যদি তুমি চাও পর্ব-০১

0
1538

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা

১.
মিসেস রুবি খান অনবরত কল দিয়েই যাচ্ছে মেয়ে অন্তরা খানকে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আজকে সে ফোন রিসিভই করছে না। মেয়ে তার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে। এতো বড়ো হয়ে গেছে তবুও মায়ের ফোন আসলে রিসিভ তাকে করতেই হবে এতে সে যেখানেই থাক না কেনো। এমনও হয়েছে রুবি মেয়েকে কল দিয়েছে মেয়ে রিসিভ করে বলেছে, “আম্মু পরে ব্যাক করছি আমি এখন ক্লাসে।” এইভাবে কথা বলতে গিয়ে বেশ কয়েকবার তাকে পানিশও করা হয়েছে তবুও মায়ের ফোন তাকে রিসিভ করতেই হবে। রুবি অনেক বুঝিয়ে ও পারেননি। কিছু বলতে গেলেই বলে, “উফফ আম্মু এসব বলো না তো। তুমি আমায় জরুরী কোনো কাজ ছাড়া তো কল দেও না আম্মু। তবে আমি কী করে রিসিভ না করে থাকি বলতে পারো?” মেয়ের এমন উত্তরে রুবি কিছু বলতে পারেন না। এই মেয়েটাই তো আছে যে তার এতোটা চিন্তা করে। নইলে ছেলেকে তো চাইলে কাছেই পাওয়া যায় না।

এক নাগাড়ে কল করতে করতে একসময় ফোন বন্ধ পেয়ে রুবি আরও চিন্তায় পড়ে যান। কী করবেন ভেবে পান না তিনি। এমন সময় তার পাশ থেকে তারই পার্সোনাল সেক্রেটারি বলে ওঠে,
-ম্যাম আপনি একবার পুলিশের সাহায্য নিন যদি কোনো খোঁজ পাওয়া যায়।
-সেটা ঠিক হবে না মিস আফসানা। আমাকে সবকিছু ভেবে পদক্ষেপ নিতে হবে। পুলিশে গেলে যদি আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়! আমি এমন রিস্ক নিতে পারবো না।
-তার মানে কী আপনার মনে হচ্ছে অন্তরা ম্যামকে কেউ অপহরণ করেছে?
-এখন অন্তত তাই মনে হচ্ছে। আচ্ছা তোমায় যে বলেছিলাম নিহালের সাথে কন্ট্যাক্ট করতে; করেছিলে তুমি?
-ইয়েস ম্যাম। তার ফোন বন্ধ বলছে।
-তবে এতক্ষণ বলোনি কেনো আমায়?
হুংকার দিয়ে ওঠেন রুবি। আফসানা ঘাবড়ে যায় তারপর বলে,
-ম্যাম আপনি অন্তরা ম্যামকে ফোনে চেষ্টা করছিলেন আর বলেছিলেন আপনি না বলা অবধি যেনো কোনো কথা না বলি তাই…
-তাই তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিলে তাই তো!
-ভুল হয়ে গেছে ম্যাম।
-এখন দাঁড়িয়ে না থেকে রাফিদ’কে কল দাও।
রাফিদ রুবির ছেলে, অন্তরার ছোট ভাই। আফসানা ফোনটা বের করে কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে রাফিদের নাম্বার খুঁজতে ব্যস্ত। রুবি রেগে গিয়ে বলেন,
-একটা নাম্বার বের করতে এতো সময় লাগে তোমার!
-মাফ করবেন ম্যাম আসলে রাফিদ স্যারের সাথে আমার কন্ট্যাক্ট নেই তাই কললিস্টে নাম্বার নেই। কনট্যাক্ট লিস্ট খুঁজে বের করছি ম্যাম।
-সার্চ অফশন নেই?
-আছে ম্যাম, আসলে তাড়াহুড়োয় ভুলে গেছি। এখনি বের করছি ম্যাম।
-রাখো আর প্রয়োজন নেই।
কথাটা বলেই রুবি নিজের ফোনটা কানে ধরেন। আফসানার সাথে কথা বলতে বলতেই তিনি রাফিদের নম্বর ডায়াল করে ফেলেছেন। কানে ধরার পরে রিং হলো তিনটে তারপর ওপাশ থেকে শোনা গেল ব্যস্ত আছে নাম্বার। মানে এই ছেলে কল কেটে দিয়েছে। রুবি ফোন সোফার উপর ছুঁড়ে রাখেন তারপর দাঁতে দাঁত পিষে বলেন,
-একটা কেউ কাজের নয়।
তিনি ঠিক করেন অনেক হয়েছে এবার নিজেকেই যেতে হবে। তারপর যেই এগোন রাফিদকে দেখা যায় মিররের ওপারে। সে মাত্রই মেইন গেইট ক্রস করলো। রুবি আফসানাকে গেইট খুলতে বলেন। আফসানা গেটের দিকে তাকিয়ে বলে,
-খোলাই আছে ম্যাম।
রুবি একবার গেটের দিকে তাকান তারপর ছোট্ট করে বলেন,
-ওহ!
রাফিদ এসে বাড়িতে ঢোকা মাত্রই রুবির প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। সে উত্তর দিতে শুরু করে,
-মা আমি কল কেটেছি কারণ বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর অন্তি আজ ভার্সিটি গেলেও ভেতরে প্রবেশ করেনি। সে বাইরে থেকে নিহালের বাইকে উঠে তার সাথে চলে যায়। আর তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর, নিহাল এই মুহুর্তে আই সি ইউ তে এডমিড আছে। তার জ্ঞান ফেরেনি এখনো। তাই তার সাথে কথা বলে অন্তির খবর পাওয়া যাবে বলে আশা না রাখাই ভালো। তবুও তুমি যদি নিহালের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করতে চাও করতে পারো। আমি চললাম নিজের মতো করে আমার বোনকে খুঁজে বের করতে।
রাফিদ বেরিয়েই যাচ্ছিলো তখন রুবি তাকে আটকান এবং প্রশ্ন করেন,
-তুই এতোটা সিওর হচ্ছিস কী করে যে অন্তি নিহালের সাথেই গেছে?
-অন্তির ফ্রেন্ড আছে না, কী যেনো নাম? আরে মনে পড়ছে না। একটাই তো ফ্রেন্ড ওর কিন্তু এই মুহুর্তে নামটা মনে পড়ছে না।
-ছায়া?
-হ্যা, ছায়া।
-ওর সাথে কথা হয়েছে তোর?
-হ্যা ওই তুমি বললে তো আমি সাথে সাথে ভার্সিটি গেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তখনই ও বেরিয়ে আসছিল সেটা দেখেই ওকে আটকেছিলাম। তারপর ওই বললো, ও অনেক করে বারণ করেছিল অন্তিকে যেতে কিন্তু তাও শোনেনি।
-ওহ। তোর কী মনে হয় মেয়েটিকে আরও কিছুক্ষণ প্রশ্ন করলে আরও কিছু ইনফরমেশন পাওয়া যেতো কি-না?
-তেমন মনে হলে তো আমি ওকে উঠিয়েই আনতাম মা।
-এখন দেখছি পুলিশের হেল্প নিতেই হবে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে কথাটা বলেন রুবি। আর কোনো পথ নেই এখন পুলিশ ছাড়া কেউই সাহায্য করতে পারবে না।

এই মুহুর্তে রুবির হাতে অন্তির কললিস্টের ডিটেইলস রয়েছে। সবগুলো নম্বরের মাঝে একটা নম্বর সন্দেহ জনক। অনেকবার কল এসেছে এই নম্বর থেকে তবে অন্তি রিসিভ করেনি। এরপর প্রায় দু’ঘণ্টার গ্যাপ তারপর রুবির নম্বর আছে। সন্দেহজনক নম্বরটি রুবির চেনা। এই নম্বরের মালিক ‘বখতিয়ারুজ্জামান’। এ এমন এক ব্যক্তি যে রুবির ক্ষতি করার জন্য যে কোনো অবস্থানে যেতে পার। রুবির সন্দেহ হয় তবে কিছু বলেন না সামনে বসে থাকা ‘এস পি হাসান’কে। এস পি হাসান রুবির বেশ বিশ্বস্ত একজন অফিসার। যে কোনো প্রয়োজনে তাকে পাওয়া যায়। আর যেহেতু এখানে অন্তি জড়িত সেহেতু রুবি বিষয়টা পাবলিক করতে চান না বলেই এই একজনের সাথেই যোগাযোগ করা ঠিক মনে করেন। রুবিকে নম্বরটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে এসপি হাসান সকলের অগোচরে নম্বরের মালিকের খোঁজ নেন। তারপর বলেন,
-ম্যাম কী তাকে সন্দেহ করছেন?
-কাকে?
-লাস্ট থেকে দু নম্বরে যেই নম্বরটা দেখা যাচ্ছে তার মালিককে।
-কী সব বলছেন?
-উনি তো আপনার….
-নিজের কাজ করুন। আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করার প্রয়োজন আপনার নেই।
-আমি তবে অন্তরা ম্যাডামের শেষ লোকেশন খোঁজার চেষ্টা করছি আপনি বরং ওই ছেলেটা কী যেনো নাম… হ্যা, নিহাল। ওর চোখ মেলে তাকানোর প্রতিক্ষা করুন। আর একবার সে জাগলেই আমাকে খবর দেবেন। তার বয়ান পেলে তদন্তে সুবিধা হবে। তার আগে যদি আপনার মেয়ের খোঁজ পেয়ে যাই তবে তো হলোই।

রুবি নিজের কালো রঙের গাড়ির ব্যাক সীটে বসে আছেন। তার সামনে একটা বাড়ি আর সেই বাড়ির মূখ্য দারে এক বিশেষ পাথরে খচিত একটা নাম জ্বলজ্বল করছে। ‘মেঘকুঞ্জ’ এই বাড়ির নাম। বেশ শৌখিন ছিলেন রুবির শাশুড়ী মা আর তারই করা ডিজাইন অনুযায়ী এই বাড়ির নির্মান করা হয়। রুবি খুব পছন্দের একটি জায়গা এটি তবে এখন এখান থেকে দূরে থাকারই চেষ্টা করেন। এই বাড়ির উপর এখন তার কোনো অধীকার নেই।

অন্ধকার এক ঘর। সেখান থেকে বাইরের কিছু উপলব্ধি করা যায় না। কখন রাত কখন দিন বোঝা সম্ভব নয়। অন্যান্য ঘরের গেটের নিচে কিছুটা ফাঁকা থাকে, জানালাও থাকে আলো বাতাস প্রবেশের জন্যে তবে এই ঘরে সে সবের কোনো ব্যবস্থাই নেই। অক্সিজেন সাপ্লাই আছে ঠিকই তবে সেটা প্রাকৃতিক উপায়ে নয়। এই ঘরে কৃত্রিম অক্সিজেনের ব্যবস্থা রয়েছে। আর সেই অক্সিজেনের জোরেই এই বদ্ধ ঘরে অন্তি এখনও শ্বাস নিতে সক্ষম হচ্ছে। মাথার পেছনে তার প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হয়। তার মনে পড়ে যায় সে নিহালের সাথে শরের বাইরে এক সুনসান এলাকায় গিয়েছিল। সেখানে নিহাল ওর সামনে হাঁটু ভাজ করে বসে একটা বক্স এগিয়ে দিয়ে সেটা খুলে তার দিকে চেয়ে ছিল। বক্সে একটা আংটি ছিল। অন্তির বুঝতে বাকি ছিল না আসলে কী হতে যাচ্ছে তার সাথে। তার ভাবনা সত্যি করে নিহাল বলেছিল,
-আমায় বিয়ে করবে অন্তু?
তার নাম অন্তরা হলেও সকলে ছোট্ট করে ডাকে অন্তি কিন্তু এই এক ব্যক্তি যে অন্তু ডাকে তাকে। যাকে সে ভালোবাসে। যাকে সে সারা জীবনের জন্যে চায়। অন্তি চোখে মুখে বিষ্ময়ের ছাপ নিয়ে তাকিয়ে তাকে কিছুক্ষণ তারপরই খুশিতে কেঁদে বলে,
-তুমি আমায় বিয়ে করবে নিহাল?
-ইয়েস, অফকোর্স। তবে অবশ্যই যদি তোমার সম্মতি থাকে। যদি তুমি চাও।
অন্তি কিছু বলতে যাবে তার আগেই কেউ এসে নিহালকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। অন্তি নিহালকে উঠার জন্য সাহায্য করতে গেলে তার মাথার পেছনেও কেউ আঘাত করে। তারপর তাকে এই অন্ধকার ঘরে এনে আটকে রাখা হয়।

চলবে…..