যদি তুমি চাও পর্ব-২০+২১

0
355

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা

২০.
রাফিদের বাঁধন খুলতে খুলতে মেঘ বলে,
-খুলে দিচ্ছি কিন্তু পালানোর চেষ্টা করবে না।
-আমায় আটকে রাখার মানেটা কী?
-কথা শুনলেই ছেড়ে দেবো।
-আমি আপনার কথা শুনতে বাধ্য নই।
-শুনতে যে তোমাকে হবেই।
-কী চান বলুন তো?
-এইভাবে একাউন্ট থেকে টাকা সরালে তোর মা একসময় রাস্তায় নামবে যে সেটার খেয়াল আছে?
রাফিদ চমকে তাকায়। এসব এই ব্যক্তি জানলো কী করে? ও তো….
-তুমি তো তোমার গার্লফ্রেন্ডের জন্য টাকাটা সরিয়েছিলে তাই না।
রাফিদ আরও অবাক হয় ও যেখানে থেমেছে মেঘ সেখান থেকে কথাটা শুরু করেছে। বিষয়টা হলো শব্দ করে কথা বললে না-হয় মানা যেতো কিন্তু এতো মনের কথাও বুঝে গেল।
-তোর বয়স কতো রে?
রাফিদ এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না তাই নিজের বয়সটাই গুলিয়ে ফেলে সে। বলে,
-আঠেরো। না না ঊনিশ।
-সঠিকটা বল।
-ঊনিশ।
-সিওর।
-হ্যা।
-শালা গর্ধবের দাদা তুই এই বয়সে প্রেম করোস! তোর গার্লফ্রেন্ডের বয়স জানিস?
-আমার সিনিয়র।
-কত বছরের?
-পাঁচ।
-তুই তো বংশের নাম ডুবাই ছাড়বি দেখছি। তো সে এখন কোথায়?
-কে?
-তোর গার্লফ্রেন্ড আবার কে?
-প্লিজ গার্লফ্রেন্ড ওয়ার্ডটা ইউজ করবেন না।
-কেনো রে! ব্রেকাপ?
-আমায় চিট করে পালিয়েছে।
রাফিদ দাঁত কটমট করে বলে। মেঘ ভ্রু-কুঁচকে প্রশ্ন করে,
-ব্যপারটা কী খুলে বল দেখি।
-আগে আমায় তো খুলুন।
মেঘ রাফিদকে খুলে দেয় তারপর দু’জনেই এক কোণে গিয়ে অর্ধ ওঠানো দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে।
-শুনলাম কিছু খাওয়া হয়নি?
-আমার ইচ্ছে ছিল না। আর এমনিতেও না খেয়ে থাকার অভ্যেস করতে হবে এখন থেকে মা যদি জানতে পারে না এতোগুলো টাকা আমি জলে ফেলেছি তাহলে..
এইটুকু বলে হাত দিয়ে গলা কাঁটার ইঙ্গিত করে জিহ্বা দাঁতে চেপে মুখ দিতে ‘ক্যাচ’ করে একটা আওয়াজ করলো। মেঘ তখন মোবাইলের মেসেজ অপশনে কিছু একটা টাইপ করে তারপর সেটা সেন্ড করে রাফিদকে প্রশ্ন করে,
-এবার বল তো কাহিনী কী?
-মেয়েটা আমার লাইফে আসার বেশীদিন হয়নি। ভালো লাগতো আমার। অন্তরার ওইভাবে বিয়ে হয়ে যাওয়া তারপর আপনার কথা মা’কে অবিশ্বাস করা এইসব নিয়ে খুব গিল্টের মাঝে দিয়ে যাচ্ছিলাম আর তখন সে আসে আমায় সাপোর্ট দেয়। বয়সে বড় ছিল কিন্তু আমার তার কাম্পানি ভালো লাগতে শুরু করে। এরপর রিলেশনশিপ শুরু হয়। একদিন আমি ওর সাথে দেখা করতে গিয়ে পাইনা ওকে। গেল কোথায় সেই চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকে। এইভাবেই কাটে দশদিন। তারপর গত পরশু আমি ওর মোবাইল নম্বর খোলা পেয়ে যায়। কাঁদছিল খুব। আমি জানতে চাইলাম কী হয়েছে? তারপর ও বললো ওর বাবার নাকি অবস্থা ক্রিটিকাল। অপারেশন করতে হবে টাকার প্রয়োজন। আমিও দিয়ে দিলাম কাউকে কিছু না জানিয়ে। এরপর থেকে সে আর নেই। পরে বুঝতে পারলাম…
এইটুকু বলে রাফিদ আর কিছু বলতে পারলো না। মেঘ বললো,
-এতো আবেগ আসে কোনখান থেকে তোদের দুই ভাই-বোনের।
-মানে!
-কিছু না।
এরই মধ্যে কেউ বলে,
-স্যার।
-এসো।
তারপর সে এগিয়ে এসে মেঘের হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। মেঘ প্যাকেটটা খুলে রাফিদের দিকে এগিয়ে দেয়। রাফিদ দেখে ভেতরে বার্গার। সে বলে,
-আমাকে বার বার বন্দি বানান আবার এইভাবে খাওয়ান। ঠিক বুঝলাম না। আমি তো আপনার শত্রুই তবে….
-আহ, শত্রু নয় শত্রুর ছেলে।
রাফিদকে কথা বলতে না দিয়ে মেঘ বলে। এরপর রাফিদ বলে,
-সে যাই হোক। শত্রু হোক বা শত্রুর ছেলে সবই এক।
-তুই বুঝবি না।
-আমার মায়ের সাথে আপনার কীসের এতো শত্রুতা?
-একটা মুভি দেখবি?
-কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন!
মেঘ হাসে তারপর বলে,
-তুই এখনও বাচ্চা। বড়দের মাঝে আসিস না মারা পড়বি। ওয়ার্নিং দিতে তোকে বন্দি বানিয়েছিলাম।
-তাই বলে আমি আমার মা’কে একা ছেড়ে দেবো?
-তোর প্রাণের মায়া নেই দেখছি সে যাই হোক চল মুভি দেখতে যাই আমার পার্সোনাল সিনেমা হলে।
-সেটা কোথায়?
-আমার বাড়িতে।
-আমি আপনার সাথে যাবো কেনো? যদি আমার মা’কে এই নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেন তখন?
-গাধা গাধাই রয়ে গেলি। ব্ল্যাকমেইল করার হলে আগেই করতাম তাই বয় কি?
রাফিদ ভাবলো। গভীরভাবেই ভাবলো। আসলেই ঠিকই তো আর যদি এমনটাই হয় তবে তার যাওয়া উচিত যদি কোনো ইনফরমেশন পাওয়া যায় তবে মন্দ হয় না।

সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে ওরা আর মেঘ হাসতে হাসতে বলে,
-শেষমেশ কিনা একটা ফ্রডের প্রেমে পড়লো রুবি খানের একমাত্র ছেলে। এটা একটা মশালাদার নিউজ হবে বুঝলি।
-আপনি আবার সেই ফ্রডের থেকে কম কিসে?
মেঘের পা থেমে যায়। সে তাকায় রাফিদের দিকে। প্রশ্ন করে,
-কী বলতে চাইছো?
-আপনি ছায়ার সাথে যেই নাটকটা শুরু করেছেন সেটা আমি বুঝি না মনে করেছেন। ছায়া অন্তির বেস্ট ফ্রেন্ড আর তাকে পটিয়ে অন্তির কাছাকাছি যাবেন আপনি তারপর তো তাকে ছুড়ে ফেলে দেবেন। আপনাদের মতো লোকেদের ভালো করেই চেনা আছে আমার।
কথাটা শেষ হতে না হতেই সজোরে একটা থাপ্পড় পড়ে রাফিদের গালে। রাফিদ গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চোখে তার রাগ এদিকে মেঘ নিজের ধৈর্য হারিয়ে ফেলায় নিজেই অবাক হয়। ছায়ার সাথে তাকে জড়িয়ে নেগেটিভ কথা বলার কারণে নাকি অন্তিকে জড়িয়ে। তার আসলে কিছুই বুঝে আসে না। সে নিজে আর না এগিয়ে সহোযোগীদের ডাকে তাদের বলে রাফিদকে ‘মেঘকুঞ্জ’এ নিয়ে যেতে এরপর ফোন বের করে কাউকে কল দিয়ে বলে,
-পৌঁছেছ?
-হ্যা।
-গুড। অন্তরা সে কোথায়?
-ফ্ল্যাটে তালাবন্ধ করে রেখে এসেছি।
-ঠিকআছে।
ফোন রাখতে গিয়েও আবার থেকে যায় আর বলে,
-লিসেন আবির।
-ইয়েস স্যার।
-রাফিদের মোবাইল চালু করবে তারপর তার মায়ের কাছে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দেবে যেনো তার চিন্তাটা দূর হয়। তাকে আগে শান্তি দেবো তারপর অশান্তিতে ভোগাবো আমি।
-মেসেজে কী লিখবো স্যার?
-সেটাও এখন আমাকে বলে দিতে হবে?
দাঁতে দাঁত পিষে বলে মেঘ। আবির ভীতু কণ্ঠে বলে,
-আমি পারবো।
-গুড।
-ওকে স্যার।
-আরেকটা কথা মেসেজ পাঠানোর সাথে সাথে ফোনটা বন্ধ করে দেবে।
-যথা আজ্ঞা।
মেঘ ফোন রাখে তার মাথায় এই মুহুর্তে একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ছায়াই যদি অন্তরার বান্ধবী ছায়া হয়ে থাকে তবে এতোদিন তার লোক ফলো করছে কাকে? চিন্তার বিষয়।

কেটে যায় কয়েকটি মাস। এর মাঝে রুবি অনেকবার চেষ্টা করেছেন অন্তিকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার তবে অসফল হয়েছেন তিনি। মেয়ে তার উপর অভিমান করেই ফিরছে না। ছেলেটাও ইদানিং কেমন যেনো হয়ে গেছে। রুবির নিজেকে খুব একা মনে হতে থাকে, পারে না যে কোথাও পালিয়ে যায়। দূরে অনেক দূরে। এইখানে হয়তো দম বন্ধ হয়ে মরেই যাবে সে। আর এইসবের একমাত্র কারণ হচ্ছে ওক বখতিয়ারুজ্জামান খান।

-অন্তরা।
অন্তি চোখ মেলে তাকায়। সে শুয়ে ছিল। শরীরটা ভালো নেই তার। চোখ মেলে আবিরকে দেখে আবারও চোখ বুঁজে ফেলে সে। আবিরকে তার কাছে একটা গোলক ধাঁধা বলে মনে হয়। যাকে সে আজ অবধি সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেনি কিন্তু তার মাঝে দিনের পর দিন আটকা পড়ে যাচ্ছে। কোনো এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়তে সে। হয়তো এমন এক বন্ধন সে নিহালের সাথে চেয়েছিল। তার তো মাঝে মাঝে মনে হয় নিহালের সাথে অন্যায় করে ফেলছে সে। ছেলেটা তাকে খুব ভালোবাসতো আর আজ তারই পারিবারিক শত্রুতার কারণে ছেলেটা প্রথমে মৃত্যুর সাথে লড়াই করলো এখন হয়তো নিজেকে বাঁচাতে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। আর অন্তি, সে কী করছে! আবির, যে কি-না অন্তিকে বন্দি বানিয়ে রেখেছে তার মাঝেই ডুবে যাচ্ছে দিনের পর দিন।

অন্তিকে ওইভাবে চোখ বুঁজতে দেখে আবির তার কপালে হাত রাখে আর প্রশ্ন করে,
-তোমার শরীর খারাপ?
অন্তি চোখ না মেলেই মাথা নাড়িয়ে না বলে। আবির চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,
-তাহলে সমস্যাটা কোথায় বলো আমায়। এইভাবে তো চলে না অন্তরা। গত সপ্তাহ থেকে তুমি বাইরে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছ এইভাবে তো দম আটকে মরে যাবে।
-আপনিই তো চেয়েছিলেন আমায় বন্দি বানিয়ে রাখতে, দেখুন আমি এখন বন্দি।
-তাই বলে তুমি ক্লাস এটেন্ড করাও বন্ধ করে দেবে!
অন্তরা অবাক হয় না। এসবে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আবিরের দু’টো রূপ সে দেখেছে এই পর্যন্ত। একটা দেখলে মনে হবে অন্তরাকে সে খুব ভালো বাসে এবং অনেক কেয়ার করে অন্যটা হলো ভয়ংকর খুবই ভয়ংকর। মাঝে মাঝে কনফিউশনে ভোগে সে আবিরকে নিয়ে।

বিকেল বেলা যখন সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে তখন সেই আলোয় দু’জন নর-নারী নিজেদের প্রেমময় আলাপে ব্যস্ত। আঙুলের ফাঁকে আঙুল ডুবিয়ে মেয়েটি ছেলেটির কাঁধে মাথার ভার ছেড়ে দিয়েছে। নিরবতা ভেঙে মেঘ বলে,
-কিছু বলবে?
-উহু।
-মনে হচ্ছে খুব চিন্তিত।
ছায়া মাথা তুলে একবার তাকায় তারপর বলে,
-তেমন কিছু নয়।
-মানে তুমি চিন্তিত তবে আমায় জানাতে চাইছো না। বুঝলাম।
-মেঘ।
-শুনছি।
-জোর করে কারো উপর কোনো সম্পর্ক চাপিয়ে দেওয়া হলে সেটা কতদূর এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে?
মেঘের চেহারায় অবাকের ছাপ তবে তার অবাক হওয়াটা কৃত্রিম। আসলে সে জানে ছায়া কার এবং কোন সম্পর্কের কথা বলছে। ছায়া বলে,
-তোমায় বলেছিলাম না আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অন্তরার কথা।
-হুম।
-মেয়েটা ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারি জানো তো কিন্তু কিছুই করতে পারি না। ইভেন আন্টি মানে ওর মাও আমায় বলেছিলেন আমি যেনো ওকে বোঝাই এটলিস্ট নিজের মায়ের সাথে তো যোগাযোগ রাখবে সেটাও করছে না ও। এখন আবার নতুন করে জেদ ধরে বসে আছে, ক্লাসে আসবে না। আসলে আন্টি এসে ওর জন্য অপেক্ষা করে তাই ও তাকে এড়াতে আসতে চায় না।
-আই সী।
-আই কান্ট, আমি পারবো না ওকে এইভাবে দেখতে। সী ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড মেঘ।
-কী চাও?
-তুমি ওর হেল্প করতে পারো না?
-কেমন হেল্প?
-যতো সমস্যা সব ওর হাজবেন্ডের মধ্যে ওইটাকে সরিয়ে দিলেই অল ওকে।
-তুমি কী আমায় মার্ডার করার সাজেশন দিচ্ছো?
-প্রয়োজনে আমি তাই করতাম যদি না শাস্তি নামক বস্তুটা মাঝখানে এসে বাধা দিতো।
-তুমি তো বেশ সাংঘাতিক মেয়ে!
-ইয়ার্কি মেরো না তো।
-আচ্ছ বাবা আমি দেখছি কী করা যায়।
-সত্যিই তুমি ওর হেল্প করবে?
-উউউ, হুম। করবো।
-থ্যাংক ইউ মেঘ।
এই বলে ছায়া আরও শক্ত করে মেঘের বাহু চেপে ধরলো। মেঘের ঠোঁটের কোণায় হাসি। তবে সেই হাসিটা ছায়া দেখতে পেলো না।

চলবে…..

||রেসপন্স অনেক কম গল্পটায় জানি শুরুতে এমন হবে তবে এও জানি কিছু নিরব পাঠকও আছে যারা এসে চুপিসারে পড়ে আবার চলে যায়। তাদের কাছে আমার জানতে ইচ্ছে করে গল্পটা কেমন হচ্ছে বা কোথাও কোনো ভুল আছে কি-না? আমি এখানে এমন কিছু বলবো না যে ভালোলাগছে না তবে এখানেই শেষ করে দেব বা আপনারা রেসপন্স না করলে শেষ করে দেব। আমি আমার মতো লিখে যাব মাঝপথে এসে ছেড়ে দেওয়াটা ভালো লাগে না। তবে একজন তার লেখার মাধ্যমে আপনাদের খুশি করতে পেরেছে কি-না সেটা জানার তো ইচ্ছে তার থাকতেই পারে। তাই নয় কী? নিজেদের অনুভূতি জানালে খুশি হবো। হোক সেটা পজিটিভ কিংবা নেগেটিভ। দিনশেষে সেটা হবে আমার ইন্সপিরেশন। সকলে ভালো থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম। ||

#যদি_তুমি_চাও
লেখনীতেঃ অনামিকা

২১.
সকাল সকাল ঘুমটা ভেঙে যায় অন্তির। হঠাৎ এই সকাল বেলা কে এলো! বিছানা থেকে উঠতেই পাশে শুয়ে থাকা আবিরকে দেখতে পায় সে। মাঝে মধ্যে এই মানুষটিকে কেমন গোলমেলে মনে হয় তার কাছে। এই কাছে আসে আবার এই দূরে সরে যায়। তবে এই গোলমেলে মানুষটিই যে কখন কীভাবে ওর মনে জায়গা করে নিয়েছে অন্তি বুঝতেই পারেনি। মাঝেমাঝে আবিরের কান্ড দেখে মনে হয় তার মনেও অন্তির একটা জায়গা হয়েছে, একটা নয় হয়তো সবটুকু জায়গাই তার। আবার আবিরের কিছু কিছু ব্যবহারে মনে হয় অন্তিকে যেনো ও সহ্য করতে পারে না। হয়তো ওর কাছে শুধুমাত্র একটা দ্বায়িত্ব যার নাম অন্তরা।

-এতোটা সময় লাগে আসতে? আমি কতক্ষণ অপেক্ষা করছি।
দরজা খুলে দিতেই অন্তিকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তবে প্রশ্নটা তাকে ততটা অবাক করেনি যতটা না করেছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি। এ যে অন্তির মা, স্বয়ং রুবি দাঁড়িয়ে আছেন। রুবি মেয়ের কাছে কোনো উত্তর না পেয়ে বিরক্ত হন আবার রেগেও যান এইটা দেখে যে তার মেয়ে দরজা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
-ভেতরে আসতে বলবে না?
মায়ের কথায় ঘোর কাটে অন্তির। সে সরে দাঁড়িয়ে মা’কে ভেতরে আসার পথ করে দেয় তারপর রুবি প্রবেশ করতেই আবারও দরজা লক করে দেয় সে। অন্তি মায়ের দিকে ফিরতেই খেয়াল করে তার মা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে চারিদিকে। তার মুখের ভঙ্গিটা দেখে আজ অন্তির পছন্দ হলো না। সে প্রশ্ন করলো,
-মা।
-হুম বলতে পারো আমি শুনছি।
-চা খাবে?
-এখানে তো কোনো সার্ভেন্ট দেখছি না। কে বানাবে?
-আমায় দেখতে পারছো না?
রুবি মেয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকান। অন্তি বুঝতে পারে মা হয়তো বোঝার চেষ্টা করছেন তার মেয়ে এতোটা পালটে গেল কী করে? যে মেয়ে আগে রান্নাঘরে পা রাখতো না সে আজ তাকে নিজে হাতে চা বানিয়ে খাওয়ানোর অফার দিচ্ছে। যে কোনো মা’ই এমন অবাক হবেন।
-তুমি বানাবে কেনো?
-কেনো মা বানাতে পারি না!
-আমার মেয়ে হয়ে কিচেনে যাবে ইম্পসিবল।
-এতোদিন কোথায় ছিল তোমার মেয়ের মা?
অন্তির কথায় তাচ্ছিল্যের ভাবটা বেশ বুঝতে পারলেন রুবি। তিনি বললেন,
-সার্ভেন্ট রাখোনি কেনো?
-সার্ভেন্ট রাখলে আর নিজেদের খেতে হবে না। কেনো বিয়ে দেওয়ার আগে খোঁজ নাওনি যাকে জামাই হিসেবে গ্রহণ করলে তার আয় কতটুকু!
-পরে নিয়েছিলাম। তবে একটা কথা কী জানো অন্তি, যেই ছেলে আমার মেয়েকে বিয়ে করার সাহস রাখে তার অন্তত একটা বাড়তি আয় আছে বলেই আমার ধারণা ছিল। এখন দেখো গিয়ে কোথায় সেটা খরচ করে আসে সে।
অন্তি মায়ের কথার অর্থটা ঠিকই বুঝলো। মা হয়ে মেয়েকে এইভাবে বলতে পারবেন উনি সেটা কল্পনার বাইরে ছিল তবুও ঠিক আছে বলুক। কতোই বা বলবে!

অন্তি বলে,
-তুমি বসো আমি তোমার চা নিয়ে আসি।
সে এগিয়ে যায় চা বানাতে হবে বলে তখনই রুবি মেয়েকে বাধা দিয়ে বলেন,
-প্রয়োজন নেই।
তারপর ঘড়ি দেখে বলেন,
-উমম… তোমায় থার্টি মিনিটস সময় দিচ্ছি নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও।
-কেনো?
-প্রশ্ন করো না যা বলছি সেটা করো।
-মা, আগে বলবে তো হয়েছেটা কী!
-তুমি আমার সাথে বাড়ি ফিরছ। অনেক হয়েছে আর নয়। শত্রু যা পারবে করুক আমি পরোয়া করি না।
-তাই বুঝি! এতোদিন কোথায় ছিলে মা?
-কাজের চাপে সাথে তোমার ভাইয়ের চিন্তায় আমার ঘুব উবে গেছিল একপ্রকার তাই…
-তাই তুমি আমাকে ভুলে গেলে?
-অন্তি, মা বোঝার চেষ্টা করো। মা খুব অসহায় হয়ে পড়েছিল।
বলেই রুবি এগিয়ে গিয়ে অন্তির গালে হাত রাখেন। অন্তি সরে দাঁড়ায় তারপর বলে,
-আমি যাবো না মা।
-অন্তি জেদ করো না। চলো আমার সাথে। নিহাল অপেক্ষা করছে।
-নিহাল!
অন্তি যেনো নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছে না। এতোগুলো দিন পরে সে কোনখান থেকে উদয় হলো? তার একবার গিয়ে দেখতে হচ্ছে বিষয়টা। কিন্তু আবির! সে তো এখনও ঘুমোচ্ছে।
-কী ভাবছো অন্তি?
-মা ওই আবির….
-ওসব তোমায় ভাবতে হবে না ওর ব্যবস্থা আমি করছি।
-কী করবে মা?
-তোমায় নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
-তুমি কী কোনোভাবে ওর ক্ষতি…..
-বেশি কথা বলা আমি পছন্দ করি না অন্তি। চলো আমার সাথে।
অন্তি আর নিজের জিনিসপত্র নেওয়ার সময় পেলো না এমনকি মোবাইলটাও নেওয়ার সময় পেলো না। রুবি একপ্রকার জোর করেই তাকে নিয়ে গেলেন। অন্তির যেতে ইচ্ছে করে না, মন পড়ে রয় এইখানটাতেই। ওর চিন্তা জুড়ে একটাই কথা ঘোরে, আবির ঘুম ভেঙে ওকে না পেলে কী করবে?

আবিরের ফোনটা বাজছে তবে সে রিসিভ করছে না। করবেই বা কী করে সে তো গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। গতকাল রাতের কথা সে অন্তির অনেকটা কাছেই চলে গিয়েছিল। একটা ঘোর কাজ করছিল তার মাঝে এরপর অন্তির কপালে যখন সে ঠোঁট ছোয়ালো তখন মেয়েটা কেঁপে উঠেছিল। আবিরের মনে হয় মেয়েটা ভয় পেয়েই এমন কেঁপে উঠেছে তাই সাথে সাথে দূরে সরে আসে সে। মাঝেমধ্যে তার যে কী হয় সে নিজেই জানে না। অন্তি শুধুমাত্র তার দ্বায়িত্ব। মেয়েটার খেয়াল রাখার জন্যই এইখানে রাখা হয়েছে তাকে আর কিছু… উহু সেটা অন্যায় হবে। জোর করে কোনো সম্পর্ক কখনো ভবিষ্যতে সুখ বয়ে আনতে পারে না বলেই আবির বিশ্বাস করে। রাতেই সে বেরিয়ে যায় অন্তিকে একা রেখে আর যখন ফেরে তখন অন্তি গভীর ঘুমে। ওর পাশে বসে ওকে দেখতে দেখতে চোখদুটো লেগে আসায় সেখানেই শুয়ে পড়ে ও। আবির যখন ঘুমিয়েছে তখন ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে আর তাই তো এখন তার ঘুম ভাঙার নাম নেই এমনকি ফোনের রিংটোনের আওয়াজটাও তার কান অবধি পৌঁছুতে পারছে না।

ছায়া বসে আছে অন্তির পাশে। সকাল সকাল হঠাৎ রুবির কাছ থেকে একটা কল পেয়েই চলে আসতে হয়েছে তাকে। এসে দেখতে পায় অন্তি নিজের ঘরে বসে আছে বধূ বেশে। নিচেই নিহালকে পাঞ্জাবী পরা দেখেছিল ঠিকই তবে সাধারণ একটা পাঞ্জাবী বলে তেমন সন্দেহ হয়নি তার তবে অন্তির সাজ দেখে তার কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যায়। সে এগিয়ে এসে অন্তির পাশে বসে প্রশ্ন করে,
-এসব কখন হলো?
অন্তির মুখটা ভার হয়ে আছে। কথাও বলছে না সে আর সেই দেখেই ছায়া জানতে চায় সমস্যাটা কোথায়? অন্তি এরপরেও চুপ করে থাকে তা থেকে ছায়াও ওইভাবেই বসে থাকে।
এই পর্যায়ে এসে ছায়া আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারে না তাই বলে,
-দেখ তুই যদি এমন চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকিস তবে আমায় মাফ কর আমি আসছি।
ছায়া উঠে দাঁড়ায় সেটা বুঝতে পেরে অন্তি বলে,
-ছায়া।
অন্তির কণ্ঠস্বর ভেজা মনে হলো। ছায়া কপাল কুঁচকে দেখে। অন্তির চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। ছায়া অন্তির সামনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে ওর হাত দু’টো মুঠোয় নিয়ে প্রশ্ন করে,
-কাঁদছিস কেনো অন্তি? নিচে তো নিহালকে দেখে এলাম এর মানে তো এই যে ওর সাথেই… তাহলে কাঁদছিস কেনো?
-কারণ আমি বিবাহিত।
অন্তি কথাটা জোর গলায় বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ছায়া অস্পষ্ট স্বরে বলে,
-সর্বনাশ!

ছায়া কিছুক্ষণ সময় নেয় তারপর নিজের মাথা আগে ঠান্ডা করে কারণ এই মুহুর্তে সে যেটা আন্দাজ করছে সেটা যদি সত্যি হয় তবে তো…
-অন্তি আমার কথা শোন।
অন্তির সেদিকে কান নেই ছায়া তখন এগিয়ে গিয়ে ওর দুই গালে হাত রেখে মাথাটা উঁচু করে বলে,
-আগে কান্না থামা৷ কেঁদে লাভ নেই। এই তুই-ই না বলেছিলি তোকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে আর নিহালকে তো ভালোবাসতি তবে?
-আমি জানি না, ছায়া। আমি সত্যিই জানি না আসলে কী হয়েছে আমার। সেই বিয়েছে আমার মত ছিল না তবে আজ এই মুহুর্তে এসে বুঝতে পারছি এই বিয়েতে আমার মতও নেই আর ভবিষ্যতে গিয়েও কখনো মেনে নেওয়ার সম্ভাবনা নেই। এমনিতেও এই বিয়ে সম্ভব নয় কারণ আমাদের এখনো বিচ্ছেদ ঘটেনি।
-আর যদি আন্টি সেটার ব্যবস্থা করে থাকেন তো!
-তারপরেও সেটা সম্ভব নয়।
ছায়া অন্তির ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলা কথার মাঝে না গিয়ে সরাসরি জানতে চায়।
-ভালোবাসিস আবিরকে?
অন্তির দৃষ্টি শান্ত। এর উত্তর সে দিচ্ছে না বা দিতে চাইছে না তবে ছায়া বুঝে গেছে। আর বুঝতে পেরেই তার মাথাটা ঘুরতে শুরু করেছে।

চলবে….