শেষটা সুন্দর পর্ব-১৫+১৬

0
737

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১৫,

খপ করে শক্ত হাতে তরীর চলমান হাতটা ধরে নির্ঝর বলল,

‘বারণ করেছি না? আর পড়তে হবে না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো!’

তরী নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কয়েক বার মোচড়ামুচড়ি করে ব্যর্থ হলো। চারপাশে নজর বুলিয়ে রক্তলাল চোখে নির্ঝরের দিকে তাকালো। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘হাতে ব্যথা পাচ্ছি।’

তরীর লাল লাল দৃষ্টিতে চোখ পড়তে নির্ঝরের চোখ দুটো কোমল হয়ে এলো। হাতের বাঁধন একটু আলগা করলো। ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,

‘প্লিজ এবার ঘুমিয়ে পড়ো।’

তরীর কি হয়ে গেল কে জানে! সে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। সারা দিনের রাগ, অভিমান, চাপা ক্ষোভ সব নির্ঝরের উপর উগ্লে ফেলল। সমস্ত শক্তি দিয়ে নির্ঝরের বুকে ধাক্কা দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল,

‘সমস্যা কি আপনার? হ্যাঁ? আমায় বোকা পেয়েছেন? যা নয় তাই বলবেন? তাই করবেন? পড়লেও বকা দিবেন আবার না পড়লেও বকা দিবেন? কি চান আপনি?’

তরীর ধাক্কার বেগ কিছুটা বেশি ছিল। নির্ঝর প্রস্তুত না থাকার কারণে একটু পিছিয়ে এলো। অবাক হয়ে তরীর দিকে চেয়ে রইলো সে। তরীর অভিমানের গভীরতা সে টের পাচ্ছে। মেয়েটাকে শান্ত করা দরকার! সোজা হয়ে বসে আরো নরম গলায় বলল,

‘আপাতত চাইছি তোমার ঘুম! প্লিজ তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।’

‘ঘুমাব না আমি। জোর করে ঘুমাতে বাধ্য করবেন?’

‘আহা,জোর করবো কেন? কুল! না ঘুমালে অসুস্থ হয়ে পড়বে। ঘুমিয়ে পড়ো এখন।’

‘ঘুমাব না মানে ঘুমাব না। সারাদিন রাত পড়াশোনা করবো। ভালো রেজাল্ট করতে হবে আমাকে। ভালো রেজাল্ট করে তারপর ঘুমাব।’

‘তাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে যে!’

‘হলে হোক! টপ রেজাল্ট চাইতো আপনার?’

নির্ঝর আহত স্বরে বলল,

‘রেজাল্ট চাই আমার এটা ঠিক। কিন্তু তোমার শরীর অসুস্থ করে নয় তরী। প্লিজ এবার লক্ষীটির মতো ঘুমিয়ে পড়ো। অসুস্থ হয়ে যাবে তো।’

‘অসুস্থ হই হবো! লেটার মার্কস প্রয়োজন আপনার। জান দিয়ে হলেও রেজাল্ট ভালো করবো আমি।’

তরীর শেষ বাক্যের প্রতিটি শব্দ নির্ঝরের বুকে তীরের মতো গিয়ে বিঁধলো। তরীর উদ্ভ্রান্ত চেহারা হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে সে তরীকে বুকে জড়িয়ে নিল। তরী নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করলো কিছুক্ষণ। নির্ঝর ছাড়লো না। উল্টো আরো শক্ত হাতে বুকের মাঝে চেপে ধরলো।

আস্তে আস্তে তরী শান্ত হয়ে এলো। তার লাল লাল চোখ দুটো জলে টলমল করে উঠলো। মস্তিষ্কের সাথে কিছুক্ষণ স্নায়ুযুদ্ধ করে অবশেষে হার মানলো। ডুকরে কেঁদে ফেলল সে। এতক্ষণ জমিয়ে রাখা অভিমানের পাহাড়ে ধ্বস নামলো। ঝরণার মতো অবিচল ধারায় গলে গলে পড়লো অভিমানের পাহাড়।

নির্ঝরের ভেতরটা অন্য রকম প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। এতদিন বুকের ভেতর বয়ে চলা উচ্ছ্বল নদী শান্ত হয়ে এলো। উথাল পাথাল ঢেউয়ে হৃদয়ের পাড় গুঁড়াে গুঁড়ো করে দেওয়া প্রতিটি ঢেউ থেমে গেল। মন নদীতে পুরনো পালে নব্য প্রেমের জোয়ার। বুকের ভেতর ভালোবাসার স্নিগ্ধ পরশে জুড়িয়ে গেল যেন! বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তার। তরীকে বুক পাজরে আঁকড়ে ধরা হাত দুটো আরো শক্ত হয়ে এলো। কন্ঠে বিষণ্ণতা নিবেদন করে মৃদুস্বরে বলল,

‘স্যরি! ভেরি স্যরি তরীরানি।’

তরীর কান্নার বেগ কমে এলো। নির্ঝর বাম হাতে তার চুলে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল,

‘আমায় ভুল বুঝো কেন তুমি? তরী, তুমি পড়ালেখার প না জানলেও তোমায় নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি নিরক্ষর, বোকা, মাথামোটা, দৃষ্টিহীন, পঙ্গু মানে যা তা হও কেন, তোমায় নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। এই তোমায় নিয়েই আমি বার্ধ্যকের শহর দেখতে চাই। কিন্তু তরী! ভবিষ্যতে আমি যখন অফিসে থাকবো, একাকী বিকেলবেলা জানালার কার্নিশে মাথা রেখে যেন তোমার মনে না হয় যে তুমি আমার যোগ্য নও! মাঝরাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেলে যেন তোমার মনে না হয় যে তুমি আমার থেকে কিছুটা পিছিয়ে। আমাদের এডুকেশনাল ডিফারেন্স নিয়ে যেন তোমার মধ্যে কখনো হীনমন্যতা সৃষ্টি না হয় সেজন্য তোমার পড়াশোনা নিয়ে আমি এত তোড়জোড় দেখাচ্ছি। তোমার পিছিয়ে পড়া রূপ আমি দেখতে পারবো না। এই ছোট বিষয়টা কেন বুঝো না তুমি? বলোতো? বাদ দাও! তুমি পড়তে না চাইলে আমি জোর করবো না। পড়তে হবে না তোমাকে!’

তরীর হাতদুটো নির্ঝরের পিঠ স্পর্শ করার আগমুহূর্তে যেভাবে আচমকা জড়িয়ে ধরেছিল ঠিক সেভাবেই আচমকা তরীকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নির্ঝর। তরী মাথা নিচু করে ওড়নার এক অংশ টেনে নাক ঝেরে মুছলো। নাঁক টেনে বলল,

‘আমি ভেবেছিলাম, আপনি আমায় দিয়ে জোরপূর্বক পড়াশোনা শিখিয়ে চাকরিতে পাঠাবেন। তারপর আমার রোজগারের সব টাকা আত্মসাৎ করবেন।’

নির্ঝর হাসতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিল। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘কি বুদ্ধি তোমার তরী। এই আইডিয়া তো আমার মোটা মাথায় একদম আসেনি। আজ থেকে বেত্রাঘাত করে তোমায় পড়াব। এট এনি কস্ট, তোমার রোজগারের টাকা আমায় আত্মসাৎ করতেই হবে। নইলে আমি মরেও শান্তি পাব না।’

‘এই অবস্থায় মজা করছেন কেন আপনি?’

‘নাহ! একদম মজা করছি আমি। আ’ম সিরিয়াস।’

‘ওমা তাই? মজা তাহলে আমি করছিলাম? এতক্ষণ!’

তরী চোখ ছোট ছোট করে নির্ঝরের দিকে তাকালো। এতক্ষণে তরীর চোখের দৃষ্টি নির্ঝরের ভেতরটা উলোটপালোট করে দিল। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। শরীরে বহমান শীতল রক্তধারা ছুটন্ত ট্রেনের গতিপ্রাপ্ত হলো। তরীর ফোলা ফোলা নাক, মুখের থেকে তার দৃষ্টি সরছে না।

তরীর গলা শুকিয়ে গেছে। সে জিহবা দিয়ে শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে বলল,

‘আমায় এক গ্লাস পানি দিন তো।’

‘এই এক্ষুণি দিচ্ছি।’

বলে নির্ঝর সেন্টার টেবিলের উপর রাখা জগের দিকে এগিয়ে গেল। তার নিজেকে কেমন অগোছালো লাগছে। কেমন মাথা শূন্য শূন্য মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে গ্লাসে পানি ঢালতে নিয়ে সব পানি গ্লাসের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। তরী এগিয়ে এসে তার হাত থেকে জগ নিয়ে নিল। সুনিপুণভাবে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,

‘সামান্য গ্লাসে পানি ঠিকমতো ঢালতে পারেন না। অথচ লেকচার দেওয়ার সময় নিজেকে মহাজ্ঞানী মনে করেন।’

তরীর একটা কথাও নির্ঝরের কানে ঢুকছে না। সে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তরীর দিকে। তরীর পরণে মেরুন রঙের থ্রি পিস। মাথায় কাপড় নেই। ঢিলেঢালা খোঁপা করা চুল ঘাড়ের কাছে পড়ে আছে। ওড়নার ঝুলন্ত একটা অংশ ফ্লোর ছুঁয়েছে। কেমন বাচ্চা বাচ্চা চেহারা! এত বাচ্চা একটা মেয়ে তার বউ? সম্মোহনের মতো দুপা এগিয়ে গিয়ে সে তরীর ঝুলন্ত ওড়না হাতে তুলে নিল।

তরী গ্লাস উঁচু করে পানি পান করছে। গ্লাস আঁকড়ে ধরা স্বচ্ছ, কোমল হাতদুটোর দিকে তাকিয়ে নির্ঝরের অনুভূতি গুলো যেন ছন্নছাড়া হতে চাইলো। মসৃণ হাতে একটা করে চিকন চুড়ি! তরীকে তার সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের মতো মনে হচ্ছে। কোমল, নরম ভালোবাসার ফুল। এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে যেই ফুলকে ভালোবাসার চাদড়ে মুড়ে আপন করে নিতে।

হাতের গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে তরী ঘুরে দাঁড়াল। নির্ঝরের হাতে ওড়নার এক অংশ দেখে অবাক হয়ে বলল,

‘ওড়না ধরেছেন কেন আপনি?’

নির্ঝর ওড়না ছেড়ে দিয়ে ঝট করে দু পা পিছিয়ে এলো। শুকনো ঢোক গিলে মাথা চুলকে বলল,

‘হাউ ফানি! আমি ধরবো কেন? ওটা আপনা-আপনি হাতে চলে এসেছে।’

‘কি? আমাকে বোকা মনে হয় আপনার কাছে?’

‘এই একদম না! বোকা তো আমি। মহাবোকা।’

‘স্বীকার করার জন্য ধন্যবাদ। রাতের খাবার খেয়েছেন আপনি?’

নির্ঝর এতক্ষণ পালানোর জন্য পথ খুঁজছিল। এই মেয়ের কাছাকাছি থাকলে ঠিক কিছু একটা ঘটে যাবে। অথচ সবকিছুর জন্য একটা উপযুক্ত সময় দরকার। সে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল,

‘রাতের খাওয়ার কথা একদম ভুলে গেছি। খেয়ে আসি।’

‘মা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি আসবো?’

‘খবরদার না! হাত আছে আমার। নিজে নিজে সব করতে পারবো। আমি আধ ঘন্টা পর আসছি। এসে যেন দেখি ঘুমিয়ে পড়েছ। মনে থাকবে?’

তরীর উত্তরের অপেক্ষা না করে নির্ঝর রুম থেকে বের হলো। বাইরে থেকে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে এক দৌঁড়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় গিয়ে বসে পড়লো। বুকে হাত চেপে টেনে টেনে শ্বাস নিল সে। ড্রয়িং রুম অন্ধকার। রান্নাঘরের জ্বালানো লাইট থেকে ছিটেফোঁটা আলো এসে এদিকটা কিঞ্চিৎ আলোকিত করেছে। সেই আলোতে নির্ঝর নিজের রুমের দিকে চেয়ে রইলো। এতদিন তরী তার প্রতি বিমুখ থাকাতে সে সবসময় প্রার্থনা করেছে, মেয়েটা যেন তার দিকে একটু ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকায়। কিন্তু এই মেয়ের প্রেমপূর্ণ একটু দৃষ্টি তার জন্য তো মৃত্যুসম। ওই চোখে নিশ্চিত তার মরণ হবে। নিশ্চিত!

_______________

লম্বা একটা হাই তুলে চায়ের কাপে গরম পানি ঢাললেন শফিকুর রহমান। প্যাকেট থেকে দুটো টি ব্যাগ, দেড় চামচ দুধের গুঁড়ো আর সুগার কিউব দিয়ে নাড়া শুরু করলেন। চায়ের কাপে টুংটাং আওয়াজ তুলে দ্বিতীয় দফায় হাই তুললেন তিনি। একটুপর চায়ের কাপে ছোট্ট করে চুমুক দিয়ে দেখলেন সব ঠিকঠাক আছে। তিনি তৃতীয় দফায় হাই তুলে চায়ের কাপ হাতে ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়ালেন।

ঘুম ঘুম চোখে সোফার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। অন্ধকারের আন্দাজ করে সোফায় বসতেই কেউ ক্যাঁক করে উঠলো। ভয় পেয়ে উঠতে নিতে গরম চা ছলকে হাতে পড়লো কিছুটা। তিনি সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,

‘কে? কে রে?’

নির্ঝর চোখ ডলে বাবার দিকে তাকালো। বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘বাবা,তুমি কি পৃথিবীতে আর কোথায় জায়গা পাওনি? ঠিক আমার পেটের উপর এসে বসতে হবে?’

নির্ঝরের কন্ঠ শুনে শফিকুর রহমান ভড়কে গেলেন। মাঝরাতে নির্ঝর রুমের বাইরে কেন? সোফায় ঘুমাচ্ছে? তিনি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ড্রয়িং রুমের লাইট অন করলেন। ফের নির্ঝরের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,

‘ইচ্ছে করছে গরম চা তোর মাথায় ঢালি। এত রাতে এখানে কি করছিস? বৌ মা রুম থেকে বের করে দিয়েছে?’

‘হাউ ফানি! আমার রুম থেকে আমাকে কে বের করবে?’

‘তাহলে রাত দেড়টার সময় আমাকে ভয় দেখানোর যথোপযুক্ত কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘কি? রাত দেড়টা বাজে?’

শফিকর রহমান নির্ঝরের বিস্ময় মিশ্রিত মুখের দিকে এক নজর চেয়ে সোফায় বসলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,

‘এত রাতে এখানে ঘুমাচ্ছিলি কেন?’

‘টেলিভিশন! টেলিভিশন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’

‘তুই ঘুমিয়ে পড়লে টেলিভিশন বন্ধ করলো কে? ভূত তো নয়,রাইট?’

নির্ঝর হাল ছেড়ে দিল। তার ওকালতি করা বাবার কাছে হার মানতে বাধ্য সে। বাবার রুটিন তার মুখস্থ। মাঝরাতে চা পান করে এখন তিনি স্টাডিরুমে বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজবেন। সে বিনয়ের সাথে বলল,

‘বাবা আমি আসছি। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে।’

হাই তুলে নির্ঝর রুমের দিকে পা বাড়াল। আড়চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলো, তিনি মিটিমিটি হাসছেন। বাবা কি সত্যি ভেবেছে যে তরী তাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছে? ও গড!

ভেড়ানো দরজা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল নির্ঝর। রুমের ছিটকিনি লাগিয়ে বিছানার দিকে তাকাতে তার ঘুম উবে গেল।

(চলবে)

#শেষটা_সুন্দর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___১৬

রুমের ছিটকিনি লাগিয়ে বিছানার দিকে তাকাতে ঘুম উবে গেল নির্ঝরের। তরী অগোছালো ভাবে শুয়ে আছে। বই, খাতা সব এখনো বিছানা জুড়ে ছড়ানো ছিটানো। মোটা একটা নোটবুকের উপর মাথা রেখে কাঁচুমাচু হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ডান হাতে এখনো একটা খাতা ধরে রাখা।

ধীরপায়ে এগিয়ে গেল নির্ঝর। তরীর দিকে ঝুঁকে কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। গভীর মনোযোগ দিয়ে তরীর মুখের প্রতিটি শিরা, উপশিরা দেখে পর্যবেক্ষণ করে চলল। একটুপর মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো সে। বিছানা জুড়ে থাকা বই খাতাগুলো একত্রে গুছিয়ে ফেলল। অল্প অল্প করে সেগুলো তরীর পড়ার টেবিলে রেখে এলো। বিছানার চাদর টান টান করে বালিশ গুলো ঠিকঠাক জায়গা রেখে সে তরীর নিকট এলো। আলতো করে তাকে কোলে তুলে জায়গা মতো শুইয়ে দিল। মাথার নিচের বালিশটা টেনেটুনে ঠিক করলো। শেষে গলা পর্যন্ত কম্বল টেনে দিয়ে তরীর পাশে বসে পড়লো।

নির্ঝর ভেবে পায় না এই ছোট্ট একটা গোলগাল মুখের মাঝে এমন কি আছে যা তাকে এতটা টানে? এতটা পাগল করে তুলে? এতটা ছন্নছাড়া করে দেয়? তার সমস্ত সুখ এই মেয়েটা যেন শুষে নিয়েছে। শুষে নিয়েছে সমস্ত অনুভূতি। তার নিজের বলতে এখন কিছু নেই। সব এই মেয়ের মধ্যে। এই মেয়েকে হাসতে দেখলে তার মুখে হাসি ফোঁটে, একে সুখে দেখলে তার সুখ সুখ অনুভূত হয়, এই মেয়ের মন খারাপ করলে তার মনের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়। মানে এই মেয়ে তার মনের সম্পূর্ণ দখল নিয়ে নিয়েছে। সে এমনি এমনি বলে না এই মেয়ে তার সম্পূর্নাঙ্গিনী।

নিজের চিন্তা ভাবনায় হেসে ফেলল নির্ঝর। সে যে কতটা তরীনির্ভর হয়ে পড়েছে তা যদি এই মেয়ে বুঝতো! হাসি থামিয়ে সে তরীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘ভালোবাসি আমার পিচ্চি বউ! বাচ্চা বউ! ভালোবাসি।’

সরে আসার সময় তরীর কপালে গভীরভাবে উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ দিল নির্ঝর। মুখটা উঁচু করতে টিশার্টে টান পড়লো তার। বুঝতে পারলো তরী ঘুমের ঘোরে তার বুকের কাছের টিশার্ট আঁকড়ে ধরেছে। মুচকি হেসে সে তরীর হাত থেকে টিশার্ট ছাড়িয়ে নিল। মনে মনে বলল,

‘এত সহজে তো আমায় পাবে না তরীরানি! যত কষ্টই হোক আমার, এতদ্রুত তোমার হাতে ধরা দিবো না তো ডিঙিরানি। তোমায় আমার জন্য উতলা করে, পাগল করে সেই পাগলামি আবার অামিই সহ্য করবো। তোমার সব পাগলামি আবার আমিই থামাব।’

তারপর একলাফে নিজের জায়গা এসে বালিশে মুখ ঢেকে চোখ বন্ধ করলো।

_______________

ভোরবেলা মেয়েলি স্বরের গুনগুন আওয়াজে নির্ঝরের ঘুম ভাঙলো। কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ ঠাওর করার চেষ্টা করলো কিসের আওয়াজ। মস্তিষ্ক কাজ করতে বুঝতে পারলো এটা তরীর কন্ঠ। তরী তার আগে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে?

বিস্ময় নিয়ে নির্ঝর চোখ টেনে খুলল। ডান কাত হয়ে শুয়ে ছিল সে। চোখ খুলতে সরাসরি তরীর মুখ আবিষ্কার করলো। তরী বিছানায় বই হাতে বসে আছে। গায়ে পাতলা কম্বল পেঁচিয়ে ঢুলে ঢুলে পড়ছে। ডান হাত দিয়ে মাঝে মধ্যে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। নির্ঝরের কাছে তরীর এই দৃশ্য বিরল। অবাক হয়ে সে তরীর দিকে চেয়ে রইলো। একটুপর মাথা ঘুরিয়ে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। পাঁচটা বাজতে এখনো সাত মিনিট বাকি!

বালিশে হেলান দিয়ে উঠে বসলো সে। তরীর দিকে চেয়ে বলল,

‘এত ভোরবেলা উঠেছো কেন তুমি? পাগল হয়ে গেছো?’

‘পাগল হয়েছি কি না সেটা আমায় জিগ্যেস করছেন কেন? পাগল কি কখনো বুঝতে পারে যে সে পাগল হয়েছে?’

তরীর উত্তরে নির্ঝর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এক পলক তার দিকে চেয়ে তরী নড়েচড়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দিল। নির্ঝর চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। হাই তুলে বলল,

‘কিছু খেয়েছ?’

‘ক্ষুধা নেই।’

নির্ঝর আর দেরি করলো না। দরজা খুলে বাইরে বের হলো। রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার সময় খেয়াল করলো মায়ের রুমে আলো জ্বলছে। হয়তো নামায পড়ার জন্য উঠেছে। সে নিঃশব্দে চুলা জ্বালিয়ে পানি গরম করতে দিল।

ডেকচিতে পানি টগবগ করে ফুটছে। নির্ঝরের সেদিকে খেয়াল নেই। সে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঝিমাচ্ছে! পেছন থেকে পুরুষালী কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,

‘এক কাপ বেশি করে চা বানা তো!’

নির্ঝর চমকে বলল,

‘বাবা!’

‘হুঁ। বল, শুনছি।’

নির্ঝর পেছন ঘুরে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। তার বাবা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে নোটবুকে কিছু লেখার চেষ্টা করছে। সে বুকে ফু দিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,

‘বাবা গো। হঠাৎ হঠাৎ উদয় হয়ে প্লিজ আমায় ভয় পাইয়ে দিবে না। এমনিতে হার্ট দূর্বল আমার।’

‘আমারও দূর্বল। হার্ট আর কি! তাড়াতাড়ি এক কাপ চা দে।’

নির্ঝর গরম পানিতে সব দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। একটুপর চায়ের কাপে ঢালতে ঢালতে বলল,

‘তুমি এখন চা খাবে, ঘুমাবে না? সারা রাত তো জেগেই পার করলে। এখন অন্তত একটু ঘুমাও।’

‘আমি তো এখন ঘুমাব। চা তোর মায়ের জন্য। নামায পড়ে চা খাবে। আমার উপর চা বানানোর হুকুম পড়েছে। সেজন্য রান্নাঘরে আসছিলাম। ভাগ্যিস তুই আগেভাগে থেকে বানাচ্চিলি। কিন্তু তুই এত সকালে কার জন্য চা বানাস? বৌমার জন্য?’

‘তোমার বৌমার জন্য চা বানাব আমি? হাউ ফানি! সবাই তোমার মতো বউকে ভয় পায় না বাবা। নিজের জন্য চা বানাচ্ছি আমি।’

শফিকুর রহমান নির্ঝরের দিকে চেয়ে অদ্ভুত ভাবে হাসলো। এগিয়ে এসে দুটো কাপের মধ্যে একটা চায়ের কাপ হাতে উঠিয়ে চলে গেল।

মিনিট দশেক পর একটা ট্রেতে এক কাপ চা, কয়েকটা টোস্ট বিস্কুট আর এক টুকরো ড্রাই কেক নিয়ে নির্ঝর রুমে ঢুকলো। তরীর পাশে চেয়ার টেনে সেখানে রেখে দিল। আবার পাশ কাটিয়ে বিছানায় ফিরে বলল,

‘খালি পেটে পড়া মনে থাকবে না। মা বলেছে! চুপচাপ খেয়ে পড়তে থাকো। আমি ঘুমাই!’

নির্ঝরের কাজে তরী বিস্মিত হলেও তার প্রকাশ ঘটলো না। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে সে চায়ের কাপ হাতে তুলে চুমুক দিল। মুহূর্তে তার ভেতরে অন্য রকম ভালো লাগায় ছেয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি নিয়ে সে নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝর তার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছে।

তরী ইচ্ছেকৃত ভাবে শব্দ করে পড়া শুরু করলো। আড়চোখে নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝরের কোনো ভাবান্তর না দেখে সে গলার স্বর আরো কয়েক ধাপ উঁচু করে পড়া শুরু করলো। সে যেহেতু ঘুমাতে পারছে না, এই মানুষটাকেও ঘুমাতে দিবে না।

তরীর গলার স্বর ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। নির্ঝরের ঠোঁটের কোণে হাসির রেশ দেখা দিল। পিঠ সোজা করে শুয়ে বন্ধ চোখে বলল,

‘এক লাইন এতবার পড়া লাগে তরী? আমার তো একবার শুনেই মুখস্থ হয়ে গেছে।’

‘আপনি কি বলতে চাইছেন আমার ব্রেন ভালো না? আমার পড়া মুখস্থ করতে অনেক সময় লাগে?’

‘হাউ ফানি! আমি এসব কখন বললাম? তুমি নিজেই তো বলছো।’

‘কি বলেছি আমি?’

‘তেমন কিছু না। অ্যানি ম্যারেজ ক্যারিড আউট বিলোও দ্য এইজ অফ এইটিন ইয়ার্স ব্লা ব্লা ইজ কলড আর্লি ম্যারেজ।এই লাইনটা বারো বার বলেছো।’

তরী কোনো উত্তর দিল না। চায়ে বিস্কিট চুবিয়ে কচমচ করে খেতে লাগলো। নির্ঝর হঠাৎ চোখ খুলে বলল,

‘আমি বাসায় থাকলে তুমি ম্যাক্সিমাম সময় ‘আর্লি ম্যারেজ’ প্যারাগ্রাফ নিয়ে বসে থাকো কেন? নাকি আমায় বোঝাতে চাও যে আর্লি ম্যারেজ করে আমি গর্হিত অপরাধ করেছি? অথবা এটা ধরে নিবো যে একটা প্যারাগ্রাফ মুখস্ত করতে তোমার এক বছর লেগে যায়।’

তরী অসহায় চোখে নির্ঝরের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পর মিনমিন করে বলল,

‘এই প্যারাগ্রাফটা কেন জানি মুখস্থ হচ্ছে না। দু চার লাইন মুখস্থ করার পর আবার ভুলে যাই। কিছুতেই মনে থাকে না।’

‘ওটা আসবে না। বাদ দিয়ে দাও। মুখস্থ করতে হবে না। আমি ড্যাম সিউর ওটা আসবে না।’

‘কি করে বুঝলেন ওটা আসবে না?’

‘আরে যেটা তুমি পারবে না, সেটা আসবে না।এই নির্ঝর শাহরিয়ার বলে রাখলো। মিলিয়ে নিও!’

তরী হাল ছেড়ে দিল। এর সাথে বেহুদা কথা বলে শুধু সময় নষ্ট। সে চুপচাপ ইংরেজি রেখে অন্য বই বের করলো।

মিনিট বিশেক পর তরী নির্ঝরের দিকে তাকালো। নির্ঝরের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে। আবার ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। সে লেখা থামিয়ে হঠাৎ আগ্রহ নিয়ে বলল,

‘আমি ভালো রেজাল্ট করলে কি উপহার দিবেন আমায়?’

তরী ভেবেছিল নির্ঝর উত্তর দিবে না। কিন্তু নির্ঝর মুখ খুলল। ঘুমের ঘোরে কি না জানা নেই। নির্ঝর বন্ধ চোখে অস্পষ্ট সুর তুলে বলল,

‘কি উপহার চাই তোমার?’

তরী মুখটা একটু এগিয়ে নিল নির্ঝরের দিকে। ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘আপনাকে! নির্ঝর শাহরিয়ারকে।’

(চলবে)