বেলা শেষে শুধু তুমি পর্ব-৩৪+৩৫

0
553

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৪

তিনদিন ও তিন রাত কোন দিক দিয়ে কেটে গেল অভয় টেরই পেলো না। এই কয়টা দিন সে অত্যন্ত ব্যস্ততার মাঝে কাটিয়েছে। বসে বসে দম ফেলার মতোও সময় পায়নি সে। একটা বড় বিখ্যাত কোম্পানির সাথে তাদের বিজনেস ডিল হওয়ার কথা। ডিল যদি না হয় তবে তাদের ব্যবসায় অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। সেই কারণেই অভয়ের এতো পরিশ্রম। তবে অভয় একটা ব্যাপারে ভীষণই খুশি। সেটা হলো ঐশানী আর তার সম্পর্ক ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। ঐশানী আর দূরে ঠেলে দেয় না অভয়কে। এটা অভয়ের কাছে স্বপ্নের মতো।

দুপুরবেলা খেয়ে এসে সবে বই নিয়ে বসেছে ঐশানী। সামনে পরিক্ষা! পড়াশোনা বিয়ের কারণে কিছুই হয়নি। যদিও সে আহামরি কোনো স্টুডেন্ট না। মোটামুটি বলা যায়। বইটা খুলতেই মনে আসে অভয়ের কথা। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে চোখে ভাসতে থাকে অভয়ের প্রতিচ্ছবি। মনটা প্রশ্ন করে….
–“আচ্ছা শ্যামলা ঘোড়া দুপুরের খাবার খেয়েছেন?”
বিষয়টা ভাবার পর সে অসহায় ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে বলে…..
–“ঐশানী, তুই তো আগে আগে খেয়ে নিলি। মানুষটা দিনরাত খেটে চলেছেন। ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করে কি না তার তো খোঁজ নেওয়া উচিত! তুই মাছ বিক্রেতা মানে সেলফিশ-ই রয়ে গেলি। যদিও আমি খুব মহৎ মনের।

বইটা ঠাস করে বন্ধ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় ঐশানী। ফোন খুঁজতে খুঁজতে বালিশের পাশে ফোন পেয়ে হাতে নেয় সে। তৎক্ষনাৎ খেয়াল করে তারই ফোনটা বাজছে। তাও আবার আননোন নম্বর! অভয়ের নম্বর সে শ্যামলা ঘোড়া দিয়ে সেভ করেছে তার মনে আছে। তবে এটা কার নম্বর? আগপাছ ভাবতে ভাবতে ফোনটা রিসিভড করেই বসে ঐশানী।
–“হ্যালো! কে বলছেন?”
–“হ্যালো! এটা কি মিসেস. ঐশানী খানের নম্বর?”
ঐশানী অবাক হয় তার নাম শুনে। তার থেকে বেশি অবাক হয় মেয়েলি কন্ঠ শুনে। কন্ঠ টা তার কাছে অপরিচিত আবার পরিচিতও!

–“কে আপনি? চিনলাম না তো?”
–“না চেনাই স্বাভাবিক। আমাকে মনে রেখে আর কি হবে? তোমার স্বামীই তো আমাকে ভুলে গেছে। তুমি আর কেন মনে রাখবে?”
ঐশানীর চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠে। মেয়েটা কে? এতো হেয়ালি করছে কেন? অদ্ভুত! তবুও নম্রভাবে সে জিজ্ঞেসা করল….
–“হেয়ালি না করে একটু পরিষ্কার করে যদি বলে দিতেন আপনি পরিচায় তাহলে ভালো হতো।”
ওপাশের মেয়েটা থেমে থেমে বলে ওঠে….
–“আমি সায়রা। সেই সায়রা যার সঙ্গে অভয়ের সম্পর্ক ছিল।”

ঐশানীর বুকটা অজান্তেই ধক করে ওঠে। মেয়েটা এখানে কেন ফোন করেছে? আর ওর নম্বরটাই বা কোথায় পেলো? ও কি অভয়কে আবার কেঁড়ে নিতে কল করেছে? ঐশানী বিশ্বাস করে অভয় একমাত্র তার। আর কারো নয়। এখন কি সায়রা আবারও অভয়কে ফিরে পেতে চায়? যদি চায় তাহলে ঐশানী কি বলবে? ফিরিয়ে দেবে? এটা আদোও সম্ভব?
–“কি হলো? কথা বন্ধ হয়ে গেল আমার নাম শুনেই?”
–“তুমি আমার কাছে এমন কোনো ভয়ের বস্তু নও যে নাম শুনেই আমার কথা বন্ধ হয়ে যাবে।”

নিজেকে সামলে কাঠকাঠ গলায় বলল ঐশানী। ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ এলো। হাসির শব্দটা ঐশানীকে যেন বলে দিল সায়রা তাকে বিদ্রুপ করছে। ঐশানী চোয়াল শক্ত করে বলল….
–“আমাকে কেন ফোন করেছো জানতে পারি? কি দরকার আমার সাথে তোমার? আর আমার নম্বরই বা তুমি কোথা থেকে পেলে?

–“পেয়েছি কোথাও থেকে।”
–“কি বলতে চাও তুমি?”
–“তুমি কি জানো? আমি অভয়কে ভালোবাসতাম। এখনো ভালোবাসি।”
ঐশানী দম ফেলতে পারে না। অন্য নারী তার স্বামীকে ভালোবাসার কথা তারই সামনে বলছে। ব্যাপারটা হৃদয়ে ঝড় তুলতে যথেষ্ট। কিন্তু ঐশানী নিজে সায়রাকে এই সুযোগ দিয়েছে। কেননা, সে চেয়েছিল সায়রাকে অভয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে। শ্বাসরুদ্ধকর কন্ঠে বলল….
–“তুমি উনাকে ভালোবাসো নাকি ঘৃণা করো এটা আমায় জানিয়ে কোনো লাভ নেই সায়রা। তুমি যাকে ভালোবাসো সেই মানুষটা যদি তোমায় ভালো না বাসে তাহলে আমার এসব জেনে কি লাভ?”
–“না না। ও আমায় ভালোবাসতো। খুব ভালোবাসতো। কিন্তু তুমি এলে! আমার ভালোবাসায় ভাগ বসালে।”

পাগলের মতো প্রলাপ বকে গেল সায়রা। তার কন্ঠে কান্নাসুর। ঐশানীর ভালো লাগল না কান্নাসুর শুনে। ঢক গিলে বলল….
–“এটা অসম্ভব সায়রা। ভালোবাসতো, ভালোবাসতাম বলে কোনো ওয়ার্ড হয় না। উনি যদি তোমায় ভালোবাসে থাকেন তাহলে তোমায় চিরজীবনের জন্যই ভালোবাসবে। তাছাড়া আমি তোমাদের নিজে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।”
–“তাহলে এখন কেন চাইছো না আমাদের মিলিয়ে দিতে? বলো বলো!”
অস্থির কন্ঠে বলে উঠল সায়রা। ঐশানী বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে। সেই সময় আর এই সময়টা আলাদা! ওই পরিস্থিতিতে ও নিজের অতীতকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল আর আজ সে অভয়কে আঁকড়ে ধরতে চায়। তাহলে কি করে পারবে ওর সঙ্গে মিলিয়ে দিতে অভয়কে?

ঐশানী অস্ফুটস্বরে বলে….
–“কারণ অভয় চান না তোমার সাথে থাকতে। এতে আমার কি করণীয়?”
–“বাহানা বানিয়ো না ঐশানী। আসল কারণ তো এটাই যে, তুমি অভয়ের সাথে থাকতে চাও।”
–“হ্যাঁ তো? আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমরা একে ওপরের সঙ্গে থাকতে চাইব এটা কি স্বাভাবিক নয়?”
কথাগুলো বলে ঐশানীর মনে হলো সে স্বার্থপরতা করছে। এক মূহুর্তে আবারও তার ধারণা পাল্টে গেল। নিজের মানুষকে নিজের করতে কীসের স্বার্থপরতা? ওপাশ থেকে কান্নার সুরটা আরো প্রগাঢ় হলো।

–“বিলিভ মি ঐশানী! এই কয়টা দিন আমি অভয়কে ভুলতে চেষ্টা করেই গেছি। কিন্তু যত ভুলতে চেষ্টা করেছি ততই ওর কথা মনে পড়েছে। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। প্রতি মূহুর্তে আমি এই কামনা করি তোমাদের বিচ্ছেদ ঘটুক। হয়ত এই কথা শুনে তোমরা রাগ লাগছে। কিন্তু এটাই সত্যি। আমি সবসময় চাই তুমি চলে যাও। কিন্তু আমার উইশ পূরণ হয় না। এমন চলতে থাকলে আমি নিজেকে শেষ করে দেব। কেউ বাঁচাতে পারবে না আমাকে।”
ঐশানী নিজেও উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। দোটানায় ভুগতে ভুগতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে তার। হঠাৎ করেই ইশানের মাথায় আসতেই ঢক গিলে বলল….

–“তাহলে ইশানের সাথে তোমার কি সম্পর্ক?”
–“ইশান? ও আমার বন্ধু। আমাকে সবসময় হাসিখুশি চেষ্টা করেছে। এর মাঝে যেই দুইবার ওর সাথে দেখা করেছি সেই দুই বার ও আমাকে হাসানোর চেষ্টা করেছে। ও আমার আসল বন্ধু। যে বিপদে আমার পাশে আছে। আর ইশানও আমাকে ভালো বন্ধুই মনে করে। হঠাৎ ইশানের নামে প্রশ্ন করছো যে?”
–“না কিছু না। রাখছি আমি।”
ঐশানী কলটা কেটে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে। এখন তার কি করা উচিত? বেশকিছুক্ষণ ভাবার পরে তার মনে হলো অনিন্দিতার সঙ্গে কথা বলা উচিত তার। অনিন্দিতা তো এই ভেবে বসে আছে যে ইশান সায়রাকে ভালোবাসে। ফোনটা হাত থেকে রাখার আগেই আবারও ফোনের রিংটোন বাজতে থাকে।

এবার সায়রা নয় ঐশানী যাকে নিয়ে ভাবছে সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিই কল করেছে। শুঁকিয়ে যাওয়া মুখে আপনা-আপনি হাসির রেশ ফুটে ওঠে ঐশানীর। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে তাড়াতাড়ি কল ধরে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে সেই মানুষটির প্রাণোচ্ছল গলার সুর শুনে হৃদয়ের দোলা দিল তার।
–“তুমি কি আগের থেকেই এতোটা হৃদয়হীনা? বরকে দুপুরের খাবার খেয়েছে কি না তার খবর অবধি নিলে না!”
ঐশানী গাল ফুলিয়ে বলে…..
–“আপনার থেকে দ্বিগুণ মহৎ হৃদয় আমার। বিয়ের আগের থেকে প্রমাণ পেয়ে এসেছি আপনি কতটা হার্টলেস! আমি আপনাকে কল করতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই….”

কথাগুলো বলার মাঝরাস্তায় থেমে গেল ঐশানী। মস্তিষ্ক দৃঢ় ভাবে জানান দিল সায়রার কথা না জানাতে। অভয় ঐশানীর পুরো কথা জানতে প্রশ্ন করল…..
–“কি তার আগে?”
–“আপনিই কল দিলেন। আপনি খেয়েছেন?”
–“হুমম পাঁচ মিনিট একটুখানি খাওয়ার সময় পেয়েছি তারপরেই তো মিটিং শুরু হলো আর ইউ নো হোয়াট কি হয়েছে?”
–“কি হয়েছে?” (আগ্রহ নিয়ে)
–“উনারা আমাদের সাথে ডিল ফিক্সড করেছেন।”
আনন্দের সাথে কথাটা বলে ওঠে অভয়। অভয়ের আনন্দিত সুর শুনে ঐশানীর হাসিও প্রসারিত হয়।
–“কংগ্রাচুলেশনস!”
–“জাস্ট কংগ্রাচুলেশনস?”

ঐশানীর চোখজোড়া ছোট হয়ে আসে। উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করে….
–“তাহলে?”
–“ভাবলাম সামথিং স্পেশাল কিছু পাবো। ইউ আর স্টিল আনরোমান্টিক ঐশানী। নো প্রবলেম। আমি আছি না? রোমান্টিকতার প্রতিটা ধাপ শিখিয়ে দেব ওকে?”
ঐশানী চোখ ছানাবড়া করে ফেলে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে….
–“আ…আমি ফোন রাখলাম।”
অভয় ওপাশ থেকে হেসে দেয়। ছেলেটা আজকাল মাঝেমাঝেই হাসে। এই ছেলেকে কিনা হাসানোর একপ্রকার যুদ্ধ ছিল। সে হাসলেও তার কোনো শব্দ শোনা যেত না। যাকে বলে মৃদু শব্দহীন হাসি। এখন সে প্রাণখুলে হাসে। ভালোবাসার মানুষ সার্বক্ষণিক নিজের কাছে থাকলে হাসিটা বোধহয় আপনাআপনি আসে।

–“ঠিক আছে রাখো।”
অভয়ও ফোন কাটতে নেয়। তৎক্ষনাৎ ঐশানীর কি যেন মনে হয়। চটপটে হয়ে বলে…..
–“আর শুনুন! আরেকটা কথা ছিল।”
–“বাবাহ, আজকাল ফোনটাও কাটতে ইচ্ছে করে না বুঝি? কি বলবে বলো।”
–“আমার স্থান আপনার কাছে কোথায় বলতে পারবেন?”
ঐশানীর অদ্ভুত প্রশ্নে চোখ সরু হয়ে এলো অভয়ের। তবে কিছু না ভেবেই বলে দিল….
–“তোমার স্থান আমার সর্বাঙ্গে। আমার শিরা-উপশিরায় তুমি বিরাজমান। আমার মস্তিষ্ক প্রতিটা সেকেন্ডে তোমার নাম করে। আমার হৃদয় তোমাতে অভ্যস্ত।”

ঐশানীর মনটা শান্ত হয়ে এলো। চোখজোড়া শীতলতায় ছেয়ে গেল। এই কথাটা বারবার শুনতে চাইছে তার কান। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে…..
–“আর সায়রার স্থান?”
–“হঠাৎ ওর কথা কেন বলছো? আমাদের মাঝে ওর নাম আনতে চাও কেন তুমি? আমি সায়রাকে ঘৃণা করিনা। কিন্তু ওকে আমাদের মাঝে পছন্দ করি না। একসময় ও আমার মস্তিষ্কে ছিল। কিন্তু হৃদয়ে পৌঁছাতে পারেনি। আর না ও আমার অভ্যেস হয়ে উঠেছে। এটা আমার লাস্ট ওয়ার্নিং। সবসময় ওর কথা তুলবে না।”
কঠোর গলায় জবাব দিয়ে ঐশানীর মুখের ওপর কলটা কেটে দেয় অভয়।

মুখের ওপর কল কেটে দিলেও মোটেও খারাপ লাগল না ঐশানীর। তার ভালো লাগছে। সায়রা নামক মেয়েটা তার অভয়কে কেঁড়ে নিতে পারবে না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে সে। এই শব্দহীন অনুভূতিটা কতই না সুন্দর এবং মোহনীয়….!!

সন্ধ্যেবেলা ঘুম ঘুম চোখে বসে আছে অনিন্দিতা। এসাইনমেন্টে চোটে ঘুম হয় ঠিকঠাক রাতে। এই মূহুর্তে সোফায় বসে সে দুজন ব্যক্তির অপেক্ষা করছে। প্রথমজন ইশান আর দ্বিতীয় জন অভয়। আজকে এক তারিখ ছিল। ইশানের প্রথম কাজের দিন ছিল আজ। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সদরদরজা পেরিয়ে বাড়িতে ঢোকে ইশান। তবে অনিন্দিতা সেটা খেয়াল করে না। ঘুমে সোফার সাথে মাথা লাগিয়ে ঢুলতে থাকে সে। অনিন্দিতাকে ওই অবস্থায় দেখে দুষ্টু হাসি দেয় ইশান। পা টিপে টিপে গিয়ে বসে অনিন্দিতার পাশে। ওকে একটু ধাক্কা দিতেই আচমকা ধড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে বসে ছিটকে গিয়ে বলে…..
–“ও মাগো!”

পাশে লক্ষ্য করেই ইশানকে দেখে চোখ ডলতে ডলতে বলে…..
–“ঘুম থেকে মানুষকে ডেকে তোলার এটা কেমন উপায় ইশান ভাইয়া?”
–“ওমা আমি কি করলাম? তোকে তো অভ্যাস করাচ্ছি।”
–“কীসের অভ্যাস?” (ভ্রু কুঁচকে)
–“আরে তোর স্বামী তো প্রতিদিন মদ খেয়ে এসে গভীর রাতে দরজা ধাক্কাবে। তোকে ঠিক এভাবেই ভয়ের চোটে ধড়ফড়িয়ে উঠতে হবে। তাই আগে থেকে অভ্যেস করে রাখ।”
তা শুনে অনিন্দিতা মুখ ফসকে বলে উঠল…..
–“এই তোমার মদ টদ খাওয়া অভ্যেস আছে? জানতাম না তো?”

বলে নিজেই থতমত খেয়ে চুপ হয়ে যায় অনিন্দিতা। ইশান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে। অনিন্দিতার মাথায় টোকা মেরে হেসে দিয়ে বলে….
–“আরে রামছাগলের ছানা! আমি আমার না তোর বরের কথা বলছিলাম।”
–“উঁহু, আমার বিয়ের কথা বাদ দাও। তোমার বিয়ের কথা বলো।”
–“আমার বিয়ের কথা কি শুনতে চাস?”
–“কেন সায়রাকে যে আমার ভাবি বানিয়ে আনতে চাইলে?”
কথাটা বলা অনিন্দিতার পক্ষে কষ্টসাধ্য হলেও শান্ত থেকে বলার চেষ্টা করল সে। ইশান কিছুক্ষণ নিরব থেকে ফিক করেই হেসে দিল। ওর হাসার কোনো কারণ পেল না অনিন্দিতা।

–“সায়রাকে নিজের বউ বানিয়ে আনব? এই কথা কি করে ভাবলি? ওই কথাটা তো সেদিন আমি এমনিই মজা করে বলেছিলাম। তুইও সিরিয়াসলি নিয়ে নিলি? এমনি এমনি তোকে রামছাগলের ছানা বলি?”
অনিন্দতার মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল যেন। চোখ দুটো খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। মুখেও হাসি ফুটে উঠল অজান্তেই। ওকে হাসতে দেখে হাসি বন্ধ হয়ে গেল ইশানের। ওর চোখজোড়া আবদ্ধ হলো অনিন্দিতার হাসিতে। ওর হাসিটা একটু বেশিই সুন্দর মনে হলো তার। কই আগে তো এমন কিছু মনে হয়নি? চোখ সরিয়ে হালকা কেশে সে বলে ওঠে…..

–“হেহে করে হাসছিস কেন?”
–“কিছু না যাও তো ফ্রেশ হয়ে নাও। ঘামের জামাকাপড় ছাড়ো। যাও যাও।”
অনিন্দিতা ঠেলেই ইশানকে তার ঘরে পাঠিয়ে দিল। তবে নিজের ভাইকে এখনো আসতে না দেখে হতাশও হলো সে। বিগত তিনদিন ধরে সায়রার সত্যিটা অভয়কে জানাতে গিয়েও সে পারেনি। অভয় এতোটাই ব্যস্ত! অনিন্দিতাও এসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত। সব মিলিয়ে কারোরই সময় হয় না। সে হতাশ ভঙ্গিতে হেলেদুলে ঘরে চলে গেল।

রাত প্রায় সাড়ে দশটা! বিধ্বস্ত ক্লান্ত ভঙিতে পা জোড়া কোনোমতে চালিয়ে ঘরে ঢোকে অভয়। চোখটাও যেন বন্ধ হয়ে আসছে তার। আজ যে শান্তির ঘুম দেবে ঐশানীকে জড়িয়ে ধরে। অনেক ধকল গেছে। দরজা খোলার শব্দে তড়িঘড়ি করে ঐশানীর সামনে থাকা ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয়। অভয়ের চোখ এড়ায় না সেটা। ক্লান্তিমাখা সুরে বলে….
–“কি করছো তুমি আমার ল্যাপটপে হু?”
–“তেমন কিছু না শুধু দেখছিলাম।”
–“ঐশানী, তুমি বড়ই মোহময়ী এক নারী সেই সঙ্গে রহস্যময়ী নারীও বটে। মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার মাঝে আরো কিছু রহস্য আছে যা আমি ভেদ করতে পারিনি।”

ঐশানী একটা হাসি দেয়। রাতের আঁধারে সফট নীল রঙের লাইট টাই জ্বালানো আছে শুধু। ক্লান্তি মাখা অভয়ের মনে ঐশানীকে দেখে তার মনে ইচ্ছে জাগল তাকে কাছে পাবার আকাঙ্ক্ষা। ঐশানী ল্যাপটপ টা গোল টেবিলে রাখতে গিয়ে পায়ে হোঁচট খেতেই অস্থিরতার সঙ্গে ছুটে আসে অভয়। দ্রুত ঐশানীর বাহু ধরে বসিয়ে কাতর সুরে বলে…..
–“ব্যাথা পেলে? কোথায় পেয়েছো ব্যাথা? দেখাও আমাকে?”
ঐশানীর কাছ থেকে সে কোনো উত্তর পায় না। ফোঁপানোর শব্দ পেয়ে মাথা তুলে তাকায় অভয়। ঐশানী ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আচমকা ঐশানী অভয়কে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। অভয় বলল….

–” কাঁদছ কেন?”
ঐশানীর কান্না পরক্ষণেই থেমে যায়। মাথা উঠিয়ে বলে….
–“খুশিতে। আপনি আমার এতোটা চিন্তা করেন, কেয়ার করেন তাই।”
–“তোমরা মেয়েরা না সত্যি অদ্ভুত। খুশিতে কাঁদো, দুঃখ পেলে কাঁদো, রাগ হলে কাঁদো, কনফিউজড হলেও কাঁদো। দিনশেষে বলো, আমরা ছেলেরা তোমাদের বুঝতেই পারিনা।”

চলবে….

#বেলা_শেষে_শুধু_তুমি
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৫

–“সত্যিই আপনারা আমাদের বোঝেন না। বিশেষ করে আমাকে বুঝতে কখনোই সফল হবেন না।”
চোখ থেকে আলতো করে পানি মুছে হাসির রেশ ফুটিয়ে বলে ঐশানী। অভয় কোমড়ে হাত দিয়ে ব্যর্থ হওয়ার ভঙ্গি করে বলে…..
–“কি করে বুঝব? তোমরা কিছু হলেই কেঁদে ভাসিয়ে দাও। রাগ, অভিমান, খুশি, দুঃখ সবকিছুর একটাই সলিউশন তোমাদের কাছে সেটা হলো কান্না। এখন তোমরা যদি না বলো কীসের জন্য কাঁদছো তাহলে আমরা বুঝব কি করে? সব কিছুতেই একরকম রিয়েকশন দিলে একটা পন্ডিতকে ডেকে এনে বুঝতে বললেও সে শহীদ হয়ে যাবে।”

ঐশানী ফিক করে হেসে দেয়। অভয়কে পেছন দিকে ঠেলার চেষ্টা করে বলে…..
–“এখন ফ্রেশ হয়ে আসুন। খেতে হবে।”
–“এই তুমি খেয়েছো?”
ঐশানী যেন অভয়ের এই সামান্য কথায় বিপাকে পড়ে যায়। অভয় নিজের শরীর থেকে ব্লেজার খুলতে খুলতে বলে…..
–“মনে হচ্ছে কেমিস্ট্রি বা ফিজিক্সের কোনো কঠিন প্রশ্ন করেছি যার কারণে বলতে এতো হচ্ছে।”
–“হ্যাঁ খেয়েছি।”
–“নাটক টা তুমি আদোও করতে জানো না ঐশানী। তুমি খাওনি। সত্যি বললে পৃথিবী উল্টে যেত না।”
শার্টের বোতামের দিকে চোখ রেখে হাত দিয়ে খুলতে খুলতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে অভয়।

–“আপনি কি করে জানলেন আমি খাইনি?”
–“তোমার পেট।” (ইশারা করে)
ঐশানী মাথা নিচু করে পেটের দিকে তাকায়। শাড়ির আঁচলের অনেকাংশ সরে গেছে। পেটের মাঝে যে কোনো দানা পড়েনি সেটা অনায়াসে বোঝা যাচ্ছে। শাড়ির আঁচল টেনে ভালোভাবে পেট ঢেকে নিল ঐশানী। তীক্ষ্ণ চোখে অভয়ের দিকে তাকিয়ে জোড়ালো কন্ঠে বলে…..
–“আপনার নজর খারাপ। মেয়েদের দিকে নজর দেন।”
অভয় বাঁকা হাসি দেয়। টাওয়ালটা নিজের কাঁধে নিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠে…..
–“তুমি মেয়ে না।”

কথাটা কানে আসামাত্র মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে যায় ঐশানী। চোখের পলক পড়াও বন্ধ হয়ে যায়। সেকেন্ড দুয়েক পরে নিজের হাত ও মুখমণ্ডল স্পর্শ করে সে। নাহ সব ঠিকঠাকই আছে মনে হচ্ছে। বিস্ময়ের সুরে বলে ওঠে…..
–“আমি মেয়ে না মানে? তো আমি কি?”
–“তুমি আমার বউ। নজর দেওয়ার লিগ্যাল রাইট আমার আছে। দরকার পড়লে কাগজপত্র দেখাতে পারি। দেখবে?”
–“না থাক।”
এই বলে স্বস্তির শ্বাস নেয় ঐশানী। অভয়ের কথা শুনে তার নিশ্বাসই একটু জন্য আঁটকে গেছিল যেন। লোকটাও মাঝে মাঝে অদ্ভুত রকমের কথা বলে। অভয় কিছু একটা ভেবে ঐশানীর দিকে এগিয়ে আসে।

–“তুমি তাহলে মিথ্যে বললে কেন? বললে কেন যে খেয়েছো?”
ঐশানী অভয়ের এগিয়ে আসাতে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে আমতা আমতা করতে থাকে। অভয় বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলে…..
–“এর উত্তরও আমার কাছে আছে। উত্তরটা হলো, তুমি আমার কাছে ধরা দিতে চাও না। তুমি আমায় ভালোবাসো ঐশানী। এখন হয়ত বলবে তুমি তো সায়ানকে ভালোবাসো। কিন্তু এক জীবনে যখন প্রথম ভালোবাসার মানুষকে কেউ চিরতরে হারিয়ে বসে সেই মানুষটার মনে দ্বিতীয়বারও ভালোবাসা জন্ম নেওয়ার চান্স থেকেই যায়। তুমিও আমায় ভালোবাসো। কিন্তু স্বীকার করো না। দ্যাটস ইউর প্রবলেম। তুমি যদি বলে দিতে, তুমি ডিনার করো নি শুধু আমার জন্য অপেক্ষা করছো। তাহলে তুমি আমার ভালোবাসার তুমি ডুবে যেতে।”

কথাটা বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায় অভয়। ঐশানী এক ধ্যানে অভয়কে দেখতে থাকে। ততক্ষণ দেখতে থাকে যতক্ষণ অভয় ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে না দিচ্ছে। দরজা লাগিয়ে দেওয়া পর ছলছল চোখে জানালার বাইরে আকাশের দিকে চোখ রাখে ঐশানী। চোখ বন্ধ করতেই বাম চোখ দিয়ে পড়ে যায় অশ্রুধারা। চোখ বুঁজে অভয়ের নামে যতসব অনুভূতি রয়েছে তা অনুভব করতে থাকে। প্রথম প্রথম অভয় তার মনে প্রবেশ করতে না পারলেও একটা সময় অভয় তার অনুমতি না নিয়েই মনের দখলদারি করতে শুরু করেছে। এটা অভয়ের বড়ই অন্যায় নয় কি? এভাবে মনের মাঝে ঢুকে ভালোবাসা পোড়ানোর খুব দরকার ছিল কি?
চোখ খুলে উঠে দাঁড়ায় ঐশানী। শাড়ি ঠিকঠাক করে হাঁটা দেয় বাইরের দিকে খাবার আনবার জন্য।

ভেজা ভেজা শরীরে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ঐশানীকে দেখতে পায় খাবার নিয়ে বসে থাকতে। অভয় গম্ভীর মুখে এসে বসে সোফায়। অভয় নিজহাতে প্লেটে ঐশানীকে খাবার বেড়ে দিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের প্লেটে খাবার বেড়ে খেতে শুরু করে। দুইবার খাবার মুখে নিতেই অভয় লক্ষ্য করে ঐশানী তার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত ঘোর লেগেই রয়েছে। খাবার যেমনটা ছিল তেমনটাই রয়েছে ঐশানীর প্লেটে। সে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে অভয়কে। তার কাছে অভয়ের থুঁতনিটা বেশ সুন্দর লাগে। খাঁজকাটা থুঁতনির অধিকারী অভয়। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি থাকলেও তা বোঝা যায়।

–“কি হলো খাচ্ছো না কেন?”
ঐশানী নড়েচড়ে ওঠে। তার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে প্লেট হাতে নেয়। প্লেটের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলে…..
–“আমাকে খাইয়ে দেবেন?”
ঐশানীর এমন অদ্ভুত আবদারের মুখোমুখি অভয় কোনোদিনও হয়নি। আগে তো ঐশানী অভয়কে সহ্যই করতে পারত না। হয়ত এখন ওর মনে তাকে নিয়ে অনুভূতি জন্মেছে। এই ভেবে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলে…..
–“আমার হাতে খাবে সত্যি?”
–“হুমম। খাওয়াবেন?”

অভয় তাড়াতাড়ি নিজের খাওয়া ছেড়ে ঐশানীর প্লেটে হাত দিতেই ঐশানী আবারও নারাজি কন্ঠে বলে……
–“উঁহু, ওই প্লেটটা রাখলেন কেন? ওখান থেকেই খাওয়ান।”
–“আমার এঁটো?”
–“হু! শুনেছি একই পাতে খাবার খেলে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা বাড়ে।”
চোখ নামিয়ে লজ্জায় জবুথবু হয়ে বলে ঐশানী। অভয়ের মন নেচে ওঠে আনন্দে। প্রিয় মানুষকে খাওয়ানোর আনন্দ এতোটা হয় তার জানা ছিল না। খাবার তুলে ধরে ঐশানীর মুখের সামনে। হা করে খাবার মুখে নেয় ঐশানী।

অভয় মুচকি হেসে ঐশানীর খাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঐশানীর মনেও আনন্দেরা ঢেউ খেলে চলেছে। স্বামীর হাতে খাবার খাওয়ার অনুভূতি এতো সুখকর কেন? আহা…! আনন্দের ঢেউ ঐশানীর চোখে আবারও অশ্রু এনে দিল। তবে ওর মুখে হাসি বিদ্যমান।
–“আবার কাঁদছো? এবার কি খুশিতে নাকি রাগে?”
–“ভালো লাগছে খুব তাই।” (খাবার চিবুতে চিবুতে)
–“আজ তুমি একটু বেশিই অশ্রুবর্ষণ করিয়ে যাচ্ছো ঐশানী। এমন করলে আমি আর খাওয়াবো না।”
বিষন্ন মনে বলে ওঠে অভয়। তা শুনে ঐশানী দ্রুত নিজের হাত দিয়ে চোখ ডলে তাকায়। অভয়ের বিষন্ন মনটা ভরে ওঠে খুশিতে আবারও।

খাবারের প্লেট নিচে রেখে এসে ঘড়ি দেখে নেয় ঐশানী। অভয় আগেই শুয়ে পড়েছে। শরীর আর চলার মতো অবস্থাতে নেই। রেস্ট প্রয়োজন। ঐশানীও অভয়ের পাশে এসে শুয়ে পড়ে। আজ হঠাৎ করেই নিজ থেকে দুই হাত দিয়ে অভয়কে জড়িয়ে ধরে সে। বুকের সাথে মাথা ঠেকিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে। অভয় চোখ খুলে হকচকিয়ে তাকায়। ঐশানী অভয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলে….
–“কি ব্যাপার? সূর্য কি অন্যদিকে উঠেছিল নাকি?”
–“এখন সূর্য নেই চাঁদ আছে।”
–“চাঁদই বোধহয় অন্যদিকে উঠেছে। যাই দেখে আসি।”
–“কি দরকার দেখার? ওকে ওর মতো থাকতে দিলেই তো হয়।”

অভয় হালকা শব্দ করে হেসে দেয়। তবে হাসিটা বেশিক্ষণ টিকে থাকে না তার। ঐশানী অভয়ের বুকের ভর করে আধশোয়া হতেই অভয় দ্রুত বলে ওঠে….
–“কি করছো?”
–“ভালোবাসছি।”
অভয় হতবাক নয়নে চেয়ে থাকল। ঐশানী অভয়ের বুকে মাথা রাখতেই অভয় একটু কেঁপে ঐশানীর চুলে হাত বুলিয়ে বলে ওঠে….
–“তুমি ঠিক আছো তো? আজ তোমার কি হয়েছে? শরীর খারাপ?”
ঐশানীর বেশ রাগ হয়। অভয়ের গেঞ্জির কলার টেনে ধরে সে। ক্ষোভ নিয়ে বলে…..
–“আপনি বলেছিলেন না? আমি আপনাকে স্বীকার করতে ভয় পাচ্ছি? আমার মনে আপনার নামে করা অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছি? এখন তো প্রকাশ করছি। শুনুন আমি আপনাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি। বুঝেছেন আপনি?”

ঐশানীর সকল কথা অভয়ের মাথার ওপর দিয়ে গেল। ওর মাথাতেই আসছে না ঐশানী ওকে ভালোবাসার কথা বলছে নাকি হুমকি দিয়ে চলেছে? অভয় অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। নিজেকে আর ঐশানীকে সামলাতে গলা খাঁকারি দিয়ে ওর গালে হাত রেখে শান্ত বাক্যে বলে…..
–“হ্যাঁ আমি বুঝেছি। আমার ভুল হয়েছে ওসব বলা। এখন শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়েছে তো।”
–“কেন কেন? এখন শুয়ে পড়তে বলছেন কেন? ঘুমাবো না আমি। আজ আমার মনে থাকা সকল ব্যক্ত কথা প্রকাশ করে তবেই আমার হবে শান্তির ঘুম। আজ আপনিও নিজের অনুভূতি উজার করবেন আর আমিও। ডিল ফাইনাল!”

–“আরে অদ্ভুত? আমি কখন এই ডিল করলাম? আর আমি তো বুঝতেই পারছি না তুমি আমায় নিজের অনুভূতির কথা বলছো নাকি হুমকি দিচ্ছো? আবার ডিলও করছো। তোমার কি হয়েছে আজ? আমার মনে হচ্ছে তুমি উল্টাপাল্টা কিছু খেয়ে ফেলেছো।”
–“নট এট অল। আমি আপনাকে সত্যিই খুব ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি শ্যামলা ঘোড়াকে। আর ভালোবাসতেও চাই। কিন্তু….. ”
–“কিন্তু কি?”
ভ্রু কুঁচকে বলে অভয়। ঐশানী মাথা নাড়িয়ে বলে….
–“কিছু না। আজ থেকে আপনি আমার, আমি আপনার ডিল ফাইনাল। আর এটা আমৃত্যু অবধি থাকবে।”

–“আমি জানি ঐশানী। তুমি আমার মনে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বেঁচে থাকবে।”
–“আজ আমাকে নিজের করে নেবেন অভয়?”
অভয় বিষম খেয়ে তাকায়। ঐশানীর বলা একটু আগের কথা বারংবার তার কানে বাজছে। অভয় বিস্ময় কাটাতে পারছে না। কিছু বলতে উদ্যত হতেই ঐশানী অভয়ের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। অভয় বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এই প্রথম নিজের প্রেয়সীর ঠোঁটের স্পর্শ পড়ল। শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ঐশানীর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায় অভয়। গালের পাশ থেকে চুলটা যত্নের সাথে সরিয়ে দিয়ে আলতো হাসি দিয়ে ঐশানীর দুই গালেও ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। আজ ঐশানীর নিজ থেকে কাছে আসা অভয়ের কাছে অবিশ্বাস্য হলেও নিজেকে আটকানো বড্ড দায় হয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে নিজেকে হয়ত না আটকিয়ে নিজের মনের কথাও শুনতে হয়। মনের কথা শুনতো গিয়ে তাদের ভালোবাসা প্রগাঢ় হতে থাকে। দৃঢ় ভাবে অনুভব করতে থাকে একে ওপরকে। এ যেন এক মোহনীয় রাত!!

নতুন সকালের আগমন ঘটে। সময় নিজ গতিতে চলতে শুরু করে। আর প্রত্যেকটা মানুষও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শুরু করে। তবে অভয়ের কাছে এটা যেন এক অন্যরকম সকাল। কেননা কাল রাত থেকে তার আর ঐশানীর পথ চিরতরে এক হয়ে গিয়েছে। দুজন আজ দুজনের কাছে বিলীন হয়ে পড়েছে। অভয় কোন ব্লেজার পড়বে তা নিয়ে কনফিউজড হয়ে পড়েছে। আলমারির মাঝে হ্যাঙ্গারের সাথে ঝুলানো সবই কালো রঙের ব্লেজার হলেও সে কনফিউজড। এরইমাঝে তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে আসে ঐশানী। অভয়কে রেডি হতে দেখতে পেয়ে সুন্দর হাসির ঝিলিক দেয় সে। আচমকা বলে বসে…..
–“এতো তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছেন?”

অভয় ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায়। ঐশানীর কথায় একটু অবাক হয়েই বলে….
–“তাড়াতাড়ি? ঐশানী, ঘড়ি দেখেছো? সাড়ে নয়টা বাজছে। আর এতোদিন তো আরো তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেছি।”
–“ওহ। হয়ত আমারই ভুল।”
–“ভুলটা মনে হয় আমার বউ ইচ্ছাকৃতই করছে। উহুম…বরকে ছাড়তে চাইছো না নাকি হুমম? আরেকটু ভালোবাসা চাই?” (ফিসফিসিয়ে)
ঐশানী চোখ নামিয়ে নেয়। তার শ্যামলা ঘোড়া লজ্জা দিতে ওস্তাদ। দৃঢ় কন্ঠে বলে….
–“যান তো। অফিসে যান।”

–“প্রথমে তো যেতেই দিতে চাইছিলে না। এখন তাড়িয়ে দিচ্ছো?”
হেসে নিজের হাতের কাছে থাকায় ব্লেজার গায়ে শার্টের ওপর জড়িয়ে নেয় অভয়। দম নিয়ে বলে….
–“ওকে দেন। আমি যাচ্ছি। তুমিও এসো খেতে।”
অভয় ঐশানীর পাশ কাটিয়ে যেতেই পিছুডাকে ঐশানী।
–“শুনুন!”
অভয় ঘুরতেই ঐশানী আবারও বলে…..
–“যাওয়ার আগে আমায় একবার জড়িয়ে ধরবেন প্লিজ?”
অভয় ঐশানীর কথায় আর কান্ডে অবাক হয়েই চলেছে। মেয়েটা কাল থেকে এমন সব অদ্ভুত আবদার করছে অভয়েরও ভালো লাগছে। আবার হতভম্বও হয়ে পড়ছে।

অভয় অপ্রস্তুত হেসে হাত প্রসারিত করতেই ঐশানী ছুটে এসে অভয়ে বুকে পড়ে। শক্ত করে চেপে ধরে অভয়কে। ঐশানী বড় বড় শ্বাস ফেলছে। পা একটু উঁচু করে জড়িয়ে রেখেছে অভয়কে। লোকটা বেশ লম্বা। তার শ্বাসপ্রশ্বাস অভয়ের ঘাড়ে পড়ছে। বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর নিজের থেকেই অভয়কে ছেড়ে দাঁড়ায় ঐশানী। মুচকি হাসি দিয়ে বলে…..
–“চলুন নিচে।”
ঐশানী ও অভয় একসঙ্গে নিচে নামে।

ব্রেকফাস্ট করছে টেবিলে সকলে। অনিন্দিতাও উপস্থিত সেখানে। সে সুযোগ খুঁজছে তার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার। আজ যে কোনোমতেই অভয়কে সবটা না বলে ছাড়বে না। অভয়ের তাড়াহুড়ো করে খেয়ে উঠতেই অনিন্দিতা ফট করে বলে….
–“ভাইয়া শোন। আমার কিছু কথা আছে তোর সঙ্গে।”
–“আমার সঙ্গে কি এমন কথা বল?”
–“এখানে না আমি খেয়ে উঠে আসছি যা।” (ইতস্তত বোধ করে)
–“আমি বাইরে বাগানে আছি। তুই আয়।”
বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় অভয়।

অনিন্দিতাও মুখে একবার পুরো স্যান্ডউইচ ঢুকিয়ে শরবত এক নিশ্বাসে খেয়ে উঠে পড়ে। মিসেস. তনয়া তা দেখে বিরক্ত হয়ে বলেন…..
–“এই, এভাবে খায় কেউ?”
–“মা সময় নেই। আমি ভাইয়ার কাছে যাচ্ছি।”
মিসেস. তনয়াকে পাত্তা না দিয়ে একপ্রকার তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যায় অনিন্দিতা।

গাড়ির সামনে একমনে দাঁড়িয়ে আছে অভয়। অনিন্দিতার পায়ের শব্দে পিছু ফিরে তাকায় সে। অনিন্দিতা তাড়াতাড়ি করে আসে। ওর হাতে ফোন। অভয় ঘড়িতে টাইম দেখে বলে…..
–“বল কি বলবি?”
অনিন্দিতা একটু থেমে বলে….
–“ভাইয়া তুই ভাবিস যে তুই সায়রাকে ঠকিয়েছিস। তুই ভুল করেছিস। তাই না?”
সায়রার প্রসঙ্গ তুলতেই অভয়ের কপাল কুঁচকে যায়। ওকে সে পাল্টা প্রশ্ন করে বলে…..
–“সায়রার কথা বলতে তুই আমায় অপেক্ষা করতে বললি?”
–“হ্যাঁ ভাইয়া। বিষয়টা জানা তোর জরুরি। সি ইজ এ লায়ার। তোকে ও প্রথমেই ঠকিয়েছে ওর বাবার কথায়।

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে অনিন্দিতা। অভয় অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে ওঠে…..
–“হোয়াট?”
–“হ্যাঁ। কয়েকদিন আগে ওর সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু তুই ব্যস্ত থাকায় বলার সুযোগ হয়নি।”
অভয়কে সব কথা খুলে বলে অনিন্দিতা। ওকে নিজের ফোনে থাকা রেকর্ডিং-ও শুনিয়ে দিতেই দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে অভয়। সে অন্তত সায়রার কাছ থেকে এটা আশা করেনি। তার বাবা কতবার এই কথা বোঝানোর চেষ্টা করে গেছে তবুও সে পাত্তা দেয়নি।
–“আই কান্ট বিলিভ। বাবা আর তুই কতবার বলেছিস আমাকে এই কথা। তবুও আমি….”

–“দেখ সায়রার সঙ্গে তোর সামনাসামনি বোঝাপড়া করা উচিত। ওর সঙ্গে সব একবারে শেষ করে দিয়ে আয়। এই কয়দিন ও আমায় সারাদিন কল করে তোর সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে চেয়ে আমার মাথা খারাপ করে রেখেছে। তুই ওর সাথে শেষবারের মতো দেখা করে সব মিটিয়ে দিয়ে আয়। এতে সকলের ভালো হবে।”
অভয় প্রথমে যেতে রাজি না হলেও নিজেদের ও সায়রার ভালোর জন্যই রাজি হয়। সায়রা যদি এমন করতে থাকে তাহলে ওরই ক্ষতি হবে। আজ অভয় যাবে সায়রার সাথে বোঝাপড়াটুকু করতে।

চলবে……