দ্বিতীয় সূচনা পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯+৪০+৪১

0
602

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৩৭
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

কেবিনে রাখা হয়েছে অয়নন্দিতাকে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সে। ফারহান কেবিনে ঢুকতেই অয়নন্দিতাকে দেখতে পায়। হাতে সেলাইন পুষ করা। ডান পায়ে বেশ মোটা করে ব্যান্ডেজ করা। কপালের এক পাশে একটু খানি ব্যান্ডেজ৷ বাম হাতের কনুইতেও ব্যান্ডেজ। দেখে মনে হচ্ছে ভালো ব্যথা পেয়েছে। সাজি, রওশন বেগম, অয়নন্দিতার মামা, মামী, হাসানের বউ সবাই কেবিনের বাইরে বসে আছে। ফারহান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কেবিন থেকে বের হয়ে আসে। সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে সাজি আর রওশন বেগমকে প্রশ্ন করে,
‘এসব কী করে হলো?’
ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে সাজি বলে,
‘আমি আমার ঘরে ছিলাম। মা কিচেনে ছিল। ভাবী গাছে পানি দেবে বলে ছাদে যায়। দক্ষিণ দিকের ছাদটায় তো রেলিং নেই। কোনোভাবে পিছলে হয়তো নিচে,,,’
সাজি কথা শেষ না করতেই রওশন বেগম বলেন,
‘এরপরই দারোয়ান চিৎকার করে। আমি চিৎকার শুনে বের হয়ে দেখি অয়নি নিচে পড়ে আছে।’
ফারহান নিজের চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে। মনে মনে ভাবছে কেন অয়নন্দিতা ছাদে গেল। কী প্রয়োজন ছিল সেখানে যাওয়ার। মারাত্মক কিছু হয়ে যেতে পারত।
সাজি আবার বলে,
‘ভাগ্য ভালো দো’তলার ছাদে যায়নি। নিচতলার দক্ষিণ দিকের ছাদে গিয়েছিল। ডান পায়ে ব্যথা বেশি পেয়েছে। কনুই ছিলে গেছে অনেকটা। তবে ভয়ের কিছু নেই।’
সাজির প্রত্যেকটা কথা শুনে ফারহানের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। না জানি কতটা ব্যথা পেয়েছে। কিছুক্ষণ পর অয়নন্দিতার মামা বললেন,
‘ফারহান, বাবা চিন্তা কোরো না। ভয়ের কিছুই নেই।’
কারো কথার কোনো জবাব দেয়নি ফারহান। খোঁজ নিয়ে সেই ডক্টরের কেবিনে যিনি অয়নন্দিতাকে দেখেছে। ডক্টরের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ডক্টরকেই বিরক্ত করে ফেলে ফারহান। বার বার প্রশ্ন করে ডক্টরকে অতিষ্ঠ করে ফেলে। অন্যান্য ডক্টর হলে এতক্ষণে রেগেমেগে আগুন হয়ে যেত। কিন্তু এই ডক্টর বুঝতে পেরেছে যে, ইনি তার বউয়ের চিন্তায় অস্থির। তাই এত প্রশ্নের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। ফারহান ডক্টরের কেবিন থেকে বের হয়ে অয়নন্দিতার কেবিনে যায়।
চেয়ার টেনে পাশে বসে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার ভালোবাসার মানুষটার দিকে। একটু আগে ডক্টরের সঙ্গে কথা বলার সময় জানতে পেরেছে অয়নন্দিতাকে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। তাই ঘুমোচ্ছে। ফারহানের ভীষণ ইচ্ছে করছিল অয়নন্দিতার হাতটা ছুঁয়ে দিতে।

আনুমানিক দশ মিনিট পর।
অয়নন্দিতা চোখ খুলে পাশে ফারহানকে দেখতে পায়। চোখ খোলার পর ফারহানকে দেখতে পাবে ভাবেনি সে। অয়নন্দিতার মনে হচ্ছিল দারুণ একটা ঘুম দিয়েছে সে। কিন্তু হাতটা নাড়াতে গিয়েই প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে সে। পা টা যেন কত কেজি ওজন হয়ে আছে। নাড়ানোর ক্ষমতা নেই এই মুহুর্তে। ফারহান অয়নন্দিতার হাতটা ধরে। হালকা হেসে প্রশ্ন করে,
‘পুরো চার ঘন্টা ঘুমিয়েছ।’
অয়নন্দিতা হেসে বলে,
‘আমি চার ঘন্টা ঘুমিয়েছি তুমি সেটা গুনেছ?’
দাম্পত্য জীবনের সম্পর্কটা যেমন এগিয়েছে তেমনি অয়নন্দিতার আপনি আজ্ঞে বলাটাও ঘুচেছে। এখন অয়নন্দিতার মুখে তুমি শব্দটাই বেশি সুন্দর লাগে। হাসপাতালের বেডে অয়নন্দিতাকে এইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে ফারহানের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল। তবুও সে নিজেকে শক্ত করে বসিয়ে রেখেছি। অয়নন্দিতা ফারহানের চোখের দিকে চেয়ে বুঝতে পেরেছে যে, ফারহাম ভালো নেই। শুধু ভালো থাকার খানিক অভিনয় করছে মাত্র।
‘তুমি কখন এসেছ?’
‘যখনই আসি। এখন কেমন লাগছে?’
‘মোটামুটি। তবে ততটা ভালো নেই।’
‘খুব ব্যথা হচ্ছে, তাই না?’
‘হ্যাঁ। যখন পড়েছি তখন মনে হচ্ছিল আমার শরীরের ভেতরের সব কিছু নড়ে গেছে। পায়ে ব্যথা লেগেছে। হাতের অবস্থাও হয়তো ভালো না।’
‘কে বলেছিল ছাদে যেতে?’
‘আমি তো প্রায়ই যাই। সাবধানেও থাকি। আজ কেন যেন সাইডে গেলাম আর ধপাস। একদম নিচে।’
‘কষ্ট হচ্ছে তোমার কথা বলতে। এরপরেও মজা করছ। কী বোঝাচ্ছ তুমি আমায়? তুমি ভালো আছো? তুমি ভালো নেই অয়নন্দিতা। ভালো নেই।’
‘তুমি আছো তো। ভালো হয়ে যাব।’
‘তুমি তো জানো অয়নন্দিতা, তোমায় আমি কতটা ভালোবাসি। যদি কিছু হয়ে যেত?’
‘আমায় ভালোবাসো?’
‘বাসি না বলছ?’
‘কে জানে।’
‘কিছু খাবে?’
‘নাহ। তুমি বসে থাকো। আমার ভালো লাগছে।’
‘বসে থাকলেই হবে? কিছু খাবে না তুমি? কিছু নিয়ে আসি।’
‘কিচ্ছু আনতে হবে না। বসো এখানে তুমি।’
বন্ধ কেবিনে অয়নন্দিতার পাশে বসে ফারহান কথা বলে যাচ্ছে। অয়নন্দিতাও ফারহানের কথা শুনছে। বন্ধুর মতো দু’জনে গল্প করে যাচ্ছে। সময়ের কোনো বাঁধাধরা নেই। কোনো তাড়া নেই।

রাতের বেলায় অয়নন্দিতাকে খাইয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছে। হসপিটাল থেকে বাসায় আসতে আসতে রাত নয়টা পার হয়ে যায়। তিন ভাই বোন মিলে অয়নন্দিতাকে নিয়ে বাসায় আসে। ফারহান নিজ দায়িত্বে অয়নন্দিতাকে তার কাছে নিয়ে আসে।
অয়নন্দিতার পাশে শুয়ে ফারহান ভাবতে শুরু করে, জীবন কেন এমন ভাবে ঘুরে যায়। অয়নন্দিতার কিছু হয়ে গেলে বেঁচে থাকা দায় হয়ে যেত। আমার জীবনে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে অয়নন্দিতার থাকাটা ভীষণ জরুরী। আমি কোনোভাবেই চাইব না অয়নন্দিতা হারিয়ে যাক। আমি কখনও চাইব না পুরনো ব্যথাটা নতুন করে শুরু হোক। অয়নন্দিতা, আমি চাইব না তুমি কখনও দূরে চলে যাও। তুমি আমার হয়ে থেকো, সারাজীবন। কারণ এই মন তোমায় ভালোবেসে ফেলেছে। অয়নন্দিতা তোমার সমস্ত দুঃখ, সমস্ত ব্যথা আমি আমার করে নেব। বন্ধু যখন হতে পেরেছি। ভালো যখন বেসে ফেলেছি তখন সমস্ত দুঃখ গুলোও আমার করে নেব। দ্বিগুণ ভালোবাসা দেব তোমায়। যেই ভালোবাসার সুতো কাটতে তোমার হাজার জনম পার হয়ে যাবে।

চলবে………………………

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৩৮
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

সারাদিন অফিস করলেও মন পড়ে থাকে অয়নন্দিতার কাছে। প্রতি এক ঘন্টায় দুইবার করে ফোন করে ফারহান। কখনও অয়নন্দিতাকে, কখনও সাজিকে, কখনও রওশন বেগমকে। বিকেলের পর পরই মন পাগলের মতো ছুটে বেড়ায় বাড়ির দিকে। হাতের বকি কাজগুলো ফেলে রেখেই চলে আসে অয়নন্দিতার কাছে। ফারহানের এমন পাগলামি দেখে অয়নন্দিতারও মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়।
অন্যান্য দিনের মতো আজও ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। ফারহান ঘরে ঢুকেই অয়নন্দিতার পাশে বসে। অয়নন্দিতা তখন বইয়ের পাতায় মুখ গুজে বসে আছে। ফারহান যে তার সামনে বসে আছে সেই খেয়াল নেই। ফারহান পলকহীন চোখে তার এই অসুস্থ বউটাকে দেখে যাচ্ছে। হেঁটে চলে বেড়ানো এত সুন্দর মানুষটা আজ দু’দিন হলো বিছানায় পড়ে আছে। তার গন্ডি এই ঘর পর্যন্তই। অনেক কষ্টে ওয়াসরুমে যাওয়া এরপর আবার বিছানা। ফারহান যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ নিজেই অয়নন্দিতার সব কাজ করে। অয়নন্দিতাকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে তার জামাকাপড় চেঞ্জ করা পর্যন্ত সব ফারহান নিজে করে। এতে তার কোনো বিরক্তি আসে না। বরং ভালো লাগে। আপন আপন লাগে।
বাম হাতের সাহায্যে অয়নন্দিতার মুখের সামনে থাকা বইটা সরিয়ে দেয় ফারহান। অয়নন্দিতা ফারহানকে দেখে হালকা হেসে ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলে। ঘড়িতে নজর দেয়। এখনও মাগরিবের আজান পড়েনি। এখনি ফারহান বাড়ি ফিরে এসেছে। অয়নন্দিতা বুঝতে পারছে তার জন্য ফারহান নিজের সমস্ত কাজ ফেলে চলে আসে।
‘এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে?’
অয়নন্দিতার প্রশ্নটি ফারহানের পছন্দ হয়নি।
‘আমি চলে আসাতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘একেবারেই না।’
‘তবে এমন প্রশ্ন করলে যে?’
‘প্রশ্ন করার কারণ আছে। আমার মনে হচ্ছে, তুমি আমায় নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস হয়ে গেছ। সমস্ত কাজকে দূরে সরিয়ে দিয়ে আমাকেই আগলে রেখেছ। এমন করলে তো কাজের ক্ষতি হয়ে যাবে। তাছাড়া বাবাও নেই। ফারাশ ভাইয়াও অফিসে যায় না যে তার উপর কিছু দায়িত্ব ফেলে দিবে। সব তো একা হাতেই করতে হয় তোমায়। সেইজন্যই বলা।’
ফারহান হাসে।
‘হাসছ কেন? হাসির কথা বললাম বুঝি?’
‘জি ম্যাডাম। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমার চাইতে তুমি ভীষণ চিন্তিত আমাদের বিজনেস নিয়ে।’
‘একদমই না। আমার জন্য সব কিছু এক সাইডে ফেলে রেখেছ। এটাই খারাপ লাগে।’
‘খারাপ কেন লাগে? অন্যান্য মেয়ে হলে তো খুব খুশি হতো।’
‘আমিও খুশি। কিন্তু আমি চাই তুমি আমার পাশাপাশি নিজের কাজকেও প্রাধান্য দাও।’
‘বড়ো বড়ো কথা অনেক হয়েছে। মেডিসিন নিয়েছিলে দুপুরে?’
‘হ্যাঁ।’
‘শরীর কেমন লাগছে এখন?’
‘ব্যথাটা আছে। এত দ্রুত সারবে বলে মনে হয় না। পায়ের দিকটায় কষ্ট হয় বেশি।’
‘এক কাজ করো অয়নন্দিতা, তোমার সমস্ত ব্যথা আমায় দিয়ে দাও।’
অয়নন্দিতা একটু শব্দ করে হেসে দেয়।
‘বাংলা সিনেমার হিরোদের মতো কথা বলছ তুমি।’
‘আর তুমি আমার হিরোইন।’
‘তোমার বাংলা সিনেমার হিরো হতে হবে না। তুমি আমার কাছের মানুষ হয়েই থাকো। ফুল অফ এটিটিউট এন্ড এংরি ইয়াংম্যান হয়েই থাকো। আমার এই ফারহানকেই ভালো লাগে। মিছেমিছি হিরো হতে হবে না।’
‘ইয়াংম্যান আমি? আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি। বয়স ৩৭+ হয়ে গেল।’
‘৩৭ বছর বয়সেও তুমি ইয়াং। আর বুড়ো হলেও আপত্তি নেই। আমিই তো পছন্দ করেছি।’
হাসি থামিয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে ফারহান। অয়নন্দিতাকে যত দেখে ততই নতুনত্ব কিছু আবিষ্কার করে সে। ফারহান অয়নন্দিতার হাত জোড়া আঁকড়ে ধরে। হুট করেই অয়নন্দিতার কপালে চুমু দেয়। অয়নন্দিতা ফারহানের চোখে নিজ চোখ রাখে। প্রশ্ন করে,
‘কী হলো, হঠাৎ চুমু খেলে?’
‘মন চাইল।’
‘এমন করে কী দেখছ?’
‘তোমায়। কঠিনকে কত সহজে সরল করে দাও তুমি। অয়নন্দিতা, তুমি সত্যিই অসাধারণ।’
‘আমি সাধারণ একজন মানুষ। আর তুমি আমার অসাধারণ স্বামী প্লাস বন্ধু। অসাধারণের সঙ্গে থেকে থেকে আমিও অসাধারণ হয়ে যাচ্ছি।’

অয়নন্দিতা বসে বসে ফ্রুট খাচ্ছে। ফারহান তার পাশেই। ল্যাপটপে কী যেন করছে। অয়নন্দিতা ফারহানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ফারহানের মুখশ্রীতে একটা চমক আছে। যেই চমক এক প্রকার শান্তি এনে দেয়। অয়নন্দিতার সব থেকে বেশি ভালো লাগে ফারহানের হাসি আর তাকানো স্টাইল। ফারহান যখন তার দিকে শান্ত নজরে তাকায় তখন মনে হয় সে এই দুনিয়াতেই স্বর্গলাভ করে ফেলেছে। ফারহান যখন তার দিকে তাকিয়ে হাসে মনে হয় সে যেন অজস্র ফুলের মাঝে শুয়ে আছে। ফারহান এমন একজন মানুষ যার দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকলে একবারের জন্যেও মনে হয় না একঘেয়েমি লাগছে। অয়নন্দিতা ভাবছে, শুনেছি মানুষ বলে, নদীর দিকে তাকিয়ে থাকলে অশান্ত মনটা শান্ত হয়ে যায় কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় ফারহানের দিকে তাকালে আমার মনটা এমনিতেই শান্ত হয়ে যায়। তবে কি নদী মানেই ফারহান। তার তাকানোটা হবে জোয়ার-ভাটা আর হাসিটা হবে স্রোত।
হঠাৎই ফারহানের ডাকে ধ্যান ভাঙে অয়নন্দিতার। অয়নন্দিতা তাকাতেই ফারহান ইশারা করে। অয়নন্দিতাও ইশারায় জানান দেয়– কিছুই হয়নি।

রাতে বেশির ভাগ সময় ফারহান জেগে থাকে। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা অয়নন্দিতার কখন কী প্রয়োজন হয় সেই চিন্তাতেই ঘুম আসে না ফারহানের। এইতো গতকাল রাতের কথা। ফারহান অনেকটা সময় ধরে সজাগ থাকার পর কখন যে ঘুমিয়ে গেছে তার আর হুশ ছিল না। অয়নন্দিতার প্রচুর ওয়াসরুম পায়। সে চেয়েছিল ফারহান সজাগ না হোক। ভেবেছিল নিজেই একা একাই যেতে। কিন্তু তা আর হলো কই। উঠতে গিয়েই ব্যথার চোটে শব্দ করে ফেলে। ফারহান শব্দ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে ওঠে। উঠে দেখে অয়নন্দিতা খানিকটা উঁচু হয়ে বসে আছে তাও পুরোপুরি না। ফারহান অয়নন্দিতাকে জড়িয়ে ধরে। তার জন্য ফারহানের এখন ঘুমোতেও ভয় লাগে। তার শুধু একটাই ভাবনা, কবে অয়নন্দিতা ঠিক হবে। আবার আগের মতো হাঁটাচলা করতে পারবে।
অয়নন্দিতার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ফারহান মনে মনে বলে, তুমি মেয়ে আমার জীবনে আসার পর ধীরে ধীরে জীবনটাই বদলে যাচ্ছে অয়নন্দিতা। মাঝে মাঝে আমি ভাবি তুমি আমার জীবনে রুপকথার পরী হয়ে এসেছ। পরীরা যেমন সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয় তুমিও ঠিক তেমন। সব কিছু ভুলিয়ে দিয়েছ। তুমি আমার বাস্তব জীবনের মিষ্টি পরী। তুমি আমার মায়াপরী। আচ্ছা, আমাদের অনুভূতিগুলো এমন অদ্ভুত কেন অয়নন্দিতা। এই অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করতে করতে তোমায় যখন ভালোবেসে আমার মায়াজালে জড়িয়ে নিলাম ঠিক তখনই তুমি অসুস্থ হয়ে বিছানায়। মেয়ে তোমায় বোঝাব কেমন করে কতটা জ্বলছি আমি তোমার যন্ত্রণায়। সুস্থ হয়ে ওঠো মায়াপরী। তোমায় নিয়ে অনেক দূরে পাড়ি জমাব। তোমায় নিয়ে স্বপ্নের শহর গড়ব। সেই শহরে আদুরে রাজপ্রাসাদ বানাব। আর সেই রাজপ্রাসাদের রাজরানী হবে তুমি। আমার ভালোবাসার রাজরানী।

চলবে……………………………

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৩৯
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

আজ পনেরো দিন পর অয়নন্দিতা এখন মোটামুটি হাঁটাচলা করতে পারছে। তবে হাঁটতে গেলে এখনও একটু টান অনুভব করে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলাফেরা করে। অয়নন্দিতার জন্য ভীষণ মায়া হয় ফারহানের। ভাবে আরেকবার ডক্টর দেখাবে। পা টা আরও একবার এক্স-রে করাবে। দেখবে আর কোনো সমস্যা আছে কি না পায়ে। অয়নন্দিতা এই কয়েকদিনে ফারহানকে খুব কাছ থেকে অবজারভ করেছে। সারাদিনে সর্বোচ্চ তিন থেকে চার ঘন্টা অফিসে থাকত ফারহান। এরপরই চলে আসত বাসায়। এসে অয়নন্দিতার আশেপাশেই থাকত। কখন কী লাগবে তদারকি করত। সব মিলিয়ে ফারহান যেন অয়নন্দিতার ছায়া হয়েছিল এই কয়েকটা দিন।
ফারহান অফিসে যাওয়ার পর এই ঘরটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগে। অয়নন্দিতারও ভালো লাগে না। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ডায়াল করে ফারহানের নাম্বারে।
পর পর তিন বার কল হয়ে যাওয়ার পরেও ফোন রিসিভ হয়নি। অয়নন্দিতাও আর ফোন দেয়নি। এতবার ফোন দেওয়া ঠিক হবে না ভেবেই মোবাইলটা রেখে দেয় সে। মোবাইল রেখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোন বেজে ওঠে। ফারহান কল ব্যাক করেছে। অয়নন্দিতাও ফোন রিসিভ করে।
‘হ্যালো।’
‘হ্যালো। ফোন করেছিলে তুমি। আমি মিটিংয়ে ছিলাম। মাত্রই বের হলাম। বের হয়ে দেখি বেশিক্ষণ হয়নি যে তুমি ফোন দিয়েছ৷’
‘ভালো লাগছিল না তাই ফোন দিয়েছি।’
‘ভালো না লাগার কারণটা জানতে পারি কি?’
‘স্পেসিফিক কোনো কারণ নেই। তবে ভালো লাগছে না।’
‘ঘুরতে যাবে?’
‘মন চাইছে খুব।’
‘আস্তে আস্তে রেডি হও। আমি দুপুরের পর পরই আসছি।কেমন?’
‘কোথায় যাব আমরা?’
‘অনেক দূরে।’
‘অনেক দূরে বলতে, কতটা দূরে?’
‘যতটা দূরে গেলে আমরা দু’জন একা থাকব।’
অয়নন্দিতার হাসিটা ফারহানের কানে লাগতেই যেন তার মনটা আরও সতেজ হয়ে গেল। বাকি কথা শেষ করে ফোন রেখে দেয় ফারহান। হাতে অল্প কিছু কাজ আছে। কাজগুলো শেষ করেই বের হয়ে যাবে৷

সবুজ রঙটায় অয়নন্দিতাকে বেশ মানায়। সে সবুজ রঙের সালোয়ার স্যুট হোক কিংবা সবুজ রঙের শাড়ি হোক৷ আজ অয়নন্দিতা সবুজ রঙের একটা শাড়ি পরেছে। আয়নায় নিজেকে দেখছে। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে চেহারাটা তার মলিন হয়ে গেছে। তবুও হালকা মেক-আপে তাকে খারাপ লাগছে না। ন্যুড কালারের লিপস্টিক তার বরাবরের প্রিয়। এই ধরনের লিপস্টিক দিলে তার ঠোঁট জোড়া যেন আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। গলায় সরু চেইন আর কানে এক জোড়া ঝুমকো যাতে সবুজ রঙের স্টোন বসানো আছে। সাজটা সম্পূর্ণ হলেও চুলগুলো নিয়ে বিপাকে পড়ে সে। খোলা রাখবে নাকি খোঁপা করবে বুঝতে পারছে না। একবার ভাবছে খোলা রাখবে আবার ভাবছে নাহ খোঁপা করবে। সাজ শেষে চুল নিয়ে এই দোটানায় পড়া অয়নন্দিতার আগের অভ্যাস।
‘চুলের ডিজাইনে তোমায় একেক সময় একেক রকম লাগে। কখনও খোলা চুলে বেশ ভালো লাগে আবার কখনও খোঁপায় দারুণ লাগে। আজ বরং খোঁপা করো। ভালো লাগবে।’

কথাটা শুনে দরজার দিকে তাকালে দেখতে পায় সেখানে ফারহান দাঁড়িয়ে আছে। ব্ল্যাক জিন্স আর হোয়াইট শার্টে ফারহানকেও বেশ সুদর্শন লাগছে। অয়নন্দিতা ফারহানকে দেখে হালকা হেসে বলে,
‘তুমি কখন এলে?’
‘যখন তুমি চিরুনি আর চুল নিয়ে বিড়ম্বনায় ছিলে তখন।’
‘বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে বাঁধবো এদের।’
‘খোঁপা করো। ভালো লাগবে।’
ফারহানের কথানুযায়ী চুলে খোঁপা করে আর্টিফিশিয়াল গাজরা বেঁধে দেয়। নিজেকে আয়নায় দেখে মনে মনে বলতে থাকে, হ্যাঁ এখন একদম ঠিকঠাক লাগছে। সবুজ শাড়ির সঙ্গে খোঁপা। সব মিলিয়ে পারফেক্ট।
তবুও আরও একবার ফারহানকে জিজ্ঞেস করে,
‘কেমন লাগছে আমায়?’
ফারহান অয়নন্দিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। অয়নন্দিতার দুই গালে নিজের হাত রাখে। আলতো স্পর্শে আরেকটু কাছে টেনে নেয় অয়নন্দিতাকে। কপালে চুমু দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘অপূর্ব।’

চারটা বেজে গেছে। মিডিয়াম স্পিডে গাড়ি চলছে। অয়নন্দিতা গাড়ির জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখছে। চারপাশে শুধু গাছ আর গাছ। আমরা কোথায় যাচ্ছি– এই কথাটা কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর ফারহান উত্তর দেয়,
‘ফার্ম হাউজে যাচ্ছি।’
‘ফার্ম হাউজ! কাদের ফার্ম হাউজ?’
‘আগে পৌঁছই৷ এরপর সব বলব। তুমি কিছু খাবে?’
‘ফুচকা খেতে মন চাচ্ছে।’
‘আমারই ভুল হয়েছে। আমি কেন জিজ্ঞেস করলাম। আমার বোঝা উচিত ছিল অয়নন্দিতা ম্যাডাম ফুচকা পছন্দ করে।’
ফারহানের কথা শুনে অয়নন্দিতাও না হেসে থাকতে পারেনি। মাঝে মাঝে ফারহান এত মজা করে কথা বলে যে, না হেসে উপায় নেই।

আরও ত্রিশ মিনিট পর ফারহান তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছায়। গাড়ি থামিয়ে অয়নন্দিতাকে হাত ধরে গাড়ি থেকে নামায় সে। গাড়ি থেকে নেমে অয়নন্দিতা অবাক নয়নে চারপাশটা দেখতে থাকে। এ যেন ছবির মতোই সুন্দর। যেন রুপকথার গল্পে পড়া কোনো এক ছোটো গ্রাম। অথচ মাঝখানে কেবল একটি বিল্ডিং। আর চারপাশে পুরো গ্রামের মতো।
তাদের দেখে কয়েকজন লোক এগিয়ে এলো। এদের মধ্যে দু’জন মহিলাও আছেন। দু’জনই মোটামুটি বয়স্ক৷ আর দু’জন পুরুষ তারাও বয়স্ক। বাকি তিনজনের বয়স মোটামুটি পঁচিশ থেকে ত্রিশের মতো হবে৷ তারা সবাই এগিয়ে আসতেই ফারহান বয়স্ক সবাইকে সালাম দেয়। এরপর পরিচয় করিয়ে দেয় অয়নন্দিতাকে। অয়নন্দিতাও ফারহানের মতো তাদের সবাইকে সালাম দেয়। সালামের জবাব নিয়ে বয়স্ক একজন মহিলা বলে,
‘ফারহান বাবা, আসো। ঘরে আসো৷ তোমরা আসবা শুইনা সব ব্যবস্থা কইরা রাখছি।’
ফারহান ওই বয়স্ক মহিলার কথার জবাবে বলে,
‘ফুফু, আপনাদের বউমা কিন্তু একটু অসুস্থ৷ তাকে একটু যত্ন করতে হবে।’
‘তোমার মা ফোন দিয়া সব বইলা দিছে। সব ব্যবস্থা কইরা রাখছি। আসো, ঘরে আসো তোমরা।’

ফারহান অয়নন্দিতাকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার সময় অয়নন্দিতা প্রশ্ন করে,
‘তোমাদের ফার্ম হাউজ এটা?’
ফারহান রহস্যময় নজরে তাকিয়ে মুচকি হেসে জবাব দেয়,
‘হ্যাঁ। আমার ফার্ম হাউজ এটা।’

চলবে………………………..

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৪০
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

দুই গ্লাস পানি এনে রাখা হয়েছে টেবিলের ওপর। অয়নন্দিতা পানির গ্লাসগুলো দেখছে। গ্লাসের ভেতরে থাকা পানির রঙটা কেমন অন্যরকম লাগছে অয়নন্দিতার কাছে। ফারহান তাকে ইশারা করে পানিটা খাওয়ার জন্য। তখনই অয়নন্দিতা প্রশ্ন করে,
‘পানিটা দেখতে এমন লাগছে কেন?’
‘খেয়ে দেখ৷ ভালো লাগবে।’
এমন সময় ঘরে প্রবেশ করে একজন বয়স্ক মহিলা যাকে ফারহান ফুপু বলে ডাকে। তিনি অয়নন্দিতার কথা শুনতে পেয়েছেন। তিনি এসে হাসিমুখে বলেন,
‘বউ, এডা লেবুর শরবত। লগে পুদিনা পাতার রস আছে। একটু ট্যাংও মিশাইছি। খাও। ভাল্লাগব।’
শরবতের বর্ণনা শুনে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল অয়নন্দিতার কাছে। সে এক গ্লাস হাতে নিল। এক চুমুক দিতেই পুরো মুখ জুড়ে স্বাদ ছড়িয়ে যায়৷ বেশ তৃপ্তি নিয়ে পুরো শরবতটা খেয়ে নেয় অয়নন্দিতা। ততক্ষণে মহিলা চলে যান। অয়নন্দিতা বলতে শুরু করে,
‘তোমাদের যে ফার্ম হাউজ আছে আগে তো বলোনি।’
‘তোমাদের না এটা আমার ফার্ম হাউজ। আমি নিজে ডিজাইন করে বানিয়েছি।’
‘আসলেই?’
‘জি ম্যাডাম। আসলেই। নকলে না।’
‘খুব সুন্দর। চারপাশটা এত সুন্দর লাগছে।’
‘এখন তো সন্ধ্যা প্রায়। কাল সকালে দেখবে আরও সুন্দর লাগবে।’
‘কেমন একটা গ্রাম গ্রাম ফিলিংস পাচ্ছি।’
‘এটা তো গ্রাম-ই। তবে অজপাড়া গাঁ হলো আরও ভেতরে। আমি একটু সামনেই জায়গা কিনে বানিয়েছি।’
‘বেশ সুন্দর হয়েছে।’
‘ফুপুরা কিন্তু মাটির চুলায় রান্না করে। আমার খাওয়ার অভ্যাস আছে। তুমি খেতে পারবে তো?’
‘তুমি মাটির চুলার রান্নাও খাও?’
‘হ্যাঁ। আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমি সব কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারি।’
‘বিজনেস টাইকুন ফারহান শেখ এত কিছু মানিয়ে নিতে পারে এটা তো জানা ছিল না।’
অয়নন্দিতার কাছ থেকে এমন কথা শুনে ফারহান একটু স্তব্ধ হয়ে যায়। হাতে থাকা শার্টটা বিছানায় রেখে অয়নন্দিতার খুব কাছে চলে আসে। অয়নন্দিতা ফারহানের এমন আচরণে ভড়কে যায়। চোখ জোড়া কুঁচকে ফারহানের দিকে গাঢ় নজরে তাকায়। ফারহান অয়নন্দিতার একদম কাছে চলে আসে। থুতনিতে হাত রেখে ফারহান বলে,
‘বিজনেস টাইকুন এই ফারহান শেখ এমন অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে পারে যা তুমিও পারবে না। বুঝলে মেয়ে।’
ফারহানের কথা শুনে অয়নন্দিতা মুচকি হেসে গলা জড়িয়ে ধরে। বলে ওঠে,
‘আমিও পারতে চাই।’
ফারহান একটু শব্দ করে হেসে অয়নন্দিতার গালে চুমু দিয়ে বলে,
‘পারতে হবে না। আপনাকে নিয়ে আমার চিন্তা হয়। কখন কোথায় পড়ে যাবেন। পরে আমার রাতের ঘুম হারাম।’
ফারহান বেশ মজা করে কথা বলতে পারে। কথার ছলে হাসাতে পারে সবাইকে। বিশেষ করে তাকে।

গ্রাম সাইডে বেশ ঠান্ডা পড়ে। অয়নন্দিতা শাল জড়িয়ে ছাদে বসে আছে। ফারহানও তার পাশে বসে আছে। চারপাশে জোনাকপোকা ডাকছে। শীতের সন্ধ্যায় কুয়াশা পড়ছে। কিছুক্ষণ আগে এসে একজন গরম গরম ভাপা পিঠা দিয়ে গেছে। ফারহান আর অয়নন্দিতার এখানে আসা উপলক্ষে ভাপা পিঠা বানানো হয়েছে।
পাশে বসে ফারহান অনেক কথা বলছে। অয়নন্দিতা গালে হাত দিয়ে চুপচাপ শুনে যাচ্ছে ফারহানের কথাগুলো। ফারহানের সঙ্গ অয়নন্দিতার বেশ ভালো। সংসার জীবনে অয়নন্দিতা কিছু পাক বা না পাক ফারহানের মতো একজন স্বামীরুপে বন্ধু পেয়ে সে ভীষণ খুশি।
ফারহান কথা বলতে বলতে অয়নন্দিতার দিকে তাকায়। অয়নন্দিতার পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে ফারহান তুড়ি মেরে অয়নন্দিতার চোখ পলক নামায়।
‘এইভাবে তাকিয়ে আছো যে?’
‘এমনি।’
‘এমনিতে কেউ তাকিয়ে থাকে বুঝি?’
‘আমি থাকি। বিশেষ করে তুমি যখন কথা বলো।’
‘ঠান্ডা বেশি লাগছে না তো?’
‘শাল জড়িয়ে আছি তো। ঠান্ডা বোঝা যাচ্ছে না।’
‘ওকে।’
কিছুক্ষণের নীরবতা। ফারহান সিগারেট টানছে। অয়নন্দিতা কিছু একটা ভেবে ফারহানকে জিজ্ঞেস করে,
‘কিছু মনে না করলে তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
‘করো।’
‘বন্দনাও কি এখানে এসেছিল?’
এমন পরিবেশে এমন প্রশ্ন ফারহান আশা করেনি। অয়নন্দিতা কখনও বন্দনাকে তেমন প্রশ্ন করেনি। ফারহান সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একটা নিঃশ্বাস ফেলে। এরপর স্মিত হেসে বলে,
‘এই ফার্ম হাউজটা বন্দনার কথা ভেবেই বানানো হয়েছিল অয়নন্দিতা।’
কথাটা শুনে অয়নন্দিতার বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। চোখ জোড়া এতক্ষণ উজ্জ্বল থাকলেও এখন সেই চোখ জোড়ায় পানি এসে জমাট বেঁধেছে। গভীর দৃষ্টিতে ফারহানের দিকে তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতা। ফারহান কী যেন ভেবে অয়নন্দিতার দিকে তাকায়।

চলবে……………………..

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৪১
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। পানিও যেন আটকাচ্ছে। অয়নন্দিতা বহু কষ্টে নিজের ইমোশনকে কন্ট্রোল করছে। ফারহান যখন থেকে বলেছে এই ফার্ম হাউজটা বন্দনার কথা ভেবেই বানানো হয়েছে তখন থেকেই বুকে ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার। ব্যথাটা এইজন্য হচ্ছে না যে ফার্ম হাউজটা বন্দনার জন্য বানানো হয়েছে। ব্যথাটা এইজন্য হচ্ছে যে একটা মানুষ একটা মানুষকে কতটা ভালোবাসলে একটা স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে পারে। অন্যকে ভালোবাসার এমন অসাধারণ ক্ষমতা এই মানুষটার এত বেশি যে অপর মানুষটা বাধ্য হয় তার প্রেমে পড়তে। তবে তার সাথেই কেন এমন হলো। কোথায় আছে বন্দনা? অয়নন্দিতা ভাবছে, আদৌ আছে তো? অয়নন্দিতা একটা ব্যাপারে বেশ অবাক হয়। ওই বাড়িতে এই পর্যন্ত কেউ একবারের জন্যেও বন্দনাকে নিয়ে কথা বলে না। এমন কি সাজিও না।
দূরত্ব বজায় রেখে ফারহান বসেছে। অয়নন্দিতা চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। দু”ফোঁটা অশ্রু মুছে নিয়ে তাকায় ফারহানের দিকে। ফারহান তখনও সিগারেট ফুঁকছে। ফারহানও নীরবতা পালন করছে। মনে মনে নিজেও গিলটি ফিল করছে ফারহান। ভাবছে অয়নন্দিতা কষ্ট পেলো না তো। হুট করে বন্দনার কথাটা বলা উচিত হয়নি। বুকটা জ্বালা করছে। চিনচিন ব্যথা করছে। আজও বন্দনার জন্য মন কেমন করে। তবে এই অনুভূতি সে কাউকে দেখায় না। বুঝতেও দেয় না। বন্দনা যে তার দুর্বলতা ছিল তা কারো চোখে পড়ার আগেই নিজেকে সামলে নেয়।
অয়নন্দিতার দিকে নজর যায় তার। জীবনের কঠিন মুহুর্তগুলো কীভাবে যে পার করেছে একমাত্র সে-ই বোঝে। একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মাঝে নিজেকে বন্দী করে রেখেছিল। কিন্তু এসবের মাঝে হুট করেই তার জীবনে অয়নন্দিতা প্রবেশ৷ প্রথম প্রথম বেশ অসুবিধা হতো ফারহানের। ধীরে ধীরে সব ঠিক হতে থাকল। অয়নন্দিতার সব কিছুই তার ভালো লাগে। অয়নন্দিতার কথাবার্তা, চলাফেরা, মুচকি হাসিটাও এখন তার প্রিয়। ফুচকা খেয়ে ঝাল সহ্য করতে না পেরে চোট পিটপিট করাও ফারহানের ভীষণ পছন্দের। সে মনে করে অয়নন্দিতার শরীর থেকে এক অদ্ভুত সুবাস ছড়ায়৷ অয়নন্দিতার চুলেও মাতাল করা সুবাশ আছে যা রাতের বেলায় ফারহানকে আকর্ষণ করে। তবে এত কিছুর পরেও
কেন বন্দনাকে সে ভুলতে পারে না। এই ভুলতে না পারা-ই ফারহানকে যন্ত্রণা দেয়। যেই যন্ত্রণাটা তাকে নিংড়ে নিংড়ে মারছে প্রতিনিয়ত।

অনেকক্ষণ কেটে যায়। প্রায় চল্লিশ মিনিট। ফারহান নিজেকে স্বাভাবিক করে উঠে দাঁড়ায়। অয়নন্দিতা ততক্ষণে বসা থেকে উঠে রেলিংয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। ফারহান ধীর পায়ে অয়নন্দিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। নিজের শরীরে ফারহানের স্পর্শ অনুভব কর‍তে পেরে অয়নন্দিতা বার কয়েক ঢোক গিলে নিজেকে আগের তুলনায় আরও স্বাভাবিক করে। ভাগ্যিস চোখের পানিগুলো আরও আগেই মুছে নিয়েছিল। ফারহান অয়নন্দিতার বাম কাঁধে নিজের মাথা রাখে। প্রশ্ন করে,
‘কী হলো, চুপ হয়ে গেলে যে।’
ফারহানের কথার জবাব দিতে ইচ্ছে করছে না। কারণ, এখন কথা বলতে গেলেই ফারহান তার কন্ঠস্বর শুনে বুঝে যাবে যে সে কান্না করছিল। তাই চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে করে অয়নন্দিতা। নীরবতা পেয়ে ফারহান বলে,
‘তুমি কেঁদেছ। আমি বুঝতে পেরেছি৷ তাই ধরা পড়ার ভয়ে কথা বলবে না এমনটা ভেব না অয়নন্দিতা। কথা বলো আমার সঙ্গে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে।’
অয়নন্দিতা চমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। ফারহান তাকে এতটা চমকে দেবে সেটা সে ভাবেনি। লাইটের স্বল্প আলোতে ফারহানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতা। ফারহান দেখছে অয়নন্দিতার চোখ চিক চিক করছে। স্বচ্ছ চোখ জোড়া একদম স্পষ্ট। অয়নন্দিতার চোখে নিজের ছবি দেখতে পাচ্ছে ফারহান। ভ্রু জোড়া উঁচিয়ে অয়নন্দিতাকে ইশারা করলে অয়নন্দিতা চোখের পলক ফেলে। ফারহান অয়নন্দিতার গাল জোড়ায় নিজের হাত রাখে। ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করে,
‘মন খারাপ করে দিলাম তোমার৷ তাই না?’
অয়নন্দিতা ঘাড়টা বাঁকা করে ফারহানের হাতে চুমু দিয়ে বলে,
‘উহু।’
‘তবে চুপ ছিলে যে?’
‘এমনি।’
‘কেঁদেছ কেন?’
প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না বলে মাথাটা নুয়ে রাখে অয়নন্দিতা। ফারহান মাথাটা তুলে নিজের মুখের সামনে ধরে।
‘বলো, কেঁদেছ কেন?’
‘ভেতরটায় একটা ব্যথা অনুভব হচ্ছিল। তাই কান্না পেয়েছে।’
‘আমায় নিয়ে ভাবছিলে। তাই ব্যথা অনুভব হয়েছে। তাই তো?’
‘হ্যাঁ। বুঝলে কী করে?’
অয়নন্দিতার প্রশ্নে ফারহান চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে তার চোখের দিকে। এরপর বলে ওঠে,
‘আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনি, দীর্ঘ বরস-মাস’
অয়নন্দিতা ফারহানের মুখে গান শুনে নিজেও পরের লাইন ধরে,
‘যদি আর কারে ভালবাসো
যদি আর ফিরে নাহি আসো
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও
আমি যত দুঃখ পাই গো’

অয়নন্দিতার মুখ থেকে গানটা শোনার পর ফারহান জবাব দেয়,
‘আমি আর কাউকে ভালোবাসি না৷ আমার ভালোবাসার মানুষ একজনই। আর সে হচ্ছে তুমি। মিসেস অয়নন্দিতা শেখ।’
এরপরই ফারহান অয়নন্দিতাকে জড়িয়ে নেয় নিজের বুকে। অয়নন্দিতা ঠান্ডা নিঃশ্বাস ছেড়ে ফারহানকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘আমি কখনও জানতে চাইনি বন্দনা সম্পর্কে। আজ যদি তোমায় বলি, আমায় বন্দনার গল্প শোনাও। শোনাবে আমায়?’
‘তোমায় আমি যতটা বন্ধু ভাবি তার থেকেও তোমায় আমি ভালোবাসি। হয়তো তুমিও আমায় ভালোবাসো। তোমার কষ্ট হবে অয়নন্দিতা।’
‘কতটা কষ্ট হবে?’
‘হয়তো অনেকটা।’
‘এখনও ভালোবাসো বন্দনাকে?’
‘বন্দনাকে ভালোবাসি না এটা শিওর থাকো। কিন্তু বন্দনাকে ভুলতেও পারি না।’
‘ভুলতে না পারার কারণ কী?’
‘কিছু স্মৃতি।’
‘ভালোবাসার নাকি বিষাদের?’
‘কষ্টের।’
অয়নন্দিতার নাকে লেবুর ঘ্রাণ আসছে। লেবুর কড়া ঘ্রাণে অয়নন্দিতার নাক ভারী হয়ে আসছে। মাথা তুলে সে ফারহানকে বলে,
‘বাতাবি লেবুর ঘ্রাণটা কত্ত সুন্দর। আশেপাশে গাছ আছে নাকি?’
‘হ্যাঁ। অনেকগুলো লেবু গাছ আছে। কাল সকালে দেখতে পাবে।’
অয়নন্দিতা আবারও বলে,
‘শোনাবে না আমায় বন্দনার গল্প।’
অয়নন্দিতার আবদারে ফারহান শান্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয় নারীটিকে। যে অনেক সময় কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে যায়। যার চোখে তাকালে ঝর্নার জলস্রোত দেখা যায়। যে পানি হয় পবিত্র এবং স্বচ্ছ।

চলবে…………………………….