ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-২৫+২৬

0
376

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_২৫
©জারিন তামান্না

সেদিনের পর থেকে বিথি আর তিয়ানের দলে যোগ হলো পলক নামের আরেকজন সদস্য। বেশ ভালোরকম বন্ধুত্ব হয়ে গেল তাদের মাঝে।প্রায় রোজ দিন তারা একসাথে বসে আড্ডা দিত। গ্রুপ স্টাডিও করতো।বিথি নিজের টিফিন খুব কমই খেত।কারণ,রোজ রোজ ব্রেড, বাটার, জ্যাম,স্যান্ডুইচ, বা ফাস্টফুড খাবার প্যাক হতো তার টিফিনে। এ জন্য প্রায়দিন টিফিন আনতো না সে ।ফলাফল পলক যে টিফিন নিয়ে আসতো সেটাতে একটা অংশ বিথির জন্য বরাদ্দ থাকতো। বিথি আর তার বন্ধুত্ব হবার আরও একটা কারণ ছিল এই খাবার ভাগাভাগির ব্যাপারটা। আর বিথির আর পলকের এই ভাগাভাগিতে আরও একজন ভাগিদারী হিসেবে যোগ হলো তিয়ান।ক্যাম্পাসে থাকাকালীন তাদের প্রায় একসাথেই দেখা যেত।বিথির পরে ক্লোজ মেয়ে বন্ধু বলতে তিয়ান পেল পলককে।আর পলকেরও একমাত্র আর প্রথম কাছের ছেলে বন্ধু হলো তিয়ান। বিথি খুব খুশি হয়েছিল তাদের এমন সম্পর্কে। তার দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড আর সে।কলেজের একটা সুপরিচিত দল হয়ে গেল তারা তিনজন মিলে। সিন্থিয়ার ব্যাপারটা একপ্রকার চাপা পড়ে গেল সময়ের সাথে। ক্লাসে দেখা হলেও এড়িয়ে যেত তিয়ান।আর এই কাজে বিথির পরে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল পলক। বিথি পইপই করে তাকে বলেছিল যে সিন্থিয়ার মুখোমুখি হতে দেখলেই তিয়ানকে কোন একটা বাহানায় সরিয়ে আনে।আর বিথির প্রক্সি হিসেবে পলকও নিষ্ঠার সাথে করতো এই কাজটা। দেখা যেত সিন্থিয়ার মুখোমুখি হলেই এটা ওটা কোন কিছু বলে বিথি নয় তো পলক মাইন্ড ডাইভর্ট করে দিতো তিয়ানের। এটা ওটা বাহানায় সরিয়ে আনতো তাকে।তিয়ানের অন্য বন্ধুরাও খুব হেল্প করেছে তাকে সিন্থিয়ার ব্যাপারটা থেকে বেরিয়ে আসতে।তিয়ান ছিল ব্যাচের মোস্ট এলিজেবল বয়।সিন্থিয়া তার গার্লফ্রেন্ড থাকাকালীন বেশ ভালো একটা প্রভাব ফেলেছিল এটা তার জন্য।বিশেষ একজন হিসেবেই পরিচিত ছিল সে ক্লাসমেটদের কাছে। কিন্তু,ব্রেক আপের পর সে ব্যাপারটা আর রইলো না।আর একপ্রকার অপ্রকাশ্যেই সেই জায়গাটা পেল পলক।সবাই নিজেদের মাঝে ধারণা করে নিল যে পলক তিয়ানের নতুন গার্লফ্রেন্ড। সিন্থিয়াকে নিয়েও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো তারা।তিয়ানকে ছাড়ার ভুল করেছে এই বলে।ফলাফল সিন্থিয়ার ক্ষোভের শিকার হলো পলক।আর এই হিংসা আর ক্ষোভের কারণে একদিন একটা ঘটনা ঘটলো যেটা পলক আর তিয়ানকে নিজেদের অজান্তেই তাদের নিয়ে গেল একে অন্যের আরও কাছে।

ক্যাম্পাসে একদিন,

তখন তাদের টেস্ট এক্সাম চলছে। সবাই মোটামুটি হলে চলে গেছে।তিয়ান বিথি আর পলকের রোল অনুযায়ী ভাগ্যক্রমে একই রুমে কয়েক বেঞ্চ আগে পরে কাছাকাছি সিট পড়েছে তাদের। এক্সাম শুরুর আগে পলক পানি খাবে বলে ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো সিন্থিয়া। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো তিয়ান বা অন্য কেউ আছে কিনা। কাউকে না দেখতে পেয়ে বেশ সুবিধাই হলো তার। পলক বেশ বিরক্ত হলো এভাবে তার পথ আটকে দেওয়ায়। ওদিকে এক্সাম শুরু হয়ে যাবে আর সিন্থিয়া এসে তাকে আটকে দিল। সে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতে তার হাত মুচড়ে ধরলো সিন্থিয়া। আচমকা এভাবে হাত মুচড়ে ধরায় বেশ ব্যাথা পেল পলক। ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠলো সে।সে অবস্থাতেই সিন্থিয়া বললো,
_তিয়ানকে তো বেশ ভালোই হাত করেছিস। আমার তো সেদিনই ডাউট হয়েছিল। আমি যেই না তিয়ানকে ছেড়েছি তোর আর তর সইলো না,হাত করে নিলি ওকে। যার জন্য ক্যাম্পাসে এত সুন্দর সুন্দর মেয়ে থাকতেও তোর মত কালী মেয়েকে নিজের গার্লফ্রেন্ড করলো তিয়ান!

_তিয়ানকে হাত করা কি এতই সহজ সিন্থিয়া? রূপ দিয়ে তিয়ানকে বশ করার মত ভ্রান্ত ধারণা কেবল তোমারই থাকার কথা!আর তোমার মত পাগলামি করা তো আর যার তার কর্ম নয়।আবার ভালোবাসতে না পেরে ইনফ্যাচুয়েশনস বলে হুট করে ছেড়ে যাওয়াটাও তুমি ছাড়া অন্য কারো দ্বারা ইজিলি হবার নয়। আর পলকের মত সোজা মনের মেয়ের পক্ষে তো নয়ই! – সিন্থিয়ার হাত থেকে পলকের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিতে নিতে বললো তিয়ান। আচমকা ওখানে তিয়ানকে দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেল সিন্থিয়া।কারণ সে জানে তিয়ান নিজের ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডস বা পার্সোনাল ম্যাটারগুলো নিয়ে কতটা রেসপন্সিবল, কেয়ারিং আর পজেসিভ। তিয়ানকে নিয়ে বিথির সাথেও বেশ কয়েকবার ঝামেলা হয়েছে তার। কিন্তু,তিয়ানকে এই নিয়ে কিছু বলতে গেলে উল্টো তাকেই ভিলেন হতে হয়েছে।আর ইদানিং অপ্রকাশ্যে সবাই বলে পলক তিয়ানের গার্লফ্রেন্ড। তাই তার জায়গাটা তিয়ানের কাছে কতটা স্ট্রং সেটা ধারণা করতে বেশি বেগ পেতে হলো না সিন্থিয়াকে। ভয়ার্তক চোখে একবার দেখলো সে তিয়ানকে। কিন্তু তিয়ানের ফেইস একদম স্বাভাবিক। সেটা দেখে আরও কিছুটা ভয় পেল সে।
এদিকে তিয়ানকে ওখানে দেখে বেশ অবাক হলো পলক। এক্সাম হলে খাতা দিয়ে দেওয়ার পরেও পলকে হলে ফিরতে না দেখে খুঁজতে এসেছিল তিয়ান।আর তখনই সিন্থিয়ার সাথে ওই অবস্থায় দেখে সে।সিন্থিয়ার কথাগুলো শুনে বেশ রাগ উঠলেও এক্সামের আগে কোন ঝামেলা চায় না বলেই চুপচাপ তার কাছে গিয়ে পলকের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েছে সে। কিন্তু,ওটুকুতেও ক্ষান্ত হলো না সে। পলককে আরেকটু অবাক করে দিয়ে তার হাতের আঙুলে নিজের আঙুল গুঁজে মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরলো। তারপর, সেটা সিন্থিয়াকে দেখিয়ে বললো,
_আমার আর পলকের সম্পর্ক বা সেটার বন্ডিং বোঝার মত ক্ষমতা তোমার নেই। হ্যাঁ,,এটা সত্যি যে এই মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি।আর পলকও আমাকে ভালোবাসে।কি তাই তো পলক? পলক পুরো হতভম্ব। কি বলে তিয়ান এসব? তিয়ান তাকে ভালোবাসে?কবে কখন থেকে? আর সেই বা তিয়ানকে ভালোবাসলো কখন? তিয়ান তাকিয়ে আছে পলকের দিকে। আর সিন্থিয়াও। পলকে চুপ থাকতে দেখে মুচকি হাসলো তিয়ান। তারপর, সিন্থিয়াকে বললো,
এভাবে নিরবেই সবচেয়ে বিশুদ্ধভাবে আমাকে ভালোবাসে পলক। তোমার মত পাগলামি করে শো অফ করে অন্যকে বলার বা দেখানোর প্রয়োজন ওর হয় না। কিন্তু সেই ভালোবাসার লেভেল বা পিউরিটি বোঝার মত সেন্স তোমার কখনো হবে না। সো,ফারদার আমাদের রিলেশন নিয়ে কখনো কোন প্রশ্ন তোলার সাহস করো না তুমি। গট ইট? ইউ বেটার গট ইট! আর কখনো পলককে ডিস্টার্ব করবে না তুমি।আর যদি সেটা করার ভুল আবার তুমি করো তাহলে তিয়ান কি করতে পারে আশা করি ঠিক ঠিক জানা আছে তোমার!
এক্সাম শুরু হবে পলক। চলো।
পলক তখনও শকড। তিয়ানের কথায়। নিজে থেকে নড়ার বোধটাও যেন খোয়া গেছে তার।তাই তিয়ান তার হাত ধরেই টেনে নিয়ে গেল এক্সাম হলে। হলে ঢোকার আগে শান্ত কন্ঠে বললো,
_বেশি স্ট্রেস নিও না পলক। তখন যা বললাম ভুলে যাও। মন দিয়ে এক্সাম দাও।
_ভুলে যাবো? অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো পলক।
_হ্যাঁ। সব কথা মনে রাখতে নেই। চলো এখন।

সেদিনের এক্সামটা ঠিকঠাক দিলেও তিয়ানের কথা একপ্রকার চেপে বসলো পলকের মাথায়। তিয়ানকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলো।অদৃশ্যভাবেই তিয়ান নামক অস্তিত্ব জুড়ে বসলো পলককে।

টেস্ট এক্সামের পরে দেখতে দেখতে এইচ. এস. সি. এক্সামও হয়ে গেল তাদের। এক্সাম শেষে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল পলক আর তিয়ান। পলকের বাসায় বিথির যাওয়া আসা থাকলেও তিয়ানের ছিল না। কথা,দেখা হওয়া কমে গেল তাদের।বিথি এলে তার থেকেই খোঁজ খবর যা মেলার মিলতো পলকের। এরপর মাস ৩ পরে রেজাল্টও হয়ে গেল। বেশ ভালো রেজাল্ট করেছে তিয়ান আর বিথি। কিন্তু পলকের তাদের তুলনায় কিছুটা কম মার্কস এসেছে। তাই রেজাল্টের পর যখন ভার্সিটি এডমিশনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল পলক তখনই একদিন খবর এলো তিয়ান আর বিথি বাইরে এডিমিশনের জন্য এপ্লাই করেছিল।আর ভালো রেজাল্ট হওয়ায় তারা দুজনেই স্কলারশিপ নিয়ে চান্স পেয়েছে। বিথি কানাডায় আর তিয়ান অস্ট্রেলিয়ার একটা ভার্সিটিতে। খুব শিঘ্রই চলে যাবে তারা। তাই যাওয়ার আগে দেখা করবে বলে এক সন্ধ্যায় বিথি এসে নিয়ে গেল পলককে। আজ রাতটা তাদের বাড়িতে থাকবে বলে। আমজাদ আলী প্রথমে রাজী না হলেও পলাশ ঠিক রাজি করিয়ে পাঠিয়ে দিল পলককে। আর সে রাতেই ঘটলো পলকের জীবনের এক নতুন সূচনা।

রাতের খাওয়া শেষে বিথিদের ছাদে বসে আছে পলক আর তিয়ান ।বিথি নিচে গেছে কফি আনতে। আজ প্রায় ৫ মাস পরে তিয়ানের সাথে দেখা হলো পলকের। স্বাভাবিক কথা বার্তা বললেও তিয়ানকে দেখে কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল পলকের। পলক ভাবলো হয় তো পরিবার ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাই মন খারাপ। ভরা পূর্ণিমার রাত। ঝলমলে চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে চারপাশ। চুপচাপ বসে ছিল ওরা দুজন।একসময় পলক উঠে গিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। বাতাসের দমকেই একসময় পলকের মাথা থেকে ওড়নার খসে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে গেল তার খোলা চুলগুলো। তিয়ান মুগ্ধ চোখে দেখলো তাকে। উঠে এগিয়ে গেল তার দিকে। পলকের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো রেলিং ঘেঁষে। হীম শীতল কন্ঠে বললো,
_এ কদিনে একটুও মিস করোনি আমায়,তাই না?
আচমকা তিয়ানের এহেন কথায় চমকে উঠলো পলক। নিজেকে ধাতস্ত করে জবাব দিল সে।
_করেছি।তোমাদের সাথেই এতগুলো দিন কেটেছে। মিস করাটাই স্বাভাবিক।
_আমি সবার কথা নয়,আমার কথা জিজ্ঞেস করেছি পলক।
তিয়ানের কন্ঠে আরও একধাপ চমকে উঠলো পলক। সহসা কি জবাব দিবে ভেবে পেলো না সে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। তাকে চুপ থাকতে দেখে তিয়ান বললো,
_ভালোবাসি তোমাকে। একজন বন্ধুর থেকেও বেশি।যে ভালোবাসায় একটা ছেলে আর মেয়ে এক হওয়ার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, সেভাবে ভালোবাসি তোমায়।সেদিন যখন বলেছিলাম ভালোবাসি তোমাকে,বন্ধু ভেবেই বলেছিলাম হয় তো। ভালোবাসতাম কিনা তাও জানতাম না।কিন্তু এই ৫ টা মাসের দূরত্ব আমাকে একটু একটু করে বুঝিয়েছে ঠিক কতটা কাছের তুমি আমার। আমার মনের কোন জায়গাটা শুধুমাত্র তোমার। খুব করে ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে।নিজের করে চাই তোমায়। সারাজীবনের জন্য….আমার হবে তুমি,পলক? বলেই পাশ ফিরে তাকালো সে পলকের দিকে। পলকের চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময়। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। তিয়ান কি বললো এসব! এখন কি জবাব দিবে সে?মূহুর্তেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল তার। উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে হালকা হালকা। কিছু বলতে পর্যন্ত পারছে না। তাকে তখনো চুপ থাকতে দেখে তিয়ান কিছুটা এগিয়ে এলো তার দিকে। পলকের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,
_তোমার কাছেও কি আমি শুধু বন্ধুই পলক? এর থেকে বেশি কিছুই নই? অন্য কোন অনুভূতি কি নেই তোমার মনে আমার জন্য?
_আ…আ…আছে।কিন্তু,এই অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ বা সাহস কোনটাই আমার নেই। তোমার সাথে আমার মিল হওয়ার নয় তিয়ান। অযথা অনুভূতিদের প্রশ্রয় দেওয়ার কোন মানে নেই। -পলকের সহজ সরল স্বীকারোক্তি।
_যদি আমি সাহস হই তোমার…প্রশ্রয় দেবে ওদের? হবে আমার?
পলক কি বলবে বুঝতে পারছিল না আর ঠিক তখনই ছাদের দরজায় কফির ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে বিথি বললো,
_আরেএএ.. ছেমড়ি,,,মুখে কুলুপ আটছো ক্যান? হ কইয়া দে।
চমকে তাকালো দুজনেই। পলক বেশ অপ্রস্তত হয়ে গেলেও তিয়ান স্বাভাবিক। কারণ বিথি আগে থেকেই জানতো সব। পলক তখনো চুপ। বিথি এবার জোরেসোড়ে ধমক দিয়ে বললো,
_হ, কইবি তুই?
_হ্যাঁ? থতমত খেয়ে বললো পলক।
তার এই ভুলে বলা ‘হ্যাঁ -কেই স্বীকারোক্তি ভেবে খুশি হয়ে গেল বিথি। তিয়ান হাসলো আলতে করে। কফির ট্রে রেখে আগে গিয়ে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানালো তিয়ানকে। তারপর পলককেও। পলক হতভম্ব। সে তো হ্যাঁ বলে নাই।কিন্তু এরা যেভাবে খুশি হচ্ছে এখন কিছু বললেও শুনবে না কেউ। তাছাড়া,তিয়ানকে সেও বেশ পছন্দ করে। পছন্দের থেকেও বেশি কিছুটা সে ফিল করে তিয়ানের জন্য। তাই হয় তো এভাবেই ভাগ্য মিলিয়ে দিল তাকে তিয়ানের সাথে। এই ভেবেই পলকও পা বাড়ালো এক নতুন সম্পর্কের যাত্রা পথে।

__________________________________

তিয়ান আর বিথি চলে গেছে প্রায় দু বছর হয়ে গেছে। এর মাঝে তিয়ানের সাথে সম্পর্কটাও বেশ এগিয়ে গেছে পলকের।যাওয়ার আগে ফেইসবুক আইডি খুলে এড করে দিয়েছে পলককে তার আর বিথির সাথে। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ওটাই ছিল তাদের একমাত্র পন্থা। তিয়ান পলককে নিয়ে সত্যিই সিরিয়াস। আর পলকও। কিন্তু, এরমাঝেই এক ঝড় এসে উল্টেপাল্টে দিল সব। তিয়ানের বাবার কোম্পানিতে বেশ লস হয়ে গেল। ব্যবসায়ের ডুবি ডুবি অবস্থা। তিয়ানের তখনো ২ বছর বাকি গ্রেজুয়েশনের। স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করলেও বিদেশে পড়ার, থাকা খাওয়ার খরচটাও বেশ ভালো। এদিকে বিজনেসের এই অবস্থা। শুরু হলো তিয়ানের স্ট্রাগল।একটা পার্টটাইম জব ম্যানেজ করলো সে। পড়াশোনায় পাশাপাশি জব আবার বাবার বিজনেসেও বড়ভাইয়ের সাথে নিজের সময়, শ্রম সব কন্ট্রিবিউট করতে শুরু করলো সে। পলকের সাথে যোগাযোগ কমে গেল তার। পলক জানতো,বুঝতো সবটাই। মেন্টালি যতটা সম্ভব সাপোর্ট করতো সে তিয়ানকে।এত কিছুর প্রেশারে তিয়ানও দূরে সরে এসেছিল পলকের থেকে। ছোট খাটো বিষয় নিয়ে রাগ করতো। ফ্রাসট্রেশনগুলো পলকের উপরেই ঝাড়তো সে। পলক তবুও চুপচাপ সহ্য করে ধৈর্য্য নিয়ে তিয়ানের সব কথা, রাগ মেনে নিতো।
কিন্তু কথায় বলে বিপদ যখন আসে চারদিক থেকেই আসে। ঠিক সেভাবেইভাগ্যের পরিহাসে পলকের জীবনেও নেমে এলো আরও কঠিন এক পরিস্থিতি।

একরাতে পলকের বড় বোন পালিয়ে গেল বাড়ি ছেড়ে।সাথে নিয়ে গেছে মায়ের যত গয়না আর আলমারির লকারে রাখা বিশ হাজার টাকা ক্যাশ। মধ্যবিত্ত একটা পরিবারে একই সাথে সম্পদ আর সম্মান খুইয়ে যাওয়া এক ভয়াবহ ব্যাপার। অন্তরা যাওয়ার পরে খুব বাজে একটা পরিস্থিতিতে কেটেছে পলক আর তার পরিবারের। পাড়া প্রতিবেশীদের কথায় টিকতে না পেরে এলাকা ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু পলক সেসবের কিছুই জানায়নি তিয়ানকে।এই ভেবে যে এম্নিতেই বেচারা কত সমস্যায় আছে।মেন্টালি স্ট্রেসড, তারপর এসব বলে তার স্ট্রেসড আর বাড়াতে চায়নি। বিথিকে বললে তিয়ানও জেনে যাবে তাই তাকেও জানায়নি কিছু। কিন্তু,যখন লোকের কথায় পলককে বিয়ে দেওয়ার জন্য তার বাবা একপ্রকার উঠে পড়ে লাগলেন তখন বাধ্য হয়ে পলক সবটা জানালো বিথি আর তিয়ানকে। একদিন বিকেলে ম্যাসেঞ্জারে নক করে পলক সবটা বলার পর তিয়ানকে জিজ্ঞেস করলো,
_এখন আমাদের এ সম্পর্কের ভবিষৎ কি তিয়ান?
_জানি না আমি।
_তুমি ভালোবাসো তো আমাকে?
_বাসি।
_তাহলে এখন যদি সত্যিই আমার বিয়ে দিয়ে দেয় বাবা কি করবো তখন আমি?
_কি আর করবা, বিয়ে করে নিবা।
_বিয়ে করে নিবো?!হতভম্ব স্বরে বললো পলক।
_হ্যাঁ,,কারণ এখন তো আর আমার লাইফ ক্যারিয়ার ছেড়ে তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব না আমার। তুমি যদি অপেক্ষা না করতে পারো তাহলে বিয়ে করে নাও অন্য কাউকে।
_আর তারপর?
_তারপর কি?
_তুমি কি করবা? ভুলে যাবা আমাকে? যেমন সিন্থিয়াকে ভুলে গেছিলা!তারপর যেমন আমাকে ভালোবাসছো,তেমন অন্যকাউকে..
_just shut up Polok. & listen. তোমাকে আমি ভালোবাসি।সত্যিই চাই তোমাকে নিজের করতে। কিন্তু এই মূহুর্তে তোমাকে নিজের করা সম্ভব না আমার।এটা তুমিও জানো। এখন তোমার বোন কি না কি কান্ড করেছে আর তার জন্য তোমার বাবা তোমাকে ভরসা করতে না পেরে বিয়ে দিতে চাচ্ছে,তো এখানে আমার কি করার আছে বলো তো? তবে তুমি যদি আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারো তো করো। আমি সেটেল হয়ে তোমাকে বিয়ে করে নেবো। এটুকু শিওরিটি আমি তোমাকে দিতে পারি।
_তাহলে কি তোমার কথাটা বলবো ফ্যামিলিতে?
_না। এই কাজটা এখন একদমই করবা না। আমি এখন এসব ফেইস করার জন্য প্রিপেয়ার্ড নই। আর আমার ফ্যামিলিকেও এই মূহুর্তে এসবে জড়ানো সম্ভব না।
_আচ্ছা।
_হ্যাঁ।তবে তুমি তোমার বাবাকে বলো এখন বিয়ে করবা না। তাহলেই তো হয়।
_সে চেষ্টা আমার করা হয়ে গেছে তিয়ান। আমি সব চেষ্টা করে ব্যর্থ আর নিরুপায় হয়েই তোমাকে আজ সব বলেছি। নয় তো আমার জন্য তোমাকে কোন ঝামেলায় ফেলার ইচ্ছা আমার ছিল না।
_তুমি ভুল বুঝতেছো পলক। না…একচুয়ালি তুমি বুঝতেই পারতেছো না ব্যাপারটা।
_আমি সব বুঝতে পারছি তিয়ান। তোমার কোন দোষ নেই এতে।সবটাই আমার ভাগ্য।তোমাকে আর এ নিয়ে ভাবতে হবে না।
_পলক প্লিজ! একটু বুঝো। আরেকটাবার ট্রাই করো। বোঝাও তোমার বাবাকে।why r not getting this that I really love u dammit. I want u as mine.
_আমি সব জানি। কিন্তু,আমি কি করবো বলো তো?
_তুমি বোঝাও আংকেলকে। আমাকে আরেকটু সময় দাও পলক।
_বাবা বুঝবে না তিয়ান। আর তোমার জন্য অপেক্ষা করাও সম্ভব না।যদি তোমার হতে হয় তবে ফ্যামিলিতে বলতে হবে তোমার কথা। যেটা তুমি চাইছো না এখন। সেটাও যথেষ্ট লজিক্যাল মানছি আমি। আর যদি তুমি একান্তই চাও আমি তোমার ছাড়া অন্য কারও না হই তাহলে নিজেকে শেষ করে দিতে হবে আমাকে।
_ওকে ফাইন। Do as u wish. But এসবের মধ্যে আমাকে আর জড়াবা না তুমি। বিয়ে করে নাও তুমি। বাবার সম্মান ইচ্ছেটাকেই ধরে রাখো তুমি। আমার হইতে হবে না তোমার। আর কখনো নক দিবানা তুমি আমাকে। Got it? রাগে হতাশায় জর্জরিত হয়ে বললো তিয়ান।

পলক কাঁদছে। খুব কাঁদছে।কিন্তু টেক্সট ম্যাসেজে সে কান্না দেখার সুযোগ তিয়ানের হয়নি। কান্নার কারণে ঠিক কি বলবে আর,,ভেবে পেল না পলক। তাই কোন মতে লিখলো,
_ভালো থেকো। খেয়াল রেখো নিজের।
_আমার কথা তোমার না ভাবলেও চলবে। আজ থেকে তোমার সাথে সম্পর্ক শেষ আমার। -এটুকু বলেই ম্যাসেজ ব্লক করে দিল তিয়ান। রাগ লাগছে তার। তবে সেটা পলকের প্রতি নয়। নিজের প্রতি। নিজের ভাগ্যের প্রতি। প্রচন্ড অসহায় লাগছে তার। এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে মানতে পারছে না সে। কিন্তু,এই দূর দেশে,জীবনের এমন কঠিন পরিস্থিতে কি-ই বা করবে সে এখন! পলকের এখন সব থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল তাকে। না জানি কত কিছু সহ্য করছে মেয়েটা। বিগত ৬ মাসে কম তো করেনি মেয়েটা তার জন্য। তার সব রাগ, অবহেলা সব কিছুকে ছাপিয়ে ভালোবেসেছে তাকে। মেন্টালি সাপোর্ট দিয়ে এসেছে। সব ঠিক থাকলে হয় তো অন্য কিছু ভাবতো না। পলকে যে করেই হোক নিজের করে নিতো। কিন্তু এখন নিজের লাইফ,ক্যারিয়ার, ফ্যামিলি সব কিছুকে আগে সেটেল করা দরকার। তারপর যা হওয়ার হবে।
এসব ভেবেই পলক আর নিজের ক্যারিয়ারের মাঝে সে বেছে নিল নিজের ক্যারিয়ারকে।

___________________________________

২ মাস পরে,

তোর ফ্যামিলির কি মাথা খারাপ হইছে রে সাজি? একটা এইট পাস ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে আর তুই সেইটা মেনে নিতেছিস? আর তিনু…সে জানে এসব কিছু?

_হ্যাঁ,,জানে। তার সাথে সব কথা হয়ে গেছে আমার।

_সব কথা হয়ে গেছে মানে? কি বলছে ও?

_He broke up.মুক্তি দিয়ে দিয়েছে সে আমায়।

_তোরা সব পাগল হয়ে গেছিস রে সাজি। দাঁড়া আমি তিনুর সাথে কথা বলতেছি।
_তোর কিছু বলার দরকার নেই। কথা হয়েছে আমার। তাছাড়া কাল বিয়ে। এখন আর কিছুই করার নেই। তিয়ানেরও কোন দোষ নেই। সে নিজের জন্য একটা ভালো লাইফ চুজ করেছে। সেখানে আমার মত মেয়েকে নিয়ে স্ট্রাগল করার কি দরকার বলতো। তবে হ্যাঁ , একটা কথা…জীবনে যত যাই হোক,সব কিছুর আগে পর আমরা বন্ধু থাকবো আজীবন।তুই আর তিয়ান আগে যেমন আমার প্রিয় বন্ধু ছিলি আজীবন তাই থাকবি। খুব ভালোবাসি রে তোদের। বলতে বলতেই কেঁদে দিল পলক।
বিথি হতভম্ব। কি বলবে বুঝে উঠতে পারেছে না। চুপ করে রইলো। একটুপর, চট করেই ডায়াল করলো তিয়ানের নাম্বারে। তিয়ান তখন অফিসে কাজ করছিল।বিথি বলেনি যে কলে পলকও কানেক্টেড ।কিন্তু, ফোনের লোকেশন মোড অন থাকায় তিয়ান ঠিকই বুঝে গেল সেটা।কম্পিউটারে কাজ করতে করতেই কল রিসিভ করলো সে। রিসিভ করতেই বিথি বললো,

_কাল সাজির বিয়ে তিনু!
_অহ! বলেনি তো আমাকে।
_বলে নাই মানে? তুই জানতি না সাজির বিয়ে ঠিক হইছে?
_হ্যাঁ,,শুনেছিলাম।ওর বাবা বিয়ে দিতে চাইছে ওকে। বিয়ে ফিক্স হয়েছে সেটা তো জানায়নি।
_তুই এত স্বাভাবিকভাবে কিভাবে কথা বলতেছিস তিনু?
_তো অস্বাভাবিকভাবে কথা বলবো নাকি? সকৌতুক হেসে বললো তিয়ান।
_তুই ভালোবাসিস না সাজি কে?
_নাহ।
_কিহ?!
_হ্যাঁ..সত্যি বলতে ওর প্রতি আমার এখন আর কোন ফিলিংস কাজ করে না। আমি না ভেবে দেখছি অনেক। পলক বিয়ের কথা বলার পরেও মনে হইছিল যে আমি ওকে হারায় ফেলতেছি। বাট, তারপর যখন সবটা ভাবলাম,মিলিয়ে দেখলাম তখন মনে হলো আমি ভুল করছি এতদিন। পলক কোন দিক থেকেই আমার যোগ্য না। না ওর ফ্যামিলি আর না ও। যে ফ্যামিলির মেয়ে বাড়ি ছেড়ে পালায় যায় তার ফ্যামিলি কতটা ভালো হইতে পারে ভেবে দেখ একবার!
_তিনু তুই…
_আমি ভেবেই বলতেছি বিথু। তাছাড়া,পলক দেখতেও খুব একটা সুন্দরী নয়। শ্যামলা, শুকনো।আমার আগের গার্লফ্রেন্ডগুলারেই মনে করে দেখ। এমন খারাপ চয়েজ কখনো ছিল আমার? পলকের বেলায় কিভাবে এই মিস্টেক হয়ে গেছে আমি এখনো ভেবে পাই না।আর ফ্যামিলিটাও কি! মিডিলক্লাস লেভেলের। আর আমার বাবা! কত বড় কোম্পানির ওনার! এখন সময় খারাপ যাচ্ছে মানছি বাট খুব দ্রুত আমি সবটা ঠিক করে নিবো। নিচ্ছিও ইন ফ্যাক্ট।
সো,,ওর সাথে আমার কি যায় বল?
_এটা তুই না তিনু! এটা তুই হইতে পারিস না। তুই আমার কথাটা একটু শোন দোস্ত। তুই যদি এখনো বলিস আ’ম শিওর সাজি কিছু একটা ম্যানেজ করে নিবে।বিয়েটা ও..
_করুক। That will be better for her. & be practical Bithu. I don’t love her. Then what for she will stop her? তাছাড়া আমি এখন যার সাথে লিভ টুগেদারে করছি.. Ayana…she is just so hot & amazing yrr. পলক তো আমাকে কিস পর্যন্ত করতে দেয়নি। আর আয়ানা…she is just…
_stop this tinu.It can’t be you.সাডেনলি তুই এতটা চেঞ্জ হইতে পারিস না। আমি..
_২ মাস অনেকটা সময় বিথু। আর আমি সব বুঝেই বলছি। যাকে ভালোবাসি না তাকে মিথ্যে আশা দিয়ে বসিয়ে রাখার মত এতটা খারাপও আমি নই। You know me..na! ok listen. I’m busy now. Talk to u later. bye sweeteart.

বিথিকে আর কিছু বলতে না দিয়েই কল কেটে দিল তিয়ান। কারণ এর থেকে বেশি বললে হয় তো ধরা পড়ে যেত সে। মিথ্য বলাটা জরুরি ছিল। অন্তত পলকে দূরে করার জন্য হলেও জরুরি ছিল এটা। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তিয়ানের বুক চিরে। আজ সে নিরুপায় হলেও কারও কাছে সারাজীবনের নামে প্রতারক হয়ে গেল।

বিথি আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না। পলকও কল ডিসকানেক্ট করে দিয়েছে কিছু না বলেই।
সব শোনার পর বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল তার। তবে তিয়ানকে সে এতটাই বিশ্বাস করতো যে তার কথাকে মিথ্যা বলেও মানতে পারেনি সে। নিজের প্রতি অবজ্ঞা,অবহেলা নিয়েই বিয়ের জন্য প্রস্তুত করলো নিজেকে।তবে ভাগ্যের চরম নির্মম পরিহাসের পাত্রী হয়ে বিয়েটাও আর হলো না তার।

________________________________

সেদিনের পর দীর্ঘদিন পলকের সাথে যোগাযোগ ছিল না তাদের কারও।নিজের সোশ্যাল আইডি ফোন নাম্বার সব চেঞ্জ করে ফেলেছিল সে। সাজিয়া মেহরিন থেকে আইডির নাম হলো মেঘ বন্দী আলো। তারা জানতো যে পলকের বিয়ে হয়ে গেছে। এভাবে কেটে যায় আরও দেড় বছর। বছর খানিক আইডি ডিএক্টিভ থাকায় পলকের সাথে যোগাযোগ ছিল না বিথির। তারপর যখন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এলো অনেকটাই একদিন আইডি একটিভ করলো পলক।ফেইসবুকে বিথিকে ফলো করার সুবাদে জানলো বিথির বিয়ে হয়ে গেছে। সেবারই প্রথম আবার নতুন করে সামনে এলো পলক। আবার যোগাযোগ শুরু হলো বিথির সাথে। বিথি জানলো সব। তিয়ানের আইডি আনফলো করে রেখেছিল পলক,যেন সে চোখের সামনে না আসে। মনে না পড়ে তাকে। বিথিও চেষ্টা করেনি তাদের মিল করানোর। তিয়ানকেও পরে সব বলেছিল বিথি।তিয়ান আগেই শুনেছিল পলকের বিয়েটা কার সাথে হচ্ছে। কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না তার। সব হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল ততোদিনে। পলক যেন একপ্রকার গায়েবই হয়ে গেছিল তাদের মাঝখান থেকে।

তারপর যখন আবার পেল,,,সাহস হয়নি তার পলকের সামনে যাওয়ার। কিছু বলার। দেশে ফিরেও যোগাযোগ করেনি পলকের সাথে।তবে ফেইসবুকে ফলো করতো তাকে রেগুলার। খুব একটা লাভ হতো না তাতে। পলক তেমন কোন কিছুই পোস্ট করতো না।এমনকি নিজের ছবিও না। প্রোফাইলে কেবল একটা মেঘলা দিনে রাস্তায় দাঁড়ানো একলা মেয়ের ছবি। কিছুদিন পরে সিফাত তাকে ট্যাগ করে এংগেইজড হওয়ার পোস্ট করলো,সেটা দেখে তিয়ানও কি ভেবে যেন ২’৫ বছর পর ব্লক খুলে ম্যাসেজ দিল তাকে।

তবে এসব কিছুর পরেও জীবন চলছিল তার নিজ গতিতে। পলকের বিয়ে ভাঙার পর আর গা’য়ের রঙ শ্যামলা হওয়াতে আরও ৮ টা সম্বোধন ভাঙে তার। পাত্র পক্ষ আসে। দেখে চলে যায়। বিয়ে আর হয় না। কিন্তু ভাগ্যচক্রে সেই পলকের জন্যই নিজ থেকে সম্বোধন নিয়ে আসে সিফাত ও তার পরিবার।

চলবে…

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_২৬
©জারিন তামান্না

তুমি ভালো আছো তো পলক?
_আলহামদুলিল্লাহ। অনেক ভালো আছি। তুমি সুখী তো?
_হ্যাঁ,,,সবকিছু হাতছাড়া হওয়ার পর নির্ঝঞ্ঝাট হয়ে গেছি একেবারে।সুখী না হয়ে যাই কই! তিয়ান নিজেই হাসলো নিজের কথায়। তা দেখে পলকও হাসলো খানিক নিঃশব্দেই। তারপর বললো,
_এখনো আয়ানার সাথেই আছো নাকি…
_আয়ানা বলতে কেউ কখনো ছিলই না,,এখন থাকার তো প্রশ্নই আসে না।
পলক হতবাক হয়ে গেল তিয়ানের এমন অকপট স্বীকারোক্তিতে। চট করেই প্রশ্ন করলো,
_তবে সেদিন যে বলেছিলে…
_অন্ধবিশ্বাস ভালো নয় পলক। বিশ্বাস যেমন অনেক কিছু পাইয়ে দিতে পারে তেমনি অনেক সময় অনেক কিছু খুইয়েও দিতে পারে। তাই বিশ্বাসের পিঠেও প্রশ্ন দাঁড় করাতে জানতে হয়। বলেই শুকনো হাসলো তিয়ান। আর পলক বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে তিয়ানের দিকে। তা দেখে আফসোস ভরা কন্ঠে তিয়ান বললো ,
_বড্ড দেরি করে ফেলেছি আমি,নাহ?ছেড়ে দিলেও একবার পেছন ফিরে দেখা উচিৎ ছিল।তাহলে হয় তো অন্তত…
_ভাগ্যের উপর কারো হাত থাকে না,তিয়ান। তবে ভাগ্যও পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আগে শেষ সুযোগ দেয় আমাদের।চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার। আমরাই শুধু সেই সুযোগ থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য পথে রাস্তা খুঁজে নেই। আমায় একলা ফেলে যাওয়া আমার সেই রাস্তাটা পার জীবনের নতুন মোড়ে পৌঁছে গেছি আমি। তুমিও আর থেমে থেকো না।
_বন্ধু তো আমরা আগের মতই আছি, তাই না?
_হ্যাঁ,,আর আজীবন থাকবো।” পবিতি গ্যাং” আজীবন একই সম্পর্কে আবদ্ধ থাকবে।
_ পলক, তিয়ান, বিথি = পবিতি, এখনো মনে রেখেছো তুমি এটা?বলেই খানিক সজোরে হাসলো তিয়ান। কলেজে ক্লাসমেটরা তাদের দলের নাম দিয়েছিল পবিতি। তারা তিনজন প্রায়সময় একসাথে থাকতো বলে বন্ধুরা মজা করে এই নাম দিয়েছিল।
আলতো করে হাসলো পলক।আজও তিয়ান মুগ্ধ হয়ে দেখলো সে হাসি।তারপর বললো,
_সিফাত ভাইয়া কবে ফিরছেন দেশে? বিয়ের ডেট কবে?
_এই তো আর ২ সপ্তাহ পরেই ফিরবেন। সিনিয়র পাইলট হিসেবে জয়েন করবে এসে। জয়েনিং এর পরেএকমাসের আগে তো ছুটি পাবেন না। তাই বিয়েটা নেক্সট ইয়ার ফেব্রুয়ারিতেই হচ্ছে। ২১ তারিখ।
_অহ,আচ্ছা। বেশ ভালো মনের মানুষ সে। প্রথমবার দেখেই ভালো লেগেছিল আমার।
_হ্যাঁ।
_সুখী হবে তুমি।
_তা জানি না। সেটা সম্পূর্ণ ভাগ্যের ব্যাপার। তবে,এটুকু জানি যে, আমার রূপ,রঙ, অতীত সবটা জেনে বুঝেই আমাকে গ্রহণ করছেন উনি,,পরবর্তীতে ভুল বলে অবজ্ঞা অন্তত করবেন না।
পলকের কথাটার অর্থ বেশ ভালো করেই ধরতে পারলো তিয়ান। মেয়েটা আজও অভিমান করে আছে তার উপর। শুকনো হাসলো সে। কারণ এর বিপরীতে কিছু বলার ক্ষমতা তার নেই আজ। তারপর, প্রশ্ন করলো পলককে।
_অতীতের সবটাই জানে তাহলে?
তিয়ান যে এই প্রশ্নের দ্বারা তাদের সম্পর্কের বিষয়টাকে বুঝিয়েছে সেটা পলক বেশ বুঝতে পারলো। সিফাত জানে না তিয়ানের আর তার অতীতটা।বলেনি সে। তবুও,সে মিথ্যা বললো তিয়ানকে,
_হু,,সবটাই জানে।
তিয়ান আর কিছুই বললো না এরপরে।সিফাত যখন সবটাই জানে এবং তারপরেও তিয়ানকে দেখেও কোন মিস বিহেভ বা আপত্তি করেনি তখন এই মানুষটার মনটা সত্যিই ভালো।সুখী হবে তার পলক এই মানুষটার সাথে। মনে মনে এসব ভাবতেই একটা প্রশ্ন উঠলো তার মনে,”তার পলক?! পলক কি আর তার আছে এখনো?” নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো তিয়ান। কিন্তু,উত্তর পাওয়ার কোন চেষ্টা সে করলো না। মনকে প্রবোধ দিল সে, সব প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি নয় সবসময়!
___________________________________

এক সপ্তাহ পর,

দুপুর বেলায় বাসায় ফিরতেই স্টাডি টেবিলের উপর একটা খাম দেখতে পেলো পলক। কৌতুহলী হয়ে খামটা হাতে নিতেই অবাক হয়ে গেল সে। সিফাত পাঠিয়েছে। দ্রুত হাতে খামটা খুলতেই একটা ভাজ করা কাগজ পেল । কাজটার ভাজ খুলতেই মুচকি হাসলো পলক। চিঠি লিখেছে সিফাত তাকে। আমজাদ আলীর অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর প্রায় দিন সময় পেলেই একবার দুবার কল করে সিফাত। মাঝে মাঝে ফ্রি থাকলে ভিডিও কল দিয়ে গম্ভীর নয়নে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে পলকের দিকে। কিন্তু কিছু বলেনা । তারপর,১/২ মিনিট পরে কল কেটে দিয়ে টেক্সট করে, “নিজের খেয়াল রাখবেন।Bye.” প্রতিবারই এক কাহিনী। প্রথম প্রথম আজব লাগতো পলকের কাছে ব্যাপারটা। তাই একবার জিজ্ঞেসও করেছিল সিফাতকে, এমন কেন করে সে? জবাবে সে কেবল বলেছিল,

_পদ্মপাতার জলের মত টলটলে ও মুখখানা দেখে আমি কেবল আমার চোখের তেষ্টাটুকু মিটাই,মৃন্ময়ী! এই নিয়ে আপনার কোন আপত্তি থাকলেও সেটা আমি মানতে চাই না। আর কথার শব্দ বাক্য তাতে ব্যাঘাত ঘটায় & নিজের কাজে ডিসার্টবেন্স মোটেও পছন্দ নয় ল। U know that right? তবে জানেন,বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ভয়ও লাগে আবার।
_ কেন? অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল পলক।
_যদি নেশা লেগে যায়।টাল হারিয়ে ফেলি! তখন এই দূর দেশে কে উদ্ধার করবে আমাকে বলুন তো?! বলেই সকৌতুক হেসেছিল সিফাত।
তবে, সিফাতের এমন অধিকারবোধের আগে পরে আর কোন কিছুই বলতে পারেনি পলক সেদিন। মানুষটার এইসব ছোট খাটো পাগলামি, শক্তপোক্ত অধিকারবোধগুলো যে তারও ভালো লাগে আজকাল।তাই লজ্জা, অস্বস্তি লাগলেও চুপচাপ বসে থাকতে হয় তাকে ক্যামেরার সামনে।

কিন্তু,এত কিছুর পরেও এই যুগে এসেও দূর দেশ থেকে এভাবে কেউ চিঠি লিখতে পারে এটা ভেবেই আশ্চর্য হয়েছিল পলক। তবে,সিফাতের এই কাজটা বেশ ভালোও লেগেছে তার। তাই দেরি না করে চটপট পড়তে শুরু করলো সে চিঠিটা । চিঠিতে লেখা,

প্রিয় মৃন্ময়ী,
আসসালামু আলাইকু। কেমন আছেন আপনি? আর বাকি সবাই?
অবাক লাগছে না? রোজ কথা হওয়ার পরেও,আপনাকে দেখতে পাওয়ার পরেও,সব সময় সব জেনেও পুরোনো দিনের মানুষদের মত চিঠি কেন লিখছি? সত্যি বলতে অবাক আমারও লাগছে। কিঞ্চিৎ লজ্জাও লাগছে কেন জানি। এইই…হাসবেন না কিন্তু আমার কথা শুনে।আপনার থেকে কিছু লুকাতে ইচ্ছে করে না তাই বলে দিলাম চিঠি লেখার অনুভূতিগুলোও।এর আগে কখনো কাউকে চিঠি লিখিনি আমি। প্রয়োজন পড়েনি কখনো। আজও কোন প্রয়োজনে লিখছি না। তবে কেন লিখছি সেটাও সঠিক জানা নেই আমার।শুধু ইচ্ছে হলো,জীবনে প্রেম না করেও প্রেমিক পুরুষ হয়ে নিজের প্রেমিকাকে একটা চিঠি লিখার। তবে,আপনি তো আমার প্রেমিকা নন। তাই চিঠিটাও আমি নিজের হবু স্ত্রীকে লিখছি।আচ্ছা,প্রেমিকার বদলে হবু স্ত্রীকে লিখলেও কি প্রেম পত্র বলা হবে এটাকে? হলেও মন্দ হবে না, তাই না?হা..হা..হা..

এখন মধ্যরাত এখানে।ঘুম আসছে তবুও।একটু আগেই কথা হয়েছে আপনার সাথে। তবুও খুব করে মিস করছি আপনাকে।তাই বিশেষ কোন কাজ না পেয়ে এই চিঠি লেখা। কিন্তু,প্রেম পত্র কিভাবে লিখে সেটা তো জানা নেই আমার।তার উপর আপনার সাথে আমার বিয়েটাও এরেঞ্জম্যারেজ। চেনা জানা নেই আমাদের খুব একটা।প্রেম তো অনেক পরের কথা।তবে বাস্তবিক অর্থে বিয়ের পরেও হয়তো কোনদিন আপনার প্রেমিক পুরুষ হয়ে ওঠা হবে না আমার।এসবে আমার বিদ্যাবুদ্ধি একেবারেই শূন্যের কোঠায়। বিয়ের পর স্বামী হিসেবে কেমন হবো,কতটা যোগ্য হয়ে উঠতে পারবো আপনার সেটাও জানি না আমি। তবে,নিজের জন্য খুব করে চাই আপনাকে। চেষ্টা করবো নিজের সমস্তটা দিয়ে আপনাকে সুখী করার।

জীবনে প্রথম কোন নারীকে এভাবে চাইছি নিজের জন্য। যার সমস্তটা জুড়ে আমি থাকবো আর আমার সমস্তটা জুড়ে থাকবে সে। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার রোজকার আর্জি এই চাওয়াটাই যেন আমার চিরস্থায়ী আর শেষ চাওয়া হয়। আমার সমস্তটা জুড়ে আপনাকে চাই মৃন্ময়ী। হবেন তো আপনি আমার?

এটুকুই থাক আজ। আর কিছু লিখতে পারছিনা। এই চিঠির বদলে কোন ফিরতি চিঠি পাবো না জানি। তবুও, চিঠিটা পাঠিয়েছি আপনাকে। ইন শা আল্লাহ খুব শিঘ্রই ফিরে আসবো আমি।আপনাকে নিজের করে নেবো সারাজীবনের জন্য। আপেক্ষায় থাকবেন বলেছেন, আপেক্ষায় থাকবো আমিও। মৃন্ময়ীর ‘প্রিয়’ হওয়ার!

নিজের খেয়াল রাখবেন। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
সিফাত

চিঠিটা পড়ে কতক্ষণ চুপ করে বসে রইলো পলক। মনের ভেতর কিসব অনুভূতিরা যেন খুব জোর আনাগোনা করছে। ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। কেবল,চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজতেই দু’ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো চোখের কার্ণিশ বেয়ে। এ নোনাজল বরাবরের মতোই উষ্ণ, স্বচ্ছ,আর তেতো জল হলেও সে জলের উষ্ণতা আজ গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিল পলককে। সে জলের স্বচ্ছতা অদ্ভুত এক স্বস্তিতে জড়িয়ে নিল তাকে। পরম এক সুখানুভূতিতে আবিষ্ট হলো পলকের সমস্ত স্বত্তা।

____________________________________
কয়েকদিন পর,

ট্রেনিং শেষে সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরেছে সিফাত। রুমের চাবি নিতে গেলে রিসিপশনিস্ট মেয়েটি বললো, তার জন্য একটি চিঠি এসেছে বাংলাদেশ থেকে। তার ট্রেনিং শেষ হতে আর ২ দিন বাকি। তারপর, অফিসিয়াল পার্টি আর বাকি সব ফর্মালিটিজ শেষ করে নেক্সট উইকেই সে দেশে ফিরে যাচ্ছে। এরমধ্যে তার জন্য বাংলাদেশ থেকে কেউ চিঠি পাঠিয়েছে শুনে বেশ চমকালো সে।তবে,বাইরে সেটা প্রকাশ না করে চিঠি আর চাবি নিয়ে লিফটের দিকে পা বাড়ালো ।লিফটে ঢুকে খামটা ভালো করে দেখলো সে। প্রেরকের কোন নাম নেই খামের উপর। একবার ভাবলো পলক পাঠিয়েছে বোধয়। সে চিঠি পাঠানোর পর তো আর কথা বলার সুযোগ হয়নি পলকের সাথে। প্র্যাকটিকাল এক্সামের বিগত কয়েকটা এর জন্য রাত দিন প্রায় বাইরেই কেটেছে তার। তাই লাস্ট ৩ দিনে একটুও কথা বলার সুযোগ হয়নি তার। এতসব ভাবতে ভাবতেই লিফট এসে থামলো তার ফ্লোরে। রুমে গিয়ে বিছানায় বসে দ্রুত হাতে খাম খুলে বের করলো চিঠিটা। চিঠি খোলামাত্রই তার আর বুঝতে বাকি রইলো না এটা তার মৃন্ময়ীর চিঠি। খুশিতে ঝলমল করে উঠলো তার চোখ মুখ।কিন্তু, মূহুর্তেই আবার চুপসেও গেল। চিঠিতে তেমন কিছুই লেখা নেই। আর না আছে কোন সম্বোধন। সরাসরি তিন লাইনের একটা চিঠি।সেখানে লিখা,

আসসালামু আলাইকুম।

আপনার হবার অপেক্ষায় থাকবে মৃন্ময়ী!

নিজের খেয়াল রাখবেন।সাবধানে ফিরে আসবেন।

ইতি
মৃন্ময়ী

মেজাজ খারাপ হচ্ছে সিফাতের। এই তিন লাইনের জন্য চিঠি লিখে এত দূর দেশে পাঠানোর কি ছিল? আর কিছু কি বলতে পারতো না সে? আজব!

আরও কয়েকবার পড়লো সে চিঠিটা। আর যতবার সে পড়ছে চিঠিটা মেঘ কাটানো রোদ্দুরের মত একটা অন্যরকম সুখানুভূতি একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে তার মনের কোণায় কোণায়। মৃন্ময়ী তার হবার অপেক্ষায় থাকবে আর কি চাই তার!

শেষবারের মত আরেকবার চিঠিটা পড়ে তাতে চুমু খেলো একটা। তারপর লজ্জা পেয়ে মৃদু হাসলো সে তার এহেন বোকা কাজে।প্রেমে পড়লে বুঝি মানুষ এমনই বোকা বোকা কাজ করে?কিংবা তীব্র ভালোবাসায়? জানা নেই তার।এরপর, আলতো হাতে ভাঁজ করে চিঠিটা সযত্নে রেখে দিল ওয়ালেটের এক কোণায়।

____________________________________

৩৫ দিন পরে আজ আবার নিজের দেশের মাটিতে ফিরে এলো সিফাত। কিন্তু, পলককে জানায়নি এ কথা। চিঠি পাওয়ার পর থেকে একবারও সে যোগাযোগ করেনি তার সাথে। পলকও নিজ থেকে কখনো কল করে না। তার নাকি লজ্জা লাগে। কিন্তু,সিফাতের কথাও তার মনে পড়ে। মিস করে তাকে। তবুও আগ বাড়িয়ে কথা বলেনা কখনো।কিন্তু,এসবের মাঝে নিশাতের সাথে ঠিকই যোগাযোগ রেখেছে সিফাত। আমজাদ আলী ও তাদের নিয়মিত খোঁজ খবর নিয়েছে। সে আজ ফিরছে এটা নিশাত জানলেও পলকে বলতে মানা করেছে। এদিকে পলকও জানে না ঠিক কবে নাগাদ ফিরবে সিফাত।সিফাত তার চিঠি পেয়েছে কি পায়নি সেটা নিয়েও একটা চিন্তা রয়ে গেছে তার মনে। সব মিলিয়ে তার বেশ অভিমান হয়েছে সিফাতের প্রতি। মানুষটা কি এক্কেবারেই ভুলে গেল তাকে? কিন্তু,মুখ ফুঁটে জিজ্ঞেস করার মত সাহসও নেই তার। লজ্জা লাগে বলেই কল বা ম্যাসেজ করে না নিজে থেকে।
_________________________________

পরেরদিন বিকেলে,

ডিসেম্বরের শেষ দিকে বেশ ভালোই শীত পড়েছে। পলকের স্কুলে শীতকালীন ছুটি চলছে।আজকাল তাই বেশ খালি সময় কাটাচ্ছে পলক। আসরের নামায পড়ে ছাদে হাঁটাহাটি করতে এসেছিল সে। দিনের শেষভাগে এসে সূর্যটাও তার লাল আভা ছড়িয়ে বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে কানে গুঁজে রাখা হেডফোনে গান শুনছিল সে।মন খারাপ তার। আজ প্রায় ৯ দিন সিফাতের সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। এদিকে যে মানুষটার সাথেই তার বিয়ের প্রস্তুতি নিয়ে মেতে আছে সবাই। অথচ, স্বয়ং ওই মানুষটারই কোন খবর নেই।এসব ভেবেই মন বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে তার। ছাদের কার্নিশে রাখা কফি মগের হ্যান্ডেলটা শক্ত হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। ঠিক সেই সময় আচমকা সে হাতের উপর অন্য কারও স্পর্শ পেয়ে চমকে পাশ ফিরে চাইলো পলক। আর মূহুর্তেই তার সমস্ত শরীর জুড়ে খেলে গেলো কনকনে শীতের চাইতেও হিমশীতল এক শিহরণ।এতক্ষণে তার হাতের বাঁধনে নিজের আঙুল গুঁজে কফির মগটা ছাড়িয়ে নিজ হাতে নিয়ে নিয়েছে ব্যক্তিটি।পলকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নির্দ্বিধায় চুমুক দিল পলকের চুমুক দেওয়া কফির মগে। কফি টেস্ট করতে করতে বললো,
এর থেকে কিছুটা স্ট্রং কফি খাওয়ার অভ্যাস করুন।বিয়ের পরে এভাবেই রোজ একমগে দুজনের কফির ভাগ থাকবে আমাদের। কখনো সূর্য উঠা ভোর দেখায় সময় কিংবা সূর্য ডুবির গোধূলি বেলায়। মনে থাকবে? বলেই পলকের চোখের দিকে তাকিয়ে কফির মগে আরেকটা চুমুক দিল সিফাত।

পলক বিস্মিত। সিফাত দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখলো সে সিফাতকে। চকলেট কালার পলিশড সুজ,ব্লু জিন্স, আর মেরুণ টি শার্টের সাথে চকলেট কালারের লেদার জ্যাকেট। ক্লিনসেভ করা। চুলগুলো এক সাইডে ব্রাশ করা। এতদিন বিদেশে থেকে এসে যেন আরও যেন আরও বেশি সুন্দর হয়ে গেছে সে। পলক মুগ্ধ হয়ে দেখলো তাকে। সেই মুগ্ধতার ছাপ ফুঁটে উঠলো তার উজ্জ্বল চোখে মুখে ‘ আর ঠোঁটের কোণে জড়ো হওয়া মৃদু হাসিতে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে সিফাত দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। বিশ্বাস করার জন্য তাকে একবার ছুঁয়ে দেখবে বলে তার গাল অবদি হাত বাঁড়িয়েও গুটিয়ে নিল সেটা। সিফাত চুপচাপ দেখছে পলকের বিস্ময়,বিভ্রান্ত চোখের দৃষ্টি। মুখে ফুঁটে ওঠা খুশি,মনের চঞ্চলতা আর এসব বাচ্চা বাচ্চা কান্ডকারখানা। কিন্তু কিছু বলছে না। কফির মগ হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরে সিফাত খেয়াল করলো,পলকের বিভ্রান্ত চোখজোড়া ধীরে ধীরে টলমলে হয়ে উঠছে। তা দেখে বেশ অবাক হলো সে। মৃন্ময়ী কি জন্য কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে সেটা ভেবে পেল না সে। কিন্তু,সব ভাবনা সাইডে করে কফির মগটা কার্ণিশের উপর রেখলো সে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে কাছাকাছি হয়ে দাঁড়ালো পলকের সামনে। তারপর আলতো করে তার দুহাত পলকের দু কাঁধে রেখে মৃদু হেসে বললো,
_মৃন্ময়ীর অপেক্ষা শেষ হবার পথে। ফিরে এসেছি আমি। আমার মৃন্ময়ীকে নিজের করে নিতে। এবারে বাকি অপেক্ষার সময়টুকুও পার করে দেবো আমরা,কেমন?

পলক মুখে কিছু বললো না। শুধু চোখ বুজে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। সিফাত হাসছে তাকে দেখে। মৃন্ময়ীর চোখের জলে আনন্দ ছলকে পড়ছে।সেটা বেশ ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছে সে। হাত বাড়িয়ে পলকের চোখ মুছতে গিয়েও মুছলো না। এই ভেজা চোখ মুখটায় অন্য রকম সুন্দর লাগছে পলককে। ভালো লাগছে তাকে এভাবে দেখতে। এবারে তাকে ছেড়ে তার থেকে কিছুটা সরে দাঁড়ালো। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করলো,
_কেমন আছেন মৃন্ময়ী?
_ভালো আছি এখন। আপনি?
_আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।
_কবে ফিরেছেন আপনি? আর এতগুলো দিন একটা ফোন অবদি করেননি আপনি।কেন?
_গতকাল রাতে ফিরেছি। মৃণ্ময়ীর অপেক্ষাটা নিজ চোখে দেখবো বলে জানায়নি কিছু। কেন,মিস করেছেন আমায়?
_নাহ। আমি মিস করতে যাবো কেন! অভিমানী সুরে বললো পলক।
_অহ,আচ্ছা। সেই জন্যই বোধয় একটা ফোনকল দূরে থাক ম্যাসেজও করেননি আপনি আমাকে। অভিযোগের সুরে বললো সিফাত।সেটা শুনে দ্রুত গলায় সাফাই দেওয়ার মত করে হরবড়িয়ে পলক বললো,
_এই না…সে জন্য না।আমি তো মিস করেছি। অপেক্ষা করেছি আপনার কলের কিন্তু লজ্জায়..এটুকু বলতেই জিভ কাটলো পলক। নিজের অজান্তেই সত্যি বলে দিচ্ছিল সে! লজ্জায় চোখ বুজে মাথা নিচু করে রইলো পলক। সেটা দেখে নিঃশব্দেই হাসলো সিফাত। তারপর ঝরঝরে গলায় বললো,
_নীচে চলুন। অপেক্ষা করছে সবাই।
_সবাই মানে?
_আমার ফ্যামিলিও এসেছে সাথে। বিয়ের আগে একা একা শশুড়বাড়ি চলে আসাটা কেমন জানি দেখায় না!তাই আর কি..বলেই সকৌতুক হাসলো সিফাত। পলকও হাসলো। তারপর, তারা দুজনেই নেমে গেল ছাদ থেকে।

____________________________________

বাসায় আসতেই পলকে দেখে ছুটে এসে জাপটে ধরলো ইয়ানা। পলকও আদর করে কাছে টেনে নিল তাকে। ড্রয়িংরুমের বিছানায় দাদার সাথে বসে ছিল প্রাপ্তি। ইয়ানাকে ওভাবে আদর করতে দেখে হুট করেই কেঁদে উঠলো প্রাপ্তি। বিগত ২০ দিনে বেশ ভালো রকম ভক্ত হয়ে গেছে সে পলকের। নিশাতের থেকেও বেশি পলকের কাছে থাকতে পছন্দ করে সে। রাতে অবশ্য বাবার কাছেই ঘুমায় সে।তাই তার ফুপ্পির ভালোবাসার ভাগাভাগিটা একদমই পছন্দ হচ্ছে না তার। হাত বাড়িয়ে দিয়ে পুপ্পি পুপ্পি বলে কান্না জুড়ে দিল সে। তা দেখে ইয়ানা হতভম্ব। সে বুঝতে পারলো না একটু আগেও তার সাথে খেলতে থাকা হাসি খুশি প্রাপ্তি আচমকা কেন কাঁদছে। পলক ইয়ানাকে ছেড়ে দ্রুত গিয়ে কোলে তুলে নিল প্রাপ্তিকে। পলকের কোলে যেতেই তার ঘাঁড়ে মুখ গুঁজেই শান্ত হয়ে রইলো প্রাপ্তি। তা দেখে ইয়ানা আরও বেশি বোকা বনে গেল। সিফাতের কাছে গিয়ে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বললো,
_পাপাই, মামণি কি এখন আর আদর করবে না আমাকে? সব আদর প্রাপ্তিকেই দিয়ে দিবে?

ইয়ানার অবস্থা দেখে বেশ হাসি পেল সিফাতের। বাচ্চারাও ভালোবাসার মানুষ নিয়ে কত ইনসিকিউর ফিল করে। কিন্তু,ছোট্ট ইয়ানার করুন মুখ দেখে হাসি চেপে গেল সে। ইয়ানাকে কোলে নিয়ে বুঝিয়ে বললো,
_তুমি যেমন আমার মেয়ে লাগো,আমি তোমাকে ভালোবাসি,তেমনি প্রাপ্তিও তোমার মামণির মেয়ে লাগে। তোমার মামণিও তাকে ভালোবাসে। আর তোমার মামণি যেমন তোমাকে ভালোবাসে,,তেমনি তোমার পাপাইও ওকে ভালোবাসে। তাহলে,সেই হিসেবে প্রাপ্তি তোমার বোন হলো।তুমিও ওকে ভালোবাসবে,ওকে?
_ওকে পাপাই। কিন্তু মামণি..?
_মা বাবার ভালোবাসা কখনো ভাগাভাগি হয় না আম্মু। তোমার আম্মু তোমাকে আর প্রাপ্তিকে,,দুজনকেই খুব ভালোবাসে।কিন্তু,প্রাপ্তি তো এখন একটু ছোট তাই সেটা বুঝতে পারেনি। তাই এভাবে কেঁদেছে। কিন্তু তুমি তো বড় ওর থেকে,বুঝো। তাই তুমি একটুও মন খারাপ করবে না। আর তুমিও যদি প্রাপ্তিকে ভালোবাসো আদর করো,তাহলে সেও আর কখনো কাঁদবে না এভাবে। বুঝতে পেরেছো?
_হ্যাঁ,পাপাই। আমি বুঝতে পেরেছি।
_এই তো আমার লক্ষী আম্মুটা।বলেই ইয়ানাকে আদর করে দিল সিফাত।
সিফাতের কথা শেষ হতেই ইয়ানা ওর আম্মুর কাছে গেল। রুকুর ব্যাগ থেকে একটা চকলেট নিয়ে ছুটে গেল পলকের কাছে। ইশারায় প্রাপ্তিকে দেখিয়ে বললো,ওকে নীচে নামাতে। প্রাপ্তি কিছুতেই পলককে ছাড়বে না। তাই পলক তার কোলে নিয়ে বসালো প্রাপ্তিকে। প্রাপ্তিকে পেয়ে হাতের চকলেটটা বাড়িয়ে দিল ইয়ানা তার দিকে। তারপর তার মিষ্টি মিষ্টি গলায় বললো,
_এই নাও প্রাপ্তি,এটা তোমার জন্য। পাপাই বলেছে তুমি আমার বোন হও। আর মা বাবার ভালোবাসার কখনো ভাগাভাগি হয় না। তাই মামণি তোমাকে যেমন ভালোবাসে তেমনি আমাকেও ভালোবাসে। তুমি একদম কেঁদো না এর জন্য। আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসবো। পাপাইও তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তুমি আর কেঁদো বোনু। চলো আমরা খেলি। বলেই হাত বাড়িয়ে দিল প্রাপ্তির দিকে। ছোট্ট প্রাপ্তি কি বুঝলো সেই জানে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে শুনছিল সে ইয়ানার কথাগুলো।আর ইয়ানা হাত বাড়িয়ে দিতেই সেও চকলেটটা নিয়ে ইয়ানার হাত ধরে পলকের কোল থেকে নেমে গেল। পলক মুগ্ধ হয়ে দেখলো ইয়ানাকে। কি ভীষণ বোঝদার মেয়ে। প্রাপ্তিকে কি সুন্দর নিজের বোন বলছে। আদর করছে। ভীষণ স্বস্তি লাগছে তার। এরপর সিফাতের দিকে চাইতেই চোখাচোখি হয়ে গেল দুজনের। মুচকি হেসে ইশারায় তাকে কৃতজ্ঞতা জানালো তাকে। সিফাতও চোখের ইশারায় আস্বস্ত করলো তাকে।

ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে এই পুরো ঘটনাটা দেখলো আরও একজন মানুষ। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করলো তার বোনের জন্য এমন একটা জীবনসঙ্গী দেওয়ার জন্য। পলাশকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো সিফাত। সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো নিজ থেকেই। তারপর তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল নিজের পরিবারের সবাইকেও। আজ সবার সাথে রুকুর বর দিহানও এসেছে। পলকের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিল তার। রুকুর মতই আন্তরিক ব্যবহার দিহানেরও। এমন একটা পরিবারে বোনকে দিতে পেরে বেশ স্বস্তি পেল পলাশ।

পলাশ সিফাতের দুবছরের ছোট। কিন্তু তারপরেও সিফাত বারবার পলাশকে ভাইয়া আর আপনি বলে সম্বোধন করায় সে বললো,
_আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকতে পারেন। আর বয়সে আপনার ছোট আমি। তুমি করেই বলুন আমায়।
_বয়স নিয়ে খোটা দিচ্ছেন শালাসাহেব? করুন মুখ করে বললো সিফাত।
_আরেএ না…আপনি ভুল বুঝছেন। আমি সেভাবে বলিনি। আসলে…বিচলিত হয়ে বললো পলাশ।তা দেখে সিফাত হেসে দিলো। সেটা দেখে বিভ্রান্তিতে পড়লো পলাশ। তাকে ওমন বিভ্রান্ত হতে দেখে হাসি মুখেই সিফাত বললো,
_বয়স যাই হোক। সম্পর্কে আপনি মৃন্ময়ীর বড় ভাই। আর সেই সুবাদে আমারও। তাই আপনাকে ভাইয়া বলেই ডাকবো আমি। আপনি আপত্তি করলেও কিন্তু শুনছিনা আমি।
সিফাতের এহেন অধিকারবোধ আর আন্তরিক ব্যবহার বেশ মুগ্ধ করলো পলাশকে। একগাল হেসে দিয়ে সেও বললো,
তাহলে আমিও কিন্তু আপনাকে ভাইয়া বলেই ডাকবো।
_আপনার যেটা ভালো লাগবে সেটা বলেই ডাকবেন আমায়।কোন সমস্যা নেই তাতে। বলেই তার ভুবন ভুলানো হাসিখানা হাসলো সিফাত।

ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে সে হাসি দেখলো পলক। মনে মনে বললো,আলহামদুলিল্লাহ।

____________________________________

সিফাত ইউ এস এ থেকে একগাদা শপিং করে এনেছে সবার জন্য।।বাদ যায়নি পলকের ফ্যামিলিও। সেসব সিফাত নিজ হাতে যার যারটা তার তার হাতে তুলে দিয়েছে। আমজাদ আলী সেসব নিতে সংকোচ করলেও সিফাত যখন বললো,
আপনার মেয়ে দিলে তো ঠিকই নিতেন। তাহলে আপনার মেয়ে যাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে নিচ্ছে তাকে কেন পর ভাবছেন? সে কি আপনাদের নিজের হবে না? আমি কি আপনার পরিবারের সদস্য হই না বাবা?
সিফাতের মুখে বাবা ডাক শুনে ও তার এত আন্তরিকতা দেখে সিফাতের উপহারগুলোকে আর উপেক্ষা করতে পারলেন না তিনি। সিফাতের মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন তাকে।

সবাইকে তাদের উপহার বুঝিয়ে দিলেও পলককে কিছুই দিল না সিফাত। ব্যাপারটা সবার নজরে এলেও কেউ কিছুই বললো না সেখানে।সন্ধ্যার পর পর বিদায় নিয়ে ফিরে গেল সিফাত ও তার পুরো পরিবার।

____________________________________

কালো রঙের জর্জেট একটা শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছে পলক। বেশ পাতলা শাড়িটা। শাড়ির সাথে থাকা ক্যাটালগ দেখেই লজ্জায় তার মরি মরি অবস্থা।ডীপ কাটিং নেকের স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে ডিজাইন করা হয়েছে শাড়িটা। এইভাবে এই শাড়ি সে কিভাবে পড়বে কখনো সেটা ভেবেই লজ্জায় অস্বস্তিতে একাকার হয়ে যাচ্ছে পলক। তারওপর সিফাত এই শাড়িটা তার জন্য এনেছে সেজন্য রাগে,লজ্জায় আরও খারাপ অবস্থায় তার। মনে মনে একগাদা বকাঝকা করা হয়ে গেছে তার সিফাতকে। পলক জাস্ট ভেবেই পাচ্ছে না,সিফাতের মত ডিসেন্ট, ম্যাচিউর একটা ছেলে এমন একটা শাড়ি তাকে কিভাবে দিতে পারে! কতক্ষণ শাড়িটা হাতে নিয়ে ঝিম মেরে বসে রইলো। তারপর রাগ বিরক্তি নিয়েই শাড়িটা বিছানার একপাশে রেখে হাত বাড়ালো পরের শপিং ব্যাগের দিকে। ওটা হাতে নিতেই তাতে একটা জুয়েলারি বক্স দেখতে পেল পলক। গোল্ড আর ডায়মন্ডের সুন্দর দুটো নাকফুল দিয়েছে সিফাত। আর সাথে একটা চিরকুট। তাতে লিখা,

সবার সামনে আপনাকে নিজ হাতে এসব দিতে কেমন যেন লাগছিল আমার। তাই আগেই ছোট আপুর হাতে আপনার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি। এরজন্য কিছু মনে করবেন না প্লিজ।

নাকফুল খুব মানায় আপনাকে।এ দুটো দেখেই ভালো লেগেছে খুব, তাই দুটোই নিয়ে এসেছি আপনার জন্য।

আর হ্যাঁ,,একটা ইম্পর্টেন্ট কথা! ক্যাটালগে দেওয়া শাড়ির ব্লাউজটা আমার মোটেও ভালো লাগেনি। ভুলেও এই ধরণের কোন ডিজাইনের কিছু কখনই পড়বেন না আপনি। কড়া নিষেধ রইলো আমার। তবে আমি খুব করে চাই এই শাড়িটায় আপনাকে দেখতে। অপেক্ষায় থাকবো,কালোর আদলে জড়ানো আমার মায়াবতী মৃন্ময়ীকে দেখার!

সিফাত।

এবারেও একগাদা বকাঝকা করলো পলক। তবে এবারে সেটা সিফাতকে নয়, নিজেকে। না জেনে বুঝে আবারও ভুল বুঝেছিল এই মানুষটাকে সে। নিশু ঠিকই বলে, ভাবনার চরকা তার এক সুতো বেশিই টানে সবসময়। যার জন্য সোজা জিনিসেও জট লাগিয়ে ফেলে সে। নিজেকে বকাঝকার পর্ব শেষ করে ফোনটা হাতে নিল পলক।সিফাতের ইনবক্সে ছোট্ট ম্যাসেজ করে লিখলো, ধন্যবাদ!
সাথে সাথেই সিফাতের রিপ্লাই এলো,
আবদারটুকু পূরণ হলেই ধন্যবাদ গ্রহণযোগ্য হবে।তার আগে নয়।
সিফাতের ম্যাসেজ দেখে আপন মনেই হেসে দিল পলক। মানুষটাও মাঝে মাঝে কেমন যেন বাচ্চা বনে যায়। চিঠিতে আদেশ দিয়ে এখন আবদার বলছে।
এরপর ঝটপট সব গুছিয়ে রাখলো সে।মনে মনে ঠিক করলো,,কালই যাবে এই শাড়ির ব্লাউজ বানাতে দিবে সে।ফুল স্লিভের লং ব্লাউজ।তারপর, ক্যাটালগটা নিয়ে ছিড়েছুড়ে ওয়েস্টবিনে ফেলে দিল সে।এবার শান্তি লাগছে তার।যত দোষ তো সব এই ক্যাটালগেরই ছিল যার জন্য আজ আবারও…এসব ভেবে নিজের কান্ডে এবার নিজেই হেসে ফেললো পলক। এত বার ভুল করেও শিক্ষা হয় না তার,,,নিজের দোষে ভুল বোঝে মানুষটাকে বারেবার।আর এবারের পর মনে মনে সত্যিই প্রতিজ্ঞা করলো সে,,,এরপর আর কখনো না বুঝে মানুষটাকে নিয়ে ভুলভাল কিছু ভাববে না সে।

চলবে…