এক মুঠো প্রেম পর্ব-২১+২২

0
428

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ২১

-প্রণব!!! তুই? তুই এখানে কীভাবে?

চোখে মুখে একরাশ বিস্ময় ফুটিয়ে তুলে প্রশ্ন করলো আনিলা। প্রণব সেদিকে কর্ণপাত করলো না। নিজের বুকের ওপর স্পৃহার ঠেকিয়ে রাখা মাথা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাত দিয়ে স্পৃহার গালে হালকা বারি দিয়ে ব্যস্ত স্বরে বললো,

-স্পৃহা, চোখ খোলো! লুক এট মি, স্পৃহা!

কিন্তু স্পৃহা নির্বিকার ভঙ্গিতে জ্ঞানহীন অবস্থাতেই পড়ে রইলো। প্রণব এবার ওকে কোলে তুলে নিয়ে প্রান্তিকে তাড়া দিয়ে বললো,

-মাকে ফোন দিয়ে আসতে বল! অথবা কোনো ডক্টর পাঠাতে বল। ফাস্ট!!

প্রান্তি মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে ফোন ঘাটতে শুরু করলো।

.

পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। স্পৃহাকে কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছেন। আপাতত ওর মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। স্পৃহার দিকে মুখ করে গম্ভীরভাবে দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে বসে আছে প্রণব। অদূরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে প্রান্তি। আনিলাও এক সাইডে দাড়িয়ে হাসফাস করছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না সে।

আনিলার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ উৎসুক দৃষ্টিতে সবটা পর্যবেক্ষণ করছে আশফি। অবশেষে নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে মুখ উঁচিয়ে আনিলার দিকে তাকিয়ে বললো,

-মাম্মা, তোমরা সবাই এমন স্যাড মুডে কেন দাঁড়িয়ে আছো? কিউট মাম্মা এভাবে শুয়ে আছে কেন? কী হয়েছে? আমায় বলো না!

আশফির কথা কানে পৌঁছুতেই প্রণব মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকায়। আনিলার দিকে তাকিয়ে মন্থর কন্ঠে বলে,

-তোর ছেলে?

আনিলা উপর নিচে হালকা মাথা দুলাতেই প্রণব জোরপূর্বক মুখে হাসির রেখা টেনে আশফির দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,

-হেই, চ্যাম্প! কাম টু মি।

আশফি ধীর পায়ে এগিয়ে এসে প্রণবের কোলে বসলো। প্রণব ওর মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,

-নাম কী তোমার?

আশফি স্পৃহার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,

-আমার তো অনেক নাম! তুমি আশফি বলেই ডেকো।

-আচ্ছাহ্? আমার নাম জানতে চাইবে না?

-তোমায় তো আমি চিনি-ই! তোমাকে তো সবাই-ই চেনে!! রকস্টার বলে কথা। টিভিতে তোমার অনেক গান শুনেছি। তোমাকেও অনেক দেখেছি, হুম!

প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে হেসে বললো,

-তাই নাকি? দ্যাট’স গ্রেট! তাহলে আমাকে তুমি কী বলে ডাকবে?

আশফি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,

-উমমম্… রকস্টার বলেই ডাকবো। মিস্টার রকস্টার! ওকে?

বলেই নিজের হাতের ছোট্ট মুঠো বাড়িয়ে দিলো। প্রণবও সেই মুঠোয় নিজের হাতের মুঠো মিলিয়ে হাসি মুখে বললো,

-ওকে, ডান! কিন্তু তুমি তো সেই কখন এসেছো! এখনো কিছু খাওনি। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। প্রান্তি, ওকে নিচে নিয়ে গিয়ে কিছু খাইয়ে দে তো!

আশফি মুখ ছোট করে বললো,

-হুম, অনেক খিদে পেয়েছে আমার। আমি খেয়ে আসছি এখুনি।

বলেই প্রান্তির হাত ধরে বেরিয়ে গেল। প্রণব আশফির ছোট্ট সত্তাটিকে অপলক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে ভাবলো, প্রকৃতি এতো নিষ্ঠুর কেন? এই নিষ্পাপ শিশুটাকে অন্তত নিজের নিষ্ঠুরতা থেকে বঞ্চিত করতে পারতো। জন্মের আগেই পিতৃহারা হলো। তবুও বাবা নামক একটা বটবৃক্ষের ছায়াতলে আশ্রয় পেয়েছিল সে। কিন্তু সেই ছায়াটাও ওর জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হলো না।

-এটা তোর বাড়ি? স্পন্দন ভাইয়া যে বললো স্পৃহা ওর ফ্রেন্ডের বাসায়। তার মানে তোর বোন স্পৃহার ফ্রেন্ড।

আনিলার বাক্যস্রোত কানে ভেসে আসায় চিন্তাজগতে ভাটা পড়লো প্রণবের। সে চোখ ঘুরিয়ে আনিলার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,

-সবটা তো বুঝতেই পেরেছিস! উত্তর আর কী দেবো?

-এতো বছরে একবার যোগাযোগ অন্তত করতে পারতি আমার সাথে!

প্রণবের ভ্রু কুঁচকে গেল। তপ্ত সুরে বললো,

-‘যোগাযোগ করতে পারতি’ মিনস হোয়াট? বিয়ে করে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলি তুই। তোর কাছে হয়তো আমাদের স্কুল টু কলেজ লাইফের বন্ধুত্ব থেকে সংসার জীবনটার প্রায়োরিটি বেশি ছিল! ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরও তোর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি আমি। কিন্তু কোনো খোঁজ পাইনি।

একদমে কথাগুলো বলেই আনিলার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাশভারী কন্ঠে বললো,

-‘যোগাযোগ করতে পারতি’ কথাটা আমার দিকে ছুঁড়ে না দিয়ে নিজেকেই বলতে পারিস। আই থিংক, দ্যাট উড বি মোর লজিক্যাল। এমন তো নয় যে, তুই জানতি না আমার ব্যাপারে কিছু! তোর ছেলেই একটু আগে বলে গেল সবটা। আমার সাথে দেখা করা অর কন্ট্যাক্ট করাটা খুব একটা কঠিন ছিল না তোর জন্য।

প্রণব কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইলো। আনিলা অপরাধীর ন্যায় মুখ ছোট করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রণবের কথাগুলোতে রাগ ও অভিমানের এক মিশ্রিত সুর উপলব্ধি করতে পারছে সে। তাই অপরাধী সুরে বললো

-আচ্ছা, সরি! বিয়ের পর থেকে একের পর এক ঝড় এমনভাবে আক্রমণ করছিল আমায় যে, মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার অবস্থাটা তখন যুক্তি খাটানোর মতো ছিল না। আজও নেই!

প্রণব আনিলার অবস্থাটা বুঝতে পেরে কিছুটা নরম হলো। নিভৃতে একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,

-সেজন্য-ই কথা বলছি তোর সাথে। নয়তো ইগনোর করতাম।

আনিলা আহত দৃষ্টিতে তাকালো প্রণবের দিকে। প্রণব প্রসঙ্গ পাল্টাতে আহিরের লেখা চিঠিটা দেখতে দেখতে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

-চিঠিটা এখন কেন দিয়েছিস স্পৃহাকে? এতো ওর কতো বড় ক্ষতি হলো, জানিস?

-ওর সবটা জানা জরুরি ছিল। আহিরের কাছে কথা দিয়েছিলাম আমি। সেটা খেলাফ করার ক্ষমতা আমার নেই।

প্রণব চিঠির ওপর থেকে চোখ সরিয়ে গম্ভীর চাহনি নিক্ষেপ করলো আনিলার ওপর। তেজস্বী কন্ঠে বললো,

-স্পৃহার হেল্থ ইস্যুটা আমার কাছে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট এখন। তবে আহিরের ব্যাপারটা ক্লিয়ার হওয়ায় ভালো হলো। নেক্সট টাইম ওকে এ ব্যাপারে কিছু বলার আগে আমায় জানিয়ে নিবি।

আনিলা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। হতবিহ্বল হয়ে বললো,

-স্পৃহা তোর বোনের ফ্রেন্ড, তাই না? তুই তো ওকে চিনিসও না! তাহলে ওর ব্যাপারে এতো সেনসিটিভ ……

প্রণব আনিলার কথা শেষ হওয়ার আগেই চিঠির ওপর মনোযোগী হয়ে ওকে আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

-আহির মারা গেল কীভাবে? কী হয়েছিল ওর?

আনিলার মুখ মুহুর্তেই অন্ধকার হয়ে গেল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। জড়িয়ে আসা গলায় বললো,

-ব্রেইন অ্যানিউরিজম। যেদিন স্পৃহা ওকে বিয়ে করতে রাজী হলো, সেদিন রাতেই ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমি ওকে হসপিটালে এডমিট করাই। সিটি স্ক্যান করানোর পর ডক্টর নিরাশ হয়ে বলেছিলেন যে, আহির তখন লাস্ট স্টেজে চলে গেছে। আর্টেরি অলরেডি ফুলে ফেটে যাওয়ার পথে। অপারেশন করালে বাঁচানোর চান্স নেই। মেডিসিন নিলে অনির্দিষ্টকালের জন্য আর্টেরি ফেটে যাওয়া আঁটকে রাখা যাবে। কিন্তু যেকোনো সময় সেটা ফেটে ব্লিডিং শুরু হতে পারে। তখন ওকে আর বাঁচানো যাবে না। কানাডা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেও আহির ডক্টরের সাথে ডিসকাস করেছিল। কারণ ও জানতে পেরেছিল, স্পৃহা সংসার জীবনে সুখী নেই। কিন্তু ওকে তখনও হতাশ হতে হয়। অপারেশন করায়নি। কারণ ও জানতো অপারেশন করালে ও বাঁচবে না। তাই ওষুধের ওপর ডিপন্ড করেই এতো দিন বেচে ছিল। কিন্তু মাস খানেক আগে আহির পা নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। মেডিসিনের সাইড এফেক্টের কারণে এমনটা হয়েছিল হয়তো! স্পৃহার অসুস্থতার কথা শুনে ঐ অবস্থাতেই বাংলাদেশে ফেরার জন্য পাগলামি শুরু করে। আমিও বাধ্য হয়ে বিডিতে ফেরার জন্য টিকিট বুক করে ফেলেছিলাম। কিন্তু ……

এটুকু বলেই আনিলা ফুপিয়ে উঠে। প্রণবের চোখেও পানি জমে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে চোখের পানি নিয়ন্ত্রণ করে সে বললো,

-কিন্তু…

আনিলা একটা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

-ফ্লাইটের দুদিন আগে সন্ধ্যায় আহিরের কান ও নাক দিয়ে ব্লিডিং শুরু হয়। আমি ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে চাইলে ও বাঁধা দিয়ে বলে, “আমার সময় শেষ হয়ে গেছে, আনিলা। আমি ব্যর্থ হয়ে গেলাম। আহির ইজ ডিফিটেড! স্পৃহাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে পারিনি। আয়াফকে দেওয়া কথাও রাখতে পারলাম না। আশফির বাবার অভাব পূরণে ব্যর্থ আমি। আমাকে ক্ষমা করে দিও।” বলেই একটা ডায়েরি দিয়ে বলেছিল যে, ওটার ভেতরে একটা চিঠি আছে। আমি যেন স্পৃহাকে চিঠিটা দেই। তারপর-ই নিজের চোখের সামনে আহিরকে শেষ নিঃশ্বাস নিতে দেখেছি আমি।

প্রণব সাথে সাথেই চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেললো। আনিলা কান্নামাখা গলায় বললো,

-আয়াফের মৃত্যু নিজের চোখে দেখিনি আমি। কিন্তু বিশ্বাস কর, আয়াফের মৃত্যুর চেয়ে আহিরের মৃত্যু আমায় বেশি কষ্ট দিয়েছে। ওর অসহায়ত্ব আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমার মনে হয় না, আহিরের চেয়ে বেশি স্পৃহাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে!

প্রণব দাঁতে দাঁত ঘষে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁকা হেসে বললো,

-সেটা তো সময়ই বলে দেবে! ইউ উইল হ্যাভ টু উইথড্র ইয়র স্পিচ। আহিরের প্রার্থনা বৃথা হওয়ার নয়।

# চলবে……

[রিচেক হয়নি। ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়। ]

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ২২

” আজকের ধাক্কাটা স্পৃহা কাটিয়ে উঠতে না পারলে ও একজন মানসিক রোগীতে পরিণত হবে।”

জানালা দিয়ে শো শো করে বয়ে আসা হিম শীতল হাওয়া পুরো ঘর জুড়ে বিচরণ করছে। ঘড়ির কাটা দু’টোর ঘর পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। স্পৃহা বিছানায় অবচেতনের মতো ঘুমোচ্ছে। গায়ে কম্বল, মাথার ওপর কিছুটা দূরে স্যালাইন ঝুলছে। প্রণব জানালার পাশে দাঁড়িয়ে একবার স্পৃহার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ঠোঁট গোল করে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে আবার বাইরে তাকিয়ে বললো,

” মানসিক রোগী মানে? মা, আমি জানি ওর শরীরের অবস্থা ভালো নয়। তার মানে এই নয় যে, ও ……”

প্রণবের কথা শেষ না হতেই মিসেস মেহরীন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন,

” ডাক্তার তুই নাকি আমি? মেয়েটার শরীরের অবস্থা একটু ইম্প্রুভড্ হয়েছে। এর আগেও ওর হাসবেন্ড-এর কাছ থেকে একটা ধাক্কা খেয়েছে ও। আর আজ আরেকটা কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে ওকে। ও একটা মানুষ, কোনো রোবট না। মন বলতে কিছু একটা আছে ওর। এই বয়সে এতো ট্রাজেডি সহ্য করাটা এতোও সহজ নয়। আর আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছি। আজকে ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে না পারলে ওর মানসিক অবস্থা অস্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

” যদি কাটিয়ে উঠতে পারে, তো?”

মিসেস মেহরীন চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ” আমার মনে হয় না এটা এতো সহজ হবে। আদৌ সম্ভব হবে তো?”

প্রণব আঙুল দিয়ে নাক ঘষে ভরাট কন্ঠে বললো,

” অসম্ভব কেন হবে? ও ঠিক নিজেকে সামলে নেবে। এটা আমার নিজের বিশ্বাস। আর……”

” প্রণব মেহরাজ- এর বিশ্বাস কখনো হারে না, তাই তো?”

প্রণব ঠোঁট প্রসারিত করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বললো,

” একজেক্টলি! আর স্পৃহার মেডিকেল রিপোর্ট গুলো নিজের কাছে রেখেছো নাকি হসপিটালেই?”

” হসপিটালেই আছে। কাল স্পৃহা আসবে নিতে। তখন ওকে কী বলবো?”

প্রণব রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,

” একটা কাজ করতে হবে তোমায়, মাই সুইট মাদার। কাজটা একটু রিস্কি। কিন্তু তোমায় সবটা হ্যান্ডেল করে নিতে হবে। ”

মিসেস মেহরীন অবাক হয়ে বললেন, “আবার কী কাজ?”

প্রণব একে একে সবটা বেশ নিখুঁতভাবে বুঝিয়ে দিলো। সব শুনে মিসেস মেহরীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

” সবই বুঝলাম। কিন্তু এটা করা কী ঠিক হবে?”

” তুমিই তো বলো তোমার ছেলে ভুল কিছু করতেই পারে না! আমি অনেক ভেবেচিন্তে কাজটা করছি। এটা ছাড়া আপাতত আর কোনো ওয়ে নেই। ”

মিসেস মেহরীন প্রসন্ন চিত্তে হেসে বললেন, “এখন কোথায় আছিস?”

প্রণব খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল এমন প্রশ্ন শুনে। আমতা আমতা করে বললো,

” বাসায়ই আছি। ”

” সেটা তো আমি জানিই! নিজের ঘরে আছিস নাকি ছাদে?”

প্রণব থতমত খেয়ে বললো, “আসলে…ঐ আর কি আছি এ…”

মিসেস মেহরীন ঠোঁট টিপে হেসে বললেন,

” মিথ্যে বলা তোর দ্বারা হবে না। কোথায় আছেন আপনি তা বেশ বুঝতে পারছি আমি। এখন রাখি। অনেক রাত হয়েছে। নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

” মা, তুমি যেমন ভাবছো, তেমন কিছু …”

প্রণবের কথা শেষ হওয়ার আগেই কলটা কেটে গেল। সেটা দেখে ও খানিকটা বিব্রতবোধ করলো। কী ভাবলো তার মা? নিজের ওপরই রাগ লাগছে ওর। কেন যে মিথ্যে বলতে পারে না? অসহ্য!!

নিজেকে কয়েকটা গালি দিয়ে চোখ ঘুরিয়ে স্পৃহার দিকে একবার তাকালো প্রণব। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার দিকে পা বাড়ালো। দরজা খোলার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই পেছন থেকে তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এলো।

” আহিরররর!!!”

চিৎকারটা কর্ণপথে তরঙ্গিত হতে প্রণব চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকালো। স্পৃহা চিৎকার দিয়ে শোয়া থেকে এক লাফে উঠে বসেছে। এরকম কিছুর ভয় পাচ্ছিল বলেই প্রণব এতো রাতে স্পৃহার ঘরে এসেছিল চেক করতে। কিন্তু ধারণা যে এভাবে সত্য পরিনত হবে, সেটা ভাবনাতীত ছিল।

প্রণব ছুটে এগিয়ে এসে স্পৃহার পাশে বসে ওর কপালে হাত দিয়ে চেক করে বললো,

” কী হয়েছে? খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন? শরীর খারাপ লাগছে? ওয়েট, আমি লাইট জ্বালাচ্ছি।”

বলেই বসা থেকে ওঠার জন্য প্রস্তুতি নিতেই স্পৃহা প্রণবের হাত দুই হাতে আঁকড়ে ধরে। প্রণবের ভ্রু আপনাআপনি কুঞ্চিত হলো। চোখ ঘুরিয়ে তাকালো স্পৃহার দিকে। ঘরের ভেতর জ্বলে থাকা নীলচে আলোয় স্পৃহার চোখের সামনে ফুটে উঠে এক পুরুষালি অবয়ব। প্রণবকে অবাক হওয়ার সুযোগ না দিয়েই স্পৃহা এক অদ্ভুত কাজ করে বসলো। মুহুর্তেই ঝাপিয়ে পড়লো প্রণবের বুকে। প্রণবের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। পরমুহূর্তেই স্পৃহার কান্নামিশ্রিত বাক্যস্রোত শুনে সব অবাকতা এক নিমিষেই উবে গেল,

” তুমি অনেক খারাপ, আহির। অনেক খারাপ। কেন মিথ্যে বলেছিলে আমায়? কেন আমায় দূরে ঠেলে দিলে? আমাকে কষ্ট দিয়ে কী আনন্দ পাও তোমরা? কিন্তু তবুও তোমায় কেন ভুলতে পারি না আমি? কেন তোমায় এতো দিনেও ঘৃণা করতে পারলাম না? তোমার মতো বাজে মানুষকে আমি একটুও ভালোবাসতে চাই না। একটুও না!!!”

স্পৃহার অভিযোগ শেষ হতেই কান্নাগুলো আরও বেশি জোর দেখিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো। প্রণব নিজেকে সামলে স্বাভাবিক করলো। মুহুর্তেই মন খারাপেরা এসে ভীড় জমালো তার অন্তর্দেশে। নিজের অজান্তেই এক হাত স্পৃহার মাথায় রাখলো সে। স্পৃহার কান্নার গতি যেন আরো বেড়ে গেল,

” আর কখনো যাবে না তো আমায় ছেড়ে? আমি একা একা কীভাবে বাঁচবো? আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমায় আর একা ফেলে যেও না, আহির!!”

শেষোক্ত কথাগুলো অনেকটা নিস্তেজ কন্ঠে বললো স্পৃহা। প্রণব মন্থর কন্ঠে বললো,

” কোথাও যাবো না।”

কথাটা স্পৃহা শুনলো কি না কে জানে? কয়েক সেকেন্ডে ঢলে পড়লো সে। প্রণব বুঝতে পারলো স্পৃহা আবারও অবচেতন হয়ে গেছে। ওকে শুইয়ে দিয়ে গায়ে কম্বল মুড়িয়ে দিলো। ওষুধের কড়া ডোজের কারণেই এমনটা হয়েছে, সেটাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মনের ভেতর ভয় দানা বাঁধছে প্রণবের। সত্যিই স্পৃহা মানসিক রোগী হয়ে যাবে না তো! পরমুহূর্তেই চোখ বন্ধ করে ভরাট কন্ঠে বললো,

“নো! প্রণব মেহরাজের বিশ্বাস এতো সহজে হেরে যেতে পারে না।”

বলেই স্পৃহার দিকে এক পলক তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিলো।
________________________

মিসেস মেহরীনের চেম্বারে বসে আছে স্পৃহা আর প্রান্তি। স্পৃহা একদমই জড় বস্তুর মতো বসে আছে। ওর চুপ হয়ে যাওয়াটা সবাইকে ভাবাচ্ছে। তবে এখন কথার প্রেক্ষিতে মাঝে মাঝে সায় দিচ্ছে স্পৃহা। যেটা দেখে প্রান্তি একটু স্বস্তি পেল।

মিসেস মেহরীন আজ কথা বলার চেয়ে স্পৃহাকে পর্যবেক্ষণ করছে বেশি। তার দৃষ্টিতে সন্তুষ্টি ও প্রসন্নতার মিশ্র এক অভিব্যক্তি। স্পৃহার ওপর থেকে সেই দৃষ্টি যেন সরছেই না। স্পৃহার সেদিকে কোনো খেয়াল না থাকলেও প্রান্তির চোখে বিষয়টা বেশ ভালো করেই ধরা খেয়েছে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

-মা, রিপোর্ট গুলো দেখেছো? কী বুঝলে সব দেখে?

মিসেস মেহরীন একটু নড়েচড়ে বসলেন। চশমাটা ভালো করে নাকে বসিয়ে হতাশ কন্ঠে বললেন,

-রিপোর্ট চেক করে তো আমি রিসিপশনে জমা দিয়ে এসেছি। স্পৃহাকে সিগনেচার করে সেটা কালেক্ট করতে হবে। আর রিপোর্টে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

প্রান্তি অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,

-মানে কী? স্পৃহা আর কখনো ……

কথাটা আর শেষ করতে পারলো না প্রান্তি। আহত দৃষ্টিতে তাকালো স্পৃহার দিকে। স্পৃহা মাথা নিচু করে বসে থাকলেও এই মুহূর্তে তার ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। সে তো আগে থেকেই জানতো, এমনটাই হবে। সুখ নামক বস্তুটার থেকে বঞ্চিত হতেই সে পৃথিবীতে এসেছে। যেখানে কোনো সুখ-ই কপালে জুটলো না, সেখানে মাতৃত্বের সুখ আশা করা নিতান্তই যুক্তিহীন।

হসপিটাল থেকে রিপোর্ট কালেক্ট করে স্পৃহার হাত ধরে টেনে সেটা আবার মিসেস মেহরীন এর কাছে নিয়ে গেল প্রান্তি। ওর যেন বিশ্বাস-ই হচ্ছে না! মিসেস মেহরীন তপ্ত শ্বাস নিয়ে বললেন,

-আমি সবটাই চেক করেছি। রিপোর্টটা সঠিকই এসেছে।

তিনি স্পৃহার দিকে একবার তাকিয়ে আবার প্রান্তির দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন,

-শোন, তোকে একবার আমার সাথে আমার বাড়িতে যেতে হবে। কাজ আছে একটু।

প্রান্তি বিরক্তি নিয়ে বললো,

-তাহলে পিহু? ওকেও নিয়ে যাবো?

-না, ওর শরীর তেমন একটা ভালো নেই। আমি প্রণবকে ফোন করে দিয়েছি। ও এসে নিয়ে যাবে।

প্রান্তি অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,

-ড্রাইভারকে বলে দিলেই পারতে। ভাইয়া…

মিসেস মেহরীন রাগী গলায় বললেন,

-প্রণব এদিক দিয়েই বাড়ি ফিরবে, তাই ওকেই বলেছি। এখন আর কথা বাড়াস না। চল।

বলেই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলো তারা। পার্কিং লটে যেতেই প্রণবকে গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। সে ওদের তিনজনকে দেখেই হৃষ্টচিত্তে হেসে এগিয়ে এলো। স্পৃহার কোনো বিশেষ ভাবাবেগ নেই। ও শুধু শান্ত ভঙ্গিতে সবটা দেখে চলেছে।

প্রণব মিসেস মেহরীন এর দিকে তাকিয়ে বললো,

-সবটা ঠিকঠাকভাবেই হয়েছে তো?

মিসেস মেহরীন চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করতেই প্রণবের চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। ও নিজের মাকে ঝাপটে ধরে উৎফুল্লচিত্তে বললো,

-থ্যাঙ্কিউ! থ্যাঙ্কিউ!! থ্যাঙ্কিউ সোওও মাচ, মা!!! ইউ আর দ্য বেস্ট মম অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। আই লাভ ইউ, মা!!

প্রণবকে এতো খুশি হতে দেখে প্রান্তি বেশ অবাক হলো। কী এমন হলো যে ওর ভাই এতো খুশি? সবটাই মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে এখন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে প্রান্তি। আর স্পৃহা শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। এমুহূর্তে তার মনে কোনো প্রশ্ন জাগছে না আর না জাগছে কিছু জানার কৌতূহল! কোনো বিষয়ে কোনো আগ্রহ-ই আর অবশিষ্ট নেই।

# চলছে.………

[রিচেক হয়নি। ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়। ]