#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_২৩
©জারিন তামান্না
নিজের কেবিনে শুয়ে আছেন আমজাদ আলী। তার বেডের পাশে রাখা চেয়ারে বসে আছে পলাশ। তার কোলে ছোট্ট প্রাপ্তি। তাদের পেছনে একে অপরকে ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে পলক, নিশাত আর শাহনাজ বানু। নিরবে কাঁদছে তারা। কিন্তু আমজাদ আলী মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে রেখেছেন। কথাও বলছেন না পলাশের সাথে। এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতেই পলাশ বললো,
_কেমন আছো বাবা?
পলাশের মুখে এত বছর পরে বাবা ডাক শুনে হুহু করে উঠলো আমদাজ আলীর বুকের ভেতরটা। চোখ বুজতেই টপটপিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো তার চোখের কোণ বেয়ে। তবুও,তিনি মুখ ফিরিয়ে চাইলেন না পলাশের দিকে। বললেনও না কিছুই। তা দেখে পলাশই আবার বললো,
_এভাবেই যদি মুখ ফিরায়াই রাখবা,তাহলে আমাকে ফিরা আসতে কেন বলছিলা?
________
_আচ্ছা, ঠিক আছে। আমার উপর তুমি রাগ করে আছো মানলাম,কিন্তু আমার মেয়েটার কি দোষ বাবা? তার কি অধিকার নাই নিজের দাদাকে কাছে পাওয়ার?
এটুকু বলতে বলতেই কোলে বসা প্রাপ্তি তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়েই শুয়ে থাকা আমদাজ আলীকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতে করতে তাকে ডাকলো।
_ দা..দ্দু…দা..দ্দু
প্রাপ্তির মুখের নিজের জন্য দাদু সম্বোধন শুনে আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারলেন না তিনি। প্রাপ্তির দিকে তাকিয়েই হুহু করে কেঁদে দিলেন তিনি। উঠে বসার চেষ্টা করতেই প্রাপ্তিকে বিছানায় বসিয়ে দ্রুত গিয়ে তাকে ধরলো পলাশ। আস্তে আস্তে ধরে উঠে বসতে সাহায্য করলো। পেছনে বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে বসতেই তিনি দু’ হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রাপ্তির দিকে। ছোট্ট প্রাপ্তিও আর দেরি করলো না। দুই এক কদমের হামাগড়ি দিয়ে ছুটে গেলো তার দাদার কোলে। প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে আনন্দে তার কান্নার বেগও বেড়ে গেল। তাকে এভাবে কাঁদতে দেখেও কেবিনে উপস্থিত কেউই কিছুই বললো না। কারণ এই কান্না যে তার এত বছরের জমাট বাঁধা কষ্টের গলিতরূপ সেটা সেখানে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ খুব ভালো করেই জানে। তারাও কাঁদছে নিঃশব্দে। আমদাজ আলী নাতনিকে কোলে নিয়ে নিজের মত আদর করে যাচ্ছেন। তা দেখে একসময় পলাশ বললো,
_বাহ! এই জন্যই লোকে বলে,গাছের চেয়ে পরগাছার কদর বেশি। এখানে যে তার এত্ত বড় ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তা তো চোখেই পড়ছে না, নাতনিকে যে পেলো তা সেটা কার জন্য পেয়েছে সেটাও ভুলে গেছে। হুহ!
পলাশের এহেন কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতেই হেসে দিল পলক, নিশাত আর শাহনাজ বানু।কাঁদতে কাঁদতেই আমদাজ আলী পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পলাশের এক হাত টেনে মুঠোয় জড়িয়ে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। পলাশ এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। মাথায়, গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করলো তাকে। আমজাদ আলী কিছুটা শান্ত হয়ে এলে তার পাশে গিয়ে বসলো সে। তারপর প্রাপ্তিকে দেখিয়ে বললো,
_জানো বাবা, ও যখন কিছুই বুঝতো না তখন থেকেই মোবাইলে তোমাদের সবার ছবি দেখিয়েছি আমি ওকে। তোমাদের সবাইকে চিনিয়েছি। জন্মের পর থেকে পরিবার বলতে সে তোমাদেরকেই চিনেছে। আর জানো তো বেশিরভাগ সময় ও তোমার ছবি নিয়েই বেশি নাড়াচাড়া করতো। তোমাকে বেশি পছন্দ করে। রক্তের টান বোধয় একেই বলে। বাবা মা বলার আগে দাদু ডাক শিখছে। আর এবার তোমার নাতিকে তোমার কোলে তুলে দিলাম। এখন ওকে তুমি আদর করবা নাকি দূরে ঠেলে দিবা আমার মতো সেটা তোমার ব্যাপার। এই আমি হাত তুলে নিলাম। এবার যা করার,যেভাবে করার তুমি করো। আমি আর ওসবের মধ্যে নেই।
_আমাকে তুই মাফ করে দিস বাবা। আমার রাগ, জেদ আর ভুলের জন্যই এতগুলা বছর তোকে তোর পরিবার থেকে আলাদা থাকতে হইছে। আমার নাতনিটা তার পরিবার থাকা সত্ত্বে একা একা বড় হইছে। তুমি মাফ করে দিস তোর এই বুড়ো বাবাটাকে। মাফ করে দিস। পলাশের কথা শেষ হতেই আচমকা তার একটা হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন আমজাদ আলী।
_তুমি কোন ভুল করো নাই বাবা। তুমি তোমার জায়গায় ঠিক ছিলে। আমিই বরং নিরুপায় ছিলাম। তাই তোমার অবাধ্য হতে হইছিল। তুমি মাফ করে দিও আমাকে। আমি কথা দিতেছি আর কারও জন্য কখনো তোমাদের থেকে আলাদা হবো না। আবার সবাই একসাথে ভালো থাকবো। ঠিক যেমন ছিলাম আগে। কিন্তু তার আগে তুমি কান্না থামাও। নয় তো শরীর খারাপ করবে আবার। আর দ্রুত সুস্থ হও তো। আমার মেয়েটা তার দাদুর সাথে খেলবে, ঘুরবে বলে সেই দুই বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে। ওর অপেক্ষা আর বাড়ায়ো না। সুস্থ হয়ে যাও তাড়াতাড়ি।
_হ্যাঁ রে বাবা। এই তো আমার দিদিভাই এসে গেছে।এবার আমি এম্নিতেই ভালো হয়ে যাবো। তুই আমাকে বাসায় নিয়ে চল। আমি বাসায় ফিরে খেলবো আমার দিদিভাইয়ের সাথে।
_হ্যাঁ,,নিবো তো বাবা। এই তো আমি গিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলবো এখন। যত দ্রুত সম্ভব তোমাকে ডিসচার্জ করার ব্যবস্থা করবো আমি। তুমি চিন্তা করো না।
ছেলের কথা শুনে স্বস্তির হাসি হাসলেন আমজাদ আলী। তারপর নাতনিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। ওদিকে একসাথে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখলো কেবিনে উপস্থিত বাকি চারটা মানুষ। তাদের সকলের চোখেই আজ বাঁধভাঙা সুখজল!
__________________________________
একটা রেস্টুরেন্টের টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে পলক আর তিয়ান। গতকাল রাতে তিয়ানকে কল করেছিল পলক। আজকে দেখা করার কথা বলেছে।তাই দুপুরে স্কুল শেষে এখানে এসেছে তারা। তিয়ান দু’টো কফি অর্ডার করলো দুজনের জন্য। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে ওখান থেকে যেতেই একটা খাম এগিয়ে দিল পলক তিয়ানের দিকে। খামটা দেখে তিয়ান জিজ্ঞেস করলো,
_কি এটা?
_নিজেই খুলে দেখো। পলকের কথায় হাত বাড়িয়ে খামটা নিল তিয়ান। খাম খুলতেই বেশ কিছু ক্যাশ টাকা দেখতে পেল তাতে। সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলো আবার,
_পলক এগুলো..?
_বাবাকে এডমিট করার সময় ৩০ হাজার টাকা লেগেছিল। তখন তো সেটা তুমিই পেমেন্ট করেছিলে নিজের কার্ড দিয়ে।
এ কদিন হাসপাতালের ঝামেলায় টাকাটা ব্যাক করা হয়নি তোমাকে। তাই আজ..
_কিন্তু এটা তো এখন না দিলেও…
_আমি কারও ঋণ রাখিনা তিয়ান। যথাসাধ্য চেষ্টা করি ঠিকভাবে সেটা পরিশোধ করার। আর এটা তুমি খুব ভালো করেই জানো।
_হ্যাঁএএ…সেটা কি আর ভুলবার বিষয়! যে মেয়ে একশ টাকার ঋণটাও যে কোন মূল্যে ফেরত দিতে বাদ রাখে না সেকি আর এতগুলো টাকার ঋণী হয়ে থাকবে নাকি!!
তিয়ানের এ কথায় মুচকি হাসলো পলক।তিয়ানের কথায় কিসের ইংগিত ছিল সেটা ঠিকই বুঝেছে পলক।পলককে হাসতে দেখে হাসলো তিয়ানও। আর সেই সাথে, আরও একবার কলেজ লাইফের স্মৃতিপটে পা রাখলো দুজনেই।কথায় কথায় উল্টেপাল্টে দেখা হলো ক্লাসমেটের পরিচয় থেকে বন্ধুত্বের পথে পা রাখার স্মৃতিটা।
৭ বছর আগে..
এই ধরো,তোমার টাকাটা। -বলেই তিয়ানের দিকে একটা একশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল পলক।
দোতলার করিডোরে দাঁড়িয়ে নিজের গার্লফ্রেন্ড সিন্থিয়া আর আশেপাশের দুই একজন বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল তিয়ান। ঠিক তখনই আগের দিন রিক্সাওয়ালাকে দেওয়া ভাড়ার একশ টাকাটা ফেরত দেবার উদ্দেশ্যেই সবার সামনেই তাকে কথাটা বললো পলক। আচমকা এভাবে এসে টাকা দেওয়াতে উপস্থিত সবাই অবাক হলো।শুধু তিয়ান বাদে। সিন্থিয়া তখন তিয়ানের কাঁধে এক হাত ঠেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। পলকের এহেন কাজ আর কথায় বিস্মিত কন্ঠে তিয়ানকে জিজ্ঞেস করলো,
_What’s the matter darling?ও তোমায় কিসের টাকা দিচ্ছে এভাবে?
সিন্থিয়ার এহেন প্রশ্নে আশেপাশে থাকা ছেলেমেয়েরাও উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে তিয়ানের মুখের দিকে। সে কি বলবে সেটার শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তারা। কিন্তু,এভাবে সবার সামনে সামান্য একশ টাকা ফেরত দেওয়ার কাজটা ইগোতে লাগলো তিয়ানের।অপমান বোধ করলো সে।ধনী পরিবারের ছেলে সে। হুটহাট বন্ধুদের ট্রিট দেওয়া, এখানে সেখানে নিয়ে গিয়ে পার্টি করা,টাকা দিয়ে হেল্প করা এসব তার নিত্যদিনের কাজ। তার কাছে,টাকা হচ্ছে হাতের ময়লা।তাই টাকা হিসেব করে চলার অভ্যাস বা স্বভাব তার নেই বললেই চলে।আর বাবা মা দুজনেই যখন বিশাল ব্যবসায়ী তখন সেই অর্জিত টাকা বেসামালভাবে খরচের জন্যও কখনো দু বার ভাবতে হয়নি তাকে। সেখানে সামান্য একশ টাকা ফেরত দিতে আসার ব্যাপারটা তার জন্য সত্যিই অপমানজনক। তবে সেও বা কম কিসের! পাল্টা জবাবে নিজের এটিটিউড দেখিয়ে বললো,
_Don’t know babe. তারপর পলকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এটা কিসের টাকা পলক?
তিয়ানের কথায় অবাক হয়ে গেল পলক। এই তো গতকাল দুপুরের কথা।রিক্সাওয়ার ভাড়া দিয়ে দিল ছেলেটা। আর এক বেলার মধ্যেই ভুলে গেল সেটা? এই নাকি ব্যাচের জিনিয়াস বয়!যার মেমোরি এত্ত ড্যাম! মনে মনে বললো পলক কথাগুলো। আর মুখে বললো,
_তুমি গতকাল আমার রিক্সার ভাড়া দিয়েছিলে,ওটার টাকা। নাও ধরো।
_তুমি ওর রিক্সার ভাড়া দিয়ে দিয়েছো তিনু ডার্লিং! But why?এই মেয়ের কাছে কি টাকা ছিল না নাকি যে ওর জন্য ভাড়াটা তোমাকে দিতে হবে? পলকের কথা শুনে পাশ থেকে তিয়ানের উদ্দেশ্যে বললো সিন্থিয়া।
সিন্থিয়ার পলককে” এই মেয়ে “বলাটা ঠিক পছন্দ হলো না তিয়ানের। তাই খানিকটা পরোক্ষভাবেই সিন্থিয়াকে সতর্ক করে দিয়ে বললো,
_ওর একটা নাম আছে বেব। পলক! মানুষকে তার নিজস্ব নামে সম্বোধন করা উচিৎ । তোমার নাম থাকতেও কেউ তোমাকে এই মেয়ে বললে সেটা নিশ্চয় ভালো লাগার মত কিছু হবে না,তাই না? মুখে কপট হাসি টেনে বললো তিয়ান।
তিয়ান কেমন ধাঁচের ছেলে তা ক্লাসের সবাই মোটামুটি জানে। তাই তিয়ানের কথাগুলোও ঠিকঠাক কাজ করলো সিন্থিয়ার ওপর। তিয়ান ঠিক কি বলেছে তাকে সেটাও সে বুঝেছে।অপমানবোধ করলো সে।আর রাগটা জমলো পলকের ওপর। কিন্তু তিয়ানের নজরে ভালো সাজার জন্য খানিকটা মিনমিনিয়েই বললো,
_Yeah…I’m.sorry.
_Good. তিয়ান বললো। তারপর, পলককে উদ্দেশ্য করে বললো,
_ওটা তুমিই রাখো। লাগবে না আমার।
_হ্যাঁ, এসব ছোটখাটো হেল্প তিয়ান এমনিতেই করে সবাইকে।টাকাটা বরং তুমিই রাখো। পরেরবার ভাড়া দিতে কাজে লাগবে। বলেই মুখ টিপে হাসলো সিন্থিয়া।
কথাটা যে সে পলককে অপমান করে বলেছে সেটা সেখানে উপস্থিত সবাই বুঝলো। আর এতে পলকের যতটা না রাগ হলো তার থেকেও বেশি লাগলো তিয়ানের। নিজের লাইফের ব্যাপারগুলোয় অন্য কারো হস্তক্ষেপ মোটেও পছন্দ নয় তার। সে টাকা নিবে না তো নিবেনা। এটা সম্পূর্ণ তার আর পলকের মধ্যকার ব্যাপার। আর এতে ৩য় ব্যক্তি হিসেবে সিন্থিয়ার এভাবে কথা বলাটাও সে কিছুতেই সহ্য করতে পারলো না। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার।এর জন্য সিন্থিয়াকে কঠিন কিছু কথা শোনানোর সিদ্ধান্ত নিল সে।তাই পাশ ফিরে সিন্থিয়াকে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই তার পেছন থেকে পলক বললো,
_আমি কারও ঋণ রাখিনা তিয়ান।নিজের সাধ্যের মধ্যে যে কোন মূল্যে সেটা পরিশোধ করার চেষ্টা করি। তুমি গতকাল আমাকে হেল্প করেছো তার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। কিন্তু,ভাড়া দেওয়ার কোন প্রয়োজন কিন্তু ছিল না। আমি বারণ করেছিলাম তোমাকে। তুমি শোননি। আমিও তখন বলিনি আর কিছু। কিন্তু,তাই বলে আমার সাধ্য থাকা সত্ত্বেও তোমার ঋণ বয়ে বেড়াবো এমন শিক্ষা আর স্বভাব কোনটাই আমার নেই। বলেই তিয়ানের হাতটা নিয়ে তার মুঠোয় গুঁজে দিল টাকাটা। তারপর এগিয়ে গিয়ে সিন্থিয়ার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। আর বললো,
_আর হ্যাঁ,,সিন্থিয়া..তোমাকে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোনো। আমার বাবা একটা স্কুলের শিক্ষক। মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের। কিন্তু,আমাদের চার ভাইবোনকে নিজের সাধ্যের মধ্যে সাবলিলভাবে মানুষ করার, আমাদের দায় দায়িত্ব নেবার ক্ষমতা তিনি রাখেন এখনো। তাই, প্রয়োজনে কারো সাহায্য নিলেও দান নেওয়ার মত অবস্থা আমাদের হয়নি এখনো। বুঝা গেল? আশা করি ঋণ আর দানের মধ্যে ঠিক কি তফাৎ সেটা এবারে বুঝতে পেরেছো তুমি।আর কখনো এই নিয়ে কোন কনফিউশন হবে না তোমার। বলেই পেছন ফিরে ক্লাসরুমের দিকে হাঁটা দিল পলক।
এতক্ষণ রীতিমত হা হয়ে পলকের কথাগুলো শুনছিল তিয়ান আর ওখানে উপস্থিত সবাই।তিয়ান পুরো শকড! এটা যে পলক ছিল সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না তার। এতদিন দূর থেকে হলেও দেখেছে সে পলককে। গতকালও পলককে দেখার পর আর বিথির কাছে ওর সম্পর্কে শুনে মনে হয়েছিল খুবই শান্ত, নরম আর অবলা নারী টাইপ ক্যাটাগরির মেয়ে পলক।।কিন্তু আজ তো দেখছে পুরো এসিড এই মেয়ে! নিজের কথায় যোগ্য জবাব দিয়ে সিন্থিয়ার করা অপমানকে কেমন ঝসলে দিল মূহুর্তেই।এমনকি তিয়ানকেও বাদ রাখেনি। তার এটিটিউডের ডট ডট ডট অবস্থা করে ছেড়েছে একদম। কিন্তু এত সহজে তো হার মানার পাত্রও তিয়ান নয়। তাই চকিতেই পলকের কথার ঝাঁজ সামলে নিয়ে ফিরে গেল নিজ এটিটিউডে। পলককে চলে যেতে দেখে পেছন থেকে ডকলো তাকে।
_ওই বাঁশপাতা..নিরামিষ। ওয়েট।
তিয়ানের এমন ডাকে ফট করে থেমে গেল পলক। ওখানে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই তিয়ান এগিয়ে গেল তার দিকে।তার মুখোমুখি দাঁড়াতেই তার হাত টেনে নিয়ে হাতের মুঠোয় গুঁজে দিল সেই একশ টাকার নোটটা। পলক অবাক! মুখে কিছু বলতেই যাচ্ছিল তার আগেই তিয়ান বললো,
_তিয়ান এভাবে টাকা নিতে অভ্যস্ত নয়। হেল্প করেছি বললে না?তবে, সেটার বিনিময়ে কিছু দাবিও তো করিনি,তাই না? কিন্তু তুমি তো আবার কারও ঋণ রাখো না। নিজের সাধ্যের মধ্যে যে কোন উপায়ে ঋণ পরিশোধ করে দাও। তাহলে আমার ঋণটাও পরিশোধ করো।তবে টাকা দিয়ে নয় অন্যভাবে।
পলক এবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে বিস্মিত। হতবাক নয়নে তাকিয়ে আছে তিয়ানের দিকে। তার হাত তখনো তিয়ানের হাতের মুঠোয়।সেই অবস্থাতেই হতবাক কন্ঠে সে জিজ্ঞেস করলো,
_অন্যভাবে মানে?
_অন্যভাবে মানে অন্যভাবে।ক্যাশ আমি নেবো না। তুমি বরং অন্য কিছু দিয়ে এই একশ টাকার ঋণটা পরিশোধ করো।
_আরেএএ..তুমি আমাকে ক্যাশ দিয়ে হেল্প করছো তো আমিও তো ক্যাশ দিয়েই সেটা রিটার্ন করবো।এখানে অন্যকিছু কিভাবে আসে?
_হ্যাঁ,,আসে তো। সহজ হিসাব !দেখো পলক..তুমি আমার থেকে ডিরেক্টরলি কোন টাকা নাওনি,,চাওনিও আমার থেকে।আমি নিজেই দিয়েছি। কিন্তু,পরে সেটা ফেরত চায়নি। দাবিও করিনি ওটা। এখন সেটা তোমার কাছে ঋণ হয়ে গেছে এবং সেটা তুমি পরিশোধ করতে চাইছো।কিন্তু,আমি তো সেটা নিতে চাইছি না। তাই এখন একান্তই যদি তোমার সেটা পরিশোধ করার হয় তবে এই টাকার সম পরিমাণ কোন কিছু তুমি আমাকে দিতে পারো। But, I won’t take any cash from you. Do u get it?
পলক হতভম্ব। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তিয়ানের দিকে। ওখানে উপস্থিত বাকিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছে। একদম ফ্রিতে ম্যাটেনি শো দেখতে পাওয়ার মত। ব্যাচের মোস্ট জিনিয়াস বয়ের আর ব্যাচের মোস্ট নিরামিষ মেয়েটার মধ্যে হওয়া এমন তর্ক বিতর্কের ঘটনাটা বেশ মজা দিচ্ছে তাদের।
এসবের মাঝেই সেখানে এসে হাজির হলো বিথি। সে এম্নিতেও লেট লতিফ।তাই বেশিরভাগ সময় কলেজে ক্লাস শুরু হওয়ার পর পর নয় তো একদম আগে আগে আগমন ঘটে তার। আজও তাই হলো।ক্লাসের ঘন্টা পড়ার মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। তখনই বিথি এসে দেখলো সিনেম্যাটিক সিন চলছে সেখানে রীতিমত। যার হিরো হিরোইন হিসেবে একজনের হাতের মুঠোয় অন্যজনের হাত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিয়ান আর পলক। তাদের পেছনে ভিলেনের মত ক্রুদ্ধ চেহারা করে দাঁড়িয়ে আছে সিন্থিয়া।আর বাকি ছেলে মেয়েরা নিষ্ঠার সাথে দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। কেবল ডিরেক্টর আর ক্যামেরাম্যানের অভাব। তবে আসল কাহিনী কি সেটা বুঝতে না পেরে তিয়ান আর পলকের কাছাকাছি গিয়ে কোমড়ে দু হাত রেখে দাঁড়ালো সে। তারপর তার টমবয় ভয়েসে সন্দিহান স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
_কি রেএএ…কি চলে এইনে? তোরা এম্নে হাত ধরাধরি কইরা খাঁড়ায় আছিস ক্যান? কেস কি মামা??
বিথির কথায় পুরো ব্যাক্কল হয়ে গেল পলক। তারপর তিয়ানের হাতের মুঠোয় থাকা তার হাতটা দেখলো একবার।সাথে সাথেই এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল তা। পলক বেশ অপ্রস্তত হয়ে পড়েছে পুরো ব্যাপারটায়। কিন্তু তিয়ান একদম স্বাভাবিক। খানিক গলা ঝেড়ে বললো,
_তোর বাঁশপাতা নিরামিষ বান্ধুবী আমার ঋণ পরিশোধ করতে চাইতেছে। বাট তুই তো জানিস আমি ক্যাশ নেই না। তাই বলছি অন্যভাবে সেটা পরিশোধ করতে।
_কিসেএএর ঋণ? একটা ম্যাথ সলভ কইরা দেওয়ায় টাকা দেওয়া লাগবে তোরে? অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো বিথি।
_আরেএএ ধুর! ম্যাথ সলভ করার জন্য টাকা দিবে কেন? ওইটা তো…
_তোরে আমি পরে সব বুঝায় বলতেছি বিথু। ক্লাসে চল এখন। বিথির হাত ধরে তাকে কাছে টেনে বললো পলক।
_হ্যাঁ…কিন্তু ও ক্যাশ নিবে না তো নিবেটা কি?
_সেটা আমি ক্যাম্নে বলবো। ওইটা তুই তোর ফ্রেন্ড রে জিজ্ঞেস করে নিস। আমি গেলাম। বলেই ক্লাসের দিকে পা বাড়ালো পলক।
_আমি দুজনের ব্যাপারের মাঝে অন্য কারও হস্তক্ষেপ পছন্দ করি না, মিস.বাঁশপাতা। তাছাড়া ঋণ পরিশোধ করার কথা তোমার। যা জানার, যা জিজ্ঞেস করার সেটা তুমি আমাকে কররা। সেটার মাঝে বিথুকে কেন টানছো?
তিয়ানের এহেন খোঁচামারা কথায় থমকে গেল পলক। পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো,
_বেশ। তুমিই বলো তাহলে কি চাই তোমার?
পলকের এহেন কথায় কিছুক্ষণ ভাবলো তিয়ান। তারপর বললো,
_উউউউমমম, এক কাজ করো তাহলে।তুমি বরং এক প্যাকেট বেনসন এনে দিও আমাকে। তোমার ঋণ শোধ হয়ে যাবে। বলেই বাঁকা হাসলো তিয়ান।
_কিইইইইহহহ……? সিগারেট!হতভম্ব স্বরে বললো পলক।
_অয় ব্যাটা,,মাথা খারাপ হইয়া গেছে তোর? ও মেয়ে হইয়া যাইবো সিগারেট কিনতে? কিসব উল্টাপাল্টা ডিমান্ড করতেছিস তুই!
_এটা তো আমার দেখার বিষয় না বিথু। তোর বান্ধুবী জিজ্ঞেস করছে আমি কি চাই।আমিও বললাম। এখন সেটা সে আমাকে দিবে কি দিবে না নাকি না দিয়ে ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াবে সেটা ওর ব্যাপার। আমি তো কোন জোরজবরদস্তি করি নাই। ঝরঝরে গলায় বললো তিয়ান।
এরই মধ্যে ক্লাসের ওয়ার্নিং বেল পড়ে গেল। আর সাথে সাথেই সবাই নড়েচড়ে উঠলো। যার যার মত পা বাড়ালো ক্লাসরুমের দিকে। বাঁকা হাসতে হাসতে তিয়ানও পাশ কাটিয়ে গেল পলকের। যাওয়ার আগে আবার পলকের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে গেল,
_তিয়ান কোন কিছুর বিনিময়ে হেল্প করে না,তাই তার ঋণ শোধ করতে চাওয়াটাও সহজ বিষয় না।But still when u wanna do this..then,Best of luck. Miss. Bashpata. বলেই বাঁকা হাসতে হাসতেই ক্লাস রুমে ঢুকে গেল সে।
পলক হতভম্ব হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। বিথিও তাজ্জব পুরো। ভাবছে তিয়ান এটা কি করলো? কেন করলো? এসব ভাবতে ভাবতেই সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো স্যার আসছে ক্লাসের দিকেই। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল সে পলকের দিকে। পলকের কোন নড়চড় না দেখে একপ্রকার টেনে ধাক্কিয়েই নিয়ে গেল তাকে ক্লাসরুমের ভিতরে।
চলবে….
#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_২৪
©জারিন তামান্না
৪ দিন পর,
কলেজ ক্যাম্পাসের পুকুরঘাটে বসে আছে তিয়ান। সময়টা রোদ দুপুর শেষের বিকেলবেলা। বিষন্ন মনে কি যেন ভাবছে সে। এদিকে তাকে খুঁজতে খুঁজতে পুকুর ঘাটের দিকে এসেছে পলক আর বিথি। পলক আসতে চায়নি কিন্তু বিথিও নাছোড়বান্দা। পলককে সে কিছুতেই হারতে দিবে না তিয়ানের কাছে। তাই ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে ওকে।
পুকুরের কাছে এসে দেখলো তিয়ান একা বসে আছে। আশেপাশে কেউ নেই। কলেজ ছুটি হওয়ায় মোটামুটি খালি হয়ে এসছে ক্যাম্পাস। তাই দেখে বিথি বললো,
_যা দিয়া আয় ওইটা। সব লেনদেনের হিসাব ক্লোজ কইরা ফেল এখনই।
_আমি একা যাবো না রে বিথু। তুই চল সাথে।
_আমি যাবো ক্যান? তোর ঋণ তুই শোধ করবি। আর আমারে দেখলে তিনু ঠিক বুইঝা ফেলবে কাজটা আমি করে দিছি। তাই তুই একাই যাবি।
_প্লিজ দোস্ত চল। তোরই বেস্টু ও। আর তুই আমার বেস্টু। সো তুই গেলে ও কিছুই ভাববে না এসব। প্লিজ প্লিজ প্লিজ..চল না রে দোস্ত। করুণ মুখে পলকের করা এই অনুরোধ বিথি ফেলতে পারলো না। খানিক ভেবে বললো,
_আচ্ছা চল। বিথির কথায় স্বস্তি পেল পলক। তারপর, দুজনে একসাথে গিয়ে দাঁড়ালো তিয়ানের পেছনে।
কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছিল তিয়ান। তা দেখে বিথি এগিয়ে গিয়ে তিয়ানের পিঠ চাপড়ে দিয়ে তার পাশে বসতে বসতে বললো,
_কি রে ব্যাটা? একা একা বইসা আছোস ক্যান এইনে?
পাশ ফিরে বিথিকে একনজর দেখলো তিয়ান। কিন্তু কোন জবাব দিল না তার কথার। বিথি বেশ অবাক হলো তিয়ানের এই কাজে।তবে সাথে এটাও বুঝলো যে তিয়ানের মন খারাপ কোন কারণে। পেছন ফিরে পলককে দেখলো একবার বিথি। তিয়ানের পেছনে দু কদম দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার সামনে কিছু জিজ্ঞেস করবে কি করবে না ভাবতে ভাবতেই জিজ্ঞেস করে ফেললো সে। তিয়ানের গালে হাত দিয়ে মুখটা নিজের দিকে ফেরালো বিথি। তারপর চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো যে কি হয়েছে। তিয়ান কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো বিথির চোখের দিকে। তার চোখে তিয়ানের জন্য চিন্তা খেলা করছে। সেই সাথে কি হয়েছে সেটার জিজ্ঞাসা। তিয়ান এবারেও কিছু বললো না। শুধু হাতের মুঠো খুলে একটা ব্রেসলেট এগিয়ে দিলো বিথির দিকে। ব্রেসলেটটা দেখেই চিনলো বিথি। এটা সিন্থিয়ার হাতে দেখেছে সে বিগত ৭ মাস ধরে। তিয়ান দিয়েছিল তাদের রিলেশনের শুরুতে। তিয়ানের গার্লফ্রেন্ড অহরহ চেঞ্জ হলেও সিন্থিয়ার প্রতি বেশ সিরিয়াস ছিল তিয়ান।বিথিকে বলেছিল সব ঠিক থাকলে ওর সাথেই সেটেল হতে চায় সে।সিন্থিয়া স্মার্ট,সুন্দরী আর ভালো স্টুডেন্টও। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে।কিছুটা উগ্র টাইপের। তিয়ানের প্রতি ওর শুরু থেকেই নজর ছিল।তাই একটা সময় বন্ধুত্বের নাম করে সম্পর্ক শুরু করলেও সিন্থিয়ার তিয়ানকে নিয়ে করা পাগলামি,শো অফ গুলোর কারণে একসময় তা রিলেশনশিপে গড়ায়। তিয়ান উগ্র না হলেও বেশ ফ্রি স্টাইলের লাইফ লিড করে সে। সিন্থিয়াও তার কোন কাজে বাঁধা দেয় না। ঠিক এই কারণেই সিন্থিয়ার প্রতি বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। বিথির সিন্থিয়াকে বিশেষ একটা পছন্দ না হলেও তিয়ানের কারণে কিছু বলেও না।সিন্থিয়ার কিছু কিছু কথা বা কাজে তিয়ানের আপত্তি তাদের ঝগড়ার কারণ হতো। কিন্তু,সিন্থিয়া বা তিয়ান নিজেদের মাঝে কথা বলে সেটা মিটিয়েও নিতো।শেষ দু দিন আগেও বেশ ঝগড়া হয়েছিল তাদের সেটা জানে বিথি।কিন্তু,ব্রেসলেটটা কেন তিয়ানের কাছে সেটা বিথি বুঝলো না। তাই জিজ্ঞেস করলো, এইটা তো…
_She broke up.
_What?হতভম্ব স্বরে বললো বিথি।
_হ্যাঁ। আজ ব্রেসলেট ফিরিয়ে দিয়ে আমার সাথে সম্পর্কটা শেষ করে গেছে।
_কিন্তু ক্যান? হঠাৎ কি হইছে এমন যে ও..
_ Because now she loves someone else.
_ও বললো আর তুই মাইনা নিলি? এত সব পাগলামি কইরা তোর সাথে সম্পর্কে জড়াইলো আর এখন বলে অন্য কাউকে ভালোবাসে? ফাইজলামি পাইছে? বেশ রাগ রাগ স্বরে বললো বিথি।
_ব্যাপারটা আজকের না রে বিথু। লাস্ট ২ মাস ধরেই ও কেমন যেন চেঞ্জ হয়ে গেছিল। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেসও করছি ওরে বাট ক্লিয়ার করে কিছু বলে নাই। বেশি কিছু বললেই রাগারাগি করতো। ঝগড়া হইতো আমাদের। আর গত পরশু হিডেন বার্গ (ছদ্মনাম) গেছিলাম বলছিলাম না তোরে?
_হ্যাঁ,,ওই তো নিউ রেস্টুরেন্টটা..
_হু,,ওখানে গেছিলাম বাফু ওদের নিয়ে। সেও গেছিল তার নিউ বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে। তাদের রোমান্টিক মোমেন্ট শেয়ার করতে ব্যস্ত ছিল। আমি দেখেও কিছু বলি নাই তখন। বাইরে সিনক্রিয়েট করে কি হতো বল? তাই পরে যখন এটা নিয়ে জিজ্ঞেস করছি সে স্বীকার করেনি। ঝগড়া হইছিল।অনেক। বাট এবার সে কলও করে নাই একবারও। আর আজকে এসে বলছে আমার জন্য কোন ফিলিংস নাই তার। যা ছিল সব তার ইনফ্যাচুয়েশনস। আমি অনেক করে বলছি,বুঝাইছি বাট জোর করতে ইচ্ছা করলো না। ছেড়ে দিলাম। বলেই তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে হাসলো সে। বিথির কাছে সে হাসি স্পষ্ট জানান দিচ্ছিল কতটা কষ্ট পেয়েছে তিয়ান। ক্লাস টু থেকে একে অপরের বন্ধু তারা।বাড়িও কাছাকাছি হওয়ায় প্রায় একসাথেই বড় হওয়া দুজনের। খুব ভালো করেই চেনে জানে তিয়ানকে। বুঝে। কিছুটা চাপা স্বভাবের ছেলেটা। বাবা মা কে কাছে পায়নি খুব একটা। বিথির পরিবারের সাথেই উঠা বসা। আর বাকিটা সময় একলা থাকা। নয় তো বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটায়। নিজের কষ্টগুলোকে কেবল বিথির সাথেই শেয়ার করে সে। তাই আজও কোন ভণিতা ছাড়াই বলে দিল সে সবকিছু। তিয়ানের অবস্থা দেখে কিছু বলতে পারলো না। শুধু শক্ত করে তার হাতটা ধরলো। তিয়ানও বিথির কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো চুপচাপ। দূরে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখলো পলক। শুনলোও সবটা। কিন্তু কাছে গেল না তাদের। ফিরেও গেল না ওখান থেকে। এদিকে তিয়ানের সাথে কথা বলতে বলতে বিথিরও খেয়াল ছিল না পলক যে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে আর তারা ঠিক কি কাজের জন্য এখানে এসেছিল। কিছুটা সময় পরে বিথির ফোন বেজে উঠলে নিরবতায় ছেদ পড়লো তাদের। ফোন বের করে দেখলো বিথির কাজিন কল করেছে। আজ তার জন্মদিন। বিথি কখন আসবে পার্টিতে সেটা জিজ্ঞেস করতেই কল করেছে।
_হ্যালো…হ্যাঁ,,দোলন, শোন বোন…আমি খুব স্যরি। বাট আমি আসতে পারবো না আজকে। তুই প্লিজ মাইন্ড করিস না।
_ফাইজলামি করিস তুই? আসবি না ক্যান তুই..তোর জন্যই তো এই বেলায় পার্টির প্রিপারেশন হইছে। এখন তুই বলতেছিস আসবিনা। ক্যান আসবি না শুনি?
_আ……আমি একটু অন্য কাজে বিজি আছি রে। এই জন্যই আসতে পারবো না। তুই প্লিজ রাগ করিস না সোনা বোন আমার।
_তিয়ানের সাথে আছিস তুই,নাহ?
_হু।
_তাইলে আর কি! এখন তো দুনিয়া উল্টায়া গেলেও ওরে ছাইড়া নড়বা না তুমি। এ্যাইই…তুই সত্যি কইরা বল তো ওর সাথে তোর শুধুই বন্ধুত্ব নাকি…
_ওইই…লিমিটে থাক। কি সব বলতেছিস। তুই জানিস সব। ভুলভাল বকিস না জেনে শুনে।রাখ এখন। আর যা পার্টি কর। হ্যাপি বার্থডে এগেইন।
_ওই ওই ওইইই…ওয়েট। স্যরি বোন আমার। আর বলবো না এভাবে। তাও তুই আয় প্লিজ।আধা ঘন্টার জন্য হইলেও আয়।তোরে ছাড়া পার্টি জমে নাকি!! তিয়ানকে বল ও বুঝবে.. প্লিইইইইজজজ
_আরেএএ বললাম তো না।
বিথির এমন কথোপকথন শুনে তিয়ান ইশারায় বললো যেতে। বিথিও না করলো। কিন্তু তিয়ানের কথায় শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো সে যাবে। দোলন তখনো ফোনে কানেক্টেড। ওকে বললো, সে আসছে। ফোন রাখতেই আরেকটা কল এলো। কথা বলতে বলতেই তিয়ানের থেকে বিদায় নিল সে। উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরতেই পলকের উপর নজর গেল তার। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল সে কি জন্য এসেছিল এখানে। ইশারায় তিয়ানকে দেখিয়ে পলককে বললো কাজটা শেষ করতে। বলেই একপ্রকার দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল ওখান থেকে।পলক তাকে কি যেন বলতে গিয়ে… আ..উচ্চারণ করায় পিছন ফিরে তাকালো তিয়ান। দেখতে পেল পলক দাঁড়িয়ে আছে। বিথিকে কিছু বলার আগেই চলে গেছে সে। ঘুরে দাঁড়াতেই তিয়ানের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল তার। বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল সে। তিয়ানও বেশ অপ্রস্তত হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবলো,পলক এখানে? কখন এসেছে? সে কি শুনেছে সব!এসব ভাবতে ভাবতেই তাকে জিজ্ঞেস করে ফেললো তিয়ান,
_তুমি এখানে? কখন এসেছো?
_বিথির সাথে।না মানে বিথি আমার সাথে এসেছিল।কিন্তু..
_অহ। বলেই করে সামনে ফিরে তাকালো সে। বুঝলো যে পলকও সবটাই শুনেছে তাহলে।ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,
_এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? বিথু তো চলে গেছে। তুমিও বাড়ি ফিরে যাও।
_হ্যাঁ.. যাবো কিন্তু..
_কিন্তু কি? কোন দরকার ছিল তোমার?
_হ্যাঁ…ওই.. বেশ লজ্জা লাগছে পলকের। মুখ ফুঁটে বলতে পারছে না কি জন্য এসেছিল সে এখানে। বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তিয়ান পলকের দিকে। কিন্তু সে কিছু বলছে না। ইতস্তত করছে বেশ। তা দেখে তিয়ানও আর কিছু বললো না। সামনে ফিরে কানে হেডফোন গুঁজে বসে রইলো ওখানেই।
খানিক বাদে পলক গিয়ে দাঁড়ালো ওর পাশে। এক হাতে আস্তে করে বাড়িয়ে দিল সিগারেটের প্যাকেটটা। আচমকা চোখের সামনে সিগারেটের প্যাকেট দেখে চমকালো তিয়ান। পাশ ফিরে চাইতেই দেখলো পলক দাঁড়িয়ে আছে। অবাক নয়নে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো পলকের দিকে। পলক উশখুশ করছে। মনে মনে ভাবছে, তিয়ান কেন নিচ্ছে না প্যাকেটটা। নিলেই তো সে যেতে পারে।এখানে এভাবে থাকতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তার। লজ্জাও লাগছে খানিক। তিয়ানকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে না পেরে একসময় পলক নিজেই বললো, কি হলো..নাও ধরো এটা। পলকের কথায় খানিক শুকনো হাসলো তিয়ান। তারপর হাত বাড়িয়ে নিল প্যাকেটটা। তিয়ান ওটা নিতেই পলক চটপটে গলায় বললো, আমি কারও ঋণ রাখি না,তোমারটাও পরিশোধ করে দিলাম। আসছি এবার। বলেই যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ঝট করে তার এক হাত টেনে ধরলো তিয়ান। পলক অবাক হয়ে পাশে তাকাতেই দেখলো তিয়ান আগের মতই বসে আছে। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই তিয়ান বললো,
_কই যাবা এখন?
_কই যাবো মানে??বাসায় যাবো। ক্লাস তো শেষ সেই কখন।
_একটু বসো এখানে।
_মা…আ…মানে? ঘাবড়ানো গলায় প্রশ্ন করলো পলক।
তিয়ান সেটার জবাব না দিয়ে শান্ত কন্ঠে আবার বললো, বসো। তিয়ানের কন্ঠে কিছু একটা ছিল যেটা পলকের অজান্তেই তাকে বাধ্য করলো তিয়ানের কথা মানতে। আস্তে করে তিয়ানের থেকে একটু দূরে তার পাশেই বসলো সে। পাশে পলকের উপস্থিতি টের পেতেই ওর হাতটাও ছেড়ে দিল তিয়ান। তারপর সিগারেটের প্যাকটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,
_ভালো সময় ভালো জিনিস দিলে। এটার খুব দরকার ছিল এখন। থ্যাংক্স।
পলক কিছু বললো না।চুপচাপ বসে রইলো তিয়ানের পাশে। তারপর তিয়ান প্রশ্ন করলো, তুমি শুনেছো সবটাই,তাই না?
_হ্য…হ্যাঁ। আসলে..
_এটা তুমি নিজে কিনেছো? সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বললো তিয়ান।
পলক কি বলবে বুঝতে পারলো না। সত্যি বলবে? নাকি মিথ্যা বলবে বিথির কথামত। তারপর কি যেন একটা ভেবে সত্যিটাই বলে দিল।
_না…বিথু ম্যানেজ করে দিয়েছে।
_কাজটা কি ঠিক হলো?
_ভুলেরও কিছু হয়নি। তোমার ঋণ পরিশোধ করার ছিল,সেটা আমি কিভাবে ম্যানেজ করেছি সেটা তোমার দেখার বিষয় তো নয়। মিনমিনে গলায় বললো পলক। তিয়ান হাসলো পলকের কথায়। তারপর বললো,
_হ্যাঁ,,সেটা ঠিক বলেছো। তবে,এই মূহুর্তে এটা পেয়ে বেশ উপকার হলো। বলতে বলতেই একটা সিগারেট নিয়ে মুখে দিল সে। আগুন জ্বালাতে যাবে তার আগেই পলক সেটা দেখে একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠলো। বললো,
_এইইই…..কি করতেছো এটা? আচমকা পলকের এহেন চিৎকারে থতমত খেয়ে গেল তিয়ান। হতভম্ব চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পলকের দিকে তাকাতেই সে বললো,
_আরেএএএ বাবা…ক্যাম্পাসে বসে সিগারেট খাবে কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এখানে এসব পুরোপুরি নিষিদ্ধ, জানো না তুমি?
পলকের এহেন কথায় হতভম্ব নয়নে কতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা হেসে দিল তিয়ান।তিয়ানকে ওভাবে হাসতে দেখে সরু চোখে তাকালো পলক। মনে মনে বললো, কি ব্যাপার এভাবে হাসতিছে ক্যান ছেলেটা? ছেঁকা খেয়ে পাগল হয়ে গেল নাকি? কিন্তু মুখে বললো,
_এখন রেখে দাও। বাসায় গিয়ে খেও।
_উঠো।হাসি থামিয়ে বললো তিয়ান।
_উঠবো মানে?
_উঠবা মানে উঠবা। দাঁড়াবা। তারপর হাঁটবা।বাসায় যাবো আমরা।
_আমরা? বোকার মত প্রশ্ন করলো পলক।
_তো কি? তোমার কি রাতে ক্যাম্পাসে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে আছে?
ফ্যালফ্যাল চোখে তিয়ানের দিকে তাকিয়ে ডা’য়ে বা’য়ে মাথা নাড়িয়ে না করলো পলক।তিয়ানও এতক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পলক ওখানেই বসে আছে। তা দেখে তিয়ান বললো,
_উঠো তাহলে। তোমাকে আগায় দিয়ে যাই । সন্ধ্যা নামতে বেশি সময় নেই। একা যাওয়া ঠিক হবে না।
পলক অবাক হলো বেশ। যদিও সেদিনও সে দেখেছে তিয়ানের দায়িত্ববোধ বেশ ভালোই। তবুও আজ এমন তার একটা অবস্থাতেও পলকের কথা ভাবতে দেখে সত্যিই অবাক হলো সে। মুগ্ধও হলো কিছুটা। আপন মনেই হাসলো সে। তারপর উঠে দাঁড়ালো সেও। সে উঠে দাঁড়াতেই দুজনে একসাথে হাঁটতে হাঁটতেই বেরিয়ে এলো ক্যাম্পাস থেকে। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে পলককে জিজ্ঞেস করলো,আমার সাথে রিক্সায় যেতে কোন সমস্যা আছে তোমার?
তিয়ানের এহেন প্রশ্নে বেশ অপ্রস্তত হয়ে গেল পলক। বাবা, ভাই ছাড়া কখনো কোন কাজিন ভাইয়ের সাথেও রিক্সায় উঠেনি সে। সেখানে অন্য কোন ছেলের সাথে কিভাবে সে.. এসব ভেবে বেশ ইতস্তত করছিল পলক। মুখে কিছু বলতে পারছে না। তাকে এভাবে ইতস্তত করতে দেখে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো তিয়ান,
_ওকে ফাইন। বাসেই যাবো আমরা। বলেই সামনের বাসটপের দিকে পা বাড়ালো তিয়ান। বাসে উঠে মাঝখানের সিটগুলোয় বসলো তারা। পলককে জানলার কাছে দিল।যেন কেউ চলাচল করলে তার সাথে ছোঁয়া না লাগে ওর। পলক বেশ স্বস্তি পেল এতে। বাসে জার্নি করার অভ্যাস একেবারেই নেই তিয়ানের।এম্নিতে কলেজে, টিউশানিতে নিজের সাইকেল নিয়েই যাতায়াত করে সে। দূরে কোথাও গেলে নিজেরদের গাড়ি নিয়ে যায়। নয় তো রিক্সা বা বুক করা সি এন জি। কিন্তু, পলককে নিয়ে এ সময় সি এন জি তে যাওয়াটা ঠিক হবে না বলে মনে হওয়ায় বাসেই যেতে হলো তাকে। তাই প্রথমবার বাসে উঠায় বেশ অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো সে। তা খেয়াল করলো পলক। সে বুঝলো ব্যাপারটা। বিথির কাছে শুনেছে তিয়ান সম্পর্কে। কিন্তু তারও বা কি করার। এ সময় তিয়ান তাকে একা ছাড়বে না আর একা বাসে ট্রাভেল করাও রিক্স তার জন্য। তাই চুপচাপ মেনে নিলো ব্যাপারটা।
বাসে যেতে যেতে তেমন কোন কথা হলো না দুজনের। জানলার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসা আলোর সাথে সন্ধ্যা নামা দেখছে পলক। বাইরে তাকিয়েই একসময় পলক বললো,
_ভালোবাসাটাকে কখনো দূর্বলতার খাতায় জায়গা দিতে নেই। হৃদয় যখন হৃদয় টানে না সেখানে ভালোবাসা বলে কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না আর। বাহ্যিক সাক্ষ্য প্রমাণ কখনো ভালোবাসার প্রমাণ দিতে পারে না। অনুভব আর বিশ্বাসটাই সব!
তিয়ান ফোনে কিসব যেন ঘাটাঘাটি করছিল। আচমকা পলকের এহেন কথায় থমকে গেল সে। পাশ ফিরে চাইলো পলকের দিকে। পলক বাইরের দিকেই তাকিয়ে আছে। মৃদুমন্দ বাতাস এসে লাগছে তার চোখে মুখে।আর তাকে পাশ কাটিয়ে কিছুটা বাতাস এসে ছুঁয়ে দিল তিয়ানকেও। তিয়ান কিছু বললো না পলকের কথার বিপরীতে। মুগ্ধ নয়নে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো পলকের দিকে। তারপর, মুখ ফিরিয়ে নিল সামনের দিকে।নিরবতায় কাটিয়ে দিল বাকিটা পথ।
_________________________________
বাস থেকে নেমে পলকের বাসার গলি পর্যন্ত এগিয়ে দিল তাকে তিয়ান। আজকেও ভাড়াটা তিয়ান দিয়েছে। পলক গাল ফুলিয়ে ছিল এই নিয়ে। কথা বলেনি আর একটাও। তাই গলির মুখে ঢুকেও যখন কোন কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিল পলক তখন পেছন থেকে তিয়ান কিছুটা জোর আওয়াজে বললো,
_হেল্প করিনি..বন্ধু ভেবে দিয়েছি ওটা….ঋণ বা দান হিসেবে নয়। ফেইসটা স্বাভাবিক করো মিস. বাঁশপাতা। ভরসন্ধ্যায় এমন গালফোলা বাঁশপাতা দেখলে ভয় পাবে তো মানুষ। বলেই সকৌতুক হাসলো তিয়ান।
কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে সবটাই শুনলো পলক। বন্ধু ভেবে দিয়েছি-কথাটা ভালো লেগেছে তার।রাগটা তখনই গায়েব হয়ে গেছিল তার,তাই শেষ কথাটায় সেও ফিক করে হেসে দিল। হাসি মুখেই বললো,
_বন্ধুকে ধন্যবাদ দিতে নেই। তাই তোমাকেও দিলাম না। সাবধানে বাড়ি ফিরে যেও। আসছি। আল্লাহ হাফেজ।
_yeah….u too.Bye.
এরপর ফিরে গেল দুজনে দুজনের রাস্তায়। সাথে নিয়ে গেল কোন রকম আয়োজন, প্রয়োজন কিংবা দীর্ঘদিনের পরিচয় ছাড়াই সদ্য তৈরী হওয়া একটা নির্মল বন্ধুতের সম্পর্ক নিয়ে।
চলবে…