন্য কাউকে শেয়ার করি না আর নিজের পারসোনাল বরকে শেয়ার করব?”
অভয় শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। আজ ঐশানী নিজের অতীতের সাথে সাথে আরো অদ্ভুত কিছু কথা বলছে যা সম্পূর্ণ অভয়কে জড়িয়ে। তবে অভয়ের ভালো লাগছে। আচ্ছা কখনো কি দ্বিতীয়বার ভালোবাসা যায়? হয়তবা যায়। কারণ ঐশানীর চোখে, ঐশানীর কন্ঠে অভয় তার প্রতি কিছু বিশেষ অনুভূতি পেয়েছে। যেই অনুভূতি ভালোবাসা না থাকলে কখনোই আসবে না। কিন্তু অভয়ের স্থান ঠিক কোথায়? সায়ানের আগে? নাকি পরে?
অভয় এসব চিন্তা বাদ দিয়ে জড়ো হাসি দিয়ে বলে….
–“তোমাকে আমায় শেয়ার করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি অন্য কারো আর হচ্ছি না। আর না তোমায় ছাড়ছি এতো সহজে।”
–“ছাড়তে তো হবেই!”
রোবটের মতো কথাটা বলতেই অভয় চমকে তাকায়। ঐশানীর কথার মানে না বুঝে বলে…..
–“মানে?”
–“কিছু না।”
অভয় উঠে দাঁড়িয়ে বড় খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। পর্দা অবাধ্যের মতো উড়াউড়ি করছে। আকাশে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ!
–“জানো? আমার আজ হিংসা হচ্ছে সায়ানের প্রতি। একটা ছেলে হয়ে আরেকটা ছেলের প্রতি নিদারুণ হিংসা হচ্ছে। ও তোমার ভালোবাসা পেয়েছে। আমি পেলাম না। নাকি পেয়েছি?”
ঐশানীর উত্তর পেলো না সে। অভয় জানে সে উত্তর পাবেও না। ওকে ভালোবাসার কথা বললেই ঐশানী শুধুই এড়িয়ে যায়। এটা নতুন কিছু না। হতাশ ভঙ্গিতে পেছন ফিরে তাকায় অভয়। ঐশানী হাঁটুতে মাথা গুঁজে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। অভয়ের মনটা অস্থির হয়ে ওঠে ওকে থামানোর জন্য। আপনজনের কষ্টটা যে কেন এতো আঘাত করে কে জানে?
দ্রুততার সাথে হেঁটে এসে ঐশানীর কাছে বসে অভয়। ঐশানীর গালে আলতো করে হাত রেখে মুখোমুখি বসে ওরা। দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকায়। তাদের চোখের গভীরে ডুব দেয়। অভয় নরম সুরে জিজ্ঞেস করে…..
–“কষ্ট হচ্ছে সায়ানের জন্য? তুমি কি ওর জন্যই এখনো আমার থেকে মুক্তি চাও?”
ঐশানীকে নিরব দেখে অভয়ের মনে ভয়ে ভয়ে ছেয়ে যায়। কি করে পারবে ও ঐশানীকে হারাতে? ধড়ফড় করে বলে ওঠে….
–“প্লিজ যেও না। আমি তোমায় জোর করে নিজের করার চেষ্টা জীবনেও করব না। শুধু তুমি আমার সামনে থাকো। তোমায় দেখে আর তোমার সাথে কথা বলেই আমি নিজের জীবন খুশিতে অতিবাহিত করতে পারব। তুমি যাবে না তো?”
–“সায়ান আমার অতীত। ও আমার স্মৃতির পাতা। আমার জীবনের গল্পের কয়েকটা পাতা। যাকে ভুলতে পারা যাবে না। ও স্মৃতি হয়েই থাকবে। ওর জন্য আমি না নতুন করে কিছু করতে চাই আর না করতে চাইব। ওর জন্য আমি কোনো পদক্ষেপই নেব না।”
অভয়ের হৃদয়ের যেন প্রাণ সঞ্চার হয়। এতটুকুই তার কাছে অনেক পাওয়া। ঐশানীকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে সে। তার ঠোঁটের কোণে অসাময়িক হাসি।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই যাওয়ার পর অভয়ের মনে পড়ে সে ঐশানীকে তার পারমিশন ব্যতীত জড়িয়ে ধরে রয়েছে। দুম করে ছেড়ে দিয়ে এক হাত দূরে এসে বালিশে মাথা রাখে অভয়। ঐশানী চোখ বুঁজে আছে। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত ও দুর্বল। চোখ মেলে তাকানোরও শক্তি পাচ্ছে না যেন! সে ওই অবস্থা তেই বলে….
–“কি হলো? আমায় ছাড়লেন কেন?”
অভয় বিস্ফোরিত নয়নে তাকায়। চোখের পলক পড়ে না ওর। ঐশানী চোখ বন্ধ করে থেকেই যেন সবটা বুঝে যায়। আবারও বলে…..
–“আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না। আমায় আগের মতো নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরুন। আমি ঘুমাবো। আর হ্যাঁ এক মূহুর্তের জন্যও ছাড়বেন না।”
অভয়ের যেন মনে হলো, সূর্য আজ অন্যদিকে উঠেছিল। তবে ঐশানী যখন নিজে কাছে আসতে চাইছে এর থেকে সুখকর কি হতে পারে? স্বামী-স্ত্রী কাছাকাছি আসবে এতে অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নেই। অভয় হাত বাড়িয়ে নিজের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঐশানীকে। দুজনের নিঃশ্বাস দুজনের মুখে আঁচড়ে পড়ে। অভয়ও আবেশে চোখ বন্ধ করে বলে…..
–“রাতের খাবার খাবে না?”
–“না। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি খেলে খেতে পারেন।”
অভয়ও খাবে না আজ। ঐশানীর ছোঁয়া তার মন আর পেট ভরিয়ে দিয়েছে।
ঐশানী ধীর গলায় বলে….
–“আর একটা কথা! আমি আজ আপনাকে এতোকিছু বললাম। আপনি কিন্তু কখনো কাউকে এসব কথা বলবেন না। আমার পরিবারকেও না। এটা আমার অনুরোধ!”
–“নিজের পরিবারের থেকে এতো বড় কথা লুকানো কি ঠিক হচ্ছে ঐশানী?”
–“ঠিক না ভুল হচ্ছে জানি না। আমি চাই না আমার কথা শুনে আমার পরিবার চিন্তায় পড়ুক। ওদের কানে এই কথা গেলে ওরা ভেতরে ভেতরে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়বে।”
–“ঠিক আছে বলব না। তবে আমি তোমায় ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব। তোমার শরীরে একটা কিডনি নেই। এর জন্য তোমার শরীরে অনেক কমপ্লিকেশনস দেখা দিতে পারে। তোমার চেকআপের প্রয়োজন।”
বেশ সিরিয়াস হয়ে কথাটা বলল অভয়। ঐশানী আগের ন্যায় বলল….
–“তার কোনো দরকার নেই। মানুষ একটা কিডনি নিয়ে নির্দ্বিধায় বাঁচতে পারে। এই কয়টা বছর তো ছিলাম ভালোভাবে বেঁচে। শেষ পর্যন্ত এভাবেই দিন কেটে যাবে।”
অভয় আরো বেশ কয়েকবার তর্ক করলেও ঐশানীর কাছে হেরে গিয়ে চুপ হয়ে যায় এসে। ঐশানীর চোখমুখে ফুঁ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঐশানীও বিড়াল ছানার মতো ঘুমিয়ে পড়ে অভয়ের সংলগ্নে।
সকাল সকাল ইশানের মেজাজ বেশ ফুরফুরে। মনটাকে আরো ভালো করতে আরেকটা খবরও পেলো সে। তার চাকরিটা হয়ে গেছে। মনে খুশির ছোঁয়া নিয়ে বাইরে বের হলো সে। সবাইকে খবর জানানো উচিত। বিশেষ করে অনিন্দিতাকে জ্বালাতন করা হয়নি অনেকক্ষণ। গতকাল তো ঐশানীকে খুঁজতেই দিন কেটে গেল। সব ভাবনা শেষ করে ঘর থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে ইশান। মুখে যেন তার হাসি ধরে না। এই বাড়িতে সে-ই একমাত্র অলস যার ঘুম সবচেয়ে পড়ে ভাঙ্গে। তারমানে এতোক্ষণে সবাই উঠে পড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে অভয়ের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। বিড়বিড় করে বলে…..
–“অভয়কে প্রথমে খবরটা দিলে মন্দ হয় না। যাই ওকেই আগে জানায়। এতোদিন কিছু করছিলাম না বলে ব্যাটা মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল। অভয় আসব?”
দরজা একটু ঠেলতেই খুলে যায়। দরজা লক করা নেই। দরজার খটখট শব্দ শুনে অভয় পিটপিট করে তাকায়। ঘুমের রেশ যেন ছাড়ছেই না। চোখ বারংবার খোলার চেষ্টা করে দরজার দিকে তাকায় চোখমুখ কুঁচকে। ইশান দরজার সামনে দুটো হাত ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ওর অদ্ভুত রিয়েকশন দেখে নিজের দিকে তাকায় অভয়। ঐশানীকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে সে। তার বুঝতে বাকি রইল না ইশানের এমন রিয়েকশনের কারণ। ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। একবার ঐশানী একবার ইশানের দিকে তাকায়। ইশান বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলে…..
–“আমি কিছু দেখিনি। তোরা রুমের দরজা লক করে ঘুমাতে পারিস না?”
–“তু…তুই!!”
–“আমার কি ভাগ্য! যেই দৃশ্য বাসর রাতে দেখব বলে তোদের ঘরে ঢুকেছিলাম এই দৃশ্য আজ দেখতে পাচ্ছি। সেদিন থেকে দুইদিন এককানে শুনতে পাইনি জানিস? আজ না চাইতেই অনেক কিছু দেখে ফেললাম। হেহেহেহে!”
বলেই আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না ইশান। পা ফেলে ধুপধাপ শব্দ করে দৌড় দেয় সে। অভয় দাঁতে দাঁত চেপে বলে….
–“ইউ….! দাঁড়া আমি আসছি।”
অভয়ও ইশানের পিছু নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়।
ওয়াশরুমের শাওয়ার নিতে ব্যস্ত ঐশানী। আজ ঘুম থেকে উঠতে লেট হয়ে গেছে। কেন যে গেছিল অভয়কে জড়িয়ে ধরতে বলতে! লোকটার উষ্ণতা এতোটা প্রগাঢ় যে ঘুমই ভাঙেনি। যখন ঘুম ভাঙে তখন অভয় ছিল না। অভয়কে মনে মনে বকতে বকতে বলে…..
–“লোকটার সাহস তো কম না! রাতে আমি বললাম আমায় ছাড়বেন না তাও ছেড়ে উঠে গেল? ডাকও দিল না একবারও? শ্যামলা ঘোড়া তো সাধে বলি না!”
আজেবাজে বকতে বকতে হাতে ফেশওয়াশ নিল ঐশানী। নিয়ে হাতে একটু ফেশওয়াশ ঢেলে মুখের ডান পাশে লাগায়। হঠাৎ নাকে অদ্ভুত গন্ধ আসে। গন্ধ শুঁকে বিরক্ত লাগে ওর। এখন চোখও খুলতে পারছে না।
উপায় না পেয়ে দরজা ফাঁক মাথাটা বের করে বলে…..
–“এইযে শ্যামলা….(একটু থেমে) অভয় আপনি আছেন?”
অভয় ততক্ষণে রুমে এসেছে। ইশানের পেছনে দৌড়ে এসে ফ্যানের নিচে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে ও। ঐশানীকে এভাবে ডাকতে দেখে এগিয়ে আসে সে।
–“কি হয়েছে?”
–“আমি না ওয়াশরুমে থেকে একটা বাজে গন্ধ পাচ্ছি আপনি পাচ্ছেন?”
অভয় সেখান থেকেই শুঁকতে শুরু করে। সেও গন্ধটা পায়। কিন্তু গন্ধটা তার চেনা। ঐশানীর ফেসের দিকে নজর যায় তার। সেখান থেকে ফেশওয়াশ একটু হাতে নিয়ে শুঁকতেই সে চোখ বড় বড় করে চিল্লিয়ে বলে উঠল…..
–“তুমি আমার দাঁড়িতে দেওয়া শেভিং ক্রিম মেখেছো??”
চলবে…..
#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৩
–“কি? আমি আপনার শেভিং ক্রিম মাখতে যাব কেন?”
–“বিশ্বাস না হলে নিজে স্মেইল নিয়ে দেখো।”
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে নিজের হাতটা ঐশানীর নাকের কাছে ধরে অভয়। ঐশানী নাক শিটকে দূরে সরে যায়। ঠাস করে অভয়ের মুখের ওপর ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে ভেতর থেকে চিল্লিয়ে বলে ওঠে…..
–“সব আপনার জন্য হয়েছে। না আমি আপনার কথা ভাবতাম ঘুমের ঘোরে না আপনার এই বিদঘুটে শেভিং ক্রিম আমার মুখে লাগাতাম। ইয়াক…..”
কালো টাওজার প্যান্টের পকেটে দুটো হাত ঢুকিয়ে সরু চোখে ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে….
–“হোয়াট রাবিশ? আমি কি করলাম?”
ওয়াশরুম থেকে চুল টাওয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে বের হয় ঐশানী। ফোনে কথা বলছিল অন্যদিক হয়ে অভয়। আজকে তাদের একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে বেশ বড় একটা কোম্পানির সাথে। হুট করেই মিটিং ফিক্সড হয়ে যাওয়ায় খানিকটা টেনসড হয়ে পড়ে সে। সেই ব্যাপারেই ম্যানেজারের সাথে টুকটাক কথা বলছিল অভয়। কথা শেষ করে ফোনটা কানের কাছ থেকে নামিয়ে সামনে ফিরতেই চোখটা পড়ে ঐশানীর দিকে। ভূত দেখার মতো চমকে উঠে খাটে বসে পড়ে অভয়। ঐশানী তাতে কপাল কুঁচকে তাকায়। লোকটা কি তাকে প্রথম বার দেখছে? তারপর কিছু একটা ভেবে মুখে একটা দারুণ হাসি ফুটিয়ে নিজের চুল ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে ভাব নিয়ে বলে…..
–“কি ব্যাপার? আমাকে কি আজকে বেশি সুন্দর লাগছে নাকি? কার মতো লাগছে? দীপিকার মতো নাকি ঐশ্বরিয়ার মতো?”
অভয় যেন বাকশক্তি হারিয়েছে। তার চোখের পলকও পড়ছে না। অস্ফুটস্বরে বলে….
–“তোমার ডান পাশের আইভ্রো!”
–“কি হয়েছে আমার ভ্রু তে?”
হাত চোখের ওপর আইভ্রোতে রাখতেই ফাঁকা ফাঁকা লাগে ঐশানীর। সেই মূহুর্তে মনে হলো তার আইভ্রো গায়েব হয়ে গেছে। ঢক গিলে তড়িঘড়ি করে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় সে। নিজেকে দেখতেই মাথা ঘুরে আসে তার। মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে যায়। দ্রুত আয়না থেকে মুখ সরিয়ে মিনমিন করে বলে ওঠে…..
–“ওটা আমি নই!”
অভয়ের মুখ ফুরে হাসি বেরিয়ে আসে। তাও আবার উচ্চশব্দে। ঐশানীর ডানপাশে ভ্রু গায়েব হয়ে গেছে। মাত্র দুই-একটা চুল অবশিষ্ট আছে ভ্রু-তে। দেখতে উদ্ভট লাগছে ওকে। অভয় পেট চেপে ধরে হাসছে। হাসির সুরেই সে বলে ওঠে….
–“ওটাই তুমি!”
–“আমি মানি না। আমার ভ্রু কোথায় গেল?”
–“মেবি শেভিং ক্রিম এর ইফেক্ট পড়েছে। অর্ধেক চেহারাতে লাগিয়েছে তাই যেই পাশে লাগিয়েছো সেখানকার ভ্রু গায়েব।”
বলে আরো জোরে জোরে হাসতে শুরু করে অভয়। ঐশানী সেখানেই চোখের ওপরে হাত রেখে ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়ে। ছলছল চোখে অসহায়ের মতো বলে…..
–“আমাকে দেখতে কতটা অদ্ভুত লাগছে! আমার কি হবে? কেউ তো দেখবেই না। দেখলেও হাসবে।”
অভয় হাসি থামিয়ে বেড থেকে উঠে ঐশানীর কাছে গিয়ে নিচু হয়ে বসে পড়ে। ঠোঁটে তার এখনো হাসির ছাপ। ঐশানীর হাত চোখের ওপর থেকে সরিয়ে বলে….
–“কি দরকার অন্য দেখার? আমি দেখব তো! আমার দেখতে ভালোই লাগছে তোমাকে। ডান সাইড থেকে তোমাকে কিছুটা সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর মতো লাগছে। ওদের আইভ্রো খুবই পাতলা থাকে। আমি তোমাকে একটা সাজেশন দিই শোনো।”
ঐশানী খুশিমনে এগিয়ে কান পেতে দেয়। সে ভাবছে অভয় হয়ত এই বিশ্রী অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কোনো সাজেশন দিতে চলেছে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে অভয়।
–“তুমি বাম পাশের আইভ্রোও তুলে ফেলো। তোমার একটা নিউ লুক ক্রিয়েট হবে। দারুণ আইডিয়া না?”
–“স্টুপিড মার্কা আইডিয়া নিজের কাছেই রাখুন।”
অভয়ের দুটো গালে আলতো থাবা মেরে উঠে দাঁড়িয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে পড়ে ঐশানী। হাতে একটা আইভ্রো পেন্সিল নিয়ে মনোযোগ দিয়ে নিজের ভ্রু কে ঠিক করার চেষ্টায় মগ্ন হয়ে পড়ে সে। বিরক্ত হয়ে আপনমনে বলে…..
–“কবে ভ্রু গজাবে কে জানে!”
অভয় ঐশানীর কান্ড দেখে প্রশ্নাত্মক চেহারা নিয়ে বলে…..
–“ওই পেন্সিল দিয়ে কি করছো?”
–“এটা শুধু পেন্সিল না! এটাকে আইভ্রো পেন্সিল বলে। এভাবে তো আর নিচে যেতে পারব না তাই না?”
–“তোমরা মেয়েটা আরো কত পেন্সিল নামাবে গড নোস! পেন্সিল আইলাইনার, লিপস্টিক পেন্সিল ব্র্যান্ড এখন আবার আইভ্রো পেন্সিল!”
–“বাবাহ….!! এতো কসমেটিকস এর নাম কি করে জানলেন আপনি? এক্সপেরিয়েন্স আছে নাকি?”
আয়নায় নিজের কাজে মন দিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল ঐশানী। অভয় কিছু বলতে উদ্যত হতেই ঐশানী নিজেই হেসে বলে দিল….
–“ওহ বুঝেছি। সায়রা তো ছিল আগে আপনার লাইফে। সেখান থেকেই এতো এক্সপেরিয়েন্স!”
‘সায়রা’ নামটা শুনে তিক্ততায় ভরে উঠল অভয়ে মন। মেয়েটা যে কেন কথায় কথায় সায়রা নামটা টানে কে জানে। বড় শ্বাস নিয়ে শান্ত হয়ে বলল….
–“ইডিয়েট কথাবার্তা বন্ধ করো। অনিন্দিতা মাঝে মাঝে আমায় লিস্ট করে দিতো মার্কেটে গেলে। সেখান থেকেই এসব নাম জেনেছি। আর শোনো, কথায় কথায় সায়রা নামটা না টেনে তোমার স্বামীর নামও তো টানতে পারো। হৃদয়টা ঠান্ডা হবে তবে।”
ঐশানী দাঁত বের করে হাসে। অভয় আয়নাতে ঐশানীকে দেখে ওর দিকে হালকা ঝুঁকে পড়ে ওর কাঁধে আলতো চুমু খায় অভয়। হকচকিয়ে উঠে পেন্সিল নড়ে যায় ঐশানীর হাত থেকে। অভয়ের দিকে ঘুরে বসে তেতিয়ে বলে ওঠে…..
–“শুনুন, এভাবে যখনতখন আমাকে চুমু খাবেন না।”
অভয় ঐশানীর হাত ধরে নিজের কাঁধে রেখে ঐশানীর কোমড়ে হাত রেখে চেপে ধরে দুষ্টুমির সুরে বলে….
–“তাহলে একটা শিডিউল করে দাও। যেখানে লিখা থাকবে, কখন তোমার সাথে রোমান্স করা যাবে আর কখন যাবে না! আমি সেই অনুযায়ীই চলব প্রমিস।”
–“আপনি না একটা যাচ্ছেতাই! বাবা আমাকে একটা লুচ্চা আর অসভ্য লোকের সাথে বিয়ে দিয়েছে।”
ঝাঁঝালো গলায় বলেই ঐশানী আইভ্রো পেন্সিল দিয়ে অভয়ের ঠোঁটের ওপরে একটা টান দিয়ে গোঁফের মতো এঁকে দিয়ে ফিক করে হেসে দেয়।
হাসিটা যেন অভয়ের বুকে গিয়ে লাগে। তার চোখের মণিতে আঁটকে গেছে শুধুই ঐশানী।
–“তুমি মুগ্ধময়ী ঐশানী। তুমি এই হাসিতে আমার প্রাণ কেঁড়ে নিতে সক্ষম।”
ঐশানীর হাসি থেমে যায় অভয়ের কথা শুনে। সেও অভয়ের চোখে চোখ রেখে বলে…..
–“কি দেখছেন?”
–“এমন একটা মেয়েকে দেখছি যে কিনা তার এই মুগ্ধময়ী হাসির পেছনে শতশত কষ্ট লুকিয়ে রাখে। এটা কি করে পারো তুমি?”
–“ভুল ভাবছেন আপনি। আমি অখুশি থাকি না। এটা আমার স্বচ্ছ হাসি। আমি অতীত ভুলতে চাই। এটাই আমার হাসির কারণ।”
আচমকা ঐশানীর ঠোঁটে আলতো করে ভালোবাসার পরশ দিয়ে সরে আসে অভয়। ঐশানী শিরদাঁড়া সোজা করে বসে থাকে রোবটের মতো। গুনে গুনে দশ সেকেন্ড যাবার পর হুঁশ ফিরে ঐশানীর। নিজের মুখে রাগি ভাব এনে বলে….
–“আপনাকে না আমি বলেছি? যখন তখন এসব করবেন না?”
–“আমিও তোমাকে বলেছিলাম না? আমাকে শিডিউল তৈরি করে দিতে?”
–“ধ্যাত….আপনার সাথে কথা বলায় বেকার!”
বলেই উঠে যায় ঐশানী। অনেক বেজেছে। নিচেও যেতে হবে তার। অভয়ের সাথে শুধু শুধু কথা বলে লাভ নেই সে ভালোভাবে বুঝেছে। বাইরে গিয়ে পর্দার আড়ালে পিছু ফিরে তাকায় ও। ঠোঁটে হাত দিয়ে মুচকি হেসে চলে যায়।
সোফার ওপর দাঁড়িয়ে আছে ইশান। দুটো হাত ওপরে তুলে রয়েছে সে। ঐশানী সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ইশানকে উদ্ভট অবস্থায় দেখতে পেতেই ভ্রু উঁচিয়ে নিচে নামে সে। তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলে….
–“কি ব্যাপার ইশান ভাইয়া? সোফায় এভাবে অদ্ভুত ভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
–“আসলে ভাবি, একটা ভালো খবর আছে। কিন্তু আজকে সকলেই যেন আলসে হয়ে পড়েছে। কেউ ড্রয়িংরুমে আসছেই না। তোমরাও যেমন আসতে লেট করেছিলে! আমি তো সর্বপ্রথম এই খবর অভয়কেই দিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু যা দেখলাম!” (চোখ গোল করে)
ঐশানী ইশানের শেষ কথাটা বুঝতে পারে না। কনফিউজড হয়ে বলে….
–“মানে কি দেখলে?”
–“থাক আর না বলি। বললে তুমিই লজ্জায় পড়বে। এমনিতে অভয় আমাকে কম দৌড় করায়নি। সকাল সকাল জিমের কাজটা অভয় করে দিল।”
ঐশানী মাথা চুলকে ভাবতে থাকে ইশান এমন কি দেখল যেটা শুনলে সে লজ্জা পাবে? এসব আগামাথা ভাবতে ভাবতে অনিন্দিতার উদয় হলো। ফোন চাপতে চাপতে বড় বারান্দার দিক থেকে হেঁটে আসছে সে। তাকে দেখে তড়িঘড়ি করে নেমে পড়ল ইশান। সে যেন অনিন্দিতারই অপেক্ষা করছিল। চিকন করিডোরে ঢুকে পড়ল অনিন্দিতা যেদিক দিয়ে হেঁটে আসছে। ঐশানী কিছু না ভেবেই রান্নাঘরে চলে আসে রেনুকে সাহায্য করতে।
ফোনে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা টাইপ করছে অনিন্দিতা। ঠিক সেই মূহুর্তে কেউ যেন তার থেকে এক প্রকার ফোনটা ছিনিয়ে নেয়। এমতাবস্থায় ফোনটা কেউ নিয়ে নেওয়ায় কড়া চাহনি নিয়ে তাকায় সে। ইশানকে দেখে সে খুব একটা চমকায় না। কারণ তার জানা আছে ইশানই একমাত্র তার সাথে এই কাজটা করতে পারে। জোর গলায় সে বলে…..
–“ফোনটা নিলে কেন? দাও আমাকে।”
–“আমি ওখানে নিজের জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্টের সুখবর দিতে যাচ্ছি আর তুই উম্মাদের মতো চোখ লাগিয়ে ফোন চালিয়ে যাচ্ছিস! তোর সাহস তো কম না। কি এমন দেখছিস ফোনে দেখি।”
বলেই ইশান ফোনের দিকে তাকায়। অনিন্দিতা ছোঁ মেরে ফোনটা নেওয়ার চেষ্টা করেও লাভ হয় না। তার দুটো হাত ধরে নেয় ইশান তার এক হাত দিয়ে। ফোনের স্ক্রিনে কারো মেসেজ ঝুলছে। তাও আবার মেসেজে ‘আই লাভ ইউ’ লিখা। অনিন্দিতা ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নেয় ততক্ষণে। ইশান রেগেমেগে বলে….
–“তাই তো ফোন দেখাতে চাইছিলি না! সব বুঝেছি। কতদিন ধরে চলছে এই চক্কর? ঢাকায় এসে এসব করে বেড়াচ্ছিস? লজ্জা করে না?”
–“আরে আজব! লজ্জা লাগার কি আছে? এমন কি করলাম যে লজ্জা করবে? আর এতো রাগার কি আছে?”
–“রাগব না মানে? তুই আমার সামনে এগুলা করে বেড়াবি আর আমি হাসিমুখে তোকে বরণ করব? বেয়াদব!”
ক্ষুব্ধ হয়ে বলে ইশান। অনিন্দিতা চোখমুখ জড়িয়ে মৃদু চিৎকার করে বলে….
–“আমি কি করছি হ্যাঁ? সব তো তুমি করেছো। নিজে দিনেরাতে অচেনা অজানা মেয়ের সাথে কথা বলছো আর আমাকে দোষারোপ করছো তাও মিথ্যে দোষারোপ? উনি আমার কলেজের সিনিয়র। একটা কারণে কল নম্বর দিতে হয়েছিল উনাকে। আর হুট করেই আই লাভ ইউ লিখে পাঠালেন। এর চেয়ে আমি বেশি কিছু জানি না হ্যাঁ?”
–“তুই কি করছিস আর না করছিস সব দেখেছি। আমাকে ভুলভাল বুঝাতে পারবি না। আমি এক্ষুনি তোর ব্যবস্থা করছি দাঁড়া।”
রাগে গজগজ করতে করতে পায়ের কদম ফেলে ইশান। পেছন থেকে অনিন্দিতার একটা কথায় তার চলা থেমে যায়।
–“তুমি কেন অযথা বেশি রিয়েক্ট করছো ইশান ভাইয়া? এটা সিম্পল ব্যাপার। আর তোমার সামনেও বা যদি এসব করতাম তাতে তোমারই বা কি যায় আসে? মানছি তুমি আমার কাজিন। কিন্তু এমন কেউ না যে এতোটা রাগ হবে। এমন রাগ তাদেরই হয় যারা প্রিয় মানুষের পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারে না।”
ইশানের থমকে যাওয়ায় তার সামনে এসে দাঁড়ায় অনিন্দিতা। ইশান অনিন্দিতার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে রাগি ভাবটা ধরে রেখে বলল….
–“যাহ, তোকে এবারের মতো ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু এই ছেলেটাকে তুই ব্লক করবি। কোনো আননোন ছেলেকে ভুলেও যদি এরপর নিজের নম্বর দিয়েছিস তাহলে কিন্তু ভালো হবে না। খেতে আয়।”
অনিন্দিতার পাশ কাটিয়ে চলে গেল ইশান। অনিন্দিতার সূক্ষ্ম মনের কোণে প্রশ্ন জাগল ইশানের এমন আচরণ করার কারণ কি?
অনিন্দিতার ধ্যান ভাঙ্গে ফোনের রিংটোনে। এই অসময় তার বান্ধবী ছাড়া কেউ কল করতে পারে না। কারণ কিছুক্ষণ পরেই তার কলেজ যেতে হবে। কিন্তু স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সে ভুল প্রমাণিত হয়। অচেনা নম্বর থেকে কল আসায় কনফিউজড হয়ে পড়ে সে। কলটা কি ধরবে নাকি ধরবে না? ভাবতে ভাবতে কল রিসিভ করেই ফেলল অনিন্দিতা। ঠোঁট কামড়ে ওপর পাশের মানুষের কন্ঠের অপেক্ষা করে থাকল সে।
–“হ্যালো, এটা কি অনিন্দিতার নম্বর?”
মেয়েলি কন্ঠ পেয়ে অনিন্দিতার চোখজোড়া ছোট হয়ে আসে। চিকন সুরে বলে ওঠে….
–“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে বলছেন?”
–“আমি সায়রা।”
অনিন্দিতার মনে আগের থেকেই সায়রার প্রতি ক্ষোভ ছিল। কারণ তার ধারণা প্রথমে অভয়ের দিকে তার নজর থাকলেও তার বর্তমান নজর ইশানের দিকে। কাঠ কাঠ গলায় সে প্রশ্ন করে…..
–“কেন ফোন করেছো?”
–“ইশানকে ফোনে পাচ্ছি না। ওর ফোন বন্ধ বলছে। ও কি ঠিক আছে?”
–“ইশান তো অচেনা ছেলে না তোমার কাছে? ওর জন্য এতোটা ডেস্পারেট কেন হচ্ছো জানতে পারি? প্রথমে আমার ভাইয়ের জন্য ডেস্পারেট ছিলে আর এখন ইশান ভাইয়ার জন্য? হাউ ফানি না?”
নিজের রাগটাকে দমিয়ে শান্ত করেই কথাগুলো গড়গড় করে বলে দিল অনিন্দিতা। ওপাশ থেকে সায়রার বিস্মিত কন্ঠ শুনতে পেল সে।
–“তুমি ভুল ভাবছো। আমি তো ভাবলাম ইশানের কোনো প্রবলেম হলো কি না! কারণ ও আমার দুঃখের সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ হঠাৎ ফোন রিসিভ না করায় একটু চিন্তায় পড়লাম। আর একটা কথা অভয়ের জন্য আজও আমি ডেস্পারেট। ও আমাকে ঠকাতে পারে কিন্তু আমি ওকে ঠাকবো না। আমি আজও ওকে ভালোবাসি।”
–“ব্যাস সায়রা! তুমি কেমন ধরণের মেয়ে বলো তো? অভয় ভাইয়া তোমায় ঠকায়নি। হ্যাঁ ও বাধ্য হয়েছিল বিয়ে করতে। কিন্তু বিয়ে নামের যেই বন্ধন আছে না? সেটা মানুষকে বাধ্য করে নিজের পরিপূরক কে ভালোবাসতে। সেটা বাধ্য করে সেই মানুষটাকে ক্ষণিকের ভালো লাগা থেকে বের করিয়ে নিয়ে আসতে। আচ্ছা, তাও মানলাম। ভাইয়া তোমায় ঠকিয়েছে। কিন্তু তুমি একবার মনে করে দেখো তো! তুমি একবারের জন্যও ঠকাওনি ভাইয়াকে?”
সায়রা জবাব দেয় না। ভাবতে থাকে অতিতে কথা গুলো। লোভে পড়ে টাকা হাতানো, বাবার কথায় ভালোবাসার নাটক করা! ওপর পাশ থেকে আবার অনিন্দিতা বলে….
–“কি হলো? উত্তর দাও! অনেস্টলি উত্তর দেবে। আমি কিন্তু এটাও জানি তুমি একবার ভাইয়ার থেকে অনেক টাকা নিয়েছিলে।”
–“হ্যাঁ আমি মানছি। আমি প্রথম প্রথম বাবার স্বার্থের জন্য ওর সাথে নাটক করেছি। বাবার কথায় টাকাও নিয়েছি ওর থেকে। আমাদের ভালোবাসার শুরুটা ভুল ছিল কিন্তু আমি যে কখন ওকে সত্যিকারের ভালোবেসেছি তা জানি না।”
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে অনিন্দিতা। তাচ্ছিল্যের সুরেই বলে….
–“এলে তো নিজের আসল সত্যিটা বাইরে নিয়ে? আমি জানতাম এটা তোমার আর তোমার বাবারই চাল হবে। কিন্তু ভাইয়া সেটা বুঝত না। একটা কথা শুনে রাখো সায়রা। যেই সম্পর্কের শুরুটা ভুলভাবে হয়। যেই সম্পর্কের শুরু ভিত্তিহীন! সেটা কখনো সঠিক হতে পারে না।”
বলেই অনিন্দিতা এক মূহুর্ত দেরি না করে কল কেটে দেয়। ওর ফোনে অটোমেটিক রেকর্ডার অন করা আছে। সব কথা রেকর্ড হয়। এটাও হয়েছে। সেও অভয়কে জানাবে সায়রার আসল সত্যি।
চলবে……
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]