তুমি যে আমার পর্ব-৫২ এবং শেষ পর্ব

0
1813

#তুমি_যে_আমার🥀
#Writer_Nondini_Nila
#Part_52
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ)

বিষ্ময়ে হতভম্ব হয়ে বিছানায় বসে আছে বর্ষা। তূর্য বাথরুমে গেছে গোসল করতে। বর্ষা এসেই গোসল করেছে। তারপর থমকানো মুখে বসে আছে। বাপি আর তূর্য এর এমন স্বাভাবিক আচরণ ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সকালেই এমন অদ্ভুত ভাবে কিডন্যাপ করলো আবার বাপি ও তাতে রাগ দেখালো না। আবার তূর্য কে এই বাসায় নিয়ে ও এলো। মাম্মার হাত ‌ই বা ভাঙলো কি করে? কিছুই তো আমার মাথায় ঢুকছে না‌। নিজেও কিছু জিজ্ঞেস করার চান্স পেলো না।
গালে হাত দিয়ে বর্ষা নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে। তূর্য ওয়াশরুমে থেকে বেরিয়ে দেখে বর্ষার চুল থেকে পানি পরছে বর্ষা চুল না মুছেই গালে হাত রেখে অন্যমনষ্ক হয়ে আছে।
তূর্য তোয়ালে হাতে বর্ষার চুল মুছে দিতে লাগলো যত্ন সহকারে। বর্ষার তূর্য এর উপস্থিতি টের পেয়ে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। আর বললো,

‘ আমার না সব তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে। প্লিজ সব বলুন আমাকে। বাপি এমন স্বাভাবিক কি করে আছে। আপনাকে কি মেনে নিয়েছে? আর নিলেও কিভাবে এটা সম্ভব হলো? আমি এতো শক নিতে পারছি না‌।’

তূর্য বর্ষার মাথায় চুল মুছে দিয়ে ঝুঁকে কপালে চুমু খেলো। তারপর বললো

‘ তোমার এসব জানতে হবে না জান। তুমি শুধু একটা কথায় শুনো তোমার বাপি আর তার জামাই উরফে আমার উপর রেগে নাই। তিনি আমাকে মেনে নিয়েছেন এবার আর শশুর বাড়ি চোরের মত লুকিয়ে আসতে হবে না।মাথা উঁচু করে আসবো আর জামাই আদর খাব। ‘

‘ সত্যি’ বর্ষা বিশ্বাস করতে পারছে না। অবাক সুরে বলল।

‘ ইয়েস মাই ডেয়ার ওয়াইফ। সব ঠিক হয়ে গেছে এবার তোমাকে আর আমাদের অনাগত সন্তান কে আমাদের নীড়ে নিয়ে যাব।’

‘ কবে ?’

‘ এক সপ্তাহ পর। লাল টুকটুকে ব‌উ সাজিয়ে টোপর মাথায় দিয়ে ব‌উ নিতে আসবো‌। ততদিনে মায়ের হাত ও ঠিক হবে।’

বর্ষা খুশির জোয়ারে ভাসছে। ও আর কিছু জানতে চায়না। সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে সেই খুশি দেখে কে‌। যেভাবেই হোক বাপি যে তূর্য কে আবার ক্ষমা করেছেন এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে।মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছে। তূর্য হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে দিয়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা কল করলো,

‘ আরিয়ানকে কি পাওয়া গেছে?’

‘ ব্রো আরিয়ান তো বিদেশে যাওয়ার সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে আজ রাত আটটায় তার ফ্লাইট।’

‘ ওকে আজ ও বিদেশে না এই পৃথিবী ছেড়ে যাবে‌। আমি আসছি‌!’

বলেই কল কেটে দিলো। বর্ষা নিজের মায়ের কাছে এসেছিলো তখন তূর্য এর ডাকে রুমে আসে।

‘ আপনি এখন আবার রেডি হয়ে কোথায় যাচ্ছেন?’

রুমে এসে তূর্য কে রেডি হতে দেখে বর্ষা প্রশ্ন ছুড়ে।’

‘ দরকার আছে। নিজের খেয়াল রেখো আমি আজ আর আসতে পারবো না।’

‘ কেন কোথায় যাচ্ছেন বলুন আমাকে?’

‘ বলা গেলে বলেই দিতাম জান। তুমি দুশ্চিন্তা করো না আমি ঠিক থাকবো। খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পরো।’

‘ কিন্তু…

‘ কোন কিন্তু না‌। বাই।’

তূর্য বর্ষাকে আর কথা বলতে না দিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। বর্ষা চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এই রাতের বেলা কোথায় গেলো উনি?

তূর্য গাড়িতে বসে আছে। যত দ্রুত সম্ভব ওকে ইয়ারপোর্টে পৌঁছাতে হবে। সারে সাতটা বাজে ও বসে আছে জ্যামে বিরক্তিকর একটা সময়। সময় মতো মনে হচ্ছে না পৌঁছাতে পারবে। শাওন কে কল করেছে ও বলছে এখনো আরিয়ানকে ইয়ারপোর্টে দেখা যায় নি‌‌। পনোরো মিনিট বসে থেকে হাঁপিয়ে গেলো তূর্য। এদিক শাওন বলছে আরিয়ানের নাম নাকি এনাউজমেন্ট হয়েছে কিন্তু সে এখানে নাই‌‌। তূর্য হঠাৎ মনে হলো বর্ষাকে বাসায় রেখে এলাম ওখানেই কোন কিছু করছে না তো। ওকে এইভাবে বাসা থেকে বের করার একটা ফাঁদ ছিলো এটা।

তূর্য গাড়ি ঘুরিয়ে সর্বোচ্চ গতিতে বাসায় ফিরে আসে। ওর সারা শরির কাঁপছে। কোন দূর্ঘটনা ঘটে যায়নি তো এদিকে শাওন কল করেই‌ যাচ্ছে তূর্য রিসিভ করছে না। বর্ষা ও ফোন রিসিভ করছে না। ও দৌড়ে বাসায় ভিতরে ঢুকে গেল।

সারা বাসা খালি তূর্য থপ করেই ফ্লোরে বসে পরলো। তাহলে কি আবার সবাই বিপদে পরলো। আরিয়ান আবার ও।
তূর্যর এখন সেই সময় কার কথা মনে পরলে তখন থানা থেকে রেগে বেরিয়ে ও গাড়িতে উঠে পরে। সব কিছু তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে। বর্ষা শুধু ওর ভালোবাসা নয় হৃদপিন্ড ওর কিছু হলে বেঁচে থেকেও মরে যাবে‌। শাওনকে কল করে বলে,

‘ ব্রো আমি….

শাওনকে থামিয়ে নিজে বলে উঠে, ‘ আরিয়ান কু* বাচ্চা কে আমি কেটে টুকরো টুকরো করে কুকুর কে খেতে দেবো। ও বর্ষাকে আমার বর্ষার দিকে হাত বাড়িয়েছে। তুই তারাতাড়ি লোক পাঠা খোঁজে বের কর আমার বর্ষাকে নিয়ে কোথায় গিয়েছে।’

‘ ব্রো কুল ডাউন। আমার কথা টা শুনো।”

‘ কথা শুনার টাইম নাই। তুই আমার কথা মতো কাজ কর। বর্ষার কিছু হলে আমি কিন্তু কাউকে ছারবো না। মৃত্যুর বন্যা ব‌ইয়ে দেবো।’

‘ ব্রো ভাবির কিছু হবে না। বিকজ ভাবি আমার কাছে‌‌। আরিয়ান ভাবিকে তুলতে পারিনি।’

‘ হোয়াট?’

‘ ইয়েস ব্রো কুল থাকো। আরিয়ানের আগে ভাবি কে নিয়ে আমি চলে এসেছি।’

‘ মানে! কোথায় আছিস তুই?’

শাওন বলতেই তূর্য সেখানে চলে আসে বর্ষাকে দেখে মনের রাগ কিছুটা দমে। শান্ত হয় তার ক্রোধ। শাওনকে জিজ্ঞেস করে এসব কি করছো হলো,

‘ কাল রাতে তোমার ফোনটা আমার কাছে ভুলে ফেলে গেছিলেন যেটা আদিল নামে সবাই জানে। তো আজ সকালে সেটা দিতে আসছিলাম। হঠাৎ তোমার ফোনে একটা মেসেজ আসে যেটা ভাবির বাবা করে। সেখানে লেখা থাকে, বর্ষার খুব বিপদ ওকে রক্ষা করো। তুমি না বলে আমার মেয়েকে খুব ভালোবাসো আজ তার প্রমাণ করো। আমি বাঁচবো কিনা জানি না কিন্তু যদি মরে যাই আমার মেয়েকে তুমি আগলে রেখো। একমাত্র মেয়ে আমার খুব আগলে মানুষ করেছি। চেয়েও ওর বিপদে কখনো বাবা হয়ে পাশে থেকে রক্ষা করতে পারিনি। তোমাকে অনেক ভুল বুঝেছিলাম আমাকে ক্ষমা করো‌। বেঁচে থাকলে আমি আর মেয়ে আর মেয়ের জামাইয়ের মধ্যে বাঁধা হবো না। আল্লাহ হাফেজ।’

এমন মেসেজ দেখে আমি থমকে যাই। তোমাকে জানানো আগেই আমি চলে যাই ভাবির বাংলোতে। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই এক দল লোক ভাবিকে অচেতন করে বাইরে আনছে। গেটে দারোয়ান ও নাই তাকে অজ্ঞান করে ফেলে রেখেছে। এতো সকাল বিদায় আশেপাশের লোকজন জাগ্রত না বেশি‌। সেই সুযোগ টাই নিয়েছে। আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এটা এতো গুলোর সাথে আমি পারবো না আর পারলেও যদি ভাবিকে কিছু করে বসে আছি দিশেহারা হয়ে পড়ি। হঠাৎ গাড়ির ড্রাইভারের সিটে নজর পরে সেখানে কেউ নাই‌। একটু দূরে সেই ড্রাইভার কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলো।আমি পেছনে থেকে সেই লোকটাকে আঘাত করে ফেলে তার পোশাক পরে মুখ ডেকে ড্রাইভিং সিটে বসে পরি।

তারপর লোকগুলো আমাকে তেমন সন্দেহ না করেই ভাবিকে গাড়িতে তুলতেই আমি গাড়ি সটার্ট
করেই ভৌ করে চলে আসি। পেছনে থেকে লোক গুলো আমার পেছনে আসার চেষ্টা করলেও লাভ হয়না কারণ ততক্ষণে আমাদের লোক চলে আসে আর ওদের অবস্থা নাজেহাল করে তুলে।

তূর্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বর্ষাকে একটা ভাড়া বাসা নিয়ে লুকিয়ে রাখে। সম্মুখে থাকা বর্ষার জন্য বিপদ তাই রুমে আটকে রেখে আসে। রুমে সি সি টিভি থাকে বর্ষা কি করছে না করছে সব দেখতে পায় তূর্য। শাওনের থেকে নিবিড় আহমেদ দের কিডন্যাপের খবর শুনে। আরিয়ান নিজের বাগান বাড়ি নিয়ে আটকেছে তাদের সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয় তূর্য। বর্ষা বাবা মাকে মুক্ত করে কিন্তু আরিয়ানকে ধরতে পারে না। আরিয়ান বর্ষার মার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে পালিয়ে যায়। আর যাওয়ার আগে একটা জোরে দেয় ওনাকে আর তাতেই হাত ভেঙেছে বর্ষার মার।

তূর্য ফ্লোরে বসে আছে হঠাৎ একজোড়া পা দেখে মাথা তুলে বর্ষাকে দেখে চমকে উঠে। বর্ষা ও তূর্য এর এমন অবস্থা থেকে ঘাবড়ে যায়। তূর্য ছুটে এসে জাপ্টে ধরে।

‘ আরে কি হয়েছে আপনার আপনি না কি কাজে গেলেন। আবার ফিরে এলেন কখন আর এই অবস্থা কেন আপনার?’

‘ তুমি কোথায় ছিলে? এতো ডাকাডাকি করলাম। আর বাকিরা কোথায়?’

‘ আমি তো ছাদে গেছিলাম। আর বাপি মাম্মাকে নিয়ে হসপিটালে গেছে মাম্মার নাকি হাতে আবার বাড়ি খেয়েছে দেয়ালে খুব ব্যাথা করছে তাই।’

‘ আরিয়ান এখানে আসিনি তাহলে!’

‘ কি বলছেন বিরবির করে?’

তূর্য কিছু না বলে বর্ষাকে নিয়ে রুমে আসে। ওর কলিজা কাঁপছে। বর্ষা ঠিক আছে ও বর্ষাকে বুকে চেপে রাখে। বর্ষা তূর্য এর এমন ব্যবহারে মাথা মন্ডু কিছু বুঝতে পারে না।

.
নিবিড় আহমেদের বাড়িতে বিয়ের আমেজে ঝলমল করছে। সারা বাসা ফুল ক্যান্ডেলা লাইট জ্বলজ্বল করছে। বাড়িতে আত্নীয় স্বজনে ভর পুর। দুই বছর আগে এমন ভাবেই বিয়ের আয়োজন করেছিলো নিবিড় আহমেদ কিন্তু সেদিন এক ঝরে বাড়ির সব আনন্দ মুছে গেছিলো।
আজ আবার সেই ভাবেই আয়োজন করা হয়েছে। অসংখ্য লোকের সমাগম। বর্ষা নিজের রুমে বসে আছে বিরক্তিকর মুখ করে। তূর্য ভিডিও কলে। সামনে পার্লারের লোকজন। তাদের তূর্য সাজ পোশাক কিভাবে করবে বলে দিচ্ছে। বর্ষা একটু পর পর রাগে কটমট করে তাকাচ্ছে তূর্য এর দিকে। তূর্য নিজের প্রেয়সীকে মন মতো সাজাচ্ছে।
বর্ষার সাজ কমপ্লিট হতেই পার্লারের লোক চলে গেলো‌। তখন রুমে ঢুকলো বর্ষার ফ্রেন্ডরা সবাই‌। তিশা আর শাওনের সম্পর্কে কথা সবাই জেনে গেছে ওদের বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে।

তিশা ফোনের দিকে তাকিয়ে তূর্য এর সাথে মজা করতে লাগলো। সাথে বাকিরাও বর্ষা মুখ বেঁকিয়ে ওদের কান্ডকারখানা দেখছে।

বাপি আসতেই বর্ষা বাপিকে জরিয়ে ধরলো,

‘ থ্যাংকস বাপি তূর্য কে আবার জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। উনাকে ছাড়া আমি সুখী হতে পারতাম না। কারণ উনিই আমার সুখ।’

নিবিড় আহমেদ ছলছল চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

‘ আমাকে ক্ষমা করছিস মা আমি তোকে কখনো বুঝতি পারিনি। কিন্তু তোর সুখ আমি তোকে ফিরিয়ে দেবো‌।’

বর এসেছে বলেই বর্ষার রুম ফাঁকা হয়ে গেলো। তখন দেখা পেলো পরীকে। বিয়ের দাওয়াত ওদেরকে দেওয়া হয়েছে। কাল‌ই এসেছে ওরা। পরী এসেই বললো,

‘ আপুনি তোমার দুইবার বিয়ে হচ্ছে কি মজা? আমিও দুইবার বিয়ে করবো তাহলে দুইবার সাজতে পারবো।’

বলেই নাচতে লাগলো। বর্ষা ওর গাল টেনে দিয়ে বললো, ‘ দুষ্টু পরী। তোমার আম্মু কোথায়?’

‘ আম্মু তো বরের কাছে।’

‘ তুমি যাওনি কেন?’

‘ সবাই তোমাকে একা রেখে গেছে তাই আমি তোমার কাছে এসেছি।নয়তো তোমার মন খারাপ হবে!’

‘ তাই এতো ভালোবাসা আমাকে।’

‘ খুওওব, অনেক বেশি।’

‘আমি ও আমার এই দুষ্টু মিষ্টি পরীকে খুব ভালো বাসি।’

নিদ্রা আপু আমার কাছে এলো। মিষ্টি রঙের শাড়ি পরেছে খুব সুন্দর লাগছে আপুকে। এই এক সপ্তাহে প্রতিদিন ই আপু আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।
আপু এসে আমার দিকে মিষ্টি করে হেসে বললো,

‘ ওয়াও আজ তো আমার ভাই চোখ‌ই সরাতে পারবে না।’

‘ উনি আমাকে আগেই দেখেছে আর এই সাজ পোশাক স্টাইল সব উনিই চয়েজ করেছেন।’

‘ তাই এজন্য ই তো বলি পাজি টা দরজা আটকে কি করছে রুমে। ব‌উয়ের সাজ নিয়ে বিজি ছিলো।’

আমি লজ্জা মিশ্রিত হাসলাম।

‘ আর লজ্জায় লাল হতে হবে না চলো নিচে চলো। তোমাদের তো আর বিয়ে পড়ানোর ঝামেলা নাই। খাবার খেয়ে ব‌উ নিয়ে চলে যাব।’

বলেই আমার হাত ধরে টেনে তুললো।
তিশা রা সবাই আসলো। সবাই মিলে আমাকে নিচে নিয়ে এলো। তূর্য স্টেজে বসে ছিলো একপাশে শাওন ও একপাশে অভ্র ভাইয়া বসে আছে।
আমাকে নিয়ে যেতেই দুজনে উঠে পরলো আর আপু আমাকে তূর্য এর পাশে বসিয়ে দিলো। আমি লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি জানি তূর্য আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমি খুব লজ্জা পাচ্ছি। তাকাতে পারছি না। আপু আমাকে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল।

সবাই চলে যেতেই তূর্য আমার বাম হাতটা টেনে মুঠোয় বন্দি করে ফেললো।
অদ্ভুত ভাবে তূর্য এর এমন স্পর্শে আমার সারা শরীরে কেঁপে উঠে।
আমি নিচের দিকে চোখ নামিয়ে রেখেছি।

হঠাৎ তূর্য বর্ষার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

‘ একবার তাকাও আমার দিকে জান। এতো লজ্জা পাচ্ছ যেন আজকেই আমাদের প্রথম পরিচয়। দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে একটু অনুভূতি প্রকাশ তো করো।’

‘ আপনি প্লিজ সরে বসুন। সবার সামনে এমন করছেন কেন? আমি তাকাতে পারবো না। আমার খুব লজ্জা লাগছে।’ লজ্জা লাল হয়ে।

তূর্য হো হো করে হেসে উঠে কিছু বলতে যাবে তখন পরী আসে। তাকে দেখে তূর্য সোজা হয়ে বসে,

পরী এসে বলে, ‘ আমি এখন বর ব‌উয়ের সাথে পিক তুলবো।’

বলেই তূর্য বর্ষার মাঝে বসে পরে। ক্যামেরা ম্যান কয়েকটা ছবি তুলে দেয়। তূর্য পরীকে টেনে কোলে তুলতে গেলে ছোট পরী সরে দাঁড়িয়ে বলে,

‘ তুমি আমাকে কোলে নিচ্ছ কেন?’

‘ কেন কি হয়েছে?’

‘ বাচ্চাদের মতো আমাকে কোলে তুলছো কেন? আমি কি বাচ্চা নাকি।’

বলেই নাক ফুলালো পরী। চারবছরে পরীর এমন কথা শুনে বর্ষা ও তূর্য দুজনেই হেসে উঠলো।পরী তা দেখে ভেংচি কেটে নেমে এলো স্টেজে থেকে।
তূর্য ও বর্ষা ক্যাপেল পিকচার তুললো‌। ফ্যামিলি ফটো ও তোলা হলো‌। আসার সময় বর্ষা আবার কাঁদতে লাগলো। তূর্যর হাতে নিবিড় আহমেদ আবার এক মাত্র মেয়েকে তুলে দিলেন। তূর্য বর্ষার কান্না দেখে আগের বারে কথা মনে পরে আর তখন বলে উঠে,

‘ বর্ষা এবার কিন্তু জ্ঞান হারানো যাবে না জান। তুমি কিন্তু আমাদের তিতির
( বর্ষা নিজের অনাগত সন্তানের নাম ভেবে রেখেছে তিতির মেয়ে হলে, আর ছেলে হলে তিহান। তূর্য তো মেয়ে চায় তাই তিতির বললো) কে কষ্ট দিতে পারো না। তাই একদম কান্না করবা না। দরকার পরলো আমি শশুর শাশুড়ি কেও বাসায় নিয়ে রাখবো নয়তো নিজে ঘরজামাই হয়ে যাব তবু কান্না করা যাবে না।’

তূর্য এর কথা শুনে বর্ষা সহ আশেপাশের সবাই হেসে উঠল। বর্ষার আর কান্না করা হলো না। জেনে বুঝে সন্তানের ক্ষতি করবে না‌। মুখটা মলিন করেই বিদায় নিতে হলো।

.
দ্বিতীয় বারের মতো বাসর ঘরে বসে আছে বর্ষা। আগের বাসর রাত ছিলো ওর জন্য নরক তুললো। আর আজকেই এই রাত এই মুহূর্ত ওর জন্য অতি আনন্দের। জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। নিজের ভালোবাসার মানুষকে আবার নিজের করে পেয়েছে। কারণ অবশ্য এখনো অজানা বর্ষার কিন্তু আফসোস নাই। তূর্য কে ফিরে পেয়েছে এইটাই ওর জন্য যথেষ্ট। বর্ষা শাড়ির উপর দিয়েই পেটে হাত রাখলো। অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি হয় ওর। ও আর কয়েকদিন পর মা হবে একটা ছোট প্রাণ ওর শরীরে বেড়েছে। যে ওকে মা বলে ডাকবে। আহ কি সুখ লাগছে ওর। এতো সুখ ওর কপালে ছিলো।

তখনি দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো তূর্য। বর্ষা মাথা তুলে তাকালো পূর্ণ দৃষ্টিতে। সারাদিন আজ ঠিকমতো তাকায়নি বর্ষা তূর্য এর দিকে। তাই খেয়াল করেনি কতোটা সুন্দর লাগছে লোকটাকে। চোখ তুলে তাকালে চোখ সরিয়ে নেওয়া নেওয়া দায়। বর্ষার শাড়ির সঙ্গে মাচিং শেরোয়ানি পড়েছে বর্ষা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে।

তারপর উঠে দাঁড়ালো। তূর্য এগিয়ে এসে বর্ষার সামনে দাঁড়ালো।

‘ এখন লজ্জা লাগছে না।সারা দিন তো মুখ তুলো নি।’

তূর্য এর কথা শুনে বর্ষা মাথা নিচু করে ফেললো‌‌। তূর্য ঠোঁট কামড়ে হেসে থুতনি ধরে মুখটা উপরে তুলে বললো,

‘ এতো লজ্জা আমার ব‌উয়ের?’

‘ আপনি কেমন জানি করে তাকিয়ে থাকেন আমার লজ্জা লাগে। আপনি অন্যদিকে তাকান আমি একটু ভালো করে দেখি আপনাকে।’

‘আমার ও তো আমার ব‌উকে দেখতে ইচ্ছে করে কিন্তু তার এতো লজ্জা যে আমি তার নাক আর কপাল ছাড়া কিছুই দেখতে পারিনি। এতো মাথা নিচু করে থাকতে পারে এই লজ্জা বতী।’

বর্ষা লজ্জা পেয়ে সরে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ থাক দেখার দরকার নাই‌। আমি চেঞ্জ করে আসছি ঘুম পাচ্ছে খুব।’

বলেই বর্ষা পালাতে ছুটতে চাইলো ওয়াশরুমের দিকে। কিন্তু তূর্য তা হতে দিলো না। বর্ষার হাত চেপে ধরে সামনে এনে দাড় করিয়ে দিল। আর বললো,

‘ আগের বাসর টা তুমি ঘুমিয়ে আর চিৎকার চেঁচামেচি করে নষ্ট করেছো এবার তো তা করতে দিচ্ছি না। এবারের এই রাত চির স্মরনীয় করে রাখবো‌। আর এখনি কিসের চেঞ্জ এতো সুন্দর করে ব‌উ সাজালাম ভালো করে না দেখেই নষ্ট করবো নাকি।’

বর্ষাকে কোলে তুলে তূর্য ছাদে নিয়ে এলো। বর্ষা অবাক চোখে ছাদ দেখছে এতো সুন্দর করে সাজিয়েছে ফুল দিয়ে বর্ষা চোখ সরাতে পারছে না। ফুলের বিছানা যার কোন ছাদ নাই আছে খোলা আকাশ আর আকাশ জুড়ে আছে অসংখ্য তারা আর চাঁদ যার আলোতে ছাদ হয়ে উঠছে অন্য রকম রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। বর্ষার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক।
তূর্য প্রিয়তমার হাসি উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এগিয়ে এসে দুহাতে বর্ষার মুখটা ধরে কপালে ও ওষ্ঠে চুম্বন করলো‌। বর্ষা মাথা তুলে তূর্য এর দিকে তাকালো। তূর্য ফটো করেই ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো আর একটা কাঠগোলাপ সামনে ধরে বললো,

‘ আমার এই অগোছালো জীবনে আসার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে।আমার এই অন্ধকার জীবনে আলো হ‌ওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আশাহীন জীবনে আশার আলো দেখানোর জন্য ধন্যবাদ। আমাকে ক্ষমা করে সুযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমাকে বেছে নিয়ে বুকে মাথা রাখার জন্য ধন্যবাদ। আমার কষ্টে কষ্ট পাওয়ার জন্য আমি ভাগ্যবান। ভালোবেসে আমার হাতটা সারা জীবন এর জন্য ধরে থাকার জন্য ধন্যবাদ। আমায় একটা সংসার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।আমার শশুর শাশুড়ি তুললো বাবা মা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমাকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখ বাবা হ‌ওয়ার আনন্দ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। পরিশেষে এতোটা ভালোবেসে ভরসা করার জন্য আমি ভাগ্যবান খুব বেশি ভাগ্যবান। অনেক ভালোবাসি তোমায় কখনো আমাকে ছেড়ে যেও না জান। তাহলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাব‌। সারাজীবন থাকবে তো পাশে এই বুকের মাথা রেখে‌??’

বর্ষার চোখ দিয়ে গলগল করে পানি পরছে মাথা নেড়ে সায় দিতেই তূর্য উঠে ফুলটা চুলৈ আটকে দিলো তারপর শক্ত করে জরিয়ে ধরলো।
অনেক ঝড় ঝাপটার পর দুটি ভালোবাসার মানুষ এক হতে পেরেছে। তাদের এখন সুখের অশ্রুজল অক্ষি থেকে বর্ষন হচ্ছে।

আরিয়ান সেদিন ইয়ারপোর্টে যাওয়ার আগেই রাস্তায় টার্কের সাথে এক্সিডেন্ট করে। সেই এক্সিডেন্ট এ আরিয়ান প্যারালাইজ হয়ে হসপিটাল ভর্তি আছেন। আরিয়ানের বাবা মা নিজেদের অপকর্ম আর ছেলেকে ভালো শিক্ষা না দিয়ে কতোবার ভুল করেছে বুঝতে পেরে ছে। তারা নিদ্রাকে সব ফিরিয়ে দিতে চায় নিদ্রা কিছুই নেয় না। সব এখন এতিমখানায় দিয়ে দিয়েছে আরিয়ানের বাবা মা। নিজের একটা বাড়ি ছিলো সেখানেই দুজন থাকেন আর আল্লাহ কাছে নামাজ পরে ছেলের আর নিজেদের অপকর্মের জন্য ক্ষণা চান। ছেলের সুস্থতা কামনা করেন।

শাওন আর তিশার বিয়ে তূর্য বর্ষার বিয়ের দুই মাস পর ধুমধামের সাথেই সম্পূর্ণ হয়।
এদিকে নিদ্রা সব সুখ পেলো একটা ঝড় বয়ে যায়। তিনমাসের প্রেগন্যান্সির সময় বাথরুম আছাড় খেয়ে সন্তান হারায়। সাথে হারায় সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা। এতেই পরিবারের সবার দিকে থেকে নিদ্রার জন্য ভালোবাসা আস্তে আস্তে কমে যায়। নিদ্রা ভয় পেতে থাকে অভ্র ও কি মুখ ফিরিয়ে নিবে। কিন্তু অভ্র এমন কিছু করে না‌। নিদ্রার পাশে থাকে। ভরসা দেয়। এমনিতেই এমন অবস্থায় নিদ্রা ভেঙে পরে তার মধ্যে শশুর শাশুড়ি সবার থেকে অবজ্ঞা পেয়ে ভেতরে ভেতরে জর্জরিত হয়ে পরে। আর এজন্য সুইসাইড করতে চেষ্টা করে। অভ্রের ধৈর্য্য এর বাদ ভেঙে যায় ‌ তখন অভ্র নিদ্রার হাত ধরে বেরিয়ে আসে পরিবার থেকে।

নয়মাস পর বর্ষার কোল জুড়ে আগমন করে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের। তূর্য মেয়েকে কোলে তুলে কেঁদে ওঠে। নয়মাস তূর্য বর্ষার খুব খেয়াল রেখেছে পাঁচ মাস আসতেই বর্ষার মা মেয়ের কাছে চলে আসে। এদিকে নিদ্রাও হাসপাতালে থেকে মাঝেই এসে দেখেছে। ভাইয়ের সন্তান কোলে নিয়েই নিদ্রা মাতৃত্বের স্বাদ নেয়।
বাধা বিপত্তি ছাড়া কোন সম্পর্ক তৈরি হয়ে উঠে না। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই প্রতিটা পদে পদেই বাধা আসে আমরা ভেঙে পরি আবার নিজেকে সামলে মাথা তুলে দাঁড়ায়। সব ঝড় ঝাপটা সামলে সামনে এগিয়ে চলি‌। তূর্য বর্ষা, নিদ্রা অভ্র ওদের জীবনেরও অনেক ঝড় এসেছে। ওরা তা সামলে এগিয়ে এসেছে। সামনেও আসবে তখনও ঠিক সামলে নিবে‌।

সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। আর দোয়া রাখবেন আমার জন্য। যেন আপনাদের আরো সুন্দর সুন্দর গল্প উপহার দিতে পারি। তূর্য আর বর্ষাকে আপনারা মিস করবেন কিনা জানি না! ওরা আপনাদের হৃদয়ে কতোটা জায়গা দখল করতে পেরেছে জানা নেই। কিন্তু আমি খুব মিস করবো। গল্পটা লিখতে‌ লিখতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছিলো। এখন আর লিখতে হবে না। সবাই সম্পুর্ন গল্পটা নিয়ে একটু সুন্দর মন্তব্য করবেন। যাতে আমার লেখায় তৃপ্তি খোঁজে পাই। ধন্যবাদ সবাইকে আমার ভালোবাসা নিবেন। লাভ ইউ অল ❤️❤️
তূর্য বর্ষাকে নিয়ে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে ভুলবেন না কিন্তু।

(সমাপ্ত)