#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩১
-বিয়ে করা বউ সে আমার। স্পৃহা চৌধুরী, ওয়াইফ অফ প্রণব মেহরাজ চৌধুরী।
প্রণবের রাশভারি বক্তব্য শুনে সব কোলাহল মুহূর্তেই নীরবতায় পরিণত হলো। স্পৃহা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উপস্থিত সবার অভিব্যক্তি-ও একই। তাদের ঠোঁটের দুই রেখার মধ্যে ঈষৎ ফাঁক বিদ্যমান। অবাকতায় বাকহারা হয়ে গেছে সবাই। প্রণব সেটা দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। যদিও ওর চোখে মুখে এখনও রাগ স্পষ্ট। গাঢ় গলায় বললো,
-অবাক হচ্ছেন? হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে অবিশ্বাস করার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের ম্যারেজ পেপার-এর অনেকগুলো কপি দিয়ে দিলাম। ডেট দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, বিয়েটা দুই মাস আগেই হয়েছে। এখন আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় যাবো, তাকে কোথায় রাখবো, সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
কথার মাঝে হঠাৎ করে কেউ একজন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
-বিয়ে হয়ে গেলে সেটা গোপন কেন রেখেছেন, স্যার? কাউকে জানাননি কেন?
প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,
-নিশ্চয়ই আমার ব্যক্তিগত কোনো কারণ ছিল। এখন আপনাদের জন্য কি আমার পার্সোনাল কোনো ইস্যু রাখা যাবে না? আমার কি কোনো ব্যক্তি-স্বাধীনতা নেই?
কেউ আর বলার মতো কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। প্রণব সেটা দেখে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
-মূলত, বিয়েটা হুট করে হয়ে গিয়েছিল। অফিশিয়ালি জানানোর জন্য একটা অকেশন এর আয়োজন অবশ্যই করতাম। কিন্তু তার আগেই যা ঘটে গেল। তবে এটা নিশ্চিত থাকুন, আজকের এই রিউমারস এর সাথে যারা যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেককে পস্তাতে হবে। প্রত্যেককে!! কাউকে আমি একচুলও ছাড় দেব না। যারা আমাদের মধ্যকার পবিত্র সম্পর্কটাকে নোংরাভাবে রিপ্রেজেন্ট করেছে, তারা কোনো ক্ষমা ডিজার্ভ করে না। নাও প্লিজ এক্সকিউজ আস!!
বলেই প্রণব স্পৃহাকে টেনে নিয়ে ওপরে চলে গেল। স্পৃহা অনুভূতিহীন নিষ্প্রভ চোখে এতোক্ষণ তাকিয়ে ছিল শুধু। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ওর। প্রণবের ঘরে নিয়ে আসতেই বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে উপস্থিত থাকতে দেখে অনেকটা প্রকৃতস্থ হলো সে। প্রণবের মুঠো থেকে নিজের হাত ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে নিলো ও। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললো,
-মিডিয়ার সামনে ওসব মিথ্যে কেন বললেন? আপনার সাহস কী করে হলো আমায় নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দেওয়ার?
প্রণব স্পৃহার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মিসেস মেহরীন ব্যতিত বাকি সবাই ওদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঘরে বসে এতোক্ষণ তারা সবাই-ই প্রণবের বলা কথাগুলো লাইভ দেখছিল। এখন তো ওদের বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারও দেখানো হচ্ছে। কাল নিউজ পেপারেও এই খবরটা ছাপানো হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রণব স্পৃহার দিক থেকে স্বাভাবিক ভাবেই চোখ সরিয়ে নিলো। এমন একটা ভাব যেন স্পৃহা তেমন বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস-ই করেনি। কেউ একজনকে ফোন দিয়ে থমথমে গলায় বললো,
-বাসার সামনের দিকটা খালি হয়েছে?
-ইয়েস, স্যার। মিডিয়ার লোকজন চলে গেছে।
-যে তিনটা নিউজ চ্যানেল আর যে দুটো নিউজ পেপার সকালের খবরটা টেলিকাস্ট করেছে, তাদের ইমিডিয়েটলি ব্যান করে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।
-ওকে, স্যার। সব ফর্মালিটিস সহ এপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিয়েছি।
-গুড। শহরের বাইরে আমার বাগান বাড়িটার সব গোছগাছ কমপ্লিট?
-কেন, স্যার? ওখানে তো আপনি বা অন্য কেউ থাকেন না! তাহলে……
-দ্যাট’স নান অফ ইয়র বিজনেস! ঐ বাড়িতে আমি আজই উঠছি।
-ওকে, স্যার।
প্রণব ফোনটা পকেটে গুঁজে ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। অতঃপর স্পৃহার হাত চেপে ধরে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
-চলুন!!
স্পৃহা নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রণব বেশ জোরে আকড়ে ধরেছে। তবুও সে বৃথা চেষ্টা করতে করতে রাগী স্বরে বললো,
-কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়? আমায় স্পর্শ করেছেন কেন আপনি? হাত ছাড়ুন। আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না।
প্রণব ওকে গাড়িতে উঠিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। স্পৃহার সিট বেল্ট লাগিয়ে দিতেই ফিচেল হেসে বললো,
-আপনি বাধ্য যাওয়ার জন্য। নাও, প্লিজ নো মোর কোয়েশ্শেন্স।
স্পৃহা রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
-মানে কী? আশ্চর্য তো!! আপ.……
স্পৃহা কথা শুরু করার আগেই প্রণব ওর মুখ বেঁধে দিলো। মুখের বাধন খোলার আগেই ওর হাত দুটোও বেধে দিলো। যদিও দুটো কাজ করতে গিয়ে ওকে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। স্পৃহা হাত মোচড়ামুচড়ি করতেই প্রণব কপালের ঘামটা মুছে বললো,
-এতো লাফান কেন আপনি? ভালো কথা শোনার মানুষ তো আপনি একদমই নন। এজন্যই এই ব্যবস্থা করতে হলো।
স্পৃহা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো প্রণবের দিকে। প্রণব সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গাড়ি স্টার্ট।
___________________
আদ্র রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। সামনের ফ্লোর জুড়ে টিভির গ্লাসের কাচ ভেঙে ছড়িয়ে রয়েছে। টেবিলে রাখা আরেকটা ফুলদানি ভাঙা টিভিতে পুনরায় ছুড়ে ফেললো সে। বিছানায় অহেতুক হামলা চালিয়ে সব এলোমেলো করেও ক্ষান্ত হতে পারছে না সে। কেন এতো রাগ হচ্ছে তার? বারবার কানে শুধু প্রণবের বলা কথাগুলো বাজছে।
-ইয়েস, এই রাগিণী নারীটির অবস্থান-ই আমার সম্পূর্ণ সত্তা ও অস্তিত্ব জুড়ে। আর ইনিই আমার একমাত্র প্রেয়সী, প্রণয়িনী, অর্ধাঙ্গিনী ও স্ত্রী। আমার মিসেস নিস্তব্ধতা!! বিয়ে করা বউ সে আমার। স্পৃহা চৌধুরী, ওয়াইফ অফ প্রণব মেহরাজ চৌধুরী।
সকালের ফেইক নিউজটা দেখে আদ্র যতটা না অবাক হয়েছে, এই মাত্র প্রণবের লাইভটা তার থেকেও বেশি রাগ হচ্ছে এখন ওর। প্রণব স্পৃহাকে বিয়ে করেছে? কিন্তু কেন বিয়ে করেছে? স্পৃহা ওকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেল? কীভাবে রাজি হলো? প্রণবের সেদিনের বলা কথাগুলো মনে পড়লো আদ্রের,
–সে অনেক কথা। ওর ব্যাপারে কেউ কৌতূহল দেখাক, সেটা আমি মেনে নিবো না। শুধু এতোটুকু জেনে রাখ, ও একটা হারিয়ে যাওয়া অমূল্য সম্পদ যা বহু সাধনার মাধ্যমে ফিরে পেয়েছে কেউ।
এজন্যই প্রণব সেদিন এ কথাগুলো বলেছিল! তার মানে প্রণব আগে থেকেই স্পৃহাকে চেনে? চিন্তাভাবনা গুলো মাথার ভেতর জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে আদ্রের। নিজের মাথার চুল খামচে ধরে সে নিজেই নিজেকে বললো,
-না! প্রণবের সাথে দেখা করতে হবে আমার। ওর থেকে সবটা জানতে হবে। প্রণবকেও জানাতে হবে আসল সত্যিটা।
____________________
বাগান বাড়ির ভেতরে গিয়ে একটা বড় রুমে নিয়ে স্পৃহাকে ছেড়ে দিলো প্রণব। দরজা লক করে ওর হাতের ও মুখের বাঁধন খুলে দিতেই স্পৃহা ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। আঙুল তুলে চিৎকার দিয়ে বললো,
-ছোঁবেন না আপনি আমায়। ডোন্ট টাচ্ মি!! আপনার কোনো অধিকার নেই আমায় স্পর্শ ………
কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রণব স্পৃহার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের সাথে চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-আমার অধিকার নিয়ে আপনার আদৌ কোনো ধারণা নেই, মিসেস নিস্তব্ধতা। স্টিল, এই পৃথিবীতে আপনার ওপর যদি কারো সবচেয়ে বেশি অধিকার থেকে থাকে, তাহলে সেই অধিকারী ব্যক্তিটা হলো আমি। ইয়র লিগ্যাল হাসবেন্ড, প্রণব মেহরাজ চৌধুরী।
স্পৃহা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। বললো,
-কিসের হাসবেন্ড? আপনার সাথে আমার কোনো বিয়ে হয়নি।
প্রণব স্পৃহাকে ছেড়ে দিলো। পকেট থেকে ফোনটা বের স্পৃহার চোখের সামনে একটা কাগজের ছবি দেখিয়ে বললো,
-এই কাগজটা দেখতে পাচ্ছেন। বলুন তো এটা কিসের কাগজ?
স্পৃহা কম্পিত স্বরে বললো,
-ক্… কাবিননামা!!!
প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বললো,
-ইয়েস! এটার নিচে দেখেছো। আমার সাইন না! তোমার নিজের সাইনটা দেখো তো! এটা কি তোমার নিজের সাইন নয়?
স্পৃহা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাইনটার দিকে তাকালো। সাইনের নিচে থাকা তারিখটা দেখে মনে এলো, এটা তো সেদিনের সাইন, যেদিন স্পৃহা মিসেস মেহরীনের হাসপাতালে রিপোর্ট কালেক্ট করতে গিয়েছিল। স্পৃহা চকিত স্বরে বললো,
-তার মানে সেদিন রিপোর্টের কাগজে সাইন নেওয়ার সময় এই কাগজে সাইন নেওয়া হয়েছে? আর এজন্যই আপনাকে সেদিন এতো আনন্দিত দেখাচ্ছিল?
প্রণব কিছু বললো না। ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বুঝিয়ে দিলো, স্পৃহার ধারণাই ঠিক। স্পৃহা তেজী স্বরে বললো,
-আমি মানি না এই বিয়ে! আর না আপনাকে আমার স্বামী হিসেবে মানি। ভালো মনে করেছিলাম আপনাকে। বেশ সম্মান দেখাতাম। কিন্তু আপনি সেটার যোগ্যই নন! এভাবে একটা মেয়ের সাথে বিট্রে করতে আপনার বাঁধলো না? আর আপনি ভাবলেন কী করে এভাবে আমায় বিয়ে করার পর আমি আপনাকে মেনে নেবো?
প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো। বললো,
-ফার্স্ট অফ অল, আপনি মানুন আর না মানুন, বিয়েটা হয়েছে। সো, লিগ্যাসি অনুযায়ী, আমি আপনার বর। আর বিট্রে করার পেছনে অবশ্যই যৌক্তিক কোনো কারণ ছিল!
-কী কারণ? কেন আমায় বিয়ে করেছেন?
প্রণব চোখ মুখ শক্ত করে বললো,
-আ’ম নট আন্সারেবল টু ইউ। এখন আপনার কাছে কিছু বলা সম্ভব নয়।
-কেন সম্ভব নয়? কী চান আপনি? কেন এখানে নিয়ে এলেন আমায়? আপনি তো আমার ব্যাপারে সবটা জানেন! আমার আগেও একটা বিয়ে হয়েছিল। আর এখন আমি একজন স্টেরাইল। আমার কাছ থেকে আশা করার মতো তো কিছু নেই! কী চান আপনি?
প্রণব নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে বললো,
-যদি বলি কিছু একটা চাই, তাহলে দেবেন? শুধু একবার দিয়ে দেখুন, নিজের সবটুকু আপনার নখদর্পনে সমর্পণ করতে রাজি আমি।
স্পৃহা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-কী চান আপনি?
প্রণব ম্লান হেসে বললো,
– এক_মুঠো_প্রেম চাই। দেবেন?
স্পৃহা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো। এমন চাওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। বিস্মিত চোখে অপলক তাকিয়ে থাকতেই প্রণব হাসলো। বললো,
-আপনার চোখের ভাষা পড়তে পারি আমি, মিসেস নিস্তব্ধতা। যেহেতু আপনি দিতে পারবেন না, সেহেতু আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তরও আশা করবেন না এখন।
বলেই প্রণব দরজা খুলে চলে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হতেই স্পৃহা বললো,
-আরেহ্!! আপনি আমায় এখানে ফেলে কোথায় যাচ্ছেন?
প্রণব ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। বললো,
-কয়েকটা দিন এখানেই থাকতে হবে আপনার। চিন্তা নেই, আপনার কোনো সমস্যা হতে দেব না।আর এখান থেকে পালানোর বৃথা চেষ্টা করতে যাবেন না আশা করি।
প্রণব দরজা বাইরে থেকে লক করে চলে গেল। স্পৃহা চেষ্টা করেও আটকাতে পারলো না।
_____________________
প্রণব আর আদ্র মুখোমুখি বসে আছে। প্রণব টেবিলে থাকা পেপারওয়েটটা ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,
-হঠাৎ তোর অফিসে কেন ডাকলি বল তো!
-তুই স্পৃহাকে সত্যি সত্যিই বিয়ে করেছিস?
আদ্রের উৎসুক চাহনির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে প্রণব বললো,
-মিথ্যে মিথ্যে বিয়ে কীভাবে করে আবার?
-দেখ, আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি!!
কথা আদ্র বেশ বিরক্ত হয়ে বললো। প্রণব অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বললো,
-স্পৃহার এখন একটাই পরিচয়। মিসেস প্রণব মেহরাজ চৌধুরী। আমার মিসেস নিস্তব্ধতা। ওর ওপর কোনো অধিকার এখন অবশিষ্ট নেই।
আদ্র অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
-মানে??
প্রণব বাঁকা হেসে বললো,
-কেউ চলে ডালে ডালে, কেউ চলে পাতায় পাতায়। কিন্তু প্রণব মেহরাজ চৌধুরী চলে শিরায় শিরায়।
# চলবে……
#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩২
-কেউ চলে ডালে ডালে, কেউ চলে পাতায় পাতায়। কিন্তু প্রণব মেহরাজ চৌধুরী চলে শিরায় শিরায়।
প্রণব ঘাড় কাত করে পেপারওয়েটটার তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে। ওর চাহনি-ই যেন অনেক কথা বলছে যার অনেক কিছু-ই আদ্রের বোধগম্য হচ্ছে এখন। বিষয়টা কিছুটা আচঁ করতে পেরে আদ্র বেশ অবাক হলো। শুকনো ঢোক গিলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো,
-মানে? কী বলতে চাইছিস তুই?
প্রণব মুখটা স্বাভাবিক করলো। দৃষ্টি সরিয়ে আদ্রের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
-এটাই যেটা তুই বলতে চাইছিস। ক্লিয়ারলি বলতে গেলে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে তুই এখানে এসেছিস সেটা।
আদ্র হকচকিয়ে গিয়ে বললো,
-উদ্দেশ্য!!!
-নেই? কোনো কারণ ছাড়া তো আজ আমায় তোর সাথে দেখা করতে ডাকিসনি, রাইট? কিছু কথা জানা এবং কিছু কথা শোনার জন্য ডেকেছিস, যদিও সবটাই তোর জানা আছে। কিন্তু আসল সত্যিটাই তোর অজানা! ডু ইউ নৌ দ্যাট?
আদ্র অক্ষিপট মেলে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-আসল সত্যটা কী?
-এটাই যে, মিসেস নিস্তব্ধতা আমার। একান্তই আমার নিজের। আর আমার নিজের ব্যক্তিটার সাথে জড়িত প্রত্যেকটা বর্ণ আমার জানা। সুতরাং কে কে তার প্রাক্তন ছিল, সেটাও আমার অজানা নয়!
শেষোক্ত কথাটা প্রণবের কন্ঠে বেশ কাঠিন্যপূর্ণ শোনালো। আদ্র চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রণবের দিকে। কথা গুলোর মানে বুঝতে আর কোনো সমস্যা হচ্ছে না তার। প্রণব সবটাই জানে। আগে থেকেই জানে। জেনেশুনে কেন বিয়ে করলো স্পৃহাকে? এক প্রশ্নের আড়াল থেকে এখন একাধিক প্রশ্ন মাথায় আসছে। ভাবতে ভাবতে অনেকটা মুখ ফসকে প্রশ্ন করেই ফেললো,
-সবটা জানলে বিয়ে কেন করলি?
প্রণব ভ্রু উঁচিয়ে আদ্রের দিকে তাকাতেই আদ্র থতমত খেয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। প্রণব আবার হাসলো,
-কারণ আমি মেরুদন্ডহীন নই!
কথার সুরে ব্যাঙ্গ ও বিদ্রুপ স্পষ্ট। আদ্রের কান গরম হয়ে উঠলো মুহূর্তে-ই। প্রণব শান্ত গলায় বললো,
-ভালোবাসা! যদিও এটার সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। তবে একেকজনের জন্য ভালোবাসার সংজ্ঞা ও ধরন একেক রকম। কিন্তু সাধারণ বিষয়বস্তু একটাই- আমরা কারো দেহকে ভালোবাসি না। ব্যক্তিত্বকে ভালোবাসি না। স্পেসিফিক অঙ্গকে ভালোবাসি না। ইভেন, কারো মনকেও ভালোবাসি না। যদি কোনো একটা দিককে ভালোবাসি বা কোনো একটা দিক বাদে বাকি সব দিককে ভালোবাসি বলে দাবি করি, তাহলে সেটাকে ভালোবাসা বলে না। সেটাকে বলে মোহ। ভালোবাসাটা সম্পূর্ণতার সাথে সমানুপাতিক ভাবে সম্পৃক্ত। ব্যক্তির সম্পূর্ণ সত্তাটা যদি মনের আঙিনায় স্থান পেতে পারে, তবেই সেটাকে ভালোবাসা বলে।
আদ্র মাথা নিচু করে বসে আছে। ওকে নিশ্চুপ দেখে প্রণবের আরো অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এতো বাক্য ব্যয়ের সময় তার নেই। তার সংক্ষেপে বক্তব্যের ইতি টানার জন্য বললো,
-শেষ থেকেই নতুন সূচনা শুরু হয়। স্পৃহার জীবনেও সেই সূচনার সাক্ষাৎ হবে অতি শীঘ্রই। হয়তো স্পৃহার মনে আমার জন্য জায়গা আদৌ হবে কিনা আমি জানি না। কিন্তু আমার যেটা চাই, সেটা আমার চাই-ই চাই। এজন্যই ওকে নিজের সাথে আবদ্ধ করেছি।
বলেই আদ্রের কাছাকাছি গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
-সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিজের প্রাণভোমরাকে দূরে রাখলে বেঁচে থাকাটা অসম্ভব। আর আমার এতো তাড়াতাড়ি মরার ইচ্ছে নেই!
প্রণব দুর্বোধ্য হাসি দিয়ে শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেল। আদ্র ওর যাওয়ার পানে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শুধু।
_________________________
সকাল থেকে চার দেয়ালে বন্দী আবদ্ধ ঘরে একাকী প্রহর গুনছে স্পৃহা। এক কোণে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে সে। ডুবন্ত সূর্যের হরিদ্রাভ আভার এক ফালি রশ্মি জানালার কার্ণিশ ভেদ করে স্পৃহার পাচে পড়তেই মুখ তুলে পিটপিটিয়ে সামনে তাকালো সে। দিবালোকের শেষ প্রহর আগত। আর কিছু মুহূর্ত পরেই ইতি ঘটবে আজকের দিনটির।
সারা দিনে এক ফোঁটা পানিও মুখে তোলেনি স্পৃহা। খাবার ওর টেবিলে রেখে গেলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করেনি স্পৃহা। আবারও হাঁটুর ভাজে মুখ লুকিয়ে বসে রইলো সে। কিছুক্ষণের ব্যবধানেই দরজার নব মোচড়ের আওয়াজ কানে এলো। কিন্তু মুখ তুলে তাকানোর ইচ্ছে বা আগ্রহ কোনোটাই আপাতত নেই ওর।
-এভাবে না খেয়ে থাকলে আপনাকে আমি ছেড়ে দেবো ভেবেছেন?
স্পৃহা মুখ তুলে তাকালো। প্রণব ওর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। রক্তিম চোখজোড়া ভয়ঙ্কর ঠেকছে। কিন্তু মুহূর্তেই সেই দৃষ্টি ম্লান হয়ে গেল। আক্রোশ ক্রমশ শূন্যে নেমে আসতেই কোমল স্বর ভেসে এলো,
-নিজের এ কী অবস্থা করেছেন আপনি? চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে গেছে তো! কাঁদছেন কেন?
স্পৃহা চোখ আবার ঝাপসা হয়ে গেল। অলক্ষ্যেই অশ্রু গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। আক্রোশ মাখা কন্ঠে বললো,
-আহ্লাদ দেখাতে এসেছেন এখানে? লজ্জা থাকা উচিত আপনার! একটা মেয়েকে ধোকা দিয়ে বিয়ে করেছেন। এখন এখানে বন্দী করে রেখেছেন। সারাদিন পর রাতে এখানে এসেছেন। আপনার উদ্দেশ্য না বোঝার মতো অবুঝ আমি না!
প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,
-বেএএএশ বুদ্ধিমতী আপনি! আই শ্যুড এপ্রিশিয়েট ইয়র ইন্টেলিজেন্স। কিন্তু সেটার অপপ্রয়োগ-এর জন্য পরে আফসোস করতে হবে।
স্পৃহা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-আফসোস তো এখন হচ্ছে! কেন যে আপনাদের বাসায় ছিলাম এতোদিন? আপনার মতো জঘন্য একটা মানুষকে বিশ্বাস করেছিলাম বলেই আজ এই দিন দেখতে হলো! নিতান্তই ঘৃণ্য একজন মানুষ আপনি। আর আপনার জন্য আফসোস? হাহ! হাসালেন আমায়। আপনি মা-রা-ত্ম-ক বাজে একজন মানুষ।
প্রণব ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
-আর কিছু?
স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ছেলেটাকে এতো গুলো কথা শোনালো, তবুও কোনো বিশেষ ভাবাবেগ নেই কেন? সামান্য দুঃখবোধ বা লজ্জাবোধ কোনোটাই নেই তার। স্পৃহা বিরক্তি নিয়ে পাশ ফিরে তাকালো। বিরবির করে বললো,
-নির্লজ্জ কোথাকার!!
কথাটা প্রণবের কানে ঠিকই পৌছেছে। প্রণব ঠোঁট প্রসারিত করে রহস্যময় হাসি দিলো। স্পৃহার শ্রবণপথের একদম নিকটে ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে বললো,
-ইয়েস! আমি জঘন্য, ঘৃণ্য, খারাপ, বাজে, নির্লজ্জ, বেহায়া। একদম অসহ্যকর একটা মানুষ। কিন্তু আমি যেমনই হই না কেন, যা-ই হই না কেন, আপনারই তো! শুধু-ই আপনার। একান্তই আপনার এবং একমাত্র আপনার।
স্পৃহা থমকালো। ধীর গতিতে চোখ ঘুরিয়ে প্রণবের ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে। অদ্ভুত শান্ত সেই অক্ষিদ্বয়। কিন্তু সেই শান্ত ভঙ্গির আড়ালে থাকা তোলপাড় গুলো চোখে দৃশ্যমান নয়। ভেতরে ভেতরে ফুলে-ফেঁপে উঠছে আর্তনাদ গুলো। তারা একটা কথাই জানান দিচ্ছে,
-এটাই তো ছিল একমাত্র চাওয়া তোর জীবনে! কেউ একজন থাকবে। একান্তই তোর নিজের মানুষ হিসেবে। আজ সেটা পেয়েও গ্রহণ করাটা দুঃসাধ্য কেন? কেন ভাগ্য এতো নির্মম তোর প্রতি? কেন নিয়তি তোর সবটা কেড়ে নিলো? আর এমন ভাবেই কেড়ে নিয়েছে যে, সেই শূন্যতা পূরণ করাটাই অসম্ভব!
ভাবতেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো স্পৃহা। গাল ছাপিয়ে অশ্রু গুলো ঝরে পড়তে লাগলো আপন গতিতে। মাথা নিচু করেই বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। প্রণব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হাত বাড়িয়ে ওর মাথার ওপর রাখতে গিয়েও আবার মুষ্টিবদ্ধ করে সেটা ফিরিয়ে নিলো। নিজেকে কেমন যেন পাগল-পাগল মনে হচ্ছে ওর। অসহ্যকর একটা অনুভূতি! গাল থেকে জোরে একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
-আমার সামনে কাঁদবেন না, মিসেস নিস্তব্ধতা! এভাবে তো কোনোদিনই কাঁদবেন না। সহ্য করতে পারি না আমি।
স্পৃহা কান্না থামিয়ে অবাক চোখে তাকালো। প্রণব ততক্ষণে খাবারের প্লেট নিয়ে এসে হাত ধুয়ে খাবারে হাত লাগিয়ে ফেলেছে। খাবার মাখতে মাখতে বললো,
-আমি জানে, আপনি ভালো কথার মানুষ নন। তাই আপনাকে খাওয়ার জন্য একদমই জোর করবো না। কিন্তু আজকের রাতের জন্য আমি দুনিয়াদারি ভুলে যাবো। শুধু একটা জিনিস ভুলবো না। সেটা কী, জানেন? সেটা হলো আমি বিবাহিত, আর আমার বউ এখন আমার সাথে এক ঘরে বন্দী।
স্পৃহা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। দৃষ্টিতে ক্রমেই রাগ এসে ঘনীভূত হতে লাগলো। কড়া গলায় কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই প্রণব ওর মুখের সামনে খাবার এগিয়ে দিয়ে বললো,
-কথা বলে কোনো লাভ নেই। ইট’স নাথিং বাট এনার্জি ওয়েস্টেইজ। খেয়ে নিন। তাহলে ঝামেলা মিটে যায়।
স্পৃহা খাবারের দিকে একবার তাকিয়ে প্রণবের দিকে আবার তাকাতেই ও চোখ দিয়ে ইশারা করলো খাবার টুকু মুখে নেওয়ার জন্য। স্পৃহা কঠিন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঝামটা মেরে মুখ ফিরিয়ে নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-আপনার হাতে খাবো আমি? ইম্পসিবল!!!
-তাহলে আপনি চাইছেন আমি কিছুক্ষণ আগে বলা কথাটা কাজে পরিণত করি। রাইট?
স্পৃহা সরু দৃষ্টিতে তাকালো প্রণবের দিকে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
-কেন আঁটকে রেখেছেন আমায় এখানে? আপনি কেন বুঝতে পারছেন না যে, আমার পক্ষে কোনো কমিটমেন্টে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি আহিরকে ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনাও করতে পারবো না কোনোদিন। যেখানে আদ্রকে নিজের মনে জায়গা দিতে পারিনি, সেখানে …… আর আপনি তো ভালো করেই জানেন সবটা! কেন আমার মতো একটা স্টেরাইল মেয়ের জন্য এসব করছেন? সব ছেলের-ই স্বপ্ন থাকে, সে কোনো মেয়ের জীবনে প্রথম ও একমাত্র ব্যক্তি হবে। কিন্তু ……
স্পৃহার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রণব আনমনে বললো,
-প্রথম ব্যক্তি-ই তো ছিলাম! হারিয়ে না গেলেই পারতেন! তাহলে আজ আপনাকে এতো কষ্ট পেতে হতো না আর আপনার কষ্ট দেখে আমাকেও অন্তঃদহনে পুড়তে হতো না।
# চলবে……