#সম্পর্কের__দেয়াল
#Writer_AnaHita_Ayat_SumaiYa
#পর্ব__২১
ডাক্তারের কথা শুনে দুজনের মাথায় যেনো বাজ পড়লো। পাভেলে মা দাঁড়িয়ে যায়। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
‘না না পাভেলের কিছু হতে পারে না। প্লিজ ডাক্তার আপনারা ভালো করে দেখুন’
ডাক্তার ও নিরুপায় তিনি ই বা আর কি করবেন? চেষ্টা করার তো আর কোনো বাকি রাখেন নি তাও যেই ফলাফল আসলো তা তো তিনি বলেই দিয়েছেন। অবশ্য আগে হোক বা পরে এটা তো বলে দিতেই হতো। সব আশা বিফলে গেলো। অনেক কান্নাকাটি করেও শেষে সব আশা শেষ হয়ে যায়। পাভেলের মায়ের আহাজারি তে ডাক্তার রা শেষে একটা পা ভালো করার আশা দেখতে পান। ফলাফল এখন একটা পা কেটে ফেলতে হবে আরেক টা পা থাকবে। কিন্তু এটা করার জন্য ও অনেক টাকার প্রয়োজন। দ্বিতীয় বারের মতো ডাক্তারের সাথে কথা বলতে নেয় উনারা দুজন। ডাক্তার বলেন,
‘দেখুন আমরা অনেক চেষ্টা করে একটা পা ঠিক করতে পারবো আর একটা কেটে ফেলতে হবে মাস্ট কিন্তু…
‘কিন্তু কি ডাক্তার?’
‘এটা করতে গেলেও প্রায় দুই লক্ষ টাকার দরকার!’
টাকার অংক টা একটা মানুষের জীবন থেকে বেশি হয়ে গিয়েছিলো। কেননা যে মানুষ টা বেকার জীবনযাপন করছিলো তার কাছে দুই টাকা ও যখন নেই তখন দুই লক্ষ টাকা তো অনেক দূরের ব্যাপার। এতো টাকার কথা শুনে পাভেলের মা কান্না শুরু করেন। রিমি ও কি করবে বুঝতে পারছে না। তার কাছে ছিলোই বিশ হাজার টাকা যা সে খরচ করে ফেলেছি। এখন এতো টাকা কোথায় পাবে সে? তার উপর দিশা ও অসুস্থ ওর কাছে গিয়ে তো আর টাকা চাওয়া যাবে না। রিমি মাথার হাত দিয়ে বসে বসে পড়ে।
ডাক্তারের কাজ থাকায় তিনি অন্য পেশেন্টের কাছে চলে যান। আর এনাদের বলেন ভেবে টাকা ম্যানেজ হলে জানাতে। ডাক্তার চলে গেলে পাভেলের মা বললেন,
‘এখন কি হবে এতো টাকা আমরা কোথায় কিভাবে পাবো!’
এই কথার কোনো উত্তর মিললো না। তাই তিনি ফের বললেন,
‘আমি আগেই বলেছিলাম তুই একটা অপায়া অলক্ষ্মী মেয়ে। তোর জন্য ই আজ আমার ছেলের এমন হয়েছে!’
পাভেলের মা বারবার ঘুরে ফিরে রিমির উপর দোষ চাপাচ্ছে দেখে রিমি রেগে যায়। ক্রুদ্ধ হয়ে বললো,
‘পাভেল আপনার ছেলে হলে, আমার ও তো স্বামী। আপনি ওকে ভালোবাসেন, আমি তো ওকেই ভালোবাসি! তাহলে আমি কি ও’কে বলেছিলাম যাও এক্সিডেন্ট করো হ্যাঁ?’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। কি ই বা বলার বাকি আছে। মাথায় শুধু পাভেল কে নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে হঠাৎ করে কিভাবে এমন হয়ে যেতে পারে। কিছুক্ষণ ভেবে তিনি নিজেই রেগে বললেন,
‘তুই ই বাঁচাবি ওকে। তুই ই টাকা জোগাড় করবি…
‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ই সব করবো!’
এটা বলে রিমি ওখান থেকে ডাক্তারের কাছে যায় আর বলে,
‘টাকার ব্যবস্থা আমি করবো আপনারা আপনাদের কাজ শুরু করে দিন!’
ডাক্তারা অনুমতি পেয়ে নিজেদের কাজ শুরু করে দেন। পাভেলের মা কে রিমি হাসপাতালেই বসিয়ে রেখে নিজেই কোনো অজানা গন্তব্যে রওয়ানা দেয়। তার যোগ্যতা অনুযায়ী কোন কোন কোম্পানি তে চাকরির ইন্টারভিউ চলছে তা জেনে নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে যায়। তার একটাই আশা যদি জব পেয়ে যায় তাহলে কোম্পানির থেকে দুই লাখ টাকা লোন নিয়ে নিবে পরে আস্তে আস্তে শোধ করবে এই তো!
রিমি ঘুরতে ঘুরতে ঐ কোম্পানির ইন্টারভিউ তেই যায় যেটা লিমনের ছিলো। সেদিনের রিমির সাথে রাস্তায় ধাক্কায় লাগা সেই লোকটির কোম্পানি অর্থাৎ লিমনের অফিসে আসে সে। লিমন তার ডেস্কে বসে ল্যাপটপে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছিলো। এমন সময় হঠাৎ করে সেদিনের সেই মুখ টা কে দেখতে পেয়ে লিমন মোটামুটি শক খায়। ঐ দিন ও যখন নিজের হুস ফিরে পায় তখন সামনে তাকিয়ে দেখেছিলো মেয়েটা আর নাই। পর পর বেশ কয়েক দিন ওখানে গিয়ে খুঁজেও সে এসেছে কিন্তু লাভ হয় নি। সেদিন একেবারেই গায়েব হয়ে গিয়েছিলো। আর না পেরে হতাশা হয়ে পড়েছিলো সে আর ভেবেছিলো আর কখনো দেখা মিলবে না। কিন্তু আজ এভাবে দেখে সে সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে যায়।
উৎসাহ উদ্দীপনা ধরে রাখতে না পেরে, ও পারছে না উড়ে চলে যাবে ইন্টারভিউ রুমের ভেতর। কিন্তু না কিছুক্ষণ থামলো। সব কিছু চেপে রেখে স্বস্তি তে বসা দায় হয়ে পড়লে ও সে জোড় করে বসে। আর দেখতে থাকে মেয়েটি কি করে। এর মাঝে নাম ধরে একজন ডাক্তার দেওয়ায় ও বুঝতে পারে পরীটার নাম রিমি। বাহ কি সুন্দর!
প্রচন্ড আপসেট থাকার কারণে ইন্টারভিউ ভালো করে দিতে পারলো না রিমি। পূর্বপ্রস্তুতি না থাকলে সব কিছু তো জিরো হবেই তাই না? রিমির ইন্টারভিউ দেখে সেই লোক গুলো সেখানেই বলে দেয় সে এই জবের উপযোগী না। রিমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
‘প্লিজ একটু বুঝোন। একটা চাকরি আমার খুব দরকার! দয়া করুণ একটু!’
‘আমরা কি দয়ার গোডাউন খুলে বসেছি নাকি!’
রিমি খুব ভেঙ্গে পড়ে বাহিরে বের হয়। জোড় পূর্বক অস্থির মন কে স্থির করে বসে থাকা লোকটি এবার উঠে দ্রুত পায়ে নিজের কেবিন থেকে বের হয়। ইন্টারভিউ টা ছিলো বসের পারসোনাল এ্যাসিসটেন্ট এর পদে। লিমন দৌড়ে গিয়ে একজন কর্মচারী কে পাঠায় রিমি কে আটকাতে এবং তার কেবিনে আসতে বলতে। ঐ লোকটির গিয়ে রিমি কে বলে,
‘আপনাকে আমাদের বস উনার কেবিনে যেতে বলেছেন। আপনার চাকরি নিয়ে কিছু কথা বলবেন?’
‘তার মানে আমার চাকরি টা কি হবে?’
‘হতেও পারে তবে আমাকে বলেন নি আপনি গিয়ে দেখুন! কেবিন টা ওদিকে!’
‘ধন্যবাদ আপনাকে!’
রিমি মনে মনে খুশি হয়ে আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকে। আর ধীর গতিতে নয় বরং দ্রুত গতিতে পা বাড়ায় বসের কেবিনের দিকে!
দরজায় সামনে এসে থামলো। ভেতরে ঢুকে কি ঢুকবে না ভাবতে থাকলো। আগে কখনো জব করে নি তাই নিয়ম কানুন ও জানে না। লিমন আর অপেক্ষা করতে না পেরে নিজেই বলে উঠলো,
‘মিস রিমি ভেতরে আসুন!’
কন্ঠ টা শুনে ও চিনতে পারে নি সে। মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকে যখন সামনে থাকা মানুষ টিকে দেখলো তখন একদম ভড়কে যায়। কি করবে না করবে মাথায় আসলো না।
লিমন অবশ্য সেদিনের মতো কিছুই করে নি। মৃদু কন্ঠে মুচকি হেসে বললো,
‘বসুন!’
ওর তো বসতে ও আর ইচ্ছা করছিলো না তবে আজকে ভদ্রতা বজায় রাখছে দেখে ও বসলো। আর তোতলিয়ে বললো,
‘আ্ আ্প আপনি?’
‘জ্বি! আমি এই কোম্পানির বস। আপনার চাকরি টা কেন জরুরি জানতে চাচ্ছি বলুন!’
রিমি কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে ঠিক ভাবে বসলো। যেহুতু সেদিনের মতো কিছু করছে তাহলে বসা ই যায়। সে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,
‘আসলে আমার স্বামী অসুস্থ।’
লিমন একটু ও চমকালো না। বরং নিজেকে কন্ট্রোল করে বললো,
‘কি হয়েছে উনার?’
‘আসলে আজ সকালেই ট্রাক এক্সিডেন্ট করে। ট্রাক টা উনার দু পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। উনার পায়ে প্রাকচার ধরা পড়েছে। ডাক্তার রা বলেছেন আমার স্বামীর চিকিৎসা করতে এখন দুই লাখ টাকা প্রয়োজন।’
কথাটা শুনে সামনে থাকা মানুষ টা গভীর ভাবে কিছু ভাবলো।
‘সময় কতোদিন দিয়েছে? আর এখন আপনার সেই টাকা প্রয়োজন?’
‘হ্যাঁ আমি ডাক্তার কে বলে এসেছি অপারেশন শুরু করতে। আমি যে করেই হোক জব ম্যানেজ করে টাকা জোগাড় করবো। তাই আমি ভাবছিলাম যদি আমি জব টা পেয়ে যাই তাহলে দুই লাখ টাকা লোন নিয়ে পরে আস্তে আস্তে শোধ করবো! আমার আসলে এই মুহূর্তে একটা চাকরি খুব দরকার!’
‘জব হয়েও গেলে কেউ আপনাকে কেন লোন দিবে যেখানে কিনা আপনি নতুন বলুননতো!’
রিমি মাথা নিচু করে বললো,
‘আমার সত্যি ই খুব দরকার। নিরুপায় হয়ে এসেছি। আর তাছাড়া আমি তো কোথাও পালিয়ে যাবো না তাই না?’
লিমন আরো গভীরে গিয়ে কিছু ভাবলো। এবং মন দিয়েই। মন বললো রিমি কে তার চাই ই চাই এবং য়া যেকোনো মূল্যে। স্বামী আছে তো কি হয়েছে ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিলেই তো হয়। তাই ও বললো,
‘আপনার জব টা হয়ে যাবে তবে শর্ত প্রযোজ্য!’
‘কি শর্ত?’
‘আপনি এই কোম্পানি তে দুই বছরের জন্য একেবারে ফিক্সড। অর্থাৎ দুই বছরের আগে আপনি এই চাকরি কোনো ভাবেই ছাড়তে পারবেন না। এই জন্য আপনাকে কন্টাক্ট পেপারে সিগনেচার করতে হবে। এই শর্তে রাজি থাকলে আপনাকে এই পেপারে সিগনেচার করুন!’
‘আমি যে কোনো শর্তে রাজি!’
লিমন কাগজ টা এগিয়ে দিলে রিমি দ্রুততার সঙ্গে সিগনেচার করে নেয়। এটা দেখে অপর জন বললো,
‘ওয়েল ডান। এই নিন আপনার জয়েনিং লেটার! আর আপনি লোন ও নিতে পারবেন এবং পরবর্তী তে আপনার সেলারি থেকে তা অল্প অল্প করে তা কেটে নেওয়া হবে!’
রিমির তো খুশি যেনো আর ধরে না।
‘থ্যাঙ্ক ইউ সার। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ্!’
দুই লাখ টাকা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জোগাড় করে ফেলতে দেখে পাভেলের মায়ের খুব সন্দেহ হয়। তবে এই মুহূর্তে ছেলের জীবন বাঁচানো জরুরি তাই তিনি কিছু ই বললেন না।
রিমির এই সামান্য কথা টা ও তখন মাথায় আসলো না যে, কেন একজন লোক তার এক কথাতেই এতো গুলো টাকা দিয়ে দিবেন। কেনই বা ইন্টারভিউ খারাপ হওয়া সত্ত্বেও চাকরি দিয়ে দিবেন! কোনো কেনই রিমির মাথায় আসলো না একবারের জন্যও! তার মনে শুধু পাভেল কে সুস্থ করে তোলার আকাঙ্ক্ষা ছাড়া আর কিছু নেই! আর অন্য মানুষ টার মাথায় ঘুরতে থাকলো রিমি কে নিজের করে কিভাবে নেওয়া যায় তার চিন্তা!
——————————
অপরদিকে রিধি গতকাল ইন্টারভিউ দিয়ে গেছে একটা কোম্পানি তে জব করার জন্য। তার পূর্বপ্রস্তুতি থাকায় ইন্টারভিউ খুব ভালো হয়। ফলে চাকরি টা পাকা হয়ে যায়। আজ তার চাকরি তে জয়েন করার প্রথম দিন। ঘুম থেকে উঠে ঝটপট রেডি হয়ে নেয় সে। তারপর বাবা মা কে সালাম করে বাড়ি থেকে বের হয়। একটা সিএনজি নিয়ে সোজা কর্মস্থলে চলে যায়। পেছনের সব কিছু ভুলে নতুন একটা জীবনে পা দিয়েছে সে। আর কোনো পিছুটান রাখতে চায় না বলেই গতকাল ই সব স্মৃতি কবর দিয়ে ফেলেছে নিজেই নিজের মধ্যে। আর কখনো এসব নিতে ভাববে না বলেই নিজেই নিজের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা বন্ধ হয়। খুব সুন্দর পরিপাটি আর হাসি খুশি এক নতুন রিধি হয়ে অফিসে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে পা রাখে সে।
নতুন হওয়ায় একজন সিনিয়র আপি তাকে সবার সাথে একে একে পরিচয় করিয়ে দেয়। আর একজন এসে তাকে দেখিয়ে দেয় নিজের ডেস্ক টা। সবার সাথে কথা বলে মন টা ফ্রেশ হয়ে যায়। তার পাশাপাশি ও একটা জিনিস বুঝতে পারে যে, এই অফিসের সব ইমপ্লয় খুব মিশুক। বন্ধুর মতো যেনো একটা পরিবার। বস প্রবেশ করলে সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
রিধি নতুন হওয়ায় নিজের কাজ বুঝতে পারছিলো না তাই অপেক্ষা করছিলো বসের ডাক পড়ার জন্য। কিছুক্ষণ পর একজন লোক এসে বললো,
‘রিধি আপনাকে বস তার রুমে যেতে বলেছেন!’
‘জ্বি আচ্ছা!’
রিধির ও প্রথম বার হওয়ায় একটু নার্ভাস সে। বসের কেবিনের সামনে এসে বললো,
‘ম্যা আই কামিং স্যার?’
ভেতর থেকে উত্তর আসলো,
‘ইয়েস কামিং!’
রিধি ভেতরে ঢুকে ঠিকই তবে তার সামনে বসের আসনে বসে থাকা মানুষ টা কে দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। ঐ ব্যক্তিটির চাহনি দেখে বুঝে যাচ্ছে তিনি ও তাকে দেখার জন্য আগে থেকে প্রস্তুত ছিলেন না! অপ্রস্তুত থেকে দুটি চেনা হয়ে ও অচেনা মানুষ কে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন প্রকৃতি….!
চলবে______________