এক মুঠো প্রেম পর্ব-২৯+৩০ + ধামাকা পর্ব

0
430

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ২৯

-স্পৃহা এই বাড়ির বাইরে কোথাও যেতে পারবে না, ভাইয়া।

প্রণবের থমথমে বাচনভঙ্গি দেখে স্পৃহা ভ্রু কুচঁকালো। অবাক হয়ে বললো,

-কেন? আমি এখান থেকে গেলে প্রব্লেম কোথায়?

প্রণব ভরাট কন্ঠে বললো,

-আপনার এতো প্রশ্নের উত্তর এখন দিতে পারছি না বলে দুঃখিত, মিসেস নিস্তব্ধতা! আ’ম নট এট অল আন্সারেবল টু ইউ।

স্পৃহা রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। কিছু বলতে যাবে, তার আগেই প্রণব স্পন্দনকে নিয়ে বাইরে চলে গেল। স্পৃহা বিরক্তি নিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললো।
_____________________

স্পৃহা মুখ কালো করে বসে আছে। আজ স্পন্দনের বিয়ে। তেমন কোন বিশেষ আয়োজন ছাড়াই একদিনের অনুষ্ঠানে বিয়েটা হচ্ছে। কিন্তু স্পৃহার শুধু সেই অনুষ্ঠানটা এটেন্ড করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। স্পন্দন কড়া গলায় আদেশের সুরে বলে দিয়েছে, স্পৃহা যেন শুধু বিয়ের সময় উপস্থিত থাকে। তার আগে পরে নয়। নিজের ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে স্পৃহা হতবাক হয়ে গিয়েছিল। প্রণব ওকে কী এমন বলেছে যে, সে স্পৃহাকে বাড়িতে নিয়েই গেল না? আবার হুমকিও দিয়ে গেল!! সব ভাবতে ভাবতে সবটুকু রাগ প্রণবের ওপর গিয়ে জমাট হলো স্পৃহার। দাঁত কটমট করতে করতে নিজের বিরক্তি ঝাড়লো প্রণবের ওপর।

-মনে মন আমাকে বকা দেওয়া শেষ হলে একটু রেডি হওয়ার সময় হবে কি আপনার হাতে, মিসেস নিস্তব্ধতা?

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকাতেই দেখলো প্রণব ওর ঘরে ঢুকছে। ওকে দেখেই স্পৃহার রাগটা আকাশ ছুঁইছুঁই হয়ে গেল। কড়া গলায় বললো,

-আপনি আমায় বিয়েতে যেতে দিলেন না কেন?

প্রণব পকেটে দুই হাত গুঁজে ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

-যেতে দেইনি মানে? আপনি তো এখন যাচ্ছেন-ই! আমি আটকালাম কখন?

স্পৃহা চোখ রাঙিয়ে বললো,

-আমাকে দেখে আপনার বোকা মনে হয়? আমি কি কিছু বুঝি না নাকি? আপনি ভাইয়াকে উল্টাপাল্টা কিছু বুঝিয়েছেন নিশ্চয়ই। নয়তো ভাইয়া আমাকে সেদিন এখানে ফেলে চলে যেতো না। সাথে নিয়েই যেতো।

-আপনার ভাইয়া তো আর ছোট বাচ্চা না যে, আমি যা বুঝাবো, সেটাই মেনে নিবেন। নিশ্চয়ই যৌক্তিক কিছুই বলেছি। তবে এখন তো যাচ্ছেন-ই! রেডি হয়ে নিন। বিকেলে বের হতে হবে।

স্পৃহা মুখ গোমড়া করে বললো,

-আপনার আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করতে হবে না। নিজের কাজ করুন গিয়ে। যান!!

প্রণব হাসলো। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,

-আপনাকে আজ দেখতে যেন খুব বেশি সুন্দর না দেখায়- বিষয়টা মাথায় রেখেই নিজেকে সাজাবেন আশা করি।

স্পৃহা কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে তাকালো। কিন্তু ততক্ষণে প্রণব ওর দৃষ্টি সীমা পেরিয়ে গেছে। প্রণবের বলা কথা গুলো মনে মনে বার কয়েক আওড়ালো সে। ‘আপনাকে আজ দেখতে যেন খুব বেশি সুন্দর না দেখায়’ কথাটা মনে আসতেই নিজের প্রতি তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো স্পৃহার মুখে।

বিয়ে বাড়িতে সন্ধ্যার ঠিক আগমুহূর্তে পৌঁছালো স্পৃহা। ওর সাথে প্রান্তি আর প্রণবও এসেছে। প্রণব আসতে চায়নি যদিও। কিন্তু স্পন্দন এতো বার বলায় না আসাটা খারাপ দেখায়। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই ফাংশন এটেন্ড করতে হবে। নিজেকে যথাসম্ভব লুকিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেও কারো দৃষ্টি এড়াতেই সক্ষম হয়নি সে। এমন সুউচ্চ ও সুঠাম দেহকে কীভাবে আড়াল করবে সে- ভেবেই বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ফেললো প্রণব। স্পৃহা ওর অবস্থা বুঝতে পেরে মনে মনে হাসলো। প্রণবকে দেখা মাত্রই দলবেঁধে ছেলে-মেয়েরা ছুটে এলো। সেলফি ও অটোগ্রাফের পাঠ চুকাতে গিয়ে প্রণবের কপালে ঘাম জমে গেছে। তবুও যথাসম্ভব হাসিমুখে সবাইকে হ্যান্ডেল করতে পেরেছে সে।

বিয়ের সব রিচুয়াল শেষ করে স্পন্দন ও মেঘাকে নিয়ে স্পন্দনের বাসায় গিয়ে আবার ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে। প্রণব এবার তাড়া দিয়ে স্পৃহা আর প্রান্তিকে নিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। যদিও স্পৃহা থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু স্পন্দন তার ঘোর বিরোধিতা করে ওকে প্রণব আর প্রান্তির সাথে ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।

রাতের মধ্য প্রহরে রাস্তা অনেকটাই নীরব। স্পৃহা ফ্রন্ট সিটে চুপচাপ বসে আছে। আর প্রান্তি পেছনের সিটে বসে ঘুমে ঢুলছে। ড্রাইভ করলেও স্পৃহার কার্যকলাপ বেশ মনযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছে প্রণব। স্পৃহা যে এক দৃষ্টিতে অদূরে থাকা আইসক্রিম পার্লারের দিকে তাকিয়ে আছে, সেটাও প্রণবের দৃষ্টি এড়ায়নি।

-এই উইন্টারে আইসক্রিম খাওয়া উচিত না।

স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে প্রণবের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আমি কখন আপনাকে আইসক্রিম খাওয়ার কথা বললাম?

প্রণব অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বললো,

-বোঝার জন্য কি বক্তব্যকেই একমাত্র মাধ্যম বলে মনে হয় আপনার?

স্পৃহা আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললো,

-হয়তো না!! কিন্তু না বলা কথাগুলো তো আর সবাই বুঝতে পারে না। এমন কতো রাতে হাড়কাঁপানো শীতের সময়ও আমি, ভাইয়া আর আহির আইসক্রিম খেতাম। যদিও তখন আমি ওকে ভালোবাসতাম না। কিন্তু অনুভূতির সূচনা তো সেখান থেকেই!!

প্রণব মলিন হাসলো। বিরবির করে বললো,

-এর থেকেও আরো প্রগাঢ় অনুভূতির বেড়াজালে বন্দী হবেন আপনি, মিসেস নিস্তব্ধতা। আপনি তখনও কাঁদবেন। কিন্তু সেই কান্না হবে আজকের কান্নার উল্টো পিঠ!
__________________

সকালে রেডি হয়ে তাড়াহুড়ো করতে করতে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো স্পৃহা স্কুটিতে চাবি ঘোরাতেই থমথমে কন্ঠ ভেসে এলো,

-একা একা কোথায় যাচ্ছেন আপনি? আপনার একা কোথাও যাওয়া অসম্ভব!!

স্পৃহা চমকে উঠলো। প্রকৃতস্থ হয়ে পেছনে ফিরতেই দেখলো, প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। স্পৃহা কিছুটা বিরক্ত হলো। সবজায়গায় এই মানুষটা বারবার কপন নাক গলায়।

-আজ প্রান্তির ডিপার্টমেন্টে পরীক্ষা, তাই ও অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে। তাই আমাকে একা-ই যেতে হবে।

-আমার সাথে চলুন। আমি ঐ রাস্তা দিয়েই যাচ্ছি। এরপর কখনো একা কোথাও যাওয়ার দুঃসাহস দেখাবেন না।

শেষোক্ত কথাটা অনেকটা হুমকি স্বরূপ বললো প্রণব। স্পৃহা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে কড়া গলায় কিছু বলার ইচ্ছে থাকলেও সেটা আর করলো না স্পৃহা। এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। তাই বিরক্তি নিয়েই গাড়িতে উঠে বসলো সে। সেটা দেখে প্রণবের অধর কোণে ফুটে উঠলো হৃষ্টচিত্তের রেখা।

কিন্তু গেইটের কাছাকাছি গাড়ি এগোতেই মিস্টার চৌধুরীকে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রণবের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। স্পৃহা তাড়া দিয়ে বললো,

-গাড়ি থামান।

প্রণব নিজের বাবার ঠিক পাশে গাড়ি থামাতেই স্পৃহা জানালার গ্লাস নামিয়ে বললো,

-কী হয়েছে, আংকেল? এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে?

মিস্টার চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-আর বলো না, মা! আমার গাড়িটা গ্যারেজে দিয়েছে ড্রাইভার। আজ মিটিং আছে একটা। কীভাবে এটেন্ড করি সেটা?

বলেই প্রণবের দিকে তাকালেন তিনি। সেটা বুঝতে পেরে প্রণব অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। স্পৃহা বললো,

-আপনি এই গাড়িতেই উঠুন না!

মিস্টার চৌধুরী ইতস্তত করে বললেন,

-না, থাক! আমি দেখি অন্য কোনো ব্যবস্থা করতে পারি কি না।

কথাটা শেষ হতে না হতেই প্রণব ভরাট কন্ঠে বললো,

-মিসেস নিস্তব্ধতা! কাউকে বিপদে ফেলে রেখে নিজেকে প্রায়োরিটি দেওয়ার মতো মানুষ প্রণব মেহরাজ না। গাড়ির ব্যাকসিট খালি-ই আছে আশা করি।

মিস্টার চৌধুরী সন্তুষ্ট চিত্তে গাড়িতে উঠতে উঠতে বললেন,

-স্পৃহা মা, কেউ যদি উপকার করতে আসে, তাহলে তাকে ফিরিয়ে দিতে নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, প্রত্যয় চৌধুরী কাউকে হতাশ করেনা।

প্রণব কথাটা শুনে ভ্রু বাঁকিয়ে ফেললো। কিন্তু কোনে বাক্য ব্যয় না করে গাড়ি স্টার্ট দিলো। স্পৃহা মনে মনে বললো,

-এই বাপ-ছেলের তো দেখি সাপেনেউলে সম্পর্ক! এদের মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে কেমন হবে?? কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব?
__________________

-আন্টি, যদি আপনার কাছে কিছু চাই, সেটা রাখবেন?

স্পৃহার এমন কথা শুনে মিসেস মেহরীন অবাক হয়ে বললেন,

-এটা কেমন প্রশ্ন হলো, স্পৃহা? যদি আমার পক্ষে সম্ভব হয়, তাহলে অবশ্যই দিবো!

স্পৃহা নিঃশব্দে হেসে বললো,

-তেমন কিছু চাই না। শুধু চৌধুরী ভবনে একটা দিন আমার সাথে থাকবেন?

মিসেস মেহরীন থমকে গেলেন। তার মুখে আধার নেমে এলো। স্পৃহা ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সেটা বুঝতে পেরে বললো,

-আমায় ফিরিয়ে দেবেন না, আন্টি। শুধু একটা দিনই তো!

-এতে তোমার লাভ?

-আপনার কাছাকাছি থেকে মায়ের স্নেহটা উপভোগ করতে চাই। সাথে প্রান্তিও একদিন এ বাড়িতে নিজের মাকে সঙ্গী হিসেবে পেল।

মিসেস মেহরীন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

-কাল সকালে আসছি আমি।

বলেই ফোন কেটে দিলেন। স্পৃহা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। সে জানতো কাজটা এতোটাও কঠিন নয়। এখন শুধু অভিমানের পাহাড় গলানো বাকি।

সকাল সকাল নিজের মাকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে প্রান্তির চোখ কপালে! সে ডায়নিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে মুখ হা করে তাকিয়ে আছে। প্রান্তিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিস্টার চৌধুরী ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই থমকে গেল। মিসেস মেহরীনের সাথে চোখাচোখি হতেই দুজনেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অথচ দুজনের চোখই জলপূর্ণ।

প্রণব ব্রেকফাস্টের উদ্দেশ্যে নিচে নামতেই মিসেস মেহরীনকে দেখে অবাক হয়ে বললো,

-মা, তুমি এখানে?

-আমি আসতে বলেছি!

স্পৃহার কথা শুনে সবাই ওর দিকে তাকালো। স্পৃহা সাহস জুগিয়ে বললো,

-আমি চাই, আংকেল-আন্টির মধ্যে সব মান-অভিমান মিটে যাক!

প্রণব রাগী গলায় বললো,

-যেটা সম্পর্কে আপনি সম্পূর্ণ অবগত নন, সেটা নিয়ে আপনার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়, মিসেস নিস্তব্ধতা।

-হয়তো আমি সবটা জানি না। আপনিও তো জানেন না! তবে এতোটুকু আমি নিশ্চিত যে, ওনাদের দুজনেই নির্দোষ আর অহেতুক কষ্ট পাচ্ছে।

স্পৃহার কথা শুনে প্রণব দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো। আসল সত্যিটা তো সে-ও জানে না! কী বলবে এখন ও? কিন্তু তার বাবার কারণে তার মায়ের চোখের পানি গুলো তো প্রণব নিজে দেখেছে।

-নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও আমার মাকে রাতের পর রাত চোখের পানি ফেলতে হয়েছে।

-নিজের মায়ের দিকটাই দেখলেন? আপনার বাবার কষ্টটা বুঝতে পারলেন না? কেন পারেন নি? তিনি পুরুষ বলে কেঁদে বুক ভাসাতে পারেন না, তাই?

প্রণব স্পৃহার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। সত্যিই তো সে এভাবে কখনো ভেবে দেখেনি!

স্পৃহা প্রণবের দিকে এগিয়ে এসে বললো,

-সত্যি করে বলুন তো? আপনি আপনার বাবাকে ভালোবাসেন না?

প্রণব মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে। বলার মতো কোনো ভাষা অবশিষ্ট নেই। স্পৃহা সেটা বুঝতে পেরে বললো,

-আমি জানি না, আপনাদের মধ্যে কী হয়েছে? আর জানতেও চাই না। কিন্তু আমার মনে হয় নিজেদের ভেতরের কথাগুলো একে অপরের কাছে প্রকাশ করা দরকার। এরপর না-হয় সিদ্ধান্তে আসবেন!!

বলেই মিস্টার চৌধুরী ও মিসেস মেহরীনের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আপনারা কি আমার সাথে একমত?

দুজনে একসাথেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। স্পৃহার মুখে হাসি ফুটে উঠলো সেটা দেখে। মিস্টার চৌধুরী বললেন,

-যখন প্রান্তির বয়স পাঁচ বছর, তখন মেহরীন হসপিটালে চাকরি করতো। সেখানে ওর এক কলিগ একদিন আমায় ফোন দিয়ে বলে যে, মেহরীন না ওর সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত। আমি যেন মেহরীনকে ছেড়ে দেই। আমার ঐ ব্যক্তির সাথে অনেক কথা কাটাকাটি হয়। মেহরীনকে সব খুলে বললে, ও ঐ ব্যক্তিকে আবার জিজ্ঞেস করে। সে নাকি বলেছে, সে এমন কিছুই বলেনি। আমি ভয়েস রেকর্ড করিনি বলে কিছু বলতে পারিনি। তবে মেহরীনও বুঝেছিল যে, ঐ ব্যক্তি মিথ্যে বলছে। তাই এতে আমাদের মাঝে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু তার কয়েকদিন পরই আমার অফিসের ঠিকানায় বেশ কয়েকটা ছবি পাঠায় ঐ ব্যক্তি। ছবিগুলো দেখে আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, ওদের মধ্যে সত্যিই কোনো সম্পর্ক চলছে। এরপর থেকেই ভাঙন শুরু।

মিস্টার চৌধুরী বলা শেষ করতেই মিসেস মেহরীন বললেন,

-ডক্টর মিহান আমার কলিগ ছিল। উনি আমার সাথে মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক ব্যবহার করতেন। আমি ঠিকই বুঝতে পারতাম, ওনার উদ্দেশ্য ভালো না। প্রত্যয়-কেও বলেছিলাম সবটা। কিন্তু সেদিন ঐ ছবিগুলো দেখে ও আমায় অবিশ্বাস করে। তবে অবিশ্বাস করাটাই স্বাভাবিক। কারণ ছবিগুলো এডিটেড ছিল না। বরং এমন ভাবে তুলে উপস্থাপন করা হয়েছিল যেকেউ দেখলেই খারাপ ভাবে নিবে।

মিস্টার চৌধুরী বললেন,

-আমি পরে জানতে পেরেছিলাম, সবটা সাজানো ছিল। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল।

মিসেস মেহরীন বললেন,

-আমি ভেবেছিলাম প্রত্যয় সবটা জানতে পারলে আমার কাছে ফিরে আসবে। কিন্তু প্রত্যয় আসেনি। তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, প্রত্যয় আসল সত্যিটা জানতে পারেনি। আর ডক্টর মিহানও হয়তো আমায় খুঁজে পায়নি। কারণ আমি গ্রামে চলে গিয়েছি যেটা প্রণব ছাড়া কেউ জানে না।

প্রণব সবটা শুনে বাবা-মায়ের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-আর তোমাদের এই বোকামির জন্য আমাকে সাফার করতে হয়েছে। ইউ গাইস আর জাস্ট ইম্পসিবল!!!

বলেই দাঁত কিড়মিড় করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেল। স্পৃহা হতাশ গলায় বললো,

-যাব্বাবাহ!! দুই পক্ষের রাগ ভাঙানোর জন্য এতো কিছু করলাম। সবটা ঠিক হওয়ার সাথে সাথে আরেক জন রেগে গেল কেন?

# চলবে…

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩০

স্পৃহার উদ্যোগে আজ একটা সম্পর্কের ফাটল ভরাট হয়েছে। নিজের বাবা-মাকে এতো বছর পর একসাথে স্বাভাবিক ভাবে দেখে প্রান্তির চোখে পানি টলমল করছে। কখনো একসাথে বাবা-মায়ের আদর পায়নি ও। পাওয়ার আশাও ছিল না। অবুঝ শিশু থাকা অবস্থায়-ই বাবা-মাকে বিচ্ছিন্ন হতে দেখেছে সে। কিন্তু আজ এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তির আনন্দটা বলে প্রকাশ করার মতো না। ভেবেই স্পৃহাকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা গলায় বললো,

-থ্যাঙ্কিউ, পিহু!! থ্যাঙ্কিউ সো মাচ, ইয়ার। আমি কখনো ভাবতেও পারিনি বাবা-মায়ের মাঝে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাবে। তুই না থাকলে কখনো এটা সম্ভব হতো না।

স্পৃহা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। পাশ থেকে আনিলা অপ্রসন্ন সুরে বললো,

-সবই তো ঠিক হলো! কিন্তু প্রণব যে আবার চটে গেল, সেটার কী হবে?

স্পৃহা কিছু একটা ভেবে বললো,

-সেটার জন্যও একটা ব্যবস্থা করতে হবে। দেখি কী করা যায়!
________________

কুয়াশায় আবৃত নিস্তব্ধ নগরী। নিকষ কালো আকাশের একপ্রান্তে মেঘের আড়াল থেকে বারবার উঁকি দিচ্ছে এক ফালি চাঁদ। ক্ষণে ক্ষণে ঝি ঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। ছাদের এক প্রান্তে বসে গিটারের ওপর অগোছালো টান দিচ্ছে প্রণব। সুরও উঠছে এলোমেলো। তবে সুদক্ষ হাতে সুরটা বেশ সুনিপুণ ঠেকছে। আজ মন ভারাক্রান্ত হওয়ার পেছনে যথাযথ কারণটা ঠিক ধরতে পারছে প্রণব। কারণটা হয়তো তার বাবা, নয়তো তার মা! হয়তো উভয়েই, নয়তো কেউই না! নিবিষ্ট মনে ভাবনায় ডুবে থাকা অবস্থাতেই কারো আগমন তীব্রভাবে অনুভূত হলো তার। কারো পদধ্বনি প্রণবের সচকিত কর্ণকুহরে তরঙ্গিত হতেই সে সুর তোলা থামিয়ে দিলো। আগমনীর ব্যাপারে না দেখেও সে সম্পূর্ণ অবগত। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন। অন্য সময়ে মানবী-টির আগমনে অজান্তে, অনিচ্ছায় ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির রেখা ফুটে উঠত। কিন্তু আজ অন্দরমহলে জমাট হওয়া কালো মেঘের কারণে ইচ্ছে সত্ত্বেও আনন্দ গুলো ধরা দিচ্ছে না।

-আপনি কি চাইতেন না যে, আপনার বাবা-মা আবার এক হোক?

প্রণব সামনে থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকালো। স্পৃহার ওপর দৃষ্টি স্থির তার। হালকা আলোয় স্পৃহার হলদেটে মুখটা মায়াবী ঠেকছে। প্রণব চোখ বন্ধ করে নিলো। সবসময় ইচ্ছে-পাখি গুলোকে ডানা মেলে উড়তে দিতে নেই। চোখ সরিয়ে নিয়ে সে নিস্তেজ কন্ঠে বললো,

-এ ব্যাপারে আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিলো না। ছোট বেলায় বাবাকে সবসময়ই পাশে পেয়েছি একজন বেস্ট সাপোর্টার হিসেবে। কখনো ভাবিনি কালের বিবর্তনে সেই ব্যক্তিটার সাথে ই আমার সম্পর্কে মরিচা ধরবে। মা যেদিন বাবার সাথে ঝামেলা করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, সেদিন আমাকে আর প্রান্তিকে নিয়ে যেতে চাইলে বাবা আমাদের ছাড়েননি। মা খালি হাতেই চলে গিয়েছিল। এরপর মাঝে মাঝে আমি মায়ের সাথে দেখা করতে যেতাম। মায়ের কষ্ট গুলো খুব কাছ থেকে দেখতে পেতাম। বাবার ওপর রাগ হতো প্রচুর। কেন মাকে অকারণে এতো কষ্ট দিতো? ইচ্ছে করত মায়ের কাছে একেবারে চলে যেতে। কিন্তু প্রান্তির জন্য পারতাম না। ও একা একা থাকবে কী করে? বাবা ওকে কোনো মতেই ছাড়বেন না। বাধ্য হয়ে এ বাড়িতে থাকতে হয়েছে। বাবাও আগের মতো আমাদের সময় দিতেন না। কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে থাকতেন সবসময়। কাজে ডুবে থাকাটাই তিনি বেশি পছন্দ করতেন।

প্রণব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললো,

-স্কুলে পেরেন্টস ডে-এর দিন একা একা যেতাম। কখনো বাবা-মাকে সঙ্গী হিসেবে পাইনি। সবাই সবার পেরেন্টস-এর সাথে আনন্দ করত, খেলত, টিচারদের সাথে ডিসকাস করত। আর আমি শুধু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। ছুটির পর ড্রাইভার নিতে এলে অনেক বকতাম। কান্না করতে করতে বলতাম, “কেন নিয়ে এসেছ আজ স্কুলে? তুমি জানো না আজ প্যারেন্টস ডে? আমার তো বাবা-মা নেই! আমায় কেন স্কুলে নিয়ে এসেছ?” অনেক কান্না পেত। বাবা-মায়ের কাছে অভিযোগ করতে ইচ্ছে করত। কিন্তু কাউকেই কাছে পেতাম না। মায়ের কান্না দেখে তাকে দূরে ঠেলতে পারতাম না। কিন্তু বাবার কান্না তো দেখতে পেতাম না। তাই রাগটা উনার ওপরই পড়ত। বাবা বলতে ইচ্ছে করতো না। সবসময় মিস্টার চৌধুরী বলেই সম্বোধন করতাম। আমি নিজে এসব সহ্য করলেও প্রান্তিকে কখনো একাকিত্ব বোধ করতে দেইনি। ওর জীবনে একমাত্র গার্ডিয়ান আমি ছিলাম। বাবা-মা দুজনদুজনের আদর একাই দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এজন্যই ও আমাকে ছাড়া কিছু বুঝে না।

কথাগুলো বলার সময় প্রণবের কন্ঠ বারবার কেঁপে উঠছে। স্পৃহা সবটা নীরবে মনযোগ সহকারে শুনলো। কষ্টটা ওর বেশ ভালো করেই বোধগম্য হলো। কেননা সে নিজেও একই পরিস্থিতির কবলে পড়ে বড় হয়েছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে প্রশ্ন করলো,

-আপনার বাবাকে আপনি ভালোবাসেন না?

প্রণব মলিন হাসলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

-খুবই জটিল প্রশ্ন করে ফেললেন, মিসেস নিস্তব্ধতা! ছোট বেলায় অবুঝ ছিলাম। অনেক অদ্ভুত কাজ করতাম যার কারণ গুলো আজও আমার কাছে অজানা। সকালে উঠে বাসার সবগুলো গাড়ির টায়ার পাম্পচার করে দিতাম যেন স্কুলে যাওয়ার আগে বাবা আমার গাড়িতেই লিফট চায়। ফাদার’স ডে তে বাবার জন্য শার্ট বা ওয়াচ কিনে ওনার ব্যবহার করা শার্ট-ঘড়ির সাথে এক্সচেঞ্জ করে রাখতাম। বাবা নিজের অজান্তেই আমার দেওয়া গিফটগুলো ইউজ করতো। বাবার বার্থডে তে একা একা ছাদে বসে কেক কাটতাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে কতশত অভিযোগ করতাম। গল্প করতাম। ছোট ছিলাম তখন। কিন্তু সেই অনুভূতি গুলো আজও প্রখর। বাবা-মা দুজনকেই ভালোবাসি আমি। কাউকে কারো থেকে কম ভালোবাসি না। দুজনের প্রতি আমার অনুভূতি সমান।

বলে পেছনে ঘুরতেই প্রণব স্থির হয়ে গেল। তার সামনে তার বাবা-মা দুজনেই দাড়িয়ে আছে। দুজনের চোখই জলপূর্ণ হয়ে আছে। তার মানে প্রণবের বলা প্রতিটা কথা তারা শুনেছেন। প্রণব চোখ ঘুরিয়ে স্পৃহার দিকে তাকালো। স্পৃহা হালকা হেসে চোখ সরিয়ে নিতেই প্রণব বুঝতে পারলো, প্রণবের মুখ থেকে সবটা শোনার জন্যই স্পৃহা এসব জিজ্ঞেস করেছে। তাই নিজের প্রতি খানিকটা বিরক্তি নিয়েই বাবা-মায়ের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্ধত হলো সে।

-আমরা আমাদের ভুল শুধরে নিতে চাই। উই আর সর‌্যি!!!

মিস্টার চৌধুরী ও মিসেস মেহরীন একসঙ্গে কথাটা বলে উঠতেই প্রণবের পা থেমে গেল। সে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে পেছন ফিরে তাকালো। মিস্টার চৌধুরী ও মিসেস মেহরীন চোখে পানি রেখেই মলিন হেসে নিজেদের কান ধরলেন। মিস্টার চৌধুরী অনুযোগের স্বরে বললেন,

-এই যে কান ধরছি তো! আর জীবনেও তোকে কষ্ট দেব না।

বলেই মিসেস মেহরীনকে ইশারা করতেই তিনিও কান ধরে বললেন,

-আমিও তোদের আর একা ফেলে কোথাও যাবো না। আর রাগ করে থাকিস না, বাবা। এবারের মতো ক্ষমা করে দে।

ওনাদের কথা বলার ধরণ দেখে প্রণব চেষ্টা করেও হাসি আটকাতে পারলো না। সশব্দে হেসে বাবা-মাকে দু’হাতে আগলে নিলো,

-সিরিয়াসলি তোমরা এতো নাটক জানো? তোমাদের ওপর রাগ নেই। কিন্তু অনেক অভিমান হয়েছিল।

কোথা থেকে প্রান্তি দৌড়ে এসে ওদের তিনজনের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে বললো,

-এই ভাইয়া! তুই বাবা-মাকে একদম ভালো-টালো বাসবি না। তোর ভালোবাসার ভাগ আমি কাউকে দেবো না।

মিস্টার চৌধুরী ভ্রু কুঁচকে বললো,

-ওরে হিংসুটে!!!

প্রান্তি ভেংচি কেটে বললো,

-হ্যাঁ, হিংসুটে-ই। তোমরা এভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসছো কেন?

মিসেস মেহরীন বললেন,

-আমাদের তো অধিকার আছে! প্রণব আমাদের ছেলে, বুঝলি? তোর থেকে আমাদের হক বেশি।

-এ্যাহহহহ!!! বললেই হলো নাকি? আমি যা বলেছি, সেটাই হবে। আমার ভাইয়া শুধু আমাকে ভালোবাসবে। আর কাউকে না।

প্রণব কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,

-তাহলে তো তুই আমাকে বিয়েও করতে দিবি না দেখছি! তোর মতো হিংসুটে ননদের ভয়ে আমার বউ আমাকে ছেড়ে চলে যাবে!

-তোর বউয়ের ব্যাপার তো আলাদা! সেক্ষেত্রে কন্সিডার করা যায়। তবে অন্য কোনো ক্ষেত্রে না।

আনিলা আর স্পৃহা ওদের কাহিনী দেখে হাসছে। শেষে আনিলা তাড়া দিয়ে বললো,

-অনেক হয়েছে। এবার চলো সবাই ডিনার করবে। চলো! চলো!!

একে একে সবাই চলে যেতেই স্পৃহা সবার শেষে ছাদের বাইরে পা রাখলে। এমনসময় প্রণব ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। স্পৃহা খানিকটা চমকে উঠলো। প্রণব সেটা বুঝতে পেরে হাসলো। বললো,

-এতো কিছু করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারবো না। যার পুরো সত্তাটাই আমার জন্য স্পেশাল, তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভঙ্গিটাও স্পেশাল হওয়া উচিত।

বলেই স্পৃহাকে কিছু না বলতে দিয়ে ঝড়ের গতিতে চলে গেল। স্পৃহা কথার মানে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শুধু।
___________________

চৌধুরী ভবনের প্রতিটা মুহূর্ত-ই এখন সুমধুর। সম্পর্ক গুলো নতুন মাত্রায় নতুন অভিব্যক্তি নিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। প্রতিটা বেলা যেন স্বর্গীয় অনুভূত হয়। এমনই এক সকালে সবাই ব্রেকফাস্ট সেরে বসার ঘরে গোল হয়ে বসেছে। প্রণব ব্যতিত সবাই উপস্থিত। টিভিতে নিউজ চ্যানেল ওপেন করতেই নিচের লেখা গুলো পড়ে থমকে গেল স্পৃহা। সাংবাদিক নিজের বক্তব্য শুরু করতেই একে একে বিষয়টা সবার দৃষ্টি গোচর হলো। মিস্টার চৌধুরী দেখলেব পত্রিকার শিরোনামও একই খবর তুলে ধরেছে। এই দিনটাও দেখা বাকি ছিল স্পৃহার?

# চলবে……

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
💖ধামাকা পর্ব💖

“নিজের বোনের বান্ধবীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত রকস্টার প্রণব মেহরাজ! নিজের বাড়ির ভেতরেই চলছে তাদের অবৈবাহিক জীবনযাপন। রাত-দিন বিভিন্ন প্রহরে তাদের একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে। নিচের ছবি গুলোই তার প্রমাণ। অতএব, প্রণব মেহরাজ ও উল্লেখিত মেয়েটির মধ্যে বিদ্যমান ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে আমরা অনেকটাই নিশ্চিত।”

টিভির পর্দায় সাংবাদিকের বক্তব্যগুলো শুনে স্পৃহার পদতল শূন্য হয়ে যাচ্ছে যেন! ছবিগুলো দেখে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠছে। সেগুলোতে তো কোনো অশ্লীলতা নেই। কিন্তু উপস্থাপন ও বক্তব্যের জন্য সবার দৃষ্টিতে খুবই বাজে ঠেকছে বিষয়টা। সেদিন রাতে রাস্তায় আটকে যাওয়ার পর যে ছোট দোকান স্পৃহা আর প্রণব ডিনার করেছিল, সেই সময়ের একটা ছবি সবচেয়ে বেশি হাইলাইট করা হয়েছে। আর বাকিগুলো গাড়িতে থাকাকালীন আর প্রণবের বাড়ির সামনে দাড়ানো অবস্থায় ও ভেতরে প্রবেশ করার সময় তোলা হয়েছে। তাদের দুজনকে অনেকদিন যাবৎ অনুসরণ করে ছবিগুলো তোলা হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

মিস্টার চৌধুরী পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ফেললেন। ছবিগুলো দেখে রাগত কন্ঠে বললেন,

-এই আজেবাজে নিউজ বানানোর সাহস কী করে হলো এদের? একসাথে দেখলেই কি সম্পর্ক হয়ে গেল নাকি?

মিসেস মেহরীন বিমর্ষ কন্ঠে বললেন,

-অনেকবার, অনেক জায়গায় ওদের একসাথে দেখেছে। সেজন্যই তো এতো সাজিয়ে গুছিয়ে খবর বানিয়েছে। এখন তো সারাদেশেই এটা প্রচার হয়ে গেছে! কী যে হবে এখন?

স্পৃহার চোখ পানিতে টলমল করছে। চরিত্রহীনার পরিচিতি পাওয়াটাই কি বাকি ছিল তাহলে? ভাবতেই নিজেকে সবদিক থেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে। এ বাড়িতে থাকাটাই তার ভুল ছিল। এখানে না আসলে প্রণবের সাথে পরিচয় হতো না আর না আজ গোটা দেশ তার প্রতি আঙুল তুলে চরিত্রহীন বলে সম্বোধন করত!

-এই দিন দেখাটা-ই বাকি ছিল তাহলে! সব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার জন্য পৃথিবীতে এসেছিলাম। আজ তার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে!

স্পৃহার কান্নামাখা কথাগুলো শুনে সবাই ওর দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকালো। প্রান্তি ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বললো,

-কাঁদিস না, ইয়ার! তুই তো এখানে একা নেই। বিষয়টার সাথে ভাইয়াও জড়িত। দেখিস, সব ঠিক হয়ে যাবে।

আনিলা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,

-কিন্তু প্রান্তি, আমরা যত যা-ই বলি না কেন! দোষটা সম্পূর্ণ স্পৃহার ওপর গিয়ে-ই পড়বে। তুমি তো জানো আমাদের সমাজ সম্পর্কে। আমাদের সমাজের দৃষ্টিতে মেয়েরা-ই সবসময় অপরাধী সাব্যস্ত হয়।

-সব মেয়ে আর আমার মিসেস নিস্তব্ধতা তো আর এক নয়, আনিলা। মানুষটা আমার। আর যা আমার, তা একান্তই আমার। আমার জিনিসকে অপরাধী সাব্যস্ত করা তো বহুদূর, চোখ তুলে তাকালেই এই প্রণব মেহরাজ চৌধুরীর অগ্নিরূপ দেখতে হবে।

গাম্ভীর্য পূর্ণ বাক্য স্রোত কানে ভেসে আসতেই সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। হাতে ঘড়ি লাগাতে লাগাতে প্রণব সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। চোখ মুখ আজ অস্বাভাবিক ভাবে রক্তিমা পূর্ণ। মুখশ্রীর দিকে তাকালেই কেমন যেন ভয়ংকর লাগছে ওকে। প্রণবের সম্পূর্ণ অবয়ব দৃষ্টিগোচর হতেই ওর বলা কথা গুলো সবার মস্তিষ্কে আর ধরা খেল না। ওর রাগী ভাবভঙ্গি দেখেই সবাই খানিকটা থমকে গেল। প্রান্তি কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। প্রণবকে প্রচন্ড ভালোবাসলেও ওর রাগ সম্পর্কে সবার ভালো ধারণা আছে। আর আজকে যা ঘটেছে, এরপর প্রণব নিজের রাগকে একদম-ই নিয়ন্ত্রণে রাখবে না, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত-ই বলা যায়।

প্রণব স্যুটের হাতাটা কনুইয়ের কিছুটা নিচ পর্যন্ত টেনে তুললো। হোয়াইট টি-শার্ট এর ওপর ব্ল্যাক স্যুট ও জিন্সের ফর্মাল লুকে ওকে সুন্দর দেখালেও চোখে মুখে গম্ভীর ভাবটা চোখে পড়ছে বেশি। স্পৃহা প্রণবের দিকে একবার তাকিয়ে বিরক্তিতে দৃষৃটি সরিয়ে নিলো। আজ এই ব্যক্তিটার জন্য-ই সবটা ঘটেছে। সবকিছুর জন্য প্রণবকেই দায়ী মনে হচ্ছে ওর। রাগে-দুঃখে কান্না গুলো অক্ষি ছাপিয়ে গালে ছড়িয়ে পড়তেই প্রণব এসে একদম ওর মুখোমুখি দাঁড়ালো। এক আঙুলে স্পৃহার গাল থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু কণা দখলে নিল। স্পৃহা অশ্রুসিক্ত চোখে একবার প্রণবের দিকে আর একবার ওর আঙুলে থাকা পানির দিকে অবাক চোখে তাকালো। প্রণব গাঢ় গলায় বললো,

-আমার জিনিসগুলো এতো ঠুনকো না যে, নিজের ইচ্ছে মতো অপচয় করবেন। আপনার কান্নার অধিকার খুব তাড়াতাড়ি হরণ হতে চলেছে, মিসেস নিস্তব্ধতা। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি হোয়াট’স গোন্না হ্যাপেন আফটার আ ফিউ মোমেন্টস!

বলেই বাঁকা হেসে আঙুলের অগ্রভাগে থাকা অশ্রু কণা ছিটকে মারলো। পরমুহূর্তেই বাইরে থেকে তুমুল হৈচৈ এর আওয়াজ ভেসে এলো। প্রণব থমথমে গলায় সবাইকে বললো,

-প্রেস-মিডিয়ার লোক চলে এসেছে। সবাই ভেতরে চলে যাও। কেউ বাইরে বের হবে না আমি বলার আগ পর্যন্ত।

সবাই মাথা নাড়িয়ে উপরে চলে যেতে নিলে স্পৃহাও এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। হুট করেই প্রণব ওর কবজি চেপে ধরলো। স্পৃহা চমকে পেছন ফিরে তাকাতেই প্রণব মন্থর কন্ঠে বললো,

-আপনাকে যেতে বলিনি আমি। যেহেতু বিষয়টাতে আপনি আর আমি দুজনেই জড়িত, সেহেতু আপনাকে প্রেজেন্ট থাকতেই হবে। চলুন।

বলেই প্রণব ওর হাত ধরে নিজের পাশে দাঁড় করালো। কিন্তু হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেই রাখলো। ওর গার্ড ও সিকিউরিটিদের ইশারা করলো সবাইকে ভেতরে ঢুকতে দিতে। সাথে সাথেই হুড়হুড় করে দলে দলে মিডিয়ার লোকজন পৃরবেশ করলো। ক্যামেরা প্রণব ও স্পৃহার ওপর তাক করতেই কোনো প্রশ্ন করার আগে প্রণব বললো,

-স্টপ, গাইস! নিজেরা তো অনেক কিছুই শুনিয়েছেন আমাদের! এখন আর আপনাদের মুখ থেকে কিছু শুনতে চাই না আমি। আপনারা কী প্রশ্ন করবেন, তা আমার বেশ ভালো করেই জানা আছে। সবটাই জানাবো আপনাদের। একটু আগে যেই মসলা মেশানো নিউজটা টেলিকাস্ট করেছেন, ঠিক সেভাবেই এখন আমার বলা কথা গুলো লাইভ টেলিকাস্ট করবেন।

সবাই সম্মতি দিতেই প্রণব ভরাট গলায় বললো,

-একটু আগে নিউজ চ্যানেলে ও পত্রিকায় কী যেন প্রচার করেছিলেন। ‘প্রণব মেহরাজ বোনের বান্ধবীর সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত’- রাইট? আবার তার সাথে বিভিন্ন ছবিও বিশ্রীভাবে উপস্থাপন করেছেন, যদিও ছবি গুলোতে একচুলও উচ্ছৃঙ্খলতা নেই। কিন্তু একবারও সবকিছুর প্রেক্ষাপট যাচাই করেছেন? আমার বাড়িতে আমার বোনের বান্ধবী থাকলেই কি তার সাথে আমার অবৈধ সম্পর্ক থাকবে? যুক্তিটা একটু বেশিই হাস্যকর হয়ে গেল না? এখন নিশ্চয়ই বলবেন, “রাতের আঁধারে আপনাদেরকে একসঙ্গে দেখা গেছে।” হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই সেদিন রাতে আমরা একসঙ্গে ডিনার করেছিলাম। আর সেটাকে সূত্র করেই আজকের এই ঘটনার পরিকল্পনা শুরু। আমার কোনো বিরোধিতাকারী ব্যক্তি-ই সবটা করেছে যেন আমার জনপ্রিয়তা-টা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সে তো আর জানে না, প্রণব মেহরাজ চৌধুরীর দিকে আঙুল তোলা এতো সহজ কাজ নয়। তবুও শুধু আমাকে কিছু বললে তেমন কোনো যায়-আসত না। কিন্তু এমন একজন মানবীকে এর সাথে জড়িয়েছে, যার অবস্থান আমার জীবনের পুরো অংশ জুড়ে।

স্পৃহা বিস্ময় নিয়ে তাকালো প্রণবের মুখের দিকে। কিন্তু প্রণব শক্ত চোখে সামনে তাকিয়ে আছে এখনো। মিডিয়ার ব্যক্তিদের চোখেও একরাশ বিস্ময়।

প্রণব তার পাশে দাঁড়ানো নিজের পিএ-এর দিকে হাত বাড়ালো। পিএ ওর হাতে কতোগুলো কাগজ এগিয়ে দিতেই ও সেগুলো হাতে নিয়ে সামনের দিকে ছুঁড়ে মারলো। শক্ত কন্ঠে বললো,

-আর সেই মানবীটি-ই আমার স্ত্রী।

বলেই স্পৃহার হাত সজোরে টান দিয়ে নিজের কাছাকাছি এনে একহাতে জড়িয়ে ধরে বললো,

-ইয়েস, এই রাগিণী নারীটির অবস্থান-ই আমার সম্পূর্ণ সত্তা ও অস্তিত্ব জুড়ে। আর ইনিই আমার একমাত্র প্রেয়সী, প্রণয়িনী, অর্ধাঙ্গিনী ও স্ত্রী। আমার মিসেস নিস্তব্ধতা!!

স্পৃহা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো প্রণবের শুভ্রতা ঘেরা মুখশ্রীর পানে। প্রণব ওর চোখ জুড়ে বিচরণ করা কৌতূহল দেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। ওর চোখের সামনে বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারটা তুলে ধরলো যার শেষপ্রান্তে স্পৃহার স্বহস্তে করা সাইনটা জ্বলজ্বল করছে।

# চলবে……

[রিচেক হয়নি। ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়। ]