বাবুই পাখি পর্ব-২০+২১

0
1209

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_২০
Writer-Afnan Lara
.
-‘রান্নার কাজটা আগেকারদিনে দু তিন ঘন্টা হতে না হতেই সম্পূর্ন হয়ে যেতো।আর এখন কিনা রান্না করেই যাচ্ছি করেই যাচ্ছি।গোসলে এক ঘন্টা সময় দিতে হবে।ঘেমে একেবারে একাকার হয়ে গেছি।আমি চাই না আমার এরকম চেহারায় ইমাদবাবু আমাকে দেখুক।
কাজ শেষ করেই দৌড় দিব বাথরুমের দিকে।১টা বেজে গেছে।উনার আসার কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।সুতরাং নিরিবিলি পরিবেশে রান্নাটা শেষ করি তারপর গোসলের কথা ভাবা যাবে।
কলিংবেল বাজার আওয়াজ আসলো।আবার কে এসেছে?”
.
ভাবতে ভাবতে পুতুল চুলার আঁচ কমিয়ে একেবারে নিচে নামিয়ে দিয়ে ওড়না ঠিক করতে করতে গিয়ে দরজা খুললো।ইমাদকে দেখে কলিজা মনে হয় ওলটপালট হয়ে গেছে তার।মুখে হাত দিয়ে ঘাম মুছে পুতুল ঐ জায়গা ছেড়ে পালিয়ে আসলো।ইমাদ চুপচাপ বাসায় ঢুকে বললো,”ওরকম পালাচ্ছেন কেন? আমি বাঘ না ভাল্লুক?মুখে কি হয়েছে আপনার?দেখি তো?”
.
-‘না দেখতে হবে না।আমার আসলে রান্নাটা কতদূর হলো গিয়ে দেখতে হবে।নাহলে পুড়ে যেতে পারে।আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।”
.
কথাটা বলেই পুতুল এক ছুটে চলে গেছে।
ইমাদ কিছুই বুঝলো না।হাতের ব্যাগটা ফ্লোরের উপর রেখে শার্টের হাতার দিকটায় থাকা দুটো বোতাম খুলে রুমের দিকে গেলো সে।
পুতুল ওড়না দিয়ে মুখ ডলতে ডলতে মনে হয় চামড়া উঠিয়ে ফেলেছে।ইমাদ আসছে কিনা সেটা দেখে ভেসিন থেকে পানি এক মগ মুখে ছিঁটিয়ে মেরে আবারও মুছলো।
তার ধারনা ঘাম দিকে তাকে কাজের বেটির মতন লাগে।আর সে একদমই চায় না কাজের বেটি লুকে ইমাদ তাকে দেখুক।এখন সে ইমাদের বউ।ইমেজ খারাপ করার কোনো মানে আছে?
কিন্তু সে তো জানে না তার চেহারা যেমনই হোক ইমাদ তাকে বিয়ে করে ফেলেছে অলরেডি।সুতরাং এত ভয় পাবার কিছুই নেই।
ইমাদ হালকা মুখ ধুয়ে গায়ের পোশাক পাল্টে নিয়ে বের হলো রুম থেকে।রান্নাঘরের দিকে একবার তাকিয়ে বললো,”এত গরম বাহিরে। যদি বৃষ্টি হতো তাহলে গরমের তাপটা কমতো একটু।আমি গরম সইতে পারি না।
ফ্রিজ ও নেই যে ঠাণ্ডা পানি খাব।”
.
পুতুল উঁকি মেরে বললো,”তমিজ আঙ্কেলের বাসা থেকে এনে দেবো?”
.
-‘নাহ।লাগবে না। আমি বরং সামনের দোকান থেকে আইসক্রিম কিনে আনি।কোন ফ্লেভার খান আপনি?”
.
-‘চকলেট’
.
-‘আচ্ছা!’
.
ইমাদ চলে গেছে।পুতুল চুলা অফ করে জামাকাপড় নিয়ে এক দৌড় দিলে গোসল করতে।
ইমাদ গেলো আর আসলো।অথচ পুতুল ভাবলো দশ/ পনেরো মিনিট লাগবে।গায়ে সাবান লাগিয়ে ফ্যানার বন্যা করার পর কলিংবেল বেজে উঠলো।পুতুল ভেবে পাচ্ছে না কি করবে।কোনো রকম জামাকাপড় পরে ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে দরজা খুললো সে।ইমাদ ওকে দেখে কপাল কুঁচকে নিজের আইসক্রিম মুখে দিয়ে আরেকটা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো,”কি হয়েছে আপনার?সারা গায়ে ফ্যানা কেন?”
.
-‘না মানে।আইস্ক্রিমটা খাচ্ছি।আপনি বসুন না।”
.
পুুতুল ছুটে চলে গেলো আবার।ইমাদ বোকার মতন তাকিয়ে থেকে গিয়ে বিছানার উপর বসেছে।নতুন তোষক, নতুন খাট।খাটে আবার নতুন রঙের গন্ধ।আইসক্রিম খেতে খেতে হেলান দিয়ে বসলো ইমাদ।
-‘পুতুলের হাবভাব কেমন এলোমেলো লাগছে।কি হয়েছে তার?জিজ্ঞেস করতে হবে।বাবা বলেছিল স্বামী -স্ত্রী একই আত্নার মতো।তাদের মধ্যে কোনো লুকোচুরি যেন না থাকে।সবসময় সব শেয়ার করে নিতে হবে।যদি একজনের হাবভাব অন্যরকম মনে হয় তাহলে তাকে একান্তে সময় দিয়ে তার মনের খবর জেনে নিতে হবে।এমনটা করলে কখনও মনমালিন্য হয় না।বাবা এই ভেবে আফসোস করেন যে তিনি কখনও এমনটা করতেন না বলেই তাদের বিচ্ছেদ হয়েছে।
পুতুল????’
.
পুতুল চুল মুচছিল আরেক রুমে।ছুটে এসে বললো,”বলুন”
.
-‘এখানে এসে বসেন।’
.
পুতুল কৌতুহলী চোখে তাকালো ইমাদের দিকে।তারপর পা টিপে টিপে খাটের অন্য কোণায় গিয়ে বসলো।ইমাদ তোয়ালেটা কেড়ে নিতেই পুতুল ঘুরে বসে বললো,’কি হয়েছে?”
.
-‘আপনার কি হয়েছে সেটা জানতে চাই।আমি যখন অফিস থেকে ফিরলাম তখন মুখ লুকিয়ে পালিয়ে গেলেন।পাঁচ মিনিটের জন্য দোকানে গিয়েছিলাম আপনি তাও গোসলে গেলেন।ফ্যানা নিয়ে আবার দরজাও খুললেন।সব এলোমেলো লাগছে।খোলসা করে বলুন।আমি আপনাকে নিয়ে পরিহাস করবো না”
.
পুতুল মাথাটা নিচু করে বললো,’অনেক কাজ ছিল বলে ঘেমে গিয়েছিলাম।আমি চাচ্ছিলাম না আপনি আমাকে ওরকম বাজে লুকে দেখুন…আর তাই…”
.
-‘থাক বলতে হবে না।বুঝলাম কি বলতে চাইছেন।বিয়ের পরে মেয়েরা বিয়ের আগেকার সময়ের মতন সাজে না কেন জানেন?”
.
-‘না’
.
-‘কারণ তারা যার জন্য সাজতো সে তার হয়ে গেছে।তাদের লিগালি বিয়ে হয়ে গেছে।তাহলে ওরকম আহামরি সাজলেও কি আর ন্যাচারাল থাকলেও কি।মানুষটা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না’
.
-‘কথা সেটা নয়।সব ছেলেরাই চায় তার ওয়াইফ পরিপাটি থাকুক।সুন্দর থাকুক।’
.
-‘সব ছেলেরা নয়।এই ধরুন কিছু ছেলেরা আগে চাইতো তার ওয়াইফ বিয়ের পরে চব্বিশ ঘন্টা পরিপাটি থাকবে।রুপের বৃষ্টি ঝরবে মুখ দিয়ে।কিন্তু এরপর তারা উপলব্ধি করে যে বউরা সংসার সামলিয়ে রুপ চর্চার সময়টুকু পেলেও সেই সময়টা স্বামীর পাশে বসে ব্যয় করে।এখন সে যদি প্রাপ্ত সময়টাতে তার সাথে ব্যয় না করে বসে বসে সাজতেই থাকে তাহলে ওতো সেজে আর লাভ কি হলো শুনি?
আমি ঠিক এটাই ভাবি।এবার বলুন,প্রতিদিন আমি অফিস থেকে ফিরলে মুখ লুকিয়ে বসে বসে সাজবেন নাকি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলবেন ভেতরে আসুন।’
.
পুতুলের মুখে হাসি ফুটলো।
-‘ভদ্র আর চুপচাপ ছেলেরা বুঝি মনের মধ্যে এত লজিক লুকিয়ে রাখে?তা জানা ছিল না।
ইমাদকে দেখে বুঝলাম তিনি আসলেই অসাধারণ একজন মানুষ।চিনতে দেরি করলাম।কিন্তু এই দেরিতে লস হলো না।বিয়েটা হয়েই গেলো তার সাথে।আমার খুশি লাগছে এই ভেবে যে এমন চিন্তাধারার একজন মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি।”
.
-‘কি ভাবছেন এতো?দুপুরের ভাতটা পাবো নাকি ভাত সার্ভের আগে মুখে ফেয়ার এন্ড লাভলি লাগাবেন?’
.
-‘নাহ কিছু দিব না মুখে।হাত ধুয়ে এসে বসুন।খাবার এখানে আনছি।’
.
পুতুল তোয়ালেটা ইমাদের হাত থেকে নিয়ে চলে গেলো।ইমাদ মুচকি হাসি দিয়ে বললো,’থ্যাংকস বাবা!তোমার আইডিয়াটা কাজে লাগিয়ে একটা মানুষের মিষ্টি হাসি দেখতে পেলাম।তার লজ্জিত মুখটা দেখলাম।এতক্ষণ বিষাদময় থাকা মুখটা এখন লজ্জার ঢেউয়ে লাল হয়ে গেছে।’
.
দুপুরের খাবারটা খেয়ে পুতুল বিছানার এক কোনায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
-‘তার ঘুমের কারণ হলো ঝুম বৃষ্টি।এত গরমে যখন অতীষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিলাম ঠিক সেমসয়ে আল্লাহর রহমতে প্রশান্তির বৃষ্টি ঝরা শুরু হলো।কি শান্তি বলে বোঝানো যাবে না।পুতুলকে দেখে মনে হয় শীত করছে ওর।বিছানা আছে, বালিশ আছে।গায়ে দেওয়ার চাদর নেই।আমি নিরুপায়।তার শীত নিবারণের জন্য কিছুই করতে পারছি না।
অনেক খুঁজে তার জামার সঙ্গের সবুজ ওড়নাটা এনে তার গায়ে জড়িয়ে দিলাম।এই ফাঁকা বাসাটায় যত কিছু নেই তার সবকিছুই অনেক জরুরি।এত জরুরি যে না আনলেই নয়।কিন্তু এতসব আনতে হলে ব্যাংক লোন লাগবে।ভালো বুদ্ধি।আমি তো লোন নিতে পারি।যা যা দরকার সব এখনই দরকার।
তাহলে মাস শেষে বেতনের অপেক্ষা করে বসে আছি কেন?পুতুল উঠুক।
উনাকে নিয়ে বিকালে ব্যাংকে যাব।ইনশাল্লাহ সব হয়ে যাবে।
মেয়েটা এবার কাঁপছে।শীত আসলেই অনেক।আমার রুমটার বিছানা একেবারে বারান্দার সাথে এটাচড্।বারান্দায় কোনো গ্লাস নেই।ঠাণ্ডা বাতাস তো ঢুকছেই সাথে করে বৃষ্টির পানির ছিঁটাও আসছে।আরেকজন এরকম পরিস্থিতিতে কেঁপে কেঁপে ঘুমাচ্ছেন।এসময়ে আমার কি করার??ঘুম থেকে উঠালে ঝাড়ি দিবে,রাগ করবে,চোখ বড় করবে।
কথা শেষ হতে না হতেই দেখলাম মহারাণী চোখ ডলতে ডলতে উঠে পড়েছেন।আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো আমি কেন কাঁথা জড়িয়ে দেইনি।
আমি বেকুবের মতন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম,”বসার চেয়ার নাই সেই কাপলের আবার কাঁথা!!খাট ও অন্যের টাকার”
ব্যস কি বললাম আমি কে জানে।তিনি এমন রাগ করলেন এমন রাগ করলেন।বালিশ নিয়ে চলে গেলেন অন্যরুমে।বাবার ভাগ্য মনে হয় আমি পেয়েছি।আমার এই বউকে নিয়ে রসাতলে যেতে হবে।কি না কি বলছি তাতে রাগ দেখানোর কি আছে।অবশ্য আমার দোষ আছে মনে হয়।কারণ বাবা বলেছিল বউ ঘুম থেকে উঠার পর ভালোমন্দ কিছু বলতে যাস না।হিতের বিপরীত হয়ে যাবে।এখন মনে হয় সেটা হয়েছে।এত সুন্দর বিছানা রেখে কিনা ঐ রুমে ফ্লোরে ঘুমাতে গেলো?
পুতুল???
পুতুল ফ্লোরে গাপটি মেরে বসে আছে।এত শীতে তার ঠাণ্ডা ফ্লোরে ঘুম আসবে না তা ভালো করে জানা আছে তার এবং আমার।তাই সে এখন চুপ করে গাল ফুলিয়ে বসে আছে।চা খাবেন?’
.
-‘আপনার মাথা খাবো দিন’
.
-‘নাহ।আমার মাথার স্বাদ নেই।লবনাক্ত।খাবেন?হা করেন তো’
.
-‘ওয়াক!!!’
.
-‘ওমা।আপনি তো বললেন খাবেন।আমি তো সার্ভ করছিলাম’
.
-‘যান তো।গিয়ে চা বানান।মাথা আর খারাপ করবেন না আমার’
.
ইমাদ মুচকি হেসে চলে গেলো।পুতুল বালিশ নিয়ে আবার বিছানায় এসে বসেছে।হাঁটু ভাজ করে মাথা দেয়ালের সাথে লাগিয়ে বারান্দা দিয়ে মেঘলা আকাশ দেখছে সে।
এরকমই একটা দুপুর চেয়েছিল।
-‘মেঘলা আকাশ,হালকা বৃষ্টি,থেমে থেমে হাওয়া,সাথে চা তাও স্বামীর হাতে বানানো।দিনগুলো খুব সুখের হয়ে আসছে তাই না?এত ভালো স্বামীর সাথে রাগ করলাম কেন?
ওহ তখন ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল তাই হয়ত।সরি বলে দিব।আগে চা বানিয়ে আনুক।আমি বৃষ্টি দেখি বরং।’
.
-‘চা রেডি।আপনি চিনি কেমন খেতেন ভুলে গেছি।আমি এক চামচ আর আরেক চামচের বেশ অর্ধেক খাই তাই সেটাও আপনাকে দিলাম।নিন চুমুক দিয়ে বলুন ঠিক আছে কিনা।’
.
পুতুল ইমাদের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে বললো,”এই বারান্দায় একটা পর্দা লাগবে।এত আলোতে বিকালের ঘুম হবে না”
.
-‘সেটা আমিও ভেবে রেখেছি।’
.
কথাটা বলে ইমাদ পুতুলের পাশে বসলো ওর মতন দেয়ালে হেলান দিয়ে।পুতুল চায়ের কাপটা দুহাত দিয়ে চেপে ধরে ইমাদের দিকে তাকিয়ে সরি বললো ওকে।
ইমাদ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঠোঁটটা বাঁকালো।যেন সে মজা নিলো পুতুলের সরি বলাতে।পুতুল ব্রু কুঁচকে চা খাওয়ায় মন দিয়েছে আবার।
ইমাদ ফোনটা নিয়ে ফেসবুকের নিউজফিডে ঘোরাঘুরি করছে।পুতুল অনেকক্ষণ বাহিরে চেয়ে আবার ইমাদের দিকে তাকালো।ইমাদকে ব্যস্ত দেখে খালি চায়ের কাপটা বিছানায় রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো সে।গ্রিল মুঠো করে ধরে চোখ বন্ধ রাখলো এবার।
-‘বৃষ্টি এত শান্তি নিয়ে আসে কেন??মনটাকে সতেজ করে দেয় যেমনটা গাছের পাতাগুলোকে করে ঠিক তেমন।
এই বারান্দাটাতে দাঁড়িয়ে দূরের একটা লেক দেখা যায়।অবশ্য তার আগে এক দু তলার বাসা আছে কয়েকটা।তবে সেগুলো নিচে দেখা যায়।চোখের সামনে ফাঁকা।দূরে তাকালে লেক।’
চলবে””

বাবুই পাখি🌿
#পর্ব_২১
Writer-Afnan Lara
.
বৃষ্টির পরের সময় এটা।শান্ত,নিরিবিলি পরিবেশ।সতেজতা ছাড়িয়ে গেছে গাছ পেরিয়ে দালানেও।রিকশার চাকার ক্ষীণ আওয়াজে পুতুল মুগ্ধ হয়ে ঢাকার শহরের সুন্দর গলিটা দেখছে।ইমাদ তার পাশে বসে গুগল ঘেঁটে ভালো ব্যাংকের নাম খুঁজতে ব্যস্ত।যে ব্যাংক কম মুনাফা নিয়ে লোন দিবে সেখান থেকেই নেওয়া হবে লোন।সহজে খুঁজে পাওয়া মুশকিল বলে প্রায়ই রিকশায় উঠার পর থেকেই ইমাদের চোখ ফোনে আটকে আছে।
গোলাপি রঙের ওড়না দিয়ে পুতুল গা ঢাঁকছে।হুট করে বাতাস শুরু।
-‘জানি না আবার বৃষ্টি হবে কিনা।মাথার চুলগুলো গুটিগুটি ফোমের দানার চেয়েও দ্রুত উড়ছে।ঐ যে দুপুরে গোসলের সময় সাবান দিয়েছিলাম সে কারণে।চুল ধরবো নাকি ওড়না।তার চেয়ে বরং ওড়না দিয়ে চুল ঢেকে রাখাই শ্রেয়’
.
ওড়নাটাকে ঘুরিয়ে মাথায় পেঁচিয়ে পুতুল নড়েচড়ে বসলো এবার।একটা বাসা দেখলো পাঁচ তলার।তার মধ্যে একটা বারান্দাও নেই।বারান্দা না থাকলে ঐ বাসাটাকে নিরামিষ মনে হয়।গোলাপি রঙের লিপস্টিকের লেপ লাগানো ঠোঁটটাকে একত্রে বাঁকিয়ে ফেলেছে পুতুল।কারণ তার বাসায় বারান্দা আছে আর এখানে নেই এই ভেবে।ইমাদ অবশেষে একটা ব্যাংক পেয়ে গেলো।স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রিকশাচালককে বললো সেই ব্যাংকে যেতে।তারপর ফোনটাকে পকেটে ঢুকিয়ে এক গাল হাসি দিয়ে পুতুলের দিকে তাকালো সে।
পুতুল মাথা বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে সব বাসা- বাড়ি দেখছে।ইমাদ ওকে একটু ঠেলা দিয়ে বললো,’কি খাবেন আসার সময়?’
.
-‘আপনার যেটা ভালো লাগবে।’
.
-‘মামা আস্তে চালান।তাড়াহুড়ো নেই।’
.
পুতুল মাথাটা একটু তুলে ইমাদের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিত হাসি দিয়ে আবার মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়েছে।নীল জিন্স আর ক্রিম কালারের শার্টটাতে ইমাদকে আজ কি যে লাগছে তা পুতুলের দুশো বার তাকানোই বলে দেয়।ইমাদ খেয়াল করেনি।সে এতক্ষণ ফোন দেখছিল আর এখন আকাশ দেখছে।
-‘আচ্ছা মানুষ রিকশায় বসে আকাশ দেখে???আমি দেখি।মনে হয় আকাশ চলছে আর নয়ত আমি চলছি।মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যি আকাশ চলছে।আমি স্থির।আকাশ কি জোরে চলেছে,সাথে মেঘের প্রতিযোগিতা।”
.
পুতুল ইমাদের হাঁটুর উপর হাত রাখলো।ইচ্ছে করেই রেখেছে তারপর দু সেকেন্ডের মাঝামাঝিতে সরিয়ে নিয়ে বললো,”সরি।পড়ে যাচ্ছিলাম”
.
ইমাদ বাঁকা হাসি দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে বললো,’থাক মিথ্যে বলতে হবে না।পড়ে যাওয়া ধরলে খাঁমছে ধরতেন।ওরকম আলতো করে ধরতেন না’
.
পুতুল জিভে কামড় দিয়ে মুখটাকে লুকানোর চেষ্টা করছে।ইমাদ ঠিক হয়ে বসে বললো,”হাত সবসময় রাখতে পারেন।সমস্যা নেই”
.
-‘না আসলে সিনথিয়া আপুকে যে ঝাড়ি দিতেন তাতে আমার ভয় হয় না জানি আমাকে উষ্ঠা দিয়ে ফেলেই দেন’
.
-‘সিনথিয়া আর আপনার মধ্যে আকাশ- পাতাল তফাৎ।তাকে আমি পছন্দ করতাম না।তাই তার ছোঁয়া আমার একটুও ভাল্লাগতো না।কিন্তু আপনাকে আমি পছন্দ করে বিয়ে করেছি।’
.
-‘একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
.
-‘হুম বলুন ‘
.
-‘ভালোলাগা আর ভালোবাসা কি একই জিনিস?’
.
-‘নাহ।ভালো লাগা মানে পছন্দ হওয়া।মানে চুজ করা।অনেক কিছুর মধ্যে যেকোনো একটা।যেকোনো একটা তখন আপনার কাছে নতুন।এরপর যখন সেটা পুরাতন হবে তারপরেও শতগুলোর মাঝে আপনার কাছে যদি ঐ একটাই ভালো লাগে তাহলে সেটা ভালোবাসা হবে।মানে আপনি ভালোবেসে ফেলেছেন সেটাকে।’
.
পুতুল চোখ জোড়া উল্টেপাল্টে চেয়ে রইলো চুপচাপ।ইমাদ মুচকি হেসে বললো,”বুঝেননি।বুঝবেনও না।আপনি বাচ্চা মেয়ে।এসব বুঝতে ম্যাচিউরিটি লাগে।যেটা আপনার নাই।যেদিন হবে সেদিন এই প্রশ্ন নিয়ে আবার হাজির হবেন”
—–
ব্যাংক এসে গেছে।ইমাদ আর পুতুল রিকশা থেকে নেমে গেলো ব্যাংকের ভেতর।সই,ডিল সব শেষ করে লোন ওকে করে তারা অবশেষে বের হলো।পুতুল বললো সে কিছু খাবে না।
ইমাদ জোর করলো একটা কিছু খেতে তাও সে বললো খাবে না।মন খারাপ না।কারণ মন খারাপ হওয়ার কিছু ঘটেনি।মন নয় বরং শরীর খারাপ।গায়ে জ্বর।তারা কেউই জানে না সেটা।পুতুল রিকশাতে বসে মুখটা গম্ভীর করে বললো,”একবার বাবার বাসায় যাবো”
.
ইমাদ মাথা নাড়িয়ে সাঁই দিলো।বাসায় পৌঁছানোর পর ইমাদ আবার গেছে একটু ঘুরতে।রিজবি আর চঞ্চলের সাথে।পুতুল সোজা গিয়ে শুয়ে পড়েছে বিছানার উপরে।চোখ মেলার শক্তি আর ইচ্ছে দুটোই নেই।ঘুম আসছে চোখ জুড়ে।বালিশের সাথে ইমাদের গায়ের সেই ক্রিম কালারের শার্টটা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে।সেটা পাল্টে অন্য শার্ট পরে গেছে সে।
পুতুল শার্টটা ধরে কাছে টেনে ফিসফিস করে বললো,”ভালো মানুষের শার্ট কাছে থাকলে শরীরের ক্লান্তি চলে যায়”
——-
-‘পুতুল ভাবী কেমন??মানে তোর কেমন লাগে ওরে?’
.
-‘ভালোই।অবুঝ কিছুটা!
সব কিছুর সংজ্ঞা তাকে দিতে হয়।তা নাহলে ভুল বুঝে বসে থাকে।’
.
-‘কেয়ার করে তোর?নাকি সিনথিয়া ভাবীর মতন গায়ে পড়া স্বভাব?’
.
ইমাদ মুচকি হাসলো তারপর রিজবির দিকে ঘুরে বসে বললো,”গায়ে পড়া স্বভাব হলেও আমার সমস্যা নেই।বিয়ে করা বউ আমার গায়ে পড়বে না তো কার গায়ে পড়বে?এমনিতে কেয়ার করে ভালোই।না চাইতেই সামনে নিয়ে আসে।তবে কিছু আমিও করি।বিয়ের দুদিন হলো সবে।এইটুকুতে এইটুকুই বুঝলাম।তবে মেয়ে খারাপ না।সবার কথা ভাবে।সাথে নিজের কথাও ভাবে’
.
কথাটা বলে সবাই একসাথে হেসে ফেললো
চঞ্চল চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,”তার মানে বউ পেয়েছিস ষোলআনা?”
.
-‘তা বটে।’
.
-‘শ্বশুর বাড়ি কেমন তোর?’
.
-‘সেটার কথা আর কি বলবো।আম, কাঁঠাল, লিচুতে ভরপুর।এত ভালো তারা যে মাসকাবারি হিসেবে এসব কিছুর দানাও দিবে না।কি আর বলি খোসাও দেবে না’
.
-‘কিপটা নাকি অন্য কারণ আছে?’
.
-‘কিপটা না।অনেক বড়লোক।কথা হলো পুতুল একবার পালিয়েছে তার পর থেকে সব ব্যাঁকা হয়ে গেছে।জানিস তো বাবারা তাদের মেয়েকে অনেক বেশি ভালোবাসে।কিন্তু সেই নরম মনের মানুষটা শক্ত হয়ে যায় তখন যখন তার ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে মেয়ে আরেকদিকে পালিয়ে যায়।তার এত বছরের ভালোবাসাকে তোয়াক্কা না দিয়েই। এই ভেবে তিনি ভালোবাসাটা নির্দিষ্ট করে ফেলেন।’
.
-‘ঠিক বলেছিস।এমন ব্যাঁকা হয় যে বছর খানেক লাগে সোজা হতে’
.
-‘তবে আমার মনে হয় পুতুল আমাকে পেয়েই খুশি।আমার দিকে কারণ ছাড়াই তাকিয়ে থাকে।আমাকে ইচ্ছে করে ছুঁয়ে না জানার ভাব ধরে।আমি রুমে শার্ট চেঞ্জ করতে আসলে দূর থেকে দেখে আবার মুখ লুকায় আবার দেখে তারপর আবার মুখ লুকায়।এমন করে পুরোটা দেখে।মানে সে তার মনের সাথে যুদ্ধ করে।মন বলে,’তুই দেখেছিস?’সে বলে,’ দেখি নাই।’তারপর আবার দেখে লুকিয়ে ফেলে মুখটা।মন বলে,’ আবার দেখেছিস।’সে বলে,’না দেখি নাই'”
.
-‘পুতুলকে অনেক কাছ থেকে বুঝে গেছিস তাই না?’
.
-‘মানুষকে বুঝতে কটাদিন এনাফ না।কিছু কিছু মানুষকে বুঝতে সারাটা জীবন লেগে যায়,আর আমি তো পুতুলের সাথে কটাদিন হলাম আছি।’
.
-‘একটা কথা বল।তোর মায়ের অবাধ্য ছেলে তো তুই না।তাহলে সেদিন এতবড় ডিসিশান নিলি কি করে?মানে আমার না এখনও বিশ্বাস হয় না।’
.
-‘জানি না কি করে।তবে ভেবে দেখলাম আমার অবাধ্যতা যদি একটা মেয়ের সারা জীবনের কান্নাকে থামিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখতে পারে তাহলে আমার অবাধ্য হওয়া ঠিক।’
.
-‘পুতুল কি তোকে পছন্দ করত?মানে তুই জানতি কি করে যে সে তোকে স্বামী হিসেবে পেলেও কাঁদবে না?’
.
-‘কারণ আমি দেখেছি সিনথিয়ার সাথে কথা বলার সময় সে মন খারাপ করত।রাগ দেখাতো।আকাল মান কে লিয়ে ইশারাই কাফি হে!’
.
-‘বাহহ!!তবে আরেকটা জিনিস বুঝলাম না।আন্টি তোরে বের করে দিয়ে এবার এক এক করে তোর জামাকাপড়, বিছানা,হাঁড়ি, পাতিল,দা, বটি এসব পাঠাচ্ছে কেন?সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে’
.
-‘আমারও।তবে পুতুল যা বললো হাসতে হাসতে মরে যাবি শুনলে।পুতুল বললো মা নাকি রাগ দেখিয়ে কেয়ার করতে চান’
.
-‘হাহাহা!!তোদের মেনে নিলেই হয়’
.
-‘সেটা এত জলদি করবে না।মাকে চিনি আমি। কাল হয়ত ফ্রিজ নিয়ে হাজির হবে।রাগ দেখাতে গিয়ে আমার সংসার সাজিয়ে দিচ্ছে।মা রা বুঝি এমনটা হয়?এবার আসলে জোর করে রেখে দেবো।’
.
-‘তোর মায়ের সাথে জোর করবি?বাপরে বাপ!তোর এত সাহস আছে?’
.
ইমাদ কলার ঠিক করে হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো।এরপর চোখ বড় করে বললো,”দশটা বাজতে দু মিনিট বাকি!
আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।পুতুল একা সেখানে।এতক্ষন কথা বললাম।ইশ!! এবার আমাকে ঝাড়ি দিবে”
.
-‘ওকে আবার দেখা হবে।এখন তো আপনি বিবাহিত। আগে রাত জেগে আড্ডা দিতেন আর এখন দু ঘন্টা পূর্ন হতে না হতেই আপনার তাড়া এসে গেছে।ভালো তো’
.
-‘এটার উত্তর পরে দেবো।এখন আমায় যেতে হবে।বাই’
——–
ইমাদ কলিংবেলে চাপ দিয়ে রেডি হচ্ছে সরি বলার জন্য।বেশ অনেকবার কলিংবেল বাজার পরেও পুতুল দরজা খুললো না দেখে চাবি দিয়েই খুললো ইমাদ।
সোজা নিজের রুমে এসে দেখলো পুতুল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
ইমাদ সব রুমে আলো জ্বালিয়ে এসে পুতুলকে দু তিনবার ডাক দিলো। পুতুল চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো এবার।
ইমাদ কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’এতবার ডাকলাম শুনলেন না।শরীর খারাপ নাকি?’
.
পুতুল মাথা নাড়িয়ে না জানালো।ইমাদ কি যেন ভেবে এগিয়ে এসে ওর কপাল ছুঁয়ে ব্রু কুঁচকে বললো,”আপনার তো অনেক জ্বর।খেয়েছেন? ”
.
-‘উহু’
.
-‘চলুন খাবেন।’
.
-‘খিধে নেই।’
.
-‘আচ্ছা আমি খাইয়ে দেবো।বসে থাকুন।খাবার আনতেছি।’
.
ইমাদ চলে গেছে।পুতুলের মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। -‘জ্বর হলে মা ও এরকম খাবার খাইয়ে দেওয়ার কথা বলতো।মাকে খুব মনে পড়ছে।একটিবার তার কোলে মাথা রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে’
.
-‘খাবার এসে গেছে।চুপচাপ পুরোটা খাবেন তারপর ঔষুধ।’
.
ইমাদ লোকমা বানিয়ে মুখের সামনে তুলে ধরতেই পুতুল ওর হাতটা জড়িয়ে ধরে মাথা ঠেকিয়ে ধরে বললো,”মায়ের কথা মনে আসছে আমার।”
.
-‘অসুখ হলে সবারই তার মায়ের কথা মনে আসে।ভাতটা খেয়ে নিন। আমি ভিডিও কলে আন্টির সঙ্গে আপনার কথা বলিয়ে দেবো।আপনার এখন ওষুধ খাওয়াটা জরুরি’
.
পুতুল মাথা সরাচ্ছে না ইমাদের ঘাঁড় থেকে।ইমাদ চুপ করে বসে আছে।পুতুল মিনিট পাঁচেক পর সরে বসলো।ইমাদ ওকে পুরোটা খাওয়াতে না পারলেও ঔষুধ খাওয়ার মতন পর্যাপ্ত খাবার খাওয়ালো।তারপর ঔষুধ খাইয়ে দিয়ে ফোন নিয়ে পুতুলের মায়ের নাম্বারে ফোন করে উনার ইমো নাম্বার জেনে নিয়েছে।তারপর ভিডিও কল দিয়ে পুতুলের সামনে ফোনটা রাখলো সে।
পুতুল মায়ের সাথে অনেকক্ষণ কথা বললো।ইমাদ এসময়ে গিয়ে খাবার খেয়ে নিয়েছে।
সব রুমের লাইট অফ করে রুমে এসে সে দেখলো পুতুল ফোন রেখে কাত হয়ে শুয়ে আছে।ইমাদ এই রুমের আলো নিভিয়ে ওর পাশে এসে বসলো তারপর আস্তে করে বললো,”বেশি খারাপ লাগছে?”
.
-‘উহু’
.
ইমাদ এবার সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো।পুতুলের জোরে জোরে শ্বাসনিশ্বাস টানার আওয়াজ পাচ্ছে সে।দু মিনিট চুপ থেকে পুতুলের হাতটা ধরলো ইমাদ।
চলবে””