এক মুঠো প্রেম পর্ব-৩৩+৩৪

0
455

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩৩

প্রণবের দিকে বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে খাবার চিবোচ্ছে স্পৃহা। হাত দুটোও বেধে দিয়েছে ওর। কিছুক্ষণ আগে স্পৃহা কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই প্রণব কৌশলে ওর মুখে খাবার পুরে দিয়েছে। পুনরায় খাবার এগিয়ে দিতেই স্পৃহা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। প্রণব ভ্রু উঁচিয়ে স্পৃহার দিকে তাকিয়ে বললো,

-খাবার খেয়ে পেট ভরতে না চাইলে খিদে দূর করার অন্য উপায়ও কিন্তু আমার জানা আছে। সেটা এপ্লাই করবো তাহলে?

স্পৃহা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। প্রণব ওকে খাইয়ে দিতে দিতে বললো,

-এভাবে হাত দিয়ে মাখিয়ে কখনো নিজেও খাবার খাইনি আমি। আজ সেখানে আপনাকে খাওয়াতে হচ্ছে! এই মোমেন্টটা অনেকটা ছবি তুলে বাধিয়ে রাখার মতো। তবে এখন থেকে আপনাকে আমি নিজের হাতেই খাইয়ে দেবো। তাই বাধিয়ে রাখার দরকার নেই তেমন!

স্পৃহা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-আপনার মতো জঘন্য একটা লোকের হাত থেকে খাবার খাওয়ার চেয়ে রাস্তার কোনো লোকের হাত থেকে খাবার খাওয়া ভালো।

প্রণব কথাটা শুনে তেমন বিশেষ অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

-এরপর থেকে আমি ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির কথা মুখে আনলে আপনার কথা বলার রাস্তা বন্ধ করে দেবো। আমি ছোট বেলা থেকেই মারাত্মক হিংসুটে। আমার জিনিসের ভাগ আমি কখনো কাউকে দেইনি। সেখানে আপনার ব্যাপারেও কোনো কম্প্রোমাইজ করা আমার দ্বারা কল্পনাতেও অসম্ভব। আগেই বলেছি মানুষ হিসেবে আমি অতোটাও জেন্টেলম্যান নই।

-তাহলে কী করবেন আপনি? আমায় জোর করবেন? ধোকা দিয়ে বিয়ে করেছেন যেভাবে, যেভাবে এখানে আঁটকে রেখেছেন, যেভাবে জোর করে খাওয়াচ্ছেন, সেভাবে জোর করে সংসার করাবেন আমায় দিয়ে?

স্পৃহা কড়া দৃষ্টির প্রতি চোখ স্থির করে প্রণব বললো,

-সবকিছু জোর করে আদায় করা যায় না। তবে আপনি আমায় আজীবন ঘৃণা করে গেলেও আপনাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। আপনার ওপর কোনো অধিকার খাটাতে আমি কখনো যাবো না। যদি কাছে থেকেও আমাদের মাঝে দূরত্ব থাকে, যদি আজীবনই আমাদের মাঝে এই আপনিময় সম্পর্ক বজায় থাকে, তবুও আপনাকে আমার হয়েই থাকতে হবে। শুধু চোখ ভরে দেখবো আর মনে মনে জানবো, আমার প্রিয়দর্শিনীর ওপর শুধুই আমার অধিকার। এটুকুই তো চাই!
_________________________

সকালের নরম রোদ চোখে মুখে আছড়ে পড়তেই পিটপিট করে চোখ মেললো স্পৃহা। নিজেকে জানালার পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করেন সে। কাল রাতে প্রণব ওকে খাইয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার পর স্পৃহার চোখ দুটো কখন লেগে গেছে, সেটা ও নিজেও জানে না। তার মানে প্রণব রাতে আর এ ঘরে আসেনি। কথাটা মনে মনে আওড়াতেই একটা তপ্ত শ্বাস ফেললো স্পৃহা। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। কালকে ওকে এখানে রেখে যাওয়ার পর এই ঘরের দিকে তেমন একটা লক্ষ করেনি স্পৃহা। এখনও সেরকম কোনো ইচ্ছে নেই। তবুও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে।

চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে নিজের পেছনের দেয়ালটার ওপর চোখ পড়তেই দৃষ্টি থমকে গেল স্পৃহার। বাঁধিয়ে রাখা প্রতিকৃতির ওপর চোখ আঁটকে গেল তার। বুকে হাত গুঁজে একপেশে ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটির ছবিটি একদম জীবন্ত ঠেকছে। চশমার আড়ালে থাকা চোখ দুটো অদ্ভুত হাস্যজ্বল। প্রসারিত ঠোঁটের বাঁকে অন্যরকম ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া বিদ্যমান। তার পুরো সত্তাটাই শালীনতা দিয়ে আবৃত। কিন্তু এই সুদর্শন পুরুষটিকে আর কখনো চোখের সামনে দেখতে পারবে না কেউ। সে হারিয়ে গিয়েছে। চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে না ফেরার দেশে।

ভাবতেই স্পৃহার চোখ দুটো জলে ভরে উঠলো। কিন্তু সেই পানি দেখে তো এই ব্যক্তিটা এগিয়ে আসবে না। আবেগ মিশ্রিত সুরে ‘স্পৃহা’ বলে ডাকবে না। সেই চিঠিতে লেখা শেষ কথাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো স্পৃহার,

” তুমি কাঁদলে কিন্তু আমি অনেক কষ্ট পাবো। কখনো আমার কথা ভেবে চোখের পানি ফেলো না। অনুরোধ রইলো। বিদায়।”

ভেবেই চোখের পানি আটকানোর বৃথা চেষ্টা করলো সে। তখনই দরজার লক খুলে প্রণব ঘরে প্রবেশ করলো। হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে ভেতরে ঢুকে স্পৃহার দিকে তাকাতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে গেল তার। স্পৃহা এক দৃষ্টিতে আহিরের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রণব খাবারের ট্রে-টা টেবিলে রেখে স্পৃহার পাশে দাঁড়িয়ে ওকে নিজের দিকে ঘোরালো। ওর চোখে পানি দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কড়া গলায় বললো,

-আমার জিনিসের অপচয় পছন্দ করি না আমি। আগেও একবার বলেছি না?

বলেই স্পৃহার চোখের পানি মুছে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই স্পৃহা কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বললো,

-ছ্ …ছোবেন না আমায়! একদম……

কথা শেষ করতে পারলো না স্পৃহা। প্রণব ওকে একটানে নিজের কাছে এনে দাঁড় করিয়েছে। মুখটা অটোমেটিক্যালি বন্ধ হয়ে গেছে স্পৃহার। প্রণব ওর দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,

-আপনি না চাইলেও আপনার পাশে আমি থাকবো! আপনি কাঁদলে সযত্নে চোখের পানি মুছে দেবো! আপনার সব কষ্ট দূর করতে না পারলেও আনন্দ দেওয়ার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখবো না। আপনার ছায়া আপনার পিছু ছেড়ে দিলেও এই প্রণব মেহরাজ চৌধুরী আপনার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।

বলেই স্পৃহার চোখের পানি গুলো মুছে দিতে দিতে বললো,

-আহিরের ছবিটা কেন লাগিয়েছি, জানেন? আমি চাই না, আপনি ওকে কখনো ভুলে যান। আমি হিংসুটে হলেও আহিরের প্রতি আমার কোনো হিংসা কাজ করে না। ও হয়তো আপনাকে ভালোবাসতো! কিন্তু আপনার প্রতি আরো বেশি অনুভূতিপ্রবণ কেউ একজন আছে। যাইহোক, ফ্রেশ হয়ে আসুন।

স্পৃহাকে ছেড়ে দিলো প্রণব। কিন্তু স্পৃহা এখনো ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। প্রণব সেটা দেখে তাড়া দিয়ে বললো,

-এভাবে দাড়িয়ে আছেন কেন? এখন কি আপনাকে ফ্রেশ করিয়ে দিতে হবে। তাহলে চলুন! ওয়াশরুম নিয়ে যাই।

প্রণব দু পা এগিয়ে আসতেই স্পৃহা চোখ বড়বড় করে তাকালো। ঝড়ের গতিতে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো সে। প্রণব সেটা দেখে আপনমনে হাসলো।

স্পৃহাকে খাইয়ে দিয়েই প্রণব বললো,

-দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিবেন। আমার শো আছে। আসতে না পারলেও খোঁজ ঠিকই নেবো।

-এভাবে কতদিন এখানে বন্দী করে রাখবেন?

স্পৃহা বেশ শান্ত গলায় প্রশ্নটা করলো। প্রণব গিটারটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে বললো,

-আর দু’দিন। তারপর আপনি মুক্ত। তবে আমার থেকে একেবারে মুক্তি পাবেন না যদিও!

স্পৃহা বিরক্তি নিয়ে বললো,

-ভাইয়ার সাথে একবার কথা বলিয়ে দিন!

-সম্ভব না!

স্পৃহা অবাক হয়ে বললো,

-কেন?

-কারণ আপনার ভাইয়া জানে যে, আপনি এখন দেশের বাইরে আছেন! তাছাড়াও আপনার এখন কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করা যাবে না। আপনার অবস্থান সম্পর্কে এখন আমি ছাড়া কেউ-ই কিছু জানে না!!

বলেই প্রণব শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেল। স্পৃহা পেছন থেকে অনেক বার ডাকলেও শুনলো না। এদিকে স্পৃহার মাথায় এখন হাজারো প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করছে। এভাবে তাকে লুকিয়ে রাখার মানে কী? কী এমন ঘটতে চলেছে দুই দিন পর?
________________________

আনিলা চিন্তিত ভঙ্গিতে বারবার হাতে হাত ঘষতে ঘষতে বললো,

-সত্যিই আমার এখন ভয় করছে! আগে বিষয়টাকে যতটা সহজ ও সাধারণ ভেবেছিলাম এখন দেখি এটা তার থেকেও কয়েক গুন বেশি জটিল!!

প্রণব চেয়ারে গা এলিয়ে ভালো করে বসে বললো,

-তোর ঐ বন্ধুটা যদি কালকে দেশে না ফেরে, তাহলে ওকে তুলে নিয়ে আসবো বলে দিলাম। ওর জন্য মিসেস নিস্তব্ধতাকে বন্দী করে রাখতে হচ্ছে। নিজের বউয়ের কাছে ঘৃণার পাত্র হওয়ার ক্ষেত্রে তোর ঐ বন্ধুও ইনডিরেক্টলি দায়ী!

আনিলা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,

-স্পৃহা তোকে ঘৃণা করে মানে? এটা বলেছে ও তোকে?

প্রণব ফোনে চোখ রেখে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,

-হুম। তবে ওসব কথা আমার গায়ে লাগেনি! যা করেছি, তার জন্য এর থেকে ভালো কিছু আশাও করা যায় না। আসলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, বিয়েটা ওভাবে না করলে মিসেস নিস্তব্ধতা বিয়েতে রাজি হতো না কখনো। ভেবেছিলাম একটু সময় নিয়ে সবটা হ্যান্ডেল করবো। কিন্তু তার আগেই এসব প্রেস-মিডিয়ার খপ্পরে পড়ে বিষয়টা লিক করতে হলো। কপাল মন্দ হলে যা হয় আর কি!!

আনিলা হাসলো। প্রণবকে ও ছোট বেলায় যেমনটা দেখেছে, এখনও ঠিক তেমনটাই আছে সে। সবসময় স্বাভাবিক ও শান্ত থাকে। ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ওর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। মন খারাপেরা কখনো ওর ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। ছেলেটা কি সবসময়ই এমন প্রাণোচ্ছল থাকতে পারবে? প্রণবের এই ব্যক্তিত্বটা যেন কখনো বাস্তবতার কারণে হারিয়ে না যায়!

# চলবে………

#এক_মুঠো_প্রেম
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ৩৪
✨রহস্যভেদ পর্ব-১✨

ঘড়ির কাটা দশের ঘরে এসে থামতেই খট করে দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলো স্পৃহা। জানালার বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো সে। প্রণব এসেছে। গত দুই দিনের তুলনায় আজ একটু দেরী করে ঘরে ঢুকেছে সে। দেখতেও অনেকটা বিধ্বস্ত লাগছে। চুল গুলো এলোমেলো। পরনের শার্টের হাতাও অগোছালো ভাবে গুটানো। স্পৃহা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা প্রণবের চোখে পড়তেই ও খাবারের ট্রে-টা রেখে স্পৃহার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

-কখন উঠেছেন? আজ একটু লেইট হয়ে গেল ব্রেকফাস্ট আনতে। এখন আসুন। খাবার খেয়ে নিন।

-আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? দেখে তো মনে হচ্ছে পৃথিবী উল্টেপাল্টে এসেছেন!

স্পৃহার বিরক্তি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে প্রণব নিঃশব্দে হাসলো। কয়েক পা এগিয়ে এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিহি কন্ঠে বললো,

-অবয়বের প্রতি এতো খেয়াল রাখতে নেই। মায়ায় জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিন্তু!

স্পৃহা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

-মায়া! তাও আবার আপনার? হাসালেন আমায়! আপনার মায়ায় কোনো দিনও আবদ্ধ হবো না আমি।

-হবেন নাকি হবেন না, সেটা তো সময়ই বলে দিবে! প্রণব মেহরাজ চৌধুরীর বিশ্বাস কখনো হারে না। তবে একটাই অনুরোধ! খুব বেশি দেরী করে ফেলবেন না যেন! সময় কিন্তু খুব নিষ্ঠুর। সঠিক সময় যতো দেরী করে আসে, চলে যায় তার চেয়েও কয়েক গুন বেশি গতিতে। এই সময়ের জন্য পরবর্তীতে আক্ষেপ করতে যেন না হয়!

প্রণব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। স্পৃহা থমকালো। সময় জিনিসটা বরাবরই তার সাথে নিষ্ঠুরতা করে। আদ্রকে বিয়ে করার ভুল সিদ্ধান্তটা বুঝতে ওর দেরী হয়েছে। আহিরের সত্যটাও সে জানতে পেরেছে ভুল সময়ে। ভাগ্য কি আরো নিষ্ঠুরতা দেখাবে? সময়েরও কি আরো নির্মমতা দেখানো বাকি?

-আসুন, খেয়ে নিন!

প্রণবের ডাকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো স্পৃহা। এগিয়ে গিয়ে বসতেই প্রণব ওর মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলো। স্পৃহা বিরক্তি নিয়ে বললো,

-আপনার হাতে খাবো না!

প্রণব ভ্রু বাঁকিয়ে শক্ত কন্ঠে বললো,

-প্রতি বেলায় আপনার এই এক কথা বলাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। চুপচাপ খাবার ফিনিশ করুন। আপনার সাথে জোরাজুরি করার মুডে নেই আমি এখন!

বলেই স্পৃহার মুখে ঠেলে খাবার ঢুকিয়ে দিলো। স্পৃহা মুখ কালো করে খাওয়া শুরু করলো। প্রণব ওকে খাইয়ে দিতে দিতে বললো,

-খাওয়া শেষে আমরা বের হবো। আজ আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন আশা করি।

বলেই স্পৃহাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না। বারবার খাবার মুখে পুরে দিতে লাগলো। খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে স্পৃহার মুখ বেঁধে দিলো। হাত দুটো বাঁধতে বাঁধতে বললো,

-ভালো কথার মানুষ আপনি একদম-ই নন! তবে আজ আপনি মুক্তি পাবেন। সবকিছু থেকেই মুক্তি পাবেন।

বলেই স্পৃহার হাত ধরে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। স্পৃহার ওর কথার মানে বুঝে উঠতে পারলো না। বোঝার কোনো চেষ্টাও করলো না। হাত আর মুখের বাঁধন খোলার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো। প্রণব সেটা খেয়াল করলো। মুখে ফুটে উঠলো মলিন হাসি। মনে মনে আওড়ালো,

-মানুষ অকারণেই ভালোবাসে, অকারণেই কষ্ট পায়!

গাড়ি থামতেই প্রণব নেমে স্পৃহাকে বের করে আনলো। স্পৃহা সামনের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। আদ্রের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। স্পৃহা বিস্মিত চোখে তাকালো প্রণবের দিকে। চোখ জুড়ে হাজারো প্রশ্ন উকি দিচ্ছে তার। প্রণব সেটা বুঝতে পারলো। কিন্তু কিছু না বলে ওকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।

আদ্র চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রের মা মিসেস সামায়রার ভাবভঙ্গিও চিন্তিত ঠেকছে। প্রণবের পুরো পরিবার হলরুমে উপস্থিত। শুধু প্রান্তি আসেনি। আনিলা আশফিকে প্রান্তির কাছে রেখে এসেছে। স্পন্দনও এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে কপাল চেপে আছে। স্পৃহা ভেতরে প্রবেশ করতেই সবাই অবাক চোখে ওর দিকে তাকালো। প্রণব ওর হাত ও মুখ খুলে দিতেই স্পৃহা যেন নিঃশ্বাস ছেড়ে বাচলো। আদ্র স্পৃহার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ ঘুরাতেই স্পৃহা সেটা খেয়াল করলো। ঘৃণা মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো সে। প্রণব সেটা লক্ষ করে আদ্রকে বললো,

-আজকের দিন থেকেই তোর আফসোসের প্রহর গোনা শুরু হলো। এখানে সবাইকে জড়ো করেছি সব সত্যি আজ প্রকাশ করবো বলে। দুই মাসে অনেক খেটে সব প্রমাণ জোগাড় করেছি আমি। তবে এতে আনন্দের চেয়ে কষ্ট বেশি হচ্ছে। কারণ সবচেয়ে কাছের মানুষ গুলোর মধ্যে তুই একজন ছিলি। আর সবটা জানলে তুই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবি।

আদ্র অবাক চোখে তাকালো। কিছু বলার আগেই প্রণব মিসেস সামায়রার দিকে তাকিয়ে বললো,

-আপনার ছেলে দুটোকে তো একবারও দেখলাম না, আন্টি!

মিসেস সামায়রা চোখ বড়বড় করে তাকালেন। বললেন,

-ছ্ ছেলে? আমার আবার ছেলে এলো কোত্থেকে?

প্রণব ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

-কেন? আপনার নিজের ছেলে আছে না দুজন? আদ্র তো আপনার নিজের সন্তান নয়! রাইট?

আদ্র হতবিহ্বল দৃষ্টিতে মিসেস সামায়রার দিকে তাকালো। মিসেস সামায়রা রাগী স্বরে বললেন,

-একদম আজেবাজে কথা বলবে না। আমি………

-প্রণব ঠিকই বলেছে। তুমি আদ্রের নিজের মা নও। এজন্যই তো এতোটা নিচে যেতে পেরেছ!

কথার মাঝেই হঠাৎ আদ্রের বাবা উপস্থিত হয়ে কথাটা বলতেই মিসেস সামায়রা একদম মিইয়ে গেলেন। আদ্র হতভম্ব হয়ে বললো,

-বাবা, কী বলছো তুমি? উনি আমার মা নন?

-না, উনি তোমার মায়ের ছোট বোন। তোমার মা তোমায় জন্ম দেওয়ার দুদিন পরেই মারা যায়। সবার কথা মেনে নিয়ে আর তোমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ওকে আমি বিয়ে করেছিলাম। সামায়রার দুই ছেলে তখন অনেক ছোট। তোমার মায়ের অনেক আগেই ওর বিয়ে হয়। কিন্তু ওর স্বামী ওকে আর ওর দুই ছেলেকে রেখে ভিনদেশে পাড়ি জমায় আর সেখানেই নতুন সংসার সাজায়। ওকে বিদেশ থেকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেয়। এতো কিছুর পর আমি বিয়ে করতে চাইনি। কিন্তু তোমার মায়ের অভাব দূর করতে বিয়েটা করতে হয়েছিল। ওর দুই ছেলেকে আমি মেনে না নিলেও দূর থেকে ওদের কোনো অভাব বুঝতে দেইনি কখনো।

আদ্র আহত দৃষ্টিতে তাকালো ওর বাবার দিকে। যাকে এতোদিন মা বলে জেনে এসেছে, আজ জানতে পারলো সে আসলে সম্পর্কে তার খালা হয়। বিষয়টা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। আদ্রের বাবা আবার রুষ্ট কন্ঠে বললো,

-কিন্তু আগে জানলে আমি এই কাজটা কোনো দিনও করতাম না। ভাবতেও পারিনি যাকে নিজের সন্তানের মাতৃরূপে উপস্থাপন করে এসেছি সবসময়, সে-ই আমার ছেলের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করবে।

আদ্র অবাক চোখে তাকালো। বললো,

-ক্ষতি??

প্রণব বলে উঠলো,

-বাকিটা না-হয় বাইরের কারো কাছ থেকে শোনা যাক!!

বলেই কাউকে কল দিয়ে বললো,

-ভেতরে এসো। ফাস্ট!!

কয়েক মিনিট পরেই এক অজ্ঞাত পুরুষের আগমন ঘটলো। তাকে দেখা মাত্র মিসেস সামায়রার ভীতি কয়েক গুন বেড়ে গেল। তিনি অস্ফুটস্বরে বললেন,

-ডক্টর, আপনি?

ডক্টর হালকা হেসে বললো,

-যাক, মনে আছে আমাকে তাহলে! এতে তো তোমার কাজটা আরো বেশি সহজ হয়ে গেল! তাই না, প্রণব?

প্রণব বাঁকা হেসে বললো,

-ইয়েস! উনি এখন আর অস্বীকার করতে পারবেন না যে, উনি তোমাকে চেনে না। যা-ই হোক, তোমাকে উনি যেন কী কী করতে বলেছিলেন!!

ডক্টর একপলক সবার দিকে তাকিয়ে বললো,

-আসলে মিসেস স্পৃহা কন্সিভ করার পরপরই মিসেস সামায়রা আমার হসপিটালে তার রেগুলার চেক-আপ করাতেন। এবোরশন রিলেটেড ব্যাপার গুলো আমিই হ্যান্ডেল করতাম। সেই সুবাদে তিনি একদিন আমার কাছে এসে বললেন, উনি ওনার পুত্রবধূর অনাগত সন্তানটাকে পৃথিবীতে আসতে দিতে চান না। পাশাপাশি তার ম্যাটার্নিটির ক্ষমতা নষ্ট করে দিতে চান, যেন সে কখনো মা না হতে পারে।

# চলবে………